হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এভাবে ইয়াজিদের বেয়াদবীপূর্ণ প্রস্তাব অস্বীকার করে যখন ওর দরবার থেকে আপনজনদের কাছে ফিরে আসলেন এবং সবাইকে একত্রিত করে বললেন, আমার প্রিয়জনেরা! যদি আমি পবিত্র মদীনা শহরে অবস্থান করি, এরা আমাকে ইয়াযীদের বাইয়াত করার জন্য বাধ্য করবে, কিন্তু আমি কখনও বাইয়াত গ্রহণ করতে পারবো না। তারা বাধ্য করলে নিশ্চয়ই যুদ্ধ হবে, ফাসাদ হবে; কিন্তু আমি চাইনা আমার কারণে মদীনা শরীফে লড়াই বা ফাসাদ হোক। আমার মতে, এটাই সমীচীন হবে যে, এখান থেকে হিজরত করে মক্কা শরীফে চলে যাওয়া। নিজের আপনজনেরা বললেন, ‘আপনি আমাদের অভিভাবক; আমাদেরকে যা হুকুম করবেন তাই মেনে নেব।’ অতঃপর তিনি মদীনা শরীফ থেকে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আহ! অবস্থা কেমন সঙ্গীন হয়ে গিয়েছিল যে, ইমাম (রাঃ)কে সেই মদীনা শরীফ ত্যাগ করতে হচ্ছিল, যে মদীনা শরীফে তার(রাঃ) নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওযা শরীফ অবস্থিত। তাঁর নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওযা মুবারক যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার টাকা পয়সা ব্যয় করে, আপনজনদের বিরহ-বেদনা সহ্য করে, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা আসে এই মদীনায়। কিন্তু আফসুস, আজ সেই মদীনাতিনি(রাঃ) ত্যাগ করছেন, যেই মদীনা শরীফ তারই(রাঃ) ছিল। নবীজী (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নয়নের তারা ছিলেন তিনি(রাঃ)। ক্রন্দনরত অবস্থায় তিনি(রাঃ) নানাজান (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর রওযা পাকে উপস্থিত হয়ে বিদায়ী সালাম পেশ করলেন এবং অশ্রুসজল নয়নে নানাজান (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুমতি নিয়ে আত্মীয়-পরিজন সহকারে মদীনা শরীফ থেকে হিজরত করে মক্কা শরীফে চলে গেলেন। মক্কা শরীফ তিনি(রাঃ) কেন গিয়েছিলেন? আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ ফরমান-
ومن دخله كان امنا অর্থ: ‘যে হেরেম শরীফে প্রবেশ করলো, সে নিরাপদ আশ্রয়ে এসে গেল।’
— সূরা আল ইমরান, আয়াত ৯৭
কেননা হেরেম শরীফের অভ্যন্তরে ঝগড়া-বিবাদ, খুন-খারাবী নাজায়িয ও হারাম। এমনকি হেরেম শরীফের সীমানায় উঁকুন মারা পর্যন্ত নিষেধ। তবে সাপ, বিচ্ছু ইত্যাদি মারতে পারে। কিন্তু যে সব পশু-পাখি মানুষের কোন ক্ষতি করে না সেগুলো মারা জায়িয নেই। মু’মিনদের ইজ্জত-সম্মান তাঁদের শান-মান এটাতো অনেক উচ্চ হয়ে থাকে। তাই ইমাম হুসাইন (রাঃ) চিন্তা করলেন যে, হেরেম শরীফেরসীমানায় অবস্থান করে আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদত বন্দেগীতে বাকী জীবন কাটিয়ে দিবেন- এ মনোভাব নিয়ে তিনি মদীনা শরীফ থেকে মক্কা শরীফে চলে আসলেন।
কুফার চিঠি
মক্কা শরীফ আগমনের সাথে সাথে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কাছে কূফা থেকে লাগাতার চিঠিপত্র এবং সংবাদ-বাহক আসতে শুরু করলো। অল্প সময়ের মধ্যে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কাছে দেড়শত চিঠি এসে পৌঁছল। অপর এক বর্ননায় বারোশ’ চিঠি এসেছিল । কিন্তু অধিকাংশ কিতাবে দেড়শত চিঠির কথা উল্লিখিত হয়েছে। দেড়শত চিঠিই বিশেষ নির্ভরযোগ্য। কারণ সেই যুগে ডাক আদান-প্রদান অত সহজ ছিল না। লোকেরা চিঠি-পত্র, পত্র-বাহকের মাধ্যমে প্রেরণ করতো এবং পত্র-বাহক পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে গন্তব্যস্থানে চিঠি পৌঁছিয়ে দিত। এমতাবস্থায় দেড়শত চিঠি পৌঁছাটা অতটা সহজ ব্যাপার নয় ।
যা হোক, ধরা যাক ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কাছে দেড়শত চিঠি পৌঁছেছিল। প্রত্যেক চিঠির বিষয়বস্তু খুবই আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ । প্রত্যেক চিঠির সার সংক্ষেপ হচ্ছে,
হে ইমাম হুসাইন (রাঃ) ! আমরা আপনার পিতা হযরত আলী (রাঃ)এরই অনুসারী এবং আহলে বাইত-এর ভক্ত। আমরাতো হযরত মুআবিয়া (রাঃ)কে সমর্থন করিনি, আর তাঁর অনুপযুক্ত ছেলে ইয়াযীদকে মানার প্রশ্নই উঠতে পারে না। আমরা আপনার পিতা আমীরুল মুমেনিন হযরত আলী (রাঃ) ও আপনার ভাই হযরত হাসান (রাঃ)এর সমর্থনকারী। আমরা ইয়াযীদের অনুসারী নই। ইয়াযীদ এখন তখতারোহন করেছে, কিন্তু আমরা ইয়াযীদকে খলীফা বা ইমাম মানতে পারি না। আপনাকেই বরহক ইমাম, বরহক খলীফা মনে করি। আপনি মেহেরবানী করে কূফায় তাশরীফ নিয়ে আসুন । আমরা আপনার হাতে বাইয়াত করবো এবং আপনাকে খলীফা হিসেবে গ্রহণ করবো। আপনার জন্য আমাদের জানমাল কুরবান করতে প্রস্তুত এবং আপনার হাতে বাইয়াত করে আপনার অনুসরণে জিন্দেগী অতিবাহিত করতে ইচ্ছুক। তাই আপনি আমাদের কাছে তাশরীফ আনুন। আমাদের প্রতি মেহেরবানী করুন এবং আমাদেরকে আপনার ছোহবতে রেখে আপনার ফয়েজ-বরকত দ্বারা আমাদেরকে উপকৃত করুন।
সমস্ত কাবিলা খানদানের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে এই ধরণের চিঠি এসেছিল। অনেকেই এই ধরণের চিঠিও লিখেছিল,
