Page 247

শ্রীশ্রীবারুণীতে আগত ভক্তের পরিচয়

যশোর জেলার মধ্যে জয়পুর গ্রাম।

আসিল তারক চন্দ্র কবির সর্ব্বোত্তম।।

রস-রাজ রস-সিন্ধু রসের আগার।

আমি দীন কি বলিব মহিমা তাঁহার।।

নয়নে গলিত-ধারা বদনে হুতাশ।

বলে ‘কোথা হরি চাঁদ কোথা কৃত্তিবাস।।

গুরুচাঁদ রূপে প্রভু এসেছ ধরায়।

গেল দিন এ দীনের কি হবে উপায়?

আত্ম-খেদ করে সাধু চক্ষে বহে ধারা।

ধাম প্রতি ছেোটে যেন গাভী বৎস-হারা।।

বহু ভক্ত পিছে তাঁর বলে হরি বল।

কেন নাচে কেহ গায় কার চক্ষে জল।।

চলিতে তারক যেন ঢলি ঢলি পড়ে।

যাদব ধরেছে তাঁরে নিজ বক্ষ পরে।।

তারকের ভাব দেখি যাদব পাগল।

ভক্ত গণে কেন্দে কেন্দে বলে “হরি বল”।।

যাদব মল্লিক আর শ্রীযাদব ঢালী।

তারকের পিছে চলে করে গালাগালি।।

শ্রীরাম স্মরণে বহে উভ চক্ষে জল।

থেকে থেকে কেন্দে কেন্দে বলে হরিবল।।”

তারকের সঙ্গে আসে ভক্ত বহুতর।

নমঃশূদ্র তেলী মালী কামার কুমার।।

মহাভাবে মত্ত সাধু চলে ধাম-পানে।

পথি মধ্যে হল দেখা হরি পাল সনে।।

গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র যেন হল প্রকত্তর।

দুই ধারা এক হল প্রবল আকার।।

উঠিল নামের ঢেউ আকাশ ভেদিয়া।

চলিতেছে দুই ধারা ধারা ডুবাইয়া।।

পূর্ব্বেতে উঠিল মহা নামের কল্লোল।

নারিকেল বাড়ী উঠে সোর শব্দ গোল।।

হুঙ্কারে কাঁটিল যেন আকাশ পাতাল।

দলে দলে ছুটে ভক্ত সাজিয়া মাতাল।।

ভাবাকুল বলে প্রভু হরিবর এল।

কবিবর মনোহর সঙ্গেতে জুটিল।।

Page 248 start

বেহালের বেশে আসে অশ্বিনী গোঁসাই।

কেন্দে কেন্দে হরি বলে ঘন ছাড়ে হাই।।

কবিবর হরিবর দুর্গাপুরে ঘর।

খুড়তুত ভাই তাঁর কবি মনোহর।।

উভযে সুকবি ধন্য করে কবি গান।

শ্রীতারক চাঁদের শিষ্য দুই মতিমান।।

শ্রীতারক, মহানন্দ দুই মহাজন।

এক সাথে নাম গান একত্রে ভ্রমণ।।

মহানন্দে দেখি মন উতলা হইল।

পদে আত্মসমর্পণ হরিবর কৈল।।

সেই হরিবর এল নারিকেল বাড়ী।

মহানন্দ চরণেতে পড়িল আছাড়ি।।”

হুঙ্কার ছাড়িয়া ডাকে সে ছোট পাগল।

“এল হরি আয় সবে গেল ভবগোল।।”

হুঙ্কারে যতেক ভক্ত আসিয়া জুটিল।

ধাম প্রতি মহানন্দ তবে যাত্রা কৈল।।

নামের তুফানে আর প্রেমের বন্যায়।

কুল নারী ঘর চাড়ি পথেতে দাঁড়ায়।।

কেন্দে কেন্দে সে পাগলে বলে করজোড়ে।

‘দয়া-করে চল বাবা আমাদের ঘরে।।

দয়ার সাগর সেই স্বামী মহানন্দ।

তার ঘরে গিয়ে তারে দিল প্রেমানন্দ।।

এই রূপে ঘরে ঘরে যেতেছে গোঁসাই।

ভক্ত গণে বলে হরি বিরামাদি নাই।।

থাকিয়া থাকিয়া প্রভু ছাড়িছে হুঙ্কার।

“আয়রে কলির জীব দিন নাহি আর।”

