জন্ম ও পরিচয়ঃ হাদীস জগতের উজ্জল নক্ষত্র সিলেটের কৃতি সন্তান জ্ঞানতাপস আল্লামা শায়দা সাহেবের নাম হল মোঃ হরমুজ উল্লাহ। কাব্যে ছদ্য নাম হলো 'শায়দা' তাই তিনি শায়দা নামে পরিচিত। অনুমানিক ১৯০০ ইংরেজীতেসিলেট সদর উপজেলাধীন তুরুখলা নামক গ্রামে এ মহান জ্ঞান তাপস জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মুকিম উল্লাহ। কে ভেবেছে তুরুকখলায় ফুলফুটে সমগ্র দেশটিকে তার ঘ্রাণে সুশোভিত করে তুলবে। বাল্য বয়সেই আল্লামাসাহেবের আচার ব্যবহার এবং সুন্দর সুন্দর কথা সকলকেই আকৃষ্ট করেছিল।
শিক্ষাজীবনঃ ছাত্র হিসেবে আল্লামা শায়দা সাহেব অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ৫ম শ্রেণীতে আসাম বোর্ডের অধীনে সরকারী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অধিকার করে বৃত্তি লাভ করেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়ন কালীন সময়েপর পর তিনরাত্রি স্বপ্নে তার মাতা ছেলেটিকে মাদ্রাসায় ভর্তি করার জন্য অদিষ্ঠ হন। দাউদিয়া জুনিয়র মাদ্রাসার হেড মাওলানা গৌছ উদ্দিনের পরামর্শে শায়দা সাহেবকে দাউদিয়া জুনিয়র মাদ্রাসাতে ভর্তি করা হয়। হেদায়তুননাহুর জামাতে (বর্তমান ৮ম শ্রেণী) ১৯১৪ সালে আসাম বোর্ডের অধীনে বৃত্তি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১ম স্থান অধিকার করে বৃত্তি লাভ করেন। ১৯১৬ সালে শরহে মুল্লা জামীর জামাতে (বর্তমান দশম শ্রেণীতে) আসামবোর্ডের অধীনে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৯১৭ সালে তিনি সিলেট আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সিলেট আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যায়নকালে আল্লামাশায়দা সাহেবের মেধা ও পরীক্ষার ফলাফল ছাত্র শিক্ষক সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। সিলেট আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নের শেষ জামাত (বর্তমান ফাজিল) কালাজ্বর নিয়ে তিনি কাহিল অবস্থার নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে বোর্ডে প্রথম স্থানঅধিকার করে গোল্ড মেডেল পান। শায়দা সাহেব টাইটেল ৩য় বর্ষে অধ্যায়নকালে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যম দিয়ে তাকে আল ইসলাহ ছাত্র সংসদের সেক্রেটারী জেনারেল নির্বাচিত করা হয়। তৎকালীন কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসারপ্রিন্সিপালের ফার্সী কিতাব নিরক্ষণের সময় শায়দা সাহেব যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। আল্লামা শায়দা সাহেব ১৯৩০ সালে জুলাই মাসে রিচার্সের জন্য হায়দাবাদ যান। বেশ কয়েক হাজার কিতাব ঘাটাঘাটির পর দুই বছরের অধিকসময়ে রিচার্স সম্পন্ন করেন। রিচার্সে তিনি যথেষ্ট যোগ্যতা ও কৃতিত্বের পরিচয় দেন এবং সনদপত্র লাভ করেন।
কর্মজীবনঃ ১৯৩২ সালের ১২ই এপ্রিল তিনি কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট পর্যন্ত কৃতিত্বের সাথে অধ্যাপনা করেন। তার অধ্যাপয়নার বিষয় ছিলহাদীস,তাফসীর,আরবী সাহিত্য,ফিকহ,উছুল,বালাগত,মানতেক,উর্দু-ফার্সী ইত্যাদি বিষয়সমুহ। বিভিন্ন কিতাবের কঠিনতম অধ্যায় বুঝার জন্য শিক্ষকরা শায়দা সাহেবের হাতের নোট নিয়ে লিখতেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগেরপর তিনি কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসায় চলে আসেন এবং অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৫০ সালের ১লা মার্চ থেকে তিনি সিলেট আলীয়া মাদ্রাসার সুপারিন্টেন্ডেন্ট এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একাধারে তিনিসাত বছর সিলেট আলীয়া মাদ্রাসায় দায়িত্ব পালন করার পর কিছু ষড়যন্ত্রকারী তাকে আবার আলীয়া বদলী করার পায়তারা করেছিল । কিছু মানুষের সহযোগিতায় তিনি আবার সিলেট আলীয়া মাদ্রাসায় পুর্ণবার সুপারের দায়িত্বগ্রহণ করে সুষ্ঠুভাবে কাজ চালিয়ে ১৯৫৮ সালের ২৯শে জুন অবসর গ্রহণ করেন।
