টুনাটুনির সিলেট ভ্রমন
টুনা আর টুনির বিয়ে হয়েছে মাত্র কিছুদিন হল। বিয়ের পর তারা নানান ফরমালিটিতে এতটাই ব্যাস্ত ছিল যে তারা একজন আরেকজনে একটুও সময় দিতে পারেনি। শ্বাস বন্ধ করা নগর জীবনে টুনা ভাবলো টুনিকে নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আসবে। একদিন রাতে টুনা আর টুনি মিলে প্ল্যান করলো এই বর্ষায় তারা সিলেট বেড়াতে যাবে। কেননা বর্ষাকাল হল সিলেট ভ্রমনে উপযুক্ত সময়। কিন্তু চাইলেই তো অপরিচিত একটা স্থানে হুট করে চলে যাওয়া যায় না। অন্যদিকে সিলেটের পরিচিতি কেউ ছিলনা টুনা আর টুনির। ভাবনায় পড়ে গেল তারা দু’জন।
টুনা আর টুনি মিলে দুইদিনের সিলেট ভ্রমনের একটা প্ল্যান করলো। তারা ঠিক করলো প্রথম দিন রাতারগুল আর বিছানাকান্দি যাবে। যদি সময়ে বাচাঁতে পারে তবে পান্থুমাই ঝর্ণাটাও দেখে আসবে ওই দিন। পরের দিন লালখাল-জাফলং দেখবে। ঠিক হয়ে গেল তাদের ট্যূার প্ল্যান যেটা কিনা যেকোন ভ্রমনের শুরুতেই করতে হয়ে। এবার টুনা ওই জায়গায়গুলো সিলেটের কোথায় অবস্থিত সেটা জানতে গুগলে সার্চ দিল। ফেরিওয়ালার ব্লগ থেকে বেশ কিছু ইনফোরমেশন পেল। টুনা এবার টুনিকে পড়ে শুনাতে লাগলো-
সিলেট জেলার ১৩টি উপজেলার একটি হল গোয়াইগাট। মেঘালয়ের একদম পাদদেশে অবস্থিত অপরুপ সুন্দর এই উপজেলাতে রয়েছে বাংলাদেশের চারটি আকর্ষনীয় পযর্টনস্পট রাতারগুল,বিছনাকান্দি,পান্থুমাই আর জাফলং। সিলেট শহর থেকে উল্লেখিত ৪টি স্পটে দুই ভাবে যাওয়া যায়। প্রথমে আম্বরখানা থেকে রাতারগুল গাড়িতে গিয়ে তারপর ইঞ্জিন চালিত নৌকা রিজার্ভ করে আপনি সবকটি স্পট কাভার করতে পারেন। নতুবা জাফলং গিয়েও ইঞ্জিন চালিত নৌকা রিজার্ভ নিয়ে সবকটি স্পট কাভার করতে পারবেন। তবে বলে রাখা ভাল যে একসাথে সবগুলো স্পট কাভার করতে নদীগুলোতে যথেষ্ট পরিমান পানি থাকতে হবে। নতুবা এটা সম্বভ নয়।আমার রিকোমেন্ডেশন হল এই ভাবে একসাথে ৪টি স্পট কাভার না করাই ভাল। আপনি ঘুরতে এসেছেন চোখ ভরে বাংলার রুপ উপভোগ করতে এসেছেন ম্যারাথন দৌড়ে আসেন নাই। আর যারা ম্যারথন দৌড়ে আসেন বা আসবেন তাদের জন্য এ লেখাটা না।
কিভাবে সাজাবেন আপনার প্ল্যান
সবগুলো স্পট ভাল ভাবে দেখার জন্য আপনার প্রয়োজন দুই দিন। যদি খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারেন এবং রিজার্ভ গাড়ি সাথে থাকে তবে চাইলে আপনি একসাথে রাতারগুল, বিছানাকান্দি আর পান্থুমাই একই দিনে কাভার করতে পারেন। আর যদি লোকাল গাড়িতে যান তবে পান্থুমাইটা বাদ দিন। পরেরদিন জাফলং আর লালাখাল। প্রথমদিন যাবার পথে প্রথমে পড়বে রাতারগুল। তারপর বিছানকান্দি। কনফিউশন কোথায় প্রথমে যাবেন। রাতারগুলটা হল বন। সকাল আর বিকালে একটু অন্ধকার হওয়াটা স্বাভাবিক। অন্যদিনে বিছানাকান্দি হল পানি যেখানে গোসল করার জন্য দরকার মধ্যদুপুর। আমার রিকোমেন্ডেশন হল প্রথমে বিছানাকান্দিই যান। কেন প্রথমে বিছানাকান্দি যাবেন? কারনটা সহজ। সীমান্তবর্তী এরিয়া হওয়ায় ওদিকটায় রাত হলে ডাকাতির ভয় থাকে। তাছাড়া প্রথমে বিছানাকান্দি গেলে আপনি ৩টার মধ্যে রাতরগুলে ব্যাক করতে পারেন। অন্যদিকে রাতারগুলে আসা মানে শহরের কাছকাছি চলে আসা। আপনি সম্পূন্য নিরাপদ থাকা।
