Page 285

কবি রসরাজ শ্রীশ্রীতারকচন্দ্রের সংক্ষিপ্ত জীবন-কথা ও বিরোধান বিবরণ


“সেই ধন্য নরকুলে লোকে যাঁরে নাহি ভুলেমনের মন্দিরে সদা সেবে’ সর্ব্বজন”.........মাইকেল মধুসুদন দত্ত।

বন্দনা

মহাকবি শ্রীতারক অজ্ঞান-তিমির নাশক।

রসরাজ কবি চুড়ামানি।

প্রেমেক সাধক ধন্য যাঁর আগমন জন্য

ধন্য হল এ-মর ধরণী।।

কন্ঠে যাঁর সরস্বতী সস্তকে ক্ষীরোদপতি

রসনাতে বাণী বাগেশ্বরী।

হৃদয়-আসনে যাঁর গুরুচাঁদ মহেশ্বর

যুগলে প্রেমবারি।।

হরিচাঁদ-তত্ত্ব-কথা হরি লীলামৃত গাঁথা

প্রেম-রসে করিল রচনা।

বঙ্গ দেশে শ্রেষ্ঠ কবি জ্বলন্ত প্রেমের ছবি

কৃপা-কণা করি হে যাচনা।।

তোমার জীবন-কথা পূর্ণ-প্রেম-পবিত্রতা।

কোনভাবে কবির বর্ণনা।

শক্তিহীন আমি দীন লক্ষ গুণে দীন হীন

ভক্তিহীন আমি অভাজন।।

আমার অসাধ্য যাহা কেমনে বর্ণিত তাহা

সাধ্য মাত্র আছ এক পথে।

Page 286 start

তোমার কুসুম তুলি তব পদে পুষ্পজ্ঞলি

দিব আমি আজি কোন মতে।।

যাঁর ফুল তাঁর স্নেহ ফুলে থাকে অহরহ

সেই শুধু ভরসা আমার।

লীলামৃত বৃক্ষ হতে ফুলগুলি নিয়ে হাতে

দাঁড়ালাম আমি দুরাচার।।

তোমার জন্মের কথা যাহা লিখিয়াছ সেথা

তাই পুনঃ লিখিলাম হেথা।

তোমার কুসুম তুমি তুলি রও অন্তর্যামী

নাহি নিলে মনে পাব ব্যথা।।

“ওরে বৎস শোন তোর জন্ম বিবরণ।

তুই যে জন্মিলি তোর পিতার সাধন।।

দেখেছিস বাল্যকালে তোর খুল্লতাত।

জন্ম অন্ধ নাম তার ছিল শম্ভুনাথ।।

তোর জন্ম বিবরণ তোর মনে নাই।

মৌখিক শুনিলি তোর পিসিমার ঠাঁই।।

তোর পিতা কাশীনাথ ছিল কালী-ভক্ত।

শক্তি আরাধি’ত কালী-পদে অনুরক্ত।।

অপুত্রক ছিল বংশে পুত্র না জন্মিল।

বংশ রক্ষা হেতু দুর্গা বলিয়া কান্দিল।।

বট পত্রে লক্ষ দুর্গা নাম লিখে পরে।

সপ্তাহ পর্য্যন্ত শিব স্বস্ত্যয়ন করে।।

আচর্য্য ফকির চাঁদ করে স্বস্ত্যয়ন।

স্বস্ত্যয়ন করি বলে “জন্মিবে নন্দন।।”

