ইহা সৃষ্টিকর্তার ইসম যাত বা সত্তা-বাচক নাম । এতভিন্ন আল্লাহর কতগুলি আস্মা সিফাৎ বা গুণবাচক নাম আছে । যথা, রাহমান, রাহিম, মালিক, খালিক ইত্যাদি । উহাদিগকে আল-আসমাউল হুসনা বলা হয় । আল্লাহ্ শব্দটি ব্যক্তি নাম, ইহার কোণ দ্বিবচন বা বহুবচন নাই । আল্লাহ কুরআনে নিজের সম্পর্কে পুরুষবাচক ক্রিয়া, বিশেষণ ও সর্বনাম ব্যবহার করিয়াছেন । এই নাম দ্বারা একমাত্র সেই অদ্বিতীয়, অনন্ত, সর্ব-শক্তিমান সৃষ্টিকর্তাকেই বুঝায় । অধিকাংশ আলিমের মতে এই শব্দটি কোন বিশেষ ধাতু হইতে উৎপন্ন নহে, আরবি ভাষায় ইহার হুবহু অর্থজ্ঞাপক কোন প্রতিশব্দ নাই । অন্য কোন ভাষায় আল্লাহ্ নামের অনুবাদ হয় না । সুতরাং "খোদা" বা "God" বা "ঈশ্বর" ইত্যাদি কোনটাই আল্লাহ্র সম্যক পরিচয় বহন করে না । অন্যপকে আল্লাহ্ নামের সহিত দ্বিত্ববাদ বা অংশীবাদের কোন সংস্রব নাই । কুরআনের নির্দেশ-
আল্লাহ্র কতগুলি সুন্দর নাম আছে, সেইগুলি দ্বারা তাহাকে সম্বোধন করো
— সূরা ৭ , আয়াত ১৮০
বলুনঃ আল্লাহ বলে আহবান কর কিংবা রহমান বলে, যে নামেই আহবান কর না কেন, সব সুন্দর নাম তাঁরই।
— সূরা ঈশরা , আয়াত ১১০
ইহাতে বুঝা যায়, কোন মুসলিমের পক্ষে আল্লাহ্ এবং তাহার আল-আসমাউল হুসনা ছাড়া অন্য কোন নামে তাহাকে ডাকা আল্লাহ্র অভিপ্রেত নহে ।[1]
আল্লাহ্ তা’আলার পরিচয়
রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম বলেন - আল্লাহ তাআ’লা দাউদের কাছে অহী পাঠালেন, তুমি তোমার পরিচয় গ্রহণ কর আর আমার পরিচয় গ্রহণ কর। দাউদ বলল- হে আমার রব! আমি কি ভাবে আমার পরিচয় গ্রহণ করব, আর কিভাবে তোমার পরিচয় গ্রহণ করব। আল্লাহ তাআ’লা তাকে বললেন- তোমার দুর্বলতা, তোমার অক্ষমতা ও তোমার বিলীন বা লুপ্ত হওয়াকে মনে করে তোমাকে চেন। আর আমার শক্তি, আমার ক্ষমতা ও আমার স্থায়ীত্বের পরিচয় গ্রহণ করে আমাকে চেন। [2]
আল্লাহ তাআ’লা হযরত আদম আলাইহিছ ছালাম হতে রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহ অছাল্লাম পর্যন্ত এক লাখ চব্বিশ হাজার নবী ও রছূলগণকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন
— মেশকাত, হাদীছ নং - ৫৪৯১
তাঁদের উম্মতের কাছে আল্লাহর পরিচয় দান ও তার আনুগত্য স্বীকারের জন্যে নবী-রছুলগণকে দায়িত্ব দিয়েছেন। প্রত্যেক নবী রছূল তাদের নিকট পাঠানো কিতাব ও ছহিফা অনুযায়ী আল্লাহ তাআ’লার পরিচয় দান করেছেন এবং তার আনুগত্য স্বীকার করে ইবাদাত বন্দেগীর দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য, প্রেম ও সন্তুষ্টির নিয়ম বিধান প্রচার করেছেন। সব শেষে নবী ও রছূল হযরত মুহাম্মাদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম এর উপর কোরআন মাজীদ নাজিল করেছেন। এ কোরআন মাজীদে আল্লাহ তাআ’লা তার পরিচয় দান করেছেন।
(১) হে রছূল বলে দাও! আল্লাহ একক (অবিভাজ্য) (২) আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন (৩) তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কারো থেকে জন্মও নেননি। (৪) তার সমতুল্য কেউ নেই।
— ছূরা এখলাছ
(২৫৫) আল্লাহ! আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। তিনি জীবিত, সব কিছুর রক্ষণাবেক্ষণকারী। না তাকে তন্দ্রা স্পর্শ করে আর না নিদ্রা। আছমান জমীনে যা কিছু আছে সকলি তাঁর। এমন কে আছে যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর কাছে সুপারিশ করবে? তাদের সামনে - পিছনে যা কিছু আছে তিনি তার সবই জানেন। তিনি যাকে যেটুকু জ্ঞান দান করেন, তাছাড়া তাঁর জ্ঞানের কোন কিছুই কেউ আয়ত্ব করতে পারে না। তাঁর কুরছি আছমান জমীনকে ঘিরে রেখেছে। আর এগুলি হিফাজাত করা তাঁর পক্ষে কঠিন কিছু নয়। তিনি সব কিছুর উর্দ্ধে এবং সব থেকে মহান।
— ছূরা বাকারাহ
(২) (হে রছুল) তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে তোমার কাছে কোরআন নাযিল করিনি (৩) একমাত্র তাদের উপদেশের জন্য, যারা ভয় করে, (৪) এ কোরআন তাঁর নিকট থেকে নাযিল হয়েছে, যিনি জমীন এবং তার উপরের আছমান সমূহ সৃষ্টি করেছেন (৫) তিনি পরম দয়াময় আরশে সমাসীন (৬) আছমান সকলের মধ্যে, জমীনে ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী স্থানে এবং মাটির নীচে যা কিছু আছে এসব তাঁরই (৭) যদি তুমি উচ্চস্বরে কথা বলো তা তিনি জানেন, আর তিনি গোপন এবং অতি সু² গোপন বিষয়কেও জানেন (৮) আল্লাহ! তিনি ব্যতীত কোন আল্লাহ নেই, সুন্দর সুন্দর সকল নাম একমাত্র তাঁরই।
— ছূরা ত্ব-হা
(২৮৪) আছমান সমূহে যা কিছু আছে এবং যা কিছু জমীনে আছে এ সবই আল্লাহর। যদি তোমরা মনের কথা প্রকাশ কর, আল্লাহ তোমাদের এ সকলের হিসাব নেবেন। এরপর যাকে ইচ্ছা তাকে মাফ করবেন, যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেবেন।
— ছূরা বাকারাহ্
(২৬) বল,হে আল্লাহ! তুমি সকল শক্তির অধিকারী, তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য কেড়ে নাও। যাকে ইচ্ছা ইজ্জত দান কর, আর যাকে ইচ্ছা বেইজ্জতি কর। তোমারই হাতে আছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয় সকল বিষয়ে তুমি ক্ষমতাবান। (২৭) তুমি রাতকে দিনের মধ্যে আর দিনকে রাতের ভিতর প্রবেশ করাও, তুমি জীবিতকে মৃত আর মৃতকে জীবিত করো আর তুমি যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিজিক দান কর।
— ছূরা আল-ইমরান
(২২) তিনি আল্লাহ! তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তিনি দৃশ্য-অদৃশ্য সবই জানেন। তিনি পরম দয়ালু, অসীম দাতা (২৩) তিনি আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, তিনি একমাত্র মালিক, পবিত্রকারী, শাস্তিদাতা, নিরাপত্তা দাতা, আশ্রয়দাতা, বলবান, অসীম ক্ষমতাবান ও অতি মহান। তারা তাঁর সাথে যা শরীক করে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র (২৪) তিনি আল্লাহ! সৃষ্টিকারী, উদ্ভাবনকারী, রূপদানকারী, উত্তম নাম সকল তাঁরই। আছমান সমূহে ও জমীনের মধ্যে যা কিছু আছে সকলেই তার তাছবীহ করে। তিনি পরাক্রান্ত ও মহাজ্ঞানী।
— ছূরা হাশর
উপরের আয়াত গুলিতে এবং কোরআন মাজীদের আরও অনেক আয়াতে আল্লাহ তাআ’লা তাঁর পরিচয় দান করেছেন।
আসমাউল হুসনা তালিকা
আল্লাহ্তায়ালার অস্তিত্ব
আল্লাহ্তায়ালাই প্রকৃত অস্তিত্ব । তিনি ছাড়া বাকী যা কিছু আছে সে সমস্তকে আল্লাহ্পাকই অস্তিত্বে এনেছেন। সুতরাং স্বয়ং অস্তিত্ব যিনি, তিনিই আল্লাহ্ । তিনি খালেক (স্রষ্টা) । আর তিনি যাদেরকে অস্তিত্ব প্রদান করেছেন তারা মাখলুক (সৃষ্টি) ।
