হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস রহ. ১৭০৩ সালে বৃহস্পতিবার সকাল বেলা উত্তর ভারতে অবস্থিত তার নানা বাড়ি মুজাফ্ফর নগরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার মূল নাম হল আহমাদ, উপাধী আবুল ফয়েজ, তিনার ঐতিহাসিক নাম আযীমুদ্দীন। তবে তিনি ওয়ালিউল্লাহ নামেই পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিত হন। তার পিতা শাইখ আব্দুর রহিম রহ. বংশগত দিক দিয়ে হযরত উসমান গণী রহ. মতান্তরে হযরত উমর রা. এর বংশের ছিলেন। আর তার মাতা ইমাম মুছা কাযিমের বংশধর ছিলেন।
ছোট বেলার আচার আচরণেই তার মাঝে ভবিষ্যত মাহাত্নের আভাস পাওয়া যায়। জযবে লতীফ নামক কিতাবে তিনি নিজেই বর্ণনা করেন যে, যখন আমার পাচ বছর বয়স, তখনই আমাকে মক্তবে ভর্তি করে দেওয়া হয়, যখন আমার বয়স সাত হয়, তখন আমার পিতা আমাকে নামায পড়ার আদেশ দেন। আর এই সময়েই আমি হিফজ শেষ করি এবং পনের বছর বয়সেই আমি তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ,উসুলে ফিকাহ, তর্কশাস্ত্র, কালাম, চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যামিতি ইত্যাদি বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করি। আমার বয়স যখন চৌদ্দে পৌছে তখন আমি আমার পিতার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করি এবং এর পরই আমি বিবাহ করি। আমার বিবাহের মাত্র দুই বছর পরই আমার শ্রদ্ধেয় পিতা এই পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে মহান প্রভুর ডাকে সারা দেন। انا لله وانا اليه راجعون
হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ. স্বীয় পিতার ইন্তেকালের পর মাদ্রাসায়ে রহীমিয়াতে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি দীর্ঘ বার বছর তার পরিবার ও সমাজকে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সমাজের অনেক উথান-পতনদেখার পর উপলব্দি করতে পেরেছিলেন যে, মুসলিম জাতিকে সমাজের চলমান গোমরাহী থেকে বাচাতে হলে তিনটি বিষয় একান্ত প্রয়োজন।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ. বর্ণনা করেন যে, তৎকালে মুসলমানেরা গ্রীক দর্শনের প্রতি ঝুকে পরেছিল। আর এই দর্শনের মূল ভিত্তি হল তর্কশাস্ত্র। যার কারণে মুসলিম সমাজে তখন অনেক প্রকার ফিতনা-ফাসাদের অনুপ্রবেশ ঘটে। সুতরাং সমাজকে এহেন অবস্থা থেকে মুক্ত করতে হলে প্রথমেই যুক্তি-দর্শন শিক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন।
সে যুগের মুসলমানেরা কুরআন-সুন্নাহকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র আধ্যাত্নিক সাধনাকে সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করত। তাদের অবস্থা এমন ছিল যে, সূফী-সাধকদের অনুমোদন ছাড়া তারা কোন কিছুকেই সত্য বলে বিশ্বাস করতো না। যার কারণেযুগের প্রেক্ষাপটে আধ্যাত্নিক সাধনা তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অংশ বলে বিবেচিত হত।
অর্থাৎ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জন হয়েছিল, এর মধ্যে কুরআনই প্রধান।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস রহ. বর্ণনা করেন যে, তৎকালীন যুগের শিক্ষিত ব্যক্তিরা উক্ত তিনটি বিষয় ছাড়াও তারা আত্নকেন্দ্রিকতার রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। তারা কখনো কোন প্রকার জটিল সমস্যার সম্মুখীন হলে কেউ কারো সাথে কোন প্রকার আলাপ আলোচনার প্রয়োজন মনে করতো না। বরং ছোট বড় সকলেই নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী শরীয়ত সংক্রান্ত বিষয়ে কোন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো। ফলে এ অবস্থার প্রেক্ষিতে তাকে উপযুক্ত তিনটি বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশ করতে হয়েছে। বার বছর যাবৎ আলোচনা, পর্যালোচনা ও গবেষণার পর সংস্কার দ্বারা তার বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মসূচী হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এব্যাপারে তিনি মৌলিকভাবে দুটি বিষয়ের প্রতি অধিক গ্ররুত্বারোপ করেন।
