আমিরুল মো’মিন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)
জীবন যাপন:
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ছিলেন খুবই নরম হৃদয়ের মানুষ এবং সাদাসিধে জীবন-যাপন করতেন
আব্দুল্লাহ ইবনে আবু মুল্লায়কা থেকে বর্ণিত কেও যদি হযরত সিদ্দিকে আকবর (রাঃ) কে ইয়া খালিফাতুল্লাহ
বলে সম্বোধন করতেন তখন তিনি বলতেন আমাকে খলিফাতুর রাসুল বল (ইযাতুন খাফা)।সুবাহানাল্লাহ।
কেমন নবী প্রেমিক একবার ভাবুন। তিনি বায়তুল মাল থেকে খুবই সামান্য অর্থ গ্রহণ করতেন।তিনি আত্মম্ভরিতা মুক্ত ছিলেন, সিদ্দিকে আকবরের নিকট পরকাল ভীতি ছিল অনেক ।কুরআনে পাক তেলাওয়াতর সময় খুব বেশী কান্নাকাটি করতেন।আর এই কথা বলে মুনাজাত করতেন আর কান্নাকাটি করতেন, “হে খোদা আমার কি অবস্থা হবে,আমার কাছে তো কোন নেকী নেই ।মন্দ আমল খুব বেশী,কিন্ত ইবাদত খুব কম।“ হায় আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)যদি এই কথা বলে তাহলে আমাদের কি অবস্থা হবে,তিনিত জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন,হে খোদা আমাদের ক্ষমা ও দয়া কর এই মাহবুব ও মকবুল সিদ্দিকি আকবর এর উসিলায় ।তার থেকে প্রবাহিত হয়েছে তরিকত জগত এর বিখ্যাত শাখা নক্সেবন্দীয়া মুজাদ্দেদিয়া।
ওফাত মুবারক:
হুযুর নবীয়ে পাকের ওফাত মুবারকের পর মাত্র আরাই বছর তিনি বেঁচে ছিলেন দুনিয়াতে।হুযুর সায়িদিল আউয়ালিনা ওয়াল আখেরি আহমদে মুজতবা মুহাম্মদে মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর বিরহে অসুস্থ হয়ে পড়েন দিন দিন রোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে।একদিন স্বপ্নে দেখলেন হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাশরিকে এনেছেন এবং হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লাম)’এর শরীর মুবারকের দুটি সাদা কাপড় এবং কিছুক্ষণ পর তা সবুজ হয়ে গেল। এত আলোকিত হয়েছিল যে,ঝক ঝক করতে ছিল ফলে সেই দিকে দৃষ্টিপাত করা যাচ্ছিল না।হযরত আবু বকর (রাঃ)হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লামের দিকে এগিয়ে এসে সালাম দিলেন।হুযুর নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় নূরানি হাত মুবারক হজরত আবু বকর (রাঃ) এর বুকের উপর রাখলেন ফলে মনের কষ্ট এবং অস্থিরতা থেমে গেল,প্রশান্তি চলে আসলো এরপর হুযুর নবীয়ে রাহমত এরশাদ করলেন, হে আবু বকর (রাঃ) এখনও কি আমার সাথে সাক্ষাতের সময় আসেনি?এই কথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) চোখেরপানি ছেরে দিয়ে বলেন,আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনার সাথে আমার সাক্ষাতের সৌভাগ্য কখন হবে?এরপর ঘুম থেকে উঠে সবাইকে বললেন আমার সময় শেষ এবং হযরত আলী(রাঃ) কে ডেকে আনলেন হযরত ওসমান(রাঃ)দ্বারা ওসিয়ত নামা লিখে রাখলেন,আর হযরত আলী(রাঃ) কে বলেন,যে হাত মুবারক দ্বারা আপনি প্রিয়নবীর বদন মোবারককে গোসল মোবারকদিয়েছেন সেই হাত মুবারক দ্বারা আমাকে গোসল দিবেন,এরপর আমার পুরানো কাপড় দ্বারা আমাকে কাফন দিবেন এবং আমাকে খাটিয়ার মধ্যে রেখে জানাযার নামাজের পর হুজুর হায়াতুন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রওজায়ে পাকের সামনে এনে এক সালাম আরজ করে অনুমতি চাইবেন,আপনার গুহার সাথী আপনার দরজায় উপস্থিত,একান্ত বাসনা আপনার কদমের নিকটে যদি একটু স্থান মেলে,তাহলে জীবন ধন্য। অপর বর্ণনায় রয়েছে তার স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস এবং আপন সন্তান আব্দুর রহমান তাঁকে গোগসল মোবারক,আম্মাজান আয়শা ছিলেন তাহার কন্যা, চোখের পানি ফেলে কাদতেছেন, কথামত জানাজা নামাজের পর রওজা শরীফের সামনে এনে সালাম আরজ করা হল, হুজরা শরীফের বন্ধ দরজা আপনা-আপনি খুলে গেলো এবং এই শব্দের আওয়াজ শুনা গেল- “বন্ধুকে বন্ধুর সাথে মিলায়ে দাও, কেননা বন্ধু বন্ধুর সাথে সাক্ষাতের জন্য পাগল পারা হয়ে আছে।” (সিরাতুল সালেহিন ৯৬পৃষ্ঠা)হিজরি ত্রয়োদশ সনের ২২ই জমাদিউস সানী রোজ সোমবার ৬৩ বৎসর বয়সে ওফাত মুবারক হয়।
ইসলামের ত্রাণকর্তা হিসাবে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) অবদান:
কুরআনুল কারীমকে সংরক্ষণঃ
ইয়ামামার যুদ্ধে বহু কুরআনের হাফিজগন শহীদ হয়ে যান, তখন সাহাবায়ে কিরামগন চিন্তিত হয়ে পড়লেন যে, এভাবে যদি হাফেজে কুরআনগণ ক্রমান্বয়ে শহীদ হতে থাকেন । তাহলে আমরা অচিরেই কুরআনুল করিম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো, তখন আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) সর্ব প্রথম খোলাফায়ে রাশেদিনদের নিয়ে কুরআনুল কারিম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলেন।নিঃসন্দেহে ইহা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) এঁর মহান খেদমতে যা আজো মুসলমান স্মরণ করেন।
ভণ্ড নবী দাবীদের দমনঃ
