Page 024

আবির্ভাব


“ভজ মন! হরি হর অভেদাত্মনে।চরণে শরণে ভয় নাই মরণে।।”( কবি রসরাজ)

বার শ’ তিপান্ন সাল ফাল্গুনী পূর্ণিমা।

অবতীর্ণ গুরুচাঁদ অপার মহিমা।।

Page 025 start

দোল পূর্ণিমার তিথি হোলির বাসর।

ফাগে ফাগে রাঙা হ’ল দিগ দিগন্তর।।

ফাগেতে রঞ্জিত রবি উঠে পূর্ব ভিতে।

হরি বলে ভক্ত দলে লাগিল নাচিতে।।

মহাপ্রভু হরিচাঁদ বসিয়া প্রাঙ্গণে।

প্রভুকে সাজাল যত ভক্ত নারীগণে।।

চরণে করিল কেহ ফাগের লেপন।

কুসুমের দলে করে মস্তক বন্ধন।।

কপোলে, কপালে দিল রক্ত ফাগরেখা।

করতলে দিল ফাগ রক্ত চন্দ্রলেখা।।

চন্দন বাটিয়া করে শ্রীঅঙ্গে লেপন।

হুলু ধ্বনি হরি ধ্বনি মঙ্গলাচরণ।।

উভ করি বাঁধে কেহ শিরেতে কবরী।

বিন্দু বিন্দু ফাগ দেয় তাহার উপরি।।

ধূপ দীপ আনে কেহ কুঙ্কুম চন্দন।

“নমো হরিচন্দ্র” বলি করে আবাহন।।

গোকুলে খেলিল খেলা যেমন গোপিনী।

ওড়াকান্দী ভক্ত নারী করিল তেমনি।।

মৃদু মৃদু হাসে প্রভু হোলির আনন্দে।

হাসি দেখি পাগলিনী ভক্ত নারী কান্দে।।

এদিকে নাচিছে ভক্ত কীর্ত্তনে পাগল।

অবিরাম করে নাম হরি হরি বল।।

ব্রজ নাচে নাটু নাচে নাচে বিশ্বনাথ।

আনন্দে গোলক নাচে করে কক্ষাঘাত।।

রুদ্রতালে নাচে ভক্ত বীর হীরামন।

কুমারের চক্র প্রায় ঘুরিছে বদন।।

হুঙ্কার ছাড়িয়া ঘুরে গোবিন্দ মতুয়া।

মৃত্যুঞ্জয় বলে হরি দু’বাহু তুলিয়া।।

নাটুয়ার নৃত্য করে মঙ্গল গোঁসাই।

দশরথ বলে হরি ঘন ছাড়ে হাই।।

প্রভুকে ঘিরিয়া সবে করে লম্ফ ঝম্ফ।

বীর দাপে ধরা কাঁপে যেন ভূমিকম্প।।

লোচন গোস্বামী এল বলে হরি হরি।

আপনি উঠিয়া প্রভু আনে হস্তে ধরি।।

মহাপ্রভু বলে তবে লোচনের ঠাঁই।

“এমন পবিত্র দিন আর দেখি নাই।।

তোমাকে পাইয়া আজি বড়ই আনন্দ।

বল প্রভু ইহা হ’তে কিবা প্রেমানন্দ।।

হাসিয়া লোচন বলে ওগো অন্তর্যামী।

কি হেতু আনন্দ কর সব জানি আমি।।

মহেশ্বর মহাকাল এ পবিত্র দিনে।

আসিয়া উদয় হবে তোমার ভবনে।।

পরম বৈষ্ণব ভোলা মত্ত হরিনামে।

ভোলাকে তুষিতে ভক্ত মত্ত নামে প্রেমে।।

আজি নিশি ছিনু প্রভু সফলা নগরে।

শেষ যামে দেখিলাম স্বপনের ঘোরে।।

আকাশ ভেদিয়া যেন এক মহাজ্যোতিঃ।

নামিয়া তোমার গৃহে পরশিল ক্ষীতি।।

সেই জ্যোতিঃ আসি তব পদে লোটাইল।

পদস্পর্শে সেই জ্যোতিঃ মূর্তিমন্ত হৈল।।

গৌরাঙ্গ বরণ কান্তি ঢল ঢল আঁখি।

রূপ দেখি মনে বলে বসে বসে দেখি।।

করজোড় করি মূর্তি তোমা’ পিতা বলে।

আপনা সম্বরি তুমি মূর্তি মধ্যে গেলে।।

আশ্চর্য মানিয়া আমি উঠিনু শিহরি।

নিদ্রাটুটি গেল মোর বলে হরি হরি।।

প্রভাতে উঠিয়া তাই ভাবি মনে মনে।

