ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)
ইমাম আবু হানিফা আল নুমান ইবনে ছাবিত ইবনে যুতি হিজরি ৮০/৭০০ খ্রি। কুফায় জন্মগ্রহন করেন । তাঁর দাদা যুতি ছিলেন ফারিসের অধিবাসী । তিনি ছিলেন অগ্নি উপাসক । ৩৬ হিজরিতে তিনি ইসলাম গ্রহন করেন। এবং স্ত্রীকে নিয়ে হিজরত করে মক্কার পথে দেশ ত্যাগ করেন। কুফায় পৌঁছে তিনি হযরত আলী (রাঃ) এর সান্নিধ্য লাভ করেন । এবং এখানেই স্থায়ী ভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন । তিনি কাপরের ব্যাবসা দ্বারা জীবিকা নির্বাহের ব্যাবস্থা করেন । একবার নওরোজের সময় তিনি কিছু ফালুদা হযরত আলী (রাঃ) কে উপহার দিলে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ এ কি জিনিস? তিনি বলেন , নওরোজের ফালুদা । ৪০ হিজরিতে যুতির এক পুত্র জন্মগ্রহন করেন । নাম রাখেন ছাবিত ।বরকতের জন্য তাঁকে হযরত আলী (রাঃ) এর কাছে নিয়ে এলে- তিনি শিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেন।শিশু ধিরে ধিরে বড় হতে থাকে । কিন্তু বেশি দিন যেতে না যেতেই তাঁর পিতা মারা যান । মায়ের স্নেহে লালিত পালিত ছাবিত পিতার প্রাচুর্যে সুখেই দিনাতিপাত করতে থাকেন । তাঁর ৪০ বছর বয়সে ৮০ হিজরিতে তাঁর ঘরে এক পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহনকরে । জনক জননী আদর করে নাম রাখেন নুমান । ইনিই বিশ্ববিখ্যাত ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) । এই সময় উমাইয়া শাসক আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান মুসলিম জাহানের শাসনকর্তা ছিলেন । হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ইরাকের গভর্নর ছিলেন । তখন পৃথিবীতে অনেক সাহাবী জীবিত ছিলেন । তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ আব্দুল্লাহ ইবনে আল হারিছ (রাঃ) মৃত্যুঃ ৮৫ হিজরি;
হযরত ওয়াছিলা ইবনে আল আস কা’আ (রাঃ) মৃত্যুঃ ৮৫ হিজরি
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আওফা (রাঃ) মৃত্যুঃ ৮৭ হিজরি
হযরত সা’আল ইবনে সা’য়াদ (রাঃ) মৃত্যু – ৯১ হিজরি
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) মৃত্যু -৯৩ হিজরি
হযরত মাহমুদ ইবনে লবিদ আল আশহালি (রাঃ) মৃত্যু – ৯৬ হিজরি
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ইউছর আল মাজানী (রাঃ) মৃত্যু - ৯৬ হিজরি
হযরত মাহমুদ ইবনে আরবাবি আল আনসারী (রাঃ) মৃত্যু- ৯৯ হিজরি
হযরত আল হারমাম ইবনে জিয়াদ আল বাহিলী (রাঃ) মৃত্যু – ১০২ হিজরি
হযরত আবু আল তোফায়েল আমীর ইবনে ওয়াছিলা আল কিনানী (রাঃ) মৃত্যু- ১০২ হিজরি
ইনিই সাহাবীদের মধ্যে সর্ব শেষ ইন্তেকাল করেন ।
হযরত আবু হানিফা (রহঃ) এদের সকলের না হলেও সাত জনের সাক্ষাত লাভ করেন । এবং তিন জনের কাছে থেকে দরস হাসিল করেন ।তিনি ছিলেন তাবীঈ ।
তিনি শৈশবে নিজ গৃহে শিক্ষা লাভ করেন । তারপর কুফায় মসজিদে আরবি ব্যাকরন , কবিতা সাহিত্য , তর্কশাস্ত্র ইত্যাদি শিখেন । তিনি কালাম শাস্ত্রে বুৎপত্তি লাভ করেন এবং অন্যদের সাথে বিতর্কে অবতীর্ণ হতেন । এই সময় খারেজিয়া শিয়া , মুরজিয়া, কাদারিয়া , জাবারিয়া , মু’তাজিলা প্রভৃতি ফিরকার আবির্ভাব ঘটে ছিল । রাজনৈতিক দিক দিয়ে উমাইয়া শাসকদের অবসান ও আব্বাসিও শাসকদের সুচনা হয়। এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে তিনি আবির্ভূত হন । তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী । অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সমকালিন সমস্যা সম্পর্কে সম্যক ওয়াকেফহাল হন ।