‘জিকির’ অর্থ স্মরণ। ‘জিকরুল্লাহ্’ অর্থ আলাহর জিকির বা আলাহর স্মরণ। ঈমান, ইসলাম, হেদায়েত ও দ্বীন-ধর্ম- শরীয়তের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে আলাহর জিকিরকে প্রতিষ্ঠিত করা। প্রথমে নিজেদের অন্তরে বাহিরে, পরে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে- এভাবে সারা বিশ্বে।
কোরআনুল করীমও আলাহর জিকির। অর্থাৎ কোরআন আলাহর কথা মনে করিয়ে দেয়। আলাহ্ পাক বলেছেন- ‘ইন্না নাহনু নাজ্জালনাজ্ জিক্রা......’ (আমিই এই কোরআন অবতীর্ণ করেছি)- সুরা হিজর, আয়াত ৯। আবার কোথাও জ্ঞান অর্থেও জিকির শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন ‘ফাসআলু আহলাজ্ জিকরা’ (জ্ঞানীগণকে জিজ্ঞেস কোরো)- সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৭।
এভাবে নামাজও আলাহর জিকির। কেননা নামাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য আল্লাহর জিকিরকে প্রতিষ্ঠা করা। যেমন বলা হয়েছে, ‘আক্বিমিস্ সলাতা লি জিকরি’ (নামাজ প্রতিষ্ঠা করো আমার স্মরণের জন্য)- সুরা ত্বহা, আয়াত ১৪। এভাবে শরীয়তের সকল হুকুম আহকামের প্রতি যদি আমরা দৃষ্টিপাত করি, তবে দেখবো সকল আমলের মূল বা ভিত্তি হচ্ছে আলাহর জিকির। আলাহর জিকির ব্যতীত কোনো আমলই আলাহ্ পাকের দরবারে গৃহীত হয় না। যেমন- হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, একাগ্রচিত্ততা (হুজুরী ক্বলব) ছাড়া নামাজ হয় না। হুজুরী ক্বলব অর্থ যে ক্বলব নামাজে হাজির বা উপস্থিত থাকে। যে ক্বলবে আলাহর জিকির থাকে, সেই ক্বলবই তো হুজুরী ক্বলব । ক্বলবে আলাহর জিকির না থাকলে গাইরুল্লাহর জিকির থাকবে। আর গাইরুল্লাহর (আলাহ্ ছাড়া অন্য কিছুর) স্মরণমগ্ন থাকলে নামাজ হবে কীভাবে।
সুতরাং বুঝতে হবে কলবে আলাহ্ পাকের সার্বক্ষণিক জিকির থাকা ইবাদত বন্দেগী কবুল হওয়ার একটি শর্ত। বরং প্রধান শর্ত। তাই কোরআন মজীদের অনেক আয়াতে এ সম্পর্কে বিশেষভাবে হুকুম দেওয়া হয়েছে। [1]
তোমরা আমাকে স্মরণ করো আমি তোমাদিগকে স্মরণ করিব
সুতরাং তোমরা শুধু আমাকেই স্মরণ কর, আমিও তোমাদিগকে স্মরণ করিব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং কৃতঘ্ন হইও না
— সুরা বাকারা আয়াত , ১৫২
ব্যাখ্যাঃ
পরম তত্ত্বের (আলাহ্ সুবাহানাহু তায়ালার) পরিচিতি (মারেফাত) লাভ হয় অন্তরের বিবর্তন ও অলৌকিক প্রাপ্তির মাধ্যমে। অধিক জিকির ও মোরাক্বাবা ঐ প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করে। সেই জিকির ও মোরাক্বাবা সম্মিলিতভাবে হোক অথবা হোক এককভাবে। সেই জিকিরের প্রতি এই আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে এভাবে― ‘ফাজকুরূনী (তোমরা শুধু আমাকেই স্মরণ করো)। এরপর বলা হয়েছে ‘আজকুরকুম’ (আমি তোমাদেরকে স্মরণ করবো)।
আবু শাইখ এবং দায়লামী ‘মসনদে ফিরদাউস’ গ্রন্থে জোবায়েরের মাধ্যমে তিনি জুহাকের মাধ্যমে এবং তিনি হজরত আবদুলাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, রসুলে করীম সলালাহু আলাইহি ওয়া সালাম ‘ফাজকুরূনী আজকুরকুম’ আয়াতের শানে এরশাদ করেছেন― আলাহপাক বলেন,
হে বান্দাসকল! তোমরা আমাকে ইবাদতের মাধ্যমে স্মরণ করো। আমি মাগফিরাতসহ তোমাদেরকে স্মরণ করবো। অর্থাৎ তোমরা আমার ইবাদত করো; আমি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবো।
হজরত আবু হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুলে আকরম স. বলেছেন,
আলাহপাক বলেন― আমার বান্দা আমার প্রতি যে ধারণা পোষণ করে, আমি তার সেই ধারণার অনুকূল। সে যখন আমাকে স্মরণ করে, তখন আমিও তাকে স্মরণ করি। সে যদি কোনো অনুষ্ঠানে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমিও তাকে স্মরণ করি অধিকতর উত্তম অনুষ্ঠানে। সে যদি আমাকে অন্তরে স্মরণ করে, তবে আমিও তাকে অন্তরে স্মরণ করি। সে যদি আমার দিকে অর্ধ হাত এগিয়ে আসে, তবে আমি এগিয়ে যাই একহাত। সে একহাত এলে আমি যাই দুই হাত। সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, তবে আমি যাই দৌড়ে।
— বোখারী, মুসলিম
হজরত আনাস রা. থেকে বাগবীও এই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনার সাথে এই উক্তিটিও রয়েছে যে,
