এ বিষয়ে আলোচনা করার আগে প্রথমে কিছু বিষয় জেনে নিতে হবে ,,
① - পীর,
② - মুরিদ,
③ - বায়আত,
④ - বায়আতে সুলুক :-
১/- পীর শব্দটি ফার্সি; অর্থ : শায়খ, বৃদ্ধ, পুরাতন।
২/-মুরিদ শব্দটি আরবি। মুরিদ শব্দটি বাবে ( ﺍﻓﻌﺎﻝ ) হতে (اسم ﻓﺎﻋل ) এর রুপান্তর। আরবি গ্রামার অনুযায়ী বাবে ইফআল
হতে ইসমে ফায়েল'-এর রুপান্তর মুরিআসে।
শাব্দিক অর্থ : ইচ্ছা পোষনকারী, দৃঢ় প্রত্যয়ী, সংকল্পকারী ! পরিভাষায় পীর বলা হয়, কোরআন সুন্নাহের আলোকে সৎপথের দিশারী এমন বিজ্ঞ আল্লাহর ওলীকে মানুষ যার হাতে নিজেকে সেচ্ছায় অর্পণ করে নিজের ইসলাহ বা আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে। যিনি নিজেকে পীরের কাছে অর্পন করেন তাকে মুরিদ বলা হয়। অর্থাৎ সে নিজের আত্মশুদ্ধির জন্য একজন শায়খ,কামেল বুজুর্গ ও আল্লাহর ওলির হাতে অর্পণ করার সংকল্প-ইচ্ছা করেছে।
৩/- বায়আত শব্দটি ﺑﺎﻋﻴﺒﻴﻌﺒﻴﻌﺎ এর- মাসদার। ( ﺑﻴﻌﺔ - এর শেষে আরবীতে গোল ﺓ আর উর্দুতে লম্বা ﺕ লাগানো হয়।) বায়আত ( ﺑﻴﻌﺖ ) অর্থ : বিক্রি করা, বেচা। পরিভাষায় :- নিজেক আগ্রহ সহকারে সেচ্ছায় আল্লাহর হাতে জান্নাতের বিনিময়ে বিক্রি করা।
৪/- বায়আতে সুলুক নফল আমল করে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা অর্জন করার জন্য বায়াআত করা হয়। বিশেষ দ্রঃ আরবীতে পীরকে শায়খ ( ﺍﻟﺸﻴﺦ ) ও সালেক ( ﺍﻟﺴﺎﻟﻚ ) বলা হয়। এই পদ্ধতিকে (পীরের হাতে নিজেকে অর্পন করা তথা বায়আত হওয়া নিজের ইসলাহ বা আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে ) বায়আতে সুলুক বলা হয়।
❥ বায়আতে সুলুক সম্পর্কে মতবাদ । পৃথিবীতে 'বায়আতে সুলুক সম্পর্কে ভিন্ন ধরনের মতবাদ পাওয়া যায়।
১/ - গায়রে মুকাল্লিদ, সালাফি, নাজদী ও মওদূদীবাদী ভাইদের নিকট "বায়আতে সুলুক ভিত্তিহীন। তারা বলেন তার কোনো প্রমাণ্যতা ও অস্তিত্ব ইসলামে নেই !!!