হে মহান ইমাম ! আপনি যদি আমাদের কাছে না আসেন, আমাদেরকে বাধ্য হয়ে ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত করতে হবে; কারণ সরকারের মোকাবেলা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাল কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ্ তা’য়ালা যখন জিজ্ঞেস করবেন- কেন আমরা নালায়েক ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলাম, তখন আমরা পরিস্কার বলব, হে মওলা! আমরা আপনার নবী করিম (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম)এর দৌহিত্রের কাছে চিঠি লিখেছিলাম, সংবাদ পাঠিয়েছিলাম, মাল-জান কুরবানী করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি(রাঃ) যেহেতু তাশরীফ আনেননি এবং আমরা সরকারের বিরোধিতা করতে পারিনি, সেহেতু আমরা বাধ্য হয়ে ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত করেছি। তাই হে ইমাম! আপনি স্মরণ রাখবেন, আমাদের এ বাইয়াতের জন্য আপনিই দায়ী হবেন।
হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)এর কূফা গমন
কূফাবাসীদের পক্ষ থেকে এ ধরনের চিঠি লিখার পরিপ্রেক্ষিতে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী হযরত ইমাম হুসাইন(রাঃ) চিন্তা করলেন যে, সেখানে তিনি যাবেন কি না। তিনি(রাঃ) অনেকের সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, প্রথমে একজন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি সেখানে গিয়ে স্বচক্ষে অবস্থা যাচাই করে দেখবেন যে, ওরা বাস্তবিকই তাঁকে(রাঃ) চায় কি না? তার(রাঃ) প্রতি সত্যিই আন্তরিক মুহব্বত ও বিশ্বাস আছে কিনা ? সঠিক বিবরণ পাওয়ার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন, তিনি যাবেন কি যাবেন না।
অতঃপর তিনি তাঁর চাচাতো ভাই হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (রাঃ) এ কাজের জন্য মনোনীত করলেন এবং ফরমালেন, ‘প্রিয় মুসলিম! কূফা থেকে যেভাবে চিঠি আসছে তা যাচাই করে দেখার জন্য তোমাকে আমার প্রতিনিধি করে সেখানে পাঠানোর মনস্থ করেছি। তুমি সেখানে গিয়ে স্বচক্ষে অবস্থা উপলব্ধি এবং যাচাই করে যদি অবস্থা বাস্তবিকই সন্তোষজনক মনে কর, তাহলে আমার কাছে চিঠি লিখবে। চিঠি পাওয়ার পর আমি রওয়ানা হবো, অন্যথায় তুমি সেখান থেকে ফিরে আসবে। তাঁর চাচাতো ভাই হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (রাঃ) যাবার জন্য তৈরি হয়ে গেলেন। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) কূফাবাসীদের কাছে একটি চিঠি লিখলেন-
ওহে কূফাবাসী! পরপর তোমাদের অনেক চিঠি আমার কাছে পৌঁছেছে। তাই আমি আমার চাচাতো ভাই হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (রাঃ)কে আমার প্রতিনিধি করে তোমাদের কাছে পাঠালাম। তোমরা সবাই তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করো এবং তাঁর খিদমত করো। সে তোমাদের মনোভাব যাচাই করে আমার কাছে চিঠি লিখবে, যদি তোমাদের মনোভাব সন্তোষজনক হয়, তাঁর চিঠি আসার পর পরই আমিও তোমাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাব।
এভাবে চিঠি লিখে সীল মোহর লাগিয়ে হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (রাঃ) দিলেন । হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (রাঃ)-এর দুই ছেলে হযরত মুহম্মদ ও হযরত ইব্রাহীম তাঁর সাথে যেতে গোঁ ধরলেন। তাঁরা বলতে লাগলেন, আব্বাজান! আমাদেরকে ফেলে যাবেন না, আমাদেরকেও সাথে নিয়ে যান। হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (রাঃ) ছেলেদের অন্তরে আঘাত দিতে চাইলেন না। তাই তাঁর ছেলেদ্বয়কেও সাথেনিলেন। অতঃপর তিনি মক্কা শরীফ থেকে মদীনা শরীফ গেলেন এবং আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করার পর কূফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।
হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)এর প্রতি প্রাণঢালা সংবর্ধনা
কূফায় পৌঁছে মুখতার বিন উবায়দুল্লাহ সাকফী, যে আমন্ত্রণকারীদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিল ও আহলে বাইত-এর অনুরক্ত ছিল, তার ঘরেই হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) তাশরীফ রাখলেন। যখন কূফাবাসীরা খবর পেল যে, হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন। তখন কূফাবাসীরা দলে দলে এসে তাঁর হাতে বাইয়াত হতে লাগলো। অল্প দিনের মধ্যে চল্লিশ হাজার লোক তাঁর হাতে বাইয়াত হয়ে গেল এবং এমন ভালবাসা ও মুহব্বত দেখালো যে, হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) অভিভূত হয়ে গেলেন। তাঁর পিছে পিছে লোক চলাফেরা করছে, দিন-রাত মেহমানদারী করছে, তাঁর হাতে-পায়ে চুম্বন করছে এবং একান্ত আনুগত্যের পরিচয় দিচ্ছে। এতে হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) ভীষণভাবে আকৃষ্ট হলেন এবং মনে মনে বললেন, এরাতো সত্যিই হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর বড়ই আশিক এবং উনার জন্য একেবারে ফানা। তিনি ভাবলেন, আমাকে পেয়ে তাদের যে অবস্থা হয়েছে, জানিনা, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম আসলে তারা কী যে অবস্থা করবে। হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি এভাবে পরিতৃপ্ত হয়ে সমস্ত অবস্থার বর্ণনা দিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কাছে চিঠি লিখলেন-