১৬ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন । পিতা ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী । তাঁর মৃত্যুর পর এই ব্যাবসার দায়িত্ব নিতে হয় যুবক ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) কে। তাঁর অসামান্য দক্ষতা ও নিষ্ঠায় ব্যাবসার পাশাপাশি তিনি কাপড় তৈরির এক কারখানা স্থাপন করেন । জা কিছু দিনের মধ্যেই অনন্য হয়ে ওঠে । এই সময় ৮৬ হিজরিতে আমীর আব্দুল মালিক মারা যান । এবং অলিদ ইবনে আব্দুল মালিক আমীর হন। ৯৫ হিজরিতে হাজ্জাজ মারা যান । এবং ৯৬ হিজরিতে অলিদ ও মারা যান ।তারপর সলায়মান ইবনে আব্দুল মালিক আমীর হন । তিনি ৯৯ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। এবং ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ খলিফা হন। তিনি উমাইয়া বংশের মারওয়ানি নীতি পালতে দেন । ইনসাফ ও ন্যায় বিচার কায়েম করেন ।খুতবায় হযরত আলী (রাঃ) সম্পর্কে যেসব অশোভন উক্তি উল্লেখ করা হতো তা আইন করে বন্ধ করে দেন । উমাইয়া খান দানের লোকেরা বিলাসী জীবন যাপনের জন্য যেসব সরকারি জায়গীর দখল করেছিল সেসব তিনি বাজেয়াপ্ত করেন । অসাধু ও অত্যাচারী কর্ম কর্তাদের অপসারন করে সৎ ও যোগ্য লোকদের নিয়োগ প্রদান করেন । শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে সার্বিক গুরুত্ব আরোপ করেন।
এ যাবত ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ব্যাবসা বাণিজ্য নিয়েই ব্যাস্ত ছিলেন । উমর ইবনে আব্দুল আজিজের জামানায় তাঁর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ এলো । একদিন কুফার প্রসিদ্ধ আলেম কাজী শা’বীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তিনি তাঁকে জিজ্ঞা সা করেন কোথায় যাও? অমুক সওদাগরের কাছে , তিনি বললেন।
তখন কাজী সাহেব বললেন, আমি জানতে চাচ্ছিলাম, তুমি কার কাছে পড়তে যাচ্ছ?
তিনি বললেন, আমি তো কারো কাছেই পড়ি না।
তখন কাজী সাহেব বললেন , বাছা আমি তোমার মধ্যে অসামান্য যোগ্যতা ও অসাধারণ প্রতিভা লক্ষ্য করছি । তুমি জ্ঞান আহরন করা শুরু কর ।
কাজী সাহেবের কথায় বালক নুমানের মন দারুন ভাবে প্রভাবিত হল । মা র কাছে এসে তিনি সব কথা বললেন। তাঁর মা ছিলেন একজন বিদ্যোৎসাহী বিদুষী মহিলা। বিদ্যার্জনে পুত্রের আগ্রহ তাঁকে পুলকিত করলো । তিনি তাৎক্ষনিক পুত্রকে নির্দেশ দিলেন, ভালো উস্তাদ তালাশ করে ইলেম হাসিল করতে।আগেই তিনি প্রয়োজনীয় শিক্ষা লাভ করেছিলেন ।তাই ইলেমে হাদিস ও ইলেমে ফিকাহর উচ্চতরশিক্ষার জন্য কুফার শ্রেষ্ঠ আলিম হাম্মাদ (রহঃ) এর কাছে যান। ২ বছর এখানে তিনি ফিকাহ অধ্যায়ন করেন।এই সময় তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।তাঁর অসাধারণ প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও মেধা তাঁকে ওস্তাদের আস্থা ভাজন করে দেয় ।
দু মাসের মধ্যে হাম্মাদ (রহঃ) বসরা যান । এই সময় তিনি প্রিয় ছাত্র আবু হানিফাকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। তিনি দক্ষতার সাথে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। নিয়মিত শিক্ষাদান ছাড়াও তিনি অগণিত আগন্তুকের নানা ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতেন।এমন সব প্রশ্নের উত্তর তাঁকে দিতে হতো, যা তিনি কখনও তাঁর ওস্তাদের কাছে শোনেননি । ইজতিহাদ করে উত্তর দিতেন। এই ধরনের ৬০ টি মাস’আলার উত্তর তিনি একটি নোটের মধ্যে লিখে রেখেছিলেন । ওস্তাদ ফিরে আসলে তিনি তাঁর কাছে সেগুলো পেশ করেন। হাম্মাদ (রহঃ) ৪০ টির উত্তর সঠিক এবং ২০ টির উত্তর ভুল হয়েছে বলে জানান । এরপর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ওস্তাদ হাম্মাদ (রহঃ) এর দরবারে ছাত্র হিসেবে কাটান। তাঁর মৃত্যুর পর এখানেই তিনি শিক্ষাদানে নিয়োজিত হন ।
