শহুরে হুতুম পেঁচা
অনেকদিন পর মনে হল আমার শহুরে জীবনের শুরুর অংশ নিয়ে একটা কিছু লেখা যায়। মজার মজার সেই সব ঘটনাগুলোর স্মৃতিকে কাল হরফে বাধাঁই করা যায়।যাহোক, প্রথম যেদিন সিলেটে আসলাম সঙ্গে ছিলেন আমার প্রিয় ফুফাতো ভাই যাকে আমি সুমন ভাই আবার মাঝে মাঝে নাম বিকৃত করে সুনু ভাই বলে ডাকতাম।তিনি আগে থেকেই আমার চাচা অর্থাৎ উনার মামার বাসায় থাকতেন। আমিও সেখানেই উঠলাম।শহরের বাসা মাশাআল্লাহ সাইজের কয়েকটি রুম।আমাদের রুমটিও ছিল সেই রকম।দু’পাশে দুটি খাট এক কোনায় একটি আলনা।সব কিছু ঠিক থাকলেও খাটের সাইজ দেখেই প্রথমদিনই আমার মনে আতংক ঢুকে গেল।এত ছোট জীবনে কখনো এত ছোট খাটে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা ছিলনা।প্রতিদিন যখন ঘুমাতে যেতাম সেই আতংকে থাকতাম। মনে হত কোনদিন জানি পড়েই যাবো খাট থেকে। একদিন কাকডাকা ভোরে সেই আশংকা সত্যি হল। ঘুমের মাঝে কি যেন একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। সেই স্বপ্নের ঘোরে হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম মশারী নিয়ে আমি ধপাস। একটু ব্যথা পেয়ে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে আবার উঠে গেলাম। বলে রাখা ভাল সেদিন ব্যাথার চেয়ে লজ্জাই বেশি লাগছিল। আমার ফুফাতো ভাই পাশের খাট থেকে বলে উঠেন কিরে কি হল। আমি বললাম না সাতসকালে একটু ব্যায়াম করছিলাম আরকি।
প্রথমদিকের মজার ঘটনারগুলোর মধ্যে রাস্তা হারানোটা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যপার। বেশির ভাগ সময় রিক্সা ড্রাইভারই ছিল আমার শেষ অবলম্বন। যখন এই শেষ অবলম্বন হঠাৎ মাঝ পথে গিয়ে বলতো মামা আমি তো নতুন রাস্তা চিনিনা একটু দেখিয়ে দিয়েন তখন কিন্তু আমার মুখটা সেই রকম দেখাতো।রিক্সা ড্রাইভারকে ছেড়ে আশপাশের ছোট ছোট দোকানদাররাই হতে উঠতো আমার অতি আপনজন। একবার কি এক কাজে গিয়েছিলাম আম্বরখানা গ্রামীনফোন অফিসে। অফিস থেকে ফেরার পথে রাস্তা বেমালুম ভুলে গেছি। ধরলাম সেই শেষ অবলম্বন রিক্সাড্রাইভার। তখন রমজান মাস। ভর দুপুর বেলা ড্রাইভার সাহেব তার আপন গতিতে আম্বরখানা থেকে সুবিদবাজারের রাস্তা ধরে যাচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম হয়তো সুবিদবাজার হয়ে কোন বাইপাশ রাস্তা আছে শেখঘাট যাবার তাই কথা বলছিলামনা। তাছাড়া আরেকটি কারনও ছিল কথা না বলার। আমি যদি ধরা খাই সেই ভয়ও কাজ করছিল মনে। রিক্সাড্রাইভারের কাছে তো ধরা খাওয়া মানে তো মান ইজ্জতের ব্যপার তাইনা। মাথার উপরে সুরুজ মামা আর নিচে রাস্তায় কাজ হচ্ছিল তাই শুধু পাথর বিছানো পথে রিক্সা ড্রাইভার যাচ্ছিল তো যাচ্ছিল। প্রায় ৪৫ মিনিট পর দেখা মিললো শাহজালাল বিজ্ঞান এন্ড প্রযুক্তি বিদ্যালয়ের সাইবোর্ড।