Page 199

শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের ভবিষ্যত কথন ও ডক্টর মীডের সন্দেহ ভঞ্জন

মীডেরে চাহিয়া প্রভু বলিল তখন।

“তোমার মনের ভাব বুঝিনু এখন।।

প্রত্যক্ষ ঘটনা যদি দেখিবারে চাও।

এবে মীড তুমি তবে গৃহে চলি যাও।।

আদ্য যেই কালে হ’ল কথোপকথন।

আগামী পরশ্ব হেথা কর আগমন।।

আমি যাহা বলি এবে শুন মন দিয়া।

আসিছে একটি ভক্ত দধি-ভাণ্ড নিয়া।।

হেথা আসিবারে লাগে দু’দিন সময়।

পরশ্ব এখানে সেই আসিবে নিশ্চয়।।

আদ্যকার যে সময় বলিতেছি কথা।

এ সময়ে আসিবে সে হবে না অন্যথা।।

আপন-নয়নে তুমি প্রত্যক্ষ করিবে।

আশা করি মনোভ্রাক্তি সব দূর হবে।।

আমার স্বভাব নহে এই সব বলা।

বড়ই-বিপদে-ভরা এই পথে-চলা।।

তোমার বিশ্বাস লাগি এই সব বলি।

ক্রমে ক্রমে মীড তুমি জানিবে সকলি।।”

দুরন্ত বিস্ময়ে পূর্ণ মীডের হৃদয়।

মনে ভাবে এই মত কি প্রকারে হয় ?

দেখা যাক কিবা হয় আগামী পরশ্ব।

সত্য যদি হয় তবে মানিব অবশ্য।।

এমত ভাবিয়া মীড লইল বিদায়।

নিজ-পত্নী নিকটেতে সব কথা কয়।।

শুনিয়া মিসেস মীড বলিল তখন।

“তোমার সঙ্গেতে আমি করিব গমন।।

Page 200 start

এই কথা সত্যে যদি পরিণত হয়।

গুরুচাঁদে পিতা বলি মানিব নিশ্চয়।।

দুই দিন গত হ’ল তৃতীয় দিবসে।

প্রহরেক বেলা কালে প্রভু আছে বসে।।

হেন কালে পত্নী সহ মীড মহামতি।

উপনীত তথাকালে অতি দ্রুত গতি।।

পরম যতনে প্ৰভু তাদের বসা’ল।

প্রীতি কুশলাদি সব জিজ্ঞাসা করিল।।

পরে মীড প্রতি চাহি জিজ্ঞাসা করিল।

“দেখুন ডক্টর মীড কি সময় হ’ল ?”

ঘড়ি পানে চাহি মীড বলিছে তখন।

“নয়টা বাজিয়া কুড়ি মিনিট এখন।।”

প্রভু বলে আর দশ মিনিটের পরে।

দধি-ভাণ্ড-সহ লোক আসিবে এ ঘরে।।

কাৰ্ত্তিক তাহার নাম গৌরাঙ্গ বরণ।

এই বাড়ী পূৰ্ব্বে তেহ আসেনি কখন।।

দধিভাণ্ড মাথে তার এক হাতে ছাতি।

বয়স চল্লিশ হবে নমঃশূদ্র জাতি।।”

বলিতে বলিতে সেথা এল সেই জন।

মস্তকে দধির ভাণ্ড গৌরাঙ্গ বরণ।।

প্রভু বলে “দেখ মীড এই সেই লোক।

দুই মাস পূৰ্ব্বে এর গেছে পুত্র-শোক।।”

দধি ভাণ্ড রাখি যবে প্ৰণাম করিল।

আপনার কাছে মীড তাহারে ডাকিল।।

পুঁছিল তাহার ঠাঁই নাম ধাম জাতি।

বর্ণে বর্ণে সত্য হ’ল নহে ইতি উতি।।

আশ্চর্য জানিয়া মীড ভাবে নত শিরে।

“এই বাৰ্ত্তা বড় কৰ্ত্তা পে’ল কি প্রকারে ?

