Page 203

১৯০৭ খৃষ্টাব্দ বা নমঃশূদ্র জাগরণ


“উঠে ধীরে সিংহ শিশু পৰ্ব্বত উপর,শিলায় শিলায় রাখি পদ আপনার’।।

প্রস্তাবনা

জীবের মঙ্গল তরে আসে অবতার।

কিন্তু কৰ্মরীতি দেখি এক সবাকার।।

নরাকারে রামরূপে আদি অবতার।

মানব-জীবন-নীতি করিল প্রচার।।

অপূর্ণ তাহাতে যাহা রহে সেই বারে।

কৃষ্ণরূপে পুরাইতে মনে বাঞ্ছা করে।।

তাহাতে অপূর্ণ যাহা তাহা ক্রমে ক্রমে।

ভিন্নরূপে পুরাইতে নামে ধরাধামে।।

ইহার রূপক দেখি শিক্ষানীতি ক্ষেত্রে।

প্রথম আরম্ভ শিক্ষা করে তাল পত্রে।।

আদি বর্ণমালা যাহা শিখে পাঠশালে।

শিক্ষার সমাপ্তি তথা সেই বর্ণ চলে।।

আদি বর্ণমালা দিয়া বিবিধ প্রকারে।

আপন মনের কথা প্রকাশিত করে।।

সেই-নীতি পথে কার্য অবতারে করে।

আদির স্বভাব কিন্তু ছাড়িতে না পারে।।

তাই দেখি অবতার মানব আকারে।

মানুষের মত তাঁর সব কৰ্ম করে।।

অবশ্য যদ্যপি ইচ্ছা করে অবতার।

সকলি করিতে পারে যে-ইচ্ছা তাঁহার।।

কিন্তু মানবের পক্ষে আদর্শ তা’ নয়।

ক্ষুদ্র-শক্তি মানবের মনে লাগে ভয়।।

তাই মানবের সাথে সুখে দুঃখে মিশি।

অবতার করে কাজ ধরাধামে আসি।।

তাই রাম বানরের সাহায্য চাহিল।

দোষ-শূন্যা সীতাদেবী বনে প্রবেশিল।।

তাই কুরুক্ষেত্র-রণে গাণ্ডীবী অৰ্জ্জুন।

তাই হরধনু পরে রাম দিল গুণ।।

তাই চৈতন্যের সাথে খোল করতাল।

মূল-বৃক্ষ অবতার আর সবে ডাল।।

এই অবতারে প্রভু মীডকে ধরিল।

মীডকে ধরিয়া জাতি উদ্ধার করিল।।

মীড ভাবে গুরুচাঁদে করিবে খৃষ্টান।

ভাব জানি মনে মনে হাসে ভগবান।।

মীড যত আগু’ হয়ে কথা-বার্ত্তা কয়।

প্রভু বলে ‘শোন মীড এ-সময় নয়।।

পূৰ্ব্বেতে বলেছি তোমা’ সব বিবরণ।

অগ্রভাগে নমঃশূদ্রে দেহ বিদ্যাধন।।

বিদ্বান হইলে সবে তোমাকে চিনিবে।

বুঝিয়া ধৰ্ম্মের তত্ত্ব খৃষ্টান হইবে’।।

প্রভুর বচনে মীড উত্তর না পায়।

মনে ভাবে কোন ভাবে এঁরে ধরা যায়।।

বিচার করিল মনে করিয়া যুকতি।

নমঃশূদ্রে কিছুফল দেখা’ব সম্প্রতি।।

উপকার পেলে সবে হবে মোর বশ্য।

সেকালে খৃষ্টান আমি করিব অবশ্য।।

এই যুক্তি মনে রাখি প্ৰভু প্রতি কয়।

বড় কৰ্ত্তা! এক কথা মোর মনে হয়।।

Page 204 start

সংবাদ পত্রের দেখি অতি প্রয়োজন।

সংবাদ পত্রিকা এবে করুন লিখন।।

আপনার জাতি পক্ষে যত কথা আছে।

পত্রিকা মুদ্রিত করি দেহ সবা কাছে।।

এই ভাবে এ জাতির হবে পরিচয়।

পত্রিকার দ্বারা কার্য বহুবিধ হয়।।

সুসভ্য সমাজ যত আছে পৃথিবীতে।

সংবাদ পত্রিকা লেখে নিজ-নিজ-মতে।।

অবশ্য পত্রিকা তুমি করহে প্রকাশ।

বহু উপকার হবে কর এ বিশ্বাস।।

