Page 339

মহাত্মা শশীভূষণ ঠাকুর

বারশ’ পঁচাত্তর সাল ভাদ্র মাসেতে।

শ্রীশশীভূষণ জন্মি নিলেন ধরাতে।।

জন্মকালে হরিচাঁদ গৃহেতে আছিল।

সুপুত্র জন্মিবে বলি আশীষ করিল।।

পরম সুন্দর রূপ চারু কলেবর।

রূপ দেখি আনন্দিত যত নারী নর।।

চন্দ্র জ্যোতিঃ মুখে দেখি হরি বলে হাসি।

“শশি সম রূপে পুত্র নাম থাক শশী।।

দিনে দিনে বাড়ে শশী স্বর্গ শশী প্রায়।

সুধীর মধুর ভাষী আধ কথা কয়।।

পঞ্চম বয়ষ কালে বিদ্যারম্ভ হয়।

গঙ্গাচরণ পন্ডিত ঘৃতকান্দী গায়।।

তেঁহ ঠছাই কিছুকাল লেখাপড়া করি।

বর্ণশিক্ষা ব্যাঞ্জনাদি এল সব সারি।।

নমঃকুলে জন্ম রঘুনাথ সরকার।

শিক্ষক সাজিয়া এল ওড়াকান্দী পর।।

ওড়াকান্দীবাসি যত স্বজাতির গণ।

শিক্ষাকর্য্যে রঘুনাথে করিল বরণ।।

গ্রাম মধ্যে গৃহ এক নির্ম্মাণ করিল।

সেই ঘরে পাঠশালা স্থাপতি হইল।।

নমঃ করে বিদ্যাদান অদ্ভুত ঘটনা।

বর্ণহিন্দু সবে করে জল্পনা কল্পনা।।

নমঃ করে বিদ্যাদান নমঃ শিক্ষা পায়।

নমঃ যদি শিক্ষা পায় কি হবে উপায়।।

তাই ভেবে বর্ণহিন্দু আলোচনা করে।

প্রকাশ্যে বলিতে নারে নমঃশূদ্র ডরে।।

নমঃ মধ্যে আদি স্কুল ওড়াকান্দি হল।

নমঃশূদ্র ছাত্রবর্গ সকলি জুটিল।।

এই পাঠশালে পড়ে শ্রীশশীভূষণ।

নিম্ন ছাত্রবৃত্তি শিক্ষা করে সমাপন।।

ছাত্রবৃত্তি কেন্দ্র রয় মহকুমা পরে।

মাদারীপুর বলিয়া জানে সর্ব্ব জনে।।

ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষাতে শ্রীশশীভূষণ।

কৃতিত্বে করিল পাশ জানে সর্ব্বজন।।

উচ্চছাত্রবৃত্তি শিক্ষা করে অতঃপর।

পরীক্ষা করিল দান মহাকৃমা পরে।।

বারশ নব্বই সালে মধ্যছাত্রবৃত্তি।

পাশ করি বড় বাবু লভিবেন বৃত্তি।।

বড়ই মেধাবীছাত্র শ্রীশশীভূষণ।

শিক্ষকে বাসিত ভাল পুত্রের মতন।।

দেশ মধ্রে শিক্ষা শেষ অতঃপর হল।

ইংরেজী শিখিতে প্রাণে কামনা জাগিল।।

পিতৃপদে মনোখেদে করে নিবেদন।

“ইংরেজী শিখিতে কিবা উপায় এখন।।

এই দেশে নাহি তাতঃ সেই বিদ্যালয়।

প্রাণের বাসনা বুঝি প্রাণে হ’ল ক্ষয়।।

দয়া করি মোরে পিতাঃ পাঠান বিদেশে।

রাজবিদ্যা ল’ব শিখি বিদেশেতে বসে।।

Page 340 start

পুত্র মুখে শুনি বাণী প্রভু বড় সুখী।

বলে “শশি থাক বসি ভয় আছে কি?

প্রাণে যদি ইচ্ছা থাকে অবশ্য পুরিবে।

রাজবিদ্যা শিক্ষা তুমি নিশ্চয় করিবে।।”

মনে চিন্তা করে প্রভু কি করি উপায়?

পুত্রধনে শিক্ষা লাগি রাখিব কোথায়।।”

হেনকালে উপনীত তারক গোঁসাই।

গানে জ্ঞানে প্রেমে ধ্যানে যাঁর তুল্য নাই।।

হরিচাঁদে সমর্পিত আত্মা মন তনু।

জ্ঞানে বৃহস্পতি তথা রূপে যেন ভানু।।

অভেদাত্মা “হরিগুরুচাঁদ” বলি জানে।

হরিচাঁদ গুরুচাঁদ এক জানি মানে।।

শ্রীহরির লীলাকালে যেমন আসিত।

সেই মত ওড়াকান্দী করে যাতায়াত।।

সেই যে তাকরচন্দ্র দিল দরশন।

ভক্তিভাবে পূজিলেন শ্রীগুরু-চরণ।।

আনন্দে হাসিয়া প্রভু কুশল জিজ্ঞাসে।

তারক উত্তর করে আঁখিজলে ভেসে।।

“তব কৃপা দৃষ্টি প্রভু যার “পরে রয়।

অকুশল তার সঙ্গ ছাড়ি দূরে যায়।।

তব কৃপা বারিধারা পড়ে যেই শিরে।

দুরন্ত সংসার তাপে কি করিতে পারে?

বারি মধ্যে শীতলতা গুণ আছে জানি।

শীতলতা গুণে স্নিগ্ধ হয় সব প্রাণী।।

যেই পাত্রে থাকে বারি তাতে ভেদ নাই।

শীতলতা রহে সদা বলিহারি যাই।।

তব কৃপা-বারি প্রভু তাপ-জ্বালা-নাশী।

যেই পায় সেই স্নিগ্ধ তাপমধ্যে বসি।।

বড়ই কুপাত্র আমি পাপ-তাপে জারা।

আমা হতে প্রভু-কার্য্য কিছু নহে সারা।।

বিফল জীবন বটে বিফল জনম।

নাহি মোর ভক্তি শক্তি নাহি পরাক্রম।।

তোমার কৃপার গুণে বলিহারি যাই।

কৃপাগুণে সর্ব্বস্থানে মহাশান্তি পাই।।

তাই বলি কৃপাগুণে আছি যে কুশলে।

তব কৃপা রাখে মোরে জলে কিংবা স্থলে।।

বিনয় বচনে যদি বলিল তারক।।”

ব্যাখ্যা তারে করে প্রভু হইয়া পুলক।।

আহারাদি শেষে ডাকি বলে তারকেরে।

“শোন শোন হে তারক বলি যে তোমারে।।

তব বাসস্থল হয় জয়পুর গ্রামে।

নবগঙ্গা তীরে দেশ সুন্দর সুঠাম।

নানা বর্ণ বাস করে সে গ্রাম মাঝারে।

বিশেষতঃ সুশিক্ষিত সবে বাস করে।।

ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য আর নবশাখ।

কুম্ভকার কর্ম্মকার নহেত একক।।

নমঃশূদ্র তেলী মালী আছে বহুতর।

সর্ব্ববর্ণ সম্মিলনে গ্রামটি সুন্দর।।

শিক্ষা দীক্ষা সভ্যতাদি সকলি রয়েছে।

ধনী জ্ঞাণী সুবিদ্বান কতই জন্মেছে।।

আমাদের দেশে দেখ তার কিছু নাই।

আলোহীন অন্ধ দেশে বাস করি তাই।।

স্কুল পাঠশালা দেখ আছে মাত্র কটা।

বাংলা শিক্ষা দেয় শুধু কিছু পরিপাটি।।

ইংরেজী শিক্ষার কেন্দ্রে এই দেশে নাই।

পুত্রগণে বল দেখি কোথায় পাঠাই।।”

এতেক বচন প্রভু কহে মনোদুঃখে।

তারক শুনিয়া বাণী রহে অধোমুখে।।

ক্ষণকাল পরে বলে “দয়াল ঠাকুর।

মনোকথা বলি খুলে দুঃখ কর দূর।।

যদি মম সাধ্য মধ্যে কোন কিছু রয়।

তব কৃপা বলে আমি করিব নিশ্চয়।।”

প্রভু কর “ হে তারক ছাত্রবৃত্তি পড়ি।

শশী রহে বাড়ী বসে উপায় কি করি?

Page 341 start

তাহার বড়ই ইচ্ছা উচ্চ বিদ্যা শিখে।

উপায় জিজ্ঞাসি তাই এই দায় ঠেকে।।”

শ্রীতারক বলে তবে করিয়া মিনতি।

“আমা হতে হতে পারে কোনরূপে গতি?”

প্রভু বলে “মম ইচ্ছা তব গৃহে থাকি।

শশী ধন্য হবে কত উচ্চ বিদ্যা শিখি।।

তব গৃহে রহে যদি শ্রীশশী ভূষণ।

মম গৃহে আছে পুত্র এই ভাবি মন।।”

প্রভুর বচন শুনি তারক কান্দিল।

গললগ্নীকৃতবাসে অনেক কহিল।।

“পরম সৌভাগ্য মোর তুল্য দিতে নাই।

নিজগুণে কৃপা করে ক্ষীরোদের সাই।।

নিজ মুখে কৃপা করে কহিয়াছে বাণী।

জয়পুর গৃহ তবে এ ভাগ্য রাখানি।।

বড় বাবু নিজ গৃহে যাইবে আপনি।

তব ইচ্ছা পূর্ণ হোক ওগো গুণমণি।।”

শ্রীশশীভূষণ পরে পিতৃ-আজ্ঞা ক্রমে।

উপনীত শিক্ষা লাগি জয়পুর গ্রামে।।

লহ্মীপাশা হাই স্কুল নিকটে আছিল।

শুভদিনে সেই স্কুলে প্রবেশ করিল।।

বড়ই আগ্রহ তার বিদ্যার কারণে।

সুশিক্ষা লভিল কত নিজ চেষ্টাগুণে।।

উচ্চবর্ণ হিন্দু যত স্কুলেতে আছিল।

শ্রীশশীভূষণ সবে পরাস্ত করিল।।

কিবা শিক্ষা, কি ভদ্রতা, অথবা চরিত্রে।

সর্ব্বগুণ সমন্বয় যেন এক পাত্রে।।

শিক্ষকেরা কানাকানি করি কথা কয়।

নমঃকুলে হেন ছেলে কিসে জন্ম লয়?

