গায়েব হল অদৃশ্য । গায়েব বা অদৃশ্য বলতে ঐসব কিছুকে বুঝায় যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যের অতীত অর্থাৎ বাহ্যিক ইন্দ্রিয়ের সাহায্য যা বুঝা যায় না। তাফসীরে কবীরের প্রথম খন্ডের ১৬৯ পৃষ্ঠায় ২৭ সতরে (মিসরী মুদ্রণ) আছেঃ
নিশ্চয়ই গায়েব হলো তা যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যের অতীত ।
এটাই জমহুর মুফাসসীরীনের অভিমত । ইন্দ্রিয় পাঁচটি - শ্রবণ, দর্শন, ঘ্রাণ, স্বাদ ও স্পর্শ । এইগুলোই হলো জ্ঞানেন্দ্রীয় । এইগুলো পাঁচটি অঙ্গের মাধ্যমে অর্জিত হয় - শ্রবনের জন্য কর্ণ, দর্শনের জন্য চক্ষু, ঘ্রাণের জন্য নাসিকা, স্বাদের জন্য জিহবা এবং স্পর্শের জন্য ত্বক । তাফসীরে আযিযীর প্রথম খন্ডে সূরায়ে বাকারার তাফসীরে ৫৭ পৃষ্ঠায় ২৮ সতরে আছেঃ
ঐ বস্তুর নাম গায়েব যা বহিন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অগোচরে বিদ্যমান ।
তাফসীরে বায়যাবীতে يؤمنون بالغيب আয়াতটির ব্যখ্যায় বলা হয়েছে-
গায়েব শব্দ দ্বারা অদৃশ্য বিষয়কে বুঝানো হয়েছে, যা’ ইন্দ্রিয় সমূহের দ্বারা উপলব্দি করা যায় না ও সুস্পষ্টভাবে জ্ঞানানুভূতির আওতায় আসে না ।
অতএব ‘গায়েব’ হচ্ছে এমন এক অদৃশ্য বস্তু বা বিষয় যা মানুষ চোখ, নাক, কান ইত্যাদি ইন্দ্রিয় সমূহের সাহায্য উপলব্ধি করতে পারে না এবং যা কো প্রমাণ ব্যতিরেকে সুস্পষ্টভাবে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পরিধিতেও আসে না । সুতরাং, পাঞ্জাবীদের জন্য বোম্বাই গায়ব বা অদৃশ্য নয় । কেননা হয়ত কেউ নিজ চোখে দেখে বা কারো কাছ থেকে শুনে বলছে যে বোম্বাই একটি শহর । ইহা হচ্ছে ইন্দ্রীয়লব্ধ জ্ঞান । অনুরুপ খাদ্যসামগ্রীর স্বাদ, সুঘ্রান ইত্যাদি গায়েব নয়, কেননা এগুলো যদিওবা চোখে দেখা যায় না, কিন্তুওন্যান্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধি করা যায় । পক্ষান্তরে এগুলোকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে কিংবা বিনা দলিলে বিবেক-বুদ্ধির দ্বারা অনুভব করা যায় না ।
গায়েব দুই প্রকার
(১) এক ধরনের গায়েব আছে, যা যুক্তি প্রমান ভিত্তিক অর্থাৎ প্রমাণাদি দ্বারা অনুভব করা যায় । উদাহরনঃ বেহেশত-দোজখ এবং আল্লাহ পাকের স্বত্বা ও গুনাবলী । এগুলো সম্পর্কে জগতের সৃষ্ট বস্তু ও কুরআনের আয়াতসমুহ দেখে জ্ঞান লাভ করা যায় ।
(২) আর এক ধরনের গায়েব আছে, যা দলিলের সাহায্যেও অনুভব করা যায় না । এ গুলো সম্পর্কে দলিল প্রমানের সাহায্যেও জ্ঞান লাভ করা সম্ভবপর হবে না । উদাহরনঃ মহাপ্রলয় কখন সংঘঠিত হবে, মানুষ কখন মারা যাবে, স্ত্রীর গর্ভের সন্তান ভাগ্যবান না হতভাগা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞান । এ দ্বিতীয় প্রকারের গায়েবকে মাফাতিহুল গায়েব বা অদৃশ্য জ্ঞান ভাণ্ডার বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং এ ধরনের গায়েব সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
