বাংলার ভেনিসে একদিন
ঘড়ির কাটা তখন সন্ধা ৭ টায়। কমলাপুরের এক অখ্যাত হোটেল থেকে বের হলাম সদরগাটের উদ্দেশ্য। হাতে সময় ২ ঘন্টা। কমলাপুর থেকে সদরগাটযেতে হবে। গুগলম্যাপ বলছে ৩০ মিনিটের মত সময় লাগার কথা। হোটেল থেকে বের হয়ে দেখি চারিদিকে মানুষের মিছিল।যেহেতু দিনটা বৃহস্পতিবারসুতরা; ফাকা রাস্তার আশা করাটা মনকে ধোকাঁ দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয় । অনেক ভেবে চিন্তে তাই রিক্সা নিলাম। পাঠাও এর কথা বার বার মাথায়আসছিল কিন্তু কেন জানি ফাইনালি আর পাঠাওকে পাঠাও বলতে পারলামনা। রিক্সা নিয়ে ১ ঘন্টায় অল্প কিছু দূর এগুলাম। একটা জায়গায় এসে রিক্সাএমন ভাবে থামলো যে ১৫ মিনিট ধরে আর সামনে এগুনোর কোন লক্ষন নাই। ঘড়ির কাটা তখন ক্রমশ উর্ধমুখি হয়ে ৮.১৫ তে। প্রচন্ড সিদ্ধান্তহীনতায়ভূগছি। রাজীব ভাইয়ের বারবার ফোন ঠিক ৯টায় ছেড়ে যাবে এম ভি সুন্দরবন। সিলেট থেকে ঢাকা এসে সামান্য এক জ্যামের জন্য লঞ্চ মিস করবোভাবতেই হার্টবাবুও তখন টাচিকার্ডিয়া নাকি ব্রাডিকার্ডিয়ায় আক্রান্ত হল বুঝতে পারলামনা। অবশেষে রিক্সা ছেড়ে হাটাহাটির পথ ধরলাম। ঠিক ৫মিনিট পর জ্যাম পেরিয়ে আরেকটা রিক্সা চড়লাম। ভাগ্য বিধাতা এবার আমার সঙ্গি হলেন। ঢাকার অফিস ফেরত মানুষের রাস্তা ফাকা করে দিলেন।মাত্র ২০ মিনিটে পৌছে গেলাম সদরগাট।
জীবনের প্রথম লঞ্চ চড়া। মনে মনে তাই কলেমা এবং আয়াতুল কুরসী পড়া। এক্সটা সাপোর্ট হিসাবে লাইফ জ্যাকেট সাথে করে নেওয়া। লঞ্চের প্রবেশমুখেই রাজিব ভাইয়ের সাথে দেখা। কোলাকুলি করে লঞ্চের ভিতর চলে যাওয়া। ভিতরে অপেক্ষমান শতাব্দী আপু, তুলি আপু, শাহরিয়ার ভাই আরমশিউর ভাইয়ের দেখা পাওয়া। লঞ্চের ডেক কি জিনিস তখনো তা ছিল অজানা। মনে মনে লঞ্চের ছাদকে কে ডেক ধরে মনকে দিচ্ছিলাম সান্তনা। তারপরদেখি লঞ্চের মেঝেকেই ডেক বলে। ওখানেই খাওয়া-দাওয়া এবং ঘুম সবই চলে। মোট ৪ তলা এম.ভি সুন্দরবন। ১ম এবং ২য় তলা ডেক আর পরের দুই তলায় কেবিনের আয়োজন। ইচ্ছে ছিল কেবিনে যাওয়ার কিন্তু তখন আর উপায় নাইটিকেট পাবার। অত:পর ডেকেই আসন পাওয়া। আর ডেকে বসেই গ্রুপের সবার সাথে নবাবী কায়দায় রাতের খাবার পুরান ঢাকার নবাবী রেস্টুরেন্টের বিরিয়ানী খাওয়া। তারপর কিছুক্ষন বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য্য আর রাতের ঢাকা দেখা।লঞ্চের তিন তলায় উঠে ঠান্ডা হাওয়া গায়ে মাখা। একসময় ঘুমের রাজ্য হারিয়ে লঞ্চের ডেকেই নাক ডাকা।