ফিকাহ অধ্যায়ন এর পর তিনি হাদিস শিক্ষার জন্য তদানিন্তন হাদিস বেত্তাদের খিদমতে হাজির হন। এবং শিক্ষা লাভ করেন । তখনও কোন প্রনিধান যোগ্য হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয়নি । কোন একজন মুহাদ্দিস সকল হাদিসের হাফিজ ছিলেন না । সুতরাং তাঁকে অনেক ওস্তাদের কাছে যেতে হয়। প্রথমে তিনি কুফায় অবস্থানরত মুহাদ্দিসদের থেকে হাদিস শেখেন । এদের মধ্যে ছিলেন,
১) ইমাম শা’বি (রহঃ) , যিনি ৫ শতাধিক সাহাবীকে দেখেছিলেন ।দীর্ঘদিন তিনি কুফার কাজী ছিলেন ।১০৬ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
২) সালামা ইবনে কুহাইল
৩) মুহাজির ইবনে ওয়াছার
৪)আবু ইসহাক সাবই
৫)আওন ইবনে আব্দুল্লাহ
৬)সাম্মাক ইবনে হারব
৭)ইব্রাহিম ইবনে মুহাম্মাদ
৮) আদি ইবনে ছাবিত
৯) মুসা ইবনে আবু আয়েশা (রাঃ)
এদের পর ইমাম আবু হানিফা বসরা যান । সেখানে তিনি হযরত কাতাদাহ (রহঃ) এর খিদমতে হাজির হন ।এবং হাদিসের দরস হাসিল করেন।
হযরত কাতাদাহ (রহঃ) ছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাদেম হযরত আনাস (রাঃ) এর শাগরেদ । হযরত কাতাদাহ (রহঃ) হাদিস বর্ণনায় শব্দ ও অর্থের পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য রক্ষা করতেন । তারপর ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) হযরত শু’বা (রহঃ) এর দরসে যোগ দেন । তাঁকে হাদিস শাস্ত্রে ‘আমিরুল মুমিনিন’ বলা হয়। তিনি ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) সম্পর্কে বলেন, আমি দৃঢ় তার সঙ্গে বলতে পারি ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ও ইলেম দুই বস্তু নয় । বসরায় তিনি এই দুই জন ছাড়াও আব্দুল করীম ইবনে উমাইয়া (রহঃ) ও আসিম ইবনে সুলাইমান (রহঃ) এর কাছে থেকে হাদিস অধ্যায়ন করেন ।
কুফা ও বসরার পর তিনি হারামাইন শরিফাইন এর দিকে দৃষ্টিপাত করেন ।প্রথমে তিনি মক্কা গেলেন । সেখানে তিনি হাদিস বিদ হযরত ‘ আতা ইবনে আবু রিবাহ (রহঃ) এর দরবারে যান । এবং শাগ রিদির দরখাস্ত পেশ করেন । তিনি নাম ও আকিদা জানতে চান ।ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) বলেন, নাম নুমান। পিতা ছাবিত । পূর্ববর্তীদের মন্দ বলিনা । গুনাহ গার কে কাফির মনে করিনা ।ক্বাযা ও কাদরে বিশ্বাস করি । জবাব শুনে হযরত আতা (রহঃ) তাঁকে দরসে শামিল হতে অনুমতি দিলেন । ১১৫ হিজরিতে হযরত আতা (রহঃ) ইন্তেকাল করেন ।এই সময়ের মধ্যে তিনি যখনই মক্কায় আসতেন তার খিদমতে হাজির হতেন । এখানে তিনি হযরত ইকরামা ( রহঃ) এর কাছ থেকেও হাদিসের সনদ লাভ করেন।
মক্কা থেকে তিনি মদিনা যান ।সেখানে তিনি হযরত ইমাম বাকের (রহঃ) এর খিদমতে উপস্থিত হন। ইমাম বাকের (রহঃ) নাম শুনেই বলে উঠেন, তুমি কি ঐ আবু হানিফা, যে নিজের যুক্তির ভিত্তিতেআমার দাদার হাদিসের বিরোধিতা করে?? তিনি বললেন, আমার সম্পর্কে এই অসত্য রটানো হয়েছে।অনুমতি পেলে কিছু বলতে চাই। ইমাম বাকের (রহঃ) বললেন, বলো ।
ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) বলেন, পুরুষের তুলনায় নারী দুর্বল । যদি যুক্তির ভিত্তিতে আমি সিদ্ধান্ত দিতাম তাহলে বলতাম যে, উত্তরাধিকারের ব্যাপারে নারীকে অধিক দিতে হবে। কিন্তু আমি তা বলিনা। বলিঃ পুরুষ দ্বিগুন পাবে। অনুরূপ ভাবে রোজা অপেক্ষা নামাজ উত্তম । যুক্তির ভিত্তিতে কথা বললে বলতামঃ ঋতুবতী মেয়েলোকের জন্য নামাজের ক্বাযা জরুরী । কিন্তু তা বলি না ।বরং বলি তার ওপর রোজার ক্বাযা জরুরী ।
ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর এই বক্তব্য শুনে হযরত ইমাম বাকের (রহঃ) অভিভুত হলেন । এবং উঠে এসে কপালে চুমু দিয়ে দোয়া করলেন ।এবং যতদিন ইচ্ছা তার কাছে থাকতে অনুমতি দিলেন ।১১৪ হিজরিতে তার ইন্তেকাল হয়। তার পুত্র ইমাম জাফর সাদিক (রহঃ) তার স্থলাভিষিক্ত হন।ইমামা আবু হানিফা (রহঃ) এর সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল । আহলে বাইত সম্পর্কে ইমাম আজম বলতেন যে, হাদিস ও ফিকাহ তথা যাবতীয় মাজহাবী ইলেম আহলে বাইতের বিদ্দালয় থেকে নিঃসৃত । যখনই তিনি মক্কা ও মদিনায় যেতেন, তখন সেখানে আগত মুসলিম জাহানের বিশিষ্ট পণ্ডিত বর্গের সাহচর্য লাভ করে তিনি তার জ্ঞান আহরনের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা মিটাতে সচেষ্ট হতেন ।
১২০ হিজরি তে হযরত হাম্মাদ (রহঃ) ইন্তে কাল করেন।কুফা বাসি হযরত ইমামা আবু হানিফা (রহঃ) কে তার স্থলাভিষিক্ত করেন। তিনি আব্বাসি শাসক মন্সুর কর্তৃক ১৪৬ হিজরিতে কারা রুদ্ধ হওয়া পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই দায়িত্ব পালন করেন । মুসলিম জাহানের সর্বত্র তাঁহার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে । অসংখ্য শিক্ষার্থী তাঁর দরসে শামিল হতে থাকে ।যেহেতু তখন পর্যন্ত কোন আইন গ্রন্থ রচিত হয় নি , তাই তিনি মুসলিম মিল্লাতের স্বার্থে এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য সংকল্প গ্রহন করেন।তাঁর কয়েকজন বিশিষ্ট শাগরেদের সমন্বয়ে তিনি একটি পরিষদ গঠন করেন ।যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁদের ওপর ন্যাস্ত দায়িত্ব সমাধা করে উম্মতে মুহাম্মাদি কে চির ঋণী করে গেছেন ।
১৪৫ হিজরি তে যায়দিয়া ইমাম ইব্রাহিম ইবনে মুহাম্মাদ আব্বাসিয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসরা অবরোধ করেন। মানসুর এই বিদ্রোহ দমন করে বাগদাদে এসে ১৪৬ হিজরি তে ইমাম সাহেবকে তাঁর কাছে ডেকে পাঠান ।তাঁর ধারনা জন্মেছিল ইমাম সাহেব যায়দিয়াদের পক্ষ অবলম্বন কারী । হত্যা করা হবে এই মতলবেই তাঁকে ডেকে আনা হয়। কিন্তু ইমাম রাভির পরামর্শে আপাতত সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখে তাঁকে কাজির দায়িত্ব পালনের জন্য আনুরোধ করা হয়।বার বার অস্বীকার করার পরও মনসুর যখন তাঁর নির্দেশ প্রত্যাহার করলো না । তখন তিনি তা মেনে নিয়ে বিচারকের আসনে বসেন । বিবাদীর কাছে পাওনার দাবিতে একজন বাদী তাঁর কাছে মামলা দায়ের করেন।তিনি বিবাদীকে প্রমান উপস্থিত করতে না পারায় কছম করতে বলেন। যখন সে মাত্র আল্লাহ্র কছম উচ্চারন করলো, তখন ইমাম সাহেব তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বাদীকে তাঁর পাওনা নিজ পকেট থেকে দিয়ে দিলেন । এবং বললেন নাও তোমার প্রাপ্য ।কখনও কোন মুসলিম কে কছম করতে বাধ্য করোনা । এই ঘটনায় তিনি অত্যন্ত প্রভাবিত হলেন । এবং সরাসরি মনসুরের কাছে গিয়ে বললেন , না আমি এই কাজ করতে পারবনা । এতে মনসুর খুব ক্ষুব্ধ হলেন। এবং তৎক্ষণাৎ তাঁকে জেলে পাঠালেন ।
কারাগারে কিছুদিন নীরবে অতিবাহিত হবার পর তিনি মনসুর কে বললেন, আমাকে এখানে দরস চালু রাখার অনুমতি দিন । তাঁকে অনুমতি দেয়া হল । তিনি এখানে পাঁচ বছর পুরাদস্তুর দরস দেন। বন্দিশালায় তাঁর সুখ্যাতি আরও বেড়ে যায় । ইমাম মুহাম্মাদ শায়বানি (রহঃ) এখানেই ইমাম সাহেবের কাছে শিক্ষা লাভ করেন।