তিনি (আল্লাহ) তাঁর গায়বী বিষয়াদি সম্পর্কে কাহাকেও অবগত করান না, তবে তাঁর মনোনীত রসুলকে ( অদৃশ্য জ্ঞান দান করেন ) যাকে তিনি রসূল রুপে গ্রহন করে নিয়েছেন ।
তাফসীরে কবীরে সূরা বাকারার শুরুতে يؤمنون بالغيب আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে -
সাধারণত তাফসীর কারকগনদের মতে গায়ব হল এমন বিষয় যা ইন্দ্রিয়সমূহ থেকে গোপন থাকে । অতঃপর গায়বকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়ঃ এক প্রকারের গায়ব হচ্ছে – সে সমস্ত অদৃশ্য বিষয়াদি, যেগুলো অবগতির জন্য কোনরুপ দলীল প্রমানের প্রয়োজন হয় না ।
তাফসীরে রুহুল বয়ানে সুরা বাকারার শুরুতে সেই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ আছে-
গায়ব হচ্ছে উহাই যা ইন্দ্রিয় ও জ্ঞানানুভূতি থেকে সম্পূর্ণরুপে এমনভাবে গোপন থাকে যে, কোন উপায়ে প্রথমদিকে স্পষ্টরুপে উপলব্দি করা যায় না । গায়ব দুই প্রকারঃ
· এক প্রকারের গায়ব হলো যার সম্পর্কে কোন প্রমান নেই । যেমন কুরআনের আয়াত عند مفاتيح الغيب ( আল্লাহর কাছেই রয়েছে গায়েবের চাবি সমূহ ) এ আয়াতে এ ধরনের গায়েবের কথাই বলা হয়েছে ।
· অন্য প্রকারের গায়েব হচ্ছে- যার অবগতির জন্য দলীল প্রমাণ আছে । যেমন- আল্লাহ ও তাঁর গুনাবলী । يؤمنون بالغيب দ্বারা এগুলোর কথাই বলা হয়েছে ।
এলমে গায়েব
পাঠকগণের উপকারার্থে নিন্মের বিষয়টি উপস্থাপন করা হলো-
রং চোখ দ্বারা দেখা যায়, নাক দ্বারা ঘ্রান নেয়া হয়, মুখ দ্বারা স্বাদ ও কান দ্বারা স্বর অনুভব করা হয় । সুতরাং মুখ ও কানের জন্য রং হচ্ছে গায়ব অনুরুপ চোখের জন্য ঘ্রান হলো গায়ব । যদি কোন আল্লাহর প্রিয় বান্দা ঘ্রান ও স্বাদেকে বিশেষ আকৃতিতে সচক্ষে অবলোকন করেন, তবে এও আপেক্ষিক ইলমে গায়ব “ইলমে গায়েবে ইজাফি” হিসাবে গন্য হবে । যেমন কিয়ামতের দিন কৃতকর্ম সমূহ বিভিন্ন আকৃতিতে দেখা যাবে । যদি কেও সেগুলোকে ওই আকৃতিতে এখানেই ( এ জগতেই ) দেখে ফেলে, তবে তাও ইলমে গায়েব বা অদৃশ্য জ্ঞানের আওতায় পড়বে । হযরত গাউছে পাক রাদিয়াল্লাহু আনহু ফরমানঃ
এ জগতের কোন মাস বা কাল আমার কাছে এসে আমার অনুমতি না নিয়ে অতিবাহিত হয় না ।