আল্লাহ্পাকের জাত (সত্তা ও অস্তিত্ব) এক, অদ্বিতীয়। তাঁর সিফাত (গুণাবলী) এক, অদ্বিতীয় এবং তাঁর আফআ’ল (কার্যাবলী)ও এক, অদ্বিতীয় । তাঁর অস্তিত্ব, গুণাবলী ও কাজ, সৃষ্টির অস্তিত্ব, গুণাবলী এবং কাজের মতো নয় । প্রকৃতপক্ষে কোনো বিষয়ে কেউ বা কোনো কিছু তাঁর সঙ্গে সংযুক্ত নয় । অংশীও নয়। না অস্তিত্বের বিষয়ে। না গুণাবলী বা কাজের বিষয়ে । আল্লাহ্পাকের জাত প্রকারবিহীন (বে-মেছাল) ।তাঁর সিফাতও বে-মেছাল । তেমনি তাঁর কার্যকলাপও বে-মেছাল । সৃষ্ট বস্তুসমূহের জাত, গুণ ও কাজের সঙ্গে তাঁর কোনোই সম্বন্ধ নেই । [1]
তথ্যসূত্র
ইসলামী বিশ্বাস (লেখকঃ মুহাম্মাদ মামুনুর রশিদ)
আল্লাহ্তায়ালার গুণাবলী/‘এলেম’ গুণ
আল্লাহ্পাকের গুণাবলীর আলোচনায় প্রথমে ‘এলেম’ গুণটির কথাই ধরা যাক । আল্লাহ্পাকের এই গুণ অনাদি এবং অবিভাজ্য । তাঁর এই ‘জ্ঞান’ গুণটির সঙ্গে বহু বিষয়ের সম্বন্ধ আছে । তবুও মূলে কিন্তু একাধিকতার অবকাশ নেই । যেহেতু তাঁর ‘এলেম’ একটিমাত্র অবিভাজ্য বিকাশ । আর ওই অবিভাজ্য ও অতুলনীয় বিকাশ থেকে আদি-অন্তের সকল জানিত বস্তু বিকশিত হয়েছে ।
আল্লাহ্তায়ালা সকল সৃষ্টবস্তুকে তাদের অনুকূল ও প্রতিকূল সকল অবস্থায় সমষ্টিগত বা আংশিকভাবে সংশিষ্ট সময়ের চলমানতায় এক অবিভাজ্য মুহূর্তেই জানেন ।
যেমন- জায়েদ নামক কোনো ব্যক্তির জন্ম, মৃত্যু, অস্তিত্ব, অনস্তিত্ব, তাঁর ভ্রূণজাত অবস্থা, শিশু অবস্থা, যৌবন, বার্ধক্য, জীবনাবসান, তার দণ্ডায়মানতা, উপবেশন, শয়ন, তার আনন্দ, বেদনা, সম্মান, লজ্জা, তারকবরজীবন, হাশর জীবন, বেহেশত অথবা দোজখ জীবন সবকিছুই তাঁর একই মুহূর্তের জ্ঞাতব্য ব্যাপার । সুতরাং আল্লাহ্তায়ালার জন্য একাধিক সম্বন্ধ নেই । একাধিক সম্বন্ধের জন্য বিভিন্ন মুহূর্তের বা সময়ের প্রয়োজন । কিন্তু আল্লাহ্তায়ালার জন্য সৃষ্টির সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত— এক অবিভাজ্য মুহূর্ত ব্যতীত অন্যকিছুই নেই । একাধিকতা এখানে অস্তিত্বহীন । কেননা আল্লাহ্তায়ালার প্রতি কোনো সময় অতিবাহিত হওয়া অসম্ভব। তাঁর জন্য অগ্র-পশ্চাৎ বলে কিছু নেই । সুতরাং তাঁর জ্ঞানের সঙ্গে যদি জানিত বস্তুসমূহের সম্বন্ধ লক্ষ্য করি, তবে সেই সম্বন্ধকেও আমরা সকল জানিত বস্তুর সঙ্গে সম্বন্ধিত দেখতে পাবো । আর ওই সম্বন্ধও হবে তাঁর এলেম গুণের মতো অতুলনীয়, অবিভাজ্য এবং প্রকারবিহীন ।
উদাহরণ
যেমন একটি উদাহরণ- একজন পাঠক একই সঙ্গে বাক্যস্থিত বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়া, স্বরবর্ণ, ব্যাঞ্জনবর্ণ, দেশী শব্দ, বিদেশী শব্দ, অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতে পালনীয় অনুজ্ঞা- ইত্যাকার অনেক অবস্থা একই সঙ্গে জানতে পারে । একই বাক্যের আধারে অক্ষর ও শব্দাবলীর বহু বিচিত্র সম্মিলিত অবস্থা একই মুহূর্তে দেখা যদি সৃষ্টজীবের পক্ষে সম্ভব হয়, তবে অবশ্যম্ভাবী এবং অতুলনীয় আল্লাহ্তায়ালার পক্ষে নিশ্চয় তা সম্ভব ।
এখানে সাদা সরল দৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী বস্তুসমূহের একত্রীকরণ মনে হচ্ছে । কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে বিষয়টি পরস্পরবিরোধী বস্তুও একত্রায়ণ নয় । বরং পরস্পরবিরোধী অবস্থাসমূহকে একই সঙ্গে জানার ব্যাপার । কেননা, আল্লাহতায়ালা যদিও একই মুহূর্তে জায়েদ নামক ব্যক্তিকে অস্তিত্বধারী ও অস্তিত্বহীন জানেন- কিন্তু সেই মুহূর্তে একথাও জানেন যে, জায়েদের আবির্ভাব অমুক সময়ে হাজার বছর আগে বা পরে । তারপর তার পৃথিবীর জীবন শুরু । আবার পঞ্চাশ, আশি বা একশ’ বছর পর তার মৃত্যু । এবার বুঝা গেলো, এখানে জায়েদের জন্ম-মৃত্যুকে একত্রিত করা হয়নি । বরং তার জন্ম-মৃত্যুর সংবাদ একই মুহূর্তে জানা হয়েছে । মনে রাখতে হবে, শুধু জায়েদের বিষয় নয় । সমস্ত সৃষ্টির সকল বিষয়ই আল্লাহ্তায়ালার জ্ঞানে এক, অতুলনীয় এবং অবিভাজ্য মুহূর্তে প্রতিভাত বা প্রতিভাসিত ।
জানা আবশ্যক
জানা আবশ্যক, আল্লাহ্তায়ালার জ্ঞান পরিবর্তনশীল নয়। এতে নতুনত্বও নিবারিত। ভ্রান্ত-দার্শনিকেরা মনে করে, একটির পর একটি বিষয় আল্লাহ্তায়ালার অবগতিতে আসে । কিন্তু এরকম অসম্ভব । ক্রমাগত জ্ঞান লাভ নয়, একই মুহূর্তে সমগ্র সৃষ্টির আদি-অন্তের সকল জ্ঞাতব্য বিষয় যেহেতু আল্লাহ্তায়ালার জানা, তাই পরিবর্তনশীলতা এবং নতুনত্বের ধারণা এখানে অস্তিত্বহীন । একাধিক সম্বন্ধ, নতুনত্ব এবং পরিবর্তনশীলতা সৃষ্টির দিক থেকে হয় । সৃষ্টির জ্ঞান সীমাবদ্ধ । আর আল্লাহ্তায়ালার জ্ঞান অসীম, অতুল, উদাহরণবিহীন ।
‘কালাম’ গুণ
আল্লাহ্তায়ালার আর একটি গুণ ‘কালাম’। কালাম অর্থ কথা বা বাক্য। আল্লাহ্তায়ালা কলীম (বাক্যধারী)। তাঁর কালাম বা বাক্যও অবিভাজ্য। আদি থেকে অন্ত— পর্যন্ত— তিনি ওই একটি বাক্যের বক্তা । আদেশ, নিষেধ, বিজ্ঞপ্তি, জিজ্ঞাসা, জবাব– সমস্ত—কিছুই ওই এক, অতুলনীয় ও অবিভাজ্য বাক্যের প্রকাশ । রসুল আ. গণের প্রতি যে সকল কিতাব ও সহিফা অবতীর্ণ হয়েছে, সেগুলো উক্ত অবিভাজ্য বাক্যের কোনো এক পৃষ্ঠা সদৃশ । তওরাত কিতাবের প্রতিলিপি করা হয়েছে সেখান থেকেই । ইঞ্জিলও সেখান থেকে লাভ করেছে অক্ষরের আকার । যবুরও সেখান থেকে আগত। কোরআন শরীফও।
প্রকৃত কালাম এক, মহান আল্লাহর
অবতীর্ণ হলো ধরে বিভিন্ন আকার।
আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেন, ‘লাইসা কামিছলিহী শাইউঁও ওয়া হুয়াস্ সামিউল বাসীর’। অর্থ– কোনোকিছুই তাঁর অনুরূপ নয় এবং তিনি শ্রবণশীল, দ্রষ্টা। এখানে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সত্তাগতভাবে তিনি (আল্লাহ্) যেমন অতুলনীয়, এক, অবিভাজ্য– গুণাবলীতেও তেমনি। আর নমুনা হিসাবে এখানে দু’টি গুণের (সামা ও বাসার) উল্লেখ করা হয়েছে। এলেম, কালাম, সামা, বাসার– তাঁর এরকম সকল গুণাবলীকেই জানতে হবে আনুরূপ্যহীন, এক এবং অবিভাজ্য।
আল্লাহ্তায়ালার কাজ
আল্লাহ্ তায়ালার কাজসমূহও তেমনি । তাঁর আফআ’ল অর্থাৎ কার্যাবলীও এক । সৃষ্টির আরম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত— সকল সৃষ্ট পদার্থ ওই এক কাজ দ্বারাই সৃজিত হয়েছে। এখনো হয়। আগামীতেও হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ্তায়ালার এরশাদ এরকম—
এবং আমার আদেশ, একই আদেশ ব্যতীত অন্য কিছু নয়, যেমন– চোখের একটি পলক’’ (সূরা ক্বমার ৫০ আয়াত)