আধ্যাত্মিক জীবনঃ আল্লামা শায়দা সাহেব কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসার ছাত্র থাকাকালীন সময়ে মাদ্রাসার সুযোগ্য ওস্তাদ ইলমে মারিফত ও তরীকতের একনিষ্ঠ খাদিম হযরত মুল্লা ছফিউল্লা (রহঃ) এর নিকট বায়আত গ্রহণ করেন।ইলমে তাছাউফের প্রয়োজনীয় দীক্ষা তিনি হযরত মুল্লা ছাহেবের নিকট থেকে গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, হযরত মুল্লা ছফিউল্লাহ (র) তৎকালীন সময়ে কলিকাতার মধ্যে কামিল বুযুর্গ ছিলেন। তিনি হযরত মুল্লা ছাহেব নামে অধিকপরিচিত ছিলেন। আল্লামা শায়দা সাহেব তার জীবনের গুরুত্ব পুর্ণ বিষয়াবলীতে হযরত মুল্লা ছাহেবের পরামর্শ নিতেন এবং তার জীবনে মুল্লা ছাহেবের যথেষ্ট অবদান রয়েছে।
জিয়ারতে হারামাইনঃ পবিত্র মক্কা শরীফে হজ্জ্ব করার এবং মদীনা শরীফে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে শায়দা সাহেব ১৯৬৩ সালে যাত্রা শুরু করেন। হজ্জ্বব্রত পালন মদীনা শরীফে জিয়ারত শেষে দেশে ফেরত আসেন।
ভানুগাছ আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপনাঃ ভানুগাছ নিবাসী আলহাজ্ব কেরামত আলী সাহেব ভানুগাছ শফাত আলী সিনিয়র মাদ্রাসাকে ক্রমাণবতি থেকে রক্ষা করে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আল্লামা শায়দা সাহেবকেসেই মাদ্রাসায় নেওয়ার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে সিলেট জেলার বিশিষ্ট উলামায়ে কেরামের বারবার অনুরোধে তিনি ১৯৬৭ সালে উক্ত মাদ্রাসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। স্বল্প দিনের মধ্যে মাদ্রাসা আশানুরুপ উন্নতি ও অগ্রগতি লাভকরে এবং তার সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
তাফসীরে কুরআনঃ গাফিলতির নিদ্রায় নিমগ্ন এ উপমহাদেশের মুসলিম জাতির মধ্যে ইসলামী পূর্ণজাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিছে দেহলভী (র) সর্বপ্রথম ফার্সী ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করে সরলপ্রাণমুসলমানদের কোরআন শরীফ বুঝার সুযোগ করে দিয়েছিলেন এবং এর মাধ্যমেই মুসলমানদের জাগরণ এসেছিল।
এ নীতির অনুসরণে আল্লামা শায়দা সাহেব বিভিন্ন স্থানে সরলপ্রাণ মুসলমানদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় পবিত্র কোরআনের তাফসীর পেশ করেন। প্রায় ২০টি মৌজার সমন্ময়ে জালালপুর বাজারের সন্নিকটে ওয়াকফকৃত স্থানে কোরআনশরীফের তাফসীর শুনার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাস থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত উক্ত ঘরে নিয়মিত তাফসীর পেশ করে ১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে প্রায় চার বছরেপবিত্র কোরআন তাফসীরের এক খতম শেষ করেন। এ সময় অনেক লোক পবিত্র কোরআনের মহাত্ম বুঝতে সক্ষম হয়। এমনিভাবে ফেঞ্চুগঞ্জ ইসলামপুর জামে মসজিদে এবং দাউদপুর মসজিদে ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘদিন পবিত্রকুরআনের তাফসীর পেশ করেন।