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওফাত মুবারকের পর বহু ভণ্ড নবীর আবির্ভাব হয়েছিল। এদের মধ্যে মুসায়েলামাতুন কাজ্জাব অন্যতম। তিনি তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেন।
যাকাত ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনঃ
যারা যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেন এবং সুষ্ঠভাবে যাকাত গ্রহণের ব্যবস্থা করেছিলেন।
অতএব, পরিশেষে আমরা বলতে পারি, ইসলামের ত্রাণকর্তা হিসেবে হযরত আনু বকর সিদ্দিক (রাঃ) মুসলিম জাহানের খেলাফতের মসনদে সমাহিন হওয়ার পর যে সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তা চিরকাল মুমিনদের হৃদয় পটে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)
ইসলাম ধর্ম গ্রহন
হযরত (সঃ) এর নবুওয়াতের প্রথম পর্যায়ে উমার (রাঃ) ছিলেন ঘোর ইসলাম বিরোধী । মক্কার নবদীক্ষিত মুসলিমদের উপর তিনি নির্যাতন চালাইতেন । তিনি ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করিতেছিলেন বটে, কিন্তু পরোক্ষে ইসলামের প্রভাবে তাহার শুভবুদ্ধি ক্রমশ জাগরিত হইতেছিল । রাসূল (সঃ) এর অজ্ঞাতসারে একদা তাহার মুখে কুরানের আবৃত্তি শুনিয়া তাহার মনে ভাবান্তর ঘটার বর্ননা পাওয়া যায় । একদিন ভগিনী ও ভগ্নীপতিকে ইসলামে গ্রহণের জন্য নির্দয়ভাবে শাসন করিতে গিয়া নিজেই তিনি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়েন এবং রাসূল (সঃ) এর নিকট উপস্থিত হইয়া ইসলাম গ্রহণ করেন । ইসলাম গ্রহণের ফলে তাহার জীবনের আমূল পরিবর্তন হয় । পরবর্তীকালে তিনি ইসলামের সেবার অক্ষয় কীর্তি রাখিয়া যান ।
খিলাফত লাভের পূর্বে খেদমত
হিজরতের চারি বৎসর পূর্বে যখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাহার বয়স ছিল ছাব্বিশ বৎসর । তাহার পর হইতে তিনি পূর্ন শক্তিতে ইসলামের খিদমতে ঝাপাইয়া পড়েন । তাহার গোত্র বানু আদি ইবন্ কা’ব হইতে এই ব্যাপারে তিনি কোন সাহায্য পান নাই । মদিনায় তাহার ব্যক্তিগত উদ্যম এবং মনোবলের প্রভাবেই তিনি রাসূল (সঃ) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজে মর্যাদা লাভ করেন, গোত্রীয় মর্যাদারকারণে নয় । সৈনিক হিসাবেও তাহার প্রভূত খ্যাতি ছিল । তিনি বদর, উহুদ ও অন্যান্য যুদ্ধে যোগদান করেন । হাদিছে আছে যে, কুরআনের কয়েকটি স্থানে উমার (রাঃ) এর উক্তি সমর্থনে অয়ায়হি অবতীর্ন হইয়াছিল । যথাঃ ২:১২৫- কাবা গৃহের পার্শস্থ মাকাম ইব্রাহীমে সালাত আদায়; ৩৩:৫৩, রাসূল (সঃ) বিবিগণের সামনে পর্দা পালন ইত্যাদি । সাহাবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বে হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) হযরত উমার (রাঃ) এর অগ্রগণ্য ছিলেন । হযরত উমার (রাঃ) বিনয় সহকারে তাহা স্বীকার করিতেন এবং সর্বদা হযরত আবু বকর (রাঃ) কে যথোপযুক্ত সম্মান দেখাইতেন । তাহাদের কন্যাগণ রাসূল (সাঃ) এর পবিত্র বিবি তথা উম্মতের জননী হইবার সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছিলেন । রাসূল কারীম (সঃ) এর বিবি হযতর হাফসা (রঃ) হযতর উমার (রাঃ) এর কন্যা ছিলেন । রাসূল কারীম (সঃ) এর ওফাতের পর হযরত উমার (রাঃ) ই সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর (রাঃ) এর নিকট বায়াত হন ।
খেলাফত লাভ ও শাসনকার্য
হযরত আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফাতকালে হযরত উমার (রাঃ) ই ছিলেন তাহার প্রধান উপদেষ্টা । মৃত্যুর পূর্বে তিনি উমার (রাঃ) কেই তাঁহার স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করেন, সাহাবীগণও সর্ব-সম্মতভাবে উমার (রাঃ) কে তাহাদের খলীফারুপে গ্রহণ করেন এবং এইরূপে নেতা নির্বাচনের আরবীয় প্রথানুসারে জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতেই উমার (রাঃ) তাঁহার খিলাফাত শুরু করেন । ঘরে বাহিরে উমার (রাঃ) যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হইলেন পূর্ব হইতেই তিনি ইহার সহিত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন । মুসলিম রাষ্ট্রের পরিধি বৃদ্ধি করিবার জন্য যুদ্ধ করা তাঁহার অভিপ্রেত ছিল না । নৌ-যুদ্ধ তাঁহার দৃষ্টিতে অধিকতর অবাঞ্ছিত, কিন্তু মুসলিম শক্তিকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করিবার জন্য বদ্ধপরিকর বিরুদ্ধ শক্তিগুলির সহিত মুকাবিলায় তিনিই ছিলেন অধিনায়ক । যে সকল সেনাপতি মুসলিমদের প্রয়াসকে সাফল্যমণ্ডিত করিয়াছিলেন তিনি ছিলেন তাহাদের সকলের নিয়ন্তা । এইক্ষেত্রে তাঁহার কৃতিত্ব সর্বজনবিদিত । ইসলামের স্বার্থে খালিদ (রাঃ) এর ন্যায় একজন সুদক্ষ সেনাপতিকেও তিনি পদচ্যুত করিয়াছিলেনএবং খালিদ (রাঃ)ও এই পদচ্যুতি অবনত মস্তকে মানিয়া লইয়াছিলেন । ইহা তাঁহার বলিষ্ঠ কৃতিত্বেরই পরিচায়ক । এই ঘটনা হইতে রাসুল (সঃ) এর সাহাবী (রাঃ) গনের চরিত্র বৈশিষ্ট্যেরও পরিচয় মিলে । ‘আম্র ইবনুল আস (রাঃ) এর মিসর বিজয়ের প্রস্তাবে সম্মতি দান করিয়া তিনি খুবই দূর-দৃষ্টির পরিচয় দেন । তিনি রাসূল কারীম (সাঃ) এর বিশিষ্ট সাহাবীদিগকে সম্ভ্রমবশত সাধারণ সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ করিতেন না । কিন্তু প্রয়োজন হইলে গুরুত্বপূর্ন পদে তাহাদিগকে নিয়োগ করিতে দ্বিধাবোধ করিতেন না । এইরূপে ইরাক ও সিরিয়ার শাসনকর্তা হিসাবে তিনি কয়েকজনকে নিযুক্ত করেন ।
