জীবনের গল্প - আমার ছোটবেলা
গ্রামের সকালটা শুরু হত মোরগের ডাক দিয়ে। ফজরের পর থেকে অবিরত ডেকে চলতো পুরুষ মোরগগুলো। মাঝে মধ্যে মহিলা মোরগগুলো তাদের সাথে সঙ্গ দিতে গলাটা হালকা কেশে নিত। আমার দাদি ছিলেন মোরগের চেয়েও এডভান্স। তিনি আরো আগে ঘুম থেকে উঠে তাহাজুদের নামায পড়ে করে ফযরের নামায আদায় করতেন। ঘুম ভাঙ্গার পর আমরা তার ওযীফা বা কুরআন মাজিদ তেলায়ত শুনতাম। দাদীর যখন কুরআন মাজিদ পড়া শেষ হত তখন আমরা আর কেউই আর বিছনায় থাকতে পারতামনা। গ্রামে তখনো বিদ্যুতের আগমন হয়নি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম সারারাত জ্বলে থাকা হারিকেনের বাতিটা অটো নিভে গেছে। কেন নিভতো সেই কারণটা খুজে পেতামনা। হয়তো সারা রাত জ্বলার পর তেল ফুরিয়ে যেত নতুবা ভোরের আলো দেখে দাদী নিভিয়ে দিতেন। যাহোক খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠাটা তখন খুব স্বাভাবিক বিষয় ছিল। তারপর ব্রাশ পেষ্ট নয় জমিয়ে রাখা ছাই দিযে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ার জন্য পুকুরে যেতে হত। ততক্ষনে আম্মা সবকিছু নিয়ে প্রস্তুত। মুখ ধুয়ে আসার পরই চলতো চা বিস্কুট খাওয়া। বেশির ভাগ সময় বিস্কুট হিসাবে থাকতো শক্ত টোষ্ট অথবা আনারকলি বিস্টিক। আমার দাদা ছিলেন খুব নিরিহ মানুষ। উনাকে আমি বুড়ো দাদা বলে ডাকতাম। উনি কারো ধারে কাছে থাকতেননা। ঘুম থেকে উঠার পরই চলে যেতেন কোথাও না কোথাও। সকাল বেলা উনাকে হাটতে যেতে দেখতাম। বেশিরভাগ দিন আমার জন্য রেলওয়ে স্টেশনের পাশে থাকা ছানুর দোকান থেকে কিছুনা কিছু একটা নিতে আসতেন। দাদার বড় আদরের এবং একমাত্র নাতি ছিলাম আমি যাকে তিনি দেখে যেতে পারছিলেন। সকাল বেলা আম্মা আর ফুফুরা মিলে খাবার তৈরী করতেন। আমরা তখন সকালে ভাত খেতাম। যেদিন মক্তবে যেতাম সেদিন চা বিস্কটু খেয়েেই চলে যেতাম। তারপর মক্তব থেকে বাড়িতে এসে ভাত খেতাম। তারপর আবার স্কুল যাত্রা। স্কুল থেকে ফিরে আর কোন কাজ থাকতোনা। সারাদিন হয় পাশের বাড়ির ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করতাম নতুবা ছোট চাচার সাথে সঙ্গ দিয়ে দাদার সাথে দুষ্টামি চলতো। দাদা তখন পিয়াজ আর জিগার নামের দু’টি ইউনানী ওষুধ খেতেন। আমি তখন বার বার এই দুটো ওষুধের নাম বলে উনাকে বিরক্ত করতাম। তিনি ধমক দিতেন, পালিয়ে বাচঁতাম। তবে কখনো মেরেছেন বলে মনে পড়েনা। আমার ছোট চাচা ছিলেন আরো বড় ফাযিল। উনি গাছের মগডালে বসে দাদার সাথে দুষ্টামি করতেন। দাদা তখন কিছু করতে পারতেননা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতেন। নিশ্চয়ই