১। মানুষের ব্যবহারিক জীবন সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকৃত পক্ষে কুরআনের অলৌকিকত্ব। পবিত্র কুরআনের এ ব্যবহারিক মূল্যায়নের প্রতিষ্ঠাকে তিনি তার শিক্ষা সংস্কারের বুনিয়াদ রূপে গ্রহণ করেছিলেন।
২। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ভারসাম্যের অভাবকে সমাজ-রাষ্ট ও জাতীয় জীবনের নৈতিক ব্যবহারিক বিপর্যয় ও বিশৃংখলার কারণ বলে তিনি নির্দেশ করেছিলেন। শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস রহ. এই দুইটি বস্তুকে সামনে রেখেই তার আন্দোলনের পথে যাত্রা শুরু করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, যদি কুরআনের অলৌকিকত্ব একমাত্র তার ভাষাগত অলংকারেই সীমাবদ্ধ হয়, সেক্ষেত্রে কেবল নির্দিষ্ট সংখ্যক লোক ব্যতীত আর সকলেই করআনের মাধুর্য থেকে বঞ্চিত থাকবে। তাই তিনি কুরআনের ব্যবহারিক দিক ও অর্থনৈতিক সমতাকেও তার সংস্কারমূলক কর্মসূচীর অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন। সাধারণত নৈতিক জীবনবোধই হচ্ছে আধ্যাত্নিকতার ভিত্তি। আর নৈতিকতার বিকাশতো তখনই ঘটবে যখন অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া যাবে। কিন্তু মানব জীবনের সাথে অর্থের সম্পর্কটা এতটা উতপ্রোতভাবে জরিত এটা কেউ কোনদিন উপলব্দিও করতে পারেনি। যার ফলে অবস্থা এমন হয়েছে যে, আমাদের রাষ্ট্র হয়েছে সার শূণ্য। আধ্যাত্নিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকাকেই জীবনের জন্য বড় সাফল্য মনে করত। পক্ষান্তরে শাহ ওয়ালি মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ. এই বাস্তবতাকে হকের নিরিখে বিচার করেছেন। তার লিখিত গ্রন্থ “হুজ্জাতুল্লাহিলবালিগা” তে তিনি এ বিষয়ের প্রতি বার বার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। মোট কথা ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রিয় জীবন পর্যন্ত সবখানেই অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিধান একান্ত জরুরী। কেননা মানুষতো তখনই নীতি, আদর্শের প্রতি মনোযোগ দিতে পারে যখন সে জীবীকা সংস্থানের দুশ্চিন্তা থেকে অবকাশ লাভ করে। নচেৎ মানব জীবন পশুজীবনে পরিণত হয়ে যাবে। শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস রহ. এই সত্যকে উপলব্দি করতে পেরে মুসলিম মিল্লাতকে এ ঘোর অমানিশা থেকে মুক্ত করার লক্ষে এ বিষয়ে সুষ্ঠ ও তত্ত্বমূলম গবেষণা করার জন্য তৈরী হয়ে যান। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন ছিল হাদীস শাস্ত্রে পূর্ণ পান্ডিত্য অর্জন করা। অথচ দিল্লিতে তখনও আশানুরুপ হাদীস গ্রন্থ ছিল না বিধায় তাকে হিজাযে সফর করতে হল।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস রহ. বর্ণনা করেন, দীর্ঘ বার বছর পর্যন্ত এ বিষয়ে গবেষণা করার পর আমার মন আমাকে মক্কা-মদিনার দিকে সফর করার জন্য উদ্ভুদ্ধ করল। আমি আমার মনের তাকাযায় ১১৪৩ হিজরীতে পবিত্র মক্কা শরিফ চলেযাই এবং সেখানে দু বছর অবস্থান করে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস শায়খ আবু তাহির রহ. এবং অন্যান্য আলেমগণের নিকট হাদীস চর্চা করি। এভাবে তিনি তাসাউফের ক্ষেত্রেও কঠিন মেহনত করে শায়খ আবু তাহির রহ. থেকে তাসাউফের খিরকা লাভকরেন।