রূপে গুণে মানামানে বর্ণহিন্দু হতে।

এই ছেলে হীন নহে কভু কোন মতে।।

যে জাতির ঘরে জন্মে এ হেন তনয়।

সে জাতি জাগিবে ধ্রুব নাহিক সংশয়।।

কেহ বলে “ওরে ভাই কথা সত্য বটে।

দৈবশক্তি বিনা কভু জাতি নাহি ওঠে।।

এই নমঃশূদ্র দেখ জঘন্য আছিল।

দৈব শক্তিধারী হরি এই কুলে এল।।

শ্রীহরি ঠাকুর বলে হয়েছে উপাধি।

তাঁর নামে কতজনে মুক্ত হয় ব্যাধি।।

সেই বংশে তার পুত্র গুরুচাঁদ নাম।

তেঁহ বটে গুণীশ্রেষ্ঠ সুন্দর সুঠাম।।

তাঁহার নন্দন এই শ্রীশশীভূষণ।

“আত্মাবৈ জায়তে পুত্রঃ এই সে লহ্মণ।।

কানাকানি করে “বটে প্রশংসাদি করে।

প্রকাশ্যতঃ হিংসা দ্বেষ করে ব্যবহারে।।

সে কালে যতেক হিন্দু পরিচয় দিত।

অশিক্ষিত জাতিগণে ঘৃণাই করিত।।

ধনে মানে রাজদ্বারে বর্ণ হিন্দুগণ।

উচ্চপদ লাভ করি করিত শাসন।।

দলিত পীড়িত যত অশিক্ষিত জন।

সমাজের নিম্নস্তরে আছিল তখন।।

অস্পৃশ্য করিয়া কত রাখিত সমাজে।

সেই জন্য কত জন হিন্দুধর্ম ত্যাজে।।

সেদিন যে ভুল হিন্দু করেছে জীবনে।

আজি ফলভোগ করে কালের পেষণে।।

হিংসা ভাব দেখি শশী মনে দুঃখ পায়।

মনে -ভাবে এই দুঃখ কোথা গেলে যায়।।

রাজধানী কলিকাতা প্রধান শহর।

সভ্যতার শ্রেষ্ঠ-কেন্দ্র ভারত ভিতর।।

“সংবাদ পত্রিকাদি কত প্রচার হইত।

শিক্ষালয়ে শিক্ষকেরা গ্রহণ করিত।।

সে সংবাদপত্র যোগে শ্রীশশি ভূষণ।

দেশ বিদেশের কথা করিত পঠন।।

ব্রাহ্ম সমাজের নীতি পড়ে মন দিয়া।

সেই নীতি পড়ি তার মুগ্ধ হল হিয়া।।

Page 342 start

মনে ভাবে হেন দিন কবে মোর হবে।

কলিকাতা শহরেতে গিয়ে-দুঃখ যাবে।।

মহাজন বাক্য আছে শাস্ত্র গ্রন্থাদিতে।

“ভাবিলে ভাবনা সিদ্ধি পারিলে ভাবিতে।।


যাদৃশী ভাবনার্যস্য সিদ্ধিযাতি তাদৃশী।।”

শ্রীশশীভূষণ যবে জয়পুর যান।

তাহার কিঞ্চিত পূর্ব্বে আছয় প্রমাণ।।

চাঁদসী নিবাসী ধন্য নমঃকুল জাত।

ডাক্তার উপাধিধারী বহুত বিখ্যাত।।

বিষ্ণুহরি নাম আদি উপাধিতে দাস।

মনসা দেবীর বরে লভে মান যশ।।

বিনা অস্ত্রাঘাতে করে ক্ষত চিকিৎসা।

ভুভারতে ধন্য আজি তাহার ব্যবসা।।

তাঁর যত বংশধর শিষ্য সংখ্যা যত।

চাঁদসী ডাক্তার বলি সবে পরিচিত।।

সেই বংশে জগবন্ধু নামেতে প্রধান।

শ্রীহরির জীবকালে ওড়াকান্দী যান।।

হরিকে দেখিয়ে তার আঁখি খুলি যায়।

বহুৎ বিনয়ে তেহ হরিকে পূজায়।।

তাহে প্রীতি হরিচাঁদ করে আশীর্ব্বাদ।

“পূর্ণ হোক তব মনে যাহা কিছু সাধ।।”

ওড়াকান্দী ধাম দেখি চিত্ত বিমোহিত।

শ্রীশশীভূষণে দেখি হল বড় প্রীত।।

অষ্টম বরষ মাত্র বয়স তাঁহার।

অপরূপ রূপ যেন পূর্ণ শশধর।।

বড়ই বিনয়ী তাতে অমি মিষ্ট ভাষা।

মনে মনে জগবন্ধু করে কত আশা।।

এমন সোনার চাঁদ যদি হাতে পাই।

ইচ্ছা হয় কন্যা দানে ধন্য হয়ে যাই।।

হরির অপূর্ব্ব লীলা আদি অন্ত নাই।

মন জানি আশীর্ব্বাদ দিলেন তাহাই।।

জগবন্ধু যেইকালে প্রস্থান করিল।

শ্রীগুরুচরণে ডাকি শ্রীহরি কহিল।।

“শুন গুরুচাঁদ আজি মোর কথা লও।

কুলে শীলে ধন্য যদি হইবারে চাও।।

শ্রেষ্ঠ বংশ হতে কন্যা গৃহেতে আনিবে।

তোমার গৃহেতে তবে রাজা জন্ম লবে।।

এই যে ডাক্তার দেখ চাঁদসী নিবাসী।

মহাশ্রেষ্ঠবংশ জান পরম বিশ্বাসী।।

এই শ্রেষ্ঠ বংশ হতে এক কন্যা এনে।

অবশ্য বিবাহ দিবে তব পুত্র সনে।।

‘যথা আজ্ঞা’ বলি প্রভু স্বীকার করিল।

বারশ’ নব্বই সালে সেই দিন এল।।

জগবন্ধু কৃষ্ণদাস প্রসন্ন বিপিন।

বংশমধ্যে শ্রেষ্ঠ সবে জ্ঞানেতে প্রবীণ।।

চারিজন একতরে এল ওড়াকান্দী।

সবে করে গুরুচাঁদ সখ্য-গুণে বন্ধী।।

এ সময়ে জয়পুরে শ্রীশশীভূষণ।

লহ্মীপাশা হাই স্কুলে করে অধ্যয়ন।।

দুইদিন ডাক্তারেরা ওড়াকান্দী রহে।

মনোগত কথা কিন্তু কিছু নাই কহে।।

তৃতীয় দিবস বেলা প্রহর সময়।

সে জগবন্ধু ডাক্তার হাসি হাসি কয়।।

“বড়কর্ত্তা তব ঠাঁই এক নিবেদন।

দয়া করি সেই কথা করুন শ্রবণ।।

এই যে প্রসন্ন মম ভ্রাতুপুত্র হয়।

বড়ই অভিজ্ঞ ইনি চিকিৎসা বিদ্যায়।।

বংশ মধ্যে ইহ সম নাহি অন্য কেহ।

কলিকাতা বাস করে করি নিজ গৃহ।।

আমাদের বংশে ছিল শ্রীহরমোহন।

প্রসন্নের খুল্লতাত অমি মহাজন।।

ভারত ব্যাপিয়া যশ ছিল চিকিৎসায়।

নিজ আয়ে গৃহে করে সে কলিকাতায়।।

Page 343 start

অপুস্কক বলি তার অর্থ বিত্ত যত।

লভিয়াছে এ প্রসন্ন আইনানুগত।।

অনঙ্গমোহিনী নাম্নী বড় গুণবতী।

এক কন্যা আছে ঘরে চির আয়ুষ্মতী।।

তব জ্যেষ্ঠ-পুত্র নাম শ্রীশশীভূষণ।

দেবকান্তি সমরূপ করি দরশন।।

দয়া করি এই কন্যা সেই পুত্র লাগি।

গ্রহণ করুন মোরা এই ভিক্ষা মাগি।।”

এতেক বচন যদি বলিল ডাক্তার।

ক্ষণ কাল স্তুব্ধ রহে প্রভু অতঃপর।।

চন্দ্রজ্যোতিঃ সম হাসি অধরে আনিয়া।

সারগর্ভ বাক্য কহে হস্ত দোলাইয়া।।

“শুনহে ডাক্তার বাবু! আমার বচন।

পবিত্র প্রস্তাব সবে করেছ কথন।।

সপ্তবর্ষ পূর্ব্ব মম পিতা বিদ্যামানে।

এই গৃহে একবার আসিলা আপনে।।

আপনি প্রস্থান যবে কর মহাশয়।

মমপিতা মোর প্রতি এক বাণীকয়।।

তব বংশ হতে এক কন্যা আনিবারে।

আজ্ঞাকরি মোর পিতা গিয়াছে আমারে।।

মম মনোমধ্যে বটে আছে সেই সাধ।

বর্তমানে সেই কার্য্য আছে কিছু বাদ।।

আমার মনের কথা আপনার ঠাঁই।

অকপটে ধীরে ধীরে বলিবারে চাই।।

এই নমঃশূদ্র জাতি দেখুন বিচারি।

কি কারণে হীন ভাবে আছে দেশে পড়ি?

মোর মনে এই বলে শিক্ষার অভাবে।

আর্য্য হয়ে ত্যজ্য মত রহিয়াছে সবে।।

প্রাণের বাসনা মোর প্রাণপণ যত্নে।

এ জাতিকে উচ্চ করি দিয়া বিদ্যা রত্নে।।

এজীবনে তিন কর্ম্ম জানিবে নিশ্চয়।

বিধাতার ইচ্ছা ক্রমে ঘটিছে সদায়।।

জন্ম, মৃত্যু পরিণয় এই কর্ম্ম তিন।

বিধাতার ইচ্ছাধীন জানিবে প্রবীণ।।

মম জ্যেষ্ঠ পুত্র শশী জয়পুর গাঁয়।

উচ্ছ বিদ্যা শিক্ষা করে উচ্চ বিদ্যালয়।।

মম মনে এই ইচ্ছা শিক্ষা শেষ হলে।

পুত্রের বিবাহ দিব উপযুক্ত কালে।।

এই ত বলিনু আমি মম অভিপ্রায়।

আপনি বলুন তবে যাহা মনে লয়।।”

শ্রীগুরুর বাক্য শুনি জ্ঞানী জগবন্ধু।

কহিতে লাগিল কথা যেন নাচে সিন্ধু।।

“ধন্য ধন্য বড়কর্তা অপূর্ব্ব ভারতী।

হেন বাক্য শুনি নাই কাহার সংহতি।।

এ জাতির মর্ম্ম কথা আজি তব ঠাঁই।

শুনিয়া তাপিত প্রাণে বড় শান্তি পাই।।

মহাশিক্ষা তব ঠাঁই লভিনু সম্প্রতি।

শিক্ষা ভিন্ন কভু নাহি উঠিবে এ জাতি।।

তব আজ্ঞা শিরোধার্য্য করিনু নিশ্চয়।

তথাপি প্রার্থণা এক মনোমধ্যে রয়।।

ইংরাজী বিদ্যার লাগি তব পুত্রবর।

প্রাণপণে চেষ্টা করে থাকি পরঘর।।

বিশেষতঃ কলিকাতা বঙ্গ রাজধানী।

সর্ব্ব শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কেন্দ্র সব ইহা জানি।।

এই ভাবে কর্ম্ম যদি হয় সমাপন।

নির্ব্বিঘ্নে করিবে শশী বিদ্যা অধ্যায়ন।।

আমাদের গৃহে থাকি নিজ-পুত্র প্রায়।

বিদ্যা শিক্ষা করিবেক যত মনে লয়।।”

এই কথা প্রভু প্রতি বলে জগবন্ধু।

মনে মনে চিন্তা করে করুনার সিন্ধু।।

শশীর প্রাণের ইচ্ছা রাজবিদ্যা শিখে।

ইহা হতে শুভযোগ আরেো কোথা থাকে?