চল্লিশ হাজার লোক আমার কাছে বাইয়াত হয়েছে, সব সময় আমার সাথে সাথে রয়েছে, আমার যথেষ্ট খিদমত করছে এবং তাদের অন্তরে আপনার প্রতি অসীম মুহব্বত রয়েছে। তাই আপনি আমার চিঠি পাওয়া মাত্রই চলে আসুন। এখানকার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক।
এভাবে হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কাছে চিঠি লিখলেন। এদিকে পত্র-বাহক পত্র নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল। আর ঐদিকে দেখুন, তকদীরে যা লিখা ছিল, তা কিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
কূফাবাসীর বেঈমানী ও হযরত ইমাম মুসলিমের শাহাদাত
ইয়াযীদের অনেক অনুসারীরাও কূফায় অবস্থান করতো। তারা যখন দেখলো, হযরত ইমাম মুসলিমের হাতে চল্লিশ হাজার লোক বাইয়াত গ্রহণ করেছে, তখন তারা ইয়াযীদকে এ ব্যাপারটা জানিয়ে চিঠি দিল। তারা ইয়াযীদকে লিখলো যে, ওহে ইয়াযীদ! তুমিতো নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছো, আর এদিকে তোমার বিরুদ্ধে কূফায় বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠছে, যা তোমার পক্ষে প্রতিরোধ করা খুবই কষ্টসাধ্য হবে। তোমারতো খবরই নেই, তোমার বিরুদ্ধে চল্লিশ হাজার লোক বাইয়াত হয়েছে এবং আরও লোক বাইয়াত হচ্ছে। যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে এখান থেকে এমন এক ভয়ানক ঝড়-তুফানের সৃষ্টি হবে, যা তোমাকে খড়-কুটার ন্যায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তাই তুমি যেভাবেই হোক এটাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করো।’ যখন ইয়াযীদ চিঠির মাধ্যমে এ খবর পেল, সে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলো। সে অবহিত আছে যে, রাজ-ক্ষমতা বড় জিনিস। কেউ নিজ ক্ষমতা সহজে ত্যাগ করতে চায় না। আপ্রাণ চেষ্টা করে সেই ক্ষমতা, সেই সিংহাসন আঁকড়ে রাখতে চায়। তাই ইয়াযীদের কাছেও যখন তার রাজত্ব হুমকির সম্মুখীন মনে হলো, তখন কূফার গভর্নর ‘নোমান বিন বশীর’ যিনি হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিকার নেননি, তাকে পদচ্যূত করলো এবং তার স্থলে ইবনে যিয়াদ যার আসল নাম ছিল ‘উবাইদুল্লাহ’ যে বড় যালিম ও কঠোর ব্যক্তি ছিল এবং যে বছরার গভর্নর ছিল, তাকে কূফার গভর্নর নিয়োগ করলো এবং তার কাছে চিঠি লিখলো- ‘তুমি বছরার গভর্নরও থাকবে, সাথে সাথে তোমাকে কূফারও গভর্নর নিয়োগ করা হলো। তুমি শীঘ্রই কূফা এসে আমার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়েছে, তা যেভাবে হোক দমিয়ে ফেলো, এ ব্যাপারে যা করতে হয়, তা করার জন্য তোমাকে পূর্ণ ইখতিয়ার দেয়া হলো। যেভাবেই হোক, যে ধরনের পদক্ষেপই নিতে হোক না কেন, এ বিদ্রোহকে নির্মূল করে দাও।’
ইবনে যিয়াদ ইয়াযীদের পক্ষ থেকে পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে কূফায় আসলো। সে কূফায় এসে সর্বপ্রথম যে কাজটা করলো, তা হচ্ছে যতগুলো বড় বড় সর্দার ছিল এবং যারা হযরত মুসলিম (রাঃ)এর সাথে ছিল ও বাইয়াত গ্রহণ করেছিল, তাদের সবাইকে বন্দী করে ফেললো এবং বন্দী করার পর কূফার গভর্নর হাউজে নজরবন্দী করে রাখলো। তাদের এই বন্দীর কথা বিদ্যুৎ বেগে সমগ্র কূফায় ছড়িয়ে পড়লো এবংএতে সমস্ত লোক হতভম্ব ও মর্মাহত হলো, সবাই চিন্তিত হলো, এখন কি করা যায়? সমস্ত বড় বড় সর্দারকে বন্দী করছে এবং ইমাম মুসলিমকে বন্দীর কৌশল নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে।
ইমাম মুসলিম যখন দেখলেন যে, বড় বড় সর্দারদেরকে বন্দী করা হয়েছে এবং আরও নতুন-নতুন বন্দী করার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন তিনি তাঁর সমস্ত অনুসারী ও বাইয়াত গ্রহণকারীদের আহবান করলেন। তাঁর ডাকে সাথে সাথে সবাই এসে সমবেত হয়ে গেল। ঐ চল্লিশ হাজার ব্যক্তি যারা তাঁর হাতে বাইয়াত করেছিল, তারা সবাই সমবেত হলো। তিনি তাদের হুকুম দিলেন, গভর্নর ভবন ঘেরাও করো। হযরত মুসলিম (রাঃ) এ চল্লিশ হাজার অনুসারীদেরকে নিয়ে গভর্নর ভবন ঘেরাও করলেন। তখন অবস্থা এমন উত্তপ্ত ছিল, তিনি একটু ইশারা করলে ঐ চল্লিশ হাজার লোক এক মূহূর্তের মধ্যে গভর্নর ভবন ধুলিস্যাৎ করে ফেলত এবং ইবনে যিয়াদ এর কোন প্রতিরোধ করতে পারতো না। কারণ, ঐ চল্লিশ হাজার লোকের মোকাবেলা করার ক্ষমতা তখন তার ছিল না। এমনকি তখন তার কাছে এত সৈন্যও ছিল না। কিন্তু তকদিরে যা ছিল, তা খণ্ডানোর কোন উপায় নেই, আল্লাহ্ তা’আলার যা মঞ্জুর ছিল, তাতো হবেই । চল্লিশ হাজার লোকের ঘেরাও অভিযান দেখে ইবনে যিয়াদ খুবই ভয় পেল। তবে সে বড় চালাকী ও ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিল। যেসব বড় বড় সর্দারদেরকে গভর্নর ভবনে নজরবন্দী করে রাখা হয়েছিল, তাদের সবাইকে একত্রিত করে বললো, দেখুন আপনারা যদি আপনাদের পরিবার-পরিজনের মঙ্গল চান তাহলে আমার পক্ষ অবলম্বন করুন। আমাকে সহযোগিতা করুন। নচেৎ আমি আপনাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিব এবং আপনাদের পরিবারের ও আপনাদের সন্তান-সন্ততিদের যে কঠিন পরিণতি হবে, তা দুনিয়াবাসী দেখবে। অতঃপর বড় বড় সর্দারেরা বললো, আপনি কি চান? কি ব্যাপারে আমাদের সহযোগিতা চান? ইবনে যিয়াদ বলল- যারা এ মুহূর্তে গভর্নর ভবন ঘেরাও করে রেখেছে, তারা হয়তো আপনাদের ছেলে হবে বা ভাই হবে বা অন্য আত্মীয় স্বজন হবে। আমি এখন আপনাদেরকে গভর্নর ভবনের ছাদের উপর নিয়ে যাচ্ছি, আপনারা নিজ নিজ আপনজনদেরকে ডেকে বুঝান, যেন তারা ঘেরাও প্রত্যাহার করে নেয় এবং হযরত মুসলিম (রাঃ)এর সঙ্গ ত্যাগ করে। যদি আপনারা এই রকম না করেন, তাহলে সবার আগে আপনাদের হত্যা করার নির্দেশ দিব এবং অতি শীঘ্রই আমার যে সৈন্য বাহিনী আসছে তারা কূফা আক্রমণ করবে, আপনাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হবে এবং আপনাদের শিশুদেরকে বর্শার অগ্রভাগে উঠানো হবে অর্থাৎ ওদের যে পরিণাম বা হাশর হবে, তা দুনিয়াবাসী দেখবে । তাই আমি আপনাদেরকে বলছি- আমার পক্ষ অবলম্বন করুন, যদি নিজের এবং পরিবার পরিজনের মঙ্গল চান।
এভাবে যখন সে হুমকি দিল তখন বড় বড় সর্দারেরা ঘাবড়িয়ে গেল এবং সবাই বলতে লাগল, ইবনে যিয়াদ! আপনি যা করতে বলেন আমরা তাই করবো। ইবনে যিয়াদ বললো, চলুন, ছাদে উঠুন এবং আমি যেভাবে বলি সেভাবে করুন। সর্দারেরা সাথে সাথে ছাদের উপর উঠলো এবং নিজ নিজ আপনজনদেরকে ডাকতে লাগলো। ডেকে চুপি চুপি বুঝাতে লাগলো, দেখ, ক্ষমতা এখন ইয়াযীদের হাতে, সৈন্য বাহিনী ইয়াযীদের হাতে, অস্ত্র-শস্ত্র, ধন-সম্পদ ইয়াযীদের হাতে। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) অবশ্যই রসূল (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর বংশধর। কিন্তু তাঁর(রাঃ) কাছে না আছে রাজত্ব, না আছে সম্পদ, না সৈন্য-সামন্ত, না অস্ত্র-শস্ত্র। তাই তিনি সৈন্য-সামন্ত, অস্ত্র-শস্ত্র ও ধন-সম্পদ ব্যতিরেকে কিভাবে ইয়াযীদের মোকাবিলা করবেন? মাঝখানে আমরা বিপদগ্রস্ত হবো। এটা রাজনৈতিক ব্যাপার। তাই তোমরা এখন এ ঘেরাও উঠিয়ে নাও এবং হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)এর সঙ্গ ছেড়ে দাও। স্মরণ রাখিও, তোমরা যদি এরকম না করো, তাহলে না তোমরা আমাদের মুখ দেখবে আর না আমরা তোমাদের মুখ দেখবো। আমাদেরকে এখনি কতল করে ফেলবে আর তোমাদের পরিণামও খুব ভয়াবহ হবে।
যখন বড় বড় সর্দারেরা নিজ নিজ আপন জনদেরকে বুঝাতে ও পরামর্শ দিতে লাগলো, তখন লোকেরা অবরোধ ছেড়ে দিয়ে নীরবে চলে যেতে লাগলো। দশ-বিশজন করে এদিক-ওদিক থেকে লোক চলে যেতে লাগলো। হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) চল্লিশ হাজার লোক নিয়ে গভর্নর ভবন ঘেরাও করেছিলেন কিন্তু আসরের পর মাগরিবের আগে মাত্র পাঁচশ জন লোক ছাড়া বাকী সব চলে গেল। এতে হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) খুবই মর্মাহত হলেন। তিনি ভাবলেন, চল্লিশ হাজার লোক থেকে সাড়ে ঊনচল্লিশ হাজার চলে গেছে, কেবল পাঁচশ জন রয়ে গেল, তাদের উপরও বা কি করে আস্থা রাখা যায় । হযরত ইমাম মুসলিম যখন এ অবস্থা দেখলেন, তখন যে পাঁচশ জন ছিল, তিনি তাদেরকে বললেন, চলুন আমরা জামে মসজিদে গিয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করি। নামাযের পর পরামর্শ করব কি করা যায় । সবাই বললেন, ঠিক আছে। হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) পাঁচশ লোককে নিয়ে মসজিদে গেলেন। তখন নামাযের সময় হয়ে গেছে, আযান হয়েছে। তিনি ইমাম হলেন। পাঁচশ জন পিছনে ইক্তিদা করলো। তিনরাকাত ফরয নামায পড়ার পর যখন সালাম ফিরালেন, তখন দেখলেন, ঐ পাঁচশ জনের মধ্যে একজনও নেই।
আহ্! সকালে চল্লিশ হাজার লোক সাথে ছিল, এখন একজনও নেই! এরা তারাই, যারা নিজেদেরকে আহলে বাইতের একান্ত ভক্ত বলে দাবি করতো, যাদের পূর্ব পুরুষেরা আহলে বাইতের অনুসারী দাবীদার ছিল। এরাই চিঠি লিখেছিল, এরাই হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে কূফায় আসার জন্য আহবান জানিয়েছিল, এরাই জান-মাল কুরবানীর জন্য নিশ্চয়তা দিয়েছিল । এরাই হযরত ইমাম মুসলিমের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল এবং বড় বড় শপথ করে ওয়াদা করেছিল যে, ‘তারা জান দেবে তবুও তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করবে না’। কিন্তু তাদের প্রাণও দিতে হলো না, তীর দ্বারা আহতও হতে হলো না, না তরবারি দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হলো, কেবল ইবনে জিয়াদের ধমকেই তার সঙ্গ ছেড়ে দিল এবং বিশ্বাসঘাতকতা করলো ।
