জীবনের গল্প - প্রাইমারি স্কুল
স্কুলের পথে… (১৯৯৩)
প্রথম যেদিন প্রাইমারী স্কুলে (কাঠালতলী সরকারি প্রাইমারী বিদ্যালয়) যাই সেদিনের কথা আজো আমার স্পষ্ট মনে আছে। একটা পলিথিনের ব্যাগের ভিতর বই ঢুকিয়ে আব্বুর পিছে পিছে স্কুলে গিয়েছিলাম সেদিন। আব্বুর বন্ধু প্রয়াত মখলিছ স্যার ছিলেন ওই স্কুলের শিক্ষক।স্যার আমার সাথে কিছুক্ষন মজা করে ভয়ভীতি দেখিয়ে তারপর সোজা নিয়ে গিয়েছিলেন ক্লাসে।প্রথম দিনের ক্লাস কেমন ছিল তা আজ আর মনে নাই। এরপর প্রতিদিনই স্কুলে যেতাম। কখনো আমার চাচার বাইসাইকেল চড়ে যেতাম। বলে রাখা ভাল আমার ছোট চাচা তখন বড়লেখা ডিগ্রী কলেজের ছাত্র। তো যেদিন ওনার সাইকেল চড়ে যেতাম সেদিন নিজেকে নায়ক নায়ক লাগতো।
ক্লাস ওয়ান
তখন স্কুলে ছোট ওয়ান এবং বড় ওয়ান বলে দুইটা শ্রেনী ছিল। যারা বাংলা এবং ইংরেজী বর্ণমালা পারতো তথা লিখতে এবং পড়তে পারতো তাদের দেওয়া হত বড় ওয়ানে। আমাকে বাড়ি থেকে এইগুলির শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল বিধায় আমি ছিলাম সরাসরী বড় ওয়ানের বড় ছাত্র।
ক্লাস টু
আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতো তখন আমরা এতোটা চালাক ছিলামনা। শুধু স্কুলে যাওয়া আসা এটাই ছিল আমাদের রোজকার কর্ম। অনেক ছোট এবং বোকা ছিলাম বিধায় ক্লাস ওয়ান এবং টু এর কোন স্মৃতি আর মনে পড়েনা।
ক্লাস থ্রি
ক্লাস ওয়ান এবং টু তে সম্ভবত ১০ টা থেকে ১২ টা পযর্ন্ত ক্লাস ছিল। ক্লাস থ্রিতে উঠার পর সেই রুটিন বদলে গেল। নিজেকে একটু বড় মনে হতে লাগলো। তখন আমাদের ক্লাস শুরু হত দুপুর ১২টা থেকে এবং শেষ হত বিকাল ৪ টায়। দুপুর ঠিক ১টার সময় আমরা কিছুক্ষনের বিরতী পেতাম।বিরতীর সময় সে কি আনন্দ! বেল বাজার আগেই কমরুল যাকে আমরা নাতী বলে ডাকতাম সে চলে যেত মাঠে। প্রচন্ড রোদ্রে চলতো আমাদের (লাই) ছুয়াছুয়ি খেলা।মাঝেমাঝে আবার বাড়িতে চলে আসতাম খাওয়ার জন্য।
ক্লাস ফোর
ক্লাস ফোরে উঠার পর শুরু হল সমস্যা। ফাইভে যারা ছিল তারা বৃত্তির জন্য মছন স্যারের কাছে পড়তো। সবাই একসাথে বসার জন্য তারা আমাদের বড় বড় ডেস্কগুলো নিয়ে যেত। এর প্রতিবাদে অনেকদিন অনেক ঝগড়ঝাটিও হয়েছিল।তাছাড়া আমার সহপাঠি বন্ধু ইমন তখন ছিল অতান্ত্য বড় মাপের একজন ইভটিজার। সে আমাদের সহপাঠিনী সোহানাকে খুব জ্বালাতন করতো। একবার এই নিয়ে তাকে হেড স্যারের মুখামুখি পযর্ন্ত হতে হয়েছিল।
ক্লাস ফাইভ(১৯৯৭)
ভেবেছিলাম ফাইভে উঠে কিছুটা শান্তি থাকবো। না, তা আর হয়ে উঠেনি। নতুন আরেক আপদ এসে জুটলো কপালে সেটা হল বৃত্তি নামক পরিক্ষা। আমাকে বৃত্তি পেতেই হবে সেই সংগ্রামে বাড়ীতে আব্বু, আমার দাদী, স্কুলে স্যারদের প্রচন্ড চাপে মাঝে মাঝে হাপিয়ে উঠতাম। আব্বুর সাথে এক টেবিলে বসে খাবার খেতামনা পড়ানোর ভয়ে। যদিও পরে আমি বৃত্তি পাইনি। আমার এই বৃত্তি না পাওয়া নিয়ে আব্বু খুব হতাশ হয়েছিলেন। তিনি আমার সাথে কথা বলা পযর্ন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমার ভুল ছিল আমি বৃত্তি পাওয়ার জন্য গনিত এবং ইংরেজিতে খুব জোর দিয়েছিলাম কিন্তু অন্য সাবজেক্টগুলো তেমন পড়া হয়ে উঠেনি।বলে রাখা তখন কিন্তু বৃত্তি পাওয়াটা আজকালকার এ প্লাসের চাইতেও মযার্দাবান ছিল।