হজরত আনাস বলেছেন, নিজের পাঁচটি আঙ্গুল গণনা করার মতো স্পষ্টরূপে এই হাদিসটি আমি রসুলুল্লাহর কাছ থেকে শুনেছি।
হজরত আবদুলাহ ইবনে শাকীক রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুলেপাক স. এরশাদ করেছেন,
মানুষের অন্তর দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। এক কক্ষে থাকে ফেরেশতা, অপর কক্ষে থাকে শয়তান। যখন মানুষ আলাহপাকের জিকির করে তখন শয়তান তার কুঠুরী ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর যখন জিকির থেকে অমনোযোগী হয়, তখন শয়তান তার ঠোঁট অন্তরে প্রবেশ করিয়ে কুমন্ত্রণা দেয়।
— ইবনে আবী শায়বা
অমনোযোগিতা ও উদাসীনতা দূর করার নামই জিকির। জিকির না করার কারণেই অন্তর কঠিন হয়। উলেখ্য, শরীয়ত সমর্থিত কথা, কর্ম, চিন্তা-ভাবনা, অনুসন্ধিৎসা-গবেষণা - এ সকল কিছুই জিকিরের অন্তর্গত। তবে শর্ত হচ্ছে, এ সব কিছুই হতে হবে বিশুদ্ধ অন্তর সহযোগে। অসৎ উদ্দেশ্য ও অমনোযোগিতার সাথে সম্পাদিত আমল আলাহতায়ালার দরবারে গৃহীত হয় না। আলাহ্ সুবহানাহু তায়ালা এরশাদ করেন―
অবশ্যই সফলকাম হইয়াছে মু’মিনগণ, যাহারা বিনয়-নম্র নিজেদের সালাতে
— সুরা মু’মিনূন, আয়াত ১, ২
আরো এরশাদ করেন―
সুতরাং দুর্ভোগ সেই সালাত আদায়কারীদের, যাহারা তাহাদের সালাত সম্বন্ধে উদাসীন
— সুরা মাঊন, আয়াত ৪, ৫
তথ্যসূত্র
আল্লাহ্র জিকির (লেখকঃ মুহাম্মাদ মামুনুর রশীদ)
যাহারা দাঁড়াইয়া, বসিয়া ও শুইয়া আল্লাহ্কে স্মরণ করে
যাহারা দাঁড়াইয়া, বসিয়া ও শুইয়া আলাহর স্মরণ করে এবং আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে ও বলে, ‘হে আমাদের প্রভুপালক! তুমি ইহা নিরর্থক সৃষ্টি কর নাই, তুমি পবিত্র, তুমি আমাদিগকে অগ্নিশাস্তি হইতে রক্ষা কর
— সুরা আলে ইমরান আয়াত ১৯১
ব্যাখ্যাঃ যাঁরা প্রকৃত আলেম, তাঁরা দাঁড়িয়ে বসে শুয়ে- সর্বাবস্থায় আলাহর জিকিরে মগ্ন থাকেন। জ্ঞানীগণের এটাই প্রধান বৈশিষ্ট্য। সার্বক্ষণিক জিকির, তসবীহ, ইস্তেগফার, দোয়া, বিনয়- ইমান ও জ্ঞানের পরিচয়। যারা এই বৈশিষ্ট্যাবলীমুক্ত, তারা চতুষ্পদ জন্তু অপেক্ষা নিকৃষ্ট। কেননা চতুষ্পদ জন্তুরাও তাদের নিজ নিয়মে জিকিররত থাকে।
সাধারণ তাফসীরকারগণের অভিমত এই যে, সার্বক্ষণিক জিকিরের কথা বলা হয়েছে এই আয়াতে। কেননা মানুষ সকল সময় দাঁড়ানো, বসা অথবা শোয়া অবস্থাতেই থাকে। রসুলে পাক স. বলেছেন,
যে ব্যক্তি জান্নাতের বাগানে পরিভ্রমণ করতে চায়, সে যেনো আলাহর জিকির অত্যধিক পরিমাণে করে
— হাদিসটি হজরত মুয়াজ থেকে বর্ণনা করেছেন ইবনে আবী শায়বা এবং তিবরানী
জিকির এর পরে এখানে বলা হয়েছে ফিকির (চিন্তা) এর কথা। বলা বাহুল্য, আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা ইবাদত। একে বলে ‘তাফাক্কুর’। এই বিশাল রহস্যময় সৃষ্টি আলাহ্্তায়ালার অপার ক্ষমতাকে নির্দেশ করে। তাঁর মহাপ্রজ্ঞা, মহাকৌশল এবং তাঁর অতুল এককত্বকে প্রমাণ করে। হজরত আলী রা. বলেছেন, রসুলে পাক স. এরশাদ করেছেন,
তাফাক্কুরের মতো কোনো ইবাদত নেই।
হজরত আবু হোরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন, রসুল স. বলেছেন, এক ব্যক্তি রাতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো বিস্ময়ঘেরা নক্ষত্রমন্ডলে। সে অভিভূত হলো এবং সাক্ষ্য দিলো, নিশ্চয়ই আমার প্রভূপালক সত্য। আমার স্রষ্টা সত্য। হে আমার আলাহ্! তুমি দয়া করে আমাকে মার্জনা করো। আলাহপাক তার প্রতি রহমত বর্ষণ করলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
— আবু শায়েখ, ইবনে হাব্বান, সা’লাবী
হাদিস শরীফে এসেছে, রসুলুলাহ্ স. সব সময় জিকিররত থাকতেন। এই জিকির হুসুলি নয়। হুজুরীও নয়। মুখের জিকির তো নয়ই। সার্বক্ষণিক মৌখিক জিকির অসম্ভব। অথচ সার্বক্ষণিক জিকিরই আসল জিকির। এই জিকিরের স্তর অতি উচ্চ। তাফাক্কুর বা ফিকিরই কেবল ওই মূল জিকিরের স্তর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। এ কারণেই আলাহপাক ‘উলুল আলবাব্’ বা বোধশক্তিসম্পন্নদের বৈশিষ্ট্যকে সার্বক্ষণিক জিকিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিয়েছেন এবং পরে উলেখ করেছেন চিন্তা গবেষণার কথা। সঠিক চিন্তা গবেষণা ওই জিকির পর্যন্ত পৌঁছুতে সহায়তা করে। ওই জিকির মূল প্রতিচ্ছায়া স্বরূপ, যা অক্ষয়, অব্যয়। তাই দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে জিকির করা অর্থ সর্বক্ষণ জিকির করা।