স্বর্ণময়ী দশভূজা মূর্ত্তি গড়ি লয়।

পূজা করিলেন শুভ নমবী সময়।।

শ্রীনবকুমার শর্ম্মা পুরোহিত এসে।

পূজা করে জগদ্ধাত্রী পূজার দিবসে।।

সপ্তাহ পর্য্যন্ত চন্ডী করিল পঠন।

অষ্টম দিবসে দিল ব্রাহ্মণ ভোজন।।

নবমী দিবসে পূজা কৈল ভবানীর।

তব পিতা বুক চিরে দিলেন রুধির।।

মার্গ শীর্ষ অমাবস্যা শনিবার দিনে।

তোর মাতা প্রসব করিল শুভক্ষণে।।

নাম করনেতে নাম রাখিল তারক।

আচার্য্য বলিল পুত্র হইবে রচক।।

........শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত

যশোহর জেলাধীনে লহ্মীপাশা সন্নিধানে

নবগঙ্গা নদী বহি যায়।

তাহার উত্তর পারে গৃহ শোভে থরে থরে

জয়পুর বলিগ্রাম কয়।।

মহাসাধু রামদাস লহ্মীপাশা করে বাস

বহু নমঃশূদ্র তথা রয়।

ক্রমে বৃদ্ধি হ’ল বংশ নানা ভাবে নানা অংশ

ভিন্ন ভিন্ন দেশে চলি যায়।।

এই নমঃশূদ্র বংশে জয়পুর মধ্য অংশে

কাশীনাথ আর শম্ভুনাথ।

দুই ভাই এক ঘরে মহাসুখে বাস করে

যেন রাম লহ্মণ সাক্ষাৎ।।

কাশী করে কবি গান দেশে দেশে পায় মান

জন্ম অন্ধ ছিল শম্ভুনাথ।

ঢাকা কিংবা কলিকাতা কাশী যায় যথা তথা

গানে মত্ত ছিল দিন রাত।।

শক্তি উপাসনা করে কালী-মুর্ত্তি ছিল ঘরে

দেবী পদে আর্ত্তি ছিল দৃঢ়।

সব দিকে সুখী কাশী দেখা যায় হাসি হাসি

মনে কিন্তু কষ্ট ছিল বড়।।

পুত্র নাহি জন্মে তার পিতৃ-পুরুষের ধার

কাশী বুঝি না পারে শোধিতে।

দিনে দিনে ম্রিয়মান হ’ল সে কাশীর প্রাণ

চিন্তা করে বহুবিধ মতে।।

Page 287 start

বহু পরামর্শ পরে যে কার্য্য করিল পরে

যত কিচু তার ইতিহাস।

লীলামৃত গ্রন্থ মাঝে যাহা লিখে রসরাজে

আমি তাহা করেছি প্রকাশ।

ফুল্ল যেন পূর্ণচন্দ্র আসিল তারকচন্দ্র

কাশীনাথে হ’ল বাঞ্ছা পূর্ণ।

মনে পেল মহাশক্তি দেখি তারকের কান্তি

রতি-পতি-গর্ব্ব কর চুর্ণ।।

দিনে দিনে দিন যায় আধ স্বরে কথা কয়

তার মধ্যে ভাবের দ্যোতনা।

রূপে শোভা ঢল ঢল হেসে ওঠে খল খল

নাচে যেন রূপের জ্যোছনা।।

পঞ্চম বরষ কালে বসিয়া পিতার কোলে

কাব্য গাঁথা করিল রচনা।

শুনে কাশীনাথে সুখ গর্ব্বে ভরে ওঠে বুক

প্রাণে তাঁর আনন্দ ধরেনা।।

ক্রমে বয়ঃবৃদ্ধি হয় পাঠশালে তাঁরে দেয়

বর্ণশিক্ষা হ’ল একদিনে।

সংযুক্ত বর্ণের খেলা শিক্ষা করে একবেলা

বিস্ময় মানিল সবে মনে।।

আদি পাঠ দিল তাঁরে দিন দিনে শেষ করে

প্রথম মানের শিক্ষা যত।

দ্বিতীয় মানের পড়া সপ্ত দিনে হ’ল সারা

পন্ডিতেরা হ’ল বাক্য-হত।।

এই ভাবে ছয় মাস শিখিলেন সবিশেষ

ছাত্রবৃত্তি পাঠ যাহা ছিল।

কাশীনাথ বলে তাই আর পড়ে কার্য্য নাই

কবি গান-শেখা এবে ভাল।।

ভাগবত রামায়ণ করিলেন অধ্যয়ন

আর পরে শ্রীমহাভারত।

গীতা পড়ে স্মৃতি পড়ে যখনে যে পাঠ ধরে

একেবারে করে কন্ঠ-গতে।।

আঠার পুরাণ পড়ে হেনকালে মনে পড়ে

চৈতন্য চরিতামৃত নাম।

সে গ্রন্থ আনিল ত্বরা দেখে প্রেমরসে ভরা

এতদিনে পূর্ণ মনস্কাম।