যাদের হাতে হাতেখড়ি
যাহোক, এবার আসি স্যারদের কথায়। সব স্যারকে মনে না থাকলেও কয়েকজন গেথেঁ আছেন অন্তরে। হেড আব্দুল গনি স্যার, কান্তি স্যার, রেবাকা আপা, এবং রথীন্দ্র স্যার ছিলেন আমার খুব প্রিয়। হেড স্যারকে দেখতাম সব সময় হাতে বাশের বড় কঞ্চি নিয়ে ঘুরতেন। মারার চাইতে স্যার ভয়ভীতিই বেশি দেখাতেন। কান্তি স্যার আমাদের বাংলা পড়াতেন। স্যার ছিলেন সাক্ষাৎ যমদূত। সম্ভবত ক্লাস থ্রীতে স্যারকে আমরা প্রথম পাই। যেদিন কান্তি স্যারের বেত হতে আমার বাচতাম সেদিন আমরা নিজেদের সৌভাগ্যবান বলে মনে করতাম। রেবেকা আপার কথা কি বলবো, উনি সম্ভবত একদিনই আমাদের বেত্রাঘাত করেছিলেন। এটাই ছিল উনার ফাষ্ট এবং লাষ্ট বেত্রাঘাত। টিফিন এর ঠিক আগের পিরিওডে কি জানি কোন এক কারনবশত আমাকে আর ইমনকে মেরেছিলেন। টিফিনের ঠিক পরের ক্লাসে আপা কাছে ডেকে নিয়ে অনেক আদর করেছিলেন এবং মারার জন্য দু:খ প্রকাশ করেছিলেন।ঠিক মায়ের মতো কোমল ছিল রেবকার আপা মন। রথীন্দ্র স্যার আমাদের ম্যাথ পড়াতেন। স্যারের মুখে সব সময় পান থাকতো। স্যারের হাতে তেমন একটা মার খেয়েছি বলে মনে হয়না।অনান্য শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন আমাদের একজন ম্যাডাম যিনি বড়লেখা ডিগ্রী কলেজের এক স্যারের ওয়াইফ হিসাবে জানতাম তখন। ম্যাডামের সাথে আমার বা আমাদের তেমন কোন সম্পর্ক ছিলনা। ম্যাডাম শুধু ক্লাসে আসতেন এবং পড়াতেন এতটুকুই ছিল। পরে যখন ইন্টারমিডিয়েটে ম্যাডামের হাজবেন্ড তথা আমাদের ডিগ্রীর ওই স্যারের সাথে পরিচিত হই তখন কিন্তু স্যার আমাকে চিনতে পেরেছিলেন। আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম এই ঘটনায়। সম্ভবত ম্যাডাম গিযে স্যারের সাথে আমাদের কথা গল্প করেছিলেন। তখন বুঝেছিলাম প্রতিটা শিক্ষকেরই ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অন্তর থেকে একটা আলাদা টান থাকে অনেকে সেটা প্রকাশ করতে পারে অনেকে আবার পারেনা।
বন্ধুবান্ধব সমগ্র
বন্ধুবান্ধবীদের মধ্যে ইমন,সমছ,সাইদ,কমরুল,শিপা,সুমেনা,লাবনী,নাজমা,সোহানা,সেতু, আরিফ, রিপা, পারভিন এই নামগুলো ছিল উল্লেখযোগ্য। তাদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা চরিত্র ছিল।
ইমন: অসম্ভব মেধাবী এবং অসম্ভব শয়তান ছিল ইমন। বন্ধু সমছের সাথে ওর সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। কেন জানি সোহানাকে প্রচন্ড ঝালাতন করতো। মাঝেমাঝে আমার সাথেও এসে ঝগড়া করতো। তারপরও ওর সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়নি।
সমছ: বেচারা সব সময় ইমনের চিন্তায় ভীত থাকতো। শরীরের দিক থেকে একটু তরতাজা ছিল বিধায় ইমন ওকে আক্রমন করার সাহস পেতনা। মানুষ হিসাবে সব সময় স্পটবাদী ছিলও।
সাইদ: আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রথম বাইসাইকেল কিনে সাইদ। ও ছিল নিরিহ গোছের মানুষ। কারো সাথে কখনো ঝগড়া করতো না। আমি ওর সাইকেল ছড়ার জন্য মাঝে মাঝে ওর বাড়িতে যেতাম।