এখানে ফিকিরের পূর্বে জিকিরের উলেখ করা হয়েছে এজন্য যে, কেবল জ্ঞান বা চিন্তা গবেষণা বিশুদ্ধ নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত প্রণয়নে সক্ষম নয়, যদি না সে জ্ঞান জিকিরের নূর এবং আলাহর পথপ্রদর্শন দ্বারা আলোকপ্রাপ্ত হয়। উলেখ্য ফিকিরের ভিত্তি জিকির এবং জিকিরের নূর। আলাহর জিকিরের নূর ব্যতিরেকে যারা চিন্তা গবেষণায় লিপ্ত, তারা তাই পবিত্রতম সত্তা আলাহ্ তায়ালার প্রতি বিশ্বাস থেকে বঞ্চিত। তারা প্রথিতযশা বিজ্ঞানী গবেষক, কিন্তু ইমানদার নয়।
তথ্যসূত্র
আল্লাহ্র জিকির (লেখকঃ মুহাম্মাদ মামুনুর রশীদ)
যখন সালাত সমাপ্ত করিবে তখন দাঁড়াইয়া, বসিয়া এবং শুইয়া আল্লাহ্কে স্মরণ করিবে
যখন তোমরা সালাত সমাপ্ত করিবে তখন দাঁড়াইয়া, বসিয়া এবং শুইয়া আল্লাহ্কে স্মরণ করিবে, নির্ধারিত সময়ে সালাত কায়েম করা বিশ্বাসীদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।
— সুরা নিসা, আয়াত ১০৩
ব্যাখ্যাঃ দন্ডায়মান অবস্থায়, উপবিষ্ট অবস্থায় এবং শায়িত অবস্থায় আলাহকে স্মরণ করার অর্থ প্রতিটি মুহর্ত আলাহর স্মরণে রত থাকা। উম্মতজননী হজরত আয়শা সিদ্দিকা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুললাহ্ স. সব সময় আলাহর স্মরণে মগ্ন থাকতেন। আবু দাউদ। উলেখ্য, কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে, বিভিন্ন হাদিসে উলেখিত সার্বক্ষণিক জিকিরের উদ্দেশ্য কলবী জিকির। মুখে সর্বক্ষণ জিকির করা তো সম্ভবই নয়।
তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রভুপালককে ডাক; তিনি যালিমদিগকে পছন্দ করেন না
— সুরা আ’রাফ, আয়াত ৫৫
ব্যাখ্যাঃ এখানকার ‘খুফইয়াতান’ শব্দটির অর্থ গোপন ইবাদত, যা বিশুদ্ধচিত্ততার সঙ্গে সম্পাদিত হয় এবং যা আত্মম্ভরিতা থেকে মুক্ত। উল্লেখ্য, আত্মম্ভরিতামুক্ত এবং শুদ্ধসংকল্প-সম্বলিত না হলে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য কোনো ইবাদতই আলাহ্পাকের দরবারে গৃহীত হয় না।
হজরত আবু হোরায়রার বর্ণনায় এসেছে, রসুল স. বলেছেন, আলাহ্ সুবহানাহু তায়ালা এরশাদ করেন, আমি আমার বান্দার ধারণার অনুকল। যদি সে আমাকে গোপনে (মনে মনে ) স্মরণ করে, তবে আমিও তাকে স্মরণ করি গোপনে। যদি সে আমাকে দলবদ্ধভাবে স্মরণ করে, তবে আমিও তাকে স্মরণ করি পবিত্র ও মর্যাদাশালী দলের মধ্যে (ফেরেশতাদের সঙ্গে)।
— বোখারী, মুসলিম
এই হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য উভয় প্রকার জিকির সিদ্ধ। কেউ কেউ বলেছেন, এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, প্রকাশ্য ও সশব্দ জিকিরই উত্তম । কিন্তু কথাটি ঠিক নয় । বরং এখানে একথাই প্রমাণিত হয় যে, নীরব ও সরব উভয় প্রকার জিকির গ্রহণীয় । বরং এখানে নীরব স্মরণকে সরব স্মরণাপেক্ষা প্রাধান্য প্রদান করা হয়েছে। [1]
তথ্যসূত্র
আল্লাহ্র জিকির (লেখকঃ মুহাম্মাদ মামুনুর রশীদ)
তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের মতো আল্লাহ্কে স্মরণ করিবে
অতঃপর যখন তোমরা হজ্জের অনুষ্ঠানাদি সমাপ্ত করিবে তখন আল্লাহ্কে এমনভাবে স্মরণ করিবে যেমন তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষগণকে স্মরণ করিতে, অথবা তদপেক্ষা অভিনিবেশ সহকারে।
— সুরা বাকারা, আয়াত ২০০