অদ্য জন্ম লবে ভোলা তোমার ভবনে।।

ভোলার রাতুল পদ দেখিব বলিয়া।

ছুটিয়া এসেছি হেথা তোমাকে স্মরিয়া।।

প্রভু বলে গোঁসাইজী রহ সাবধান।

অন্যে যেন নাহি পায় তত্ত্বের সন্ধান।।

হাসিয়া লোচন বলে “তুমি মম গুরু।

তব আজ্ঞা শিরোধার্য বাঞ্ছা কল্প তরু।।

Page 026 start

হেনকালে এক নারী এসে ত্বরা করি।

বলে ‘শুভ সমাচার শুনহে শ্রীহরি।।

আদ্যাশক্তি শান্তিদেবী তোমার ঘরণী।

চন্দ্রসম পুত্র কোলে পেয়েছে এখনি।।

নাচিয়া নাচিয়া বলে গোস্বামী লোচন।

“বিশ্বগুরু” এল নেমে শ্রীগুরু চরণ।।

ভক্ত সবে গুরুচাঁদ তাহারে কহিবে।

ধন্যরে কলির জীব সকলে তরিবে।।

আনন্দে উতলা যেন প্রভু হরিচন্দ্র।

ভক্ত গণে ডাকি বলে শুন ভক্ত বৃন্দ।

ক্ষান্ত কর নাম গান শুনহে বচন।

দেখ সবে অদ্য কেবা এসেছে এখন।।

কথা শুনি ভক্তগণে ক্ষান্ত করে নাম।

লোচনের প্রতি রহে চেয়ে অবিরাম।।

লোচনে দেখিয়া সবে ভাবে মনে মনে।

দেখিতে বলিল প্রভু এই মহাজনে।।

ভকতের ভাব দেখি শ্রী লোচন কয়।

“মুক্তা ফেলি কাচ পানে বল কেবা চায়।।

শুনহে ভক্ত সবে শুভ সমাচার।

শান্তি মাতা কোলে পেল প্রভু দিগম্বর।।

এই কথা শ্রী লোচন যখনি বলিল।

আনন্দে ভক্ত সবে নাচিয়া উঠিল।।

প্রসূতি গৃহের পানে সবে ছুটি যায়।

গৃহের নিকটে থাকি শুনিবারে পায়।।

আব্ আব্ মত শব্দ গৃহ মধ্যে হয়।

ববম্ ববম্ শব্দ যেন শোনা যায়।

আরও আশ্চর্য এক সকলে দেখিল।

শত সূর্য রশ্মি যেন গৃহেতে ফুটিল।।

পিছু পিছু হরিচাঁদ আসিয়া দাঁড়ায়।

রশ্মি আসি প্রভু পদে আপনি লুকায়।।

এই দৃশ্য দেখি ভক্ত বলে হরি হরি।

প্রেমানন্দে ভূমে পড়ে করে গড়াগড়ি।।

ভক্ত নারী উলুধ্বনি করে অবিরত।

ভক্ত মুখে চলে ছুটে হরিধ্বনি স্রোত।।

আনন্দে ভকত যত করে নানা খেলা।

লম্ফ ঝম্ফ করে কেহ ভাবেতে উতলা।।

ভাবোন্মাদ হীরামন হাসে অট্টহাসি।

লম্ফদিয়া শ্রী গোলক পৃষ্ঠে পড়ে আসি।।

প্রেমের আলাপে তারে কহে হীরামন।

আমি কি বৃষভ নাকি শিবের বাহন।।

ভাবালাপ শুনি বলে গোস্বামী গোলক।

আপনা বৃষভ বলি হাসাইলে লোক।।

এ নহে কৈলাশ কিম্বা নহে স্বর্ণ কাশী।

জানো নাকি ওড়াকান্দি কিসে ভালবাসি।।

শত গোলকের চেয়ে ধন্য ওড়াকান্দি।

শত ব্রহ্মা শত শিব রহে হেথা বন্দি।।

আমার সোনার চাঁদ প্রভু হরিচাঁদে।

মনপ্রাণ সঁপে পদে রেখেছে যে বেঁধে।।

সে কেন শিবের হবে সামান্য বাহন।

মূল না জানিয়া তাই বল এবচন।।

এই ওড়াকান্দি আজ যেবা আসিয়াছে।

ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব আদি ক্ষুদ্র তাঁর কাছে।।

এতেক কহিল যদি গোস্বামী গোলক।

হীরামন ভূমে লুটে হইয়া পুলক।।