মহা শক্তিধারী এই পুরুষ রতন।

যতেক সন্দেহ মোর হইল খণ্ডন।।

এ হেন ব্যক্তির দেখা আর নাহি পাই।

যাহা বলে বড় কৰ্ত্তা তাহা করে যাই।।

নিশ্চয় বুঝিনু ইনি ঐশশক্তিধারী।

নমঃকুলে এর মত অন্যে নাহি হেরি।।

এমত ভাবিছে মীড নীরব অন্তরে।

কহিল মিসেস মীড প্রভুর গোচরে।।

“এক কথা বড় কৰ্ত্তা আমি ভাবিয়াছি।

সেই হেতু মীড সহ হেথা আসিয়াছি।।

সমস্ত শুনেছি আমি মীডের নিকটে।

মন খুলে তাই সব বলি অকপটে।।

মনের প্রতিজ্ঞা মোর ছিল সেই দিনে।

পতিসহ আজ আমি আসিব এখানে।।

যদ্যপি ঘটনা সত্য দেখি নিজ চোখে।

“ধৰ্ম পিতা” বলি আমি ডাকিব তোমাকে।।

আমার বাসনা পূর্ণ হ’ল আজি তাই।

তুমি মোর ধৰ্ম-পিতা শশী মোর ভাই।।

মিসেস মীডের কথা শুনিয়া শ্রবণে।

আনন্দে মাতিয়া প্রভু বলিলা তখনে।।

“তুমি মোর ধৰ্ম-কন্যা করিনু স্বীকার।

তব কাছে নাহি মোর কোনই বিচার।।

নিজ বাড়ী নিজঘর ভাবিবে সদায়।

যাতায়াত কর মাগো সৰ্ব্বদা হেথায়।।”

শুনিয়া মিসেস মীড করে নিবেদন।

“এক কথা বলি আমি করুন শ্রবণ।।

খৃষ্টানের জাতি মোরা তা’তে পরদেশী।

সামাজিক ক্রিয়া কৰ্ম্মে মোরা নাহি মিশি।।

তোমরা হিন্দুর জাতি মোরা দিলে জল।

পান নাহি কর মনে ভেবে অমঙ্গল।।

আমি যদি কন্যা আজি হয়েছি তোমার।

আমার হস্তে কি তুমি করিবে আহার ?”

মিসেস মীডের মুখে শুনি এই বাণী।

হাসি হাসি কথা কয় প্রভু গুণমণি।।

“শুন কন্যা, গুণে ধন্যা, আমার বচন।

জাতি-ভাগ মোর ঠাঁই পাবে না কখন।।

Page 201 start

নরাকারে ভূমণ্ডলে যত জন আছে।

‘এক জাতি’বলে মান্য পাবে মোর কাছে।।

আমার পিতার ভক্ত আছে যত জন।

এক জাতি বলে তারা হয়েছে গণ।।

লোকাচারে তারা কেহ কায়স্থ ব্রাহ্মণ।

‘মতুয়ার’ মধ্যে তাহা নাহি নিরূপণ।।

নমঃশূদ্র, তেলী মালী, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ।

ইসলাম, বৈদ্য জাতি - রোগে সিদ্ধ-হস্ত।।

মতুয়া সকলে এক, জাতি-ভেদ নাই।

বিশেষতঃ কন্যা হ’লে নাহিক বালাই।।

তুমি যদি কন্যা হ’লে আমি পুত্ৰ হ’ব।

যা’ দিবে আমাকে খেতে মনোসুখে খা’ব”।।

এই ভাবে ভাবালাপ হ’ল কতক্ষণ।

আসন ছাড়িয়া মীড দাঁড়াল তখন।।

মীড কহে “শুন বলি ও হে বড় কৰ্ত্তা।

অদ্য প্রাতেঃ হ’ল মোর বড় শুভযাত্রা।।

মনের সন্দেহ মোর সব ঘুচিয়াছে।

গুটী ক’ত কথা তাই বলি তব কাছে।।

আমার জননী হ’ল অতি সতী নারী।

এদেশে এসেছি তাঁর আজ্ঞা শিরে ধরি।।

বাল্যকাল হ’তে মোর মনের পিপাসা।

খৃষ্ট-ধৰ্ম প্রচারিতে মনে বড় আশা।।

দুঃখীর বেদনা দূর করিতে বাসনা।

ডাক্তারী শিখিনু তাই হয়ে একমনা।।

‘কোথা যাই কোথা যাই’ ভাবি মনে মন!