ইসলামী চিন্তাধারাঃ আল্লামা হরমুজ উল্লাহ শায়দা সাহেব অবহেলিত ও নির্যাতিত মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী ধ্যান ধারণা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং সকল বাতিল মতবাদ থেকে মুসলমানদের রক্ষা করে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল সল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত পথে পরিচালিত করার জন্য আজীবন সাধনা করে গেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদায় বিশ্বাসী। সুন্নী আকায়ীদের বিরুদ্ধবাদীদের দাতভাঙ্গা জবাব দিতেন।হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে মিলাদ শরীফ পাঠ এবং মিলাদ শরীফের ক্বিয়াম করা জায়েজ বরং উত্তম একথা বিভিন্ন দলিল দ্বারা প্রমাণ করার পর আল্লামা শায়দা সাহেব সিলেট রেজিষ্ঠারী মাঠের মিলাদুন্নবীমাহফিলে হাজার হাজার জনতার সম্মুখে প্রায় শতাধিক উলামায়ে কেরামের উপস্থিতিতে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, যদি কেউ মিলাদ শরীফ এবং মিলাদ শরীফের ক্বিয়ামকে নাজায়েজ অথবা ঘৃণিত বলে, তবে তাকে তাকে জানিয়ে দাওশুধু মুখে নয় প্রয়োজনীয় দলিল ও কিতাবাদীসহ আমার সাথে আলোচনায় বসতে। আমি সর্বদা এ ধরণের আলোচনায় প্রস্তুত আছি।
কোরআন শ্রবণে অধীর আগ্রহঃ পবিত্র কোরআন শরীফের তেলাওয়াত শ্রবণে আল্লামা শায়দা সাহেব ছিলেন অতি উদগ্রীব। ছহি শুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত শায়দা সাহেবকে ব্যাকুল করে তুলত।
মুনাজির হিসাবে আল্লামা শায়দা সাহেবঃ ১৯৫৯ সালে বালাগঞ্জ উপজেলাধীন গোয়ালাবাজার নামক স্থানে দ্বোয়াল্লিন এবং জোয়াল্লিন অর্থ্যাৎ কোরআন শরীফের দ্বোয়াদ্ব হরফকে জোয়া পড়া প্রসঙ্গে একটি মুনাজারা অনুষ্ঠিত হয়।উক্ত মোনাজারায় আল্লামা শায়দা সাহেব দ্বোয়াদ্ব অক্ষরকে দ্বোয়াদ্ব পড়া সঠিক প্রমাণিত করেন। অনুরূপ ১৯৫৯ সালে সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার হবিবপুরে এবং ১৯৬০ সালে মৌলভীবাজার জেলাধীন কমলগঞ্জউপজেলার মুনশীবাজার নামক স্থানে দ্বোয়াদ্বকে জোয়া উচ্চারণকারী উলামায়ে কেরাম পরাজয় বরণ করেন।
সাহিত্য চর্চাঃ আল্লামা শায়দা সাহেব যেভাবে উপ-মহাদেশের খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ও মুফাসসির ছিলেন, তেমনিভাবে একজন বিশিষ্ট লেখক ছিলেন। বিশেষ করে তিনি উর্দু ও ফার্সি ভাষায় একজন প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন। যদিও শায়দাসাহেব বাংলা ভাষাভাষী ছিলেন কিন্তু তার বেশিরভাগ সাহিত্য চর্চা ছিল আরবী,ফার্সী ও উর্দু ভাষায় এবং এ তিন ভাষায় তার পান্ডিত্য ছিল অপরিসীম।
অসুস্থতাঃ প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা হরমুজ উল্লাহ শায়দা সাহেব ১৯৮৩ সালে শেষ দিকে প্যারালাইসেস রোগে আক্রান্ত হন এবং বাড়ীর বাহিরে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৬ সালে এক রাত্রি থেকে তার বাকশক্তি বন্ধ হয়েযায়। এর পর থেকে কোন কিছু বলার ইচ্ছে হলে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝাতেন।
ইন্তেকালঃ ইলমে হাদীস ও ইলমে তাফসীরের উজ্জ্বল নক্ষত্র বাহারুল উলুম আল্লামা শায়দা সাহেব দীর্ঘ অসুস্থতার পর মহান রাব্বুল আলামীনের ডাকে সাড়া দিয়ে ২রা ডিসেম্বর ১৯৯০ ইংরেজী,১৭ই অগ্রাহয়ন ১৩৯৭ বাংলা মোতাবেক১৩ ই জমাদিউল আউয়াল ১৪১১ হিজরী রোজ রবিবার সকাল ১০ঃ৩০ মিনিটের সময় নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন (ইন্না-----------রাজিউন) তার জানাজায় ইমামমতি করেন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলাহ। অতঃপর দাউদপুরমসজিদের পাশে আল্লামা শায়দা সাহেবকে দাফন করা হয়।
তথ্যসুত্রঃ ফেঞ্চুগঞ্জ মোহাম্মদী ফাযিল মাদ্রাসা, সিলেট এর সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুন নুর রচিত, উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা হরমুজ উল্লাহ (র) ।