এ রকম যা কিছু বর্তমানে মওজুদ বা আস্তিত্তবান না হওয়ার বা অনেক দূরে বা অন্ধকারে থাকার কারনে দেখা যায় না তাও গায়েব হিসাবে গন্য । এ সম্পর্কে জানাটাও অদৃশ্য জ্ঞান । যেমন হুজুর আলাইহি সালাম ভবিষ্যতে উদ্ভাবিত কিংবা আবিস্কৃত হবে- এমন বস্তূ সমূহ দেখেছেন বা হযরত উমর বাদিয়াল্লাহু আনহু মদীনা শরীফ থেকে নেহাওয়ান্দে অবস্থানরত হযরত সারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু- কে দেখেছিলেন এবং স্বীয় আওয়াজ তাঁর কাছে পৌছে দিয়ে ছিলেন । অনুরুপ কেউ যদি পাঞ্জাবে বসে মক্কা মুয়াজ্জামা বা অন্যান্য দূরবর্তী দেশসমুহকে হাতের তালু দর্শনের মত স্পষ্টভাবে দেখতে পান, তবে তাও গায়েবের অন্তর্ভূক্ত হবে ।
উপকরন বা যন্ত্রপাতি সাহায্যে যেই সমস্ত অদৃশ্য বস্তুকে অবলোকন করা যায় , উহা ইলমে গায়েবের পর্যায়ে পড়ে না । যেমন যন্ত্রের সাহায্যে কোন মহিলার গর্ভস্থিত সন্তান সম্পর্কে জানা যায় বা টলিফোন ও রেডিও দ্বারা দূরের আওয়াজ শুনা যায় । এ গুলো ইলমে গায়েবের পর্যায়ে পড়ে না । কেননা গায়েবের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, যা কিছু ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা যায় না, তা’ই গায়েব । আর টেলিফোন ও রেডিও দ্বারা শ্রুত আওয়াজ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা যায় । যন্ত্রের সাহায্যে গর্ভবতীর শিশুর অবস্থা জানাও ইলমে গায়েব নয় ।
মোট কথা, যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে যদি কোন অদৃশ্য বস্তু প্রকাশিত হয়ে যায় এবং প্রকাশিত হওয়ার পরেই আমরা উহার সম্যক ধারণা লাভে সক্ষম হই, তহলে উহা ইলমে গায়েবের পর্যায়ে পড়ে না ।
তথ্যসূত্র
জা’আল হক ১ম খন্ড
এলমে গায়েবের প্রকারভেদ
ইলমে গায়ব তিন ধরনের রয়েছে এবং এদের পৃথক বৈশিষ্ট্য রয়েছে । (খালিসুল ইতেকাদ গ্রন্থের ৫ পৃষ্ঠা হতে সংগৃহীত) ।
প্রথম প্রকারঃ-
১) মহান আল্লাহ তাআলা সত্ত্বাগত ভাবেই জ্ঞানী । তিনি অবগত না করালে কেউ একটি অক্ষরও জানতে পারে না ।
২) আল্লাহ তাআলা হুযুর আলঅইহিস সালাম ও অন্যান্য আম্বিয়া কেরাম (আলাইহিস সালাম) কে তাঁর আংশিক অদৃশ্য বিষয়াদি জ্ঞান দান করেছেন ।
৩) হুযুর আলাইহিস সালামের জ্ঞান সমস্ত সৃষ্টিকূল থেকে বেশী । হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) ও খলীল (আলাইহিস সালাম) মৃত্যুর ফিরিশতা এবং শয়তানও সৃষ্টিকূলের অন্তর্ভূক্ত ।
এ তিনটি বিষয় ধর্মের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়াদির অন্তর্ভূক্ত বিধায় এগুলো অস্বীকার করা কুফর ।
দ্বিতীয় প্রকারঃ-
১) আম্বিয়া কিরাম (আলাইহিস সালাম) এর মাধ্যমে আওলিয়া কিরাম (রহমতুল্লাহে আনহু) ও ইলমে গায়বের কিয়দংশ পেয়ে থাকেন ।
২) আল্লাহ তাআলা হুযুর আলাইহিস সালাকে পঞ্চ গায়বের অনেক ক্ষেত্রে সুবিস্তৃত জ্ঞান দান করেছেন ।
যে এ দ্বিতীয় প্রকারের ইলমে গায়বকে অস্বীকার করবে সে পথভ্রষ্ট ও বদমযহাবী বলে গণ্য হবে । কেননা এটা শত শত হাদীছকে অস্বীকার করার নামান্তর ।
তৃতীয় প্রকারঃ-