দিবারাত্রি পড়ে গ্রন্থ কভু নাহি করে ক্ষান্ত

ভাব দেখি সুখী কাশীনাথ।

মনে মনে ভাব তাঁর তারকেরে অতঃপর

রাখিবেন আপনার সাথ।।

নরে যাহা মনে ভাবে সব পূর্ণ হ’ল কবে

পূর্ণ নহে সকল বাসনা।।

কিছু দিন পরে তার শুন সব সমাচার

বলিতেছি সে সব ঘটনা।।

পঞ্চদশ বর্ষ যবে তার বয়ঃক্রম হবে

নিয়তির অলঙ্ঘ্য নিয়মে।

ছাড়িয়া সংসার-মায়া ত্যাজিয়া নশ্বর কায়া

কাশীনাথ গেল স্বর্গধামে।।

একা ঘরে নিরুপায় ঠেকিয়া বিষম দায়

সে তারক করিল কল্পনা।

পিতৃ-ব্যবসায় ধরি আমি কবি গান করি

তাই হোক আমার সাধনা।।

পিতার “দোঁহার” যত সবে করি হস্তগত

মনোমত কবি গান গায়।

দেখিয়া বালক-প্রায় কেহ নাহি ডেকে তায়

মনোদুঃখে বুক ফেটে যায়।।

একদিন মনোদুঃখে সমস্ত ‘দোহার’ ডাকে

বলিলেন তারক গোঁসাই।

“কি ক’ব দুঃখের কথা হেঁট হ’ল মোর মাথা

দুঃখ-বলা স্থান নাহি পাই।।

তোমরা যাহার সাথে গান কর বিধি মতে

শাস্ত্রজ্ঞান আছে যার সাথে।

তার কাছে কবি গান কেহ নাহি শোনে কেন

বুঝিয়া না পাই কোন মতে।।

Page 288 start

ভোলা, সূর্য্য যেথা গায় বল দেখি মহাশয়

তার কাছে অন্যে কিবা গাবে?

বুঝিলাম তত্ত্ব-সার কবি গান বুঝিবার

এই দেশে নাহি কেহ এবে।।”

এই ভাবে কথা কয় সূর্য্ নারায়ণ তায়

হেসে উঠে খল খল করি।

বলে শুন মহাশয় বলিলেন যে-ভাষায়

শুনে আমি লজ্জা পেয়ে মরি।।

শাস্ত্রজ্ঞান যদি কও তুমি তার কিছু নও

বলিতেছি আমি যাঁর কথা।

এক কথা যদি কয় বলি আমি সুনিশ্চয়

হেঁট করে রবে তুমি মাথা।।

দূরে নহে তাঁর ঘর থাকে সে কালীনগর

নাম তাঁর সাধু মৃত্যুঞ্জয়।

তাঁর মত শক্তিশালী নমঃশূদ্র বংশাবলী

মধ্যে অন্যে দেখা নাহি যায়।।

শাস্ত্রজ্ঞান কত তাঁর শুন সেই সমাচার

ঘটে যাহা নবগঙ্গা তটে।

দেশবাসী সবে জানে সুধী-তর্কপঞ্চাননে

হার মানে তাঁহার নিকটে।।

তিনি অতি মহাজন ভাগ্যে তার দরশন

হল মোর সে কালী নগরে।।

দেখিলাম কতজনে পড়ে আছে সে চরণে

মগ্ন সাধু আপনা ভিতরে।।”

বলে সূর্য্যনারায়ণ তারকের মুগ্ধ মন

মনে মনে করে আলোচনা।

“শুনি তার বিবরণ আকৃষ্ট হয়েছে মন

মনে মনে জাগিছে কল্পনা।।

আমি যাব তাঁর কাছে দেখি সেথা কিবা আছে

কোন গুণে সেই গুণমণি।

এমন শকতি পায় বসে আছে কোনাশায়

কোন গুণে এত বড় গুণী।।”

প্রকাশ্যে তারক বলে সূর্য্ নারায়ন-স্থলে

“শোন সূর্য্য আমার মনন।

সে কালীনগরে যাব তোমাকেও সঙ্গে নিব

মৃত্যুঞ্জয়ে করি দরশন।।

মোর মনে এই কয় মৃত্যুঞ্জয়ী মৃত্যুঞ্জয়

নবরূপে করিতেছে খেলা।

আমার পাগল মন করিতেছে আকর্ষণ

শোনা-মাত্র প্রাণে হ’ল জ্বালা।।

দিনস্থির করি দোঁহে চুপ করে গৃহে রহে

তারকের চোখে ঘুম নাই।

মন যেন দেহ ছাড়ি চলিয়া গিয়াছে উড়ি

শূণ্য বুকে ঘন ছাড়ে হাই।।

ব্যাকুল অন্তরে ঘুরে নদীতীরে বনান্তরে

ঘন ঘন কেন্দে উঠে প্রাণ।

রাত্রি শেষে নিদ্রা ঘোরে মহামায়া বলে তাঁরে

শুনি বলি তাহার আখ্যান।।

---০---