১৫০ হিজরি ৭৬৭ খ্রিস্তাব্দে তিনি কারাগারে ইন্তেকাল করেন। কারাগারে আবদ্ধ করার পরও তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় খলিফা মনসুর ভীত সঙ্কিত হয়ে বিষ প্রয়োগে তাঁকে হত্যা করে। ১৫ রজব ১৫০ হিজরি তে তিনি ইন্তে কাল করেন। বাগদাদের কাজী হাসান ইবনে আম্মারাহ তাঁর গোসল দেন ও কাফন পরান। জোহরের পর তাঁর প্রথম নামাজে জানাজাহ অনুষ্ঠিত হয়। অগণিত লোক এতে শরিক হয় ।পড়ে আসর পর্যন্ত আরও ছয় বার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এবং আসরের নামাজের পর তাঁর অয়াসিওত অনুযায়ী খায়জরান কবরস্থানে দাফন করা হয়। দাফনের পর ২০ দিন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত মানুষ কবরে তাঁর জানাজার নামাজ আদায় করেন।
৪৫৯ হিজরিতে সালজুকি সুলতান তাঁর কবরে একটি কুব্বা নির্মাণ করেন। আজও বাগদাদে তাঁর মাজার এলাকা ইমামিয়া , আ’জমিয়া, ও নুমানিয়া নামে খ্যাত ।
তিনি ছিলেন আপোষহীন ব্যাক্তিত্ব । নীতির জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করা ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য । কুফার উমাইয়া গভর্নর ইয়াজিদ ইবনে আমর ইবনে হুবায়রা এবং পরে আব্বাসি খলিফা মানসুর তাঁকে প্রধান কাজির পদ দান করলে তিনি তা দৃঢ় তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। এই কারণে তাঁকে দৈহিক শাস্তি ও কারাদণ্ড ভোগ করতে হয় এবং অবশেষে বিষ পানে প্রান ত্যাগ করতে হয়। তিনি নির্যাতন ভোগ করেছেন কারাগারে জীবন কাটিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত মজলুম অবস্থায় দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। তবুও তিনি নীতির প্রশ্নে আপোষ করেন নি । যালিম ও স্বৈরাচারী শক্তির কাছে নতি স্বীকার করেন নি ।
ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) তাঁর ওস্তাদের নামানুসারে একমাত্র পুত্রের নাম রাখেন হাম্মাদ। তিনি প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন। পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হাম্মাদ কখনও কোন সরকারি চাকরি করেন নি । শিক্ষা দান করতেন। এবং নিজের ব্যাবসার আয় দিয়ে জীবন যাপন করতেন।১৭৬ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। কুফায় তাঁকে দাফন করা হয়।
খলিফা হারুন অর রশিদ একবার ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ) কে ইমা আবু হানিফা (রহঃ) সম্পর্কে কিছু বলতে বললে তিনি বলেন, ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ছিলেন একজন মহান চরিত্রের অধিকারী সম্মানিত ব্যাক্তি । শিক্ষা দানের সময় ছাড়া প্রায় সময়ই নিশ্চুপ থাকতেন । তাঁকে দেখলে মনে হতো যেন তিনি কোন গভীর চিন্তায় মগ্ন আছেন । কোন প্রশ্ন করলে উত্তর দিতেন, নইলে চুপ থাকতেন।দানশিল ও হৃদয়বান ইমাম কখনও কারো কাছে কিছু চাইতেন না। দুনিয়াদার দের থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতেন । এবং পার্থিব জ্ঞান ও জশ কে তুচ্ছ জ্ঞান করতেন। কখনও কারো নিন্দা করতেন না । আলোচনা এলে শুধু ভালই বলতেন। খুব বড় আলেম ছিলেন । সম্পদের ন্যায় জ্ঞান বিতরনে ছিলেন উদার ।