হযরত উমার (রাঃ) এর সময়েই ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তব ভিত্তি স্থাপিত হয় । এই সময়েই অনেকগুলি ইসলামী বিধি-ব্যবস্থা বাস্তব রূপ লাভ করে বলিয়া কথিত হয় । এইগুলির পূর্ন রুপায়ন ঐতিহাসিক বিকাশ ধারা অনুসারে ক্রমে ক্রমে সাধিত হইলেও ইহাদের সূচনা হযরত উমার (রঃ) এর সময়েই হইয়াছিল । যখনই কোন প্রশ্ন বা সমস্যার উদ্ভব হইত, তিনি সাহাবী (রাঃ) গনকে একত্র করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেন সেই ব্যাপারে হযরত (সঃ) এর কোন উক্তি বা সিদ্ধান্ত আছে কিনা তাহাদের সহিত আলোচনার ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেন । কুরআন ও সুন্নাহ্ই ছিল তাঁহার সংবিধান এবং বিশিষ্ট সাহাবী [যথা আলী, আব্দুর রাহমান ইবন আওফ (রাঃ) প্রমুখ] গণ ছিলেন তাঁহার পরামর্শ সভার সদস্য । দীনতম নাগরিকও তাঁহার কর্মের সমালোচনা করিতে শুধু সাহসীই নহে বরং উৎসাহিতও হইতেন-ইহার বহু নজির পাওয়া যায় । তাঁহার জীবন যাপনের মান সাধারণ নাগরিকের অনুরূপ ছিল । এই বিষয়ে হযরত উমার (রাঃ) এর দৃষ্টান্ত সত্যই বিরল ।
জিম্মি (মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিক) গণের অধিকার সংরক্ষণ, সরকারি আয় জনগণের মধ্যে বণ্টনের জন্য দীওয়ান ব্যবস্থার প্রবর্তন, সামরিক কেন্দ্র (যথাঃ বসরা, কুফা)- সমূহ প্রতিষ্ঠা (এই সকল কেন্দ্র হইতেই উত্তরকালে কয়েকটি বৃহৎ নগরীর সৃষ্টি হয়) । এতদ্বব্যতিত ধর্মীয়, পৌর এবং দণ্ডবিধি সঙ্ক্রান্ত বিশেষ বিধিও তিনি প্রবর্তন করেন । যথাঃ তারাবীহের সালাত জামা’আতে সম্পন্ন করা, হিজরি সনের প্রবর্তন, মদ্যপানের শাস্তি ইত্যাদি ।
আবু বকর (রাঃ) খলীফা (খালীফাতু রাসুলুল্লাহ বা রাসুলের প্রতিনিধি) বলিয়া অভিহিত হইতেন । তদনুসারে উমার (রাঃ) ছিলেন রাসূলের খলীফার খলীফা । হযরত (সঃ) নেতা অর্থে সাধারনত আমীর শব্দের ব্যবহার করিতেন এবং আরবদের মধ্যে এই শব্দের ব্যবহার প্রচলিত ছিল । ১৯ হিজরিতে তিনি এই উপাধি গ্রহণ করেন । সম্ভবত তিনি নিজকে রাসূল (সঃ) এর খলীফা বা স্থলাভিষিক্ত বলা বা মনে করাকে ধৃষ্টতারুপ গণ্য করিতেন । হাদিছে বিবৃত হইয়াছে যে, রাসূল (সঃ) বলিয়াছেন, “আমার পর কেহ নবী হইলে উমার নবী হইত ।” (দ্রঃ আল মুহিব্বুত-তাবারী, মানাকিবুল আশারাঃ ১খ, ১৯৯)
শাহাদত
উমার (রাঃ) এর অন্তরে আল্লাহ্র ভয় ও ভক্তির মধ্যে দৃশ্যত ভয়ই ছিল প্রবলতর । তিনি যে সম্মান অর্জন করেন তাহা তাঁহার চরিত্রগুণের কারনে, শারীরিক শক্তির জন্য নহে । যদি আবু উবায়দা (রাঃ) জীবিত থাকিতেন তবে তাহাকেই তাঁহার স্থলাভিষিক্তরুপে মনোনীত করিতেন, তাঁহার এইরূপ ইচ্ছা প্রকাশের বিবরন পাওয়া যায় । হযরত (সঃ) এর সত্যিকারের সাহাবী এবং কুরআন ও সুন্নাহ্র পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসারী খলীফারুপে মর্যাদার উচ্চ শিখরে সমাসীন থাকাকালে ২৬ জুল হিজ্জাঃ ২৩/৩ নভেম্বর, ৬৪৪ সালে তিনি মুগীরাঃ ইবন শু’বা’র খ্রিষ্টান ক্রীতদাস আবু লু’লু’র ছুরিকাঘাতে শাহাদাত প্রাপ্ত হন । ইতিহাসে কথিত হইয়াছে যে, উমার (রাঃ) এর নিকট আবু লু’লু’ তাঁহার মনিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে । উমার (রাঃ) এর বিচারে অসন্তুষ্ট হইয়া সে নিহায়েত ব্যক্তিগত আক্রোশের বশে অতর্কিতভাবে তাহাকে হত্যা করে । মৃত্যুর পূর্বে উমার (রাঃ) ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবীর নামোল্লেখ (‘উছমান এবং আলী (রা:) ও তাহাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ) করিয়া পরামর্শক্রমে তাহাদের মধ্যে একজনকে খলীফা মনোনীত করার উপদেশ দিয়া যান । ইহার ফলে হযরত উছমান (রাঃ) খলীফা মনোনীত হন ।
আল মুহিব্বুল তাবারীর আর-রিয়াদুন-নাদিরা ফী মানাকিবিল আশারাঃ, কায়রো ১৩২৭, পুস্তকে তাঁহার গুণাবলীর আলোচনা আছে । শী’আ সম্প্রদায় তাহাকে ভাল চক্ষে দেখে নাই; কারন তাঁহারা মনে করে, যাহাদের কারণে আলী (রাঃ) রাসূল (সঃ) এর খিলাফাতে অধিষ্ঠিত হইতে পারেন নাই, উমার (রাঃ) তাহাদের অন্যতম । সূফীগণ হযরত উমার (রাঃ) এর অনাড়ম্বর জীবন যাপন পদ্ধতির প্রশংসা করিয়াছেন ।
হযরত উসমান ইব্ন আফ্ফান (রাঃ)