২/ - আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর অনুসারী যারা তারা বলেনঃ "বায়আতে সুলুক" কোরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। পরকালীন নাজাত বিশুদ্ধ ঈমান এবং নেক আমলের জন্য ।
✔ বায়আতে সুলুক এর ফায়দা।
বায়আতে সুলুক এর অনেক ফায়দা রয়েছে। তন্মধ্যে দুটি বড় ফায়েদা উল্লেখ করা হলোঃ-
① - 'বায়আত' নফল আমল সমুহে আধিক্য এবং তার মাধ্যমে জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা অর্জন করার মাধ্যম। মানুষ তো নফল আমল নিজেই করতে পারে কিন্তু অভিজ্ঞতা ও তাজরেবা হলো তা কামিয়াব বা সফল হয় না। কিন্তু যখন নিজের অন্যের কাছে সমর্পণ- হাওয়ালা করে দেয় তো এই উদ্দ্যেশ্য-মাকসাদ সহজেই অর্জন হয়।
② - বাতেনী জিন্দেগী পরিস্কার করা যায়। যেভাবে আমাদের বাহ্যিক ময়লা হয় এবং তা পরিস্কার করতে হয়, তেমনি ভাবে আমাদের অভ্যন্তরীণ ময়লা হয় এবং তা পরিস্কার করাও আবশ্যক হয়। বাতেনী বা অভ্যন্তরীণ ময়লা হলো দুশ্চরিত্র, নৈতিকতা অবক্ষয়; যা পরিস্কার করা নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর আরোপিত ফরজ ছিলো। সুরায়ে বাকারার ১২৯ নং ও সুরায়ে জুমআর ২নং আয়াতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর আরোপিত চারটি ফরজবয়ান করা হয়েছ ( সূরা আল জুমুআহ : ২ - তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াত সমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত।)
( সূরা আল বাক্বারাহ : ১২৯ - হে পরওয়ারদেগার! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুণ যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দিবেন। এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় তুমিই পরাক্রমশালী হেকমতওয়ালা।)
☞ আয়াতে ( ﻭﻳﺰﻛﻴﻬﻢ ) বাক্য আছে। আর ﻭﻳﺰﻛﻴﻬﻢ অর্থাৎ মুসলমানদের বাতেনী বা অভ্যন্তরীণকে ( জিন্দেগী, চারিত্রিক অবক্ষয় ইত্যাদি থেকে) পবিত্র ও পরিস্কার করা এবং উন্নত চরিত্র দ্বারা আলোকিত করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
আমি প্রেরিত হয়েছি উত্তম চরিত্র শিক্ষা দেওয়ার জন্যে । এই উদ্দ্যেশ্যও বায়আত দ্বারা অর্জিত হয়।
✔ কোরআন শরীফ এর আলোকে বায়আতে সুলুক - এর প্রমাণ্যতা -
কোরআন শরীফের অনেক আয়াত দ্বারা বায়আতে সুলুক বা পীর- মুরিদী প্রমাণিত। সুরা আল-মুমতাহিনা : আয়াত নং :১২ হে নবী ! ঈমানদার নারীরা যখন আপনার কাছে আসে বায়আত হতে এই শর্তে (আনুগত্যের শপথ করে) যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না,জারজ সন্তানকে স্বামীর ঔরস থেকে আপন গর্ভজাত সন্তান বলে মিথ্যা দাবী করবে না এবং ভাল কাজে আপনার অবাধ্যতা করবে না, তখন তাদের বায়আত করুন এবং তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু।
☞ এই আয়াতে বায়আতের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।
এখানে বায়আত দ্বারা "বায়আতে সুলুক "(যাকে আমাদের ভাষায় পীর-মুরিদী বলে থাকি। অর্থাৎ নিজের আত্মশুদ্ধির জন্য পীর বা শায়খ এর হাতে বায়আত হওয়া।) উদ্দেশ্য। "বায়আত আলাল জিহাদ" উদ্দ্যেশ্য নয় । সাহাবীরা মু'মিন হওয়াসত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে বায়আত গ্রহন করতেন নিজেদের আত্মশুদ্ধির জন্য। জীবনের চলার পথে কোথাও ত্রুটি হচ্ছে কিনা, কিভাবে চললে আল্লাহ ও তার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুশী? এই পথের সঠিক দিশারী রাসূলুল্লাহর হাতে তারা বায়আত হতেন।