হযরত মুসলিম নামায শেষে আল্লাহ্! আল্লাহ্! করছিলেন এবং মনে মনে ভাবছিলেন, এখন কী করা যায়, সব লোকতো আমাকে ছেড়ে চলে গেল। এদিকে আমি হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে চিঠি লিখে দিয়েছি যে, এখানকার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক। এখানকার লোকদের মনে তাঁর(রাঃ) প্রতি আন্তরিক ও অসীম মুহব্বত রয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) তো এক মুহূর্তও বিলম্ব করবেন না। তিনি খুবই জলদি এসে যাবেন। তখন তাঁর(রাঃ) কী যে প্রতিক্রিয়া হবে, যখন এসে দেখবেন এসব লোকেরা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যা হোক তিনি(রাঃ) মসজিদ থেকে বের হয়ে নিজ মুরীদের কাছে গেলেন। কিন্তু যেই মুরীদের কাছেই গেলেন, দেখলেন যে, ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। ডাকাডাকি করার পরও ঘরের দরজা খুলে না। হায়রে! যারা বড় বড় ওয়াদা করেছিল এবং আহলে বাইতের ভক্ত বলে দাবি করেছিল, এখন তারা ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে রাখলো ।
হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) কুফার রাস্তায় এমনভাবে অসহায় অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন যেমন একজন সহায়-সম্বলহীন মুছাফির ঘুরাফিরা করে। তিনি(রাঃ) বড় পেরেশানীর সাথে অলি-গলিতে হাঁটতে লাগলেন। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় গিয়ে এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখলেন, যিনি ঘরের দরজা খুলে বসেছিলেন। তিনি(রাঃ) তার কাছে গিয়ে পানি চাইলেন। বৃদ্ধা পানি দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি(রাঃ) কে? কোথা থেকে এসেছেন, কার সঙ্গে দেখা করবেন এবং কোথায় যাবেন? যখন বৃদ্ধা মহিলাটি তাঁর অবস্থা জিজ্ঞাসা করলেন, তখন তিনি অকপটে বললেন, ওহে বোন! আমি মুসলিম বিন আক্বীল, হযরত ইমাম হুসাইন বিন আলী (রাঃ)এর প্রতিনিধি হয়ে কূফায় এসেছিলাম। মহিলাটি আশ্চর্য হয়ে বললেন, আপনি মুসলিম বিন আক্বীল ! আপনি এভাবে অসহায়ভাবে ঘুরাফিরা করছেন ! কূফার সবাইজানে যে, আপনার হাতে হাজার হাজার লোক বাইয়াত হয়েছে এবং সবাই আপনার জন্য জান-মাল কুরবান করতে প্রস্তুত। কিন্তু এখন আমি কী দেখছি ! আপনি যে এভাবে অসহায়, একাকী ঘুরাফিরা করছেন? হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) বললেন, ‘হ্যাঁ বোন । বাস্তবিকই তা ছিল। কিন্তু তারা আমার সাথে বেঈমানী করেছে। তাই আপনি আমাকে এই অবস্থায় দেখছেন। কূফার কোন ঘরের দরজা আজ আমার জন্য খোলা নেই, এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আমি রাত্রি যাপন করতে পারি এবং আশ্রয় নিতে পারি। বৃদ্ধা মহিলা বললেন, আমার গরীবালয় আপনার জন্য খোলা আছে, আমার জন্য এর থেকে বড় সৌভাগ্য আর কি হতে পারে যে, রসূলুল্লাহ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর একজন আওলাদ আমার ঘরে মেহমান হয়েছেন। সেই বৃদ্ধাটি তাঁকে(রাঃ) ঘরে জায়গা দিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বুড়ীর ঘরে আশ্রয় নিলেন। সেখানে তিনি রাত যাপন করলেন।
খোদার কুদরত! ঐ বুড়ীর এক ছেলে ছিল বড় নাফরমান। এটা খোদারই শান, নেককার থেকে বদকার এবং বদকার থেকে নেককার পয়দা হয়। আল্লাহ্ তা'আলা ম’মিনদের ঘরে কাফির সৃষ্টি করে দেন এবং কাফিরদের ঘরে মু’মিন।
‘ইউখ্রিজুল হাইয়ু মিনাল মাইয়াতি ওয়া ইউখ্রিজুল মাইয়াতু মিনাল হাইয়্যি’ । অর্থাৎ তিনি জিন্দা থেকে মূর্দা বাহির করেন এবং মূর্দা থেকে জিন্দা ।
আল্লাহ্ তা’আলা মুমিনদের ঘরে কাফির সৃষ্টি করেন এবং কাফিরদের ঘরে মু’মিন । কাফিরের ঘরে লালিত খলিলুল্লাহ (আঃ) মূর্তি নিধনকারী হয়ে যায় । আবার নূহ (আঃ) এর ঘরে জন্ম ও লালিত পালিত হয়ে তাঁর ছেলে কাফির হয়ে যায় । ফিরআউনের স্ত্রী বেহেস্তের সর্দারনী হয়ে যায় আর হযরত লুত (রাঃ) এর স্ত্রী হয়ে যায় কাফির । কোন এক কবি সুন্দর বলেছেন। আর হযরত লূত আলাইহিস সালাম-এর স্ত্রী হয়ে যায় কাফির। ‘ফেরাউনের ঘরে লালিত পালিত হযরত মুসা (আঃ) খলিলুল্লাহ হয়ে যান । আর নূহ (আঃ) এর পুত্র হয়ে যায় গোমরাহ্ । লুত (আঃ) এর স্ত্রী হয়ে যায় ‘কাফেরা’ আর ফেরাউনের স্ত্রী হয়ে যায় ‘তাহেরা’ (পবিত্রও) । এটা খোদা তা’আলারই শান, খোদার শানের অদ্ভুত প্রকাশ । তিনি মু’মিনের ঘরে কাফির এবং কাফিরের ঘরে মু’মিন সৃষ্টি করেন । তিনি বদ্বখতের ঘরে নেকবখত্ এবং নেকবখতের ঘরে বদবখত্ পয়দা করেন । যিনি বেনিয়াজ, তিনি যা ইচ্ছে তা করতে পারেন- ‘ইয়াফ’আলু মাঈয়াশাউ’ ।