উসমান ইব্ন আফফান (রাঃ) ইসলামের তৃতীয় খলিফা । তিনি মক্কার বিখ্যাত বানু উমায়্যা গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি এই বংশের আবুল আসীর পৌত্র ছিলেন । রাসূল (সঃ) এর নবুওয়ত লাভের প্রথম দিকেই হিজরাতের বেশ পূর্বে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন । উমায়্যাগন অনেক পরে ইসলাম গ্রহণ করিলেও ব্যক্তিগতভাবে হযরত উসমান (রাঃ) এই সৎ সাহসের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেন । তিনি একজন ধনী ব্যবসায়ী ( সেহেতু তাহকে উসমান গনী বলা হইত) এবং সামাজিক খ্যাতি ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন । তিনি সৌন্দর্য ও শালীনতার প্রতীক ছিলেন । রাসূল (সঃ) এর কন্যা রুকায়ার সহিত তাঁহার বিবাহ ইসলাম গ্রহণের পর সঙ্ঘটিত হয় এবং তিনি বিবাহের পর পত্নীসহ আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন (শিবলী, সীরাতুন্নাবী ২খ, ৪২৬) । হযরত উসমান (রাঃ) আবিসিনিয়াতে মুসলিমগণের দুইটি হিজরাতেই অংশগ্রহণ করেন । তৎপর মদিনায় মুহাজিরগণের সহিত মিলিত হন। তাঁহার স্ত্রী পিড়িটা থাকায় তিনি বাঁদরের যুদ্ধে যোগদান করিতে পারেন নাই । হযরত রুকায়্যার (রাঃ) মৃত্যুর পর রাসূল (সঃ) হযরত উসমান (রাঃ) এর সহিত তাঁহার অপর এক কন্যা উম্মু কুলছুমের বিবাহ দেন । এই কারণে তাহাকে যুন-নুরাইন (দুই জ্যোতির অধিকারী) বলা হইত ।
হযরত উমার (রাঃ) ইন্তিকালের পূর্বে খলীফা নির্বাচনের উদ্দেশ্যে বিশিষ্ট যে ছয়জন সাহাবীর সমন্বয়ে একটি মাজলিস গঠন করিয়াছিলেন হযরত উসমান (রাঃ) ছিলেন তাহাদের অন্যতম । তাহারা সর্বসম্মতিক্রমে উসমান (রাঃ) কে খলীফা পদে মনোনীত করেন । হযরত উসমান (রাঃ) তাঁহার খিলাফাতকালে কুরআন ও সুন্নাহ্র নীতি অনুসরণ করেন ।
হযরত উসমান (রাঃ) এর খিলাফাতের সপ্তম বৎসরে মুসলিমদের প্রথম অন্তবিরোধ আরম্ভ হয় । এবং স্বয়ং খলীফা এই বিরোধ বহ্নিতে শাহাদাত বরন করেন । আরব ঐতিহাসিকগণ এই ব্যাপারে খলীফার বিরুদ্ধবাদীগণের অভিযোগসমূহ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন (আত-তাবারীকৃত আর রিয়াদুন নাদিরাঃ ফী মানাকিবিল আশারাঃ , কায়রো ১৩২৭ হিঃ, ২খ ১৩৭-১৫২ পুস্তকে ইহার বিস্তারিত আলোচনা আছে )। তাঁহার বিরুদ্ধে প্রথম এবং প্রধান অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি তাঁহার আত্মীয় স্বজনগণকে প্রাদেশিক শাসঙ্কর্তার পদে নিযুখ করিয়াছিলেন । বাস্তবিকপক্ষে এই শাসনকর্তাদের অধিকাংশই উয্রত উমার (রা;) এর সময়েই নিযুক্ত হইয়াছিলেন । হযরত উমার (রাঃ) এর সময়েই প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণের স্বাতন্ত্র্য-প্রিয়তার জন্য তাহাদিগকে খলীফার ক্ষমতাধীনে রাখা ক্রমশ দুরূহ হইয়া উঠিতেছিল । কিন্তু হযরত উমার (রাঃ) তাঁহার ব্যক্তিত্ব প্রভাবে প্রাদেশিক শাসনকর্তাগনকেও আয়ত্তে রাখিতে সক্ষম হইয়াছিলেন । হজরত উসমানের নমনীয়তার সুযোগ লইয়া তাঁহার গোত্রীয় আত্মীয়-স্বজনগণ তাঁহার উপর প্রাধান্য বিস্তারকরে । তাঁহার বিরুদ্ধে আর একটি অভিযোগ এই ছিল যে, তিনি বিজয়লব্ধ ধন-সম্পত্তির একাংশ তাঁহার আত্মীয় স্বজনকে দান করিয়াছিলেন । উসমানী খিলাফাতের পূর্বে যে মধ্যপ্রাচ্যের অমুসলিম দেশগুলির বিরুদ্ধে যে জিহাদ চলিতেছিল, তাহাতে যে “মালু’ল গানীমা” পাওয়া যাইত তাহা সমস্ত সৈনিকের মধ্যে বণ্টন করিয়া দেওয়া হইত । ইহা হইতে কিছু কিছু অংশ বিশেষভাবে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণকে দেওয়া হইত । হযরত উসমান (রাঃ) জনগনের সম্পদ হইতে অন্যায়ভাবে কাহাকেও কিছু দেন নাই । ব্যক্তিগত সম্পদ হইতে অনেক সময় আত্মীয় স্বজনকেও দান করিতেন । হযরত উসমান (রাঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ) সংগৃহীত কুরআন মজিদের প্রামাণ্য অনুলিপি প্রস্তুত করাইয়া প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণের নিকট পাঠাইয়া দেন এবং আঞ্চলিক পাঠ বৈষম্যযুক্ত অনুলিপিগুলি জ্বালাইয়া ফেলিতে আদেশ দেন । হযরত উসমান (রাঃ) এর এই কার্যের উদ্দেশ্য ছিল যে, বিস্তীর্ন মুসলিম খিলাফাতে প্রচলিত আরবী বাক-রীতির অনুপ্রবেশে যেন কুরআনে পাঠ-বৈষম্যের সৃষ্টি না হয় । অথচ ইহাকেও তাঁহার বিরুদ্ধবাদীরা আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে ।
হযরত উসমান (রাঃ) এর সময়ে অশান্তির ঘটনা প্রবাহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এইরূপঃ
হযরত উসমান (রাঃ) এর দ্বাদশ বর্ষব্যাপী খিলাফাতকাল দুই অংশে বিভক্ত । প্রথম ছয় বৎসরে (২৩-২৯) শান্তি বিরাজ করে এবং শেষ ছয় বৎসর (৩০-৩৫) অশান্তির কাল । এই বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র ছিল মিসর । সেই সমুদয় ইহুদী যাহারা শুধু মৌখিকভাবে লোক দেখানোর জন্য ইসলাম গ্রহণ করিয়াছিল । এই ষড়যন্ত্রকারী দলের নেতা ছিল মুসলমান ছদ্মবেশী ইহুদী সন্তান আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা । সানআর অধিবাসী আব্দুল্লাহ ইব্ন সাবা ইসলাম গ্রহণের কিছুকাল পর মদিনায় আসিয়া বসবাস আরম্ভ করিল । হযরত আলী (রাঃ) এর নাম নিয়া হযরত উসমান (রাঃ) এর বিরুদ্ধে মুসলমানদিগকে উসকাইতে লাগিল । ইহার পর সে বসরায় গিয়া একই