যাতায়ত
গন্তব্য: বন্দরবাজার/জিন্দাবাজার/আম্বরখানা
রাস্তা: হুমায়ুন রশিদ চত্তর -> কদমতলী -> কীন ব্রিজ -> বন্দরবাজার -> জিন্দাবাজার -> চৌহাট্টা -> আম্বরখানা
ধরে নিলাম আপনি ঢাকা অথবা চট্রগ্রাম থেকে সিলেট আসছেন। প্রথমে সিলেটে আপানাকে স্বাগতম । কিভাবে আসলেন সেটা ম্যাটার নয় যদি বাসে অথবা ট্রেনে আসেন। বিমানে আসলে আপনি ভি.আই.পি মানুষ। বিমানের যাত্রিরা এই লেখাটি ফলো করার দরকার নাই। যাহোক বাস আপনাকে নামিয়ে দিতে পারে হুমায়ুন রশিদ চত্তর বা কদমতলী যেখানে ওদের কাউন্টার। আর ট্রেন হলে কদমতলী। কোথায় নামলেন সেটও কোন ম্যাটার নয়। আপনি সিলেট আসছেন সেটাই আসল। যদি একা বা সাথে মেয়ে মানুষ নিযে খুব ভোরে চলে আসেন তবে বলবো অন্তত সকাল ৭টা পযর্ন্ত বাস/ট্রেনের কাউন্টারে থাকুন। তারপর একটা রিক্সা/সি.এন.জি নিয়ে চলে আসুন বন্দরবাজার। আর যদি সকালের নাস্তাটা পানসী বা পাঁচ ভাইয়ে করার ইচ্ছে থাকে তবে জিন্দাবাজার যেতে পারেন। আপনি বন্দরবাজার বা জিন্দাবাজার যে বাজারে আসুন না কেন কোন সমস্যা নাই। আম্বারখানা কিন্তু বেশি দুরে না। আম্বরখানা? সিলেট শহর থেকে রাতারগুল বা বিছানাকান্দি যেতে আপনাকে যেতে হবে আম্বরখানা। বন্দরবাজার কালেক্টর জামে মসজিদের সামনে থেকে আম্বখানার লোকাল সি.এন.জি যায় । অন্যদিকে জিন্দাবাজার থেকে আম্বরখানা আরো কাছে। ওখান থেকে অবশ্য কোন লোকাল সি.এন.জি যায়না। চাইলে হেটে ১০ মিনিটের পথ নতুবা রিক্সায় ২০ টাকার ভাড়া আম্বরখানা যাওয়া যায়। বলে রাখা ভাল আপনি কিন্তু চাইলে হুমায়ুন রশির চত্তর বা কদমতলী থেকে সি.এন.জি রিজার্ভ করেও আম্বখানা যেতে পারেন। ওকে আম্বারখানা গেলেন। তারপর সি. এন.জি যেখানে নামিয়ে দিবে আপনাকে যেতে হবে রাস্তার ঠিক বিপরীত পাশে ডানে কিংবা বামে নয়। বিপরীত পাশে যাবার পর ওখানে দেখবেন সারিবদ্ধভাবে সি. এন.জি রাখা। লক্ষ্য করুন আপনার ডানপাশে একটি বড় টাওয়ার নাম গোল্ডেন টাওয়ার। আপনি সঠিক জায়গায় চলে এসেছেন। ওখান থেকে মাদুরগাট (রাতারগুল) আর হাদারপার (বিছানাকান্দি) এর লোকাল সি. এন.জি পাওয়া যায়। আপনি যেখানে যেতে চান সেখানের সি. এন.জিতে উঠে পড়ুন।
ভাড়া
ভাড়াটা নির্ভর করে আপনি লোকাল গাড়িতে যাচ্ছেন নাকি রিজার্ভ করে নিয়ে যাচ্ছেন সেটার উপর। ওকে প্রথমে লোকাল ভাড়াটা দেখে নেই। বলে রাখা ভাল লোকাল গাড়ি রাস্তা কিন্তু উপরে উল্লেখিত রাস্তার সাথে নাও মিলতে পারে। আর রিক্সার কোন লোকাল সার্ভিস নাই।