অতপর ১১৪৫ হিজরীতে দিল্লিতে ফিরে এসে তার কাঙ্ক্ষিত সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। সংস্কার আন্দোলনের জন্য ফিকাহ ও ইলমে হাদীস শাস্ত্রে স্বাধীনভাবে ইজতেহাদ করার যোগ্যতা থাকা আবশ্যক। মক্কা-মদিনায় অবস্থান কালে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস রহ. এ বিষয়ে পরিপূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হন। তিনার দাবি ছিল যে, বাদশা আকবর কর্তৃক প্রণিত দ্বীনে এলাহীর উদার নীতিতে যে সকল নিয়ম নীতি ছিল, তা পরিবর্তন করে নতুন করে শাষন ব্যবস্থা তৈরী করা একান্ত প্রয়োজন। এ দাবিকে সামনে রেখেই তিনি তার আন্দোলনের কর্মসূচী পেশ করেন। তার কর্মসূচীকে মোট আটটি ধারায় বিভক্ত করা যায়।
প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র সংস্থার আন্দোলন দ্বারা কোন দেশের মানুষের আত্নশুদ্ধি করা অত্যান্ত কঠিন ব্যপার । এর জন্য প্রয়োজন আম্বিয়ায়ে কেরামের সংস্কার ধারা ঠিক রেখে দ্বীনের পরিপূর্ণ জাগরণ সৃষ্টি করা। তৎকালীন সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত দ্বীনে এলাহীর উদার নীতির ফলে মুসলমানদের ঈমান-আকীদার ক্ষেত্রে যে বিশৃঙ্ক্ষলা বিরাজ করছিল তা সকলেরই জানা। সহজ-সরল মুসলিম জাতি বিভিন্ন ভাবধারা ও দর্শনপন্থিদের সাথে উঠা-বসা, চলা-ফেরার কারণে, বিশেষ করে সম্রাট আকবরের আমলে হিন্দু সাংস্কৃতির একক প্রাধান্যতার কারণে ভারতবর্ষে শুধুমাত্র নামধারী মুসলমানেরই অস্তিত্ত্ব বাকি ছিল। ইসলামী ধ্যান-ধারনা, ইসলামী আকীদা, ইসলামী অনুশাষনের সাথে তাদের পার্থক্য ছিল আকাশ পাতালের ন্যায়।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস রহ. এ সত্যকে উপলব্দি করতে পেরে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এ বিপর্যয় থেকে মুসলিম জাতীকে উদ্ধার করতে হলে ব্যাপকভাবে কুরআনের দাওয়াত প্রচার করতে হবে। মহাগ্রন্থ আল কুরআন সার্বজনিন ও আন্তর্জাতিক। যে কোন যুগে যে কোন স্থানে এর বৈপ্লবিক নীতিকে অনুসরণ করলে ইসলামের স্বর্ণ যুগের (সাহাবাদের যুগের) ন্যায় নব জাগরণের সূচনা ঘটবে। এ কাজকে তিনি আঞ্জাম দিতে সর্বপ্রথম তিনি ফার্সী ভাষায় কুরআনের অনুবাদ করেন যার নাম করন করেন, “ফুতুহুর রহমান” করে। এ কাজ করতে গিয়ে তাকে অনেক গাল মন্দ ও বিপদের সম্মক্ষিণ হতে হয়েছে। এক দল আলেম তো বলেই ফেলেছে যে, ফার্সী ভাষায় কুরআনের অনুবাদ করলে কুরআনের অলৌকিকত্ত্ব ও তার মাধুর্যতা নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং এ রকম কাজ করা কুফুরী তুল্য। শুধু এতটুকুনই নয় বরং এক পর্যায়ে তার ব্যাপারে কুফুরীর ফতোয়া ও দেয়া হয়। কিন্তু এ কথা চিরন্তন সত্য যে, “ কুকুরের ঘেউ ঘেউ চন্দ্রের আলোকে ম্লান করতে পারে না। তাই তার অবদান পৃথিবীতে বিরজমান রইল।
এ বিষয়ে আমাদের জানতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে যে, ইসলামের মধ্যে হাদীসের গুরুত্ত্ব কতটুকুন। হাদীসের প্রচার ও তার সংরক্ষণ কেন প্রয়োজন? হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা বা অবহেলা করলে ক্ষতি কী? প্রকৃতপক্ষে হাদীস হল উম্মতের ঈমান-আকীদার জন্য মান দন্ড সরূপ। শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ. এর প্রথম কর্মসূচী ছিল আল কুরআনের প্রতি দাওয়াত। এই কাজের জন্য হাদীসের জন্য কতটুকুন তা আর আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। তার কারণ হল পবিত্রকুরআনের ব্যাখাই যে, হাদীসে নববী । যেমন কুরআনের মাঝে আছে, اسوة حسنة রাসূলুল্লাহ সাল্ল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাঝে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। ভারতের