জীবিতকরণ অথবা মৃত্যুপ্রদান ওই একঅদ্বিতীয় কাজের উপরেই নির্ভরশীল। কষ্ট প্রদান অথবা অনুগ্রহ প্রদানও তেমনি। সৃজন কিংবা ধ্বংস– এরকম সকল কাঙ্ক্ষিত অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ ওই এক কাজেরই বিভিন্ন বিকাশ। মোট কথা, আল্লাহ্তায়ালার কাজের মধ্যে বিভিন্ন সম্বন্ধ নেই। বরং এক সম্বন্ধের ফলেই অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের সমুদয় সৃষ্টি আপন আপন অস্তিত্ব, স্থিতি অথবা বিলয় লাভ করে চলেছে । আর ওই সম্বন্ধটিও অতুলনীয়, অবিভাজ্য এবং আকার-প্রকারহীন। অপরপক্ষে সৃষ্টি (মাখলুক) আকার প্রকারের বৃত্তে আবদ্ধ এবং সতত পরিবর্তনশীল। সুতরাং আকারসম্ভুত বস্তু আকারাতীত আল্লাহ্তায়ালার দিকে দৃষ্টিবিক্ষেপ করতে অক্ষম। চিন্তাবিক্ষেপ করতেও অপারগ ।
আল্লাহ্তায়ালার সৃষ্টিকরণ গুণকে তাকবীন বলা হয়। এই তাকবীন বা সৃষ্টিকরণ গুণকে ইমাম আবুল হাসান আশআরী র. নতুন বলেছেন এবং আল্লাহ্তায়ালার কার্যকলাপসমূহকে নতুন সৃষ্টি বলে ধারণা করেছেন। এই ধারণা ভুল– একথা বলেছেন হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি শায়েখ আহমদ ফারূকী সেরহিন্দি র.। তিনি বলেন, নতুন যা, তা হচ্ছে আল্লাহ্তায়ালার সিফাতে তাকবীনের (সৃষ্টিকরণ গুণের)ক্রিয়া বা ফল মাত্র। অবিকল তাঁর সৃজনগুণ ‘তাকবীন’ নয় ।
আবার কোনো কোনো সুফী তাজাল্লিয়ে আফআ’ল অর্থাৎ আল্লাহ্তায়ালার কার্যকলাপের আবির্ভাব সম্পর্কে বলেছেন, তাঁরা সকল সৃজিত বস্তুর মধ্যে এক আল্লাহ্তায়ালার কাজ ব্যতীত অন্য কিছু দেখেন না। এঁদের ভুলও ইমাম আশআরীর ভুলের মতো । প্রকৃতপক্ষে তাঁরা যা দেখেন, তা আল্লাহতায়ালার এক, অনাদি, অতুলনীয়, অবিভাজ্য আকার-প্রকারহীন সৃষ্টিকরণ গুণ অর্থাৎ সিফাতে তাকবীনের ক্রিয়া পতিক্রিয়া বা ফলাফল। অবিকল আল্লাহ্তায়ালার কাজের তাজাল্লী নয়। আল্লাহ্তায়ালার কাজ তাঁর পবিত্র অস্তিত্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য । সুতরাং আকার, প্রকার এবং আদিসম্ভুত সৃষ্টির দর্পনে তার সংকুলান এবং অবস্থান সম্ভব নয়। হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি র. বলেন ‘এ ফকিরের নিকটআল্লাহ্তায়ালার কার্যকলাপ ও গুণাবলীর (আফআল ও সিফাতের) তাজাল্লী বা আবির্ভাব তাঁর পবিত্র অস্তিত্বের (জাতের ) তাজাল্লী থেকে বিচ্যুত হওয়া অসম্ভব । জাত থেকে যা বিচ্যুত বা বিচ্ছিন্ন হয়, তা তাঁর গুণাবলী ও কার্যাবলীর প্রতিবিম্ব (জেল)। মূলবস্তু এবং তার প্রতিবিম্ব নিশ্চয়ই এক নয় । কিন্তু সকলের জ্ঞান এই পূর্ণস্তরে পৌঁছতে পারে না’। ‘এটা আল্লাহ্তায়ালার প্রতুল অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছা এটা দান করেন। আল্লাহ্পাক অতি উচ্চ অনুকম্পাপরবশ’। আল কোরআন ।
আল্লাহ্তায়ালা কোনোকিছুর মধ্যে প্রবেশ করেন না। কোনো বস্তুও তাঁর ভিতরে প্রবিষ্ট হতে পারে না । তিনি সকল সৃষ্টিকে ঘিরে আছেন। সৃষ্টির সঙ্গে তাঁর নিকটতা আছে, সংশিষ্টতা আছে। কিন্তু বেষ্টন, নৈকট্য এবং সংশিষ্টতা সম্পর্কে আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞান যা ধারণা অথবা অনুমান করতে পারে, প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। কারণ সীমার ধারণা সীমানাতীত দরবারের উপযোগী হতে পারেই না।আধ্যাত্মিকসাধকেরা আত্মিক দর্শনে (কাশফে) যা অবলোকন করেন, তা থেকে তিনি মুক্ত ও পবিত্র । সৃষ্টি ( মাখলুক) তাঁর অস্তিত্ব, গুণনিচয় এবং কাজের পরিচিতি লাভ করতে গিয়ে অজ্ঞতা, অক্ষমতা এবং অসহনীয় ও বিস্ময়বিমূঢ় পিপাসা ব্যতীত আর কিছুই লাভ করতে পারে না। তাই দৃষ্ট, শ্র“ত এবং জ্ঞাত নয়-এরকম পবিত্র জাতের প্রতি অর্থাৎ অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। কালামুলাহ্ শরীফে তাই বর্ণিত হয়েছে, ‘ইউ’মিনূনা বিল গয়ীব’ (যারা অদৃশ্যের উপরে আস্থা স্থাপন করে)।
সুফী সম্প্রদায়কে এই কথাটা ভালোভাবে স্মরণ রাখতে হবে। কারণ বহুবিচিত্র আত্মিক বিকাশ বা কাশফ তাঁদের আধ্যাত্মিক পথপরিক্রমায় প্রায়শই পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু সে সকল দর্শিত, শ্রুত এবং জ্ঞাত বিষয়কে অনুক্ষণ আবৃত্তিশীল কালেমার ‘লা’ (না) দ্বারা মুছে ফেলতে হবে।
আনকা ফাঁদে পড়বে না, ফাঁদ নাও তুলে
ফাঁদে শুধু শূন্য বাতাস, ভরা আশার ভুলে।
আমাদের হজরত খাজা বাকী বিল্লাহ্ (রঃ) এর একটি রুবায়ী (চতুর্পদী) কবিতাও এরকম অবস্থার সুন্দর দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
সে মহান আল্লাহর পবিত্র আনন
এখনো অনেক দূরে তাহার কানন
পেয়েছি এবার আমি তাঁর সনিড়বধান
অপছন্দ করি আমি এই অনুমান।
অতএব, আমাদের বিশ্বাস এরকম থাকতে হবে যে, আলাহ্ সকল বস্তুকে বেষ্টনকারী, সকলের নিকটবর্তী এবং সকলের সঙ্গে আছেন। কিন্তু এই বেষ্টন, নৈকট্য ও সঙ্গতার প্রকৃত অর্থ আমাদের জানা নেই। এলেম বা জ্ঞান কর্তৃক বেষ্টন, নৈকট্য এবং সঙ্গতা-এরকম বলাও সমীচীন নয়। কারণ এরকম অর্থ করা মোতাশাবেহ্ বা অবোধ্য আয়াতের অর্থ করার মতো ।
সৃষ্টির সঙ্গে সর্ম্পকঃ দুই
আল্লাহ্তায়ালা সৃষ্টির সঙ্গে একীভূত হন না । সৃষ্টিও তাঁর সঙ্গে একীভূত অথবা সমীভূত নয় । কোনো কোনো সুফীর কথায় বোঝা যায়, একীভূতি অথবা সমীভূতি সম্ভব । কিন্তু প্রকৃত অর্থ অন্যরকম । যেমন, ‘ফকর’ বা মুখাপেক্ষীতার যখন শেষ হয় তখন তা-ই আল্লাহ্-এ বাক্যের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, ফকর অথবা মুখাপেক্ষীতার শেষে যখন কেবল নাস্তি বা শূন্যতা লাভ হয়, তখন আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যকিছু অবশিষ্ট থাকে না । অথচ মূর্খ ব্যক্তিদের ধারণা, ফকির বা মুখাপেক্ষী ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে একাকার হয়ে যায় এবং আল্লাহ্ হয়ে যায় । এরকম বিশ্বাস কুফরী এবং বেদ্বীনি । আল্লাহ্তায়ালা জালেমদের এরকম অসৎ বিশ্বাস থেকে মুক্ত ও পবিত্র। হজরত খাজা বাকী বিল্লাহ্(রঃ) বলেছেন ‘আনাল হক’ বাক্যের অর্থ এরকম নয় যে ‘আমিই হক’ বা ‘আমিই আল্লাহ্’ বরং এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে-আমিতো আমারঅস্তিত্বের আধার হারিয়ে ফেলেছি আল্লাহ্তায়ালার অস্তিত্বের আলোকচ্ছটায় । এখন অবস্থা এই যে-আমি নেই। আল্লাহ্ই আছেন । এই ‘আমি’ উচ্চারণ আমার অস্তিত্ব থেকে নয়। আল্লাহ্তায়ালার দিক থেকে । আমার অবস্থা এখন মুসা আ. এর সেই বৃক্ষের মতো, যে বৃক্ষেরথেকে উচ্চারিত হয়েছিলো,
‘ইন্নানি আনাল্লাহ্…..’ (নিশ্চয় আমিই আল্লাহ্…..)