লোকাল ভাড়া
হুমায়ুন রশিদ চত্তর/কদমতলী টু বন্দরবাজার
সি.এন.জি: ১০ টাকা
যেতে সময় লাগবে: ১০ মিনিট
হুমায়ুন রশিদ চত্তর/কদমতলী টু জিন্দাবাজার/আম্বখানা
সি.এন.জি: ২০ টাকা
যেতে সময় লাগবে: ১৫/২০ মিনিট
বি:দ্র: সরাসরি জিন্দাবাজারের লোকাল গাড়ি নাই। আম্বরখানার গাড়িতে উঠতে হবে
আম্বরখানা টু মাদুরগাট
সি.এন.জি: ৮০ টাকা
যেতে সময় লাগবে: ৪৫ মিনিট
আম্বরখানা টু বিছানাকান্দি
সি.এন.জি: ১২০টাকা
যেতে সময় লাগবে: ১.৩০ মিনিট
রিজার্ভ ভাড়া:
হুমায়ুন রশিদ চত্তর টু বন্দরবাজার
রিক্সা হলে- : ৫০/৬০ টাকা
সি.এন.জি হলে- ১০০ টাকা
হুমায়ুন রশিদ চত্তর টু জিন্দাবাজার
রিক্সা হলে- : ৬০/৭০ টাকা
সি.এন.জি হলে- ১০০/১২০ টাকা
কদমতলী টু বন্দরবাজার
রিক্সা হলে- : ৩০/৪০ টাকা
সি.এন.জি হলে- ৮০ টাকা
কদমতলী টু জিন্দাবাজার
রিক্সা হলে- : ৪০/৫০ টাকা
সি.এন.জি হলে- ১০০ টাকা
কদমতলী টু আম্বরখানা
রিক্সা: না যাওয়ার চান্স বেশি গেলে ১০০ টাকা
সি.এন.জি হলে- ১৫০ টাকা
রাতারগুল হলে রিজার্ভ সি.এন.জি ভাড়া: ১০০০ টাকা (আসা-যাওয়া)
বিছানাকান্দি হলে রিজার্ভ সি.এন.জি ভাড়া: ১৩০০ টাকা (আসা-যাওয়া)
রাতারগুল এবং বিছানাকান্দি হলে রিজার্ভ সি.এন.জি ভাড়া: ১৫০০ টাকা (আসা-যাওয়া)
বিছানাকান্দি
হাদারপার বাজারে আপনাকে স্বাগতম। এ বাজারে রয়েছে বিছানাকান্দি যাবার দুটো ঘাট। তাছাড়া গাড়ি নিয়ে আসার পথে পাবেন আরো কিছু অলিখিত ঘাট। কারো কোন কথায় কান দিবেননা। আপনি মাঝপথে নামার দরকার নাই। সোজা বাজারে চলে আসুন। এবার বাজারে থাকা দুটো ঘাটের যেকোন একটিতে চলে যান। যদি খুব সকালে চলে আসেন তবে পান্থমাই যেতে পারেন সাথে লক্ষনছড়া। আর যদি আসতে দেরী হয় তবে বাদ দিন। কেননা আপনাকে বিছাকান্দি দেখে যেতে হবে রাতারগুল। যদি আপনারা মানুষ ৪ জনের বেশি হোন তবে নৌকা নিন। অনথ্যায় মটরবাইকে করেও মেইন স্পটে যেতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনাকে বাজারে গিয়ে ঘাটে যেতে হবে। তারপর লোকাল নৌকায় এপার থেকে ওপারে চলে যান। ওপারে দেখবেন বাইকওয়ালারা আপনার অপেক্ষায়। মনে রাখবেন বাইক শুধু বিছানাকান্দি যায়।
বিছানাকান্দি নৌকা ভাড়া: ৮০০টাকা (যাওয়া-আসা)
হাদারপার বাজার থেকে নৌকায় বিছানাকান্দি যেতে সময় লাগে: ২০/৩০ মিনিট
বাইক ভাড়া: ১ জন ১৫০ টাকা আর ২ জন হলে ১৫০ টাকা (শুধু যাওয়া)
বিছানাকান্দি প্লাস পান্থুমাই নৌকা ভাড়া: ১২০০ টাকা (যাওয়া-আসা)
হাদারপার বাজার থেকে নৌকায় পান্থুমাই যেতে সময় লাগে: ৫০/৬০ মিনিট
বিছানাকান্দি-পান্থুমাই-লক্ষনছড়া: ১৫০০টাকা (যাওয়া-আসা)
হাদারপার বাজার থেকে নৌকায় পান্থুমাই আর লক্ষনছাড়া যেতে সময় লাগে: ১.২০ মিনিট
নোট: যাতায়তের সময়টা নির্ভর করছে আপনার নৌকার স্পিড আর নদীতে পানি থাকার উপর। অনেক ক্ষেত্রে এটা তারতম্য হতে পারে।
রাতারগুল