ইবনে হুবায়রা যখন তাঁকে সরকারী পদ প্রত্যাখ্যান করার কারনে দৈহিক নির্যাতন করছিল তখন ইমাম সাহেবের মা জীবিত ছিলেন । তিনি পুত্রের প্রতি এই নির্যাতনে নিদারুন ভাবে মর্মাহত হন। ইমাম সাহেব তখন বলেছিলেন, ওরা আমাকে যে ক্লেশ দিচ্ছে আমি তা কিছুই মনে করিনা । তবে এতে আমার মা কষ্ট পাচ্ছেন তাই আমি ব্যাথিত । ইমাম সাহেব প্রত্যহ ফজরের নামাজের পর দীর্ঘক্ষণ কুরআন তেলাওয়াত ও নির্ধারিত আজিফা আদায় করতেন। তারপর আগন্তুকদের প্রশ্নের জবাব দিতেন। জোহরের নামাজের পর ঘরে যেতেন। দুপুরের আহারের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন।আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত লোকজনদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতেন ও ব্যাবসায় সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারক করতেন। মাগরিবের পর থেকে ইশা পর্যন্ত দরস দিতেন। এশার পর প্রায়ই মসজিদে থাকতেন ।এবং ফজর পর্যন্ত তাহাজ্জুদ ওঅন্যান্য আজিফা আদায় করতেন।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের মানুষ । কারো দুঃখ বেদনায় তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়তেন। সাধ্যানুযায়ী তিনি মানুষের সাহায্য করতেন। বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করতেন। তিলাওয়াতের সময় তাঁর চোখ থাকতো অশ্রু সিক্ত । নামাজ কিংবা নামাজের বাইরে যখনি আজাবের অথবা ধমকের কোন আয়াত তেলাওয়াত করা হতো তখন তাঁর ওপর এমন প্রভাব করত যে, তিনি কাঁপতে থাকতেন ও চোখ দিয়ে অশ্রু বিগলিত হতো ।
ইমাম মালেক (রহঃ)
ইমাম মালেক ইবনে আনাস (রা:) ৯৫ হিজরী মোতাবেক ৭১৫ খৃষ্টাব্দে মদীনা মোনাওয়ারায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭৯ হিজরী/৭৯৫ খৃষ্টাব্দ সালে সেখানেই বেসালপ্রাপ্ত হন। তিনি বলেন যে সত্তরজন ইমাম তাঁকে ফতোওয়া জারি করার তাকিদ দেয়ার পর তিনি তা দেয়া আরম্ভ করেন। তিনি আরও বলেন,
আমার শিক্ষকদের মধ্যে এমন খুব কম সংখ্যক-ই ছিলেন যাঁরা আমার কাছ থেকে ফতোওয়া নেননি।
ইমাম এয়াফী-ই বলেন যে ইমাম সাহেবের এই কথাটি বড়াই করার জন্যে বলা হয়নি, বরং তা আল্লাহতা’লার রহমত-বরকত প্রকাশের উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছিল। ইমাম যুরকানী মালেকী ‘মুওয়াত্তা’ গ্রন্থের ওপর কৃত তাঁর শরাহ’র মধ্যে লেখেন:
ইমাম মালেক (রহ:) ছিলেন বিখ্যাত ইমাম আল-মযহাব; শীর্ষ স্থানীয় আলেমদের অন্যতম। তিনি ছিলেন সুতীক্ষ্ণ ধীশক্তি ও সুনৈতিকতার অধিকারী। রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর আহাদীসের তিনি-ই ছিলেন উত্তরাধিকারী। তিনি আল্লাহতা’লার ধর্ম তাঁরই সৃষ্টির মাঝে প্রচার-প্রসার করেন। নয়’শ উলামা-এ-হাক্কানী/রব্বানীর সান্নিধ্য লাভ করে তিনি ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ হন। তিনি সংকলন করেন ১ লক্ষ হাদীস। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি শিক্ষা দান আরম্ভ করেন। তাঁর প্রভাষণ শুনতে আসা শ্রোতার সংখ্যা তাঁরই শিক্ষকদের প্রদত্ত প্রভাষণের শ্রোতা সংখ্যার চেয়ে বেশি ছিল। হাদীস ও ফেকাহ শিখতে শ্রোতারা তাঁর দরজার সামনে জড়ো হতো। এতে তাঁকে বৈতনিক একজন দারোয়ান নিয়োগ করতে হয়েছিল। প্রথমে তাঁর শিষ্যদের, তারপর সর্বসাধারণের প্রত্যেককে প্রবেশাধিকার দেয়া হতো। তিনি প্রতি তিন দিনে একবার হাউজে (গোসলখানায়) গমন করতেন। হযরত ইমাম বলতেন, ‘হাউজে দীর্ঘক্ষণ থাকতে আমি লজ্জাবোধ করি।’ ‘মুওয়াত্তা’ গ্রন্থটি লেখার সময় তিনি নিজের বিশ্বস্ততা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। তিনি বইটি (হাউজের) পানিতে রাখেন। তিনি এ সময় বলেন, ‘যদি বইটি ভিজে যায়, তাহলে এর কোনো প্রয়োজন আর আমার কাছে থাকবে না।’ আশ্চর্য, বইটির কোনো অংশ-ই ভেজে নি।