প্রক্রিয়ায় উসমান (রাঃ) এর বিরুদ্ধে জনসাধারণকে উত্তেজিত করিতে লাগিল । তারপর কুফা ও দামেস্কে গিয়া একই কাজ করিতে লাগিল । অবশেষে মিসরে পৌঁছাইয়া জনসাধারণকে এত উত্তেজিত করিয়া তুলিল যে, তাঁহারা উসমান (রাঃ) কে নিহত করাকেই জাতির স্বার্থে সর্ববৃহৎ কর্ম বলিয়া মনে করিতে লাগিল । কিছুকাল যাবত এইরূপ দুর্যোগের যে মেঘ পুঞ্জীভূত হইতেছিল ৩৫ হিঃ এর শেষে তাঁহার বইঃপ্রকাশ ঘটিল । বিভিন্ন প্রদেশের বিদ্রোহীগণ মদিনার দিকে যাত্রা করে । সর্বপ্রথম আসে মিসরীয়গণ । খলীফার সহিত সাক্ষাতে তাঁহার তাহাদের অভিযোগসমূহ অতিশয় তীব্র ভাষায় প্রকাশ করে । কিন্তু খলীফার নম্র এবং শান্ত ব্যবহারে তাঁহার প্রশমিত হয় । খলীফা তাহাদিগের সমস্ত দাবী মানিয়া লন ।
কিন্তু পথিমধ্যে আল-আরীশ নামক স্থানে হযরত উসমান (রাঃ) এর এক দূত ধরা পড়ে এবং তাঁহার নিকট একটি পত্র পাওয়া যায় । ইহা মিসরের গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে সা’দের নিকট লিখিত ছিল । পত্রে আন্দোলনের এই নেতৃবৃন্দকে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর মৃত্যুদণ্ড দিতে কিংবা অঙ্গচ্ছেদ করিতে বলা হইয়াছিল । এই পত্র হস্তগত হওয়ায় ফলে বিদ্রোহীগণ ক্রোধান্বিত হইয়া প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে মদিনায় ফিরিয়া আসে ।
হযরত উসমান (রাঃ) এই পত্র তাঁহার লিখিত বলিয়া অস্বীকার করেন এবং ইহা তাঁহার শতুগনের দুরভিসন্ধিমূলক কার্য বলিয়া অনুমান করেন । অবশেষে লেখার পদ্ধতিতে ধরা পড়িল যে, ইহা মারওয়ানের লেখা । হযরত আলী (রাঃ) ও অপরাপর সাহাবাগন আপ্রাণ চেষ্টা করিলেন যাহাতে বিদ্রোহীগণ মদীনা ত্যাগ করিয়া চলিয়া যায় । বিদ্রোহীগণ বুঝিতে পারিল যে চিঠি সত্যই উসমানের (রাঃ) লেখা নয় । তথাপিও তাহারা উসমান (রাঃ) এর খিলাফাত ত্যাগের জন্য আন্দোলন চালাইয়া গেল । বিদ্রোহীগণ হযরত উসমান (রাঃ) কে গৃহে অবরুদ্ধ করিয়া রাখে । হযরত উসমান (রাঃ) বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে সাহাবীগণকে নিষেধ করেন । কিন্তু তাহাদের কেহ কেহ আপন পুত্রগণকে হযরত উসমান (রাঃ) এর গৃহদ্বারে প্রহরী নিযুক্ত করেন । হযরত আইশা (রাঃ) এই সময়ে মক্কায় হাজ্জকরিতে গিয়াছিলেন । হযরত উসমান (রাঃ) নিজ মর্যাদায় অবিচলিত থাকিয়া ঘোষণা করিয়া দিলেন যে, তিনি কোন অবস্থাতেই খিলফাত ত্যাগ করিবেন না । কয়েকদিন এইরূপ অবরোধের পর কতিপয় ব্যক্তি ৩৫ হিঃ (জুন ৬৫৬) মুহাম্মদ ইব্ন আবী বকরের নেতৃত্বে খলিফার গৃহাভ্যন্তএর প্রবেশ করিয়া তাহাকে আক্রমণ করে । খলিফা এই সময় কুরআন পাঠ করিতেছিলেন । তাঁহার রক্ত কুরআনের উপর ছিটকাইয়া পড়ে । তাঁহার কাল্ব গোত্রীয়া স্ত্রী নাইলা বিন্ত ফুরাফিসা আহত হন । খলীফার শাহাদাতের পর রাত্রে অতি গোপনীয়তার সহিত তাঁহার মৃতদেহ কয়েকজন আত্মীয় দাফন করেন । মু’আবিয়া (রাঃ) সিরিয়া হইতে খলীফাকে সাহায্য করিবার মানসে একদল সৈন্য প্রেরণ করিয়াছিলেন । পথে খলফার নিহত হওয়ার সংবাদ পাইয়া আবার তাঁহার সিরিয়ায় ফিরিয়া যায় ।
এই হত্যাকাণ্ডের ফলে ইসলামের রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় একতা নষ্ট হইয়া যায় এবং ধর্মীয় মতবিরোধ ও গৃহযুদ্ধের যুগ আরম্ব হয় । হযরত উসমান (রাঃ) এর খিলাফাত এবং ইহার রক্তাক্ত সমাপ্তি ইসলামের ইতিহাসে একটি করুন ও যুগান্তকারী ঘটনা ।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত উসমান (রাঃ) অত্যাধিক নির্মল চরিত্রসম্পন্ন ছিলেন এবং সরলপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন । নম্রতা, ধর্মপ্রানতা ইত্যাদি গুণাবলী তাঁহার চরিত্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল । কোরআনসঙ্কলনের বিশেষ অবদানের জন্য তাহাকে জা’মেউল কোরআন উপাধি দেয়া হয় । হাদিসে আছে রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলিয়াছেন “ বেহেশতে প্রত্যেক নবীরই সঙ্গী থাকিবে । আমার সঙ্গী হইবে উসমান ।”
হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (রাঃ)
হযরত আলী (রাঃ) হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর চাচাত ভাই ও জামাতা এবং চতুর্থ খলীফা । তাঁহার পিতা আবু তালিব ছিলেন আব্দুল মুত্তালিব ইবন হাশিমের পুত্র । আলী (রাঃ) এর ডাক নাম আবু তুরাব, হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর নিকট হইতে প্রাপ্ত । তিনি হযরত (সঃ) এর কন্যা ফাতিমা (রাঃ) কে বিবাহ করেন । তাঁহার মাতার নাম ফাতেমা বিনতে আসাদ ইবন হাশিম । ইসলাম গ্রহণের সময় তাঁহার বয়স কত ছিল তাহা সঠিকরূপে নির্ধারন করা যায় না । হযরত খাদীজা (রাঃ) এর পরে তিনি প্রথম মুসলিম; আবুযার, আল মিকদাদ, আবু সাইদ আল খুদরী (রাঃ) প্রমুখের মতে বুরায়দা ইবনিল হুসায়ব (রাঃ) অথবা তিনি দ্বিতীয় মুসলিম । হযরত (সঃ) যে দশজনকে জান্নাতে প্রবেশ লাভ করিবেন বলিয়া স্পষ্টভাবে সুসংবাদ প্রদান করেন, তিনি তাহাদের অন্যতম । উমার (রাঃ) কর্তৃক তাঁহার মৃত্যুশয্যায় মনোনীত ছয়জন নির্বাচকেরও তিনি ছিলেন অন্যতম ।