করুণা রুপিণী দেবী হরিপ্রিয়া সতী।

শান্তি মাতা পদে বার্ত্তা করে অবগতি।।

Page 344 start

সানন্দ অন্তরে মাতা আজ্ঞা করি দিল।

বিবাহের দিন ধার্য্য তবেত হইল।।

মহাসমারোহে হয় পরিণয় কার্য্য।

উভে উভ সসমভাব নহে কিছু ত্যজ্য।।

জয়পুর ছাড়ি তবে শ্রীশশীভূষণ।

কলিকাতা থাকি করে বিদ্যার সাধন।।

কটন স্কুলে প্রথমে প্রবেশ।

ইংরেজী বিদ্যার জ্ঞান লভিল বিশেষ।।

প্রবেশিকা পরীক্ষঅতে কৃতিত্ব সহিত।

উত্তীর্ণ হইল তেঁহ সবে হ’ল প্রীত।।

ঢাকা শহরেতে ছিল জগন্নাথ নাম।

উন্নত কলেজ এক সুন্দর সুঠাম।।

প্রভুর তৃতীয় পুত্র শ্রীউপেন্দ্র নাথ।

পড়িবারে গেল ঢাকা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সাথ।।

কলেজে পড়েন শশী ইস্কুলে উপেন্দ্র।

এক ঠাঁই দুই ভাই অভেদ অভিন্ন।।

দৈবের লিখন দেখ খন্ডন না যায়।

দৈবশক্তি বলশালী মহাজনে কয়।।

অচিন্ত্য দুঃখের ভরা তথা সুখ-ভার।

জীব ভাগ্যে আসে নিত্য জান পরস্পর।।

এ কারণে দৈবশক্তি জানিবে প্রবল।

অসাধ্য সাধন করে দৈব মহাবল।।


“অচিন্তিতানি দুঃখানি যথৈবায়ান্তি দেহিনাম।সুখান্নাপি তথামন্যে দৈবমাত্রাতিরিচ্যাতে।।”

দৈবযোগে সে উপেন্দ্র পড়ে মহারোগে।

তাহার শুশ্রূষা শশী করে রাত্রি জেগে।।

ওড়াকান্দী ডাকঘর ছিল না তখন।

দেশবাসী জানিত না পত্রাদি লিখন।।

বহু দূরে ডাকঘর ছিল সে সময়।

চিঠি দিলে দশ দিন পরে সবে পায়।।

ঢাকা হতে চিঠি লিখে শ্রীশশীভূষণ।

এদিকে সঙ্কটাপন্ন ভ্রাতার জীবন।।

চারিদিন পরে তবে সে উপেন্দ্র নাথ।

ত্যজিল জীবন যেন হ’ল ইন্দ্র পাত।।

এই ভাবে সে-উপেন্দ্র ত্যাজিল জীবন।

সংক্ষেপে জীবনী তাঁর করিব লিখন।।

বারশ’ পঁচাশী সালে তেঁহ জন্ম লয়।

তের শত এক সালে দেহ ছাড়ি যায়।।

শাস্ত্রে পাই কার্ত্তিকেয় বড়ই সুন্দর।

“মরা” হতে রূপে শ্রস্ঠ নামটি কুমার।।

তাহার অধিক রূপ সে উপেন্দ্র ধরে।

রূপের ঝলক সদা নাচে দেহ ঘিরে।।

শুধু রূপ নয় হায়! বহু শক্তিধারী।

তাঁর শক্তি দেখে সবে বলে “বলিহারী।।”

পঞ্চবর্ষ মাত্র যবে তাঁর বয়ঃক্রম।

শক্তি ক্ষেত্রে দেখাইল অপূর্ব্ব বিক্রম।।

অর্দ্ধ মণ ‘বাটখারা’ লৌহের নির্ম্মিত।

অনায়াসে সে উপেন্দ্র দূরে নিয়ে যেতে।।

পিতামাতা স্নেহ তাঁরে করে অতিশয়।

পিতামাতা বন্ধু ভ্রাতা সবে ভাল কয়।।

আত্ম-সম্ভ্রমেতে ছিল অতি সচেতন।

সে সম্বন্ধে শুন এক আশ্চর্য্য ঘটন।।

একদা প্রভুর সঙ্গে উপেন্দ্র সুজন।

প্রতিবেশী গৃহে গেল করিতে ভোজন।।

বয়সে বালক মাত্র খেলাধূলা করে।

খেয়ালের বেশ গেল পিতৃসঙ্গ ধরে।।

আহারের কালে হল মহা গন্ডগোল।

বাড়ী শুদ্ধ পড়ে গেল মহা কলরোল।।

অপরের পক্ষে তাহা বেশী কিছু নয়।

উপেন্দ্রর পক্ষ হল মন্দ অতিশয়।।

একখানি বড় পীড়ি প্রভুকে দিয়াছে।

বড় থাল এনে তার সম্মৃখে রেখেছে।।

তার পাশে ঠাঁই করে উপেন্দ্রের জন্য।

ভিন্ন পীড়ি দিল তারে থাল দিল ভিন্ন।।

Page 345 start

কিন্তু পীড়ি থালা গ্লাস সবগুলি ক্ষুদ্র।

দেখিয়া উপেন্দ্র ক্ষেপে যেন মহারুদ্র।।

“আমাকে দেখিয়া ছোট উপেক্ষা করিল।

কিছুতে রবনা হেথা বাবা তুমি চল।।”

গৃহকর্ত্তা পড়িলেন ঘোর সমস্যায়।

কোনরূপে সে-উপেন্দ্র শান্ত নাহি হয়।।

বড় থাল বড় পীড়ি সব-কিছু দিল।

তবু বলে “মোরে কেন উপেক্ষা করিল।।”

পরিশেষে গৃহকর্ত্তা ক্ষমা চাহি লয়।

তবে সে উপেন্দ্রনাথ শান্ত হয়ে খায়।।

পিতৃ-বুকে এই স্মৃতি ছিল চিরদিন।

বলিতে বলিতে প্রভু হতেন মলিন।।

শ্রীশশীভূষণে তেঁহ ভালবাসে বেশী।

তাঁর কাছে কাছে তেঁহ থাকে দিবানিশি।।

পাঠ লাগি শশী যবে ঢাকা চলি যায়।

উপেন্দ্র চলিল সাথে পাঠের আশায়।।

নমঃশূদ্র ছাত্র যত এক সঙ্গে রয়।

নিজ হাতে পাক করে অনেক সময়।।

এতদিন সে উপেন্দ্র করিলেন পাক।

ডা’ল তরকারী রাঁধে আর রাঁধে শাক।।

দৈবের লিখন তাহা কে খন্ডা’বে বল?

পাকরূপে মহাকালে উপস্থিত হ’ল।।

শাক মধ্যে ‘লঙ্কা বাঁটা’ বেশী দেয় হয়।

ঝাল দেখে তারা সবে শাক ফেলে দিল।।

সকলে শশীকে বলে “দেখুন মশায়।

আপনার ভাই কার্য্য করেছে অন্যায়।।”

সকল জানিয়া শশী বলিল তখনে।

“কি উপেন্দ্র শাকে এত ঝাল দিলে কেনে।।”

আত্মসম্ভ্রমেতে তাঁর আঘাত পড়িল।

বলে “দাদা মাপ চাই, বেশি নাহি বল।।

কিছু ফেলে নাহি দিব খাইব সকলি।

নিশ্চিত হইয়া যাও কলেজেতে চলি।।”

কলেজ চলিল শশী উপেন্দ্র তখন।

সব শাক একা একা করিল ভক্ষণ।।

অল্প পরে কাল রোগে তাঁরে আক্রমিল।

রাহুগ্রস্ত চন্দ্রসম ঢলিয়া পড়িল।।

“আত্মকর্ষণ” যন্ত্রে তেঁহ কিছু দিন পরে।

বলিলেন কথা তবে শশীর গোচরে।।

“তব পুত্ররূপে দাদা আমি জন্ম লব।

তোমার স্নেহের দান গ্রহণ করিব।।”

সে সব কাহিনী যত পরে জানা যাবে।

এবে শোন শশীবাবু কি করে কি ভাবে?

মহাশোকে মুহ্যমান শ্রীশশীভূষণ।

ক্ষণে ক্ষণে ভ্রাতৃ-জন্যে করিছে রোদন।।

এদিকে যেদিন চিঠি পৌঁছে ওড়াকান্দী।

ক্ষণে ক্ষণে লহ্মীমাতা উঠে কান্দি কান্দি।।

চিঠির বৃত্তান্ত শুনি প্রভু গুরুচন্দ্র।

সবাকে ডাকিয়া বলে “সংবাদ যে মন্দ।।

কি জানি কি আছে ভাগ্যে বলা নাহি যায়।

শশীকে আসিতে বাড়ী লিখহ ত্বরায়।।”

সবে বলে “ওহে প্রভু মানিনু বিস্ময়।

শশীকে আসিতে বল উপেন্দ্র কোথায়?”

হাসিয়া বলেন ‘প্রভু তাতে কাজ কিবা।

বাড়ীতে আসিলে শশী সকলি শুনিবা।।

মাতা কেন্দে বলে নাথ একি সমাচার।

তাহলে কি গেছে চলে উপেন্দ্র আমার?

প্রভু বলে “শান্ত হও, ব্যস্ত কেন আগে?

ডাকিরে ঘুমন্ত শত্রু নিজে শত্রু জাগে।।

আসুন না শশী বাড়ী শুনি সমাচার।

পারে যদি উপেন্দ্রও সাথী হোক তার।।

প্রভুর গভীর লীলা নরে বোঝা যায়।

বাক্য-ছলে মৃত্যু-বার্ত্তা প্রভু বলে যায়।।

নিরাশার মাঝে আশা সকলে করিল।

শীঘ্র করি চিঠি লিখি শশীকে আনিল।।

Page 346 start

একক শশীকে দেখি কাঁদিছে জননী।

‘উপেন্দ্র কোথায় বাপ বল তাই শুনি?