মনে মনে হাসতেন নিজের ছোট ছেলের এমন পাগলামী কর্মকান্ড দেখে। দুপুররের সূর্যটা একটু হেলে যাবার পর শুরু হত গোসল। সবাই মিলে একসাথে পুকুরে গোসল করতাম। কামাল সাবান ছিল তখনকার বিখ্যাত সাবান। অনেক সময় ওই সাবান দিয়ে শ্যাম্পুর কাজটা সারতাম। বিকালটা শুরু হত খাবারের পর থেকে। বিকালে পাশের বাড়িতে চলে যেতাম যেখানে আমার জন্য অপেক্ষায় থাকতো সেতু ভাই, টুকটুক আপু আর তাদের কাজের ছেলে গিয়াস। সেতু ভাইয়ের চাইতে টুকটুক আপুর সাথে আমার বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল। আমরা একসাথে পুতুলের বিয়ে দিতাম। টুকটুক আপুই আমাকে প্রথম ঘড়িতে সময় দেখা শিখিয়েছিলেন। গিয়াস ছিল বন্ধুর মত মানুষ। একবার আমি কি কারনে জানি আমি ওর গেঞ্জিটা ছিড়ে ফেলছিলাম। তারপর ডাইরেক্ট এসে সে বাড়িতে সেটা বিচার দেয়। সেদিন ছোট চাচার হাতে যে পেদানি খেয়েছিলাম তা আজো মনে আছে। বিকালে সেতু ভাইদের বাড়ির সামনে খেলার আয়োজন হত। সারা গ্রামের ছেলেমেয়েরা সেখানে দল বেধে আসতো। আমি বেশ ছোট থাকায় কেউ আমাকে কোন দলে নিতে চাইতো না কিন্তু পাশেই বাড়ি থাকা আর সেতু ভাইয়ের সাথে ভাল সম্পর্ক থাকার কারনে নিতে বাধ্য হত। সেতু ভাই তখন দেখতে বেশ মোটাসোটা মানুষ ছিলেন। অনেকে তাকে ভুতু বা মহিষ উপাধী দিয়েছিল। সেতু ভাইয়ের আব্বা ফখরুজ জামান চাচা ছিলেন বেশ মজার মানুষ। উনি কেন যানি ছাগল সহ্য করতে পারতেন না। যদি কোনক্রমে উনার বাড়িতে ছাগল ঢুকে যেত তবে সেটাকে ধরে সারাদিন বেঁধে রাখতেন। গ্রামে তখন গরু ছাগল জমা দেওয়ার একটি স্থান ছিল যেটাকে কুয়াড় বলতো। অনেক সময় আবার সেখানে পাঠিয়ে দিতেন। তারপর মালিকপক্ষ টাকা দিয়ে সেটা ছাড়িয়ে নিত সেখান থেকে। ছাগল ধরা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ ছিল। অনেক সময় চাচাকে আমি ছাগল ধরতে সাহায্য করতাম। তারপর ছাগলের উপর উঠে ঘোড়ার মত চড়তাম। সেতু ভাইদের বাড়ির সামনে বেশ ঝোপঝাড় আর একটি ছোট খালও ছিল। প্রায়ই সেখানে বসে বন্য ফুল দেখতাম। বন্য ফুলের মাতাল করা ঘ্রান উপভোগ করতাম। সন্ধা হতেই হাত মুখ ধুয়ে পড়াশুনায় বসতে হত। বাড়িতে তখন তিন বেলা খাবারের পাশাপাশি তিন বেলা চা চক্র চলতো। সন্ধা হতে না হতেই আবার সেই পর্ব শুরু হত। গ্রামের রাত ৮ টা তখন অনেক রাত। তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হত পরদিন ভোরে উঠার জন্য।
তিন চাকার গাড়ি
সাতাঁর কাটা শেখানোর মজার কাহিনী
সাইকেল চালানো শেখা
শীতের দিনের আগুন পোহানো
প্রথম কারেন্ট আসা
প্রথম সাদাকাল টেলিভিশন।