হযরত আলী (রাঃ) এর বয়ছ ছিল তখন প্রায় বাইশ বছর । আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ইয়াছরিবে হিজরত করার শেষ রাতে শত্রুদের চোখের সামনে দিয়া নিরাপদে গৃহ ত্যাগ করিলেন । যাবার সময় হযরত আলী (রাঃ) কে আমানতের গচ্ছিত সম্পদ প্রদানের দায়িত্ব দিয়া গেলেন । প্রত্যুষে শত্রুপক্ষ দেখিল, রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর বিছানায় শেরে খোদা হযরত আলী (রাঃ) নিশ্চিন্ত মনে শুইয়া আছে ।
হিজরাতের দ্বিতীয় বর্ষে হযরত (সঃ) এর প্রিয় কন্যা ফাতেমা (রাঃ) এর সহিত আলী (রাঃ) এর বিবাহ সম্পন্ন হয় । বিবাহের সময় হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর বয়স ছিল ১৪ বছর এবং হযরত আলী (রাঃ) এর বয়স ছিল ২২ বছর । (তাবাকাতে ইবনে সা’দ, এসাবা, খোলাফায়ে রাশেদিন) । তিনি বদর, উহুদ ও খন্দক(পরিখা) এর যুদ্ধে যোগদান এবং তাবূক ছাড়া অন্য সমস্ত অভিযানে হযরত (সঃ) এর সঙ্গে গমন করেন । তাবূক অভিযানের সময় হযরত (সঃ) এর অনুপস্থিতিতে তাঁহার পরিবার-বর্গের তত্ত্বাবধান এবং মদিনার শাসনভার তাঁহার উপর ন্যস্ত ছিল । উহুদের যুদ্ধে তিনি ষোলটি আঘাতপ্রাপ্ত হন; তাঁহার প্রচণ্ড আক্রমণে খায়বারের দুর্জয় কা’মূস দূর্গের পতন ঘটে ।
হযরত (সঃ) এর উপর নবম সূরা (আল বারা’আঃ বা আত-তাওবা) অবতীর্ন হওয়ার অল্প পরে উহার প্রথম তেরটি আয়াত হাজ্জের সময় মিনা প্রান্তরে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করার জন্য হযরত (সঃ) তাহাকে প্রেরণ করেন । দশম হিজরি, মুতাবিক ৬৩১-৩২ সনে আলী (রাঃ) ইয়ামানে এ প্রচার সফরে গমন করেন । ইহারই ফলে হামাদানীরা ইসলাম গ্রহণ করে । এ বছরই রাসুল (সঃ) হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কাশরীফ গমন করেন ; হজ্জ হতে ফেরার পথে তিনি হযরত আলী (রাঃ) এর হাত ধরিয়া ফরমাইলেন “আমি যাহার মওলা হই, ইনিও অর্থাৎ হযরত আলী (রাঃ)ও তাঁহার মওলা ।”
হিজরাতের বছরকে ইসলামী সনের প্রারম্ভ হিসাবে গ্রহণের জন্য আলী (রাঃ) ই উমার (রাঃ) কে পরামর্শ দেন । হযরত উছমান (রাঃ) এর ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রদেশসমূহ হইতে অভিযোগ আসিলে তাঁহার নিকট অভিযোগগুলি উত্থাপনের ভার আলী (রাঃ) এর উপর অর্পিত হয় । উছমান (রাঃ) এর সময়ে অরাজকতা দেখা দিলে আলী (রাঃ) খালীফা ও বিক্ষুব্ধদের মধ্যস্থের কাজ করেন । উছমান (রাঃ) এর গৃহ অবরোধের সময় আলী (রাঃ) তাঁহার আনুকূল্য প্রদর্শন করেন এবং তাঁহার নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন । উছমান (রাঃ) এর শহীদ হওয়ার পর তিনি খিলাফাতের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব প্রথমে বিনীতভাবে অস্বীকার করেন, কিন্তু পাঁচ দিন পরে সাহাবীদের অনুরোধে সাহাবীদের অনুরোধে তাহা গ্রহণ করেন । ৩৫ হিজরির জুলহিজ্জা শুক্রবার (জুন ২৪, ৬৫৬) মদিনার মসজিদে সমবেত মুসলিমগণ খালীফা হিসাবে তাঁহার হাতে বায়া’ত করেন ।
খিলাফাত গ্রহণের পরেই সর্বপ্রথম তিনি হযরত উসমান গনী (রাঃ) এর হন্তাদের খোঁজ করেন । কিন্তু প্রকৃত হন্তার কোন সন্ধান পাইলেন না । হযরত আলী (রাঃ) উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন যে বনু উমাইয়াদের বিশৃঙ্খলার দরুনই ইসলামী খিলাফাত এমন গুরুতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হইয়াছে । তাই তিনি উচ্চপদস্থ সকলকে একে একে রদবদল করিলেন । এই রদবদলে হযরত ওসমান ইবনে হানীফ (রাঃ) বসরার এবং হযরত সাহল (রাঃ) সিরিয়ার গভর্নর নিযুক্ত হন ।
হযরত সাহল (রাঃ) সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হইলে তবুক নামক স্থানে আমীর মুআবিয়া (রাঃ) এর লোকদের দ্বারা বাঁধা প্রাপ্ত হন । আমীর মুআবিয়া (রাঃ) হযরত উসমান গনী (রাঃ) এর হত্যার প্রতিশোধ লইবার জন্য শর্ত জুড়িয়া দেন । এদিকে হযরত আলী (রাঃ) উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদের সন্ধান না পাওয়ায় হযরত তালহা (রাঃ) এবং হযরত যুবাইর (রাঃ) অসন্তুষ্ট হইয়া মক্কায়চলিয়া গেলেন । এসময় হযরত আয়েশা (রাঃ) হজ্জ পালনে নিমিত্ত মক্কায় অবস্থান করিতেছিলেন । সিরিয়া ও কুফা ব্যতীত অন্যান্য স্থানে আলী (রাঃ) এর নিযুক্ত গভর্নরগণ সমর্থন পান । এই পরিস্থিতিতে হযরত আলী (রাঃ) বুঝিতে পারিলেন যে, যুদ্ধ ব্যতীত এই গুরুতর পরিস্থিতির মোকাবেলা করা সম্ভবপর হইবে না । হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে এই ফ্যাসাদ ও বিদ্রোহের পরিচালক মারওয়ান ইবনে হাকাম তখন মক্কায় অবস্থান করিতেছিলেন । মুআবিয়া (রাঃ) এর সমর্থকদের একটা বিরাট দলও তাঁহার সাথে ছিল । তাহারা মিলিয়া হযরত আয়েশা (রাঃ) কে হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিতেছিল এবং তাহাকে বসরায় গিয়া হযরত