বৃক্ষএখানে ঘোষক মাত্র । অথবা মাধ্যম, যেমন মাইকের হর্ণ বক্তার কথা প্রকাশের মাধ্যম হয়।
আল্লাহ্তায়ালার অপরিবর্তনশীলতা
আল্লাহ্তায়ালার অস্তিত্বে, গুণে এবং কাজে কোনোরকম পরিবর্তন ঘটে না । অথচ সৃষ্টি নিত্য পরিবর্তনশীল, লয়, ক্ষয় ও বিবর্তনের অধীন । পবিত্র ওই জাত যাঁর জাত, সিফাত ও আফআল সৃষ্টির মতো পরিবর্তনশীলতা এবং নতুনত্বের কলংক থেকে মুক্ত ও পবিত্র । অজুদিয়া মতাবলম্বী সুফীগণ ‘তানায্যুলাতে খামছা’ নামের যে পঞ্চস্তরের বিবরণ দিয়েছেন, তা ওয়াজিবুল অজুদ বা অবশ্যম্ভাবী মর্যাদার মধ্যে অর্থাৎ আল্লাহ্তায়ালার জাত, সিফাত ও আফআলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এরকম ধারণা অবিশ্বস্ত এবং ভ্রান্ত । উক্ত পঞ্চস্তরের অনুমান আসলে জাত, সিফাত ও আফআ’লের তাজাল্লী বা আবির্ভাবের জেল অর্থাৎ ছায়া-প্রতিচ্ছায়ার প্রতি আরোপযোগ্য । আর একথা অকাট্য ও সন্দেহাতীত যে, প্রতিচ্ছায়াগত পরিবর্তন মূল বিষয়ের উপরে কোনোই প্রভাব রাখে না ।[1]
তথ্যসূত্র
ইসলামী বিশ্বাস (লেখকঃ মুহাম্মাদ মামুনুর রশীদ)
আল্লাহ্তায়ালার অমুখাপক্ষিতা
আল্লাহ্তায়ালা গনী। অর্থাৎ শর্তহীন অভাবশূন্য। অস্তিত্বে, গুণে, কাজে সকল কিছুতেই তিনি গনী। কোনো বিষয়েই তিনি অন্য কারো মুখাপেক্ষী নন। তাঁর অস্তিত্বে যেমন তিনি অমুখাপেক্ষী, তেমনি আবির্ভাব ও প্রকাশের বিষয়েও তিনি অমুখাপেক্ষী। যে সকল সুফী বলেন, আল্লাহ্তায়ালা তাঁর নাম ও গুণাবলীর (ইসিম ও সিফাতের) পূর্ণতা প্রকাশের ক্ষেত্রে সৃষ্টির মুখাপেক্ষী, তাঁরা ভুল বলেন। এরকম বাক্য উচ্চারণ করা মহা অন্যায়। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, নিজেদের পূর্ণতা অর্জনের জন্যই সৃষ্টিকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ্তায়ালা যিনি সত্তাগতভাবে স্বয়ংপূর্ণ, তাঁর পূর্ণতা লাভের তো প্রশ্নই আসতে পারে না। আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন-
আমি জ্বিন ও মানুষকে ইবাদত করা (আমার পরিচয় বা মারেফাত লাভ করা) ভিন্ন অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি’।
— সূরা জারিয়াহ্ , ৫৬ আয়াত।
এখানে এ বিষয়টি পরিষ্কার যে, জ্বিন ও মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য এই- যেনো তারা আল্লাহ্তায়ালার মারেফাত লাভের অভিলাষী হয় এবং পূর্ণতা অর্জনে ধন্য হয়। হাদিসে কুদসীর ভাষ্য
আমি গুপ্ত ধনভাণ্ডার। পরিচিত হওয়ার জন্যই আমি সৃষ্টিকে অস্তিত্বদান করেছি।
কথাটির অর্থ এই যে, সৃষ্টি যেনো পরিচয়প্রাপ্ত হয়ে তাদেও জন্য নির্ধারিত পূর্ণতা অর্জনে ধন্য হয়। এরকম মনে করা অন্যায় যে- আমি আল্লাহ্ সৃষ্টির নিকট পরিচিত হই এবং এই পরিচিতির কারণে আমার কিছু পূর্ণতা সাধিত হয়। আল্লাহ্তায়ালা গনী। অমুখাপেক্ষী। সুতরাং বর্ণিত অসৎ ধারণা থেকে তিনি অতি উচ্চ, পবিত্র ও মহান।[1]
তথ্যসূত্র
ইসলামী বিশ্বাস (লেখকঃ মুহাম্মাদ মামুনুর রশীদ)
আল্লাহ্তায়ালার র্পূণতা
আল্লাহ্তায়ালা সকল রকম ক্ষতি, বিনষ্টি ও নতুনত্বের কালিমা থেকে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি শরীরধারী নন। স্থান এবং কালসম্ভূতও নন। সকল পূর্ণতা তাঁর মধ্যেই বিদ্যমান। বরং বলা যায় পূর্ণতা তিনিই। সৃষ্টি তার নিজস্ব ধরনের পূর্ণতা তাঁর অনুগ্রহেই পায়। তাঁর আটটি পূর্ণগুণ এমন যে, ওই গুণগুলি তাঁর মধ্যে অতিরিক্ত অস্তিত্ব অনুযায়ী অস্তিত্বশীল। ওই গুণাবলী হচ্ছে
১. হায়াত (জীবন)
২. এলেম (জ্ঞান)
৩. কুদরত (ক্ষমতা)
৪. এরাদা (ইচ্ছা)
৫. সামা (শ্রবণ)
৬. বাসার(দর্শন)
৭. কালাম (বাক্য)
৮. তাকবীন (সৃজন)।
এই গুণসমূহ বাস্তব। কাল্পনিক বা ধারণাসম্ভূত নয়। এই গুণ অষ্টক প্রকৃত অর্থেই আল্লাহ্তায়ালার জাতের সঙ্গে অতিরিক্ত অস্তিত্ব হিসাবে বর্তমান। এ ব্যাপারে মোতাজিলা দার্শনিকেরা এবং অজুদিয়া সুফীরা মনে করেন, ঐ গুণ অষ্টকের অস্তিত্ব রয়েছে শুধু জ্ঞানে এবং ধারণায়। বাস্তবে জাতের সঙ্গে এক বা একাকার। কিন্তু উপরোক্ত গুণ অষ্টকের বাস্তব অস্তিত্বের স্বীকার না করা পর্যন্ত বিশ্বাসী হওয়ার উপায় নেই। বরং এরকম যারা করবে, তারা আল্লাহ্তায়ালার সিফাতের প্রতি অবিশ্বাসী বলে বিবেচিত হবে।[1]
আল্লাহ্তায়ালার আদি-অন্তহীনতা
আল্লাহ্তায়ালা আদি-অন্তশূন্য। নিরারম্ভ এবং নিঃসমাপ্ত। তিনি ছাড়া অনাদি, অনন্ত বলে আর কিছু নেই। আল্লাহ্তায়ালা ছাড়া অন্য কোনোকিছুকে যদি কেউ অনাদি অনন্ত বলে, তবে সে কাফের। এই কারণেই ইমাম গাজ্জালী র. ইবনে সিনা, ফারাবী এবং তাঁদের মতো অন্যান্য দার্শনিকদেরকে কাফের বলেছেন। কেননা তাঁরা ‘দশ আকল’ অর্থাৎ জ্ঞান নীতি এবং নফস বা প্রাণকে অনাদি বলেছেন এবং হাইউল বাপ্রত্যেক বস্তুর মূল আকার-আকৃতিকে (সুরত) অনাদি বলে ধারণা করেছেন। আবার আকাশ এবং তাতে যা কিছু আছে, তার সবকিছুকেও অনাদি বলেছেন। হজরত খাজা বাকী বিল্লাহ্ বলেছেন ‘শায়েখ মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবীর অভিমত এরকম যে, কামেল ব্যক্তিগণের রূহ অনাদি- এরকম বাক্যের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণীয় নয়। বরং এর ভাবার্থ গ্রহণ করাই সমীচীন, যাতে সকল সুষ্ঠু মতামতের মধ্যে ঐক্যের সূত্র অটুট থাকে’।
আল্লাহ্তায়ালার সর্বশক্তিমানতা
আল্লাহ্তায়ালা সর্বশক্তিমান এবং ইচ্ছাময়। ঔচিত্য ও বাধ্যতা তাঁর প্রতি আরোপিত হয় না। হতে পারে না। অজ্ঞ দার্শনিকেরা অবশ্য বলেন অন্যকথা। তাঁদের মতে সক্ষম ব্যক্তি যেমন কাজ করতে বাধ্য, আল্লাহ্তায়ালাও তেমনি। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। আল্লাহ্পাক সর্বশক্তিমান, সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু তিনি শক্তি প্রদর্শন করতে এবং সৃষ্টি করতে বাধ্য নন। আল্লাহ্পাকের এরশাদ এরকম- ‘ফাআ’লুললিমা ইউরিদ’ (নিশ্চয় তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করেন)। ওই দার্শনিকেরা যতই খ্যাতিমান হোন না কেনো, আদতে তারা মূর্খই। তারা তো মনে করেছে, বাধ্যতামূলকভাবে সৃষ্টিজগতকে সৃজনের পর অবশ্যম্ভাবী জাতপাকের আর কাজ নেই। আর প্রাত্যহিক কাজ ও ঘটনা সৃষ্টি করে ‘আকলে ফায়াল’ (কার্যকরী জ্ঞান যা প্রথম স্তরে অবস্থিত)। এই আকলে ফায়ালের অস্তিত্ব রয়েছে কেবল তাদের কষ্টকল্পনায়। বাস্তবে নয়। তাদের বিকৃত ধারণা অনুযায়ী যেনো আল্লাহ্তায়ালার সঙ্গে তাদের কোনো সম্বন্ধই নেই। তাই তারা বিপদ ও কষ্টের সময় বাধ্য হয়ে আকলে ফায়ালের আশ্রয়প্রার্থী হয়। আল্লাহ্পাকের প্রতি মোটেই লক্ষ্য করে না। কারণ, তাদের অসৎ বিশ্বাসে প্রাত্যহিক কার্যকলাপে আল্লাহ্তায়ালা অধিকারহীন। প্রকৃতপক্ষে