বিছনাকান্দি থেকে রাতাগুল যাবার লোকাল সি.এন.জি পাবেননা। যদি আপনি লোকাল সি. এন.জিতে হাদারপার এসে থাকেন তবে রাতারগুল যাবার জন্য সি. এন.জি রিজার্ভ করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু রাতারগুলের জন্য না করে সিলেটে জন্য করলে ভাল হয়। কেননা রাতারগুল থেকে তো আপনাকে আবার সিলেট যেতে হবে। তবে আমার সাজেশন হচ্ছে যদি মানুষ বেশি হয়ে থাকেন তবে আম্বরখানা থেকে উভয় জায়গার জন্য একবারে সি. এন.জি রিজার্ভ করে যাওয়া। আর কম হলে কি করা। বিছানাকান্দি থেকে রাতারগুল হয়ে সিলেট আসতে ৮০০/৯০০ দাবী করে বসতে পারে যেহেতু ফিক্সড কোন রেট নাই। হাদারপারের মত রাতারগুলেও আছে তিনটা ঘাট। যেকোন একটা গাটে চলে যান। তারপর একটা নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ার রাতারগুল। তবে মনে রাখবেন সারাদিনের জন্য নৌকা রিজার্ভ করবেন না। এক্ষেত্রে ২ ঘন্টা যথেষ্ট টাইম। আর চাইলে কায়াক নিয়ে নিজে নিজে বেরিয়ে পড়তে পারেন। তবে কায়াক নিলে গাইড নিবেন অবশ্যই। নতুবা গহীন জঙ্গলে পথ হারিয়ে কোন অমঙ্গল ডেকে আনবেন কে জানে।
নৌকা ভাড়া: ৭৫০টাকা ২ঘন্টার জন্য।
কায়াক: ৩০০ টাকা (২ জন) এবং ৪৫০ টাকা (৩ জন) ১ঘন্টার এর জন্য। গাইড ফি ১০০ টাকা।
ভুরিভোজন: উভয় জায়গায় ভুরিভোজনের তেমন একটা ভাল ব্যবস্থা নাই। যা আছে তাতে মানিয়ে নিতে হবে। সীমান্তবর্তী এরিয়া ভাল কিছু আশা করা ভুল। সিলেট থেকে কিনে নিলে খাবার নষ্ট হবার চান্স থাকে।
কেনাকাটা: বিছানাকান্দি স্পটে ইন্ডিয়ার পন্যের বাজার বসে। ওখান থেকে চকলেট, সাবান, বিস্কিট, কসমেটিকস কিনতে পারেন।
টিপস
১. সি.এন.জি ড্রাইভার, নৌকার মাঝিকে বিশ্বাস করবেন তো মরবেন।
২. হাদারপার বাজারে যাবেন ড্রাইভারের কথায় মাঝপথে নামবেননা।
৩. নৌকার মাঝির সাথে দামাদামি করবেন।
৪. আজেবাজে কোন অফার গ্রহন করবেননা।
৫. বিছানাকান্দিতে কাপড় চেঞ্জ/ওয়াসরুম ফি ৫০ টাকা।
৬. ডি.এস.এল.আর ওয়ালাদের দেখা পাবেন। এদের দিয়ে ছবি না তোলানো ভাল। তুললে ১০ টাকা করে রাখবে ছবি প্রতি। তাদের আচরণ জঘন্য।
৭. ইন্ডিয়ান প্রোডাক্ট কিনলে এক্সপায়ার ডেট অবশ্যই দেখে নিবেন।
বিছানাকান্দি আর রাতারগুলের উপর এত্তোগুলো টিপস পড়ে টুনা আর টুনির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। রাতে সিলেট ফিরে কোথায় থাকবে সেটা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলো তারা। বিশেষ করে হোটেলের সেফটি ইস্যু তাদের ভাবিয়ে তুলতো। আবারো তারা গুগলের কাছে হাজির হল। গুগল তাদের জানালো কম টাকায় ভাল হোটেল হল সিলেটের তালতলায় অবস্থিত ইষ্ট এন্ড আর গুলশান। আর বড়লোকে জন্য সুপ্রিম, বিট্রেনিয়া, মেট্রো। বড়লোকের হোটেলগুলো একেকটা জায়গায় অবস্থিত। স্বল্পআয়ি মানুষ টুনা তার টুনিকে জানালো দেখো টুনি একদিন আমাদের ও হবে।