এখানে সরব জিকিরের কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে অত্যধিক জিকিরের কথা। আলেমগণের ঐকমত্য এই যে, গোপন জিকিরই উত্তম এবং অতি উচ্চঃস্বরে জিকির বেদাত। তবে কোনো কোনো উচ্চঃস্বরে জিকির অত্যাবশ্যক। যেমন- আজান, ইক্বামত, তক্বীর, তাশরীক ইত্যাদি। এ ছাড়া নামাজে ইমামের অজুভঙ্গ হলে তাঁকে উচ্চঃস্বরে তক্বীর বলতে হয়। মোক্তাদির অজু ভঙ্গ হলে তাকে উচ্চঃস্বরে ‘সুবহানালাহ্’ বলে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। হজ্বের সময় উচ্চঃস্বরে বলতে হয় লাব্বাইক, আলাহুম্মা লাব্বাইক......ইত্যাদি। নিম্নস্বরের জিকির অথবা গোপন জিকিরই প্রকৃত জিকির। অতি উচ্চঃস্বরে জিকির করা বেদাত। একথাটিও প্রণিধাননীয় যে, সরবতা ও নীরবতার মধ্যে যেহেতু দৃশ্যত দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, সেহেতু নীরবতাই অধিকতর গ্রহণযোগ্য হওয়াই সমীচীন। তাই গোপন জিকিরই (জিক্রে খফি) উত্তম। সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীগণের ঐকমত্য ছিলো নীরব জিকিরের পক্ষে।
তথ্যসূত্র
আল্লাহ্র জিকির (লেখকঃ মুহাম্মাদ মামুনুর রশীদ)
তোমরা বিনীতভাবে এবং গোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাকো
হাসান বসরী র. বলেছেন, উচ্চঃস্বরের দোয়া ও নিম্নরের দোয়ার মধ্যে সত্তর হাজার গুণ পার্থক্য রয়েছে। প্রথম যুগের মুসলমানগণ দীর্ঘ সময় ধরে দোয়া করতেন। তাঁদের ওই দোয়ার সামান্য আওয়াজও শোনা যেতো না। শুধু শোনা যেতো ওষ্ঠ সঞ্চালনের শব্দ। কেননা আলাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন―
তোমরা বিনীতভাবে এবং গোপনে তোমাদের প্রভুপালককে ডাক।
— সুরা আ’রাফ, আয়াত ৫৫
নবী জাকারিয়া সম্পর্কে অন্যত্র এরশাদ করেছেন―
যখন সে তাহার প্রভুপালককে আহবান করিয়াছিল নিভৃতে।
— সুরা মার্য়াম, আয়াত ৩
হজরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস বর্ণনা করেছেন, রসুল স. বলেছেন, উত্তম জিকির হচ্ছে জিকরে খফি (নীরব জিকির) এবং উত্তম জীবিকা হচ্ছে ঐ জীবিকা, যা ন্যূনতম সামর্থের অন্তর্ভূত।
— আহ্মদ, ইবনে হাব্বান, বায়হাকী
হজরত আবু মুসা আশআরী বর্ণনা করেছেন, খয়বর যুদ্ধের সময় একটি প্রান্তর অতিক্রমকালে মুসলিম সৈন্যরা উচ্চঃস্বরে তক্বীর উচ্চারণ করেছিলেন। রসুলেপাক স. তখন বলেছিলেন, শান্ত হও। তোমরা কোনো অনুপস্থিত স্বত্বা তো আহবান করছো না তোমরা ওই সত্তাকে ডাকছো, যিনি সর্বশ্রোতা এবং নিকটতম।
আমি বলি, বাগবী বর্ণিত এই হাদিসটির মাধ্যমে জিক্রে খফির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। কিন্তু এখানে এ বিষয়টিও লক্ষণীয় যে, রসুলেপাক স. এখানে উচ্চঃস্বরে তক্বীর ধ্বনিকে নিষিদ্ধ করেননি। বলেছেন, শান্ত হও। তাই এই হাদিসের মাধ্যমে জিক্রে খফির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হওয়ার সাথে সাথে একথাও প্রমাণিত হয় যে, নীরব ও সরব উভয় প্রকার জিকির সিদ্ধ।
জিকির তিন প্রকার-
১. চিৎকার করে জিকির করা। আলেমগণের ঐকমত্যানুসারে এরকম জিকির সকল অবস্থায় মাকরুহ্। তবে বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে যদি অধিকতর উপকার পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, পরিস্থিতিগত কারণে আলেমগণ যদি সাময়িকভাবে এরকম জিকিরকে কল্যাণময় মনে করেন, তবে তাকে অসিদ্ধ বলা যাবে না। বরং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অত্যুচ্চ আওয়াজে জিকির করাই উত্তম। যেমন- আজান, হজ্বের তালবিয়া ইত্যাদি। চিশতিয়া তরিকার কোনো কোনো পীর ও মোর্শেদ প্রাথমিক অবস্থায় মুরিদগণকে উচ্চঃস্বরে জিকির করতে বলেন। শয়তান বিতাড়ন, আলস্য দূরীকরণ, ঔদাসীন্য অপসারণ, অন্তর উত্তপ্তকরণ, অনুপ্রেরণা ও অনুরাগের উজ্জীবন ইত্যাদির উদ্দেশ্যে চিশতিয়া তরিকার পীরগণ প্রাথমিক সালেকদের জন্য এরকম জিকির নির্ধারণ করে দেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আত্মপ্রসাদ এবং যশলাভের উদ্দেশ্যে অত্যুচ্চ আওয়াজে জিকির করা থেকে বিরত থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
২. রসনা সঞ্চালনের মাধ্যমে অত্যন্ত অনুচ্চ আওয়াজে জিকির করা। রসুলেপাক স. বলেছেন, সকল সময় আলাহ্র জিকিরে তোমরা রসনাকে সিক্ত রাখো। ইমাম আহমদ ও তিরমিজির বর্ণনায় রয়েছে, একবার রসুললাহ্ স.কে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আলাহ্র রসুল! সর্বাপেক্ষা উত্তম আমল কোনটি? তিনি স. বললেন, পৃথিবী পরিত্যাগের সময় আলাহ্র জিকির দ্বারা রসনাকে সরস রাখা।
৩. জিহ্বা সঞ্চালন ব্যতীত কেবল কলব, রূহ ও নফস দ্বারা গোপনে জিকির করা। এই জিকিরকে বলে জিক্রে খফি। আমল লেখক ফেরেশতারা এই জিকির সম্পর্কে অজ্ঞাত।