একসাথে দুই ভাই বিদেশেতে গেলে।

ভাই ফেলে একা কেন আজ বাড়ী এলে?

কুলের গৌরব তুই জ্যেষ্ঠ-পুত্র মোর।

বহু মূল্য মণি এক সাথে দিনু তোর।।

মণি হারা ফণী মত তোরে দেখা যায়।

আমার প্রাণের মণি রাখিলি কোথায়?”

এমত বিলাপ মাতা করে লোকাচারে।

গর্জ্জন করিছে প্রভু আসি অন্তঃপুরে।।

“মরা শব লাগি কান্দ’ ওরে জ্ঞানহীনা।

দেহ ছেড়ে গেলে প্রাণ কখনো ফিরে না।।

মরণ জানিবে ধ্রুব দেহধারী পক্ষে।

শোক দুঃখ যত দেখ প্রভু পরীক্ষে।।


“জীবানাম মরণঃ ধ্রুবঃঅসাধ্যোয়ং নিবারণেন সদা।।”

কেবা কার পুত্র কন্যা কেবা কার পতি?

সম্বন্ধ-বিহীন সবে ভ্রমিতেছে ক্ষিতি।।

মায়া-ঠুলী চোখে দিয়ে যত জীব গণ।

যারে দেখে তারে বলে “আমার আপন।।”

যখনে মরণ আসি ভাঙ্গে মায়া-ঠুলী।

আপন স্বরূপে দেখে দৃষ্টি যায় খুলি।।

আর না পাছের ডাকে সেই ফিরে চায়।

কর্ম্মফল অনুসারে যথা তথা যায়।।

শোক নহে সত্য শুধু মায়ার বাহন।

স্নেহ-কৃপা-শৃঙ্গে জীবে করিছে শাসন।।

এতই অজ্ঞান জীব এ ভবে আসিয়ে।

আঘাতের ব্যথা থাকে নীরবে সহিয়ে।।

দেখ ত শোকের কান্ড কত ভয়ঙ্কর।

অবিরাম বক্ষে কত করিছে প্রহার।।

ছাড়হ শোকের ছলা চিত্ত কর স্থির।

এসব জানিবে লীলা শুধু শ্রীহরির।

আর শুন গূঢ় কথা কহি তব ঠাঁই।

শোকে করে দেখ কিন্তু বিরুদ্ধেতে যাই।।

যদ্যপি প্রভুর মনে হয়ে থাকে ভাব।

পুত্র নিয়ে শোক দিয়ে দিবে পরভাব।।

তাঁহাদের ইচ্ছায় সুখ যদি নাহি পাই।

দুঃখ পেয়ে কেন্দে কেন বিরুদ্ধেতে যাই?

তাঁর ইচ্ছা যাহা হ’ল তাই ধন্য মানি।

তাঁহার ইচ্ছায় শুভ এই মাত্র জানি।।

মোরা যে তাঁহার প্রিয় যত জীব গণ।

অপার করুণা গুণে পালে সর্ব্বক্ষণ।।

যা কিছু মোদের দেয় সকলি সুন্দর।

সকলি আনন্দময় প্রেমের আকর।।

শোক দুঃখ তূল্য সব জান তাঁর ঠাই।

আনন্দ-মূরতি তিনি নিরানন্দ নাই।।

শীঘ্র করি শোক ফেল করগো আনন্দ।

তুচ্ছ লাগি উচ্চ জনে নহে নিরানন্দ।।

এতেক বচন শুনি প্রভুর শ্রীমুখে।

শোক সম্বরিয়া দেবী চুপ করি থাকে।।

পড়িবারে পুনঃ শশী যেতে চায় ঢাকা।

জননী জাকিয়া বলে “কোথা যাবি একা?

ঢাকা জিলা গিয়ে বাছা কার্য্য কিছু নাই।

ইচ্ছা হলে পড় গিয়ে অন্য কোন ঠাঁই।।

পুনঃ কলিকাতা তাই আসিলেন শশী।

মেট্রোপলিটন কলেজ ভর্ত্তি হল আসি।।

অল্পদিন পরে সেই কলেজ ছাড়িল।

“জেনারেল এসেম্বলী” কলেজে পশিল।।

প্রিন্সিপ্যাল মরিসন সাহেব সুন্দর।

শ্রীশশীভূষণে করে অতি সমাদর।।

স্বভাবের গুণে শশী করে তাঁরে বাধ্য।

সাহেবে করায় কাজ অন্যে যা অসাধ্য।।

কতদিন এই ভাবে পড়াশুনা করে।

গুরুচাঁদ ডাকে তারে কিছুদিন পরে।।

Page 347 start

বলে “শোন বাছা শশী বলি তব ঠাঁই।

ইহার অধিক পাঠ কার্য্য আর নাই।।

তব পরে দেখ আছে ভাই দুই জন।

তুমি বিনা ইহাদিগে কে করে শাসন?

একাকী উন্নত হ’লে কিবা ফল তায়?

সেই ধন্য যেই সাথে সকলে উঠায়।।

তাই বলি বাছাধন কলিকাতা ছাড়ি।

এবে তুমি ঘরে এস, ওড়াকান্দী বাড়ী।।

পিতৃ আজ্ঞা শিরোধার্য্য করে সেই গুণী।

পড়া ছাড়ি ওড়াকান্দী আসিল তখনি।।

মধ্যম ইংরাজী স্কুল গ্রামেতে স্থপিল।

প্রধান শিক্ষক পদে আপনি বসিল।।

সযতনে প্রাণপণে ছাত্র দিতে শিক্ষা।

শিক্ষামহাপূণ্যব্রতে লইলেন দীক্ষা।।

নমঃকূলে আদি কালে যত মহাজন।

শশী ঠাঁই শিক্ষা পেল প্রায় সর্ব্বজন।।

ধন্য ওড়াকান্দীবাসী ভীষ্মদেব দাস।

“ব্যবস্থাপক সভায়’ সভ্য অর্জ্জিল সুযশ।।

শ্রীশশীভূষণ বটে তস্য গুরু হন।

এই রূপে আছে আর কত মহাজন।।

গ্রামের শিক্ষার কেন্দ্রে যবে স্থির হল।

শ্রীশশীভূষণ তবে স্বদেশ ছাড়িল।।

পুনরায় আসিলেন কলিকাতা পরে।

কটন ইস্কুলে থাকি শিক্ষকতা করে।।

সেই কালে কলিকাতা বাসী শ্রেষ্ঠ জন।

শশীভূষণের সঙ্গে হইল মিলন।।

মহামান্য হাইকোর্ট শ্রেষ্ঠ আদালতে।

সারদা চরণ মিত্র জজিয়তী পদে।।

পরম পন্ডিত ছিল সেই মহাশয়।

“হাইকোর্টজজ” বলি সদা মান্য পায়।।

তেঁহ সঙ্গে শশীবাবু করে আলাপন।

কালক্রমে হল প্রেমে ষনিষ্ঠ বন্ধন।।

শশীবাবু সঙ্গে তাঁর ছিল বড় ভাব।

শশীর চরিত্রে সেথা বাধ্য ছিল সব।।

ব্রহ্মধর্ম্ম কুলাচার্য শাস্ত্রী শিবনাথ।

যাঁর নাম নিলে হয় সদা সুপ্রভাত।।

নগেন্দ্র চ্যাটার্জ্জি ন্য ব্রাহ্ম মহাজন।

ইহসঙ্গে শশী সদা করেন মিলন।।

আদি পরিচয় পরে হয় ভাবালাপ।

প্রগাড় বন্ধুত্ব পরে প্রেমময় ভাব।।

ইহা প্রেমে পড়ি তেঁহ করে যাতায়াত।

ব্রাহ্ম সমাজেতে মিশে যত ব্রাহ্মসাথ।।

ব্রাহ্মের উদার নীতি শুনি দিনে দিনে।

ব্রাহ্মধর্ম্মে দীক্ষা নিতে ইচ্ছিলেন মনে।।

‘থিওজফি’ সমাজেতে যাতায়াত করে।

পুরাতত্ত্ব জানিবারে কামনা অন্তরে।।

পরলোক, পরতত্ত্ব প্রাচীন সাধনা।

জানিবারে প্রাণে তার বড়ই বাসনা।।

বিশেষতঃ গাঢ় শ্রদ্ধা ব্রাহ্মধর্ম্ম প্রতি।

সেই ধর্ম্মে দীক্ষা নিতে ইচ্ছিল সংপ্রতি।।

পিতৃ-আজ্ঞা প্রয়োজন ভাবে মনে মনে।

ওড়াকান্দী উপনীত হয় কতদিনে।।

সরল প্রাণের কথা করে নিবেদন।

“আমি পিতাঃ ব্রাহ্মধর্ম্ম করিব গ্রহণ।।

বড়ই উদার ধর্ম্ম এই ব্রাহ্ম-নীতি।

সর্ব্ব সমন্বয় তাতে সব এক জাতি।।

হিংসা দ্বেষ নাহি কিছু সব সমতুল।

পরম উদার ধর্ম্ম জনিয়াছি স্থুল।।

তব আজ্ঞা ব্যাতিরেকে কিছু সাধ্য নাই।

শ্রীচরণে নিবেদন সেহেতু জানাই।।

প্রীতমনে আজ্ঞাদান করুণ আমারে।

‘ব্রহ্ম’ পেতে চাই আমি ব্রাহ্মের ভিতরে।।”

পুত্রের বচন শুনি প্রভু কন হাসি।

“এহেন অবোধ চিন্তা কোথা পেলে শশী।।

Page 348 start

ব্রাহ্ম হলে ব্রহ্মপাবে এই কোন কথা?

ব্রহ্মকি এতই সোজা পাবে যথা তথা?

ব্রহ্ম যারে বল সেত সেই নারায়ন।

কোথায় বসতি তার জান কি কখন?

ব্রহ্ম নহে অন্যকোথা ব্রহ্ম নিজ দেহে।

বীর্য্যরূপে ব্রহ্ম আছে সর্ব্বজীব গেহে।।

সে’ত আছে ঘরে তব নহে’ত বাহিরে।

তুমি যে করিছ চেষ্টা দূরে দিতে তারে।।

ঘরে যেঁই আছে বসে তাঁরে দিয়ে দূরে।

চোখ বুঁজে কিবা পাবে গভীর আন্ধারে?