দুই সাধু জড়াজড়ি পড়াপড়ি করে।

আনন্দে মাতিয়া ভক্ত নৃত্য করে ঘিরে।।

কোন ভক্ত ফাগ গুলি পাত্রেতে করিয়া।

উভয় সাধুর গাত্রে দিতেছে ঢালিয়া।।

দেখিয়া ভক্তে করে উচ্চ হরি ধ্বনি।

বজ্র স্বরে গেল যেন ভেদিয়া মেদিনী।।

ভাবের প্রলাপ কত কহে ভক্ত সবে।

মৃত্যুঞ্জয় বৃহস্পতি আরোপের ভাবে।।

উচ্চ কন্ঠে ডেকে বলে সাধু মৃত্যুঞ্জয়।

“তোরা কি করিস সবে ভাবে বোঝা দায়।।

Page 027 start

দেবগুরু বৃহস্পতি আমি আসিয়াছি।

তোদের আচার দেখে আশ্চর্য মেনেছি।।

এসেছে দয়াল হরি হরিচাঁদ রূপে।

ক্ষীরোদের নাথ মর্তে নরের স্বরূপে।।

কাঁদা কাঁদি করি তোরা কি কর্ম করিস।

বুঝে নাহি পাই আমি কাজের হদিশ।।

প্রেমেতে বসতি করে হ্লাদিনী যে শক্তি।

তারে পূজি সুখী সবে তাতে অনুরক্তি।।

দেবী বাণী প্রভু প্রিয়া অবিদ্যা নাশিনী।

তাঁরে ভূলি কিবা পূজ শকতি হ্লাদিনী।।

বেদরূপে জন্মে বাণী প্রভুর শ্রীমুখে।

কন্যারূপে বক্ষ মধ্যে রাখিয়াছি তাঁকে।।

বাণী পূজা বাণী সেবা কর সবে আজি।

ভাবের প্রলাপ ছাড়ি হও কাজে কাজি।।

এত যদি ভাবালাপে কহে মৃত্যুঞ্জয়।

মহাভাবে হীরামন বলিছে তাঁহায়।।

“ওরে বেটা বৃহস্পতি কোথা তোর বাড়ি।

কোন মুখে এলি বেটা দিতে হেথা আড়ি।।

বিদ্যার জননী নাকি তোর সরস্বতী।

মোর প্রভু হরিচাঁদ সরস্বতী-পতি।।

বিদ্যা কি অবিদ্যা মোরা কিছু নাহি মানি।

সর্ব সার মূল তত্ত্ব হরিচাঁদে জানি।।

তোর যে জননী বিদ্যা সেবাদাসী হয়ে।

দিবানিশি প্রভুপদে রয়েছে পড়িয়ে।।

হ্লাদিনী ব্যাধিনী প্রায় প্রভু পদে রয়।

এমন চরণ যদি চোখে দেখা যায়।।

তার কিসে লাগে বল বাণী কি হ্লাদিনী।

মূল ছেড়ে ডাল লয়ে কর টানাটানি।।

ভক্তি মুক্তি নাহি চাই চাহিনা সম্পদ।

যদি বাবা হরিচাঁদ দেয় রাঙ্গা পদ।।

ভক্তের আলাপ শুনি দয়াল ঠাকুর।

ভক্ত গণে ডাকি বলে বাক্য সুমধুর।।

“শুন শুন সাধুগণ আমার বচন।

ভাবালাপ করে সবে আনন্দে মগন।।

সর্ব সিদ্ধি দাতা হয় হরি ভক্ত গণ।

তোমাদের কাছে তাই এই আবেদন।।

যেই পুত্র করিয়াছে হেথা আগমন।

তাঁর গুণে মুক্তি যেন পায় নরগণ।।

এই বংশ তার গুণে যেন ধন্য হয়।

তারে দেখে দুঃখী তাপী যেন শান্তি পায়।।

হরিভক্ত গণ সবে করো আশির্বাদ।

শ্রী গুরুচাঁদের যেন পুরে মনোসাধ।।

প্রভু যবে এই কথা বলে ভক্ত ঠাঁই।

কাঁদিয়া ভকতে বলে দয়াল গোসাই।।

তোমার লীলার তত্ত্ব মোরা কিবা জানি।

যাহা কও যাহা দেও তাই মাত্র মানি।।

সর্ব ফলদাতা হয় তোমার চরণ”।।

এই ভাবে গুরুচাঁদ অবতীর্ণ হ’ল।

ধরার কলুষরাশি দুরে চলে গেল।।

অবতীর্ণ গুরুচাঁদ পরম রতন।

হরি-গুরুচাঁদ প্রতি হরি বল মন।।

--০—