উম্মত-জননী হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. থেকে আবু ইয়ালী বর্ণনা করেছেন, রসুল স. বলেছেন, সরব জিকির অপেক্ষা নীরব জিকির সত্তর হাজার গুণ অধিক মর্যাদাপূর্ণ। শেষ বিচারের দিন ফেরেশতারা যখন মানুষের আমলনামা উপস্থিত করবে, তখন আলাহ্পাক এক লোককে দেখিয়ে বলবেন, ভালো করে দ্যাখো আমার এই বান্দার কোনো পাপ পুণ্য লেখা বাদ পড়লো কিনা! ফেরেশতারা বলবে, আমরা যা কিছু জেনেছি, শুনেছি ও দেখেছি― সবকিছুই আমলনামায় লিখে নিয়েছি। কোনো কিছুই পরিত্যাগ করিনি। আলাহ্তায়ালা বলবেন, আমার এই বান্দার গোপন আমলও রয়েছে, যার কথা তোমরা জানো না। সেই আমল হচ্ছে জিক্রে খফি।
আমি বলি, এই জিক্রে খফি বা কলবী জিকিরের ধারাবাহিকতা কখনো ছিন্ন হয় না। শারীরিক ক্লান্তি, শ্রান্তি ও আলস্য গোপন জিকিরের প্রতিবন্ধক নয়। জিকিরে জাগ্রত ক্বলবে তাই প্রতিটি মুহূর্তে চলতে থাকে আলাহ্র জিকির।
তথ্যসূত্র
আল্লাহ্র জিকির (লেখকঃ মুহাম্মাদ মামুনুর রশীদ)
তোমার প্রভুপালককে মনে মনে সবিনয়ে সকাল-সন্ধ্যা স্মরণ করিবে
তোমার প্রভুপালককে মনে মনে সবিনয় ও সশংকচিত্তে অনুচ্চস্বরে প্রত্যূষে ও সন্ধ্যায় স্মরণ করিবে এবং তুমি উদাসীন হইবে না
— সুরা আ’রাফ, আয়াত ২০৫।
ব্যাখ্যাঃ
হজরত ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, এই আয়াতে নামাজের ক্বেরাতের উচ্চারণসীমা নির্দেশ করা হয়েছে। ‘ওয়াজকুর রব্বাকা ফি নাফসিকা’ কথাটির মধ্যে উলেখিত ‘জিকির’ অর্থ নামাজের ক্বেরাত অর্থাৎ এখানে বলা হয়েছে নামাজের মধ্যে গোপনে, মনে মনে (জিহবা সঞ্চালনসহ) ক্বেরাত পাঠ করবে। ‘ওয়া দুনাল জাহরি মিনাল ক্বওলি’- এখানে আল জাহরি অর্থ প্রকাশ্য নামাজ (যে নামাজে সশব্দে ক্বেরাত পাঠ করতে হয়)। দুনাল জাহ্রি অর্থ অনুচ্চস্বরে। অর্থাৎ সুউচ্চ স্বরের চেয়ে কম আওয়াজে এবং নিঃশব্দ আওয়াজের চেয়ে কিছুটা উচ্চস্বরে। এরকম বলার উদ্দেশ্য এই যে- যে নামাজগুলোতে উচ্চস্বরে ক্বেরাত পাঠের বিধান আছে (মাগরিব, এশা, ফজর) সে নামাজগুলোতে অত্যন্ত স্পষ্ট উচ্চারণে কোরআন পাঠ কোরো, অতিরিক্ত চিৎকার কোরো না। বরং এমন শান্তভাবে মধুর স্বরে পড়ো, যেনো পশ্চাতের ব্যক্তিদের শুনতে কোনো অসুবিধা না হয়।
মুজাহিদ বলেছেন, জিকির করবে অন্তরে অন্তরে। এটাই এই আয়াতের বক্তব্য। প্রার্থনার মধ্যে থাকতে হবে বিনয় ও শংকা। উচ্চকন্ঠ হবে না। চিৎকার করে আলাহকে ডাকবে না। মনে মনে দোয়া করলে হৃদয়ের বিশুদ্ধতা বৃদ্ধি পায়। আমি বলি, এখানে অনুচ্চস্বরে এবং মনে মনে কথা দুটোর মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক সংযোগ। কথা দুটোর মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে জিকরে জেহরী (অনুচ্চস্বরে জিকির) এবং জিকরে খফিকে (মনে মনে জিকিরকে)। ‘বিলগুদুব্যি’ অর্থ প্রত্যুষে, সকালে। আর ‘ওয়াল্ আস্লি’ অর্থ দিবসের শেষভাগ, সন্ধ্যা। সকাল ও সন্ধ্যা এ দুটো সময় যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তাই এই দুই সময়ে বিশেষভাবে জিকিরে নিমগ্ন থাকতে বলা হয়েছে। নতুবা জিকির তো করতে হবে সর্বক্ষণ। তাই শেষে বলা হয়েছে ‘ওয়ালা তাকুম্ মিনাল্ গফিলীন’ (এবং তুমি উদাসীন হয়ো না)। একথার অর্থ কোনো সময়ই আলাহর জিকির থেকে অমনোযোগী থেকো না।
আমি বলি, আয়াতের শুরুতে বলা হয়েছে ‘ওয়াজকুর্ রব্বাকা ফি নাফসিকা’। পরে বলা হয়েছে, ‘বিল গুদুব্যি ওয়াল আস্লি ওয়ালা তাকুম্ মিনাল্ গফিলীন’। এই বিবরণভঙ্গির মাধ্যমে এখানে জিকির বলে সব রকম জিকিরকেই বুঝানো হয়েছে। কোরআন পাঠসহ সকল জিকিরই এই নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত।
আলাহর স্মরণের বিষয়ে উদাসীনতা বা অমনোযোগিতা দূর করাই এখানে প্রধান উদ্দেশ্য, যে কোনো ধরনের জিকিরের মাধ্যমে তা করা হোক না কেনো।
একটি প্রশ্নঃ আলাহর জিকির ও দোয়ায় উচ্চকণ্ঠ হওয়া বেদাত। নিঃশব্দে এবং অনুচ্চস্বরে জিকির করা এবং দোয়া করা সুন্নত। কিন্তু আলোচ্য আয়াতে জিকিরের আলোচনা সূত্রে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ক্বেরাতের। তাহলে ক্বেরাত ও জিকিরের মধ্যে পার্থক্য কী? ক্বেরাতও তো জিকির- নয় কি?