তারা আকলে ফায়ালের প্রতিও মনোযোগী নয়। কারণ বিপদ দূর করতে আকলে ফায়ালেরও নাকি কোনো অধিকার নেই। এরকমই ধারণা তাদের। এরা মূর্খতা ও বোকামিতে সকল পথভ্রষ্ট দলের নেতৃস্থানীয়। যারা কাফের, তারাও বিপদে আপদে আল্লাহ্তায়ালার নিকট সাহায্যপ্রার্থী হয় এবং তাঁর নিকটই বিপদমুক্তি কামনা করে। যতরকম পথভ্রষ্ট দল আছে, তাদের মধ্যে এ সকল বোকা দার্শনিকদের ভিতর দু’টি অতিরিক্ত ভ্রষ্টতা আছে। ১. তারা আল্লাহ্তায়ালার অবতারিত হুকুম এবং সংবাদ (ওহী) অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, ওহীর সঙ্গে শত্রুতা ও হিংসা রাখে। ২. তাদের অর্থহীন উদ্দেশ্যের সমর্থনে কতকগুলি ব্যর্থ মুখবন্ধ উপস্থাপনের প্রয়াস পায়। মিথ্যার পক্ষে যুক্তি প্রমাণ দিতে গিয়ে তারা হয়েছে প্রায় পাগল এবং বিকৃতমস্তিষ্ক। তারা মনে করে, আকাশ এবং নক্ষত্রমন্ডলী সকল কাজের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। আকাশ এবং নক্ষত্র-নীহারিকার স্রষ্টা, ব্যবস্থাপক, পরিচালক ও বিধানদাতা যিনি, সেই পবিত্র এক আলাহ্র প্রতি তাদের কোনো খেয়ালই নেই। এরা সত্যিই বিস্ময়কর হতভাগ্যের দল। এদের চেয়েও অজ্ঞ ওই ব্যক্তিরা, যারা এদেরকে জ্ঞানী মনে করে। এ সকল দার্শনিকদের চর্চিত বিদ্যার মধ্যে একটি হলো জ্যামিতি। মানুষের বিশাল বিকৃত জীবনপরিসরে (আলমে আরওয়াহ্ থেকে আখেরাত) এই বিষয়টির তেমন কোনো গুরুত্বই নেই। ত্রিভুজের তিনটি কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের সমান- এরকম জ্ঞান কোন কাজে লাগে? তাদের মর্মস্পর্শী প্রতিজ্ঞা হচ্ছে শাকলে আরছি (৪৭ প্রতিজ্ঞা) এবং শাকলে মামুনী (৫ম প্রতিজ্ঞা)। এসকল প্রতিজ্ঞা করেইবা কোন্ উদ্দেশ্য সাধিত হয়? তাদের বিদ্যার মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিদ্যাবলী হচ্ছে এলমে তিব বা শরীরতত্ত্ব শাস্ত্র, এলমে নজুম বা নক্ষত্রবিদ্যা এবং চরিত্র সংশোধনবিদ্যা। এ সমস্ত এলেম পূর্ববর্তী রসুলগণের কিতাব থেকে তারা অপহরণ করে নিজেদেও নামে চালিয়ে দিয়েছে। এই বিষয়টি ইমাম গাজ্জালী র. তাঁর ‘আল মুনকিজ আনিদ্ব্দ্বালাল’ গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। দ্বীনদার ব্যক্তিরা নবী-রসুলগণের পথপ্রদর্শনের উপরেই প্রতিষ্ঠিত থাকেন। তাঁরা দলিল-প্রমাণে ভুল করলেও ক্ষতি নেই। কারণ তাঁদের নির্ভরতা পয়গম্বরগণের অনুসরণের উপর। দলিল প্রমাণ তাঁরা উপস্থাপন করেন প্রযোজনবশত বিরুদ্ধবাদীদের ধারণা পরিস্কৃতির জন্য, অথবা আত্মকৌতুহল নিবারণের জন্য। কিন্তু মূর্খ দার্শনিকেরা এর বিপরীত। তারা পয়গম্বর আ.গণের অনুসরণ অস্বীকার করে না। তাদের পূর্ণ নির্ভরশীলতা যুক্তি-প্রমাণের উপরেই- যা খত, সীমাবদ্ধ, সন্দিগ্ধ, অসম্পূর্ণ এবং সিদ্ধান্ত—বিবর্জিত। এরা নিজেরা তো ভ্রষ্টই। একই সাথে অপরকেও ভ্রষ্টতার প্রতি আহবানকারী। এদের কোনো একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের নিকট হজরত ঈসা আ. এর নবুয়তের দাওয়াত উপস্থাপন করা হলে সে বলেছিলো ‘আমরা পথপ্রাপ্ত দল।পথপ্রদর্শনকারীর প্রয়োজন আমাদের নেই’। কতো বড়ো মূর্খতা! কতো বড়ো দুর্ভাগ্য! যিনি মৃতকে জিন্দা করেন, জন্মান্ধ এবং কুষ্ঠরোগীকে নিরাময় দান করেন, তাঁর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করাই ছিলো জ্ঞানীর কাজ। কারণ, ওই সকল মোজেজা তো অপ্রকৃত জ্ঞানকে মুহূর্তেই নিভিয়ে দিয়ে মূল জ্ঞানশিখার সংস্পর্শ এনে দেয়। না দেখে, না বুঝে, না চিন্তা করে নবুয়তের আহবানের অস্বীকৃতি পূর্ণ হিংসা এবং নিখাদ মূর্খতা। তাদের বিদ্যাবত্তার মূল শিরোনাম ‘ফাল্সাফাহ্’ (দর্শনশাস্ত্র)। ফাল্সাফার অধিকাংশ অক্ষর সাফাহ্ বা মূর্খতা। আলাহ্পাক এদেও অপবিত্র বিশ্বাসের অন্ধকার থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন। আমিন।
শায়েখ মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবীর বর্ণনাসমূহের মধ্যেও ঔচিত্য এবং বাধ্যবাধকতার ইঙ্গিত আছে। তিনি আল্লাহ্তায়ালার ‘কুদরত’ বা ক্ষমতাগুণের অর্থ ও প্রয়োগের ব্যাপারে দার্শনিকদের মতের অনুকুল ধারণা রাখেন। দার্শনিকদেও মতো তাঁরও মত এই যে, সক্ষম ব্যক্তির জন্য কাজ না করা বৈধ নয়। বরং কাজ করা তার জন্য অত্যাবশ্যক (আর আল্লাহ্ যেহেতু ক্ষমতাবান তাই কাজ করতে বা সৃষ্টি করতে তিনি বাধ্য)- এরকম মত সত্যের প্রতিকূল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এরকম ভ্রান্ত মতামত ব্যক্ত করা সত্ত্বেও শায়েখ মহিউদ্দিন আল্লাহ্তায়ালার নিকট গ্রহণীয় ব্যক্তিগণের অন্তর্ভূত পরিলক্ষিত হচ্ছেন। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ মতামত সত্যবাদী আলেমগণের বিরুদ্ধে। ইজতেহাদ বা মাসআলা উদ্ধারে ভুল হলেও যেমন মুজতাহিদ ব্যক্তি নিন্দিত বা তিরস্কৃত হন না, শায়েখ মুহিউদ্দিনের বিষয়টিও সেরকমই। তাঁর ভুল প্রকৃতপক্ষে কাশফের ভুল, যা ইজতেহাদী ভুলের মতো। হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি র. বলেন ‘শায়েখ মুহিউদ্দিনের প্রতি আমার খাস আকিদা এই যে, তিনি আল্লাহ্তায়ালার দরবারে মকবুল। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ কাশফ ভুল এবং সাধারণের জন্য ক্ষতিকর। সুফীগণের কোনো কোনো দল শায়েখকে নিন্দা-অপবাদ দেয় এবং তাঁর এলেমসমূহকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা করে। আবার কোনো কোনো দল শায়েখের আনুগত্য করে এবং তাঁর সমস্ত এলেমকে শুদ্ধ ও সত্য বলে বিশ্বাস রাখে এবং বিভিনড়ব দলিল-প্রমাণ দ্বারা শায়েখেরমতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করে। এই উভয় দল সরল সত্য মধ্যবর্তী পথথেকে সরে গিয়েছে। শায়েখ আল্লাহ্তায়ালার মকবুল ব্যক্তি। সুতরাং কীভাবে তাঁকে অস্বীকার করা যেতে পারে? আবার তাঁর এলেমসমূহের অধিকাংশই সত্যবাদী আলেমগণের মতের বিপরীত। সুতরাং কীভাবে সে সম্পর্কে শুদ্ধ বলে স্বীকার করা সম্ভব? অতএব বর্ণিত অভিমতদ্বয়ের মধ্যাবস্থাই সত্য। আল্লাহ্তায়ালা তাঁর অপার অনুগ্রহে একথা আমাকে অবগত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। অবশ্য ‘ওয়াহ্দাতুল অজুদ’ (তওহিদের একটি অপরিণত ও বিখ্যাত ধারণা) এর মাসআলার মধ্যে সূফীগণের এক বিরাট দল একমত। এই মাসআলাটি বাহ্যত সত্যবাদী আলেমগণের বিপরীত মনে হলেও চিন্তা ও গবেষণাসাপেক্ষে, সমন্বয় অথবাসমাধানযোগ্য। এ অধম ফকির (হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি) আমাদের হজরত খাজা বাকী বিল্লাহ্ র. এর রুবাইয়াতের ব্যাখ্যায় এই মাসআলাটিকে সত্যবাদী আলেমগণের মতের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। বিষয়টির জটিলতা শব্দ বিভ্রাটের উপর স্থাপন করে উভয় দলের দ্বিধা-সন্দেহ এমনভাবে উৎপাটিত করেছেন যে, প্রতর্কপ্রশ্রয়তার অবকাশ আর নেই’।
