রুইলুই পাড়ার সাজেক
ঘড়ির কাঁটা তখন জানান দিন দিল রাত তখন ১২টা। ইউনিকের বাস ছাড়ার কথা ছিল ১১.৩০ এ । নাম যেহেতু ইউনিক ছাড়ার সময়টাও তো তাই ইউনিক
হওয়া চাই। যাহোক ইউনিক ইউনিক সময়েই ছাড়লো। পাশে পেলাম আমার বাসের প্রতিবেশি। প্রথম দর্শনে বেচারার পায়ে স্যান্ডেল আর পরনে ছেড়া জিন্স পেন্ট আবিষ্কার করলাম। শিহোরিত হলাম যখন দেখলাম উনার শরীরে বেশ কয়েক জায়গায় কাটাছেড়ার দাগ বিদ্যামান। মনে মনে চ্যালেন্জটা নিয়েই নিলাম। অনেক শখ করে পিক৬৯ থেকে একটা নিক পিলো কিনেছিলাম। ইচ্ছে ছিল বাসের মধ্যে আরাম করে ঘুমিয়ে যাবো। নিক পিলোটা ব্যাগের মধ্যেই থাকলো। চ্যালেন্জ ছিল সারাটারাত চোখ খুলা রেখে ঢাকা যাবার। মাঝপথে হোটেল লাল শালুকে একটা বিরতী। বাস থেকে নামার সময় ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছি দেখে ভদ্রলোক প্রথম আওয়াজ দিলেন। উনার পাশে ব্যাগ রেখে যাবার দাবী জানালেন। কিন্তু এই ভদ্রলোক যে নাছোড়বান্দা। ব্যাগের ভিতর তার জীবনরক্ষাকারী ওষুধ। অত:পর হার মানলেন সেই ভদ্রলোক। লাল শালুকে ঘটলো আরেক কাহিনী। মুখ ধুয়ে বাহিরে ফিরে দেখি চশমাটা চোখে নাই। বুঝলাম মাথাটা ঠিকমতো কাজ করছেনা। সারাদিন অফিস করার পর রাতে চোখ খুলা রেখে ভ্রমন মাথাটার জন্য হয়ে যাচ্ছে একটু যানি কেমন। আবারো ফিরি লাল শালুকে। এবার চোখে লাল শালুকের লাল অংশটা দেখতে পাই। চশমাটা যে রেখে যাওয়া জায়গায় নাই। হতাশ হয়ে যাই। অত:পর কাউন্টারে এসে চশমাটা ফেরত পাই।দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। আমাদের গন্তব্য খাগড়াছড়ি। রাত ১২টার বাসে আমাদের যাত্রা শুরু হয় আরামবাগ শ্যামলীর কাউন্টার থেকে। নির্ধারিত সময়ের পূর্বে সেখানে পৌছে রাজীব ভাই, ইব্রাহিম ভাই, মশিউর ভাইসহ আরো অনেক নতুন মুখ দেখতে পাই। ইব্রাহিম ভাই এবার তার পুরো দলবল নিয়ে এসেছেন। পরিচিত হই ভাবি আর বাচ্চাদের সাথে। অন্যদিকে রাজিব ভাইয়ের বোন সেজুতি আপুও তার হাজবেন্ড এবং ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছেন। একে একে সবার সাথে পরিচিত হই। নির্ধারিত সময়ে বাস ছাড়ে। মাঝপথে কুমিল্লাতে একটা বিরতী দিয়ে সকাল ৮ টায় আমরা পৌছে যাই খাগড়াছড়ি। তারপর দুটি চাঁন্দের গাড়িতে ২১ জন মানুষ চলে যাই নাস্তা করতে ইজোর রেস্টুরেন্টে। আদিবাসীদের খাবারের জন্য বিখ্যাত এই রেস্টুরেন্টে সকালে নাস্তা সেরে আবারো আমাদের যাত্রা শুরু হয় সাজেকে পথে। যেহেতু আর্মি ইস্কট সকাল ১০.