হেনকালে ঘটে এক আশ্চর্য ঘটন।।

একদা প্রভাত কালে মাতা ডাকি কয়।

“শুন মীড মোর বাক্য আসিয়া হেথায়।।

বিচিত্র স্বপন এক আজ রজনীতে।

ভাসিয়া উঠেছে মোর দুই আঁখি পাতে।।

দেখিলাম একজন দিব্য-দেহধারী।

মস্তকে সুদীর্ঘ কেশ যেন এক নারী।।

দীর্ঘ শ্মশ্রু মুখে দেখি বুঝিলাম মনে।

যীশু প্রায় দেখা যায় অঙ্গের গঠনে।।

সেই মহাজন মোরে ডাক দিয়া কয়।

“শুনহে মীডের মাতা! মম অভিপ্রায়।।

তব পুত্র মীড ইচ্ছা করিয়াছে মনে।

করিবে দীনের সেবা পরম যতনে।।

ডাক্তারী শিখেছে তাই করিয়া যতন।

কোন দেশে যাবে এবে তাই ভাবে মন।।

আমি বলি মীড়ে তুমি দেহ আজ্ঞা করি।

অপার-ভারত-সিন্ধু দিয়া যাক পাড়ি।।

ভারতবর্ষের মধ্যে আছে বঙ্গদেশ।

তার মধ্যে আছে দুঃখী জানিও বিশেষ।।

শিক্ষা-দীক্ষা-হীন তারা ধন-রত্ন নাই।

কত কষ্টে কাটে কাল কি বলে বুঝাই।।

দলিত-পীড়িত তারা আছে হীন হ’য়ে।

অসহ্য জীনব-বোঝা স্বন্ধেতে বহিয়ে।।

তার মধ্যে এক জাতি নমঃশূদ্র নাম।

তাহাদের কাছে গেলে পূর্ণ মনস্কাম।।

সেই ঘরে আছে এক পুরুষ মহান।

তাঁর কাছে গেলে হবে সকল সন্ধান।।”