এইরূপ হইতেছে কথোপকথন।

হেনকালে উপনীত তথা চারিজন।।

রাধানাথ, ভীষ্মদেব, আর শ্রীমোহন।

কুমুদ মল্লিক নামে বিখ্যাত ভুবন।।

কিছু পরে উপনীত প্ৰভু জ্যেষ্ঠ পুত্র।

শ্ৰীশশিভূষণ নাম পরম পবিত্র।।

এবে শুন ইহাদের যেই পরিচয়।

রাধানাথ মণ্ডল বাড়ী জ্যোৎকুরায়।।

শ্ৰীমোহনলাল নামে বাক পুরা বাসী।

ঠাকুরের কাছে যবে উপনীত আসি।।

কুমুদ মল্লিক বাস খুলনা জিলায়।

বি, এ, পাশ করি বাবু ঘুরিয়া বেড়ায়।।

শিক্ষা লাভ করি সবে বহু দুঃখে ভোগে।

চাকুরীর চেষ্টা সবে করে এক যোগে।।

ইতি পূৰ্ব্বে শশীবাবু চাকুরী কারণে।

করিল বিফল-চেষ্টা ভ্ৰমি’ নানা স্থানে।।

নমঃশূদ্র জাতি বলি সবে ঘৃণা করে।

কিসের চাকুরী দিবে বসায় অন্তরে।।

বহু চেষ্টা করি বাবু বিফল হইয়া।

পিতার নিকটে সব কহিল আসিয়া।।

প্রভু বলে “শশী দুঃখ না করিও আর।

তোমাকে দিবেন হরি চাকুরী এবার।।

যার সাহায্যেতে তুমি চাকুরী পাইবে।

সেইজন আসিতেছে বুঝি অনুভবে।।”

তাই যবে মীড আসি দিল দরশন।

প্রভু বলে “শুন শশী এই সেই জন।।

ইহ সনে তুমি সদা বন্ধুত্ব রাখিবে।

নিশ্চয় জানিবে মীড মঙ্গল করিবে।।

তদাবধি মীড সনে বাবুর পীরিতি।

মীড তাঁরে মনে প্রাণে ভালবাসে অতি।।

পরামর্শ দিল মীড শ্ৰীশশিভূষণে।

‘দরখাস্ত কর শশী চাকুরী কারণে।।’

স্কুলে আছ থাক তা’তে ক্ষতি নাই।

চাকুরী কারণে কিন্তু চেষ্টা করা চাই।।’

মীড পরামর্শ মতে শ্ৰীশশিভূষণ।

সাবরেজেষ্ট্রার জন্যে করে ‘পিটিশন’।।

মাঝে মাঝে তত্ত্ব লয় গিয়া জেলা’ পরে।

‘কিছু হয় নাই’ জেনে দুঃখে আসে ফিরে।।

এই ভাবে গৃহে বসি চিন্তিত অন্তর।

বিষম দুঃখের তাপে চিত্ত জর-জর।।

হেন কালে উপনীত চারি মহাশয়।

নিজ নিজ দুঃখ বার্ত্তা ঠাকুরে জানায়।।

সবে বলে “শুন প্রভু দুঃখের বারতা।

মোরা সবে রাজ-কার্য নাহি পাই কোথা।।

দ্বারে দ্বারে ঘুরি সবে হইলাম ব্যর্থ।

অন্য জাতি সবে খুঁজে নিজ-নিজ-স্বার্থ।।

আপনি জাতির কৰ্ত্তা সবে মোরা জানি।

উপায় বলুন কিছু মোরা তাই শুনি।।’

এই সব কথা যদি তাহারা বলিল।

প্রভু বলে “দেখ মীড কি করি তা’ বল।।

এই সব ছেলে যদি চাকুরী না পায়।

লেখা পড়া কেহ নাহি করিবে হেথায়।।

এদের ব্যবস্থা তুমি কর মহাশয়।

এরা ধন্য হোক সবে তোমার কৃপায়।।

Page 205 start

প্রভুর বচনে মীড কহিতে লাগিল।

‘শুন বড় কৰ্ত্তা মনে যে ভাব আসিল।।

তব জ্যেষ্ঠ পুত্র যিনি শ্ৰীশশিভূষণ।

দরখাস্ত করিয়াছে চাকুরী কারণ।।

তাঁর জন্য বহু চেষ্টা করিতেছি আমি।

দেখি কিবা করে তারে প্রভু অন্তর্যামী।।

অন্য যারা আসিয়াছে তোমার কে হয় ?

