খারিজীরা ইসলামের সর্বপ্রথম বিপথগামী সম্প্রদায় । আকীদা, আমল ও খিলাফত সম্পর্কে বিতর্ক সৃষ্টি করে তারা নিজেদেরকে মুসলিম উম্মাহ্ থেকে আলাদা করে ফেলে । রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা পুনঃ পুনঃ বিদ্রোহ করে সাময়িকভাবে খিলাফতে রাশিদার শেষ দুই বছর এবং উমাইয়া আমলে মুসলিম রাষ্ট্রের পূর্বাংশে অশান্তি সৃষ্টি করে; হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে আব্বাসীগণকে যুদ্ধে পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিল । 'আল-মিলাল ওয়ান নাহল' গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছেঃ
খারিজী ঐ সম্প্রদায়ের লোকদের বলা হয় যারা এমন নিয়মতান্ত্রিক ইমামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে তাঁর আনুগত্য থেকে বের হয়ে যায়; যার ইমামতের আনুগত্যের প্রতি মুসলিম জনগন একমত পোষণ করেছেন । চাই এ বিদ্রোহ সাহাবায়ে কিরামের যামানার আইম্মায়ে রাশিদীনের বিরুদ্ধে হোক কিম্বা তাবিঈনের সময়কার মুসলিম জনগন স্বীকৃত ইমামগণের বিরুদ্ধে হোক অথবা পরবর্তী যুগের প্রতিষ্ঠিতইমামগণের বিরুদ্ধে হোক, সকলেই খারিজীদের অন্তর্ভূক্ত ।
— আল-মিলাল ওয়ান নাহল, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৪৪
খারিজী শব্দটির অর্থ হলো দলত্যাগী । মুসলিম জামা'আতকে পরিত্যাগ করায় খারিজীরা উক্ত নামে অভিহিত করা হয় ।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় ৬৫৭ খৃষ্টাব্দে হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর মধ্যে সিফফিন নামক স্থানে তুমুল যুদ্ধ বাঁধে । যুদ্ধে হযরত মু'আবিয়া (রাঃ) নিশ্চিত পরাজয় অনুধাবন করেন । ফলে তাঁর দলের কতক লোক কুরআন শরীফ উর্দ্ধে উত্তোলন করে হযরত আলী (রাঃ) এর কাছে সন্ধির প্রস্তাব করেন । হযরত আলী (রাঃ) ও তাঁর অধিকাংশ সঙ্গী সন্ধি প্রস্তাবেসম্মত হন এবং দু'দল থেকে এতে দু'জন সালিস নিযুক্ত করা হয় । কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) এর একদল সমর্থক এ সালিসী প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এবং আল্লাহ তা'আলা ব্যতীত অন্য কারো ফয়সালা চলবে না; এ আওয়াজ তুলে তাঁর দল পরিত্যাগ করে । এ দলত্যাগী খারিজীরা আব্দুল্লাহ ইবন ওয়াহাবকে তাদের দলপতি নির্বাচন করে, তাঁর নেতৃত্বে নাহরাওয়ান নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে । পরেখারিজীরা বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে প্রচারনা প্রচারনা চালাতে থাকে । হযরত আলী (রাঃ) এ সংবাদ পেয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন । নাহরাওয়ানে সংঘটিত যুদ্ধে খারিজীদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবন ওয়াহাবসহ বহুসংখ্যক খারিজী নিহত হয় । এতে খারিজীরা অতিশয় ক্রোধান্বিত হয়ে হযরত আলী (রাঃ), হযরত মু'আবিয়া (রাঃ) ও তাঁর উপদেষ্টা মিসরের শাসনকর্তা আমর ইবন আস (রাঃ) কে ইসলামের শত্রু হিসেবে স্থির করে এ তিনজনকে হত্যা করার জন্য বদ্ধপরিকর হয় । হযরত মু'আবিয়া ও হযরত আমর ইবন আস (রাঃ) কোনোক্রমে বেঁচে যান । কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) আততায়ী আব্দুর রহমান ইবন মুলযিমের হাতে শহীদ হন । হযরত আলী (রাঃ) এর শাহাদাতের পর খারিজীরা নীরবে বসে থাকেনি । উমাইয়া শাসকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকালধরে প্রচারনা চালাতে থাকে এবং আব্বাসীয়দের সাথে যোগাযোগ করে উমাইয়াদের পতন ত্বরান্বিত করে । আব্বাসীয় শাসকগণ যখন মসনদে সমাসীন হন, তখন খারিজীরা তাদেরও বিরোধিতা করে । এবং মেসোপটেমিয়া পূর্ব আরব ও উত্তর আফ্রিকার উপকূলে অশান্তির সৃষ্টি করে । অবশেষে মিসরের ফাতেমী শাসকগণ খারিজীদের শক্তি সমূলে ধ্বংস করে দেন । ফলে রাজনৈতিক প্রচারণা বর্জন করে তারা শুধু একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে পরিণত হয় ।
