Page 495

সাধক কবি অশ্বিনী গোঁসাই

অশ্বিনী গোঁসাই ধন্য প্রেম মহাজন।

কর জোড়ে বন্দিলাম তাঁহার চরণ।।

গোলকের বরে জন্ম কার্ত্তিকের ঘরে।

খুলনা জেলার মধ্যে গঙ্গাচর্না পরে।।

মহানন্দ ছিল তাঁরে শুদ্ধ প্রেমভক্তি।

শ্রীতারক দিল তাঁরে রচনার শক্তি।।

সঙ্গীতের অর্ঘ্য দিল দুই বিগ্রহেরে।

‘‘শ্রীহরি সঙ্গীত’’ নামে ব্যপ্ত চরাচরে।।

পরম উদার সাধু কার্ত্তিক সুজন।

পুত্রে শিক্ষা নাহি দিল দরিদ্র্য কারণ।।

আক্ষরিক জ্ঞান মাত্র হ’ল পরিচয়।

স্বভাব শক্তিতে দেখ রচনা করয়।।

Page 496 start

‘‘শ্রীহরি সঙ্গীত’’ যদি কর অধ্যায়ন।

বুঝিবে কবির বুকে কবিত্ব কেমন।।

নবীন ভাবের রসে মাধুর্য্য মিশিয়া।

উদাত্ত সুরের রেশে চলিছে ভাসিয়া।।

প্রেমতত্ত্বে, সমহিত গানের কবিতা।

যত গান রচিয়াছে অশ্বিনী গোঁসাই।।

চিরন্তন ভাব তার পুরাতনী নাই।।

এ হেন সাধক কবি যেথা জন্ম লয়।

সেই দেশ সেই জাতি তাতে ধন্য হয়।।

এবে শোন গোস্বামীর কিছু বাল্য লীলা।

গোস্বামী বাসিত ভাল থাকিত একেলা।।

গুণ গুণ স্বরে সদা হরি গুণ গায়।

ভাবের তরঙ্গ যেন ঢেউ খেলে যায়।।

সাংসারিক অভাবেতে বহু কষ্ট পায়।

তার পিতা তাই তাঁরে মজুরী খাটায়।।

কৃষাণ রাখিল তাঁরে মালাকার বাড়ী।

কাজ করে গান গায় দিবা বিভাবরী।।

একদা দুপুরবেলা ছুটির বেলায়।

আর আর কৃষাণেরা গৃহে চলে যায়।।

অশ্বিনী গোঁসাই বলে সকলের ঠাঁই।

‘‘অগ্রভাগে চল সবে আমি পিছে যাই।।’’

সকলে চালিয়া গেল রহিল গোঁসাই।

‘হরিচাঁদ’ ‘গুরুচাঁদ’ বলে ছাড়ে হাই।।

খেজুর গাছের নীচে করি পদ্মাসন।

বসিয়া গোস্বামী হল ভাবেতে মগন।।

‘নিরালার সাথী হরি দেখা দাও মোরে।

ঝরিল নয়ন তাঁর হরিচাঁদে স্মরে।।

কান্দিয়া কান্দিয়া সাধু নিদ্রাগত হল।

সুষুপ্তির মাঝে কত স্বপন দেখিল।।

বৃক্ষতলে পড়ি সাধু সুখে নিদ্রা যায়।

রৌদ্র কর আসি তাঁর পড়িল মাথায়।।

ভকত জনেরে দেখ সবে বাসে ভাল।

দৈবে এক অজগর সেখানে আসিল।।

ভকতে চিনিতে তার বাকী নাহি থাকে।

নিজ অঙ্গ দিয়া তাই রৌদ্র কর ঢাকে।।

বহুক্ষণ গত দেখি সবে উচাটন।

‘অশ্বিনী ফিরেনা কেন তাই ভাবে মণ।।

তত্ত্ব নিতে কৃষাণেরা সেইখানে যায়।

সেই ভাবে গোস্বামীরে দেখিবারে পায়।।

বড়ই আশ্চর্য্য মনে তাহারা ছুটিল।

গৃহস্বামী কাছে আসি সকলি কহিল।।

ত্র্যস্তে ব্যস্তে গৃহস্বামী তথা ছুটে যায়।

ততক্ষণে গোস্বামীর নিদ্রা ভঙ্গ হয়।।

গোস্বামীর নিদ্রা ভঙ্গ দেখি অজগর।

নিজলোকে চলি গেল দৃষ্টির অন্তর।।

গৃহস্বামী এসে দেখে কোথা কেহ নাই।

একেলা বসিয়া আছে অশ্বিনী গোঁসাই।।

বিপুল বিনয় তবে সেই মহাজন।

নিজ গৃহে গোস্বামীরে লইল তখন।।

তার পরে গেল স্বামী নারিকেল বাড়ী।

মহানন্দ গোস্বামীর শ্রীচরণ ধরি।।

যেথা যায় সে অশ্বিনী সদা গান গায়।

কৃষাণের কার্য্য তাতে কম পড়ে যায়।।

তাহাতে কৃষাণ তাঁরে রাখিতে চাহে না।

যাহা বল গোস্বামীজী কথা’ত কহে না।।

দয়াময় মহানন্দ বলে তাই জেনে।

‘‘অশ্বিনী কৃষাণ র’বে আমার আঙ্গিণে।।

‘‘অকেজো’’ বলিয়া তাঁরে সবে বাদ দেয়।

আমি দেখি ‘‘বাদে কোন কাজ হয়।।’’