মাঝে যে শিরক-বিদআতের সয়লাব দেখা দিয়েছিল। তার এও একটা কারণ ছিল যে, হাদীসে নববীর প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা প্রদর্শন করা। রাসূলে কারীম সাল্ল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেন, যখন কোন সম্প্রদায় একটি বিদআতে লিপ্ত হয়, তখন তাদের থেকে একটি সুন্নত উঠিয়ে নেয়া হয়। (মিশকাত) শাহ সাহেব সমাজ থেকে শিরক বিদআতের অন্ধকারকে দূর করার লক্ষ্যে সুন্নতে নববীর প্রচার প্রসার মনোযোগি হলেন। মূলত তিনিই প্রথম মানুষ যিনি ভারত উপমহাদেশে সর্ব প্রথম হাদীসের দরস চালু করেন। হাদীসের ক্ষেত্রে হযরত শাহ সাহেবের অনেক অবদান রয়েছে। তার লিখিত হাদীস গ্রন্থসমূহ থেকে উল্লেখযুগ্য কয়েকটি: মুছাফ্ফা, মুছাওয়া, শরহে তরজমায়ে সহীহ বুখারী, আল-ফসলুল মুবীন মিন হাদীসিন নাবিয়্যিল আমীন।
অনেক কাল আগে থেকেই মুসলমানগণ ফিকাহ ও হাদীস নিয়ে চর্চা করে আসছেন। তবে তা ছিল নিতান্তই বিচ্ছিন্ন। শাহ সাহেবই সর্ব প্রথম ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিকার মাঝে সমণ্বয় ঘটান।
অনেকের ধারণা যে, শরিয়তের কোন হুকুম আহকাম কোন উদ্দেশ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। কাজের সাথে তার কোন প্রকার ফলাফলের সম্পর্ক নেই। এই ধারণা ভুল। ইজমা, কিয়াস ও খাইরূল কুরুন উক্ত মতবাদকে খন্ডন করেন যেমন, নামায। এই হুকুমটি আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করা ও তার কাছে মুনাজাত করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গরীব ও অসহায়দের দুখ দূর্শদশা ও অভাব অনটনকে অনুভব করার জন্য আল্লাহ তায়ালা যাকাতের জন্য বিধান দান করেছেন। মানুষের অন্তরকেকুপ্রবৃত্তির প্রভাব থেকে দূর করার জন্য আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য রোযাকে ফরয করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালার মহা গ্রন্হ আল কুরআনের প্রচার প্রসার ও সুজলা সুফলা সুন্দর এই পৃথিবী থেকে সকল প্রকার ফেতনা ফাসাদ দূর করার লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা জিহাদকে ফরয করেছেন। অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্ল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদেশ নিষেধের মাঝেও অনেক রহস্য লুকায়িত রয়েছে। যেমন যোহরের পূর্বে চার রাকাত নামায সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্ল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ঐ সময় আকাশের দরজা উন্মুক্ত করা হয়, আমার ইচ্ছে হয় এ সময় যেন আমার নেক আমল উর্ধোরহন হয়। এভাবেই প্রত্যেক হুকুমের মাঝেই কোন না কোন রহস্য লুকায়িত রয়েছে। এক শ্রেণীর মানুষ মনে করে যে, ইসলামী হুকুম আহকাম যুক্তির আলোকে বিশ্লেষণ করা এবং এগুলোর রহস্য উদঘাটন করা ইসলামের জন্য ক্ষতিকারক। শাহ সাহেব বলেন যে, এই ধারণা ভুল। কারণ ইসলামী হুকুম আহকামকে যুক্তির আলোকে বিশ্লেষণ করলে কোন প্রকার ক্ষতি নয় বরং উপকার হবে। যেমন আমলের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। এছাড়াও ফিকহি ইজতেহাদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হবে। এদিকে লক্ষ্য করেই শাহ সাহেব এ কাজকে তার বিপ্লবী কর্মসূচীর অন্তর্ভূক্ত করেন।
আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তার দাসত্বের জন্য। সাথে সাথে পৃথিবীর সুষ্ঠ পরিচালনা আঞ্জাম দেওয়ার জন্য যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা হল ‘খিলাফত’। এই খিলাফত মানব জীবনের একটি মৌলিক বিষয়। এর মধ্যে নিহিত রয়েছেঅনেক অনেক কল্যাণকর দিক। শাহ সাহেব এর গুরুত্ত্ব ও প্রয়োজনিয়তা জনসাধরণের মাঝে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যার নজীর নেই। তিনি তার ‘ইযালাতুল খিফা’ নামক গ্রন্থে খিলাফতের ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেন।