কমরুল: আন্তাজের নাতী কমরুল।আন্তাজ ছিল ওর নানার নাম। ওর নানার দোকান ছিল স্কুলের পাশে। ও নানার সাথে থাকতো এবং নানার সাথে সেই বয়সে ও দোকানদারী করতো।বলে রাখা ভাল সেই কমরুল এখন বড় ব্যাবসায়ী।
শিপা: মেয়েটা ছিল একদম নরম মনের। ওরা দুই বোন ছিল শিপা এবং সুমেনা। শিপা সবার সাথে সহজেই মিশতে পারতো আর সুমেনা ছিল একটু গম্ভীর মনের ফলে সহজে কারো সাথে কোন কথা বলতো না।
লাবনী: প্রাইমারী স্কুলে আমাদের ক্লাসে একমাত্র হিন্দু মেয়ে ছিল লাবনী।অনেক ভাল একটি মেয়ে ছিল। কথা খুব কম বলতো। বেশির ভাগ সময়েই মুচকী হাসতো।
নাজমা: কিছুটা বাচাঁল টাইপের ছিল। সবার সাথে মিশতে পারতো।ছাত্রী হিসাবে মন্দ ছিলনা। ওর আরেক ভাই সম্ববত চাচাতো ভাই আতিক ছিল আমাদের সহপাঠি।
সোহানা: ছেলেদের স্বপ্নের নায়িকা ছিল আমাদের সোহানা। গান গাইতে পারতো মুঠামুঠি। ওর বাড়ি ছিল আমার পাশেই। জানিনা কেন ওকে আমি বেশ ভয় পেতাম। বেশীর ভাগ সময়ই ওকে দেখলে পালিয়ে বাঁচতাম।
সেতু: ছেলেটা সম্ভবত ক্লাস ফোর পযর্ন্ত আমাদের সাথে ছিল। তারপর ওর পরিবারের সাথে মিডল ইষ্টের কোন একটা দেশে চলে যায়।একটু তোতলা ছিল। ওর তোতলামী মার্কা কথা শুনতে খুব ভাল লাগতো।
আরিফ: ছেলেরা ছেলেদের সাথে মিশবে এটাই স্বাভবিক কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের আরিফ ছিল একটু ব্যাতিক্রমি। ও বেশির ভাগ সময়ই মেয়েদের সাথে থাকতো। ওদের কথা শুনতো। ওর বোন রিপা ছিল আমাদের সহপাঠিনী। বেচারী বেশ মজার মানুষ ছিল।
পারভিন: পারভিনের বাড়িও ছিল আমার পাশেই। মেয়ে হিসাবে ও খুব ভাল ছিল এমনকি বন্ধু হিসাবেও। আমার এই বান্ধবীটি আজ আর নাই। বিয়ের কিছুদিন পরই এক মেয়ের জন্ম দিয়ে ও দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে।
দুলাল: বন্ধুটির বাড়ির কোথায় ছিল তা আজ আর মনে নাই। ওর সাথে বেশ মিশতাম আমি। একই রাস্তায় আমাদের বাড়ি হওয়ায় এক সাথে স্কুলে যেতাম এবং একই সাথে ফিরতাম। আমার ছোট বেলার বেশ ভাল বন্ধু ছিল দুলাল।
আয়েশা: “আয়েশা মাটির তলে (নিচে) পয়সা। পয়সা করে ঠনঠন। আয়েশার বাড়ি লন্ডন” আয়েশা নামক মেয়েটিকে আমরা এই বলে ক্ষেপাতাম প্রাইমারী স্কুলে। একদম নরমের মনের মেয়ে ছিল আয়েশা। খুব একটা কারো সাথে কথা বলতে তাকে কখনো দেখিনি। ওর সাথে আমার আরেকটি স্মৃতি জড়িয়ে আছে মাদ্রাসায় একবার একটি কোর্স করার সময়। রমজানে মাসে তখন তালিমুল ক্বিরাত নামে কোরআন শিক্ষা দেওয়া হত মাদ্রাসায়। আমি সেখানে ভর্তী হয়ে দেখি আয়েশাও ভর্তী হয়েছে সেখানে। একদিন ওর কুরআন শরিফ ডেস্ক থেকে কিভাবে জানি ফেলে দেই। তখনো সে কিছু বলেনি।বন্ধুটি আজ আর নাই আমাদের মাঝে। দূর তারাদের মাঝে হারিয়ে গেছে আমাদের আয়েশা।
লেখাটি ক্রমবর্ধমান। অনেক বন্ধুর নাম ভুলে গেছি সাথে অনেকের চরিত্রও।ছোট বেলার ছোট ছোট স্মৃতিগুলো সহজে মনে করা সহজ নয়। কেউ ভুল ধরিয়ে দিলে খুশি হই। #primary #school #jiboner golpo
এই লেখাটা উৎসর্গ করলাম আমাদের বন্ধু আয়েশা, খয়রুল আর পারভিনকে যারা আমাদের ছেড়ে দূর তারাদের দেশে।