জন্মঃ ১৮৯৫ সালের ১৮ই মে ১৩১৬ হিজরী রোজ শনিবার তৎকালীন আসামের কাছাড় জেলার করিমগঞ্জের রায়পুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আলী রায়পুরী (র)। তার পিতার নাম মোশাররফ আলী ও মাতার নাম নছিরা বিবি। পিতা-মাতা উভয়েই সহজ সরজ ও ধার্মিক ছিলেন।
জৈনক দরবেশের ভবিষ্যৎবাণীঃ তিনি মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময়ে এক দরবেশ তার পিতার কাছে ভবিষ্যৎবানী করেছিলেন যে তার পিতার ঔরশে এমন এক সন্তানের জন্ম হবে যার মাধ্যমে একজগত আলোকিত হবে।
নাম ও উপাধীঃ তার নাম হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আলী। উপাধি হাদীয়ে বাঙাল, কোতবুল ইরশাদ, শাহ সুফী ইত্যাদি।
শৈশব ও প্রাথমিক জীবনঃ শৈশব থেকে তার মধ্যে অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে। চলা-ফেরা, চাল-চলন ছিল সম্পুর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের মতো অযথা যত্র-তত্র তিনি ঘোরাফেরা করতেন না। নম্রতা এবং লজ্জাশীলতা ছিল তার স্বভাব। শৈশবেই তার পড়াশোনার প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। মাওলানা হাশিম আলী (র) এর কাছে প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ করেন। অল্প দিনে সাফল্যের সাথে প্রাথমিকশিক্ষা সমাপ্ত করেন।
উচ্চশিক্ষাঃ প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তিনি বাইরে যাওয়ার চিন্তা করেন। ১৯০৬ ইংরেজীতে রায়পুরী (র) বিয়ানীবাজার উপজেলার খশির (হাতিটিল্লা) আগমন করেন। খশির সড়ক ভাংগির সামান্য উত্তর পাশে মরহুম কনাই মিয়ার বাড়ীতে একটি মাদ্রাসা ছিল। সেখানে কয়েক মাস পড়াশোনা করেন। ১৯১৩ সালে তিনি কাটিগড়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি একবছর পড়াশোনা করেন। ১৯১৪ সালে তিনি সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানার ফুলবাড়ী মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি পড়াশোনা করেন। এরপর অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে ছাহারণপুর মুজাহিরুল উলুম মাদ্রাসা থেকে ১৯২৬ সালে তিনি দাওরাহে হাদিস পাশ করেন।
ইলমে তাসাউফের সন্ধানেঃ ইলমে তাসাউফের নিগৃঢ় তথ্য হাসিলের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অতি উৎসাহী। ছাহারণপুর মাদ্রাসায় অধ্যায়নকালে ইলম তাসাউফের অনুসন্ধানে তিনি তৎপর হয়ে উঠেন। এসময় তিনি মাওলানা আব্দুল গাফফার বরিশালী (র) এর কাছে ইলমে তাসাউফের জ্ঞান লাভ করেন।
মুর্শিদের কাছেঃ মাওলানা আব্দুল গাফফার বরিশালী (র) এর আগমনের সংবাদ শুনামাত্র হযরত রায়পুরী (র) তাকে মোজাফফর নগরে নিয়ে যাওয়ার জন্য সহপাঠীদের অনুরোধ করলেন। কিন্তু সহপাঠীগন বাড়ার টাকার অভাবের কথা বললেন। তিনি যাতায়াতের সমস্ত খরচ বহনের ওয়াদা দিলেন। এবং সকলকে নিয়ে রওনা দিলেন। রায়পুরী (র) হযরত বরিশালী (র) নুরানী চেহারা দেখে অভিভূত হলেন। মোজাফফর নগরে বরিশালী (র) এর বয়ান শেষে বয়াত হওয়ার জন্য আরজ পেশ করলেন। অতঃপর বয়াত গ্রহণ করত সকলকে মোরাকাবায় বসায়ে যখন হযরত তাহাজ্জুহ করলেন তখন রায়পুরী (র) বাহ্য জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। অনেক্ষণ পর্যন্ত তিনি বেহুঁশ অবস্থায় পড়ে রইলেন। বরিশালী (র) তার গায়ের পাঞ্জাবি খুলে বাতাস করার কথা বলে অন্যত্র চলে গেলেন। তখন