শোন শশি কিছু তত্ত্ব কহি তব ঠাঁই।

‘শক্তিরূপ’ ব্রহ্ম তুমি জানিবে সদাই।।

এই শক্তি দেখ রহে জীবের শরীরে।

পরম অমূল্য নিধি বীর্য্যরূপ ধরে।।

এই শক্তি যদি কা’র ব্যয় নাহি হয়।

নিশ্চয় জানিবে ব্রহ্ম তাঁরে ঘিরে রয়।।

সে কেন চাহিবে ব্রহ্ম, ব্রহ্ম তারে চায়।

তার-ছোকে ব্রহ্ম দেখে তার মুখে খায়।

“যস্মিন চরিত্র ব্রহ্ম” ব্রহ্মচর্য্য কয়।

ব্রহ্মের আশ্রয় স্থল জানিবে নিশ্চয়।।

ব্রহ্মচর্য্য পালে যেই কায়মনোবাক্যে।

ব্রহ্ম তারে রহে ফিরে সবার অলক্ষ্যে।।

এই ব্রহ্ম পেতে বাপু! ব্রহ্ম হতে চাও।

ব্রহ্ম যদি পেতে চাও ব্রহ্মচারী হও।।

আপনার ঘরে রহে অমূল্য রতন।

অন্ধ তুমি তাই ভ্রমে করনা যতন।।

আপনার ঘরে রহে মধুর ভান্ডার।

পর্ব্বতে ছুটিতে চাহ মধু আনিবার?

যমোবন্ত দেব যিনি মম পিতামহ।

গৃহী ব্রহ্মচারী সাধু আছিলেন তেহ।।

ব্রহ্মচার্য্য পালিলেক সেই ধর্ম্মবীর।

তাঁর দেহে ব্রহ্ম তাই ছিল সদা স্থির।।

সেই ব্রহ্ম রূপ নিল শ্রীহরি ঠাকুর।

ব্রহ্ম পেতে গেলে চাই সাধনা প্রচুর।।

শোন কথা শশী আমি বলি তব ঠাঁই।

পবিত্র চরিত্র হলে কোন চিন্তা নাই।।

আমিত গৃহস্থ লোক সাধনাদি নাই।

বল দেখি কেন আমি যাহা চাই পাই।।

মম পিতা মহাপ্রভু শ্রীহরি ঠাকুর।

তিনবাক্য দিয়ে মোরে তোলে এতদূর।।

পবিত্র চরিত্র আদি বলিল আমারে।

চিরকাল ব্রহ্মচর্য্য বলে রক্ষিবারে।।

প্রাণপণে সেই বাক্য আমি পালিতেছি।

তাঁর কৃপাগুণে আমি সকলি পেতেছি।।

বন্ধ-চোখে যে ব্রহ্মকে দেখিবারে চাও।

সে ব্রহ্ম পারে না কিছু এই কথা লও।।

আর কথা শোন শশী গীতার বচন।

নিজধর্ম্ম শ্রেষ্ঠ জানে যত মহাজন।।

পরধর্ম্ম ভয়াবহ জানিবে ধার্ম্মিক।

নিজধর্ম্মে মৃত্যুভাল এই জানি ঠিক।

“স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরোধর্ম্ম ভয়াবহঃ”....গীতা...

তাই বলি ব্রহ্ম পেতে ব্রহ্ম কেন হবে?

পরধর্ম্ম নিয়ে প্রাণে কিবা শান্তি পাবে?

আর শুন মম ঠাঁই যত সমাচার।

তুমিত বলিলে ব্রাহ্ম সব একাকার।।

বলিতে পারকি শশী কোন কোন জাতি?

ব্রাহ্ম ধর্ম্মে দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছ সম্প্রতি?

মুচি, ডোম, আদি করি নীচ জাতি যত।

ব্রাহ্মধর্ম্ম দীক্ষা এরা নেয়’ত সতত।।

ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, যত ব্রাহ্ম হ’ল।

নীচ জাতি ব্রাহ্ম সাথে আছে জল চল?

আমি জানি ব্রাহ্ম হলে কিবা হবে পার।

যার জাতি তার সাথী মিশামিশি তার।।

Page 349 start

বাক্যে সমন্বয় বাপু পাবে বহুজন।

কার্য্যকালে প্রায় তার নাহি আচরণ।।

তাই বলি ব্রাহ্ম হয়ে কার্য্য কিছু নাই।

ব্রহ্মচারী হলে ব্রহ্ম নিজ দেহে পাই।।

অকাট্য প্রভুর যুক্তি তত্ত্ব-রসে ভরা।

পরম পবিত্র সত্য প্রকৃতি “অপরা”।।

পুনঃ প্রভু বলে তারে ‘শুন তুমি শশি।

কলিকাতা ছেড়ে এস থেকোনা বিদেশী।।

ঘরে এসে দেখ যদি নিজ জাতি তরে।

কিছুকাজ করে যেতে পার এ সংসারে।।

সুকীর্ত্তি ঘোষিবে লোকে জাগিবে এ বংশ।

কীর্ত্তি যার সেই ধন্য নর-অবতংস।।

পিতৃমুখে শুনি এই অপূর্ব্ব ভারতী।

কলিকাতা ছাড়ি করে ওড়াকান্দী স্থিতি।।

জাতির উন্নতি লাগি মনেতে পিপাসা।

‘শিক্ষা দাও’ ‘শিক্ষা দাও’ এই মাত্র ভাষা।।

মধ্যম ইংরেজী স্কুল গ্রামেতে স্থাপিল।

প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হইল।।

সেই পদে অধিষ্ঠিত ছিল কত দিন।

ছাত্রগণে শিক্ষা দেয় শিক্ষাতে প্রবীণ।।

বিশুদ্ধ চরিত্র ব্যাখ্যা করে সর্ব্বক্ষণে।

সেই শিক্ষা ছাত্রদলে নিল প্রাণে প্রাণে।।

তার হস্তে যেই ছাত্র কভু শিক্ষা পায়।

জ্ঞানে গুণে, ধনে মানে উন্নত সে হয়।।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাঠশালা করে কত শত।

শিক্ষাগ্রহ দেশ-মধ্যে বাড়ে অবিরত।।

শিক্ষা বিনে গতি নাই বুঝে দেশবাসী।

পথপ্রদর্শক তার হইলেন শশী।।

এহেন মধুর ভাব দেশ মধ্যে এল।

জাতির উন্নতি লাগি শ্রীশশী মাতিল।।

গৃহেতে থাকিয়া তেঁহ পিতৃ-আজ্ঞা মতে।

স্বজাতি উন্নতি তরে চিন্তে নানা পথে।।

শহর বন্দর গ্রামে যেথা যেথা যান।

নমঃশূদ্র-হিত-কথা সবাকে বুঝান।।

মাঝে মাঝে গুরুচাঁদে বলে বিনয়েতে।

এ জাতির ভাল, পিতাঃ হবে কোন পথে?

একদিন গুরুচাঁদ বলিলেন তাঁরে।

“শুন এক কথা শশী বলিব তোমারে।।

ধর্ম্মের পালক রাজা জানিবে নিশ্চয়।

রাজশক্তি বিনা কিছু বড় নাহি হয়।।

জাতি, ধর্ম্ম যাহা কিছু উঠাইতে চাও।

রাজশক্তি থাকে যদি যাহা চাও পাও।।

রাজার করুণ-দৃষ্টি এই জাতি পরে।

কোন ক্রমে বাপু যদি পার আনিবারে।।

তবেত জাগিবে জাতি নাহিক সংশয়।

রাজশক্তি মূলশক্তি কহিনু নিশ্চয়।।

ইংরেজ মোদের রাজা রাজদন্ডধারী।

তার সাথে সখ্যভাবে ন্যায্য মনে করি।।

প্রভু মুখে বাণী শুনি শশী ভাবে মনে।

ইংরেজ বান্ধব আমি পাব কোন খানে?

বালিয়াকান্দিতে দেখা অক্ষয়ের সাথে।

শুনিল তাহার কথা নানাবিধ মতে।।

পিতৃপদে আসি সব নিবেদন করে।

পরে করে সবকাজ আজ্ঞা অনুসারে।।

দেশবাসী আর যত আছিল প্রধান।

সকলের সঙ্গে নিয়ে করে অভিযান।।

সে সব বৃত্তান্ত পূর্ব্বে করেছি লিখন।

পুনঃ তাহা উল্লেখের নাহি প্রয়োজন।।

এবে বলি কি কি কার্য্য শ্রীশশী করিল।

কেন দেশবাসী তাঁরে বেসেছিল ভাল।।

মন দিয়া শুন সবে অপূর্ব্ব ঘটনা।

‘ভঙ্গ ভঙ্গ’ হবে বলি হল যে রটনা।।

পূর্ব্ব ও পশ্চিম বঙ্গ নামে দুই ভাগে।

বঙ্গদেশে হল ভঙ্গ বিভিন্ন বিভাগে।।

Page 350 start

বঙ্গবাসী ক্ষুন্ন হয়ে করে আন্দোলন।

‘স্বদেশী’ নামেতে করে দল সংগঠন।।

বঙ্গভঙ্গ রদ হবে এক রবে।

অন্যথায় বঙ্গবাসী রাজাজ্ঞা লঙ্ঘিবে।।

ঊনিশ শ’ পাঁচ অব্দে এই আন্দোলন।

দলে দলে উচ্চ হিন্দু মাতিল তখন।।

অম্বিকা চরণ নামে এক মহাশয়।

উপাধি মজুমদার উকিল সে হয়।।

ফরিদপুরেতে তেঁহ করে ব্যবসায়।

এই আন্দোলনে তেঁহ দৃঢ় মত্ত হয়।।

ফরিদপুরেতে যত নমঃশূদ্র ছিল।

এই আন্দোলনে কেহ যোগ নাহি দিল।।

তাহা দেখি চিন্তা করে সেই মহাশয়।

নমঃশূদ্রে সঙ্গে নিলে কাজ ভাল হয়।।

এই ভাবে তিনি আসি ঘৃতকান্দী গাঁয়।

স্বদেশী দলের সভা সেখানে মিলায়।।

বহু নমঃশূদ্র সেথা বক্তৃতা শুনিতে।

উপস্থিত হল সবে নানা গ্রাম হতে।।

বড় শক্তিশালী বক্তা অম্বিকাচরণ।

বক্তৃতার গুণে করে হৃদয় হরণ।।

দলে দলে স্বদেশীতে যোগ দিতে সবে।

বক্তৃতাতে বলে তেঁহ বীরের স্বভাবে।।

বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে নমঃশূদ্র গণ।

স্বদেশী দলেতে যেতে করিল মনন।।

সবে মনে ভাবে মোরা স্বদেশী সাজিব।

বড় কর্তা গুরুচাঁদে এ বার্ত্তা জানাব।।

এ জাতির পিতা তিনি মান্য সবাকার।

একবার অনুমতি লইব তাঁহার।।

বিশেষ তাঁহার পুত্র শ্রীশশীভূষণ।

এই দেশে মধ্যে তিনি বিদ্যাতে প্রধান।।

তাঁহার মন্ত্রণা মোরা অবশ্য শুনিব।

আজ্ঞা যদি পাই সবে স্বদেশী সাজিব।।

এই যুক্তি করি যত নমঃশূদ্র গণ।

পতাকা ধরিয়া হস্তে করিল গমন।।

যেইমাত্র ওড়াকান্দী উপনীত হ’ল।

তা সবারে মহাপ্রভু তিরস্কার কৈল।।

পরে সবে পাঠাইল শশীর নিকটে।

তেঁহ সবে বলে শশী অতি অকপটে।।

“‘আমরা স্বজাতি ভাই কবা এই কান্ড?