আল্লাহ্তায়ালার সৃজনশীলতা
সৃষ্ট পদার্থ যে রকমই হোকনা কেনো- আশ্রয়নিরপেক্ষ অথবা আশ্রয়সাপেক্ষ, শরীর অথবা প্রাণ, আকাশ অথবা ভূতচতুষ্টয় (আগুন, পানি, মাটি, বাতাস)- সকল কিছুই সর্বশক্তিমান এবং ইচ্ছাময় আল্লাহ্তায়ালার সৃজনেচ্ছার প্রতি সম্পূর্ণতই নির্ভরশীল। তিনিই সমগ্র সৃষ্টিকে অনস্তিত্বের অন্তরাল থেকে অস্তিত্বের দৃষ্টিগোচরতায় এনেছেন। অস্তিত্বপ্রাপ্তি এবং স্থায়িত্ব লাভ, সকল ব্যাপারেই সৃষ্টি তাঁর মুখাপেক্ষী। সকল সামগ্রী-সরঞ্জাম (যেমন মাতাপিতার মধ্যস্থতায় সন্তান লাভ, ঔষধের মধ্যস্থতায় রোগ নিরাময়, পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্থোপার্জন) তাঁর কাজের পর্দা এবং সকল বুদ্ধিকৌশল তাঁর কুদরতের আবরণ। তাও নয়। বরং উপকরণ-সামগ্রীকে তিনি তাঁর কাজের প্রমাণ এবং জ্ঞানবুদ্ধিকে তাঁর অসীম ক্ষমতার নিদর্শন করেছেন। সৃষ্টির অস্তিত্ব ও স্থিতি সম্পূর্ণতই তাঁর মুখাপেক্ষী। তাঁর ইচ্ছা এবং অনুগ্রহেই জগতের সকল নিয়মশৃঙ্খলা, আবর্তন-বিবর্তন-অনুবর্তন-পরিবর্তন অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। নতুবা জড় এবং অচেতন বস্তুপুঞ্জের সঞ্চালন, স্পন্দন আদৌ সম্ভব ছিলো না। জ্ঞানী ব্যক্তিগণ সহজেই বোঝেন যে, সৃষ্টির এই ভাঙাগড়া লীলারহস্যেওপরিচালক, ব্যবস্থাপক এবং স্রষ্টা নিশ্চয়ই কেউ আছেন। আর যারা নির্বোধ, তারা সৃষ্টিকে স্বয়ং ক্ষমতাসম্পন্ন এবং আপনাআপনি সৃষ্ট মনে করে। এভাবেই তারা প্রকৃত স্রষ্টাকে অস্বীকার করে এবং নাস্তিকতার ভ্রান্তিকে সত্য বলে মনে করতে থাকে।
আল্লাহ্তায়ালার এরশাদ-
‘ইউদ্বিল্লুবিহী কাছীরাঁও ওয়া ইয়াহ্দী বিহী কাছীরা’
- ‘ইহা দ্বারা অনেকেপথচ্যুত হয়, আবার অনেকে হয় পথপ্রাপ্ত’।
— সুরা বাকারা, ২৬ আয়াত
হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি শায়েখ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দি র. বলেন ‘আমার এই মারেফাত নবুয়তের তাক থেকে গৃহীত। সবাই এই তত্ত্বটি বুঝতে সক্ষম নয়। একদল সুফী মনে করেন, সরঞ্জাম বা মধ্যস্থতা উঠে যাওয়াই কামালাত বা পূর্ণতা। তারা সকলকিছুকে বিনা মাধ্যমে আল্লাহ্তায়ালার প্রতি সম্পর্কিত করেন। তারা জানেন না যে, সরঞ্জাম-মধ্যস্থতা উঠে যাওয়া মানে আল্লাহ্তায়ালার হেকমত বাকৌশল উঠে যাওয়া। অথচ হেকমতের ভিতরে বহু উপকার এবং কল্যাণ রয়েছে। আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেন-
‘রব্বানা মা খলাক্তা হাজা বাতিলা’- হে আমাদের প্রতিপালক। এটা তুমি অনর্থক সৃষ্টি করোনি।
— আলে ইমরান, ১৯১ আয়াত।
নবী ও রসুলগণ সরঞ্জাম-মধ্যস্থতার প্রতি দৃষ্টি রেখে চলতেন এবং সকল কাজের ফলাফল আল্লাহ্তায়ালার প্রতি ন্যস্ত করতেন। মানুষের কুদৃষ্টির আশংকায় হজরত ইয়াকুব আ. তাঁর পুত্রদেরকে বলেছিলেন ‘বৎসগণ, তোমরা এক দরোজা দিয়ে (বাদশাহর দরবারে) প্রবেশ কোরো না। ভিন্ন ভিন্ন দরোজা দিয়ে প্রবেশ কোরো’। সূরা ইউসুফ, ৬৭ আয়াত।
এরকম উপদেশ দেওয়ার পর তিনি আল্লাহ্তায়ালার প্রতি নির্ভরতা প্রকাশ করেছিলেন এভাবে-
আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্তায়ালার পক্ষের কোনোকিছু থেকে রক্ষা করতে পারবো না। আদেশ আল্লাহ্তায়ালার অধিকারভূত। আমি তাঁর উপরেই নির্ভর করলাম এবং তাঁর উপরে নির্ভর করাই নির্ভরকারীগণের কর্তব্যকর্ম’।
আল্লাহ্তায়ালা নবী ইয়াকুব আ. এর এই মারেফাত এবং জ্ঞানকে পছন্দ কওে বলেছেন ‘নিশ্চয়ই তিনি জ্ঞানবান, যেহেতু আমি তাঁকে জ্ঞান দান করেছি। কিন্তু অধিকাংশ লোক একথা জানে না’। সূরা ইউসুফ, ৬৮ আয়াত। আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদুর রসুলুল্লহ্ স.কেও আল্লাহ্তায়ালা সরঞ্জামমধ্যস্থতার পাঠ দিয়েছেন এভাবে-
হে নবী! আপনার জন্য আল্লাহ্তায়ালাই যথেষ্ট। তৎসহ আপনার আনুগত্যকারী মুমিনগণ’।
— সূরা আনফাল, ৬৪ আয়াত
বস্তুসমূহ বা উপকরণ-সরঞ্জামাদির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার (তাছির) ব্যাপারটা আবার অন্যরকম। আল্লাহ্তায়ালা যদি সরঞ্জাম-সামগ্রীতে তাছির সৃষ্টি করেন তবে উদ্দেশ্য সফল হয়। আর যদি না করেন তবে হয় না। সাধারণভাবে তাছির অস্বীকার করা গোয়ার্তুমির নামান্তর। তাছির স্বীকার করতে হবে। কিন্তু তাকেও বস্তুসামগ্রীর মতো আল্লাহ্তায়ালার সৃষ্টবস্তু বলে জানতে হবে। এই ফকিরের অভিমত এরকমই। আল্লাহ্পাক প্রকৃত বিষয়ের জ্ঞানদাতা’। উপরের আলোচনায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, সামান-সরঞ্জামের মধ্যস্থতা গ্রহণ আল্লাহ্পাকের উপর তাওয়াক্কোলবিরোধী নয়। বরং এরকম আচরণ পূর্ণনির্ভরতার পরিচায়ক। যেমন, রোগে ঔষধের মধ্যস্থতা, যুদ্ধে অস্ত্রসম্ভারের, ক্ষুধায় খাদ্যের। অর্থোপার্জনে চাকুরী বা ব্যবসার মধ্যস্থতা গ্রহণও তাওয়াক্কোলের অনুকূলেই থাকে। প্রতিকূলে নয়। হজরত ইয়াকুব আ. মধ্যস্থতা অবলম্বন করেই তাঁর তাওয়াক্কোলকেপ্রকাশ করেছিলেন এভাবে- ‘তাঁরই প্রতি আমার নির্ভর এবং তাঁরই প্রতি নির্ভর করা নির্ভরকারীদের কর্তব্যকর্ম’। সূরা ইউসুফ, ৬৭ আয়াত।
আল্লাহ্তায়ালা সকল কাজের স্রষ্টা
আল্লাহ্তায়ালা ভালো মন্দ- সকল কাজের স্রষ্টা। কিন্তু তাঁর সন্তুষ্টি ভালো কাজের সঙ্গে এবং অসন্তুষ্টি খারাপ কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। ‘ইচ্ছা’ এবং ‘সন্তুষ্টি’র মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান। স্খলনমুক্ত দল আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত কেবল এই পার্থক্যের প্রতি জ্ঞান রাখে। অন্যান্য দল এই পার্থক্যের জ্ঞান না পাওয়ায় ভ্রষ্টতায় নিপতিত। যেমন মোতাজিলা সম্প্রদায়ের বিশ্বাস- প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ কাজের স্রষ্টা। আর কুকাজ এবং গোনাহর সৃষ্টিকর্তা মানুষই। শায়েখ মুহিউদ্দিন এবং তাঁর অনুগামীগণের বক্তব্য থেকেও বোঝা যায় যে, ইমান এবং সৎকর্ম যেমন আল্লাহ্তায়ালার ‘আল হাদী’ নামের পছন্দনীয় এবং কাম্য, তেমনি কুফর এবং গুনাহ্ও তাঁর ‘আল মুদিলু’ বা ‘ভ্রষ্টকারী’ নামের মনঃপুত এবং অভীপ্সিত। তাঁর এই বাক্যও সত্যবাদী আলেমগণের বিরুদ্ধে এবং আল্লাহ্তায়ালার প্রতি বাধ্যতা আরোপকারী। সূর্য যেমন কিরণ দিতে বাধ্য তার ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির এখানে কোনো মূল্যই নেই। কিন্তু সূর্যের সৃষ্টিকর্তা তো সেরকম নন। বাধ্যতায় নয়, বরং স্ব-ইচ্ছায় ও অনুগ্রহে সকল কাজ তিনিই সৃষ্টি করেন। তাঁর