তালহা (রাঃ) এর সমর্থকদের সঙ্গে লইয়া মদিনায় গমন করিতে উদ্বুদ্ধ করিলেন । হযরত আলী (রাঃ) বসরার এইরূপ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হন । মদীনা হইতে বসরাভিমুখে যখন রওনা হন তখন সুযোগসন্ধানী আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা এবং তাঁহার সঙ্গীরা হযরত আলী (রাঃ) এর সৈন্যদলে যোগদান করেন । প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত কাকা (রাঃ) কে তিনি আয়েশা (রাঃ) প্রমুখের খেদমতে প্রেরণ করিয়া মতানৈক্য দূর করার প্রয়াস চালান । হযরত কাকা (রাঃ) যুক্তিসঙ্গত বিবৃতির মাধ্যমে তাহাদের মধ্যে মতভেদ দূর করিতে সমর্থ হন । কিন্তু রাত্রিকালে উভয় দলে উপস্থিত মুনাফিকেরা কুচক্র করিয়া একে অপরের উপর ঝাপাইয়া পড়িয়া যুদ্ধ সৃষ্টি করিল । হযরত আয়েশা (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ) উভয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করিয়া যুদ্ধ থামাইতে চেষ্টা চালাইতেছিলেন ।
যুদ্ধ চলাকালে একসময় হযরত আলী (রাঃ) অশ্বারোহণে হযরত যুবাইর (রাঃ) এর কাছে আসিয়া ফরমাইলেন, ‘হে আবু আব্দুল্লাহ ! তুমি রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর সম্মুখে এই কথা বলিয়াছিলে যে, আমি হযরত আলীকে ভালবাসি’। এতদুত্তরে রসুলুল্লাহ (সঃ) ফরমাইয়াছিলেনঃ “তুমি একদিন অনর্থক আলীর সহিত যুদ্ধ করিবে । “ কথাটা তোমার স্মরণ আছে কি ?’
হযরত যুবাইর (রাঃ) কথাটা শ্রবণ করামাত্রই চমকিয়া উঠিলেন এবং রণক্ষেত্র ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন এবং সেবাহ্ নামক ময়দানে গিয়া নামাজ পড়িতে লাগিলেন । কিন্তু আমর ইবনে জরমুয নামক জনৈক সাবাঈ তাহাকে নামাজরত অবস্থায় তরবারি দ্বারা শহীদ করিল । হযরত আলী (রাঃ) যুবাইর (রাঃ) এর মস্তক দেখামাত্রই ক্রন্দন করিলেন এবং বলিলেন ‘ইহা সেই যুবাইরের মস্তক, যাহার তরবারি দীর্ঘকাল ধরিয়া রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর হেফাজত করিয়াছে । হে যুবাইরের হত্যাকারী আমি তোমকে জাহান্নামের সুসংবাদ জানাইতেছি ।” হত্যার পুরস্কার না পাইয়া ক্ষোভে অস্থির ইবনে জরমুয নিজের বুকে আপন তলোয়ার ঢুকাইয়া আত্নহত্যা করিল । এইভাবে হযরত আলী (রাঃ) তাহাকে যে সুসংবাদ জানাইয়াছিলেন তা সত্যে পরিণত হইল ।
অতঃপর আলী (রাঃ) উম্মুল মোমেনীন হজর আয়েশা (রঃ) এর খেদমতে হাযির হইলেন এবং কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিলেন । উভয়পক্ষের ভুল বুঝাবুঝির উপর অনুতাপ প্রকাশ করা হইল ।
এই যুদ্ধের নাম জঙ্গে জামাল । জামাল অর্থ উট । আয়েশা (রাঃ) এর উট ব্যবহার করিয়া মোনাফিকেরা যুদ্ধ চালাইয়া যাইতেছিল । যখন এই উট বসিয়া পড়িল যুদ্ধও ক্ষান্ত হইল । মুনাফিকেরা পলায়ন করিল ।
জঙ্গে জামালে আলী (রাঃ) জয়ী হবার পর আমীর মুআবিয়া (রাঃ) বুঝিতে পারিলেন যে আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভবপর হইবে না । তাই শোরাহবিল ইবনে সামাত (রাঃ) এর সহযগীতায় তিনি সিরিয়াব্যাপী ব্যাপক সমর্থন আদায় করিবারা প্রয়াস করিলেন । ওসমান (রাঃ) এর রক্তমাখা জামা এবং তৎপত্নী নায়েলা (রাঃ) এর কাটা অঙ্গুলি [ যাহা ওসমান (রাঃ) কে রক্ষা করার চেষ্টায় কাটা গিয়াছিল ] এই দুইটি জিনিস জনসাধারণকে উত্তেজিত করতে ব্যবহার করা হইয়াছিল ।
এদিকে আমীর মুআবিয়া (রাঃ) এর প্রভাব হ্রাস এবং রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর স্মৃতিবিজড়িত শহর মদিনাকে আক্রমণ থেকে হেফাজতের উদ্দেশ্যে আলী (রাঃ) মদীনা থেকে রাজধানী কুফায় স্থানান্তর করিলেন ।
হযরত আলী (রাঃ) মুআবিয়া (রাঃ) এর সৈন্যদলকে ভয় করিতেন না; কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে হানাহানি তিনি পছন্দ করিলেন না । তাই মুআবিয়া (রাঃ) এর নিকট সন্ধিপত্র পাঠাইয়া দিলেন এই মর্মে যে তিনি উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদের বিচার করিবেন তবে এই জন্য আলী (রাঃ) এর বাইয়াত গ্রহণ করা জরুরী । কারন হযরত আলী (রাঃ) মুহাজির ও আনসারগণের দ্বারাই খলিফা নির্বাচিতহইয়াছেন । জবাবে মুআবিয়া (রাঃ) লিখিলেন, ‘আমরা আপনার হাতে বাইয়াত করিতে অস্বীকার করিতেছি না এবং আপনার যোগ্যতাও অস্বীকার করি না, তবে একটা শর্ত আছে এবং উহা এই যে, হযরত উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদেরকে আমাদের হাতে অর্পন করিতে হইবে ।’
হজরত আলী (রাঃ) পুনরায় চিঠিতে মতৈক্যে পোছাতে আমীর মুআবিয়া (রাঃ) এবং তাঁর উপদেষ্টা আমর ইবনুল আ’সকে নির্দেশ দিলেন; অন্যথায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল হইবে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হইবে ।
এই চিঠির পরো কোন ধরনের মতৈক্যে পৌঁছা সম্ভবপর হয় নি । বাধ্য হইয়া হিজরি ৩৬ সালের শেষভাগে হযরত আলী (রাঃ) আশি হাজার সৈন্য লইয়া আমীর মুআবিয়ার মোকাবেলার জন্য রওনা হইলেন এবং ফোরাত নদীর তীরে সিফফফীন নামক স্থানে গিয়া অবস্থান করিলেন ।