এবার সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি কি শেখঘাটের রাস্তা চিনো। ড্রাইভার হা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো মামা আপনি চিনেন না।ততক্ষনে আমি শেষ। তারপর আবার সেই আশাপাশের ছোট দোকানদার। তারা উপদেশ দিল এখান থেকে ১০ টাকা দিয়ে সি.এন.জিতে যাবার। অত:পর সেই রিক্সাড্রাইভারকে ৫০ টাকা এবং সি.এন.জিতে ১০ টাকা দিয়ে সেই যাত্রায় উদ্ধার পেলাম।
শহুরে জীবনে আমার প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে মনির ছিল একজন।তাকেও আমি সংক্ষিপ্ত নামে শুধু মনি বলে ডাকতাম। প্রতিদিনই ফোনে কথা হত আমাদের। ও যখন শেখঘাট পয়েন্টে এসে আমাকে কল দিত তখন বলতাম মনি একটা মিনিট আমি আসছি। আমার চাচি তো একদিন মনি নামটি ধরে ফেললেন। তারপর কোন বিষয়ে মনি’র কথা তুলে বলছেন কে এই প্রিয় বান্ধবী যে প্রতিদিন কল দেয়। আমি তো হাসতে হাসতে শেষ। মনিরের সংক্ষিপ্ত রুপকে মনি বলে সেদিন উনাকেও বেশ হাসিয়েছিলাম।সেই মনির আর আমি একদিন বাংলালিংক অফিসে যাবো বলে প্ল্যান করি।বলে রাখা ভাল আমি তখন মোবাইল ফোনের বেশ বড় একজন ভক্ত ছিলাম।নিয়মিত তাদের অফিসে যাতায়ত করতাম নতুন নতুন অফারের আশায়।স্থানীয় মোবাইল দোকানদারের মুখে শুনলাম বাংলালিকের অফিস কদমতলী।আমাদের যাত্রা শুরু হল কদমতলীর দিকে।হেটে হেটে কীন ব্রিজ পেরিয়ে গেলাম কদমতলী। সেখানে গিয়ে শুনি বাংলালিংকের অফিস এখন জল্লারপার। তারপর আর কি করা আবারো হেটে হেটে ফিরলাম। তালতলায় আসতে আসতেই সন্ধা হয়ে গেল। চারিদিকে অন্ধকার লোডশেডিং চলছিল মনে হয়। ভাবলাম এখন আর বাসায় গিয়ে কি হবে তারচেয়ে ঘুরে আসি জল্লারপার। হোটেল গুলশানের ওদিকে যে ছোট রাস্তা সেটি ধরে এগুতে লাগলাম।নতুন রাস্তা তার উপর আবার চারিদিক অন্ধকার। জল্লারপার গিয়ে দেখি ততক্ষনে বাংলালিংক অফিস বন্ধ গেছে। ভাবলাম আরেকটু ঘুরি। মনির আর আমি এবার হোটেল গুলশানমুখী সেই পথে না গিয়ে অন্যদিকে গেলাম। মির্জাজাঙ্গালের দিকে হাটছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম এই এলাকাটা চেনা দরকার।অন্ধকারের মধ্যে হাটতে হাটতে হঠাৎ আমরা আবিষ্কার করি আবারো সেই হোটেল গুলশানের সামনে। বেশ টাসকি খেয়ে একজন আরেকজনের মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। কে জানতো আমরা এতক্ষন যে আবারো অন্য দিকে তালতলার পথেই হাটছিলাম ।
বি:দ্র- এই লেখাটি আমার ছোট ভাই অপুকে উৎসর্গ করলাম। যে এখন সিলেটে নতুন এবং আমার মতো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হচ্ছে। তাকে রাস্তা চিনাতে গিয়েই এই লেখার অবতারনা।