উত্তরঃ
কোরআনের মধ্যে রয়েছে অনেক উপদেশ, অনেক শিক্ষণীয় ঘটনা এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধান। কোরআনের বিবরণ ও ব্যঞ্জনা হৃদয়গ্রাহী, মাধুর্যমন্ডিত এবং প্রাঞ্জল। এই বৈশিষ্ট্যগুলো জিকির অপেক্ষা অতিরিক্ত। জিকিরের মাধ্যমে অন্তরের ঔদাসীন্য দূর হয়। জিকির স্বয়ং একটি ইবাদত। কিন্তু এর মধ্যে অন্যকে শোনানোর মতো কিছু নেই, যেরকম রয়েছে কোরআনে। আর কবুল হওয়া না হওয়াই দোয়ার বৈশিষ্ট্য। সুতরাং এর মধ্যেও অন্যকে জানানোর মতো কিছু নেই। তাই নীরব জিকির ও দোয়া সর্বোত্তম। নীরব জিকিরের গতি মগ্নতার দিকে। জিকিরে মগ্ন ব্যক্তির স্মৃতিপটে কেবল আলাহই সমুদ্ভাসিত থাকেন। এভাবেই তার লাভ হয় ফানা ফিলাহ্। এ সকল বৈশিষ্ট্য আবার ক্বেরাতের মধ্যে নেই।
তথ্যসূত্র
আল্লাহ্র জিকির (লেখকঃ মুহাম্মাদ মামুনুর রশীদ)
মু'মিন তো তাহারাই যাহাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়
মু’মিন তো তাহারাই যাহাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তাঁহার আয়াত তাহাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন উহা তাহাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তাহারা তাহাদের প্রভুপালকের উপরই নির্ভর করে।
— সুরা আনফাল, আয়াত ২
ব্যাখ্যাঃ
‘বিশ্বাসী তো তারাই, যাদের হৃদয় কম্পিত হয় যখন আলাহর স্মরণ করা হয়’ এ কথার অর্থ- ওই সকল লোকই পরিপূর্ণ বিশ্বাসী যাদের অন্তর (ক্বলব) আলাহ্ তায়ালার অতুলনীয় মহিমা, গৌরব ও পরাক্রম স্মরণ করে ভীত হয়। কেউ কেউ বলেছেন, এখানে ওই সকল লোকের কথা বুঝানো হয়েছে, যারা কোনো পাপ কর্মের ইচ্ছা করলে তাদেরকে যদি বলা হয় ‘আলাহকে ভয় করো’ তবে তারা আলাহর আযাবের ভয়ে তৎক্ষণাৎ সেই পাপকর্মের চিন্তা পরিত্যাগ করে। এই ব্যাখ্যার আলোকে এখানে ‘আলাহর স্মরণ’ অর্থ হবে- আলাহর আযাবের স্মরণ।
এরপর বলা হয়েছে- এবং যখন তাঁর আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন তা তাদের বিশ্বাস বৃদ্ধি করে এবং তারা তাদের প্রভূপালকের উপরেই বিশ্বাস করে। একথার অর্থ- যখন ওই সকল ব্যক্তির সামনে কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তাদের প্রতি বর্ষিত হয় অজস্র বরকত। তাদের চোখে ও হৃদয়ে সমুদ্ভাসিত হতে থাকে আলাহ্তায়ালার অনেক বিস্ময়কর নিদর্শন। ফলে তাদের বিশ্বাস হয় অধিকতরদৃঢ়বদ্ধ। তারা তখন সকল অবস্থায় সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন কেবল আলাহর উপর। অন্যের উপর তারা যেমন নির্ভর করেন না, তেমনি অন্য কাউকে ভয়ও পান না। তাদের যাবতীয় কার্যকলাপ সমর্পিত হয় আলাহর প্রতি।
তথ্যসূত্র
আল্লাহ্র জিকির (লেখকঃ মুহাম্মাদ মামুনুর রশীদ)
আল্লাহ্র স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়
যাহারা বিশ্বাস করে এবং আলাহর স্মরণে যাহাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়; জানিয়া রাখ, আলাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।
— সুরা রা’দ, আয়াত ২৮
ব্যাখ্যাঃ
‘যারা বিশ্বাস করে এবং আলাহর স্মরণে যাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়’ একথার অর্থ- আলাহ অভিমুখী যারা, তাদের চিত্তে (কলবে) বিশ্বাস দৃঢ়বদ্ধ হয়। সকল সন্দেহের অবসান ঘটে এবং আলাহর স্মরণে তাদের হৃদয় হয় পরিতৃপ্ত ।