এই ভাবে আসে ছুটে স্বামী মহানন্দ।

হৃদি-পুষ্প পরিপূর্ণ প্রেম-মকরন্দ।।

পূর্ব্বেতে উঠিয়া বন্যা চলে মহাবেগে।

অগ্রে চলে মহানন্দ বীর অনুরাগে।।

দক্ষিণে বাজিল শিঙ্গা ডঙ্কার নিক্কণ।

সাঙ্গপাঙ্গ সঙ্গে স্বামী শ্রীদেবী চরণ।।

যোজন-বিস্তৃত-শাখা মহাবৃক্ষ প্রায়।

মহাতেজা দেবীচাঁদ দাড়াইয়া রয়।।

‘বলরে হরি, বলরে হরি, হরিবল।

বলে হরি চক্ষে বারি ঝরে অবিরল।।

হরিবলে হেলে দুলে ছাড়িল হুঙ্কার।

মধুমতী নাচে রঙ্গে কাঁপিল সংসার।।

হুঙ্কারের ধ্বনি কর্ণে শুনিল গোপাল।

বলে “তোরা ওড়াকান্দী কে কে যাবি চল।।”

মাধব জুটিল সাথে জুটিল শ্রীনাথ।

লহ্মীখালী বেতকাটা হ’ল একসাথ।।

বানিয়ারী আসি সবে উপনীত হল।

দেবীচাঁদ বলে “শীঘ্র ওড়াকান্দী চল।।

ধন্যগ্রাম লহ্মীখালী খুলনা জিলায়।

মহাসাধু শ্রীগোপাল যেথা জন্ম লয়।।

দেবীচাঁদ গোস্বামীর কৃপা হৈল তাঁরে।

তাঁর গুণে মুক্তি পেল কোটী নারী নরে।।

কি ভাবে গোপাল পেল শ্রীগুরু দর্শণ।

সে সব রহস্য পরে করিব কীর্তন।।

এবে যাহা বলিতেছি এমন সময়।

শ্রীগোপাল ওড়াকান্দী কিছু কিছু যায়।।

দেবীচাঁদ-সঙ্গে চলে ভকত-তাঁহার।

এতোধিক পরিচয় নাহি কিছু আর।।

গোপাল, মাধব, আর মন্ডল শ্রীনাথ।

দেবীচাঁদ এক সাথে করে প্রণিপাত।।

গোপাল মাধব দোঁহে সম্পর্কেতে ভাই।

মামাত পিসাত ভাই সবে জানে তাই।।

গোপাল আসিল আর আসিল বিপিন।

কেনুভাঙ্গা বাস যাঁর ভক্তিতে প্রবীণ।।

বরিশাল জিলা মধ্যে কেনু ভাঙ্গা নাম।

সেই গ্রামে জন্ম নিল সেই গুণ ধাম।।

দেবীচাঁদ দেখি মন পাগল হইল।

দেহ মন গুরু পদে সকলি সঁপিল।।

Page 249 start

গৌরাঙ্গ বরণ সাধু আঁখি ছল ছল।

প্রণমি গুরুর পদে বলে ‘হরিবল’।।

রাজনগরেতে বাস ভকত নেপাল।

গণেশ আসিল সাথে বলে হরি বল।।

টুঙ্গীপাড়া গ্রামে সাধু শ্রীতপস্বীরাম।

প্রচন্ড শরীর তাঁর রূপে অনুপম।।

হরি বলে বাণীয়ারী হল উপস্থিত।

তাহাকে দেখিয়া দেবী অতি হরিষিত।।

সামর্থগাতীর গ্রামে যত ভক্ত ছিল।

বানিয়ারী গ্রামে আসি উপস্থিত হল।।

এমত আসিল ভক্ত অসংখ্য সংখ্যায়।

