Page 184

ডক্টর মীডের সহিত প্রভুর ভাবালাপ ও ডক্টর মীডের চিন্তা

সভা অন্তে প্রভু কহে শ্রীশশীভূষণে।

“জল যোগ করাও মীডে অতিথি বিধানে।।

মীডে চাহি পুনঃ প্রভু বলিল বচন।

“শুন মীড শশী যাহা করে নিবেদন।।”

শশী বাবু প্রতি মীড চাহি তবে কয়।

“এই বুঝি আপনার প্রথম তনয়।।

ইহ সঙ্গে পূর্বে মোর আছে জানা শোনা।

শুন বড় কর্তা এক বিচিত্র ঘটনা।।

ভীষ্মবাবু যবে মোরে আসিবারে বলে।

ওড়াকান্দী আসি আমি কিছু কাল গেলে।।

খোঁজ করি ভীষ্মদেবে দেখা নাহি পাই।

মনো দুঃখে সেই কালে ফিরে যেতে চাই।।

বিল মধ্যে শশী বাবু আমাকে ধরিল।

নৌকা ফিরাইতে মোরে বিনয় করিল।।

আমি ভাবি এই ব্যক্তি নহে নমঃশূদ্র।

এর দেখি বেশভূষা সবখানে ভদ্র।।

নিশ্চয় কায়স্থ কিম্বা ব্রাহ্মণ সন্তান।

ছল করি মোরে বুঝি দেখায় সম্মান।।

তাহাতে প্রথমে আমি স্বীকৃত না হই।

মন বুঝিবারে তাঁরে বহু কথা কাই।।

অবশেষে মুখ দেখি সংশয় ঘুচিল।

তাই শশী বাবু মোরে ফিরায়ে আনিল।।”

এত বলি সেই মীড করে উচ্ছ হাস্য।

সকলে হাসিল শুনি মীড মুখে ভাষ্য।।

তবে’ত শীশরে চাহি মীড কহে হাসি।

“কিবা নিবেদন তব বল মোরে শশী।।

অতি বিনয়েতে তবে প্রভু-পুত্র কয়।

“জলযোগ দিতে তোমা বড় ইচ্ছা হয়।।

Page 185 start

আমরা দরিদ্র অতি না জানি আচার।

তব দয়া আছে জানি এ-জাতির উপর।।

তাহাতে সাহসী হয়ে করি নিবেদন।

অল্প কিছু ফল মূল করুন গ্রহণ।।”

একথা শুনিয়া মীড পত্নী-প্রতি চায়।

দেখিয়া মিসেস মীড হাসি হাসি কয়।।

“কিছুই আপত্তি মোর নাহি জলযোগে।

এই বাড়ী কেন যেন নিজ বাড়ী লাগে।।

ইহার কারণ আমি বুঝিয়া না পাই।

মনে হয় শশী যেন মোর নিজ ভাই।।

এই বাড়ী জল খেতে নাহি যেন মানা।

আন শশী বাবু আমি নিষেধ করি না।।”