এখানে ‘জিকির’ অর্থ কোরআন মজিদ এবং ‘ইত্মিনান’ অর্থ ইমান। উল্লেখ্য, অপবিত্রতা ও অপবিশ্বাস হচ্ছে হৃদয়ের অস্বস্তি ও চাঞ্চল্য। আর হৃদয়ের প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তি হচ্ছে ইমান। অথবা আল্লাহর স্মরণে চিত্ত প্রশান্ত- হয় কথাটির অর্থ হবে আলাহর জিকির দ্বারা হৃদয় থেকে দূরীভূত হয় শয়তানের প্ররোচনা। এমতাবস্থায় জিকিরের অর্থ হবে আল্লাহর স্মরণ।
রসুলেপাক স. বলেছেন, মানুষের অন্তঃকরণে (ক্বলবে) রয়েছে দুটি প্রকোষ্ঠ। একটিতে থাকে ফেরেশতা এবং অপরটিতে থাকে শয়তান। অন্তরে জিকির উত্থিত হলে শয়তান পালিয়ে যায়। আর জিকির না থাকলে শয়তান ক্বলবে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয় তার চিন্ত। এভাবেই সে মানুষকে প্ররোচিত করে।
‘মুনসিফ’ গ্রন্থে হজরত আবদুলাহ ইবনে শাকীক থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইবনে শায়বা এবং হজরত ইবনে আব্বাস থেকে মারফুরূপে প্রলম্বিত সূত্র সহযোগে বর্ণনা করেছেন বোখারী।
হজরত ইবনে আব্বাসের বর্ণনায় এসেছে, শয়তান দলিত মথিত করতে থাকে মানুষের অন্তর। সে যখন জিকিরে রত হয়, তখন শয়তান পশ্চাদপসরণ করে, আর অমনোযোগী হলে অন্তরে ঢেলে দেয় কুমন্ত্রণা । আলোচ্য বাক্যের মর্ম এরকমও হতে পারে যে, আলাহর জিকিরে চিত্ত প্রশান্ত হয়- যেমন সলিলাভ্যন্তরে প্রশান্তি লাভ করে মৎস্য, উন্মুক্ত আকাশে বিহঙ্গ এবং অরণ্যে অরণ্যবাসীরা। পক্ষান্তরে জিকির বিস্মৃত অন্তরে সৃষ্টি হয় অশান্তি, যেমন অশান্তি ভোগ করে পানির সাথে সম্পর্কচ্যত মাছ। পানিতে নিমজ্জিত স্থলচর প্রাণী এবং পিঞ্জিরায় আবদ্ধ পাখি। এই বিষয়টি সুফী সাধকগণের অনুসারীদের নিকটে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। সত্যনিষ্ঠ পীর-মোর্শেদগণের খানকায় গমনকারীরা এর প্রত্যক্ষদর্শী। অতএব এখানে ‘যারা বিশ্বাস করে’ কথাটির মর্মার্থ হবে ওই সকল সুফী দরবেশ, যাদের অন্তর পবিত্র ও জিকিরময়।
‘জেনে রেখো, আলাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়’ কথাটির অর্থ- পবিত্র হৃদয় বিশিষ্ট যাঁরা, তাঁদের চিত্ত প্রশান্ত হয় আলাহর স্মরণে। এ সম্পর্কে একটি সন্দেহ ও তার নিরসনের উলেখ করেছেন বাগবী। সন্দেহটি এরকম- এক আয়াতে (সুরা আনফাল, আয়াত ২) বলা হয়েছে ‘বিশ্বাসবান তারাই, আলাহর জিকির করা হলে যাদের হৃদয় আল্লাহর ভয়ে কম্পমান হয়’। আর এখানে বলা হলো ‘আল্লাহর স্মরণে যাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়’ এখন প্রশ্ন হলো ভয় ও প্রশান্তির সহঅবস্থান কি সম্ভব?
এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে, শাস্তির বিষয় উলেখ করা হলে বিশ্বাসীদের অন্তরে জেগে ওঠে শংকা। আর আলাহর অপার করুণা ও ক্ষমার কথা মনে হলে অন্তরে আগমন করে প্রশান্তি। ভয় ও প্রশান্তি পরস্পরবিরোধী দুটো বিষয়। তাই এ দুটো একই সঙ্গে হৃদয়ে অবস্থান করতে পারে না। একটি এলে অপরটি অপসারিত হয়। আমি বলি, প্রশান্তি ও ভীতির মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো বৈপরীত্য নেই। প্রশান্তি সৃষ্টি হয় ‘উনস’ বা অনুরাগ থেকে। আর অনুরাগ বর্তমান থাকে ভয়ের সময়েও। এভাবে একই সঙ্গে হৃদয়ে সঞ্চারিত হতে থাকে ভয় ও আশা।
হজরত আনাস বর্ণনা করেছেন, অন্তিম যাত্রা কালে এক যুবকের শয্যাপাশে উপস্থিত হলেন রসুলেপাক স.। বললেন, তোমার মনের অবস্থা এখন কেমন?