কোন কার্য্য সাধিবারে হস্তে নিলে দন্ড?”

অগ্রগণ্য হয়ে তবে এক মহাশয়।

বলে “শুন বড়বাবু যাহা অভিপ্রায়।।

আমরা সকলে আজি স্বদেশী সাজিব।

দেশ-মাতৃকার লাগি জীবন ত্যাজিব।।

দেশের সন্তান মোরা বুঝেছি নিশ্চয়।

বিফল জনম যদি মাতা দুঃখ পায়।।

তব পিতা বড়কর্ত্তা আমাদের নেতা।

তাঁর অনুমতি লাগি আসিয়াছি হেথা।।”

কথা শুনি হাসি শশী কহিল সবারে।

“এই শিক্ষা পেলে বুঝি সভার ভিতরে?

কথা ভাল শোনা যায় আপাততঃ বটে।

ভিন্ন ভাব জাগে কিন্তু মোর হৃদি-পটে।।

অবশ্য বক্তৃতা শোনা নহে কিছু দোষ।

তবু কিছু বলি আমি নাহি কর রোষ।।

দেশ-মাতৃকার তরে স্বদেশী সাজিবে।

“দেশ তামা বলে কারে বুঝিয়াছ সবে?

মাটি নাকি মাটি তাহা বলে দেখি ভাই।

‘দেশ মাতৃকার’ ব্যাখ্যা বুঝে নিতে চাই।।

যে মাটিতে নাহি কোন মানব বসতি।

কেবা তারে ডাকে মাতা কে তার সন্ততি?

দেশ নহে মাটি মাত্র “দশে-দেশ বাসী।

নর নারী যত সব এক সাথে মিশি।।

নর নারী যদি কভু দুঃখ পেয়ে কান্দে।

“দেশ” কান্দে বলে সবে অতি নিরানন্দে।।

Page 351 start

আজ’ত ‘স্বদেশী’ সবে সাজিতেছ ভাই।

তোমরা দেশের কেবা জানিয়াছি তাই।।

এতকাল তিলে তিলে অসহ্য যাতনা।

কতই সয়েছ সবে নাহিক তুলনা।।

কোথা ছিল ‘দেশমাতা’ সে দুঃখের দিনে?

দুর করি দিল দেখি আপন সন্তানে।।

“ত্যজ্যপুত্র” মোরা সবে মাতা নাহি চিনি।

কোন শঠ আসি কাণে দেয় মাতৃ ধ্বনি?

মোদের কারণে মাতা নয় দয়া দয়াবতী।

উপেক্ষিত সন্তানের নাহি কোন গতি।।

ভাই ভাই রব তুলি আজি যারা আসে।

মুখে মধু বুকে বিষ কার্য্য সিদ্ধি আশে।।

নিজ-স্বার্থ বিঘ্ন বুঝি ঘটিয়াছে আজ।

তাই ভাই বলে ডাকে মোদের সমাজ।।

দেশ নহে শুধু মাত্র শিক্ষিত সমাজ।

সেই কথা সবাকারে বুঝাইব আজ।।

অশিক্ষিত যারা দেশে তাহারা সংখ্যায়।

শিক্ষিত হইতে শশী জানিও নিশ্চয়।।

ইহাদের পানে কেহ কভু এতদিন।

চাহে নাই দেখে নাই মনে ভেবে হীন।।

মুষ্টিমেয় ব্যক্তি লয়ে যদি দেশ হয়।

প্রকৃত দেশের প্রাণ বহু দুরে রয়।।

এদের উন্নতি লাগি এ সব স্বদেশী।

কি করেছে কোনখানে দেশমধ্যে আসি?

শিক্ষার আলোকে যারা চিনিয়াছে দেশ।

দেশ-মাতা পূজা তারা করুক বিশেষ।।

মোরা অশিক্ষিত সবে আপনা না চিনি।

কোথা দেশমাতা তারা মোরা কিবা জানি?