৩০ এ আর তাই হাজাছড়া ঝর্ণাটা দেখার সময় হয়ে উঠেনা। । হাতে থাকা ক্যামেরাগুলো আস্তে আস্তে একটিভ হয়ে উঠে। কেউ স্টিল ইমেজের পাশাপাশি ভিডিও ধারন করে। সাজেকে উচু নিচু পথ চলতে চলতে হঠাৎ একটা উচু স্থানে এসে আমাদের গাড়িটা খারাপ হয়ে যায়। ভাগ্য ভাল যে ড্রাইভার সাথে সাথে ব্রেক কষে। মেইন স্পট তখন আমাদের থেকে মাত্র ১ কিমি দূরে। রাস্তা এতটাই খাড়া আর মাথার উপর আগুন ধরানো রোদে একটু জায়গা পায়ে উঠে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। অপেক্ষা করতে থাকি প্রথম গাড়িটার জন্য যেটা ইতিমধ্যেই সাজেক পৌছে গেছে। কিছুক্ষন পর সেটা এসে নিযে যায়। পৌছে দেয় সাজেকের নিরিবিলি কটেজে।
নিরিবিলি কটেজ! রুইলুই পাড়ার বেশ সুন্দর একটা কটেজ। কটেজ থেকে মেঘ আর পাহাড়ের মিতালীটা বেশ ভাল উপভোগ করা যায়। যেহেতু ওই দিন কড়া রোদ ছিল তাই মেঘের আনাঘোনা তেমন একটা চোখে পড়ছিলনা। কটেজে গিয়ে সবাই গোসলটা সেরে একটু রেস্ট নিয়ে নিয়ে নিলাম। আরেক দল রাজিব ভাইয়ের নেতৃত্বে আবিষ্কার করতে চলে গেল নতুন একটা ঝর্ণা। পাহাড় থেকে বেশ নিচে নেমে তারা ঝর্ণায় গোসল করে আসার পথে হাড়ে হাড়ে টের পেল পাহাড় কি জিনিস। সাথে পানি না নিয়ে যাওয়ায় আদিবাসিদের রোপন করা পেপে গাছ থেকে কাঁচা পেপে চিবিয়ে গেল পানির বিকল্প হিসাবে। আসলে পাহাড় দেখতে যতটা সহজ সরল বাস্তবের পাহাড় বিজয় ঠিক ততটাই কঠিন। এখানে হিসাবের একটু গড়মিল হলে আপনি শেষ। দিনটা শুক্রবার হওয়ায় আমরা চলে গেলাম জুম্মার নাযাজ আদায় করতে। নামায আদায় করে এসে কটেজে ফিরে বাঁশ খেলাম। ভ্রমনে বেশ ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত থাকায় কাঁচা বাশের তরকারিটার স্বাদ অমৃতের মতো লাগছিল। সাথে আরেকটা আইটেম ছিল বন মুরোগের ঝালফ্রাই। পেট ভরে খেয়ে তারপর দিলাম ঘুম। সেই ঘুম ভাঙ্গলো সূর্য ডুবার আগে।
সূর্য ডুবার দৃশ্য দেখতে ঠিক হল সাজেকের হেলিপ্যাডে যাবার । চান্দের গাড়ি নিয়ে আমরা সেখানে চলে গেলাম। কিন্ত একি আমাদের সূর্য মামা গেল কই? সাজেকের আকাশে তখন কাল মেঘের বিচরণ। চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন। আলো এতটাই কম ছিল যে সেখানে ছবি পযর্ন্ত তুলা যাচ্ছিলনা। কিছুটা সময় সেখানে কাটিয়ে চলে আসি কফি শপে। এবার কফির সাথে জমে উঠে সন্ধার আড্ডা। আড্ডার মাঝে হঠাৎ মেঘের কান্না শুরু হল। তড়িঘড়ি করে আমরা বৃষ্টির মাথায় নিয়ে কটেজে আসি।
বৃষ্টিটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। চাঁদ মামা তখন চাদেঁর দেশে। অভিমান করে বসে তারারাও। পূর্নিমাটা মিস হয়ে যাবার কষ্ট বুঝতে পারে মেঘ। আস্তে আস্তে মেঘ নিচে নেমে আসে আমাদের সঙ্গ দিতে। বৃষ্টি তখন উধাও হয়ে যায়। মেঘময় সাজেকে আমরা নিজেদের আবিষ্কার করি মেঘের ভিতর। বাড়তে থাকে রাত। বারবিউটা শেষ করে ১২টার দিকে চলে যাই আবারো হেলিপ্যাডে। শুরু হয় আমাদের সাথে মেঘের লুকোচুরি খেলা। ক্যামেরার সাটারে ধরা পড়া মেঘগুলো মুহুর্তেই পালিয়ে যায় দূর অজানার দেশে। আবারো আসে নতুন মেঘ। সাদা সাদা মেঘ ভিজিয়ে দেয় আমাদের । এরপর কটেজে ফিরে গিয়ে দেই ঘুম। সূর্য কে না হয় নাইবা বিদায় দিতে পারলাম কিন্তু বরণ করতে যে প্রস্তুত থাকা চাই।