১) কিয়ামত কখন হবে সে সম্পর্কেও হুযুর আলাইহিস সালাম জ্ঞান লাভ করেছিলেন ।
২) বিগত ও অনাগত ভবিষ্যতের সমস্ত ঘটনাবলী যা লওহ মাহফুজে সুরক্ষিত আছে সে সবের জ্ঞান বরং এর চেয়েও বেশী জ্ঞান হুযুর আলাইহিস সালামকে দান করা হয়েছে ।
৩) হুযুর আলাইহিস সালামকে রূহের হাকীকত বা নিগুঢ় তত্ত্ব এবং কুরআনের সমস্ত অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থবোধক বিষয়াদির জ্ঞান দান করা হয়েছে ।
তথ্যসূত্র
জা’আল হক ১ম খন্ড
এলমে গায়েবের বিপক্ষে শর্ত সমূহ
ইলমে গায়বে অবিশ্বাসীগণ যখন তাদের বক্তব্যের সমর্থনে প্রমাণাদি উপস্থাপন করে তখন নিম্নলিখিত বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা প্রয়োজন ।(এজহাতুল গায়ব গ্রন্থের ৪র্থ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য ।)
শর্ত ১
উপস্থাপিত আয়াতটি সুষ্পষ্ট ও অকট্রভাপবে ব্যাখ্যাকৃত হতে হবে যা বিবিধ অর্থ বোধক বা রূপক ব্যাখ্যার যোগ্য হলে চলবে না । আর হাদীছ উপস্থাপিত করা হলে হাদীছটি রেওয়ায়েতের দিক থেকে মুতাওয়াতির হতে হবে । (সাহাবায়ে কিরাম তাবেয়ীন ও তাবেয়ে তাবেয়ীন এ ৩টি যুগেই যে হাদীছের অগণিত বর্ণনাকারী হয় উহাই হাদীছে মুতাওয়াতির ।)
শর্ত ২ঃ
ঐ আয়াত বা হাদীছ যেন জ্ঞান দান করার বিষয় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয় অর্থাৎ আল্লাহ জ্ঞান দান করেনি কিংবা আমাকে এ জ্ঞান দান করা হয়নি এ ধরনের অস্বীকৃতির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত থাকতে হবে ।
শর্ত ৩ঃ
কোন বিষয়কে প্রকাশ না করলে তাতে সে বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞানতা বোঝা যায় না। এমনও হতে পারে যে প্রিয় নবী হুযুর (আলাইহিস সালাম) কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। কিন্তু কোন বিশেষ কারণে উহা ব্যক্ত করেননি । অনুরূপভাবে হুযুর আলাইহিস সালামের এ কথা বলা যে আল্লাহ জানেন আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা কিংবা আমি কি জানি? ইত্যাদি বাক্য দ্বারা হুযুর আলাইহিস সালামের জ্ঞানের অস্বীকৃতি বোঝা যায় না । এ ধরনের উক্তি সত্ত্বাগত জ্ঞানের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন ও উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে নীরব রাখার জন্যও ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।
শর্ত ৪ঃ
যে বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয় সে বিষয়টি যেন কোন ঘটনা সম্পর্কিত হয় ও উহা কিয়ামত পর্যন্ত সময় সিমানার মধ্যে হয় । কেননা আল্লাহর যাবতীয় গুনাবলী ও কিয়ামতের পরবর্তী বষয়াদি সম্পর্কিত জ্ঞানের আমরাও দাবী করি না ।
এ চারটি পরিচ্ছেদের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।