শেষ রাতে বৃদ্ধার সেই নাফরমান ছেলে ঘরে আসলো, এসে মাকে পেরেশান দেখে জিজ্ঞাসা করলো, মা তুমি চিন্তিত কেন ? মা বললেন, বৎস! মুসলিম বিন আক্বীল (রাঃ), যিনি আমাদের প্রিয় নবী (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর খানদানের একজন, তিনি(রাঃ) কূফায় এসেছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর প্রতিনিধি হয়ে। কূফাবাসী তাঁর (রাঃ) হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল, তারা তাঁর সাথে সাতেহ থাকতো এবং জান-মাল কুরবানী করার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান গভর্নরের ধমকীতে সবাই তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেছে এবং বেঈমানী করে সবাই তাঁর (রাঃ) জন্য ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি অসহায় অবস্থায় অলি-গলিতে ঘুরছিলেন। যাক, খোদা তায়ালা আমাকে সৌভাগ্যবান করেছেন, আজ তিনি আমার ঘরে মেহমান এবং আমার ঘরে অবস্থান করছেন। তিনি আজ আমার গরীবালয়ে কদমরেখেছেন। এর জন্য আমি আজ গর্ববোধ করছি যে, আমি তাঁর মেহমানদারীর সুযোগ লাভ করলাম। এ জন্যই একদিকে আজ আমি খুবই আনন্দিত, আর অন্যদিকে আমি খুবই দুঃখিত যে, কূফাবাসীরা একজন সম্মানিত মেহমানের সাথে এ ধরনের বেঈমানী করতে পারলো।
বৃদ্ধা মহিলাটি যখন এসব ঘটনা বলছিল, ছেলে মনে মনে খুবই খুশি হলো এবং মনে মনে বলতে লাগলো- শিকার হাতের মুঠোয়, এটাতো বড় সৌভাগ্যের বিষয়। আমার মা’তো একজন সাধাসিধে মহিলা। তিনি কি জানেন ইবনে জিয়াদের ঘোষণার কথা ? ইবনে যিয়াদ তো ঘোষণা করেছে, যে ব্যক্তি হযরত মুসলিম বিন আক্বীল (রাঃ)কে গ্রেফতার করতে পারবে, তাকে এক হাজার দিরহাম পুরস্কার দেয়া হবে। যা হোক, তিনি যখন সৌভাগ্যবশতঃ আমার ঘরে এসে গেছেন, আমি খুবই সকালে গিয়ে খবর দিয়ে উনাকে আমার ঘর থেকে গ্রেফতার করাবো এবং হাজার দিরহাম পুরস্কার লাভ করবো। ছেলে এই অসৎ উদ্দেশ্য ও ইচ্ছা তার মা’র কাছে গোপন রাখলো।
এদিকে সে অস্থির হয়ে পড়লো, কখন সকাল হবে, কখন খবর পৌঁছাবে এবং পুরস্কার লাভ করবে। ফজর হওয়া মাত্রই সে তার অন্যান্য বন্ধুদের নিয়ে ইবনে যিয়াদকে খবর দিলো যে, হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) ওর ঘরেই অবস্থান করছেন, সে হলো সংবাদদাতা এবং সে পুরস্কারের দাবিদার। ইবনে যিয়াদ বললো, ‘তোমার পুরস্কার তুমি নিশ্চয়ই পাবে, প্রথমে উনাকে গ্রেফতার করার ব্যবস্থা করো’। সে বললো, ‘ঠিক আছে, আমার সাথে সিপাই পাঠিয়ে দিন’। তার কথা মতো তার সাথে সত্তরজন সিপাই গেল এবং সেই মহিলাটির ঘর চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো।
হযরত মুসলিম (রাঃ) এই অবস্থা দেখে তলোয়ার নিয়ে বের হলে সৈন্যরা জঘন্যভাবে বেয়াদবী করলো এবং এমন ভাষা উচ্চারণ করলো, যা মোটেই সহনীয় নয় । ওরা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কঠোর সমালোচনা করলো এবং ইয়াযীদের প্রশংসা করলো। আর তাঁর (রাঃ) বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ আনলো। হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) এসবের যথার্থ উত্তর দিলেন। কিন্তু ইত্যবসরে ওরা তীর নিক্ষেপ করলো।
হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) বললেন, যদি আলোচনা করতে চাও তাহলে বুদ্ধিমত্তার সাথে আলোচনা করো। আর যদি তীর নিক্ষেপ করো আমিও এর যথোচিত জবাব দিব। ওরা বললো, ঠিক আছে, শক্তি থাকলে জবাব দিন। তাদের কথা শুনে হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) তাদের সামনা-সামনি এসে গেলেন এবং তলোয়ার চালাতে শুরু করলেন। তিনি একাই সত্তরজনের সাথে মোকাবিলা করতে লাগলেন আর এদিকে ওরা তাঁর বীর বিক্রম আক্রমণে হতভম্ভ হয়ে গেল এবং তারা মনে মনে বললো, আমরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে ভুল করলাম। হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)এর সুনিপূণ তলোয়ার চালনার সামনে ওরা টিকতে না পেরে পিছপা হলো। তবুও তিনি কয়েক জনকে হত্যা করতে সক্ষম হলেন এবং অনেককে আহত করলেন। এই অবস্থায় তিনি নিজেও আহত হলেন। একটা তীরের আঘাতে উনার সামনের দাঁত ভেঙ্গে গেল এবং রক্ত বের হচ্ছিল।
তখন তিনি বৃদ্ধা মহিলাটির কাছ থেকে পানি চাইলেন। মহিলাটি উনাকে পান করার জন্য এক গ্লাস পানি দিলেন। যখন তিনি পানি পান করতে মুখে নিলেন, তখন সেই পানি মুখের রক্তে লালে লাল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত তিনি পানি পান করলেন না। গ্লাসটা মাটিতে রেখে তিনি মনে মনে বললেন, ‘হয়তঃ দুনিয়ার পানি আমার ভাগ্যে আর নেই। আমি জান্নাতুল ফিরদাউস-এ গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করবো।’
অতঃপর হযরত ইমাম মুসলিম(রাঃ) পুনরায় লড়তে শুরু করলেন । এ খবর যখন ইবনে জিয়াদের কাছে পৌঁছলো তখন সে মুহম্মদ বিন আশআছকে পাঠালো এবং তাকে বললো, তুমি গিয়ে কুটনৈতিক ও রাজনৈতিক পন্থায় উনাকে বন্দী করে আমার কাছে নিয়ে এসো। সে হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)এর কাছে এসে বললো,
ওরা আসলে বোকামী করেছে। ওদেরকে ইবনে যিয়াদ মোকাবিলা বা লড়াই করার জন্যে পাঠায়নি। ওদেরকে পাঠানো হয়েছিল আপনাকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আপনি আমার সাথে গভর্নর ভবনে চলুন। আপনি গভর্নরের সাথে কথা বলুন, তিনি আপনার সাথে মত বিনিময় করতে চান। কারণ ইত্যবসরে হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালামও কূফায় এসে পৌঁছবেন। তাই তিনি চাচ্ছেন, এ সময়ে যেন কোন ফিতনা ফ্যাসাদের সৃষ্টি না হয়। গভর্নরের কাছে চলুন, কথাবার্তার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হোন। মত বিনিময়ের মাধ্যমে হয়ত সন্ধিও হয়ে যেতে পারে।
হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) বললেন, আমিও তো তাই চাচ্ছি । তা না হলে আমি যখন চল্লিশ হাজার সমর্থক নিয়ে গভর্নর ভবন ঘেরাও করেছিলাম তখন আমার একটু ইশারাই গভর্নর ভবন তছনছ এবং ইবনে যিয়াদকে গ্রেফতার করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আমি এটা নিজে পছন্দ করি না যে, মারামারি বা খুন-খারাবী হোক। মুহম্মদ বিন আশআছ বললো, আমার সাথে চলুন, সিপাইদেরকে ধমকের সুরে বললো, তলোয়ার খোলা রেখেছ কেন? বেকুবের দল কোথাকার, তলোয়ার খাপের মধ্যে ভরে রাখো। এভাবে ওদেরকে ধমক দিল আর উনাকে সাথে নিয়ে চললো। হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) তার সাথেগেলেন এবং গভর্নর ভবনে প্রবেশ করার সময় এই দুআটি পড়লেন-
ربنا افتح بيننا وبين قومنا بالحق وانت خير الفاتحين রব্বানাফ্তাহ্ বাইনানা ওয়া বাইনা ক্বওমিনা বিল্হাক্কি ওয়া আংতা খইরুল ফাতিহীন।
— সূরা আ’রাফ-৮৯
এই দুআটি পড়তে পড়তে যখনই তিনি গভর্নর ভবনের শাহী দরজায় প্রবেশ করলেন, এদিকে ইবনে যিয়াদ উম্মুক্ত তলোয়ারধারী কিছু সিপাহীকে দরজার দু’পাশে নিয়োজিত করে রেখেছিল এবং তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করা মাত্রই দু’দিক থেকে আক্রমণ করে যেন হত্যা করা হয়। নির্দেশ মত যখনই তিনি গভর্নর ভবনের দরজায় পা রাখলেন, তখনই তাঁর উপর দু’দিক থেকে তলোয়ার দ্বারা আক্রমণ করা হলো এবং সেখানেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন)
উলামায়ে কিরাম-এর কেউ কেউ তাঁদের কিতাবে লিখেছেন যে, তিনি যথারীতি ইবনে জিয়াদের কাছে পৌঁছেছেন এবং আলোচনা করেছেন। ইবনে যিয়াদ হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) বললো,
দেখুন, আপনি বড় অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছেন। তথাপি একটি শর্তে আমি আপনাকে রেহাই দিতে পারি। শর্তটি হচ্ছে, আপনি ইয়াযীদের বাইয়াত গ্রহণ করুন এবং প্রতিশ্রুতি দিন যে, যখন হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) আসবেন, তাকেও ইয়াযীদের বাইয়াত করিয়ে দিবেন। এতে সম্মত হলে আপনাকে আমি মুক্তি দিতে পারি। অন্যথায় আপনার ও হযরত ইমাম (রাঃ)এর কোন নিস্তার নেই।
হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) উত্তরে বললেন, ‘প্রস্তাব মন্দ নয়, তবে আমি কিংবা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ইয়াযীদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করতে পারি না। এটা কখনো কল্পনাও করা যায় না যে, আমরা ইয়াযীদের কাছে বাইয়াত হবো। তাই তোমার যা ইচ্ছা তা করতে পার।’ ইবনে যিয়াদ পুনরায় বলল, যদি আপনি বাইয়াত গ্রহণ না করেন ও ইমাম হুসাইন (রাঃ)কেও বাইয়াত করানোর ব্যবস্থা না করেন, তাহলে আমি আপনাকে শহীদ করার নির্দেশ দিব। হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) দৃঢ়কন্ঠে বললেন, ‘তোমার যা ইচ্ছে তা করতে পার।'
ইবনে যিয়াদ জল্লাদকে নির্দেশ দিল, হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)কে গভর্নর ভবনের ছাদের উপর নিয়ে গিয়ে শহীদ করো এবং মাথা কেটে আমার কাছে নিয়ে আসো আর দেহকে রশি বেঁধে বাজারে হেঁচড়াও, যাতে হাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় এবং লোকেরা যেন এই দৃশ্য অবলোকন করে। জল্লাদকে হুকুম করার পর, ওরা যখন উনাকে ধরতে আসল, তখন হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) দেখলেন যে, গভর্নর ভবনের চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। তারা সব এসেছে তামাশা দেখার জন্য। কিন্তু আফসুস! এদের মধ্যে অনেকে এসেছে যারা হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল, যারা চিঠি লিখে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে কূফায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ) ওদেরকে দেখে বললেন,
হে কূফাবাসী! তোমরা বেঈমানী করেছ; তা সত্ত্বেও এখন আমি তোমাদেরকে তিনটি কাজের দায়িত্ব দিচ্ছি। যদি পার, এই তিনটি কাজ তোমরা অবশ্যই করবে। প্রথম কাজ হচ্ছে, আমার কাছে যে হাতিয়ারগুলো আছে, এগুলো বিক্রি করে অমূক অমূককে দিও। কারণ, আমি ওদের কাছে ঋণী। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে, যখন আমার মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ইবনে জিয়াদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে এবং আমার লাশ বাইরে নিক্ষেপ করবে, তোমরা আমার লাশটি উঠিয়ে কোন এক যথোপযুক্ত স্থানে দাফন করো। তৃতীয় কাজ হচ্ছে, যদি তোমাদের মধ্যে এক তিল পরিমাণও ঈমান থাকে এবং আহলে বাইত-এর প্রতি এক কণা পরিমাণও মুহব্বত থাকে, তাহলে যে কোন উপায়ে তোমরা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কাছে সংবাদ পৌঁছে দিও, যেন তিনি কূফায় তাশরীফ না আনেন।