প্রকৃত তত্তেবর কথা শুন সবে ভাই।

এ সব হুজুগে মেতে কোন ফল নাই।।

আর শুনি গূঢ় কথা বলিব সবারে।

মম পিতৃদেব যাহা বলিলেন মোরে।।

রাজ-কৃপা ব্যতিরেকে জাতি নাহি জাগে।

ধন, মান, বিদ্যাশিক্ষা সব কিছু লাগে।।

আমরা কৃষক সবে কৃষিকার্য্য করি।

সম্পদের মধ্যে মোরা ভূমি মাত্র ধরি।।

বিলাস ব্যসন মোরা কিছু নাহি চিনি।

কায়ক্লেশে মাটি চিরে ধান্য শস্য আনি।।

“দেশের পরান” বলি যদি কিছু রয়।

কৃষক দেশের প্রাণ জানিবে নিশ্চয়।।

দেশ-বৃক্ষ-মূল বলি কৃষকে জানিবে।

কৃষকের স্কন্ধে সুখে রাখিয়াছে সবে।।

মূল দেয় রস বহি শাখা প্রশাখাতে।

“সুখের কপোত” সেজে সবে বাঁচে তাতে।।

এ হেন দুব্বৃত্ত দেখ এই সব শাখা।

মূল-মূলে জল দিতে কার নাই দেখা।।

বিষময় ফল দেখ ফলিয়াছে আজ।

মেরুদন্ডহীন যত শোষক সমাজ।।

‘সুখের বাসায়’ বুঝি বিঘ্ন ঘটিয়াছে।

চাপে পড়ি তাড়াতাড়ি ‘দরদী’ সেজেছে।।

‘দরদী চিনিতে কিছু বাকী নাহি রয়।

এতদিনে এ দরদ ছিল বা কোথায়?।।

পতিত দলিত যত আছে বঙ্গদেশে।

রাজা ভিন্ন বন্ধু নাই জানিবে বিশেষে।।

আগে বিদ্যা আন ঘরে আন ধন মান।

আচরণে সৎ হও ডাক ভগবান।।

এ কর্ম্ম করিলে তবে এ জাতি জাগিবে।

‘দেশ মহা’ বলে কারে তখন চিনিবে।।

অন্ধজনে কিবা পারে? চোখে দৃষ্টি নাই।

আগে দৃষ্টি আন চোখে ঘুমাতে বালাই।।

দৃষ্টি পেয়ে জ্যান্ত হয়ে যদি কর কাজ।

মান পাবে ধন্য হবে জগতের মাঝ।।

এত বলি শশী বাবু নীরব হইল।

নমঃশূদ্রগণ তবে ভাবিতে লাগিল।।

Page 352 start

সবে পুণ উপনীত প্রভু সদনে।

বহু উপদেশ প্রভু দিল সর্ব্বজনে।।

মনের সন্দেহ দূর হইল সবার।

দল ভাঙ্গি সবে ফিরি গেল নিজ ঘর।।

এ হেন প্রকারে প্রভু জাতি রক্ষা কৈল।

প্রভুর আদর্শে জাতি জাগিয়া উঠিল।।

অতঃপর মীড এল ওড়াকান্দী গ্রামে।

প্রভুকে দেখিয়া মত্ত হল তার প্রেমে।।

বহু স্নেহ করে মীড শ্রী শশীভূষণে।

বহু কথা এক সাথে কহে দুই জনে।।

এক দিন মীড পাশে শশী দুঃখে কয়।

মোদের দুঃখের কথা শুন মহাশয়।।

লেখাপড়া কিছু মোরা করিয়াছি বটে।

কিন্তু কোন রাজকার্য ভাগ্যে নাহি ঘটে।।

ইহার উপায় করি করহে কল্যাণ।

আপনি ভরসা শুধু রহে মতিমান।।

শশীর বচনে তুষ্ট মীড মহাশয়।

বলে শুন শশী বাবু বলি যে তোমায়।।

তোমার পিতা কাছে এই আবেদন।

পূর্ব্বেই শুনেছি আমি সব বিবরণ।।

প্রাণপণে চেষ্টা আমি নিশ্চয় করিব।

নমঃশূদ্রে রাজকার্য্য নিশ্চিতই দিব।।

এক কার্য্য এবে তুমি কর মহাশয়।

ছোটলাট বাহাদুরে জানাইতে হয়।।

সম্প্রতি ফরিদপুরে আসিবেন তিনি।

সবে পরিচিত হবে সেথা আমি জানি।।

তোমার জাতির পক্ষে মিলি কতজনে।

লাট-দরবারে যাহ জাতির কারণে।।

সেই উপদেশে শশী সে কার্য্য করিল।

তাঁর ফলে নমঃশূদ্রে চাকুরি পাইল।।

সে ঘটনা সব আমি প্রভুর জীবনে।

পূর্ব্বে বলিয়াছি তাহা বিবিধ বিধানে।।

শ্রীশশীভূষণ তবে পায় রাজ কার্য্য।

সাবরেজিষ্ট্রার পদ করে দিল ধার্য্য।।

ঊনিশশ সাত সালে রাজকার্য্য পায়।

বহুস্থানে বঙ্গদেশে ঘুরিয়া বেড়ায়।।

বহুদিন রহে গোপালগঞ্জের শহরে।

বহু ব্যাখ্যা করে তাঁরে যত নারী নরে।।

তাঁহার শুণের কথা বাখানে না যায়।

গুণে ব্যাধ্য ছিল সবে যেবা সঙ্গ পায়।।

সকল বিনয়ী তাহে পবিত্র চরিত্র।

সকলে সম্ভ্রম করে যায় যত্র তত্র।।

সুন্দর শোভন বেশ অতি পরিপাটী।

বাক্য কার্য্য আচরণে নাহি কোন ত্রুটি।।

পিতৃপদে ভক্তি তাঁর ছিল অতিশয়।

সদা করজোড় করি পিতৃ অগ্রে যায়।।

ন্যায়কর্ম্মে শিশু সম উলঙ্গ পরাণ।

অন্যায় দেখিলে তার নাহি ছিল ত্রাণ।।

‘বজ্রাদপি কঠোরাণী” দুষ্ট জন পক্ষে।

‘মৃদুনি কুসুমাদপি’ সাধুর সমক্ষে।।

ঊনিশ শ আঠার সালে খুলনা জিলায়।

রামপাল থানাস্থানে বদলি সে হয়।।

নোনা জল নোনা দেশ সাগরের কাছে।

স্বাস্থ্যভঙ্গ হলে সেথা দীর্ঘ ছুটি যাচে।।

এমনি মহৎ প্রাণ ছিল যে তাঁহার।

একটি ঘটনা বলি কিবা চমৎকার।।

রামপালে বসি যবে ব্যাধিগ্রস্থ হল।

প্রিয় ভক্ত শ্রীগোপালে সংবাদ পাঠাইল।।

ধন্য শ্রীগোপাল সাধু লহ্মীখালী গাঁয়।

যাঁর কীর্ত্তিগাঁথা ব্যাপ্ত হল বিশ্বময়।।

সংবাদ পাইয়া ব্যস্ত সাধু মহাশয়।

এ অধমে সঙ্গে করি রামপালে যায়।।

গিয়া দেখে বাবু আছে গৃহের ভিতরে।

ভূমিষ্ঠ হইয়া সাধু প্রণমিল তাঁরে।।

Page 353 start

সাধুকে দেখিয়া বাবু উঠে তাড়াতাড়ি।

বারান্দা উপরে বসে গৃহশয্যা ছাড়ি।।

কুশল জিজ্ঞাসা করে প্রফুল্ল হৃদয়।

রোগজ্বালা যেন কিছু বোঝা নাহি যায়।।

তখনে কান্দিয়া সাধু বলিল তাঁহারে।

“রোগের বৃত্তান্ত কিছু বলুন আমারে।।”

সাধুকে ডাকিয়া তবে বলিলেন শশী।

‘রোগে পড়ি শোন সাধু রামপালে আসি।।

আমার পিতার তুমি ভক্ত যে প্রধান।

তাঁর পদে দিলে অর্ঘ্য দেহ মন প্রাণ।।

লোক মুখে আমি বটে শনিয়াছি কথা।

তব বাক্য কোন কালে না হল অন্যথা।।

আমার রোগের বিধি আজ করি দেহ।

মম প্রতি কিছুমাত্র যদি থাকে স্নেহ।।

বাবুর বচন শুনি সাধু উঠে কান্দি।

বলে “বাবু চিরকাল আমি পদে বন্দী।।

তব পিতা গুরুচাঁদ পরম দয়াল।

তাঁর কৃপাগুণে চলে এ দীন কাঙ্গাল।।

কোন কিচু করিবারে সাধ্য মোর নাই।

যা করে তা করে মোর গুরুচাঁদ সাঁই।।

তাঁর অংশ বটে বাবু আপনি মহান।

তব ব্যাধি বিধি দিতে কহেনা পরাণ।।

মম মনে বলে প্রভু আপনি সত্বর।

ছুটি লয়ে চলে যান আপনার ঘর।।

সেখানে বাবার আজ্ঞা যাহা তব প্রতি।

সেই বিধি মান্য হলে পাবে অব্যাহতি।।”

কথা শুনি বড় বাবু সাধু প্রতি কয়।

‘শোন সাধু মম মনে সেই ভাব হয়।।

শাস্ত্রে শুনি আর সাধু মহাজনে কয়।

হরি হতে হরিভক্ত শ্রেষ্ঠ বটে হয়।।

ভক্তে মান্য দিয়ে সুখী ভক্তবৎসল।

তেঁহ যেন বৃক্ষপ্রায় ভক্ত যেন ফল।।

ভক্তে যাহা বলে হরি তাই আগে রাখে।

তাঁর চিন্তা সদা কিসে ভক্ত সুখে থাকে।।

ভক্তে যদি দয়া করে হরি করে গ্রাহ্য।

আপনা হইতে হরি ভক্তে করে পূজ্য।ৎ

জানি বটে পিতা মোর জগতের নাথ।

তবু ভয় হয় মনে যাইতে সাক্ষাৎ।।

তুমি ভক্ত শ্রেষ্ঠ তাহা জানিত বিশেষ।

তুমি দাও বিধি মোর রোগ হোক শেষ।।

তুমি যা বলিবে মোর যেন এই লয়।

সেই বিধি পালি যদি রোগ হবে ক্ষয়।।”

এতেক বিনয় বাক্য বাবু যদি বলে।

অবিরল ভাসে সাধু নয়নের জলে।।

কিছু পরে সাধু কহে করিয়া মিনতি।

‘বড় বাবু দীনহীন আমি হীনমতি।।

আমার মনের মাঝে উঠে এক কথা।

নিবেদন করি পদে নোয়াইয়া মাথা।।

দেখুন কাননে ফুটে নানা জাতি ফুল।

রূপে গন্ধে মুগ্ধ করে যত অবিকুল।।

যে ফোটায় এই ফুল যেবা ডালে রাখে?

ভুলে কি মানব কভু মনে করে তাঁকে।।

আর দেখ কিমাশ্চর্য্য যত নারী নরে।

তাঁর ফুল দিয়ে সবে তাঁরে পূজা করে।।

মোর পক্ষে বিধি-বলা সেই কার্য্য প্রায়।

ঠাকুরের বিধি কহি ঠাকুর সভায়।।

যাঁর বিধি তাঁকে বলি পুষ্প-অর্ঘ্য যথা।

যাঁর কতা তাঁরে কহি নহে মোর কথা।।”

এত বলি সাধু তবে বিধিকথা কয়।

বিধি পালি শশীবাবু রোগে শান্তি পায়।।

অতঃপর তেঁহ ওড়াকান্দী চলি গেল।

দৈবের নির্ব্বন্ধে পুনঃ রোগগ্রস্ত হল।।

বৎসর অবধি রোগ কমে আর বাড়ে।

যাই যাই করে রোগ নাহি যায় ছেড়ে।।

Page 354 start

মৃত্যুদিন আসে ক্রমে জানিতে পারিল।

সপ্তাহ পূর্ব্বেতে পিতৃপদে নিবেদিল।।

“ওহে তাতঃ প্রণিপাত জানাই চরণে।

নিশ্চয় বুঝিনু মোরে লইবে মরণে।।

জন্মিলে মরণ ধ্রুব ইথে নাহি আন।

তবু এক চিন্তা করি কেন্দে উঠে প্রাণ।।

আপনার আশীর্ব্বাদে শ্রীহরি-কৃপায়।

প্রথম মন্মথ দুই পুত্র জন্ম লয়।।

নিতান্ত বালক দোঁহে না চিনে জগত।

আমি গেলে এ দোঁহেকে কে দেখিবে তাতঃ?

মনোখেদে গুরুচাঁদে কান্দি কথা কয়।

সুখদুঃখাতীত প্রভু বিচলিত নয়।।

হাসিয়া বলেন প্রভু “শুন শুন শশী।

কি জন্য ব্যাকুল তুমি তাইভাবি বসি।।

কেবা কার পিতা পুত্র আত্মীয় স্বজন।

যার যার তার তার আপন আপন।।

নরদহে মায়া মোহ দেখায় সম্বন্ধ।

দেহ ফেলে আত্মা গেলে কবো করে বন্ধ?

এ মাটিতে যাহা ফলে এ মাটিতেই রয়।

মাটি ছাড়া হলে দেখ কেহ কার নয়।।

কর্ম্মফলে আত্মা দেখ দেহবদ্ধ হয়।

যার যেই কর্ম্ম দেখ তার পিছে ধায়।।

মাটি দিয়ে গড়া দেহ মাটিতেই লয়।

দেহ হতে দেহ তাই প্রকৃতি গড়ায়।।

যা নিয়ে সম্বন্ধ হেথা সেও অই মাটি।

মাটি পরে মাটি রবে আত্ম যাবে খাঁটি।।

পুত্র বল কারে তুমি দেহ বা আত্মাকে?

দেহ যদি পুত্র বল তাত হেথা থাকে।।

তাহলে ত দেহ তুমি চিন্তা কিবা আর?

কখনো হবে না যেতে ছাড়িয়া সংসার।।

আর যদি আত্মারামে পুত্র বলি বল।

আত্মা রহে সর্ব্বস্থানে বেড়িয়া সকল।।

অবিনাশী এই আত্মা জরা মৃত্যু নাই।

কি লাগি কাঁন্দিবে আত্মা কিসের বালাই?


“বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজরব্যারম”।।--শ্রীমদ্ভাগবদগীতা

দেহিতে পারে না তারে প্রবল অনলে।

সিক্ত নাহি হয় আত্মা অগাধ সলিলে।।

আপন ইচ্ছায় আত্মা সর্ব্ব স্থানে চলে।

জীবদেহে বান্ধে বাসা প্রকৃতির ছলে।।


‘ণেনংছিন্দন্তি শাস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবক”।নচৈনঃক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।।”--শ্রীমদ্ভাগবদগীতা

এবে শুন কেবা কান্দে কিসের মায়ায়।

ব্রহ্মের বিকারে সৃষ্ট ব্রহ্মান্ড যে হয়।।

অবিকারী চিৎশক্তি ব্রহ্ম যাঁর নাম।

গুণাতীত সত্ত্বা সেই বি-কুন্ঠ নিষ্কাম।।

ব্রহ্মের বিকার ভাগ হল পঞ্চ ক্রমে।

ক্ষিতি অপঃ তেজঃ মরুদ্বোম পঞ্চ নামে।।

অবিনাশী ব্রহ্মশক্তি নশ্বর-বিকার।

ব্যোম, বায়ু, তেজঃ ক্রমে হয় রূপান্তর।।

শব্দ মাত্র গুণ হয় ব্যোমেতে প্রকাশ।

শব্দ, স্পর্শ. দুই গুণে বহিছে বাতাস।।

শব্দ, স্পর্শ রূপ দেখি তেজ-তত্ত্ব মাঝে।

শব্দ, স্পর্শ রূপ রস জল মধ্যে রাজে।।

ক্ষিতি ধরে শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ।

পঞ্চগুণময়ী সৃষ্টি এই তার ছন্দ।।

কূর্ম্ম যথা নিজ অঙ্গ দেহ মধ্যে লয়।

পঞ্চ যবে মিশে ব্রহ্মে সৃষ্টি লয় হয়।।

পঞ্চতত্ত্ব মধ্যে যত সকলি নশ্বর।

পঞ্চতত্ত্ব মধ্যে ঘুরে ব্রহ্ম পরাৎপর।।

ব্রহ্ম ধরে ‘আত্মা’ নাম তত্ত্বে দেহ কয়।

উভয়ে মিলন হলে জীব সৃষ্টি হয়।।

Page 355 start

ভুত’ত আধার মাত্র দেহ নাম ধরে।

চিৎ শক্তি আত্মা আছে তাই চলে ফিরে।।

নির্গুণ ব্রহ্মকে সদা জানিবে নিস্ক্রিয়।

দেহতত্ত্বে অচৈতন্য সর্ব্বত্র জানিও।।

প্রশ্ন বটে উঠে তাতে ইহা কি সম্ভব?