তদবধি নারিকেল বাড়ী তেহ রয়।

গুণ গুণ স্বরে গুণ সর্ব্বাদায় গায়।।

ভক্তের পরীক্ষা দেখ কত ভয়ঙ্কর।

পদে পদে বিপজ্জাল আছে নিরন্তর।।

Page 497 start

নারিকেলবাড়ী পরে ছিল এক নারী।

মনে মনে ইচ্ছা তার করে ব্যাভিচারী।।

গোস্বামীর কাছে তাই করিল প্রস্তাব।

মনে মনে গোস্বামীর হ’ল বড় তাপ।।

‘‘আহা নারী! বিষ খেয়ে মরিবারে চাও।

সোজা পথ ছেড়ে কেন ‘বাঁকা’ পথে যাও।।

গোস্বামী ভাবিল মনে তারে দিব শিক্ষা।

নাম গুণে হবে পার ভীষণ পরীক্ষা।।

পুনরায় সেই নারী যবে কথা কয়।

গোস্বামী কহিল ‘‘রাজী হইনু নিশ্চয়।।

যেই দিন তব স্বামী গৃহে নাহি রবে।

আমার নিকটে তুমি খবর পাঠাবে।।

আহলাদিতা সেই নারী করে সেই মত।

গোস্বামীজী সেই গৃহে হ’ল উপস্থিত।।

কু-আশায় নারী কয় ‘‘করহ শয়ন।।’’

গোস্বামী কহিল ‘‘বসে থাকি কিছুক্ষণ।।

গুটি’কত গান আমি করিব নিশ্চয়।

পরে মোরে বল তুমি যাহা ইছ্চা হয়।।’’

স্বীকৃতা হইল নারী সাধু করে গান।

ভাব ধরে চলে যেন সুরের উজান।।

এক, দুই, তিন করি যত গান গায়।

ভাবের তরঙ্গে পাপ রসাতলে যায়।।

কাম দূরে গেল নারী পেল মনস্তাপ।

‘‘সাধুরে করেছি আমি মিলন প্রস্তাব।।

কু-চরিত্রা, অপবিত্রা আমি অভাগিনী।

সাধু গুরু মহাজনে আমি নাহি মানি।।’’

অনন্ত নরকে মোর যথাযোগ্য স্থান।

কর্ত্তব্য নহেক আর রাখিতে পরাণ।।’’

এত ভাবি সেই নারী পড়ে তাঁর পায়।

বলে ‘‘বাবা! দয়া করে রক্ষ হে আমায়।।

না চিনিয়া করিয়াছি বহু বাচালতা।

পাপ হতে রক্ষা কর হলে মোর পিতা।।’’