এসব কথা শুনে ইবনে যিয়াদ খুবই রাগান্বিত হলো এবং চারিদিকে ঘুরে সবাইকে বলল, খবরদার! যারা হযরত মুসলিমের এ সব কথামত কাজ করবে, আমি তাদেরকে কতল করাবো এবং তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে বর্শার অগ্রভাগে উঠাবো, যাতে কেউ হযরত মুসলিম (রাঃ)এর কথা অনুসরণ করতে না পারে। এবং সে হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)কে লক্ষ্য করে বললো,
আমি আপনার হাতিয়ারগুলো আমাদের মুজাহিদ বাহিনীর মধ্যে বণ্টন করবো এবং আপনার লাশকে দাফন করতে দিব না। বরং কূফার অলিতে-গলিতে ঘুরাবো এবং জনগণকে দেখাবো। তাই যারা আমার পক্ষ অবলম্বন করবে, তারা যেন মুসলিমের কোন কথা না শুনে । আর হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে খবর দেয়া থেকে বাধা দেয়ার কারণ হলো, তাকে (রাঃ) এখানে আনা চাই এবং তাঁকেও বিদ্রোহীতার স্বাদ উপভোগ করাতে চাই।
ইবনে জিয়াদের এ দম্ভোকির কথা শুনে ইমাম মুসলিম (রাঃ) অস্থির হয়ে উঠলেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর ভবিষ্যত পরিণতির কথা চিন্তা করে তখন ইমাম মুসলিম (রাঃ) কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং কূফাবাসীর বিশ্বাস-ঘাতকতার কথা তাঁকে(রাঃ) আরও বেঁদনাক্লিষ্ট করল। এমন সময় জল্লাদরা উনাকে ধরে ছাদের এক কিনারে নিয়ে গেল। তিনি তাদের কাছে দুই রাকায়াত নফল নামায পড়ার অবকাশ চাইলেন। কিন্তু তারা সেই সুযোগটাও দিল না। তিনি অশ্রু-সজল নয়নে মক্কা-মদীনার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওহে আমার মাওলা হুসাইন! আমার এই অবস্থার খবর আপনাকে কে পৌঁছাবে, আমার সাথে কী যে নির্মম আচরণ করা হচ্ছে। হায়! আমি যদি আপনাকে চিঠি না লিখতাম এবং কূফার অবস্থা সন্তোষজনক না জানাতাম তাহলে আপনি এখানে কখনো আসতেন না। কূফাবাসীরা আজ আমার সাথে যেভাবে বিশ্বাস ঘাতকতা করলো, জানিনা, আপনার সাথে কি ধরণের আচরণ করবে ? উনি এসব চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। আর এদিকে জল্লাদরা উনাকে ধরে ছাদে শুইয়ে শরীর মুবারক থেকে মস্তকমুবারক বিচ্ছিন্ন করে ফেললো।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কূফা গমন
আল্লাহ তায়ালার কি যে মহিমা! যেদিন হযরত মুসলিম (রাঃ) কূফায় শহীদ হলেন, সেদিনই হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) প্রিয়জন ও আপনজনদের নিয়ে মক্কা শরীফ যাত্রা করলেন। কারণ, উনার কাছে চিঠি পৌঁছেছিল যে, কূফার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক, তিনি যেন বিনা দ্বিধায় অনতিবিলম্বে তাশরীফ নিয়ে আসেন । তিনি তাঁর (রাঃ) বিবিগণ, বোন, ছেলেমেয়ে এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরকেও সঙ্গে নিলেন এবং মক্কা মুকাররমা থেকে বের হলেন। উলামায়ে কিরাম লিখেছেন যে, তাঁর (রাঃ) কাফেলায় ৮৩ জন ছিল যাদের মধ্যে মহিলা, দুগ্ধপোষ্য শিশুও ছিল । তার সঙ্গে কয়েকজন যুবক বন্ধু-বান্ধবও ছিলেন।আল্লাহ্! আল্লাহ্! এখানে একটি কথা বিশেষভাবে স্মরণীয় যে, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বা মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে বের হননি। কেননা, তিনি যদি যুদ্ধ বা মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে বের হতেন তাহলে, তিনি কখনও মেয়েলোক ও দুগ্ধপোষ্য শিশুদের নিয়ে বের হতেন না। আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে যারা যুদ্ধ বা মোকাবেলা করার উদ্দেশ্য বের হয়, তারা কখনওমেয়েলোক ও দুগ্ধপোষ্য শিশুদের নিয়ে বের হয় না । ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর নিজের বিবি ও দুগ্ধপোষ্য শিশুদের নিয়ে বের হওয়াটা এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি যুদ্ধ কিংবা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে বের হননি। তাঁর কাছে তো চিঠি এসেছে যে, সেখানকার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক, চল্লিশ হাজার লোক বাইয়াত গ্রহণ করেছে, কূফাবাসীরা বেশ মেহমানদারী করছে। তাই তিনি তাঁর আপনজনদেরকে নিয়ে বের হয়েছেন এবং যুদ্ধ করার কোন অস্ত্র-শস্ত্র রাখেননি। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) মক্কা শরীফ থেকে কূফার উদ্দেশ্যে বের হয়ে কিছুদূর যাবার পর হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)-এর শাহাদাত বরণের খবর পেলেন।
হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)-এর শাহাদাতের খবর শুনে তিনি এবং তাঁর সফরসঙ্গীগণ একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। কোথা থেকে কি হয়ে গেল। মাত্র কয়েকদিন আগে হযরত ইমাম মুসলিম (রাঃ)-এর চিঠি আসলো, কূফার অবস্থা খুবই সন্তোষজনক। অথচ এখন শুনছি তাকে শহীদ করে ফেলেছে । এটা কি ধরণের ঘটনা! যা হোক, তারা পিছপা হলেন না, সম্মুখপানে অগ্রসর হলেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত হলো, ওখানে যাওয়া যাক এবং কিভাবে এত তাড়াতাড়ি এ ধরণের ঘটনা ঘটে গেল, তা জানা হওয়া। এ মনোভাব নিয়ে তারা কুফার দিকে ধাবিত হলেন ।