আবদুর রহমান ইবনে আনাস (রহ:) বলেন,
হাদীসের জ্ঞানে ইমাম মালেক (রহ:)-এর চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য আর কেউই বর্তমান পৃথিবীতে নেই। তাঁর চেয়ে জ্ঞানী আর কাউকেই আমি দেখিনি। হযরত সুফিয়ান সাওরী (রহ:) হাদীসের একজন ইমাম, কিন্তু তিনি সুন্নাহ’র ইমাম নন। আল-আওযাঈ (রহ:) সুন্নাহ’র ইমাম, কিন্তু হাদীসের ইমাম নন। ইমাম মালেক (রহ:)-ই হাদীস ও সুন্নাহ উভয়েরই ইমাম।” ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ (রহ:) বলেন, “ইমাম মালেক (রহ:) হলেন দুনিয়ার বুকে আল্লাহতা’লার সৃষ্টিকুলের জন্যে মহান প্রভুর সাক্ষীস্বরূপ।
ইমাম শাফেঈ (রহ:) বলেন,
যেখানেই হাদীস অধ্যয়ন করা হবে, ইমাম মালেক (রহ:) সেখানে আকাশের তারকাসদৃশ। (এতদসংক্রান্ত) জ্ঞানের মুখস্থকরণ, উপলব্ধি ও সংরক্ষণে কেউই ইমাম মালেক (রহ:)-এর মতো হতে পারবেন না। আল্লাহ-সম্পর্কিত জ্ঞানেও কেউ তাঁর মতো আস্থাভাজন নন। আল্লাহ পাক ও আমার মাঝে সাক্ষী হলেন ইমাম মালেক (রহ:)। ইমাম মালেক (রহ:) ও হযরত সুফিয়ান ইবনে উবায়না (রহ:) না হলে এতোদিনে হেজায অঞ্চল থেকে জ্ঞান তিরোহিত হতো।
হযরত আবদুল্লাহ (রহ:) যখন তাঁর পিতা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-কে জিজ্ঞেস করেন কে ইমাম যাহরী (রহ:)-এর শিষ্যদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী, তখন তিনি জবাবে বলেন ইমাম মালেক (রহ:)-ই (ইসলামী) জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় সবচেয়ে বেশি জানেন। ইবনে ওয়াহহাব বলেন,
ইমাম মালেক (রহ:) ও লায়েস (রহ:) না হলে আমরা সবাই পথভ্রষ্ট হতাম।” ইমাম মালেক (রহ:)-এর নাম মোবারক যখনই আল-আওযাঈ (রহ:) শুনতেন, তৎক্ষণাৎ তিনি বলতেন, ”তিনি জ্ঞানীদের মাঝে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং মদীনা মোনাওয়ারার সেরা আলেম; আর তিনি মুফতী-এ-হারামাইন শরীফাইন-ও।
হযরত ইমামের বেসাল হওয়ার খবর শুনে হযরত সুফিয়ান ইবনে উবায়না (রহ:) বলেন,
তাঁর মতো কাউকে আর বর্তমানে ধারণ করে না এই পৃথিবী। তিনি ছিলেন এই দুনিয়ার ইমাম, হেজায অঞ্চলের আলেম, তাঁর সময়ের সাক্ষী এবং উম্মতে মোহাম্মদীয়ার সূর্যতুল্য পুণ্যাত্মা। আমাদেরও তাঁর পথে চলতে হবে।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) বলেন যে ইমাম মালেক (রহ:) হযরত সুফিয়ান আস্ সাওরী (রহ:), ইমাম লায়েস, ইমাম হাম্মাদ ও আল-আওযাঈ (রহ:)-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। হযরত সুফিয়ান ইবনে উবায়না (রহ:) জানান যে নিম্নের হাদীসটি ইমাম মালেক (রহ:)-কেই উদ্দেশ্য করে বিবৃত হয়েছে; মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান,
মানুষদের যখন (কারোর খোঁজ করা) জরুরি প্রয়োজন দেখা দেবে, তখন তারা মদীনায় অবস্থিত আলেমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কাউকে পাবে না।
ইমাম মালেক (রহ:) বলেন যে তিনি প্রতি রাতেই রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে স্বপ্নে দেখতেন। মুসা’আব বর্ণনা করেন তাঁরই পিতা হতে শ্রুত বাণী, যিনি বলেন,