সন্তোষ উত্তম কাজের সঙ্গে। আর অসন্তোষ অনুত্তম কাজের সঙ্গে। একথা অবশ্যস্মরণীয়। বান্দাদেরকে ইচ্ছা করবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যাতে তাদের অর্জন তাদেও নিজেদের ইচ্ছার কারণে হয়। অতএব, ব্যাপারটা দাঁড়ালো এরকম যে ‘সৃজন’ আল্লাহ্তায়ালার দিক থেকে আর ‘অর্জন’ বান্দাদের সঙ্গে সংশিষ্ট। আল্লাহ্তায়ালার ফিতরত বা আত্মভাব এরকম যে, বান্দারা কাজের ইচ্ছা করলে আল্লাহ্তায়ালার সৃজনশৈলী তার সঙ্গে সংশিষ্ট হয় এবং ঘটনা বা কাজে রূপ নেয়। বান্দার ইচ্ছাই যেহেতু কাজ সৃষ্টির সূচনা বা কারণ, তাই প্রশংসা অথবা তিরস্কার (সওয়াব অথবা গোনাহ্) তার প্রতিই বর্তায়। অনেকে বলেন, বান্দার ‘এখতিয়ার’ বা ইচ্ছাশক্তি দুর্বল। আল্লাহ্তায়ালার এখতিয়ার বা ইচ্ছাশক্তির তুলনায় দুর্বল একথা অবশ্য ঠিক, কিন্তু ‘নির্দেশিত কাজ সম্পাদনে তার ইচ্ছাশক্তি যথেষ্ট নয়’ একথা ঠিক নয়। কারণ আল্লাহ্তায়ালা আয়ত্তাতীত বিষয়ের দায়িত্ব প্রদান করেন না। এরশাদ হয়েছে-
বরং তিনি বান্দার প্রতি সহজ করতে চান। কঠিন করতে চান না’।
— সূরা বাকারা, ১৮৫ আয়াত
পৃথিবীর সাময়িক কাজের বদলে চিরস্থায়ী বিনিময় প্রদান- আল্লাহ্তায়ালারই অনুগ্রহসিক্ত পরিমান নির্ধারণ। নির্ধারিত হয়েছে যে, সাময়িক কুফরের প্রতিফল চিরস্থায়ী আজাব এবং সাময়িক ইমানের বিনিময় চিরস্থায়ী বেহেশত। আল্লাহ্তায়ালার এরশাদ এরকম-
এটা মহাপরাক্রমশালী ও সুকৌশলী আল্লাহ্তায়ালার পরিমাণ নির্ধারণ’।
— সূরা ইয়াসিন, ৩৮ আয়াত
হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি র. বলেন, আল্লাহ্তায়ালার দয়ায় আমরাও বুঝতে পারি যে, যিনি সকল প্রকার বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ নেয়ামত দান করেছেন, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা- সকল পূর্ণতা, পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর অস্তিত্বেই বিদ্যমান। এরকম পবিত্রতম সত্তার প্রতি অস্বীকৃতির প্রতিফল কঠিনতম হওয়াই যুক্তিযুক্ত। তাই অস্বীকৃতির শাস্তি চিরকাল দোজখবাস। অপরপক্ষে শয়তান এবং প্রবৃত্তির প্রাধান্য সত্ত্বেও পবিত্রতম, মহোত্তম ও অদৃশ্য আল্লাহ্তায়ালার প্রতি ইমান আনা এবং তাঁর প্রত্যাদেশকে সত্য জানার প্রতিদান সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়াই শোভনীয়। অনন্ত— বেহেশতবাস তাই তার পারিতোষিক নির্ধারণ করা হয়েছে। কোনো কোনো মাশায়েখ বলেছেন, বেহেশতলাভ আল্লাহ্তায়ালার অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু একে ইমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কারণ এই যে, কর্মের প্রতিফল হিসাবে পারিতোষিক প্রাপ্তিরধারণা অধিক আনন্দময়। এ ফকিরের ধারণা, বেহেশতলাভ প্রকৃতপক্ষে ইমানের প্রতিই নির্ভরশীল। আর ইমান আল্লাহ্তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ। নিছক দয়া। পক্ষান্তরে দোজখভুক্তি কুফরের প্রতি ন্যস্ত এবং কুফর নফসে আম্মারা, অর্থাৎ অসৎ প্রবৃত্তিজাত অপবিত্রতা। আল্লাহ্পাক এরশাদ করেন-
উৎকৃষ্ট যা কিছু তুমি পাও তা আল্লাহর দিক থেকে। আর নিকৃষ্ট যা কিছু লাভ করো তা তোমারই প্রবৃত্তিজাত।
— সূরা নিসা, ৭৯ আয়াত
বেহেশতপ্রাপ্তি ইমানের কারণে জানা, প্রকৃতপক্ষে ইমানকে সম্মান করা, বরং যাঁর প্রতি ইমান আনা হয়েছে, তাঁরই সম্মান করা। এজন্যই চরমতম এবং উচ্চতম পারিতোষিক ইমানদার বান্দাকে দেওয়া হয়েছে। আবার দোজখভুক্তিকে কুফরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা কুফরকে অপমান করা এবং একই সঙ্গে পবিত্রতম ও অতুলনীয় ওই সত্তার সম্মান করা, যাঁর প্রতি অবিশ্বাস করা হয়েছে। তাই চরমতম এবং নিকৃষ্টতম বিনিময় তার প্রতিদান
আল্লাহ্তায়ালার দর্শন
মুমিনগণ পরকালে বেহেশতে আল্লাহ্তায়ালার দীদার লাভ করবেন। এই দীদার বা দর্শন সম্পর্কে আমরা যেরকম ধারণা রাখি, সেরকম নয়। আল্লাহ্পাকের দীদারের ক্ষেত্রে দিক, প্রকার, উদাহরণ- কোনোকিছুই কল্পনা করা যায় না। দূরত্ব- নৈকট্যের ধারণাও সেখানে অচল। হাদিস শরীফে এসেছে,
তোমরা অতিশীঘ্রই তোমাদের প্রতিপালককে এমনভাবে দেখবে, যেমন ভাবে দেখো চতুর্দশীর চাঁদকে।
এই হাদিসের বর্ণনায় বোঝা যায়, দীদারের সম্পর্ক কেবল দেখার সঙ্গে। নতুবা চাঁদ কখনো আল্লাহ্পাকের জাতের তুলনা হতে পারে না। রসুলেপাক স. এর উক্ত হাদিসের প্রতি আমাদের আস্থা রাখতে হবে। কিন্তু তিনি যা বলেছেন, তার সঠিক অবস্থা আমাদের জ্ঞানের আওতাভূত যে নয়, একথাও বুঝতে হবে। দীদারের প্রতি ইমান রাখাই জরুরী। দীদারের রকম, প্রকার, অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ ( যা অসম্ভব ) করা জরুরী নয়। পৃথিবীতে জাগ্রত অবস্থায় স্বচক্ষে আল্লাহ্তায়ালার দীদার সম্ভব নয়। কেবল মেরাজের রাতে রসুলেপাক স. আল্লাহ্পাককে দেখেছেন। কিন্তু সেই দীদার হয়েছিলো ঊর্ধ্বজগতে। পৃথিবীতে নয়। হজরত শায়েখ আব্দুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী র. বলেন, মুহাদ্দিসীন, ফিকাহবিদ, দার্শনিকবৃন্দ, এমনকি তরিকার মাশায়েখগণ এ বিষয়ে একমত যে, আউলিয়াগণের কেউই স্বচক্ষে আল্লাহ্তায়ালাকে দেখতে পাননি। ‘কিতাবে তাআ’রুফ’ নামক গ্রন্থে লিখিত আছে, মাশায়েখ বা বুজর্গবৃন্দের কেউই স্বচক্ষে আল্লাহকে দেখার দাবী করেননি। কেউ এ বিষয়ে কোনো দলিল-প্রমাণও দেননি। কিন্তু মূর্খ সুফীদের একদল (আদতে তারা সুফীদের কাতারভুক্তও নয়)আল্লাহকে দেখার দাবী করে থাকে। বুজর্গানে দ্বীন এ বিষয়ে একমত যে, স্বচক্ষে আল্লাহ্দর্শনের দাবীদার মিথ্যাবাদী এবং এরকম বাক্য মারেফত লাভ না হওয়ার চিহ্ন। আল্লাহ্পাককে স্বপ্নে দেখা সম্পর্কে অবশ্য মতভেদ পাওয়া যায়। কিন্তু একথা সত্য যে, স্বপ্নে আল্লাহর দীদার সম্ভব। পূর্ববর্তী বুজর্গগণ এ বিবরণটির প্রত্যয়ন করেছেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র. বর্ণনা করেছেন, আমি আল্লাহ্পাককে স্বপ্নে দেখে প্রশ্ন করলাম ‘হে আমার আল্লাহ! সর্বোত্তম ইবাদত কী এবং তোমার নৈকট্য অর্জনের নিকটতম উপায় কোনটি ? আল্লাহ্পাক জবাব দিলেন ‘কোরআনুল করীমের তেলাওয়াত’। ইমামে আজম র. বর্ণনা করেছেন যে, তিনি একশত বার স্বপ্নে আল্লাহ্তায়ালাকে দেখেছেন। ইবনে সিরীন র. বলেন, স্বপ্নে আল্লাহ্পাককে দর্শনকারী বেহেশতে প্রবেশ করবে এবং দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে। শায়েখ আব্দুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী র. বলেন ‘এরকম স্বপ্নদর্শন আসলে অন্তরের দর্শন। প্রকাশ্য চক্ষু তাঁকে দেখতে অক্ষম। যদি কেউ প্রকাশ্য চোখে আল্লাহকে দেখে, তবে সে দর্শন হবে মেছাল। আল্লাহ্ মেছ্লী নন। কিন্তু মেছালী।