_সুরা আল-ফাতহ, আয়াত নং ১০ যারা আপনার কাছে বায়আত হয় (আনুগত্যের শপথ করে), তারা তো আল্লাহর কাছে আনুগত্যের শপথ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে। অতএব, যে শপথ ভঙ্গ করে; অবশ্যই সে তা নিজের ক্ষতির জন্যেই করে এবং যে আল্লাহ তা'য়ালার সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে; আল্লাহ তা'য়ালা সত্ত্বরই তাকে মহাপুরস্কার দান করবেন।
☞এই আয়াতেও স্পষ্টভাবে বায়আতের কথা উল্লেখ রয়েছে । আরো অনেক আয়াত রয়েছে যে আয়াতে "বায়আতে সুলুক" আমাদের ভাষায় পীর- মুরিদী উদ্দ্যেশ্য। অর্থাৎ নিজের ইসলাহ বা আত্মশুদ্ধির জন্য আল্লাহওয়ালা-বুজুর্গদের কাছে বায়আত হওয়া উদ্দ্যেশ্য।
✔ হাদীস শরীফ দ্বারা "বায়আতে সুলুক"-এর প্রমাণ__
" বায়আতে সুলুক " অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। বুখারী শরীফ থেকে একটি হাদীস উল্লেখ করছি হযরত আবুল ইয়ামান আবু ইদ্রিস আয়িযুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেন: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পার্শ্বে সাহাবাদের উপস্থিতিতে (সাহাবাদেরকে লক্ষ করে) বলেনঃ আমার নিকট বায়আত গ্রহণ কর এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহ তা'য়ালার সাথে কিছু শরিক করবেনা, চুরি করবেনা, যিনা-ব্যাভিচার করবেনা, সন্তানদের হত্যা করবেনা, মিথ্যা অপবাদ দিবে না, সৎকাজে নাফরমানী করবেনা। তোমাদেরই মাঝে যে তা পূর্ণ করবে তার পুরুস্কার আল্লাহ তা'য়ালার নিকট রয়েছে। আর যে এর কোন একটিতে লিপ্ত হলে হয়ত তাকে দুনিয়াতেই শাস্তি দেওয়া হবে; তখন তা হবে তার কাফফারা সরূপ। কেহ এর কোনো একটিতে লিপ্ত হলে অতপর আল্লাহ তা'য়ালা তা গোপন রাখেন তাহলে তা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি ইচ্ছা করলে ক্ষমা করে দিবেন, ইচ্ছা করলে শাস্তি দিবেন। (সাহাবায়ে কেরাম বলেনঃ-) অতপর আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে বায়আত হলাম। ((বুখারী শরীফ ১/৭ কিতাবুল ঈমান))
এই হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বায়আতে সুলুক উল্লেখ আছে। এরকম অসংখ্য হাদীস আছে যেখানে বায়আতে সুলুকের কথা স্পস্টত উল্লেখ আছে। বায়আতে সুলুক বা পীর মুরিদী অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
যে সকল অজ্ঞ-মুর্খ জাহেলরা বলে ইসলামে কোনো পীর মুরিদী নেই, কোরআন হাদীসে কোনো পীর- মুরিদী নেই তারা কি এই আয়াত- হাদীস সমূহ দেখেনা? দেখবে কিভাবে? তাদের না আছে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান, না আছে কোরআন ও হাদীস সম্পর্কে যথেষ্ট ও সঠিক জ্ঞান।
জাহেলরা ভ্রান্ত লেখকদের কয়েকটি বাংলা ইংলিশ বই পড়েই মনে করে অনেক বড় জ্ঞানী হয়ে গেছে। শুরু করে উল্টাপাল্টা ফতোয়া দান। আসলে তারা তো বাতিল শক্তি, তাদের কাজই হলো মুসলমানদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়ানো। মিথ্যাচার করে মুসলমানদের ঈমান-আমল নষ্ট করা। সকল শ্রেণীর মুসলমান ভাই বিশেষকরে যুবক শ্রেনীর ভাইদেরকে বলবো আপনারা মওদুদীবাদী, কাদিয়ানী, শিয়া, আহলে হাদীস এসকল ভ্রান্ত ফিৎনা ফিরকা হতে দূরে থাকবেন; এদের কোনো কথায় কান দিবেন না।
আপনারা সব সময় উলামায়ে কেরামের নিকট যাবেন। দ্বীনকে সঠিকভাবে বুঝার চেষ্টা করবেন। কারণ:- উলামায়ে কেরামই কোরআন ও হাদিসের সঠিক জ্ঞান রাখেন। হ্যাঁ আর যারা বাতিল ফিরকা তারা এই আয়াত ও হাদীস মানবেনা। কারণ তাদের উদ্দেশ্য ইসলাম নয় বরং তাদের উদ্দেশ্য (ফিৎনা) ভ্রান্ত মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে মুসলমানদের ঈমান- আমল নষ্ট করা ।
আল্লাহ তা'য়ালা আমাদের সবাইকে সহীহ আক্বিদা বুঝার এবং বাতিল আক্বিদাকে প্রত্যাখান করার তাওফিক দান করুন। আমিন,