তাহার সমুদ্র দর্শন
রায়হান ভাইয়ের পরিচয় দেবার আগে তার সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া ভাল। বেচারা অদ্ভুদ একটা মানুষ। ধরুন একসাথে কিছু করবেন বা কোথাও যাবেন সবকিছু ঠিকটাক হুট করে বলে বসবেন উনার পেটে সমস্যা! আসতে পারছেনা। অতীত হিষ্টোরীগুলো এতটাই তিক্ততায় ভরপুর যে ভরসা রাখার জায়গাটাও আর রাখেননি। সম্পর্কে বেচারা আমার কলিগ। যদিও কলিগ কিন্তু সেই সম্পর্ক কলিগের চেয়েও অনেক উর্দ্ধে। যাহোক হুট করে প্ল্যান হয়ে গেল একসাথে কক্সবাজার যাবার। দিন যত ঘনিয়ে আসতে থাকলো ভয় ততই বাড়তে লাগলো। টিকেট করা শেষ বেচারা এখনো কনফিউজসড যাবেন কি যাবেননা। প্রতিদিন তাকে কাউন্সিলিং করতে হত। যাবার আগেরদিন এসে উল্টাপাল্টা কথা শুরু করেন। আমরা বেশ ভয় পেয়ে যাই। আবারো কাউন্সিলিং করতে হয়। অবশেষে আসে সেই প্রতিক্ষিত দিন। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রথম টাস্ক ছিল রায়হান ভাইকে ঘুম থেকে জাগানো। কল দিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি বেচারার ফোন রিসিভ করার কোন লক্ষন নাই। সকাল ৭টায় শেষে কল রিসিভ করে জানালেন ঘুম থেকে উঠেছেন এবং রেডি হচ্ছেন। উনার পজিটিভ কথায় ৭৫% ভরসা পাই। স্টেশনে এসে দেখি ট্রেনের কোন খবর নাই। সকাল ১০ টার পাহাড়িকা দুপুর ১২ টায় ছাড়ার সম্ভাব্য সময় দিয়ে রাখছে কর্তৃপক্ষ। কোন উপায় না দেখে আরো কিছু কাজ সেরে নেই। এরই মাঝে রায়হান ভাই আমাদের মাঝে এসে হাজির হোন। ভরসাটা ৯০% তে চলে যায়। ট্রেন ছাড়ার সময় দুপুর ১২ টা থেকে ১ টায় পৌছায়। ভাবছি লেট দেখে যদি বেচারা চলে যান। তাছাড়া আবারো জানালেন উনার সেই পুরনো সমস্যার কথা। ব্যাগ থেকে ওষুধের কৌটাটা বের করে উনাকে একটা মেট্রোনিডাজল গিলাই। দুপুর ১টায় ট্রেন সিলেট থেকে রওয়ানা দেয় চট্রগ্রামের উদ্দেশ্য। ট্রেন ছাড়ার পর নিশ্চিত হই যে তিনি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন অবশেষে।
ট্রেনে উঠেই শুরু করেন উল্টাপাল্টা কাজ। একদল হিজরার আগমনে সীটের মাঝে নিজের মোবাইল ফেলে ভুদৌড় দেন রায়হান ভাই। তারপর এক হিজরা এসে উনাকে সেই রকম ঝাড়ি দেয় মোবাইল সীটে রেখে যাবার জন্য। বেচারা কনফিউজড। হিজারাটাও। হিজরাদটা এবার ইন্টারভিউ নিতে শুরু করে রায়হান ভাইয়ের। নাম ঠিকানা জানতে চায়। ভয়ে বেচারা এক এক করে সব বলতে থাকেন। কিন্তু ওমা একি! হিজরাটা দেখা যায় উনাকে চিনে ফেলে । বেচারার বাড়ি লালাবাজার হিজারটাও নাকি সেখানে থাকে। তারপর আর কারো কাছ থেকে কোন টাকা না নিয়ে চলে যায় হিজরাগুলো। আমার পাশে বসা বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসার মুচকী মুচকী হাসতে থাকেন। মাসুমের সাথে বাংলা আর ইংরেজীতে কথা চলতে থাকে রায়হান ভাইয়ের। আমি নিরীহ ভদ্রলোক প্রকৃতি দেখতে দেখতে সময় পার করে দেই। শায়েস্তাগঞ্জ আসার পর ট্রেনে আমাদের অনলাইনের অর্ডার করা খাবার নিয়ে আসে হোটেল কর্তৃপক্ষ। দুপুরের খাবারটা ট্রেনেই সেরে নেওয়া হয়। বিকাল গড়িযে সন্ধা হয়ে যায়। রায়হান ভাইয়ের পাগলামীর মাত্রা আরো বেড়ে যায়। এবার অনেকটা ইচ্ছে করেই উনাকে থামানোর জন্য বাংলাদেশের ব্যাংকের ওই অফিসারের সাথে উনার পরিচয়টা করিয়ে দেই। বলে রাখা ভাল উনার বড় ভাইযের কলিগ এই অফিসার ভাই। পরিচয়ের পর আর উনাকে কে পায়। সীটে নয় বাকী পথের অর্ধেক সময়ই উনার অন্য বগিতে কেটে যায়।
