রায়হান সমগ্র- ভূতুড়ে পোষ্টার
রায়হান ! এই নামের সাথে জড়িয়ে আছে বেশ কিছু মজার স্মৃতি। কারন এই নামের আমার দু’জন মজার বন্ধু আছে। এক রায়হান আমার ডিপ্লোমা লাইফের প্রিয় বন্ধু। আরেকজন রায়হান ভাই অফিসের সবচেয়ে কাছের কলিগ। জানিনা কেন জানি রায়হান নামের মানুষদের আমি অসম্ভব জ্বালাতন করি। ইচ্ছে করেই তাদের সাথে লাগি। আনন্দ পাই তাদের ক্ষেপিয়ে। যদিও রায়হান নামের মানুষগন অসম্ভব হেল্পফুল এবং চরম ভাল মানুষ। আর তাই তারা আমার পাগলামীতে সহজে বিরক্ত হয় না। প্রথমে আসি প্রিয় বন্ধুর কাহিনীতে। ডায়েরীর পাতা থেকে নেওয়া স্মৃতিগুলো অবিকৃত অবস্থায় তুলে ধরলাম।
ডিপ্লোমা ইন ইজ্ঞিনিয়ারিং এ ক্লাস শুরুর প্রথমদিকের কাহিনীগুলো মনে পড়ছে। দু’তিন জন ছাড়া আমরা প্রায় সবাই ছিলাম সিলেটের নতুন বাসিন্দা। আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছিল কোন এক হাড় কাপাঁনো শীতে। তখন সবাই ভারী ভারী পোষাক পরে আসতো। সামনের সীটে বসার জন্য একটু তাড়াতাড়ি আসতো। একটা মানুষ ছিল যে কখনো সামনের সীটে বসতো না। একদম পিছনের সীট ছিল তার ফাষ্ট চয়েস। সন্ধা হলে ক্লাসরুমে মরটিন কয়েলের গন্ধ পাওয়া যেত। সেই কয়েলের গন্ধ আবিষ্কার করতে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম আমাদের বন্ধু রায়হানকে। বন্ধু রায়হান! কেমন জানি একটা মানুষ। চোখে হাই পাওয়ারের একটা চশমা, মাথায় জাফর ইকবালের মতো সাদা-কাল চুল। একটু যে অন্যরকম তা ভাবতে যে কারো হবেনা কোন ভুল। তার এই ব্যতিক্রমধর্মী কার্যকলাপ দেখে একদিন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ওর ব্যাগে একটা চিরুনী অভিযান চালাবো। যদিও সেদিন আমরা তার ব্যাগে কোন চিরুনী পাইনি কিন্তু মশার কয়েলের সাথে আরো পেয়েছিলাম কয়েকটা কলা, একটা দিয়াশলাইয়ের বক্স, পানির বোতল, মোমবাতি আরো কিছু অদ্ভুত জিনিস। পুরো ব্যপাটাই ঘটেছিল সম্পূন্য তার আগোচরে। যদিও তাকে আর পরে সরি বলা হয়নি।
একবার কি কারনে জানি কয়েকদিনের জন্য কলেজ বন্ধ ছিল। ছুটি কাটিয়ে অনেকদিন পর রায়হানের সাথে দেখা। ওর পিঠে একটা থাপ্পর মেরে বললাম কি খবর? আচমকা থাপ্পর খেয়ে জবাব না দিয়ে বললো ’থাপ্পর মারস কেরে?’ বুঝলাম সে আর দশজনের মতো সাধারন কোন মানুষ নয়। থাপ্পরটা তাই তাকে বন্ধুত্বের স্বাদ দেয়না। এরপর আরো কিছু কাহিনী ঘটলো তাকে নিয়ে আমার এবং আমাদের ব্যাচের আরো কয়েকজনের। আমরা সবাই মিলে যেখানে এক প্রান হয়ে থাকতাম সেখানে রায়হান ছিল সম্পূন্য ব্যতিক্রম। আমরা যখন একসাথে নামাযে যেতাম, চটপটি খেতাম, মেলায় ঘুরতাম তখন ও একা একা হয় বসে থাকতো নতুবা কোথায় যেত কেউ জানতোনা। তারপরই শুরু হল ওর সাথে ব্যতিক্রমি কিছু করা। সত্যি কথা বলতে গেলে সবাই আনন্দ পেতে লাগলো ব্যতিক্রমি এই মানুষের সাথে ব্যতিক্রমি কিছু করতে। শুরুটা হল পোষ্টারিং দিয়ে। তো এবার চলুন ঘুরে আসা যাক ডায়েরীর পাতা থেকে।
০৪- ফেব্রুয়ারী -২০০৯
আজ খুব মজার একটা দিন ছিল আমার জন্য। কিছু সুখবর আর বন্ধু রায়হানকে নিয়ে অসাধারণ একটা দিন কাটালাম। রায়হান? মদন মোহন কলেজের ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এর কম্পিউটার টেকনোলজির ৫ম পর্বের একজন ছাত্র। ও ইদানিং খুব ব্যস্ত প্রাইভেট টিউশনি নিয়ে। সাষ্টের স্টুডেন্ট নিয়ে ওর ঘটক পাখি ভাই টাইপের একটা প্রতিষ্টান খুলছে যেখানে বর কনে নয় টিউশনি দেওয়া নেওয়ার কাজ চলে। ওর এই ব্যস্ত দিনে আমাদের মজার আয়োজন ‘আপনি কি বিনা বেতনে পড়তে চান?’ পোষ্টারটি। ঠিক ধরেছেন ওর মোবাইল নাম্বার সম্বলিত পোষ্টারটি আজ লাগিয়ে দিলাম মদন মোহন কলেজের প্রবেশমুখসহ কলেজের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ন স্থানে। কাল থেকে হয়তো ওর ব্যস্থতায় আরেকটু মাথা গরম হওয়ার মতো কিছু সু-খবর চলে যাবে ওর ফোনে। অপেক্ষায় থাকলাম আগামি দিনের অজানার আনন্দের।।
০৫- ফেব্রুয়ারী -২০০৯
আজ বৃহস্পতিবার। একটা কাজে ঘুম থেকে উঠেই কলেজে যেতে হল। সাথে ছিল বন্ধু মনির, মারুফ আর সৈকত। কলেজে গিয়ে দেখলাম গতকাল রায়হানকে নিয়ে লাগানো পোষ্টারগুলো অক্ষত অবস্থায় আছে। মাথায় নতুন আরেকটা একটা আইডিয়া আসলো। মনিরকে দিয়ে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে রায়হানকে কল দিলাম। কিছুক্ষন রিংটোন হওয়ার পর অপরপ্রান্ত থেকে-
রায়হান: হ্যালো স্লামালিকুম কে বলছেন?