সূর্য কে বরন করতে পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি চলে যাই হেলিপ্যাডে। পাহাড়ের গাযে তখন মেঘের বন্যা। সবুজ পাহাড়গুলোকে একেকটা বরফের সাগর মনে হচ্ছিল। চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল অপরুপ সাজের এই সাজেক দেখে। হেলিপ্যাডে তখন ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত সবাই। আস্তে আস্তে সাদা মেঘ গুলো লাল হয়ে উঠলো। বুঝা গেল এটা সূর্য মামার রাজকীয় আগমন। তারপর কিছুক্ষন সেখানে কাটিয়ে আমারা চলে যাই কংলাক পাহাড়ে। কংলাক পাহাড়ে সাজেকে সবচেয়ে উচু স্থানে চলতে লাগলো ফটোসেশন। পায়ের নিচে মেঘগুলোকে বন্দি করতে সবাই যেন বেশ রোমাঞ্চিত। আর্মি ইস্কটের কথা মনে পড়তেই আবার তড়িঘড়ি করে ফিরতে হয়। সাজেক ০ কিমি তে এসে চললো আরেকদফা ফটোসেশন। তারপর কটেজে ফিরে সকালের নাস্তা সেরে সাজেককে বিদায় জানানোর পালা। পথে পথে হাড় নেড়ে বিদায় জানালো সাজেকের আদিবাসি শিশুরা।
সাজেক যাবার পথে হাজাছড়া ঝর্ণা দেখে যাবার কথা থাকলে সেটা দেখতে হয় ফেরার পথে। ঝর্ণার পানিতে বেশ ঝাপাঝাপি করে ফিরি ইজোর রেস্টুরেন্টে। পাহাড়ি আইটেম ব্যাম্বু চিকেন, লইট্যা ফ্রাইসহ আরো বিভিন্ন আইটেম দিয়ে চলে দুপুরের ভোজন। খাবার শেষে তেতুলের জুসটা ছিল অসাধারন। ততক্ষনে রিসাং আর আলু টিলার রহস্যময় গুহা দেখতে আনচান করে মন। আবারো সাথে থাকা চান্দের গাড়ি নিয়ে দুই দল দুই দিকে চলে যায়। সাথে থাকা কাপলরা যায় আলুটিলায় আর আমরা নতুন কুঁড়িরা যাই চ্যালেজি; অভিযান রিসাং ঝর্ণায়। রিসাং ঝর্ণায় যেতে না যেতে বৃষ্টি হানা দিয়ে বসে। রাস্তা দূর্গম হওয়ায় মোটাসোটা মানুষদের গাড়িতে রেখে একদল চলে যায় রিসাং বিজয়ে। রিসাং ফেরার পথে ঘটে বেশ মজার এক ঘটনা। উচু পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি আবারো থেমে যায়। পিছন থেকে হেল্পার বলে উঠে জাম দেন, জাম দেন। তা শুনে সত্যি সত্যি এক ভাই গাড়ি থেকে জাম্প দিয়ে বসেন। গাড়িতে তখন আমরা নির্বিকার বসে আছি। আসলে এই জাম ছিল ব্রেক কষা। ভাইটি বেশ লজ্জা পান। তারপর আলু টিলার রহস্যময় গুহায় হারিয়ে যাই আমরা। মশালের আলোয় সেখানেও চলে ফটোসেশন। আলু টিলার গুহার পর ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে যাই জেলা পরিষদ পার্কে। ঝুলন্ত ব্রিজে ঝুলতে ঝুলতে ফিরি ইজোড় রেস্টুরেন্টে। তারপর রাতের খাবার হাসের মাংষের কালা ভুনা খেয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায় পযর্টক দল।