ট্রেন চটগ্রাম পৌছে রাত সাড়ে ১০ টায়। স্টেশনেই নেমেই রায়হান ভাইকে বললাম অনেক কাউন্সিলিং করেছি এবার প্রতিশোধ নেবার পালা। হোটেল খুজতে গিয়ে দেখি পিক সিজন হওযায় নরমাল রেটের চেয়ে ডাবল হয়ে যাওয়া। এগিয়ে আসে মাসুম। বহুভাষাবিদ মাসুম। জন্ম তার সিলেটে হলেও বেড়ে উঠা চট্রগ্রামে। দামাদামী করতে গিয়ে হোটেল ম্যানেজার তাই কনফিউজড সিলেটের এই পাবলিকের মুখে চাটাঁগাওয়ের ভাষা শুনে। জাতীয় পরিয়পত্র বের করতে দেখা গেল সে রাঙ্গামাটির বাসিন্দা। আরেক দফা ধাক্কা খায় ম্যানেজার। দু’মিনিট নিরবতা পালিত হয়। অবশেষে সেই হোটেলে থাকার সিদ্ধান্ত হয়। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা চলে যাই নতুন ব্রিজে। সৌদিয়া আর এস. আলমের টিকেট না পেয়ে শ্যামলী (সারা বাংলাদেশ লোকাল পরিবহন) দিয়ে চলে যাই কক্সবাজার। কক্সবাজার সদরে ঢুকতেই গাড়ি নষ্ট। কোনক্রমে বাস স্ট্যান্ডে এনে আমাদের নামিয়ে দেয় বাস কর্তৃপক্ষ। এবার শুরু হয় হাটার পালা। প্রতিশোধ নেবার পালা। মাথার উপর কড়া রোদ আর উচু নিচু রাস্তায় হাটতে হাটতে ৪৫ মিনিট পর আমরা কলাতলীতে হোটেলে পৌছাই।
প্রথমদিন মাত্রারিক্ত ক্লান্ত থাকায় সেইদিন আর সমুদ্রস্নান সম্বভ হয়না। রাতে নির্জন সৈকতে সমুদ্রের গর্জন শুনে শুনে সমাপ্ত হয় সেই দিনের কাযর্ক্রম। ইচ্ছে ছিল সেন্টমার্টিন যাবার। Tob তে সেন্টমার্টিনের আপডেট দেখে বাতিল সেই প্ল্যান আবার। দরিয়ানগরে প্যারাসাইলিং এর ভুত মাথায় চাপে। পরেরদিন সকালে উঠে তাই পযর্টকরা দরিয়ানগরের উদ্দেশ্যে ছুটে। পাখির চোখে সমুদ্র দেখি আমি আর মাসুম। রায়হান ভাই ভয়ে প্যারাসাইলিং থেকে বিরত থাকেন। মনে মনে আল্লাহর নাম জপেন। উড়ন্ত লাশ দেখার ইচ্ছাটা উড়ন্তই থেকে যায়। তারপর সুগন্ধা বীচে এসে চলে ঝাপাঝাপি। সেখানেও ঝামেলা। আমার আর মাসুমের সাথে তার সমুদ্রে নামতে মানা। কি আর করা ঝাপাঝাপি করে হোটেলে ফেরা। বিকালে চলে যাই লাবনী বীচে। সেখান থেকে সোজা কক্সবাজার সদরে। কিছু কেনাকাটা করে ফিরতে ফিরতে সন্ধাটা গড়িয়ে রাত হয়ে যায়। সমুদ্রের গর্জন বাড়তে থাকে।
শেষ দিনের শেষ কাযর্ক্রম শুরু হয় বেলা ১০ টায়। অনেক কিছু বাদ পড়ে যায় ঘুম ভাঙ্গতে দেরী হওয়ায়। চলে যাই হিমছড়ি । রায়হান ভাই একাই পাহাড় থেকে সমুদ্র দেখেন। আমি আর মাসুম সাগরের টেউ গুনি। তারপর ফিরে এসে সেনাবাহিনী পরিচালিত এক রেস্টুরেন্টে লবস্টার দিয়ে দুপুরের আহারটা সেরে নেই। এবার ফেরার পালা। কলাতলী এসে হোটেলে থেকে ব্যাগ নিয়ে কলাতলী সী বিচে চলে আসি। তারপর সেখানে ঘন্টাখানেক কাটিয়ে চট্রগ্রাম ফেরার বাস ধরি।