মনির: ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভাই আপনাদের একটা পোষ্টার দেখলাম। আমি পুলিশ লাইন স্কুল থেকে বলছি। আপনাদের ওখানে নাকি বিনা বেতনে পড়ানো হয়?
রায়হান: না ভাই এটা এখন নাই আর। এটা ফিলআপ হয়ে গেছে।
মনির: মাত্র দেখলাম ভাই।
রায়হান: হ্যাঁ ফিলআপ হয়ে গেছে। ওখানে লেখা দেখেন আসন সংখ্যা সীমিত। এখন আপনি চাইলে আপনাকে প্রাইভেট টিউটোর দেওয়া যেতে পারে। বাসায় গিয়ে পড়াবেন এবং আপনাকে মান্থলী পে করতে হবে। বুঝছেন? আর আপনি যেটার কথা বলছেন সেটা ফিলআপ হয়ে গেছে আর হবেনা।
মনির: ওহ তাহলে আপনার বাসায় গিয়ে পড়ান, না?
রায়হান: হ্যাঁ। টিচার লাগলে কল দিয়েন।
মনির: তা আপনারা মেয়েদের পড়ান নাকি ছেলেদের পড়ান?
রায়হান: ছেলে-মেয়ে সবাইকে পড়ানো হয়। মেয়েদের জন্য মেয়ে টিচার আছে, ছেলেদের জন্য ছেলে টিচার।
মনির: ওহ। তাহলে কি মেয়েদের ফ্রি পড়ান নাকি ছেলেদের।
রায়হান: কি??
মনির: না বলছিলাম ফ্রি টা কি মেয়েদের জন্য ছিল নাকি ছেলেদের..?
রায়হান: এটা সবার জন্য ছিল তবে মেয়েদেরকে নেইনি আমরা। কারন মেয়েদেরকে নিলে একটু সমস্যা হয় আর কি।
মনির: ও আচ্ছা। তাহলে ছেলেদের জন্য। তাইনা।
রায়হান: হ্যাঁ ছেলেদের জন্য। ওইটা আর নাই। ওইটা আর কোনদিন হবেনা। ফিলআপ হয়ে গেছে আর কখনো ফ্রি দেওয়া হবেনা।
মনির: তাহলে এই রকম মানুষদের হয়রানি করাটা একটা অপরাধের মতো ব্যাপার। এই যে পোষ্টারটা আছে এটা দেখে অনেকে তো আপনাদের কল দিবে তাইনা?
রায়হান: আপনি কোন জায়গা থেকে বলছেন?
মনির: আমি পুলিশ লাইন স্কুল থেকে বলছি ভাই।
রায়হান: আপনি কি স্টুডেন্ট নাকি অভিবাবক?
মনির: জ্বি ভাই আমি নিজেই স্টুডেন্ট। ক্লাস নাইনে পড়ি।
রায়হান: সমস্যা নাই। আপনার টিচার লাগলে জানাবেন। আপনাকে টিচার দেওয়া যাবে। ঠিক আছে। (লাইনটা কেটে গেল)
বিকালে ক্লাসে আসার পর আমরা সবাই মিলে তাকে ধরলাম। কি ব্যপার তোর পোষ্টার দেখলাম। তুই নাকি ইদানিং মানুষদের ফ্রি পড়াস !? কাহিনী কি বল।
রায়হান: আর বলিসনা বন্ধু। কয়েকদিন আগে পেপারের সাথে আমার কিছু লিফলেট দিয়েছিলাম। মনে হয় কোন শয়তান এটা দেখে আমার বিজনেসের পিছনে লাগছে। অনেক জায়গা থেকে কল আসছে। মনে হয় সারা সিলেটে পোষ্টারিং করে ফেলছে। (উল্লেখ্য যে, আরো কিছু কল আমরাই দিয়েছিলাম)
তার কথা শুনে আমরা শুধু মুচকী মুচকী হাসলাম। বেচারা রায়হান! ডিপ্লোমা লাইফের একদম শেষে এসে অবশ্য (আরো ১.৫ বছর পর) তাকে জানিয়েছিলাম এই কান্ডটি আমরা করেছিলাম। ততদিনে অবশ্য সে বন্ধুত্ব কি জিনিস তা বুঝে নিয়েছিল।
(এই লেখা প্রকাশ করার পূর্বে রায়হানের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হযেছে। রায়হানের অনুরোধে পোষ্টার থেকে ওর ফোন নাম্বারগুলো হাইড করে রাখা হল।)
আগামী শুক্রবারে থাকছে: রায়হান সমগ্র - শিশু পার্কে কিছুক্ষন