বাপ-দাদার জন্মভূমিতে
গত বৃহস্পতিবারটা আমার জন্য অন্যান্য বৃহস্পতিবার থেকে একটু ভিন্ন ছিল। এই প্রথম গত বৃহস্পতিবারে দেশের বাহিরে পা রাখি আমি। খুব ভোরে ঘুম থেকে
উঠে নাস্তা সেরে বাসে করে চলে গেলাম ডাউকি বর্ডারে। তারপর সেখান থেকে ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে সোজা চলে গেলাম বাপ-দাদার জন্মভূমিতে। বাপ-দাদার জন্মভূমি। আহ! এ অনুভূত আসলে লিখে প্রকাশ করার মত নয়। যাহোক ডাউকি ব্রিজটা পার হতেই অবাক নয়নে প্রতক্ষ্য করতে থাকলাম প্রিয়বাংলাদেশকে। চারিদিকে শুধু পানি তার মাঝে দু চারটা বসতি। গাড়ি আস্তে আস্তে এগুতে লাগলো। ডাউকি গ্রামে প্রবেশ করতেই শাফী ভাই কিছু ডলারএক্সচেন্জ করে নিলেন স্থানীয় দোকানে। তারপর চলে যাই ওয়ার্নক্রান ফলসে। সেখানে ফটোসেশন শেষ করে যাই বড়হিল ফলসে। এদিকটায় পচন্ড গরমথাকায় সেখানে বেশিক্ষন থাকা হয়নি। এবার যাত্রা শুরু হয় দক্ষিন এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্চন গ্রাম মওলীননোঙ্গ ভিলেজে। প্রতিটা বাড়ির সামনে ফুলেরবাগান তার মাঝে রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা। এ অনুভুতি সত্যি অসাধারণ। একসময় পৌছে গেলাম মওলীননোঙ্গ ভিলেজের লিভিং রুট ব্রিজে।গাছের তৈরী প্রাকৃতিক এই ব্রিজটি দেখে সত্যি প্রান জুড়িয়ে গেল। বেশিক্ষন সেখানেও থাকা গেলনা। আমাদের যে যেতে হবে মেঘের দেশ মেঘালয়ে।মেঘ ! গাড়ি যতই সামনে এগোয় ততই মেঘ। সাদা সাদা মেঘ। এক সময় সামনে আর কিছু দেখা যায়। জ্বলে উঠে গাড়ির হেডলাইট। আমরা আতংকিতহয়ে পড়ি। ড্রাইভার তখন তার আপন মনে পাহাড়ি রাস্তায় ফুল স্পীডে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত। কিছু দূর যায় তো মেঘ সরে যায়। আবার মেঘ। এইরকম করেকরে মেঘের ভিতর এক সময় পৌছে গেলাম একটি ভিউ পয়েন্টে। সেখানেও মেঘ। একটা রেস্টুরেন্টে চা খেয়ে চললো কিছুক্ষন ফটোসেশন। তারপরআবারো ছুটে চলা মেঘের ভিতর। মেঘময় পাহাড়ী রাস্তায় হারাতে হারাতে একসময় পৌছে যাই মেঘালয়ের রাজধানী শিলং। শিলং পৌছেই বিপত্তি।ইন্টারনেট বিহীন এই প্রথম নিজেকে অসহায় অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। ভাল ভাল হোটেলের নাম ঠিকানা লিখে না নিয়ে আসার বিপদটা বেশ ভাল করেটের পেলাম। তারপর ম্যানুয়ালি একটা একটা করে হোটেল চেক করতে লাগলাম আমরা। বেশিরভাগ হোটেলে সীট খালি পাওয়া গেলনা। অত:পর শিলংশহরের প্রানকেন্দ্র জি.এস রোডের হোটেল আশুতোশ ইন এ জায়গা হল আমাদের।
চমৎকার একটা শহর শিলং। অধিকাংশ মানুষই খাসিয়া। মাঝে মধ্যে দু’চার জন হিন্দু এবং মুসলিমের দেখা মিলে। মাতৃকেন্দ্রিক পরিবার হওয়ায় শহরে নারীদের আনোগনাটা বেশি চোখে পড়ে। রিক্সা বিহীন ট্র্যাফিক জ্যাম মুক্ত এই শহরে সবাইআইন মেনে চলে। রাত ৮টার সময় দোকান বন্ধ মানেই বন্ধ। তার আগেই খেয়ে নিতে হবে রাতের খাবার। খাসিয়াদের প্রিয় খাবার শুকরের মাংস। তারা গরুর মাংসও খেতে পচন্দ করে। স্থানীয় মুসলিমরা তাই হিন্দু রাষ্ট্রের মেঘালয় ষ্ট্রেটেআনন্দের সাথে গরু জবাই দিয়ে থাকে। শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি গরুর মাংসের কেজি সেখানে মাত্র ২২০ টাকা । সবকিছু চিন্তা করে রাতের খাবারটা তাই সবজি দিয়ে সেরে নিলাম। তারপর হোটেলে ফিরে গিয়ে চললো ঘুম।