সাহাবায়ে কিরামের বর্ননায় খারিজীদের হারুরিয়াহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে । কেননা খারিজীরা হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহের আওয়াজ তুলেছিল হারুরা নামক স্থানে । তাই খারিজীরা 'হারুরিয়া' নামেও অভিহিত ।
আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ) হারুরিয়াদের সম্পর্কে বর্ননা প্রসঙ্গে বলেন, নবী করিম (সঃ) বলেছেন, তারা ইসলাম থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর শিকার ভেদ করে বের হয়ে যায় ।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে তাঁর আনুগত্য থেকে যারা বেরিয়ে পড়ে তাদেরকেই প্রথমত খারিজী নামে অভিহিত করা হয় ।
তথ্যসূত্র
সংক্ষিপ্ত ইসলামিক বিশ্বকোষ, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৮৬-৩৮৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
ফাতাওয়া ওয়া মাসাইল (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ)
খারিজীদের ভ্রান্ত বিশ্বাস
খারিজীদের ভ্রান্ত আকীদা ও মতবাদসমূহঃ
১) যারা মুসলমান হওয়ার দাবিদার হয়ে অন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং এহেন পরিস্থিতিতে যুদ্ধরত হতে বের হয়ে না আসে তারা কাফির । (নাউজুবিল্লাহ)
২) খারিজীরা তাদের ধারনায় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী । তাদের মতে, খলীফাকে অবশ্যই সমগ্র মুসলিম কর্তৃক নির্বাচিত হতে হবে । কোন বিশেষ শ্রেনী-গোত্র কিংবা সম্প্রদায়ের মধ্যে খিলাফত সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং ধর্মীয় দৃষ্টিকোনে যে কোন মুসলমান এ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবে । (নাউজুবিল্লাহ)
৩) তারা হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত উমার (রাঃ) কে ইসলামের বৈধ খলীফা বলে মনে করে এবং অন্যান্য খলীফাকে অবৈধ বলে ঘোষনা করে । (নাউজুবিল্লাহ)
৪) কবীরা গুনাহ খারিজীদের কাছে কুফরীর শামিল । কোন মুসলমান নামায, রোযা ও অন্যান্য ফরয কাজসমূহ পালন না করলে কিংবা কবীরা গুনাহে লিপ্ত হলে সে কাফির হয়ে যায় । (নাউজুবিল্লাহ)
৫) তাদের মতে, যে মুসলমান কবীরা গুনাহ করে এবং তওবা না করে মারা যায় সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী । (নাউজুবিল্লাহ)
৬) খারিজীদের মতে, যারা তাদের আকীদার সঙ্গে একমত, তারা ধর্মদ্রোহী তথা কাফির । এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অপরিহার্য । (নাউজুবিল্লাহ)
৭) যে ব্যক্তি শক্তি থাকা সত্ত্বেও সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ না করে সে কাফির । (নাউজুবিল্লাহ)
৮) খারিজী সম্প্রদায় আরও বিভিন্ন বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আতের বিপরীত আকীদা পোষন করে । যেমন তারা 'মোহসিন' (বিবাহিত) যিনাকারীকে রজম করার শাস্তি অস্বীকার করে । চুরির অপরাধে বাহুর গোড়া পর্যন্ত হাত কাটার শাস্তি নির্ধারণ করে । মহিলাদের মাসিক হায়িয অবস্থায়ও তাঁর জিম্মায় নামায পড়া ওয়াজিব বলে মনে করে ইত্যাদি । (নাউজুবিল্লাহ)
তথ্যসূত্র
ফাতাওয়া ওয়া মাসাইল (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ)