কেন আমি রাজাকার?
সময়টা ১৯৭১ সাল। আমি বসে বসে অপেক্ষা করছিলাম কখন আমার বাড়িতে যাওয়ার সময় হবে। প্রতিক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে অবশেষে এল সেই ভয়াবহ সংবাদটা। না, অনুমতি পাইনি। এরই মধ্যে কেটে গেল ১৬ বছর। অবশেষে একদিন অনুমতি আসলো। ১৯৮৭ সালের জানুয়ারী মাসের ১৪ তারিখ চলে এলাম নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশে। আহ! কি শান্তি।নিজের দেশ, নিজের আপনজন। বাড়িতে এসে সে কি কান্না! সবাই আমার কান্না দেখে হাসছে শুধু আমিই কাদঁছি। দেখার মত দৃশ্য ছিল ওটা। ইস তখন যদি ফেসবুক থাকতো তাহলে হয়তো কান্না ভেজা মুখ নিয়ে একটা ষ্ট্যাটাস দিতাম সাথে ‘এল ও এল’ লিখে দিতাম।
আমার দাদা মানুষটা অসম্ভব রকমের একটা ভাল মানুষ ছিলেন। তিনি প্রতিদিন আমাকে স্থানীয় ছানুর দোকান থেকে বাটারবন এনে খাওয়াতেন। বাটারবনের জন্য যে ভাল বলছি তা নয়। মানুষের ভাল-মন্দ নির্নয় করতে হয় তার চরিত্র দিয়ে। তিনি ছিলেন একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। পেশাগত জীবনে তশীলদার ছিলেন। সেই আমলের একজন তশীলদার হয়েও তার বাড়ীর কোন রাস্তা ছিলনা। একজন মানুষ কতটুকু সততার সাথে দায়িত্ব পালন করলে এমন হতে পারে সেই রকম কোন উদাহরন আমার জানা নাই। দাদা ইসলামী আদর্শে জীবন-যাপন করতেন। সংসারে ছিল ৫ মেয়ে এবং ৪ ছেলে। একজন মেয়ে বাল্যকালে মারা যাওয়া আমরা সেই সংখ্যাটাকে ৪ ইসটু ৪ করে ফেলছি। আমার ফুফুর ভাগ্যটাই আসলে খারাপ ছিল। অল্প বয়সে ভাল চিকিৎসার অভাবে তিনি শুধু নিজেই মারা যাননি সঙ্গে ভাই-বোন সংখ্যার লিষ্ট থেকে ও মুছে যান। বলা হয়নি আমার দাদা ছিলেন ইন্ডিয়ান। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন জামায়াত এর সার্পোটার। ১৯৭১সালে যুদ্ধে তাই তিনি তার দল জামায়াত এর অনুকরনে অখন্ড পাকিস্তান সাপোর্ট করেন। তবে কতিপয় রাজাকারদের কার্যকলাপে তিনি ছিলেন অনেকটাই বিব্রত। সরকারী চাকুরীজিবী হিসাবে মুক্তিযোদ্ধের পর দেওয়া অপশনে তিনি বাংলাদেশ থেকে যান। এই দেশে তার সম্পত্তি বলতে আমাদের বাড়ীটুকু ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। এইরকম আত্মীয়-স্বজনহীন একটা জায়গায় তিনি মানুষ করেন তার ৪ ছেলে এবং ৪ মেয়েকে।