প্রভুর গদীর কাছে শ্বেত বস্ত্রে ঢাকা।

সুন্দর টেবিল এক হইয়াছে রাখা।।

তার দুই দিকে দুই চেয়ার পাতিয়া।

শ্বেতবস্ত্রে সে দু’খানি রেখেছে মুড়িয়া।।

শশীবাবু মীড-পত্নী পানে চাহি কয়।

দয়া করি ঐ আসনে এবে যেতে হয়।।

উঠিল ডক্টরমীড পত্নীর সহিতে।

বসিল চেয়ারে দোঁহে চাহি চারি ভিতে।।

আপন গদীতে বসে প্রভু গুরুচন্দ্র।

কিছু দূরে দাঁড়াইল যত ভক্তবৃন্দ।।

শ্রীশশী, সুধন্য মিলি ভাই দুইজন।

জলযোগ দ্রব্য যত করে আনয়ন।।

বিস্তৃত টেবিল পরে রাখে সমুদয়।

শুন সবে এক মনে দ্রব্য-পরিচয়।।

কর্পূর-বাসতি জল কাঁচের ঝারিতে।

কাঁচের গেলাস দুই রাখে দুই ভিতে।।

বৃহৎ চীনের মাটী নির্ম্মিত বাসন।

দোঁহার সম্মুখে রাখে করিয়া যতন।।

ক্ষুদ্রাকৃতি চীনামাটী প্রস্তুত বাসনে।

বহুভাগে ফলমূল রাখিল যতনে।।

সুপক্ক শবরী কলা থালা সহ আনি।

চীনের বাসনে রাখে শ্রীশশী আপনি।।

সুপক্ক আম কাটি রাখে বাসনেতে।

দুই ঠাঁই জাম কিছু রাখে দুই ভিতে।।

কমলা লেবুর শোভা বলিহারী যাই।

সুপক্ক দাড়িম্ব দুটী রাখে দুই ঠাঁই।।

মনোলোভা কিবা শোভা আঙ্গুর আসিল।

সুপক্ক কাঁঠাল-গন্ধে সে গৃহে ভরিল।।

বেদানা, আপেল এল, এল নাশপাতি।

অঙ্গশোভা আহা কিবা খেজুরের পাতি।।

রসে-ভরা আনারস আতাফল কত।

জামরুল কালোজাম লিচুর সহিত।।

কচি শশা, তরমুজ আরো পক্ক বেল।

বোম্বাই পেঁপে এল অতি বড় দেল।।

সপেটা কতগুলি পেয়ারা আসিল।

অসুবিধা মনে করি তাল নাহি দিল।।

চারি ঠাঁই চারি ডাব পেটে ভরা জল।

ইহা ছাড়া বঙ্গদেশে মেলে কোন ফল?

কাবুলী বাদাম এল আখরোট সহ।

পোস্তা এল খাস্তা হয়ে কত কব কহ।।

‘অসম্ভব’ বলি যদি কেহ ভাব মনে।

তার ভ্রান্তি দূর লাগি বলিব এখানে।।

ওড়াকান্দী পাড়াগাঁয়ে এ সব জিনিষ।

কে জানিত বল নাকি ফলের হদিশ।।

আমি বলি একবার ওড়াকান্দী যাও।

দেখে এসো ওড়াকান্দী কত ফল পাও।।

হরিচাঁদ-কল্পবৃক্ষে ফলে সর্ব্বফল।

কিসের অভাব বল তুচ্ছ-বৃক্ষ-ফল।।

ভকত রঞ্জন যিনি ভক্ত প্রাণ ধন।

তাঁর কিছু থাকে নাকি অভাব কখন।।

দিবারাত্রি ভারে ভারে বিশ্ববাসী নর।

ফল ফুল আনি দেয় প্রভুর গোচর।।

Page 186 start

যেখানে যে ভাল দ্রব্যকোন ভক্ত পায়।

প্রভু লাগি প্রাণ দিয়া জোগাড় করয়।।

সেই হেতু বলিয়াছি অসম্ভব নয়।

গুরুচাঁদ-কল্পবৃ্ক্ষে সব মিলে যায়।।

কিবা সে ডক্টর মীড করিবে আহার।

শুদ্ধ হয়ে রহে দেখি ফলের বাহার।।

আনিল গরম জল ‘কেটলি’ করিয়া।

ডক্টর মীডের কাছে রাখিল ধরিয়া।।

চা আনে বিস্কুট আনে আনিল মাখন।

শ্রীঘ্রগতি কাজ করে ভাই দুইজন।।

ক্ষীর-নাড়ু ক্ষীর-সাজ বাসনে রাখিল।

চিনি রাখি দুই খান চামচ আনিল।।

কলিকাতা বাসকালে শ্রীশশীভূষণ।

এসব যোগাড় করি করে আনয়ন।।

রাখিল বিলাতী কেক স্বদেশী সন্দেশ।

মিশ্রীমাখা সরভাজ আয়োজন শেষ।।

সমস্ত দেখিয়া মীড মৃদুভাষে কয়।

“বড়কর্তা কেন কর অর্থ অপচয়।।

এত আয়োজন আমি কোথা দেখি নাই।

কত অর্থ ব্যয় হল মনে ভাবি তাই।।

আমরা ইংরেজ জাতি অল্পাহার করি।

অথচ এখানে খাদ্য আছে সারি সারি।।

অর্থ-অপচয় করে বাঙ্গালী সমাজ।

খাদ্য লাগি এত ব্যয় নহে ভাল কাজ।।

মীডের বচন শুনি প্রভু হাসি কয়।

আপনার অনুমান কিছু ঠিক নয়।।

অর্থ ব্যয় করি নাই এ সব সংগ্রহে।

এ সব আমার ঘরে মজুত ত রহে।।

আমার পিতা গুণে এই পরিচয়।

এ সব পাইতে মোর নাহি অর্থব্যয়।।

এই যে ভকত সব আছে দাঁড়াইয়া।

এরা সবে দেয় মোর পিতারে স্মরিয়া।।

অঙ্গুলি নির্দ্দেশে প্রভু ভক্ত দেখাইল।

স্থির-নেত্রে একদৃষ্টে মীড চেয়ে রল।।

সবার কাঙ্গাল বেশ এক বস্ত্রধারী।

অথচ নহেত কেহ কড়ার ভিখারী।।

তেজদীপ্ত অঙ্গ হতে জ্যোতিঃ বাহিরায়।

মেষ-শিশু-সম যেন চাহে নিরুপায়।।

দীর্ঘ কেশ দীর্ঘ শ্মশ্রু বলিষ্ঠ গঠন।

হীন বলে তার মধ্যে নহে কোন জন।।

ভক্তগণে দেখি মীড লাগে চমৎকার।

পত্নীকে ডাকিয়া বলে “দেখ একবার।।”

