Page 510

শ্রীশ্রী প্রমথ রঞ্জনের বিলাত যাত্রা (উদ্যোগ)


“সন্তান যাঁহার হেলায় সাগর ডিঙায়ে করিল লঙ্কা জয়”--- দ্বিজেন্দ্র লাল

তের শত নয় সালে, আসিল জননী কোলে,

ওড়াকান্দি শিশু এক পরম সুন্দর।

গুরুচাঁদ ‘বর’ দেয়, তাই তারে শশী পায়,

ধন্য! ধন্য করে মিশে যত নারী নর।।

গেল বর্ষ গেল মাস, দিনে দিনে সুপ্রকাশ,

বাড়িতে লাগিল শিশু আপন বিভবে।

ক্রমে পঞ্চ বর্ষ যায়, বিদ্যালয়ে দিতে চায়,

শিশু তা’তে তুষ্ট নয় কভু কোন ভাবে।।

রাখালের সাথে জুটে, গোধন চরা’বে মাঠে,

সেই কার্যে প্রীতি তার সকলের বেশী।

নিজ করে ধরে তারে, আনি পাঠশালা ঘরে,

শিক্ষা দিল জোর করে তার পিতা শশী।।

শক্তিমান ভবে যারা, তাহাদের কার্যধারা,

সাধারণ হ’তে রহে অনেক প্রভেদ।

সুপরি চালনা হ’লে, এই শক্তিমান দলে,

জীবন করিতে পারে উচ্চ লক্ষ্য ভেদ।।

Page 511 start

ফিরিল মনের গতি, মন চলে শিক্ষা প্রতি,

ধীরে ধীরে ক্রমে উঠে বিভিন্ন পর্যায়।

সিংহ শিশু যথা ধীরে, পদ রাখি স্তরে স্তরে,

ক্রমে উপনীত হয় পর্বত চূড়ায়।।

বিধির নির্বন্ধ যাহা, কে খণ্ডাবে বল তাহা,

তাহার বিধান দেখ চলে অবহেলে।

সরলা অবলা মাতা, নাবালক দুই ভ্রাতা,

সবে ফেলে গেল পিতা স্বর্গধামে চলে।।

নীরবে শোকাগ্নি সয়, গুরুচাঁদ ভাবময়,

পাষাণ টুটিয়া যায় সেই অগ্নি দাহে।

দুই কক্ষে দুই জন, প্রমথ মন্মথ রঞ্জন,

অন্তরদেবের সম শোকাভার বহে।।

ফল্গু সম স্নেহ ধারা, হৃদয় রহিল সারা,

বাহিরে কঠিন সাজি করিল তাড়না।

প্রমথ রঞ্জন তাই, পথে ভুল করে নাই,

শ্রীগুরুচাঁদের গুণে পুরা’ল বাসনা।।

তের শত একত্রিশে, সহপাঠী সহবাসে,

বিদেশে চলিতে প্রাণ হ’ল উচাটন।

পিতা নাহি বর্তমান, পিতামহ মুহ্যমান,

কা’র বলে ‘সপ্ত সিন্ধু’ করিবে লঙ্ঘন।।

এদিকে প্রভুর মনে, ইচ্ছা জাগে ক্ষণে ক্ষণে,

সাগর ডিঙা’তে দিবে নমশূদ্রে বল।

লাট বলে সেই কথা, দেখিয়া জগত পিতা,

নমশূদ্রে দিতে চাহে সঞ্জীবনী ফল।।

প্রমথ রঞ্জন ভাবে, পিতামহে কোন ভাবে,

আপনার মনোকথা করিবে প্রকাশ?

অমূল্য কুমার নামে, বাস ওড়াকান্দি গ্রামে,

পিতা তার জানি শ্রীকমলা কান্ত দাস।।

বি.এস.সি. করি পাশ, কলিকাতা করে বাস,

মনে মনে ভাবে এবে কিবা করা যায়?

প্রমথ রঞ্জন ভাবে, মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে,

সঙ্গী যদি হ’ন মোর এই মহাশয়।।

অমূল্যের কাছে গিয়ে, তাহারে বলে বুঝা’য়ে,

মোর কথা শোন তুমি খুড়া মহাশয়!

কোন ভয় নাই মনে, চল মোরা দুই জনে,

সাগর ডিঙায়ে যাই রাজার আলয়।।

তাহাতে অমূল্য কয়, “কিছু বাধা নাহি তায়,

মোর পিতা সুস্থ মনে যদি দেন মত।

পিতাকে বুঝাতে হ’লে, যাও তুমি তার স্থলে,

এই ছাড়া আমি নাহি দেখি কোন পথ।।”

অমূল্যের কথা শুনি, প্রমথ রঞ্জন গুণী,

কমলা কান্তের কাছে হ’ল উপস্থিত।

বহুত বুঝায়ে তারে, নিল ‘মত’ জোর করে,

আপনার কথা তারে বুঝা’ল বিহিত।।

কমলা কান্তেরে কয়, “শোন দাদা মহাশয়,

আমার যা মনে হয় বলি সেই কথা।

মোর পিতামহ ঠাই, আপনার বলা চাই,

অমূল্য প্রমথ দোহে করেছে একতা।।

আসুন উভয়ে তাই, দোহে বিলাত পাঠাই,

নমশূদ্র জাতি তা’তে পাবে উপকার।

এই ভাবে কথা হ’লে, পিতামহ যদি বলে,

অনায়াসে যা’ব মোরা সাগরের পার।।”

