কেন আমি রাজাকার ? (শেষ কিস্তি)
আমি তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্র। একদিন ক্লাস বিরতীর সময় পরিচিত কিছু বড় ভাইয়েরা আমাদের স্কুলে এলেন। আমাদের দাওয়াত দিলেন তাদের সাথে মসজিদে যাবার জন্য। জোহরের নামাযের পর তাদের প্রোগ্রাম শুরু হল।সদা সত্য কথা বলা,নিয়মিত জামাতের সাথে নামায আদায় করা এবং পাঠ্যপুস্তকের সাথে সাথে জিহাদী বই পবিত্র কুরআন এবং হাদীস নিয়মিত তেলাওয়াত করার নির্দেশনা দিতে লাগলেন তারা। সেই সাথে তাদের সংঘটন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির কখন কিভাবে কার কার রগ কেটেছিল এবং স্বাধীনতার পর জন্ম নিয়ে কিভাবে রাজাকার হয়েছিল তার ব্যাখা দিলেন।তাদের কথাগুলো অসম্ভব ভাল লেগেছিল তাই তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম বড় হয়ে আমিও রাজাকার হবো।
ক্লাস এইট,নাইন,টেন নিয়মিত প্রোগ্রাম হতো। বিষয়বস্তু সেই একই। সংক্ষেপে যাকে বলে মগজ ধোলাই। অনুরোধ করতাম আমাকে বড় বড় প্রোগ্রামে নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমার রাজাকার ভাইয়েরা বয়স হয়নি বলে আমার অনুরোধ রাখতেন না।এস.এস.সি পাস করার পর প্রথম বড়সড় প্রোগ্রামে যাই। কেন্দ্রিয় সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু ছিলেন সেই প্রোগ্রামে প্রধান অতিথী। অনেক আশা নিয়ে গিয়েছিলাম সেই প্রোগ্রামে। ভাবছিলাম হয়তো এবার শিখবো কেমন করে রগ কাটে। কিন্তু আমার আশায় ঘুড়েবালী। ঘুরে ফিরে সেই পড়াশুনার কথা।প্রোগ্রামটি ছিল এস.এস.সি উত্তির্ণদের সংবর্ধনা দেওয়ার একটি প্রোগ্রাম।
পরিচিত হলাম আমাদের বড়লেখা দক্ষিনের সভাপতি জসিম ভাইয়ের সাথে। ঘটনে হালকা-পাতলা টাইপের এই মানুষটি অসম্ভব দ্রুততার সাথে মানুষের মোগজ ধোলাইয়ে সক্ষম ছিলেন। তার সাথে কেউ হাত মিলালে দেখা যেত সে শিবিরে যোগ দিয়ে ফেলতো। কি বলবো আমার ছোট এই জীবনে দেখা সেরা মানুষগুলোর মধ্যে জসিম ভাই ছিলেন অন্যতম।তিনি সভাপতি ছিলেন কিন্তু কখনো কাউকে কোন কাজ করার নির্দেশ দিতে দেখতাম না বরং নিজে নিজেই কাজগুলো করে ফেলতেন! সব সময় হাসিখুশি এই মানুষটির কাছ থেকে শিখেছিলাম কিভাবে একজন ভাল কর্মী হওয়া যায়।
ইন্টামিডিয়েটে পড়ার সময় জড়িয়ে পড়ি লেখালেখিতে। সংঘটনকে তখন তেমন সময় দেওয়া হয়নি। স্থানীয় কিশোর ভোরের শিশির ম্যাগজিন নিয়ে সংঘটনের সাথে বিরোধও বাধে। কিন্তু জসিম ভাইয়ের হস্তক্ষেপে সব ঠিক হয়ে যায়।এই.এস.সির পর আর শিবিরের সাথে জড়ানো হয়নি। জড়ানো হয়নি বললে ভুল হবে শিবিরই আমাকে জড়ায়নি। ডিপ্লোমার ক্লাস বিকালে হওয়ার কারনে মদন মোহন কলেজের মতো স্থানে থেকে আমি বা আমরা ছিলাম সম্পূন্য রাজনীতির বাহিরে।বিকালে প্রায়ই মসজিদে দেখা হতো সিলেট মহানগরী সভাপতি টিপু ভাইয়ের সাথে। অনুরোধ করতাম আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য। সারাদিনের কর্মকান্ডের পর বিকালে সময় না দিতে পারার অক্ষমতা প্রকাশ করতেন তিনি।
আজ জীবনের এই পর্যায়ে এসে এটা আমি বলতে পারি আমার জীবনের সেরা সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ক্লাস সেভেনের ওই মিটিং গিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তটা। এখন আমি এটা নিশ্চিত করতে পারি আমাদের ছোট ভাইদের জন্য ছাত্র-শিবির হচ্ছে একটা আশির্বাদ স্বরুপ। বিশ্বাস করুন নারায়ে তাকবিরে স্লোগান শুনলে এখনো আমার রক্তে কাঁপন ধরে। আমার মনে হয় আমি যদি মারা যাই আর আমার কবরের পাশ দিয়ে নারায়ে তাকবিরের মিছিল যায় তবে আমি আল্লাহর কাছে আরেকবার চাইবো সেই মিছিলে যোগ দিতে।