ছিল শীতকাল। অনেক্ষণ পর তার চেতনা শক্তি কিছু ফিরে এলে দুজন লোক তার দু কাধ ধরে তাকে নিয়ে হাটাহাটি করছিলেন। অবশেষে তার পুর্ণ জ্ঞান ফিরে এল। তিনি লক্ষ্য করলেন তার সমস্ত শরীর ঘর্মাক্ত। কোথায় কি অবস্থায় ছিলেন কিছুই তিনি বলতে পারছেননা। দু চোখ বয়ে চলছে অশ্রুসজল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল বরিশালী (র) তাওয়াজ্জুহ তার দেহ পিঞ্জিরকে একেবারে গুড়িয়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর দুনু পরিচর্চাকারীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাপড় চোপড় পরিধান করে আবার হযরতের খেদমতে চলে গেলেন। বায়াতের প্রথম দিনের তাওয়াজ্জুর বরকতে ওলায়তের ছোগরা পর্যন্ত তার ছবক পৌছে যায়। ঐদিনের বিরাট মাহফিলে বরিশালী (র) মন্তব্য করলেন, আজকের মোহাম্মদ আলী কালে মুরীদ জগতে শীর্ষ আসন লাভ করবে। যা পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়।
খেলাফত ও উচ্চ দরজা লাভে রায়পুরী (র)ঃ বয়াতের প্রথম দিনই তিনি ওলায়ওতে ছোগরা পর্যন্ত ছবক লাভ করেন । ঐ দিনই বরিশালী (র) ঘোষণা করেন, আজকের নবদীক্ষিত মুরিদ মাওলানা মোহাম্মদ আলী রায়পুরী, কালে মুরীদ জগতে শীর্ষ আসন লাভ করবে। বাস্তবিকই ঐ ঘোষণার বিশ বছর পর ১৩৫২ বাংলা মোতাবেক ১৯৪৫ সালে বরিশালী (র) জীবনের অন্তিম সফরে, একদা করিমগঞ্জের চৌকিরমুখ নামক স্থানে আগমন করেন। এখানে একটি মাহফিলে বিশিষ্ট খলিফাগণ সহ বহু সংখ্যক মুরিদান একত্রিত হয়েছিল। নসীহত এবং তালিম তরবিয়তের পর একসময় হযরত রায়পুরী (র) কে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি মোজাফফরনগর মজলিশে যা বলেছিলাম তা কি সত্য হয়নি? সকলে নিরব রইলেন। জনৈক মাওলানা সাহেব বললেন হতে পারে। তখন পুনঃরায় একটু রাগতঃস্বরে বললেন, কি আমার সে কথা সত্যে পরিণত হয়নি? তখন সকলে এক বাক্যে বলে উঠলেন হুযুর, আপনার কথা সত্যে পরিণত হয়েছে।
যাহেরী খেলাফত লাভঃ মুর্শিদের খেদমতে থেকে কঠোর সাধনা ও মেহনত করে রায়পুরী (র) নক্বশবন্দীয়া, মুজাদ্দেদীয়া, ক্বাদেরীয়া, চিশতীয়া এবং শাজলিয়া প্রভৃতি তরীকার কামাল নিসবত হাসিল করেন। স্বীয় মুর্শিদ থেকে এসব তরীকার যাহেরী খেলাফত লাভের সঙ্গে সঙ্গে ঐ সব তরীকার মাশায়িখ গণের কাছ থেকে বাতেনী খেলাফতও লাভ করেন।
বিবাহঃ রায়পুরী (র) প্রথম বিবাহ করেন নিজ বাড়ীতে পিতৃব্য মাওলানা হাশিম আলী সাহেবের কন্যা ছালিমা খাতুনকে। হযরত রায়পুরী (র) দ্বিতীয় বিবাহ করেন বাড়ীর আহলিয়া মইওবী বিবিকে।
সন্তানরা হচ্ছেনঃ মরিয়ম বেগম, ফরিদ উদ্দিন, আছিয়া খাতুন, মাওলানা আব্দুল জব্বার সাহেব, রুহুল আমিন, মছউদ আহমদ, হাফিজ মাওলানা শাব্বির আহমদ, হাফিজ রশিদ আহমদ, আয়েশা খাতুন, আব্দুন নুর,এছাড়া রায়পুরী (র) কানাইঘাট থানার দাওয়াদারী নামক গ্রামে তৃতীয় বিবাহ করেন। উক্ত শাদীর সুফিয়া নামক একজন কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেন।