দ্বিতীয় দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে চলে গেলাম পুলিশ বাজার পুলিশ বক্সের সামনে। সেখানে চা খেতে খেতে ড্রাইভার আলিম ভাইয়ের সাথে পরিচয়। বেচারা বেশ মিশুক মানুষ। নিজের ইন্ডিয়ান সীমটি আমাকে দিয়ে দিলেন ব্যবহারের জন্য।তারপর তাকে নিয়ে শুরু হল আমাদের দ্বিতীয় দিনের চেরাপুঞ্জি যাত্রা। প্রথমেই একটি ভিউ পয়েন্টে গিয়ে শুরু হল বড় বড় পাহাড়ের গায়ে মেঘের খেলা দেখা। সেই সাথে চললো ফটোসেশন। কিছুক্ষন সেখানে কাটিয়ে চললাম ওয়াকাভা ফলসেরউদ্দেশ্য। ওয়াকাভা ফলসে গিয়ে দেখি চারিদিক মেঘে ঢাকা। ঝর্ণার শুধু গর্জন শুনা কিন্তু দেখা আর মেলে না। বিফল মনে সেখান থেকে পা বাড়াই নুকায়কালী ফলসের উদ্দেশ্য। পথে দেখে নিই পাহাড়ের বুক চিরে কয়লা উত্তোলনে দৃশ্য। কয়লাউত্তোলনের জন্য করে রাখা বিশাল সুড়ঙ্গের ভিতর নিজেকে একজন কয়লা শ্রমিক হিসাবে আবিষ্কার করি। তারপর চলে যাই নুকায়কালী ফলসে। অপূর্ব এই ফলসটিও মেঘে ঢাকা ছিল। একটু অপেক্ষা করার পর মেঘ সরে যায়। দেখা মিলে বিশালঝর্ণার। হৃদয় বিদারক নুকায়কালীর কাহিনী পড়ে খারাপ লাগে। মৌসুমী কেইভ দেখতে যাত্রা শুরু হয়। অন্ধকার গুহার ভিতর গা চমচমে পরিবেশে বেশ ভয় লাগে। অনেকক্ষন হাটার পর যখন একটু আলোর দেখা মেলে তখন কলকাতার মাসীচিৎকার করে উঠেন ওগো আলো দেখা যাচ্ছে বলে। গুহা থেকে বেরিয়ে সকালের নাস্তাটা সেখানেই সারা হয়। পা বাড়াই সেভেন সিষ্টার দেখতে। সেভেন সিষ্টারে যেতে যেতে সূর্যি মামা মাথার উপরে চলে আসে। সেখানে পৌছে দেখি মেঘ আরমেঘ। কিছুই দেখা যায়না শুধু মেঘের আড়ালে সাত বোনের গর্জন শুনা যায়। অনেকক্ষন সেখানে কাটানো পর হঠাৎ দুই বোনের দেখা মিলতেই সবাই উল্লসিত হয়ে পড়ে। মিনিটের ভিতরই মেঘ এসে দু’বোনকে আড়াল করে দেয়। শিলং আসলেএমন এক জায়গা যেখানে ঝর্না দেখার জন্য ভাগ্য দেবতা সঙ্গে থাকা লাগে। চেরাপুঞ্জি থেকে ফেরার পথে শেষ চেষ্টা চলে ওয়াকাভা ফলস দেখার। এই যাত্রায় আমরা সফল হই।
আমাদের তৃতীয় দিনের প্ল্যান ছিল শিলং শহরের স্পটগুলো কাভার করার। বেচারা আলিম ভাই নাড়োছবান্দা তিনি আমাদের সুইট ফলস আর লাইটলুম দেখাবেন। অত:পর তার প্ল্যানে প্রথমে সুইট ফলস দেখতে যাই। খুব সকালে চলে যাওয়ায়সেখানে মেঘের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাই । প্রানভরে উপরে উপভোগ করি সুইট ফলস। তারপর যাত্রা শুরু হয় লাইটলুম এর দিকে। অপূর্ব লাইটলুমে এসে উত্তর মেরুর স্বাদ মিলে। চারিদিক সাদা মেঘে ঢাকা। ছবি তুলতে গিয়ে হাইকি (সাদারমাঝে সাদা) ছবি তোলার টেকনিক মনে পড়ে। অনেকক্ষন অপেক্ষা করার পর যখন কোন কিছু দেখা যায়না তখন আবারো বিফল মনে শহরে ফিরি। শহরের ফিরতে ফিরতে দেখে নেই রাজার বাড়ি আর অল সেন্টস চার্চ। তারপর যাওয়া হয়লেডি হায়দোরী পার্ক আর ওয়ার্ড লেকে। সেখানে কিছুক্ষন কাটিয়ে আবারো যাত্রা শুরু হয় উমিয়াম লেক বা বড় পানির লেক দেখতে। বিশাল এই লেকটি দেখতে বোট ভাড়া করতে হয়। চলে সেখানেও ফটোসেশন। তারপর আবারো শহরেফিরি।
চতুর্থ দিন ছিল শিলং শহরে আমাদের শেষ দিন। ওই দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে হোটেল থেকে চেকআউট করি। নিচে তখন গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় আলিম ভাই। তারপর ব্যাগ নিয়ে পা বাড়া এলিফেন্ট ফলস দেখতে। এলফেন্ট ফলসের হাতিরমতো গর্জন শুনতে কাটিয়ে দেই সেখানে কিছুক্ষন। আমাদের যাত্রা এবার ডাউকি। নাহ আমরা তখনো ফিরছিনা। যেতে হবে কিরানসুরি ওয়াটার ফলসে। অপূর্ব এই ফসলকে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সাথে তুলনা করা যায়। ইচ্ছে করে সেখানে একটিরাত ক্যাম্পিং করার। কিন্তু আমাদের হাতে যে আর সময় নাই । আসার পথে দেখে আসি সমপেডাং ভিলেজ। ঝুলন্ত সেতুতে পা বাড়াতেই শাফি ভাই চোখে মুখে আতংক লক্ষ্য করা যায়। আগের রাতে বৃষ্টি হওয়ায় নিচের পানিগুলো কাল রংধারন করে। নীল পানি দেখার স্বাদটা বেদনার নীল রংয়ে কল্পনায় চলে যায়। ঝুলন্ত ব্রিজে ঝুলতে ফেরা হয় প্রিয় বাংলাদেশ।