এমত আগ্রহ দেখি, প্রমথ রঞ্জনে ডাকি,

আশীর্বাদ করিলেন শ্রীকমলাকান্ত।

বলে “ভাই ভয় নাই, ঈশ্বরের শুভেচ্ছায়,

প্রাণপণে চেষ্টা আমি করিব একান্ত।।”

এত বলি মহাশয়, প্রভুর নিকটে যায়,

অন্তর্যামী দয়াময় সব জানে মনে।

অগ্রভাগে বলে তাই, ‘কি কমলা কান্ত ভাই,

শুভ বার্তা আজ যেন শুনিব এ কানে।।

সে সব শুনিব পাছে, বহুত সময় আছে,

অগ্রভাগী কথা কিছু আমি তবে বলি।

মনে মোর যেই ভাব, এ জাতির যে স্বভাব,

ইচ্ছা হয় একা একা ভিন্ন পথে চলি।।

Page 512 start

আমার যা’ মনে হয়, শুন বলি মহাশয়,

অদ্যাবধি এ জাতির মধ্যে কোন জন।

উচ্চ শিক্ষা পায় নাই, বিদেশেতে যায় নাই,

আজো কেহ করে নাই বিলাত গমন।।

মহামূর্খ এ সমাজ, নাহি চেনে শুভ কাজ,

অল্প পেয়ে স্বল্পে তুষ্ট কাঙ্গালের প্রায়।

মোরে যদি মান তুমি, এক কথা বলি আমি,

বিলাতে পাঠাও পুত্র ওগো মহাশয়।।

প্রভুর বচন শুনি, সে কমলাকান্ত গুণী,

আশ্চর্য ভাবিয়া মনে চাহিয়া রহিল।

ভাবিলেন মনে মনে, ইনি দেখি সব জানে,

এর কাছে কিবা ক’ব মনেতে ভাবিল।।

তবু ধীরে ধীরে কয়, “শুন কর্তা মহাশয়,

আমার প্রাণের কথা জানিলা আপনে।

তাই করি নিবেদন, একসঙ্গে দুই জন,

পাঠাইয়া দিব মোরা বিদ্যার কারণে।।

আপনার পৌত্র গুণী, প্রমথ রঞ্জন জানি,

তার সঙ্গে একযোগে অমূল্যে পাঠাও।

নমশূদ্র বল পাবে, ধরাতলে কীর্তি রবে,

দয়া করে এই কার্যে কর অনুমতি।”

অন্তরের ভাব ঢাকি, প্রভু বলিলেন ডাকি,

“মোর কথা শুন তুমি দাস মহাশয়।

মোর বটে ইচ্ছা আছে, বলিতেছি তব কাছে,

সুধন্যরে ডাক হেথা দেখি সে কি কয়।।

আমারে বিশ্বাস নাই, কবে আছি কবে নাই,

তাতে মনে এই কার্যে সাহস না পাই।

সুধন্য যদ্যপি কয়, তবে বটে পারা যায়,

সেই ভার নিলে বটে কোন ভয় নাই।।”

প্রভুর মধ্যম পুত্র, শ্রীসুধন্য সুপবিত্র,

পিতৃ আজ্ঞা পেয়ে আসি দাঁড়া’ল নীরবে।

প্রভুজী তখনে তায়, সকল খুলিয়া কয়,

বলে “তব অভিপ্রায় বল সত্য ভাবে”।।

কি যেন আসিল মনে, সকলি বিধাতা জানে,

নানা যুক্তি প্রদর্শনে সেই মহাশয়।

কথা কয় আধা আধা, বিলাতে যাইতে বাধা,

দিতে তিনি ইচ্ছা করে ভাবে বোঝা যায়।।

বুঝিয়া মনের ফাঁক, প্রভু বলে “তবে থাক,

অমূল্য একাকী যাক সাগরের পারে।

আশীর্বাদ করি তারে, সে যেন জাতির তরে,

যশ মান সুকল্যাণ পারে আনিবারে।।”

জানাজানি হ’ল কথা, প্রমথ নোয়ায়ে মাথা,

মনে পেয়ে বড় ব্যথা কান্দে নিরালায়ে।

প্রমথের সাথে সাথে, প্রভু দুঃখ পায় চিতে,

কিছু পারে না বলিতে বিবাদের ভয়ে।।

নর-চক্র ফেলে গুণী, ঐশ-চক্রে আনে টানি,

আপন-আপন জানি ভক্ত গোপালেরে।

পূর্ণব্রহ্ম ইচ্ছাময়, কেবা তারে বাধা দেয়,

দিনে দিনে পূর্ণ হয় যাহা ইচ্ছা করে।।

শুন সেই পরিচয়, কিভাবে সম্ভব হয়,

প্রমথ রঞ্জন যায় সাগরের পারে।

প্রভু করে সুকৌশল, গোপালের ভক্তিবল,

অসম্ভব সুসম্ভব প্রভু কৃপা জোরে।।

শ্রীগুরু-চরিত কথা, ভবভয়হারী গাঁথা,

আপদ বিপদ নাশে মুহূর্ত সময়।

মহানন্দ কর্ম দোষে, কান্দে শুধু কুলে বসে,

পারাপারে যেয়ে তরী তারে ফেলে যায়।।

---০---