এদিকে আমীর মুআবিয়ার সৈন্যগণ আগেই ফোরাত অধিকার করিয়া রাখিয়াছিলেন । তাহারা আলী (রাঃ) এর সৈন্যদের পানি ব্যাবহার করিতে দিত না । ফলে পানি লইয়া যুদ্ধ লাগিয়া গেল । এই যুদ্ধ সিফফিনের যুদ্ধ নামে পরিচিত । মুআবিয়া (রাঃ) এর সৈন্যগণ পলায়ন করিলেন । কিন্তু ফোরাতের পানি অধিকারে আসার পর হাসেমীগন এই পানি পানে কাউকে বাঁধা প্রদান করেননি । কয়েকমাসব্যাপী বারংবার এই যুদ্ধ চলে । উভয়পক্ষের অনেক সৈন্য নিহত হইল । রণক্ষেত্র লাশে পরিপূর্ন হইয়া গেল । দীর্ঘ যুদ্ধের পর মুআবিয়া (রাঃ) এর সৈন্যদল ক্রমশঃ দূর্বল হইয়া পড়িল এবং পরাজয়ের আশঙ্কায় সন্ধিপ্রস্তাব হযরত আলী (রাঃ) কে পাঠাইলেন । হিজরি ৩৭ সনের রবিউল আউয়াল মাসে উভয়পক্ষ সন্ধিপত্রে সাক্ষর করিল এবং সিদ্ধান্ত হইল যে, বিচারকদের সিদ্ধান্ত ঘোষণার অনুষ্ঠান শাম ও ইরাকের মধ্যবর্তী এলাকা দুমাতুল জন্দল নামক স্থান অনুষ্ঠিত হইবে । দুইজন বিচারক হওয়ায় যা হইবার তাহাই হইল; রায়ের পরিণাম দুঃখজনক হইল । সন্ধির পরপর একদল বিপ্লবী সন্ধি ভাঙ্গিয়া পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ করিবার চেষ্টা করিল । কুটচেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ায় আলী (রাঃ) এর দলত্যাগ করিল । ইতিহাসে তাহারা খারিজি বলে পরিচিত । ইহাদের অনেক আকিদা ইসলাম সঙ্গত ছিল না । তাহারা একত্রিত হইয়া নিরীহ মুসলমান নর-নারীকে নির্দয়ভাবে হত্যা করিয়া চলিল । অবশেষে তাহাদের দমনার্থে আলী (রাঃ) অগ্রসর হইলেন । মুসলমানদের হাতে তারা পরাজিত হইল । কিন্তু আলী (রাঃ) এর বাহিনী ক্রমশঃ দূর্বল হইয়া গেল ।
অপরদিকে আমীর মুআবিয়া (রাঃ) শক্তিশালী হইয়া হেজাজ, ইরাক ও মিশরে আধিপত্য বিস্তার করিতে লাগিলেন । তাঁহার হাতে মক্কা ও মদিনার পতন হইল । অতঃপর ইয়ামনে আক্রমণ করিলেন এবং বহু সাধারণ লোক নিহত হইল । এইরূপ অরাজকতায় খারিজিরা সুযোগ লইল । আব্দুর রহমান ইবনে মুজলেম ১৮ ই রমজান ফজরের নামাজ ইমামতীকালীন আলী (রাঃ) কে বিষমাখা তরবারি দ্বারা মাথায় আঘাত করিল । হযরত আলী (রাঃ) নামাজের মসল্লাতেই শুইয়া পড়িলেন । তিনদিন পর ২১ শে রমজানর রাত্রে এই এলেমের সূর্য অস্ত গেল ।
রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর কোলে যিনি লালিত-পালিত হইয়াছিলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর মুখে যিনি কোরআন পাক শ্রবণ করিয়াছেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছেই যিনি কুরআন শিক্ষা লাভ করিয়াছেন এবং বুঝিয়াছেন, তাঁহার এলম সম্পর্কে আর কাহার এলেমের তুলনা করা যাইতে পারে ? রাসুলুল্লাহ (সঃ) ফরমাইয়াছেনঃ “আমি এলেমের শহর এবং আলী উহার দরজা ।“ এই কাড়নের সাহাবীগণের মধ্যে হযরত আলী (রাঃ) অন্যান্য সাধারণ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন ।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)
হাদীস বর্ণনাকারী হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র নাম সা’দ,পিতার নাম মালেক। মাতার নাম আনীসা বিনতে আবিল হারিছ। তিনি আনসার সাহাবীদের অন্যতম। তাঁর পূর্বপুরুষ খুদরা ইবনে আওফের নামানুসারে তাঁকে খুদরী বলা হয়।
জন্ম
হিজরতের দশ বৎসর পূর্বে হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু জন্মগ্রহণ করেন। হিজরতের বছরে (৬২২ খ্রিস্টাব্দে) তাঁরমাতা-পিতা দুজনই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি বনী মুত্তালিকের যুদ্ধসহ পরবর্তী ১২টি ইসলামী জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। কম বয়সের কারণে বদর ও ওহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ৬০ হিজরীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। ৬৩ হিজরীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হানযালার নেতৃত্বে কুখ্যাত ইয়াজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
ইলমে হাদীসে তাঁর আবদান
হাদীস শাস্ত্র গবেষকদের বর্ণনা মতে, হাদীস শাস্ত্রে তাঁর অবদান অপরিসীম। তিনি সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের অন্যতম। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১১৭০টি। তন্মধ্যে বুখারী শরীফে এককভাবে ১৬টিও মুসলিম শরীফে ৫২ টি হাদীস উলেখ রয়েছে । হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। অসংখ্য তাবেয়ী তাঁর শিষ্য ছিলেন। হাদীস মুখস্থকরণ ও সংরক্ষণে তিনি অনন্য মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। হাফেজুল হাদীস হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে।
ইন্তেকাল
৭০ হিজরীতে জুমাবার মাদীনা মুনাওয়ারায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর জীবনকাল ৮৪ বৎসর। জান্নাতুল বাক্বী’র নূরানী কবরস্থানে তিনি সমাধিস্থ হন।