শুভক্ষণে যাত্রা করি ধাম প্রতি ধায়।।

অগ্রে চলে গোস্বামীজী পবিত্র মূরতি।

নিশান উড়ায়ে চলে ভকত-সংহতি।।

অবিরাম হরিনাম ডঙ্কা শিঙ্গা রোল।

অযূত কণ্ঠেতে ভক্ত বলে ‘হরি বোল।”

শঙ্খ-কন্ঠ ভগীরথ যেমতি প্রকারে।

পতিত-পাবনী-গঙ্গা আনিল সংসারে।।

অগ্রে চলে ভগীরথ শঙ্খ বাজাইয়া।

পশ্চাতে চলির গঙ্গা ধরা ডুবাইয়া।।

মহা রোলে সে কল্লোল ধাইয়া ছুটিল।

পাহাড়, নগর, বন সকলি ডুবিল।।

সেইমত অগ্রে ধায় গোস্বামী সুন্দর।

নামের বন্যঅয় ভক্ত ডুবায় সংসার।।

মালীখালী গ্রামে বাস শ্রীবদন রায়।

ভক্ত সেঙ্গ মনোরঙ্গে ওড়াকান্দী যায়।।

বাসুড়িয়া গ্রামে ঘর রাইচাঁদ নাম।

ওড়াকান্দী ধাম প্রতি চলে গুণধাম।।

রাইচরণের কথা বলি কিছু হেথা।

তারকচাঁদের খেলা অপূর্ব্ব বারতা।।

পিতৃহীন রাইচাঁদ ভাই দুইজন।

বহুকষ্টে তার মাতা করিল পালন।।

নিরুপায় জননীর অন্য চিন্তা নাই।

শুধুভাবে কোনভাবে এদের বাঁচাই।।

সদা কান্দে সেই নারী হরিচাঁদ বলে।

বসন তিতিয়া যায় নয়নের জলে।।

নারীর কান্নায় প্রভু তারে দয়া কৈল।

বাসুড়িয়া শ্রীতারক উপস্থিত হইল।।

একবাড়ী শ্রীতারক করে নাম গান।

সেই নারী আসি হেথা হল অধিষ্ঠান।।

তারকে দেখিয়া নারী হল জ্ঞানহারা।

অবিরল নেত্রে তার বহে জলধারা।।

এইভাবে কিছুকাল একদৃষ্টে চায়।

ক্ষণপরে পড়িল সে গোস্বামীর পায়।।

তার পুত্র রাইচাঁদ বালক তখন।

গোস্বামীর পদতটে করিল শয়ন।।

গোস্বামী ধরিয়া তারে শিরে দিল হাত।

বলে ‘রাই ভয় নাই দিনু আশীর্ব্বাদ।।

রাহা হবি প্রজা পাবি হরিভক্তগণে।

ভক্তি যেন থাকে সদা শ্রীহরি-চরণে।।

এই কথা গোস্বামীজী তারে যবে কয়।

উঠিয়া পালায় রাই ধরা নাহি দেয়।।

তাহা দেখি শ্রীতারক হলেন গম্ভীর।

সবে দেখে ঝরে তার দুই চক্ষে নীর।।

ভক্তগণে জিজ্ঞাসিল গোস্বামীর ঠাঁই।

“কি কারণে কাঁদে প্রভু গুনিবারে চাই।।”

তারক বলেন, ‘তাহা বলিবার নয়।

বিবিধ ইচ্ছাতে দেখি সবকর্ম্ম হয়।।

যে ঘটনা ঘটিয়াছে মম অগোচরে।

বুঝিলাম তাঁর ইচ্ছা প্রবল সংসারে।।”