মানুষ সাধারন তার বংশের টাইটেল পেয়ে থাকে। চৌধুরীর ছেলে যে চৌধুরী হবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। এই সর্ম্পকিত মজার একটা জিনিস গ্রামে প্রচলিত আছে। কেউ যদি চেয়াম্যান পদপ্রার্থী হয়ে নির্বাচনে হেরেও যায় তবে পরবর্তীতে মানুষ তাকে চেয়াম্যান টাইটেল দিয়ে দেয়। যুক্তিবিদ্যার লজিক অনুসারে যেহেতু আমার দাদা পাকিস্তান কে সাপোর্ট করেছিলেন সেহেতু আমার বাপ পাকিস্তানের সার্পোটার আর আমার বাপ যেহেতু পাকিস্তানের সার্পোটার সেহেতু আমি ও পাকিস্তানের সাপোর্টার অনিবার্য। আমার দাদা যদি রাজাকার হতেন তবে যুক্তিবিদ্যার ভাষায় আমি এবং আমার পরবর্তী প্রজন্ম ও রাজাকার হতো। ভাগ্যিস সেটা হয়নি। মহান এই যুক্তিবিদ্যা কে ম্মরন করতে গিয়ে যার নাম সর্বাগ্রে মনে পড়ে তিনি আমাদের এক মহান নেতা। যিনি সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখাতে গিয়ে নিজেই স্বপ্নের ঘোরে পড়ে হারিয়ে যান অকালেই। পাকিস্তানীদের হারিয়ে দিয়ে শেষতক নিজেই হারিয়ে যান নিজ পরিবার এবং কতিপয় দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তিনি হারিয়ে গেলেও তো আর যুক্তিবিদ্যা হারায়নি। নতুন করে আমরা সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখি নতুন প্রজন্মের চোখে। তবে এইবার সোনার দাম অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় স্বপ্নটার বাই-পাস সাজার্রী করাতে হয়। অপারেশনের পর আমরা এটার নাম দিলাম ডিজিটাল বাংলাদেশ। নামে কেমন যানি একটা ডিজিট ডিজিট ভাব! জিরো এবং হিরো কে নিয়ে খেলার করার এই স্বপ্নে জিরো এবং হিরো দুটোই বিদ্যমান ছিল শুধু দরকার ছিল যুথসই একটা মাঠের। একটা চিহ্নিত কোর্ট কে বেছে নেওয়া হল এর জন্য। সবকিছু যেহেতু আপডেট সেহেতু এখন প্রতিপক্ষের নামটা ও আপডেট করা দরকার। রাজাকার নামটা সেকেলে হয়ে যাওয়ার এর ডিজিটাল ভার্সণ বের হল ‘মানবতা বিরোধী অপরাধী’। খেলা শুরুর পালা। মানবতা বিরোধী অপরাধ নয় হাস্যকর একটা মামলা হল কথিত চিহ্নিত অপরাধীবৃন্দের উপর। ১৯৭১ সালে যারা অখন্ড পাকস্তিানকে সাপোর্ট করেছিলেন, প্রতিটা থানায় যাদের নামে অফুরন্ত কেইস জমা আছে এবং যাদের অবৈধ সন্তানে ভরে আছে এই ডিজিটাল বাংলাদেশ ধরে আনা হল তাদের। দরকার সাক্ষীর। সেটার ও ব্যবস্থা হল। হিরো পয়েন্ট থেকে হুংকার আসলো যারা এর বিরোধীতা করবে তারাই রাজাকার। চোখের সামনেই বদলে গেল অনেক কিছু। অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পেয়ে গেলেন রাজাকার নামক ডিজিটাল সার্টিফিকেট। এমন সময় হিরো পয়েন্টের অন্দরমহল থেকে একটি মানবতা বিরোধী খবর বেরিয়ে আসলো। হিরো পয়েন্টের হিরো এইবার ও বেইমানী করলো যুক্তিবিদ্যার লজিক কে প্রমান করতে।
কথায় আছে নিজের ঢোল নিজেই পিঠাতে হয়। আমাকে ও তাই করতে হল। ১৯৭১ সালে জন্ম না নিয়ে ও আমি রাজাকার হয়ে গেলাম। সাক্ষীর অভাব এই দেশে কখনো পড়েনি এবং পড়বেও না। ক্ষমতালোভীরা ক্ষমতার সার্থে সব কিছুই করতে পারে। তবে আর যাই হোক আমি কখনো বেইমান ছিলাম না এবং হবো ও না।