মোর কাছে তুমি দেও সেই পরিচয়”।।

প্রভু বলে ‘শুন মীড আমার বচন।

এরা সবে পুত্র মোর শশীর মতন।।

এ জাতির যে-যেখানে আছে যত ছেলে।

সকলি আমার পুত্র বলি মন খুলে।।

সকলের তরে চেষ্টা কর গিয়ে তুমি।

সেই কার্যে মহাসুখী হ’ব তবে আমি।।”

এতেক শুনিয়া মীড মানিল বিস্ময়।

বাবুগণ প্রতিচাহি জিজ্ঞাসা করয়।।

“কোন কার্য কোন জনে করেছ মনন।

আমার নিকটে সবে বলহে এখন।।

রাধানাথ বলে “স্যার জানাই তোমারে।

‘কানুন গো হ’তে ইচ্ছা আমার অন্তরে।।

মোহন বলিছে কথা করিয়া বিনয়।

“হইতে দারোগা’ বড় মনে ইচ্ছা হয়।।

কুমুদ বিহারীবাবু কহে সর্ব্বশেষে।

“মোর ইচ্ছা বলি মীড আপনার পাশে।।

এই জাতি মধ্যে নাহি উচ্চ পদধারী।

ইচ্ছা হয় করি আমি ডেপুটী-চাকুরী”।।

সব কথা শুনি মীড বলিল তখন।

বড়ই কঠিন কার্য শুন দিয়া মন।।

তোমাদের জাতি-বাৰ্ত্তা রাজার গোচরে।

কেহ কভু বলে নাই নিজে দয়া করে।।

রাজ-ঘরে পরিচিত নহে এই জাতি।

তার লাগি মনে আমি ভয় পাই অতি।।

তথাপি করিব চেষ্টা আমি প্রাণপণে।

যদি বড় কৰ্ত্তা শুধু মোর কথা শুনে।।

রাজ-ঘরে পরিচিত যদি হ’তে হয়।

নানা উপাদান লাগে বলিনু নিশ্চয়।।

বড় কৰ্ত্তা যদি তাহা করেন স্বীকার।

যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করিব এবার।।

বড়কৰ্ত্তা বিনে তাহা পূর্ণ নাহি হবে।

বুঝিয়া বলুন কথা বড় কৰ্ত্তা এবে।।”

মীডের বচন শুনি মহা প্রভু কয়।

“কি কি কার্য প্রয়োজন বল মহাশয়।।

যতই অসাধ্য হোক নাহি করি ভয়।

শুধু যদি তা’তে মোর জাতি ভাল হয়।।

জাতির কারণে আমি করিলাম পণ।

নিশ্চয় করিব আমি অসাধ্য-সাধন।।”

উনিশ শ’ সাত সনে এ সব ঘটনা।

নিজমুখে প্ৰভু যাহা করিল রটনা।।

তের শত চৌদ্দ সনে বাংলা গণনায়।

নমঃশূদ্র রাজকার্যে নিয়োজিত হয়।।

সে সব ঘটনা পরে করিব লিখন।

এবে শুন কিবা বলে মীড মহাজন।।

মীড বলে “বড়কর্ত্তা! শুন দিয়া মন।

কি জন্য তোমার জাতি পতিত এমন।।

এই দেশে উচ্চ বর্ণ হিন্দু যত আছে।

শুন সবে কিবা বলে রাজশক্তি কাছে।।

তোমার জাতির কথা বলে ঘৃণাভরে।

সেই লাগি রাজ শক্তি চেনেনা তোমারে।।

এইজন্য কর এবে পত্রিকা প্রচার।

তা’হলে তোমার জাতি পাবে উপকার।।

আর বলি এই সব যুবকের দল।

এই ভাবে ঘুরে ঘুরে নাহি কোন ফল।।

দরখাস্ত কর সবে চাকুরী কারণে।

দেখি চেষ্টা করে আমি থাকিয়া পিছনে।।

Page 206 start

ইতি মধ্যে এক কার্য কর মহাশয়।

আসিবেন ছোট লাট তোমার জেলায়।

যত সব নমঃশূদ্র একত্র হইয়া।

সবে মিলি দেহ অভিনন্দন লিখিয়া।।

তবে’ত তোমার জাতি হবে পরিচিত।

সবে মিলি দেখা কর লাটের সহিত”।

ডক্টর মীডের মুখে শুনিয়া প্রস্তাব।

ধন্য ধন্য করে প্রভু করি উচ্চরব।

---০---