দুই যদি নাহি করে কেবা করে সব?

ব্রহ্ম তত্ত্ব দুই যবে মিলন করয়।

চারি বস্তু সেই ক্ষণে প্রকাশিত হয়।।

অহং, চিত্ত, বুদ্ধি, মন এই চারি কহে।

“জীবাত্মা” নামেতে সেই জীব দেহে রহে।।

জীবাত্মা চালায় দেহ “আত্মা’ রহে ঘুমে।

মায়াশক্তি জীবাত্মাকে ঘিরে ক্রমে ক্রমে।।

গর্ভবাসে জীবাত্মার মহাকষ্ট হয়।

পরমাত্মা কাছে সদা কেঁদে কেঁদে কয়।।

“এই কারা হতে আজি উদ্ধারহ মোরে।

তোমাকে ভুলিব না কবু ঘিরে ধরা পরে।।

মায়াময়ী প্রকৃতির এ-মায়া প্রপঞ্চ।

মায়া দিয়ে ঘেরা তার এই বিশ্বমঞ্চ।।

‘ভূমিষ্ঠ’ জীবাত্মা তাই পড়ে মায়া-ফাঁদে।

মায়াতে কান্দায় জীবে তাই জীবে কাঁদে।।

অতঃপর “জীবাত্মার” কিবা গতি হয়?

সেই কথা আমি ক্রমে বলিব নিশ্চয়।।

প্রতি পলে মায়া ছলে প্রকৃতি জননী।

জীবকে ভুলায়ে রাখে করিয়া মেলানি।।

গর্ভাবাসে মহাকষ্ট মনে হয় ভুল।

এমায়া প্রপঞ্চে ভাবে সর্ব্ব-সুখ-মূল।।

পরমাত্মা সাথে বার্ত্তা মনে নাহি হয়।

দারা, পুত্র, পেয়ে পূর্ব্বস্মৃতি ভুলে যায়।।

কত দুঃখে কাটে কাল নাহিক চেতনা।

মায়া মুগ্ধ জীব পরমাত্মাকে চেনে না।।

পরমাত্মা তারি মাঝে রহে অচেতন।

তার তত্ত্ব নাহি রাখে এম্নি অভাজন।।

এই ভাবে দিন যায় জীবন সন্ধ্যায়।

‘কর্ম্মফল’ বলে চল নাহিক সময়।।

অতি দুঃখে সে ‘জীবাত্মা’ দেহকে ছাড়িয়ে।

‘কর্ম্মফল’ নাশিবারে জন্মে’ত আসিয়ে।।

যতকাল কর্ম্মফল নাশ নাহি হয়।

বারে বারে সে জীবাত্মা জন্মে এ ধরায়।।

যবে কর্ম্মফল নাশ সুকৃতি উদয়।

‘জীবাত্মা’ মিশিয়া যায় পরম আত্মায়।।

অবিরত অগণিত জীব সমুদয়।

‘কর্ম্মফলে’ বারে বারে জনম লভয়।।

ভোগ ইচ্ছা সেই কর্ম্মে কামনা জাগায়।

পিপাসা মিটেনা শুধু তৃষ্ণা বেড়ে যায়।।

তৃষ্ণা যদি নাহি মিটে কামনা রহিবে।

কামনা পূরাতে পুনঃ ধরাতে আসিবে।।

মানা-বিহীন-কর্ম্ম সাথে যেই জন।

তার নাহি হবে পুনঃ ধরাতে গমন।।

ফল হীন কর্ম্মে দেখ ফলে মোক্ষ ফল।

‘ফলহীন কর্ম্ম’ এবে কহিব সকল।।

নিজ ভোগ জানি কর্ম্ম করিলে জীবাত্মা।

সেই কর্ম্মে ফলে ভোগ রুষ্ট পরমাত্মা।।

ভোগে বাড়ে তৃষ্ণা, তৃষ্ণা বাড়ায় কামনা।

কামনা শোধিতে জীব না জন্মে পারে না।।

আত্মাসুখ-ভোগ ভুলি জীবে সাধে কর্ম্ম।

ফলহীন-কর্ম্ম তাহা মহাজন-ধর্ম্ম।।

পরমাত্মা-প্রীতি-হেতু যেই কর্ম্ম হয়।

ফলহীন-কর্ম্ম বলি জানিবে নিশ্চয়।।

ফল-শূণ্য কর্ম্মে লাগে পূর্ণ নির্ভরতা।

তাঁর ইচ্ছাক্রমে চলে, বলে তাঁর কথা।।

নিষ্কাম কর্ম্মেতে যবে জীবাত্মা চলয়।

পরমাত্মা সনে তার হয় পরিনয়।।

এই পরিনয়-ফলে ফলে মোক্ষফল।

যাতায়াত শেষ হয় জনম সফল।।

Page 356 start

“কর্ম্মজৎ বুদ্ধি যুক্তাহি ফলং ত্যক্ত্যা মনীষিণঃ।জন্মবন্ধ বিনির্স্মৃক্তঃ পদং গচ্ছস্ত্যাময়ম।।”--শ্রীমদ্ভাগবদগীতা

সেই হেতু বলি শশী কিবা দুঃখ কর।

মায়া ফাঁসি কেটে ফেলে তাঁর চিন্তা ধর।।

নাবালক পুত্র ভাবি দুঃখিত অন্তরে।

কার কাজ কেবা করে এই ধরা পরে।।

যার কাজ সেই করে পায় কর্ম্মফল।

কর্ম্মে দেয় সুখ দুঃখ কর্ম্মই প্রবল।।

কর্ত্তব্য আমার তবু জানাই তোমারে।

তব পুত্রগণে আমি পালিব সাদরে।।”

এই কথা বলি স্তব্ধ প্রভু গুরুচন্দ্র।

শ্রীশশীভূষণ পেল পরম আনন্দ।।

“পিতা যদি নিল ভাব পুত্র পালিবারে।

কিছুই নাহিক দুঃখ যেতে পরগারে।।

আমার ভাগ্যের কথা কহেন না যায়।

পিতা নিল পুত্র ভার কিবা আর দায়।।

সপ্ত দিন ছিল তাঁর দেহেতে জীবন।

অবিরাম হরিনাম করেন কীর্ত্তন।।

ভক্তগণে যথা কান্দে ডাকে হরিচান্দে।

নিরালে বসিয়া শশী হরি বলে কান্দে।।

“হৃদয়ের নাথ কোথা প্রভু হরিচন্দ্র।

দেখা দাও সাথে লও জগতের চন্দ্র।।

শৈশব দেখিনু তোমা স্মৃতি অবশেষ।

পূর্ণরূপে এসো প্রাণে হৃষীকেশ।।

বত বংশে জন্ম হল অপার সৌভাগ্য।

গুণে, জ্ঞানে কোনখানে নাহি আমি যোগ্য।।

বেলা যায় সন্ধ্যা হয় খেয়া আসে ঘাটে।

দয়া করি এস হরি মৃত্যু-নদীতটে।।

তব সাথে আঁধারেতে যেতে নাহি ডর।

এসো প্রিয়তম মোর প্রাণের ঈশ্বর।।”

এই ভাবে কাঁদাকাঁদি করিলেন শশী।

ক্রমে ক্রমে উপনীত শেষ দিন আসি।।

পিতা মাতা উভে আনি আপনার কাছে।

পদধূলি অঙ্গে মাখি ক্ষমা ভিক্ষা যাচে।।

পুত্র কন্যা পাশে ডাকি কহে উপদেশ।

“মম পিতৃ আজ্ঞা সবে পালিবে বিশেষ।।

তেঁহ বিনা গতি নাই জীবনে মরণে।

সকলে শরণ নিও অভয় চরণে।।

আমার পিতার পদে লইলে স্মরণ।

যাহা চাবে তাহা পাবে না হবে লঙ্ঘন।।

মম প্রাণে দুঃখ নাই সবে ছেড়ে যেতে।

দুঃখ মাত্র পারি নাই পিতাকে সেবিতে।।

অধিক কহিব কিবা সবে রাখ শুনি।

নর নয়-পিতা মোর দেব শূলপাণি।।

কি খেলা খেলিতে পিতা এসেছে অবনী।

তাঁর মর্ম্ম কথা আমি কিছু নাহি জানি।।

পিতা যদি ইচ্ছা করে মোরে বাঁচাবারে।

অবশ্য বাঁচাতে পার অতি অকাতরে।।

তবু যে মরণ মোর হল এ সময়।

এ সব পিতার ইচ্ছা জানিবে নিশ্চয়।।

তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হোক পূর্ণ হোক লীলা।

আমি কিবা বুঝি তাঁর সীমা-হীন-খেলা।।

আমার মরণ লাগি কোন দুঃখ নাই।

পিতার চরণে ভক্তি রাখিও সবাই।।

এতবলি রুদ্ধ করি আপন-নয়ন।

“হরিচাঁদ” বলি ডাক ছাড়ে ঘন ঘন।।

ক্ষণপরে বলে শুধু “বাবা গুরুচাঁদ।।”

আমাকে করহ দয়া ক্ষম অপরাধ।।

‘হরি’ ‘হরি’ ধ্বনি করি নয়ন মুদিল।

ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদি প্রাণ উর্দ্ধেতে উঠিল।।

উঠিল ক্রন্দন রোল গৃহের ভিতরে।

প্রভু গুরুচাঁদ আস সবে শান্ত করে।।

Page 357 start

প্রমথ মন্মথ দুই পৌত্র কোলে করি।

বসিলেন গুরুচাঁদ আপনা আশরি।।

ঘৃত মাখি সর্ব্ব অঙ্গে সৎকার হইল।

দেশবাসী সবে আসি যোগদান দিল।।

অশ্রান্ত কীর্ত্তন করে মতুয়ার গণ।

শেষকৃত্য করিলেন প্রমথরঞ্জন।।

পরম পবিত্র চিত্ত শ্রীশশি ভূষণ।

দেহ ছাড়ি নিজ লোকে করিল গমন।।

এহেন চরিত্র কথা শুনে ভক্তিমান।

ধন ধন্যে গৃহপূর্ণ ধন্য যশ মান।।

হরি হরি বল সবে দিন নাহি আর।

মহানন্দ রহে ভুলে পাতিয়া সংসার।।

---০---