ভোর ৫ টা। ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল। হ্যাঁ আমরা পৌছে গেছি বাংলার ভেনিস বরিশাল। লঞ্চ থেকে নেমে প্রথমেই টাসকী খাই। বরিশাল সদরগাটে এসে চট্রগ্রাম মুসলিম হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের দেখা পাই। তারপর আর কি চাওয়া।বরিশাল এসে বরিশালে নয় চট্রগ্রামে নাস্তা খাওয়া। রেস্টুরেন্টের ডাল ভাজিটা ছিল অসাধারন। নিশ্চিত করে বলতে পারি এটার স্বাদ কেড়ে নিবে ভোজন রসিক যে কারো মন। নাস্তা শেষে মাহেন্দ্র নিয়ে সবুজ প্রকৃতি দেখতে দেখতেবানারীপাড়ার উদ্দেশ্য চলা। পথে পথে বরিশালের গল্প শুনা এবং নিজে থেকে কিছু বলা। একসময় মাহেন্দ্র এসে থামলো বানারীপাড়ায়। সন্ধ্যা নদীতে ট্রলার নিয়ে মাঝি তখন আমাদের অপেক্ষায়। আসল যাত্রা শুরু হল এবার। ভাসমান পেয়ারাবাজার ঘুরে দেখার। পথে পথে নৌকা ভর্তী পেয়ারা, সবজী আর আমড়া, দেখে দেখে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। একসময় আমাদের ট্রলার হারিয়ে গেল সবুজের মাঝে। দুপাশে পেয়ারা বাগান মাঝে ছোট একটা খাল প্রকৃতি যেখানে সেজেছে অপরুপসাজে। নিজেকে হারাতে হারাতে এক সময় আমরা হারিয়ে গেলাম ভীমরুলী ভাসমান পেয়ারা বাজারে। যেখানে এক বা দুইটা নয় পেয়ারা বিক্রি হয় হাজারে হাজারে। এবার পেয়ারা খাবার ক্ষন । কিন্তু না দিতে হল মিষ্টিতে মন। মিষ্টি ! হ্যাঁভীমরুলী বাজারের এমন স্বাদের মিষ্টি না খেলে হত মিস ভীষন। তারপর ফেরার পথে খালের স্রোতে ঝাপাঝাপি করা। গাছের উপর থেকে লাফ দিয়ে পানিতে পড়া। দুপুরটা দ্রুত চলে যায়। পেট ছো ছো করতে থাকে অসম্বভ ক্ষিধায়। খালেরপারেই কোন এক রেস্টুরেন্টে হল আমাদের খাবারের আয়োজন। খাঁটি ইলিশ দিয়ে হল দুপুরের ভোজন। এবার বাসে করে সোজা চলে যাই দূর্গাসাগরে। সময়টা কেটে যায় দীঘির জলে পা ভিজিয়ে আর চিত্রা হরিনের সাথে মিতালী করে। বরিশালএসে বরিশালের আমড়ার স্বাদ কেমনে যাবে বাদ। ইতি ভাবীকে সঙ্গে নিয়ে তাই বেশ কয়েকবার টক নয় মিষ্টি আমড়া খাই। তারপর আবার গুটিয়ার মাহেন্দ্র ধরা। উদ্দেশ্য বাইতুল আমান মসজিদের সৌন্দয্য উপভোগ করা। অপরুপ সাজেরএই মসজিদটি দেখতে দেখতে কেটে যায় বেলা। অতএব এবার ফেরার পালা। ফেরার পথে রাজিব ভাইয়ের আবারো বায়না। বরিশাল এসে বরিশালের মিষ্টি আর দই কেউ না খেয়ে যায়না। কেমনে করি মিস। আমিও যে ভীষন ভোজন রসিক।অত:পর পেট ফুলিয়ে লঞ্চে চড়া। অসম্ভব ক্লান্তিতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া। তারপর আবার শুরু হয় কীর্তণখোলা নদীর বুকে ডাকার প্রতিযোগীতা।
এই ট্যূরের আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানাই বরিশাল নিবাসী রাজীব আব্দুল্লাহ ভাইকে। সেই সাথে ধন্যবাদ বরিশালের বাসীন্দা ইতি ভাবী, শতাব্দী আপু, তুলি আপুকে। ধন্যবাদ শাহরিয়ার ভাই (একদম চুপচাপ মানব এবং ঘুম প্রতিযোগীতায়বিজয়ী ), মশিউর ভাইকে যাত্রাপথে সঙ্গ দেওয়ার জন্য এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সাহায্য করার জন্য। এই দুই ভাইয়ের সাথে নতুন পরিচয় কিন্তু কখনো তা মনে হয়নি। আরো ধন্যবাদ আমাদের সাথে আরো যারা ছিলেন কিন্তু সময় এবংসুযোগের অভাবে যাদের সাথে তেমন মিশতে পারিনি।