ভারত থেকে বাংলাদেশে হিজরতঃ রায়পুরী (র) প্রথম দিকে কুশিয়ারা নদীর বাম তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে দাওয়াতী কাজ আরম্ভ করেন। অল্প দিন যেতে না যেতে তার কামাল বুযুর্গী ও সুনাম দেশ-বিদেশ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো। হাজার হাজার মানুষ হযরতের কাছে বায়াত হল। আল্লাহ ও রাসুলের এশক ও মহব্বতের এক নতুন জোয়ার মানুষের মধ্যে দেখা দিল। এ অবস্থায় দিন যতই বাড়লে লাগলো, তারদাওয়াত ও সফরের পরিধি আরো বাড়তে লাগলো। এমনি অবস্থায় আল্লাহর রহমত শামিলে হাল হলো। একদিন রায়পুরী (র) কাশফী হালতে দেখেন, হযরত শাহজালাল (র) তার কাছে এসে বলতেছেন আপনি আমার সিলেটে আসুন। এখানে ইসলামের হাকিকত ডুবে যাচ্ছে। আপনি মা'রেফতের নেয়ামত এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে বিতরণ করুন। এ ঘটনার পর থেকে তিনি সিলেট জেলায় আসা যাওয়া আরম্ভ করেন এবং সিলেটের দুর-দুরান্ত অঞ্চলে গিয়ে তরীকতের কাজ চালু করেন।
আল্লাহর ওলীর প্রকৃত পরিচয় যখন মানুষের কাছে জানা-জানি হয়ে গেল তখন দলে দলে মানুষ এসে বায়াত গ্রহণ করলেন। প্রত্যেকের মধ্যে আমলী জেন্দেগীর এক নব চেতনা ফিরে এলো। রায়পুরী (র)তাহাজ্জুর বদৌলতে শত শত মানুষের শরীরের অণু-পরমাণুতে আল্লাহর যিকির চালু হলো। রায়পুরী (র) সিলেট সফরের সময় প্রায় মাহফিলে হযরত শাহজালাল (র) এবং তদীয় সঙ্গীগণ সহ তরীকতের অন্যান বুযুর্গানের রুহানী ফায়য ও তাওয়াজ্জুহ লাভের অনেক ঘটনা মজুদ আছে। মোট কথা- সত্যিকারের একজন কামিল ওলী হিসেবে অতি অল্প দিনের মধ্যে রায়পুরী (র) সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ভারতের কাছাড় জেলা থেকে নিয়ে সুদুর আসাম পর্যন্ত তিনি সফর করতে লাগলেন। অপর দিকে বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার এবং সুনামগঞ্জ ইত্যাদি জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে, গ্রামে গঞ্জে শহরে ও পাড়া গায়ে তিনি তরীকতের মেহনত শুরু করলেন। রায়পুরী (র) দেখে সর্ব সাধারণের মধ্যে, আল্লাহ ও রাসুলের মহব্বতের এক নতুন জযবা সৃষ্টি হল। হযরতের দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে হেদায়েতের এক ইনকেলাব সৃষ্টি হয়ে গেলো। এতে করে দিন দিন বাংলাদেশের মুরীদ সংখ্যা অগণিত হারে বৃদ্ধি পেতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন দাড়ালো যে- মুরীদগণের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঘন ঘন সফর করা অতীব প্রয়োজন দেখা গেলো। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারত দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়ার কারণে উভয় দেশে ইচ্ছেমত যাতায়াত করা তার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়লো। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান দুটি রাষ্ট্রে যাতায়াতের সুবিধের জন্য ভিসা প্রথা প্রবর্তন করা হলো। এতে যদিও যাতায়াত ব্যবস্থার সুযোগ সুবিধা কিছুটা ভালো হলো। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে সেই প্রথা পরিবর্তন হলো। এই পরিবর্তনের ফলে তিনি যথা সময় ইচ্ছে মতো বাংলাদেশের মুরীদগণের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে না পারায় অন্তরে অনেকটা পেরেশানী বোধ করতেন। এর মধ্যে একদিন আবার কাশফ হলো। সেই কাশফের ইশারার পর তিনি বাংলাদেশে হিজরত করেন।
ইন্তেকালঃ আল্লাহর মকবুল বান্দা ১৬ই অক্টোবর ১৯৮১ সালে ৮৬ বছরে ইন্তেকাল করেন।
তথ্যসুত্রঃ ছিরাজে গফুরী শায়খে রায়পুরী (র) বই থেকে নেওয়া।
তথ্য সংগ্রহ করতে সহযোগিতা করেছেন হাফিজ মাওলানা ফরহাদ আহমদ, শিক্ষক জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর মাদ্রাসা, বিয়ানীবাজার, সিলেট।