যুবক বললো, আমি আলাহর ক্ষমার আশা রাখি আবার তাঁর ভয়ে আমি ভীতও। তিনি স. বললেন, পৃথিবী পরিত্যাগের প্রাক্কালে যার অন্তরের অবস্থা এরূপ হয়, আল্লাহ্ তাকে দান করেন তার কাম্যবস্তু এবং রক্ষা করেন ভয়ভীতি থেকে।
— তিরমিজি, ইবনে মাজা
তথ্যসূত্র
আল্লাহ্র জিকির (লেখকঃ মুহাম্মাদ মামুনুর রশীদ)
যদি ভুলিয়া যাও, তবে তোমার প্রভূপালককে স্মরণ করিও
যদি ভুলিয়া যাও, তবে তোমার প্রভুপালককে স্মরণ করিও।
— সুরা কাহফ, আয়াত ২৪
ব্যাখ্যাঃ
কথাটির অর্থ- হে আমার রসুল! আপনি যদি ইনশাআল্লাহ্ বলা ছাড়া কোনো কথা বা কাজের ঘোষণা দেন, তবে আলাহ তায়ালার প্রশংসা বর্ণনা ও ক্ষমাপ্রার্থনার মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করবেন। অথবা এমতো অনবধানতার কারণে আলাহর বিরাগভাজনতার কথা স্মরণ করে অনুতপ্ত হবেন। কিংবা এই উদ্দেশ্যে আলাহকে স্মরণ করবেন, যেনো তিনি আপনার বিস্মৃতিপ্রবণতাকে দূর করে দেন এবং আপনার স্মরণশক্তিকে করে দেন প্রখর।
ইকরামা বলেছেন, আলোচ্য আয়াতের মাধ্যমে এই মর্মে সদুপদেশ দেওয়া হয়েছে যে, যখন তোমরা রাগান্বিত হও তখন আলাহ্কে স্মরণ কোরো। ওয়াহাব বর্ণনা করেছেন, ইঞ্জিল শরীফে উলেখিত হয়েছে, হে আদম সন্তান! তোমরা রাগান্বিত হলে আমাকে স্মরণ কোরো (তাহলে রাগ কমে যাবে)। এরকম যদি করো, তবে আমার রোষতপ্ত অবস্থায়ও আমি তোমাদের স্মরণ করবো (ক্ষমা করবো তোমাদের অপারগতাকে)।
জুহাক ও সুদ্দী বলেছেন, আলোচ্য আয়াতের নির্দেশনাটি নামাজের হুকুমের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ এখানে বলা হয়েছে- নামাজের মধ্যে যদি তোমরা কোনো করণীয় আমলের কথা ভুলে যাও, তবে আল্লাহকে স্মরণ কোরো। কথাটির অর্থ এরকমও হতে পারে যে- নামাজ পাঠের কথা যদি তোমরা ভুলে যাও, তবে স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে নামাজ আদায় করে নিও। হজরত আনাস কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, রসুলেপাকস. আজ্ঞা করেছেন,
যে ব্যক্তি নামাজ পড়তে ভুলে যায়, সে যেনো স্মরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আদায় করে নেয়।
— বাগবী, বোখারী, মুসলিম, আহমদ, তিরমিজি।
নাসাঈর বর্ণনায় বিষয়টি উলেখিত হয়েছে এভাবে- বিস্মৃতি অথবা নিদ্রার কারণে যদি কারো নামাজ যথাসময়ে পঠিত না হয়, তবে তার কর্তব্য হবে, স্মরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে তার বাদ পড়ে যাওয়া নামাজ আদায় করে নেবে।
সুফিয়ানে কেরাম আলোচ্য আয়াত সম্পর্কে এক সারগর্ভ আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। তাঁদের মতে এই আয়াতের মর্মার্থ এরূপ- যখন তোমরা আলাহকে ছেড়ে অন্য কিছুর স্মরণে লিপ্ত হও, তখন আলাহর কথা স্মরণ কোরো বিশুদ্ধ অন্তরে। তাঁরা আরো বলেন, গাইরুল্লাহর স্মরণ থেকে পরিপূর্ণরূপে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত বিশুদ্ধ হৃদয়ে আলাহকে স্মরণ করা যায় না। কারণ মানুষের কলব একটিই। সুতরাং একথা কিছুতেই বলা যায় না যে, কলবে একই সঙ্গে জাগ্রত থাকবে আল্লাহ এবং গাইরুল্লাহর (আলাহ্ ছাড়া অন্য সকলকিছুর) স্মরণ। ক্বলবকে যদি আল্লাহর ভালোবাসায় পূর্ণরূপে নিমজ্জিত করা যায় তাহলে নিশ্বাস-প্রশ্বাসও রঞ্জিত হবে আল্লাহর ভালোবাসায় ও স্মরণে। এই অবস্থার নাম ফানায়ে ক্বলব (ক্বলবের অস্তিত্ব বিস্মতি)। এই ফানায়ে কলব অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সুফিয়ানে কেরাম কাউকে তওহীদপন্থী বা এক আল্লাহয় বিশ্বাস স্থাপনকারী মনে করেন না। আমি বলি, সুফিয়ানে কেরামের ব্যাখ্যাই কোরআন মজীদের স্পষ্ট বর্ণনা, আরবী ব্যাকরণ এবং অভিধানের অনুকূল। দেখুন, এখানে প্রথমে বলা হয়েছে ‘যদি ভুলে যাও’। তারপর বলা হয়েছে ‘তোমার প্রভুপালককে স্মরণ কোরো’। এভাবে এখানে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, বিস্মরণ ও স্মরণ (গাফলত ও জিকির) বিপরীতধর্মী দুটি বিষয়। এ দুটোর একত্রায়ণ সম্ভবই নয়। সুতরাং এ দুটো ক্রিয়ার একটিকে প্রত্যক্ষ অর্থে, আর একটিকে পরোক্ষ অর্থে গ্রহণ করতে হবে, যেনো কোনো অযথার্থ অর্থ গ্রহণ না করতে হয়। অতএব একথা মানতেই হবে যে, এক্ষেত্রে সুফিয়ানে কেরামের বক্তব্য সঠিক ও বাস্তবোচিত।
তথ্যসূত্র
আল্লাহ্র জিকির (লেখকঃ মুহাম্মাদ মামুনুর রশীদ)