মেছেল বলা হয় সম্পূর্ণ গুণাবলীর দিক দিয়ে যার সাথে তুলনা করা হয়, তার সমকক্ষ হওয়াকে। কিন্তু মেছালের মধ্যে গুণাবলীর সমতা আবশ্যকীয় নয়। যেমন আকল বা জ্ঞানকে সূর্যের সঙ্গে তুলনা দেওয়া হয়। অথচ জ্ঞানের সঙ্গে সূর্যেও সামগ্রিক সাদৃশ্য নেই। উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু এতোটুকু- সূর্যের আলোয় যেমন বস্তুসমুদয় স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হয়, জ্ঞানের আলোকেও তেমনি সুন্দর-অসুন্দর ভালোমন্দে র পার্থক্যরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মেছাল হওয়ার জন্য এরকম ক্ষীণ কোনো সম্পর্ক থাকাই যথেষ্ট। এ কারণেই বাদশাহ্কে সূর্য এবং মন্ত্রীকে চন্দ্রের সঙ্গে উপমা দেয়া হয়। স্বপ্নে সূর্যদর্শনের ব্যাখ্যা এই যে- রাজদর্শন ঘটবে। আর চন্দ্রদর্শনের ব্যাখ্যা- ঘটবে মন্ত্রীদর্শন।
মেছালকে কোরআন মজীদে এভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে-
আল্লাহর নূরের উপমা ওই নূরের মতো, যার মধ্যে থাকে প্রদীপ এবং প্রদীপটি শিশার ফানুসের মধ্যে আলো বিকিরণ করতে থাকে।
— সূরা নূর
আল্লাহ্পাকের অতুলনীয় জাত বা সত্তা প্রদীপ, শিশা ও ফানুসের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না। তিনি এসবের সাদৃশ্য থেকে পবিত্র ও মুক্ত। জয়তুন গাছের সঙ্গেও তিনি তুলনীয় নন। অবশ্যই নন। বরং এখানকার দৃষ্টান্ত— ওই ধরনের, যেমন কোরআন মজীদকে তুলনা করা হয়েছে ‘হাবলুম মানাতিনে’র (একটি আলোকরশ্মির) সঙ্গে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একটি রশ্মি কোরআনের সামগ্রিক সাদৃশ্য নয় ।ফেরেশতাবৃন্দ এবং রমণীকুলও আখেরাতে আল্লাহ্পাকের দীদার লাভ করবেন। তবে তাঁদের পরস্পরের মধ্যে মুমিনদের মতোই সংখ্যাগত এবং অবস্থাগত পার্থক্য তো থাকবেই। জ্বিন স¤প্রদায় আল্লাহ্তায়ালার দীদার পাবে না। এ সম্পর্কে শায়েখ আব্দুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী র. বলেন ‘জ্বিনদের আল্লাহ্দর্শন থেকে বঞ্চিত থাকার কথাটা মেনে নেওয়া যেতে পারে। কেননা, ইমামে আজম আবু হানিফা র. এবং অন্যান্য ইমামগণের এক দল এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, জ্বিনেরা তাদেও নেক আমলের সওয়াব পাবে না। বেহেশতেও তারা প্রবেশ করতে পারবে না। তাদের সৎ কাজের প্রতিদান হবে এই যে, তারা দোজখের আগুন থেকে পরিত্রাণ পাবে। তিনি আরো বলেন ‘কাফের এবং মুনাফিকেরাও কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহকে কঠোর এবং প্রচন্ড রোষাম্বিত অবস্থায় দেখবে। এরপর চিরদিনের জন্য সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে যাবে, যাতে তাদের আক্ষেপ এবং আজাব ক্রমাগত প্রচন্ডতর হতে থাকে’।[1]
আল্লাহপাক নূর
আল্লাহর একটি সিফাত (গুণ) হলো ‘যুন্ নূর’, যার অর্থ তিনি নূর (আলো)-এর স্রষ্টা এবং ওই নূর দ্বারা আসমান ও জমিন, আর সেই সাথে ঈমানদারদের অন্তরও হেদায়াতের আলো দ্বারা আলোকোজ্জ্বলকারী। ইমাম নববী (রহ:) নিজ ‘শরহে সহীহ মুসলিম’ গ্রন্থে হুযূর পূর নূর (দ:)-এর দোয়া উদ্ধৃত করেন: “এয়া আল্লাহ, আপনি হলেন আসমান ও জমিনে নূর এবং সমস্ত প্রশংসা-ই আপনার.....” (মুসাফিরদের নামায-বিষয়ক বই #১৯৯)
উপরোক্ত ‘আপনি হলেন আসমান ও জমিনে নূর’ - এই বাক্যটির ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরাম বলেন: “আপনি-ই তাদেরকে (আপনার নূর দ্বারা) আলোকিত করেন এবং আপনি-ই তাদের নূর তথা আলোর স্রষ্টা।” হযরত আবু উবায়দা (রা:) বলেন, “এর অর্থ - আপনার নূর দ্বারাই আসমান ও জমিনে অবস্থানকারী সবাই হেদায়াত লাভ করেন।” আল্লাহর নাম ’নূর’ সম্পর্কে আল্ খাত্তাবী তাঁর তাফসীরে লিখেন, “তিনি (আল্লাহ) এমন এক সত্তা যাঁর নূর দ্বারা অন্ধ দেখতে পায় এবং পথহারা পথের দিশা পায়, যেহেতু তিনি আসমান ও জমিনে নূর (আলো); আর এটাও সম্ভব যে ‘নূর’ বলতে ‘যুন্ নূর’-কে বোঝানো হয়েছে। উপরন্তু, এটা সঠিক নয় যে ‘নূর’ আল্লাহতা’লার যাত মোবারকের গুণ (যাতী সিফাত/সত্তাগত গুণ), কেননা এটা ’সিফাতু ফে’লী’ (গুণবাচক ক্রিয়া); অর্থাৎ, তিনি নূরের স্রষ্টা।” অন্যান্য উলামা বলেন, “আল্লাহ আসমান ও জমিনে নূর - এ বাক্যটির অর্থ হলো, তিনি ওগুলোর সূর্য ও চাঁদ ও তারাসমূহের কর্তা।”
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) বর্ণনা করেন যে মহানবী (দ:) এরশাদ করেছেন: “মহান আল্লাহ সৃষ্টি জগত (মাখলুকাত)-কে অন্ধকারে (ফী যুলমাতিন) সৃজন করেন; অতঃপর তাদের প্রতি নিজ নূর মোবারক বিচ্ছুরণ করেন। যিনি-ই এই ঐশী আলোর স্পর্শে এসেছেন, তিনি-ই হেদায়াত পেয়েছেন; আর যে সত্তা এর স্পর্শ পায় নি, সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। তাই আমি বলি, (ঐশী) কলম শুকনো এবং (সব কিছুই) আল্লাহর (ঐশী) ভবিষ্যৎ জ্ঞানের আওতাধীন।” (আল হাদীস)
ওপরের এই হাদীস ইমাম তিরমিযী (রহ:) সহীহ সনদে তাঁর ‘সুনান’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন (‘হাসান’ হিসেবে)। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) নিজ ‘মুসনাদ’ কেতাবের ২টি স্থানে, ইমাম তাবারানী (রহ:) তাঁর হাদীস সংকলনে, হাকিম (রহ:) নিজ ’মুসতাদরাক’ পুস্তকে এবং ইমাম বায়হাকী (রহ:) তাঁর ‘সুনান আল কুবরা’ কেতাবে এটি বর্ণনা করেছেন। হযরত ইবনুল আরবী (রহ:) তিরমিযী শরীফের ওপর তাঁর ব্যাখ্যামূলক ‘আরিদাত আল আহওয়াযী’ গ্রন্থে (১০:১০৮) ইমাম তিরমিযী (রহ:)-এর বর্ণনার বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করে বলেন, “এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, প্রত্যেকে ওই নূর থেকে ততোটুকুই পান যা আম (সাধারণ) ও খাস্ (সুনির্দিষ্ট)-ভাবে তাঁর জন্যে মন্ঞ্জুর করা হয়েছে...তাঁর অন্তরে এবং শরীরে।”
উপরোল্লিখিত হাদীস ও হযরত কাজী ইবনে আরবী (রহ:)-এর ব্যাখ্যা পরিস্ফুট করে যে ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নূর (জ্যোতি), আর মহানবী (দ:) হলেন ইমানদারদের মধ্যে প্রথম এবং নূরের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হবার বেলায় সর্বাগ্রে, এমন কি ফেরেশতাবৃন্দ যারা নূরের সৃষ্টি, তাঁদেরও অগ্রে। ঈমানী ঘাটতি যাদের, শুধু তারাই এ সত্যটি অস্বীকার করতে পারে যে আল্লাহ যখন তাঁর নূর সৃষ্টিকুলের প্রতি বিচ্ছুরণ করেছিলেন, তখন মহানবী (দ:)-ই নিশ্চিতভাবে সর্বপ্রথমে ও সর্বাগ্রে ওই ঐশী জ্যোতির পরশ পেয়েছিলেন, এমন মাত্রায় তা পেয়েছিলেন যা কোনো ফেরেশতা, কোনো নবী (আ:) কিংবা কোনো জ্বিন-ই পান নি।