এত বলি শ্রীতারক চুপ করি রয়।

পথে আসি গূঢ়-কথা ভকতে জানায়।।

“মম বাক্য কভু নাহি হইবে লঙ্ঘন।

ধনী হবে সাধু হবে সে রাইচরণ।।

Page 250 start

কিন্তু পরে পলাইবে হরি-ধর্ম্ম ছাড়ি।

এ-তত্ত্ব বুঝিনু আমি আশীর্ব্বাদ করি।।

যাহা দিয়া ফেলিয়াছি ফিরাতে না পারি।

তাই দুঃখে ফেলিলাম দুটি অশ্রুবারি।।”

যাহা যাহা শ্রীতারক বলিলেন কথা।

কালে কালে সেই সব ফলিল সর্ব্বথা।।

রাইচাঁদ ওড়াকান্দী মতুয়া হইল।

প্রেমে মত্ত মহাভাবে ভাবুক সাজিল।।

ধন হল শিষ্য পেল বাড়ির প্রতিষ্ঠা।

ক্রমে ওড়াকান্দী পরে হল নিষ্ঠা-ভ্রষ্টা।।

বৈরাগী আচারে করে জীবন যাপন।

তারকচাঁদের বাণী হইল পূরণ।।

ওড়াকাদন্দী প্রতি নিষ্ঠা ছিল সে সময়।

সেইকালে বারুণীতে ভক্তিসহ যায়।।

পাতলা নিবাসী সাধু নাম ধনঞ্জয়।

মতুয়ার সঙ্গে মিশে ধাম প্রতি ধায়।।

মহেশ বিশ্বাস আর যাদব বিশ্বাস।

পাগল সে বিচরণ তালতলা বাস।।

শ্রীচন্ডী বৈরাগী ধন্য শ্রীগোপাল রায়।

হরিবলে বাহু তুলে ওড়াকান্দী ধায়।।

মাধবেন্দ্র বাবুরাম, আসিল বিপিন।

শত শত ভক্ত কত আসে সংখ্যা হীন।।

রমণী গোঁসাই নামে হুড়কাতে বাস।

পারশুলা গ্রামে ঘর শ্রীহরি বিশ্বাস।।

কাথলিয়াবাসী সাধু নিবারণ চন্দ্র।

চাঁদকাঠি গ্রামে ভক্ত শ্রীগোপাল চন্দ্র।।

উমাচরণ, বিপিন, কৃষ্ণপুরবাসী।

দূরদেশ হতে ভক্ত উপস্থিত আসি।।

তেরখাদা গ্রামে ঘর তিনকড়ি নাম।

শ্রীহরির ভক্ত হল জাতিতে ইসলাম।।

মালঞ্চ নামিনী ধনি আসিল কান্দিয়া।

গুরুচাঁদে ভক্তি করে মনপ্রাণ দিয়া।।

ওড়াকান্দী মাচকান্দী রাউৎ খামার।

নড়াইল তারাইল কত বলি আর।।

সব গ্রামে আছে ভক্ত দৃঢ় অনুরাগে।

সর্বকার্যে ছুটে তারা সকলের আগে।।

এই ভাবে সর্বদিকে হতে ভক্তগণ।

শ্রীমহাবারুণী-তীর্থে করে আগমন।।

শ্রীতারক হরিপাল পশ্চিমের দিকে।

পূর্বে াতে শ্রীমহানন্দ প্রেমানন্দে থাকে।।

দক্ষিণ হইতে এল স্বামী দেবীচন্দ্র।

দিবানিশি সমভাব প্রেমে নাহি ভঙ্গ।।

ধামে আসি সবে মিশি করে হরি নাম।

শ্রীগুরু শ্রীপদে শেষে করিল প্রণাম।।

নামগানে প্রেমানন্দে দুই দিন যায়।

প্রতিবর্ষ বারুণীতে এই ভাব হয়।।

তেরশ সতের সালে যে-বারুণী হয়।

এবে শুন মহাপ্রভু তাতে কিবা কয়?

---০---