তাই বলি মীড তুমি বঙ্গদেশে যাও।

দীন দুঃখী সেবা করে জীবন কাটাও।।

সেই হ’তে মনে মনে করি আলোচনা।

কোন খানে আছে মোর সে-সব নিশানা।।

মাতৃবাক্যে এই দেশে আসিয়াছি বটে।

কভু ধরা দেই নাই কাহার নিকটে।।

তোমার আহ্বানে বটে এই দেশে আসি।

সন্দ তবু হয় মনে ভাবি দিবানিশি।।

তোমার স্বভাব দেখে শুনিয়া বচন।

তলে তলে অগ্রসর হ’ল মোর মন।।

তথাপি সন্দেহ বীজ এড়া’তে না পারি।

‘করি’ ‘করি’ বলে কাজ ধরেও না ধরি।।

Page 202 start

কিন্তু যবে এই দিনে দিলে পরিচয়।

আনন্দে নাচিল প্রাণ গভীর বিস্ময়।।

মনে ভাবিলাম আমি এতদিন পরে।

সন্দেহের নিরসন হল এই বারে।।

তোমার বচন যদি সত্য নাহি হ’ত।

অবশ্য এ ওড়াকান্দী ছাড়িতাম দ্রুত।।

বুঝিতাম এই কৰ্মক্ষেত্র নহে মোর।

তুমি মোরে বাঁধিতেছ দিয়ে মাত্র ডোর।।

এখানে সংশয় মোর হইয়াছে দূর।

এতদিনে চিনিলাম আসল ঠাকুর।।

অতঃপর আর মোর কোন কথা নাই।

বহু নমস্কার আমি তোমারে জানাই।।

তোমার জাতিকে আমি ধরিলাম হাতে।

সৰ্ব্ব উপকার পাবে এরা আমা’ হ’তে।।

যে-জমি করেছ দান তাহার উপরে।

করিব দ্বিরদ-হৰ্ম্ম্য মিশনের তরে।।

তাহার নিকটে হবে উচ্চ বিদ্যালয়।

আর চিন্তা করে দেখি কি কি করা যায়”।।

এত বলি মীড পুনঃ নমস্কার দিল।

পত্নীসহ ততক্ষণে বিদায় হইল।।

ডক্টর মীডের মনে ঘুচিল সংশয়।

অন্ধ-দেহে আলো জ্বালে প্রভু দয়াময়।।

এ সব ঘটনা দেখি ভকত সকল।

কান্দিয়া লোটায় সবে চক্ষে বহে জল।।

প্রভু ডাকি ভক্তগণে কহিল বচন।

“এ মোর বারতা আজি শুন সৰ্ব্বজন।।

পতিত-পাবন লাগি এল মোর পিতা।

তাঁর কার্য সাধিবারে করগো একতা।।

শুধু গুণগান নহে ধরমের সার।

‘তৎ-প্রীতি-কাম’ হেতু কৰ্ম কর তাঁর।।

পতিত-তারক পদে যদি থাকে ভক্তি।

প্রাণ দিয়া কর সবে পতিতের মুক্তি।।

পতিতে তরা’তে যেই শক্তি প্রয়োজন।

সেই পথে পিতা সবে করেছে গঠন।।

এত কষ্টে যেই বৃক্ষ করেছে রোপন।

অদ্য যদি তারা ফল না করে_ধারণ।।

কত ব্যথা বুকে পিতা পাবে তার লাগি।।

তাই বলি ঘুম হ’তে উঠ সবে জাগি।

তোমাদের মুক্তি দিতে মীডে প্রয়োজন।।

দেখ মীড উপনীত এদেশে এখন।।

অবশ্য এ-সব তত্ত্ব নাহি বুঝে জাতি।

কিন্তু ভক্ত যারা তারা হও মোর সাথী।।

তোমরা চিনেছ সবে আমার পিতায়।

তাই সবে ঠেকিয়াছ জাতি-তোলা-দায়।।

চিরকাল একদল কাজ করে থাকে।

ভোগ কালে ফল নিতে সবাকারে ডাকে।।

কৰ্ম যারা নহে তারা তাহাতে দুঃখিত।

চিরদিন করে তারা জগতের হিত।।

তাহারাই চিরদিন রহে স্মরণীয়।

তাহারাই জীবশ্রেষ্ঠ ধন্য-বরণীয়।।

যুগে যুগে তাঁহাদের করম কাহিনী।

কালের বুকেতে চলে অনন্ত-বাহিনী।।

তাই বলি ভক্তগণ হও অগ্রসর।

কৰ্ম কর কীৰ্ত্তি থাক হও হে অমর”।।

প্রভু মুখে শুনি বাক্য শ্ৰীদেবী চরণ।

করজোড় করি করে এক নিবেদন।।

“যেই আজ্ঞা হবে প্রভু আপনার হ’তে।

অবশ্য পালিব তাহা আনন্দ-সহিতে”।।

সব ভক্ত জনে জনে প্রতিজ্ঞা করিল!

দেখিয়া প্রভুর মনে মহানন্দ হ’ল।।

আনন্দে হাসিয়া প্ৰভু কহে পুনরায়।

“শুন সাধুগণ যাহা মোর অভি প্রায়।।

মীডেরে রাখিয়া সাথে করিব সকল।

তোমরা সকলে তা’তে মোরে দিও বল”।।

Page 203 start

তারক কান্দিয়া বলে “দুৰ্ব্বলের বল!

সকল বলের বল তুমি মহাবল।।

কিবা বল দিব বল আমরা দুর্ব্বল।

বল দিব মোরা বল এই কোন ছল ?

ইচ্ছাময় তুমি প্রভু যাহা ইচছা কর।

দয়া করে দাসগণে কৃপা-হস্তে ধর”।।

বিনয়ে তারক কহে এমত বচন।

‘জয় গুরুচাঁদ ধ্বনি কহে ভক্তগণ।।

পতিত তরাতে এল পতিত পাবন।

কোন ভাবে করে কৰ্ম শুন সৰ্ব্বজন।।

---০---