চাহিল মিসেস মীড মতুয়ার পানে।

আশ্চর্য্য মানিয়া তেঁহ ভাবে মনে মনে।।

সভাকালে লক্ষ্য নাহি করিয়াছি কিছু।

নিশ্চয় সকলে তবে বসেছিল পিছু।।

প্রথমে দেখিলে মনে না জাগে সম্ভ্রম।

কিছু পরে সেইভাবে জাগে ব্যতিক্রম।।

জ্বলন্ত-অনল যেন ভষ্ম-মাঝে-ঢাকা।

মূল-বৃক্ষ গুরুচাঁদ এরা সবে শাখা।।

ক্ষণেক দেখিয়া মেম দৃষ্টি ফিরাইল।

পত্নীরে সম্বোধি মীড কহিতে লাগিল।।

“দেখ প্রিয়া এই সব ভকত সকল।

রাগাত্মিকা ভক্তিরসে করে টলমল।।

সকলে দীনের বেশে আছে দাঁড়াইয়া।

কি যেন ইহারা সবে পেয়েছে আসিয়া।।

ইহাদের দরশনে মনে এই হয়।

ইহাদের বাসভূমি ধরাধামে নয়।।

মেষ-শিশু-সম যেন কত অহসায়।

কিন্তু বক্ষমাঝে যেন অগ্নিরাশি রয়।।

যে-শক্তি এদের বুকে এই তেজ দিল।

তার তুল্য শক্তি প্রেয়া কোথা আছে বল?

দিনে দিনে কি আশ্চর্য্য দেখি এই দেশে।

আমার হৃদয় মুগ্ধ হইল নিমেষে।।

Page 187 start

মনে বলে পরে পরে আর কি দেখিব।

পেয়েছি মনের মানুষ এই দেশে রব।।

এইভাবে আলাপনে বেলা শেষ হল।

জলপার করি মীড বিদায় হইল।।

অতঃপর ভক্ত সঙ্গে প্রভুর আলাপ।

প্রেমানন্দে করে সবে প্রেমের বিলাপ।।

সন্ধ্যা আগমনে সবে করে সংকীর্ত্তন।

মহারোল উঠি যেন ভেদিল গগন।।

আপন তাঁবুতে বসি মীড শুনি তাই।

সবে বলে “শুন শুন হেন শুনি নাই।।

উতরোল কলরোল করিছে কাহারা?

শঙ্খ শিঙ্গা বাজে শাঁখ বাজিছে টিকারা।।

মনে হয় এই শব্দ নহে বেশীদূর।

শব্দে যেন আকাশ-বাতাস-ভরপুর।।

চাকরের কাছে মীড জিজ্ঞাসে তখন।

“বল দেখি এই শব্দ কিসের কারণ?”

সাহেবের খানসামা সেই দেশে বাস।

সব-মর্ম্ম-জানা তার সে করে প্রকাশ।।

“হুজুরের গোচরার্থে নিবেদন করি।

মতুয়ারা উচ্চশব্দে বলিতেছে হরি।।

সাহেব বলিছে “বল মতুয়া কাহারা?

ভৃত্য বলে “হরিচান্দের ভক্ত যাহারা।।

ঠাকুরের বাড়ী যারা দাঁড়িইয়া ছিল।

দীর্ঘ কেশ দীনবেশ আঁখি ছল ছল।।”

সাহেব বলিছে “কেন মতুয়া উপাধি।

ভক্ত কেন নাহি বল ভক্ত ওরা যদি?”

ভৃত্য বলে “শুনিয়াছি এই পরিচয়।

হরিনামে তারা সবে মাতোয়ারা হয়।।

জ্ঞান শূণ্য হরিনামে করয় কীর্তন।

মাতোয়ারা তাই “মতো বলে সর্ব্বজন।।।”

সাহেব ভাবিয়া বলে “বুঝিনু সকল।

এইখানে নমঃশূদ্র পায় সর্ব্ববল।।

ঈশ্বরের প্রতি নিষ্ঠা মত্ত সেই নামে।

তাই শক্তিশালী এরা এই ধরা ধামে।।

এরা যারে মানে সেই কেমন পুরুষ।

নিশ্চয় সেজন নহে সামান্য মানুষ।।”

মতুয়া দেখিয়া মীড চিন্তিত হইল।

কবি কহে চিন্তা ছাড়ি হরি হরি বল।।

---০---