খিলাফত অর্থ সাধারণের ক্ষমতা লাভ করায় ইলমে দ্বীনকে জিন্দা করার মাধ্যমে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য, ইসলামের নীতি-বিধান ও জিহাদ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি যেমন সৈন্য বিন্যাস, যোদ্ধা তৈরী ইত্যাদি সংস্থাপনের জন্য এবং দন্ডবিধি প্রয়োগ করা, জুলুম-শাষন বিনাশ করা, সুপথের আদেশ ও কুপথের নিষেধ প্রভৃতিকে কায়েম করা হযরত রাসূল সাল্ল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্থলাভিষিক্ত রুপে ।
এ সময় আরো একটি বিষয় মসলমানদের মাঝে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল, তা হল খিলাফতে রাশেদা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের সন্দেহ প্রকাশ। শাহ সাহেব বিরুদ্ধবাদিদের এ সকল ভ্রান্ত ধারণাকে এমনভাবে খন্ডন করেন, যা যথাযথই যুক্তিযুক্ত ছিল। তার সব গুলি যুক্তিই ছিল কুরআন হাদীসের ভিত্তিতে প্রণীত। তিনি এ ব্যাপারে একটি গ্রন্থও রচনা করেন, তার নাম ‘ইযালাতুল খিফা আন-খিলাফাতিল খুলাফা’।
শাহ সাহেব বলেন যে, শ্রমিদের উপর থেকে শ্রমের অতিরিক্ত চাপ রহিত করা ছাড়া সমাজের মাঝে ভার সাম্য সৃষ্টি হতে পারে না। (বাস্তব প্রমাণ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন) অতিতে রোম, পারস্যে যে নৈতিক অধপতন নেমে এসেছিল তারও মূল কারণ ছিল শ্রমিক নিপীড়ন। সুতরাং সমাজের মাঝে ভারসাম্যতা ফিরিয়ে আনতে হলে কুরআনের সেই বৈপ্লবিক চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে। শাহ সাহেব কুরআনের সেই বৈপ্লবিক চেতনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
শাহ সাহেব দরস ও তাদরিসের পাশা-পাশি সমাজের সকল প্রকার অনৈতিক কর্ম কাণ্ড সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে অবগত ছিলেন। তিনি সমাজের এহেন সকাল প্রকার রোগ থেকে মুক্তির জন্য সমাজের সর্বস্তরের জনগণের প্রতি বিশেষ আহবান জানান।
তার এই বৈপ্লবিক আন্দোলনের একটি অংশ এও ছিল যে, এমন কিছু মর্দে মুমিন তৈরী করা যারা ভবিষ্যতে তার এই বৈপ্লবিক আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এরই প্রতি ফলন হল শাহ আব্দুল আজীজ রহ. শাহ মুহাম্মাদ ইসহাক রহ. শাহ মুহাম্মাদ বেলায়েত আলী রহ. সৈয়দ আহমাদ বেরলভী রহ. হযরত শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দি রহ. শাইখুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ. প্রমুখ।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সম্রাট আলমগীরের মৃত্যুর পর ভারতে যে রাজনৈতিক বিশৃংখলা দেখা দিয়েছিল, তা মুসলমানদের জন্য খুবই বিপদজনক ছিল। শাহ সাহবে মুসলিম জাতিকে এ দুর্যোগ থেকে উদ্ধারের লক্ষ্যে জনসাধরণের মাঝে জিহাদী প্রেরণা সৃষ্টি করেন।
১১৭৬ হিজরীর ২৯ শে মুহাররম যুহরের সময় হযরত শাহ সাহেব এই অস্থায়ী পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চিরস্থায়ী ধরার প্রতি যাত্রা শুরু করেন। মৃত্যুর সময় তিনার বয়স হয়েছিল ৬১ বৎসর। মৃত্যুর সময় তিনি চার জন যুগ্য সন্তান রেখে যান । তারা হলেন, শাহ আব্দুল আযীয, শাহ বদিউদ্দীন, শাহ আব্দুল কাদির, শাহ আব্দুল গণী।
বিশেষজ্ঞদের মতে তার রচনাবলী দুইশতের অধিক। হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ, উসুলে ফিকাহ, রাষ্ট্রনীতি, তাসাউফ নির্বিশেষে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তার অবদান রয়েছে।