গোস্বামী কহিল ‘‘মাতা! বলি তব ঠাঁই।

পাপে যদি জাগে তাপ তবে পাপ নাই।।

পুনঃ যেন হেন ইচ্ছা না আসে অন্তরে।

স্বামীকে বলিও সব তাঁর পদ ধরে।।

তাঁর পদে মাপ নিয়ে হও নিষ্ঠাবতি।

স্বামী পদে সদা মাতা রাখিও ভকতি।।

পর পুরুষের সঙ্গ করে যেই নারী।

অনন্ত নরকে বাস হইবে তাহারি।।

তাই বলি পাপ চিন্তা ছেড়ে দাও মাতা।

প্রাণ পণে রাখ শুধু স্বামীর যে কথা।।

স্বামীর বচনে নারী পাপচিন্তা ছাড়।

মতুয়া হইল তারা গোস্বামীরে ধরে।।

হেনকালে প্রভুপাদ স্বামী মহানন্দ।

ত্যজিল মরত ধাম কাটি কর্ম্মবন্ধ।।

গোস্বামীজী তার পরে দুর্গাপুরে এল।

হরিবর সাধুজীর আশ্রয়ে রহিল।।

তার দলে ‘কবিগান’ করে কিছু দিন।

হরি-প্রমরসে সদা রহে বটে লীন।।

কিছু কাল পরে নিজে দল সাজাইল।

বহু স্থানে ‘কবিগান’ করে বেড়াইল।।

ইতিমধ্যে দেখা পেল গোস্বামী তারকে।

তাঁহার ‘চরণ বন্দে’ পরম পুলকে।।

মাঝে মাঝে গোস্বামীর সঙ্গে মহাশয়।

ওড়াকা্ন্দী গুরুচাঁদে দেখিবারে যায়।।

শ্রীতারক বলে তাঁরে প্রভুর বারতা।

মনোযোগে সে-অশ্বিনী শোনে সব কথা।।

গুরুচাঁদ সঙ্গে নহে বেশী আলাপন।

নিরালে চলিছে তাঁর সাধন ভজন।।

একবার গোস্বামীজী চলিলেন ঢাকা।

দল নিয়ে গান সেথা করিবেন একা।।

পদ্মা পাড়ি দিয়া গেল ঢাকার জেলায়।

দৈব যোগে নৌকা তাঁর জলে ডুবে যায়।।

Page 498 start

গোস্বামীর যত বস্ত্র সব ডুবে গেল।

অন্তরে গোস্বামী তাতে বহু কষ্ট পেল।।

মূল্য দিয়া বস্ত্র কেনে হেন সাধ্য নাই।

মহাকষ্ট ভাবে মনে অশ্বিনী গোঁসাই।।

ভকতের দুঃখ হেরি প্রভু দয়াময়।

ভকতের দুঃখ রাশি দুর করে দেয়।।

গান অন্তে গোস্বামীজী তরীতে আসিল।

অকুল পদ্মার বুকে তরণী ভাসিল।।

চারিদেকে গোস্বামীজী ফিরিয়া নয়ন।

নৌকা মধ্যে নিজ বস্ত্র করে দরশন।।

তাড়াতাড়ি তাহা ধরি দেখিল গোঁসাই।

রয়েছে সকল দ্রব্য কিছু যায় নাই।।

তাহা দেখি প্রাণ তাঁর প্রেমে পূর্ণ হল।

‘‘কত দয়া করছ’’ বলে গান বিরচিল।।

কিছুকাল পরে তার গোস্বামী তারক।

পৃথিবী ছাড়িয়া তবে গেল পরলোক।।

সেই হতে গোস্বামীজী করে অবিরত।

ওড়াকান্দী শ্রীধামেতে সদা যাতায়াত।।

ক্রমে ক্রমে গুরুচাঁদ বলিলেন তাঁরে।

‘‘সঙ্গীত রচনা কর তারকের বরে।।

তোমারে করেছে কৃপা তারক গোঁসাই।

তাঁর মত গান কর আমি তাই চাই।।’’

কাঁন্দিয়া অশ্বিনী বলে ‘‘ওগো দয়াময়।

তারক গোলক সব আছে তব পায়।।

আমার শকতি নাই করিতে রচনা।

সব হতে পারে যদি করহে করুণা।।’’

প্রভু কয় ‘‘নাহি ভয় আমি বল দিব।

রচনা করিয়া আন আমি তা শুনিব।।’’

সেই হতে সর্ব্বদায় সেই মহাত্মায়।

গুরুচাঁদ পদে আনি গান অর্ঘ্য দেয়।।

যে যে খানে গুরুচাঁদ করেন গমন।

সর্ব্বদায় অশ্বিনীরে করেন স্মরণ।।

প্রভুর সঙ্গেতে সাধু হেথা সেথা যায়।

মানস কুসুম গাঁথি প্রভুরে সাজায়।।

ওড়াকান্দী এল তাঁরে প্রভু ডেকে কয়।

‘‘গান কর, গান কর, গোস্বামী মশয়।।’’

লৌকিক আচারে শেষ জীবনের দিকে।

ব্যথিত ছিলেন প্রভু বহুবিধ শোকে।।

বেদনার ক্ষণে তাই গোস্বামী সুজন।

সাজায়ে গানের অর্ঘ্য করিত অর্পন।।

‘‘দরদী’’ সাজিয়া প্রভু গানের অঞ্জলি।

আপনার শুভ্র করে লইতেন তুলি।।

এই ভাবে প্রভু তাঁরে বহু কৃপা করে।

বহু জনে গুরু বলে মান্য করে তাঁরে।।

বহু দেশে চলে সাধু প্রচার কারণে।

‘‘হরি গুরুচাঁদ’’ নাম দেয় সর্ব্বজনে।।

বহু গান যবে তাঁই হইল রচনা।

মুদ্রিত করিতে চায় গ্রন্থ একখানা।।

প্রভুর আজ্ঞায় গ্রন্থ হইল মুদ্রিত।

হইল গ্রন্থর নাম ‘‘শ্রীহরি সঙ্গীত।।’’

ক্রমে ক্রমে এই ভাবে দিন যায় গত।

‘‘দৈবই প্রেবল ভবে’’ জানিবে নিশ্চিত।।

পরম সংযমী সাধু অশ্বিনী গোঁসাই।

কি কুক্ষণে বিয়া কৈল মনে ভাবি তাই।।

কামবাঞ্ছা গোস্বামীজী নাহি মনে করে।

‘‘প্রভুর ইচ্ছায় ধন্য’’ ভাবে নিরন্তরে।।

নারী হতে এজগতে আসিয়াছে পাপ।

বাইবেল শাস্ত্রে বলে ‘‘নারী অভিশাপ।।’’

নারীর কারণে সাধু ত্যজিল জীবন।

এবে শোন বলিতেছি সেই বিবরণ।।

ভকত চরিত্র কথা সুধা হতে সুধা।

কবি বলে পিও সবে যাবে ভব-ক্ষুধা।।

---০---