ইমাম মালেক (রহ:) ও আমি একবার মসজিদে নববীতে অবস্থান করছিলাম। কেউ একজন এসে জিজ্ঞেস করেন আমাদের মধ্যে কে আবূ আব্দিল্লাহ মালেক (রহ:)। আমরা ইমাম সাহেবকে দেখিয়ে দেই। ওই ব্যক্তি তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে কপালে চুম্বন করেন। অতঃপর তিনি বলেন, ’আমি স্বপ্নে দেখেছি হুযূর পূর নূর (দ:) এখানে বসে আছেন। তিনি আদেশ দেন, মালেককে ডাকো। আপনি কাঁপতে কাঁপতে ছুটে আসেন। মহানবী (দ:) এরশাদ করেন, এয়া আবা আবদ-আল্লাহ, শান্ত হও! বসো এবং নিজ বক্ষ বিদীর্ণ করো! অতঃপর আপনার বক্ষ বিদীর্ণ হলে সর্বত্র সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।’ এ কথা শুনে ইমাম মালেক (রহ:) অনেক কাঁদেন। তিনি বলেন, এই স্বপ্নকে জ্ঞান হিসেবে ব্যাখ্যা করতে হবে।
ইমাম শাফেঈ (রহঃ)
ইমাম শাফেঈ (রহ:)-এর পুরো নাম মোহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস ইবনে আব্বাস ইবনে উসমান ইবনে শাফেঈ। তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে ৮ম প্রপিতামহ হাশেম ইবনে আব্দিল মোত্তালেবের চাচা হাশেম ছিলেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর পূর্বপুরুষ। ইমাম সাহেবের ৫ম প্রপিতামহ সায়িব বদরের যুদ্ধে শত্রু পক্ষে অবস্থান করলেও পরবর্তীকালে তিনি ও তাঁর ছেলে শাফেঈ সাহাবী হবার মর্যাদা লাভ করেন। এই কারণে ইমাম সাহেবকে ‘আশ্ শাফেঈ’ বলা হয়। তাঁর মাতা সাহেবানী ছিলেন একজন শরীফা, মানে ইমাম হাসান (রা:)-এর বংশধর। ইমাম শাফেঈ (রহ:)-এর জন্ম গাযায় ১৫০ হিজরী মোতাবেক ৭৬৭ সালে এবং বেসাল মিসরে ২০৪ হিজরী/৮২০ সালে। দু’বছর বয়সে তাঁকে মক্কা মোকাররমায় নেয়া হয, যেখানে তিনি শৈশবকালে আল-কুরআন হেফয করেন এবং মাত্র ১০ বছর বয়সে ইমাম মালেক (রা:)-এর ‘মুওয়াত্তা’ হাদীসের গ্রন্থটি মুখস্থ করেন। পনেরো বছর বয়সে তিনি ফতোওয়া জারি আরম্ভ করেন। একই বছর তিনি মদীনা মোনাওয়ারায় যান এবং সেখানে ইমাম মালেক (রহ:)-এর কাছ থেকে ইসলামী জ্ঞান ও ফয়েয (আধ্যাত্মিক জ্ঞান) লাভ করেন। তিনি বাগদাদে আসেন ১৮৫ হিজরী সালে। দু’বছর পরে তিনি হজ্জ্ব উপলক্ষে মক্কা মোয়াযযমায় গমন করেন। হিজরী ১৯৮ সালে তিনি আবার বাগদাদে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৯৯ সালে মিসরে বসতি আরম্ভ করেন। তাঁর বেসাল শরীফের দীর্ঘকাল পরে কেউ কেউ তাঁর জিসম মোবারক বাগদাদে ফেরত নিতে চাইলে তাঁর মাযার খনন করা হয়। ওই সময়মাযার শরীফ থেকে কস্তুরিগন্ধ বের হয়ে খননকারী লোকদেরকে বেহাল করে দেয়। তারা খনন কাজ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ইসলামী জ্ঞান, এবাদত-বন্দেগী, যুহদ, মা’রেফত, ধীশক্তি, স্মরণশক্তি ও কুলপরিচয়ে তিনি ছিলেন তাঁর সময়কার ইমামবৃন্দের পাশাপাশি তাঁর আগেকার ইমামদেরও পুরোধা। তাঁর মযহাব দূর-দূরান্তে প্রসার লাভ করে। আল-হারামাইন ও আল-আরদ্ আল-মুকাদ্দাস (প্যালেস্টাইন)-এর অধিবাসীরা সবাই শাফেঈ মযহাবের অনুসারী হন। ইমাম শাফেঈ (রহ:) ছিলেন নিম্নবর্ণিত হাদীসে কৃত ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তব রূপ; মহানবী (দ:) এরশাদ ফরমান,
কুরাইশ গোত্রের আলেম-ব্যক্তি পৃথিবীকে জ্ঞান দ্বারা পরিপূর্ণ করবেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-এর পুত্র আবদুল্লাহ তাঁর বাবাকে ইমাম শাফেঈ (রহ:)-এর জন্যে কেন এতো বেশি বেশি তিনি দোয়া করেন এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তাঁর বাবা ইমাম সাহেব জবাবে বলেন,
ওহে পুত্র! মানুষের মাঝে ইমাম শাফেঈ (রহ:)-এর মর্যাদা হলো আকাশে সূর্যের উপস্থিতির মতো। তিনি আত্মার (ব্যাধি) নিরাময়কারীস্বরূপ।
ওই দিনগুলোতে ‘মুওয়াত্তা’ হাদীসগ্রন্থে সংকলিত হয়েছিল ৯৫০০ হাদীস। পরবর্তীকালে তা থেকে যাচাই-বাছাই করে বর্তমানের ১৭০০টি হাদীসের সংকলন হিসেবে এটি আকৃতি পায়। ইমাম শাফেঈ (রহ:)-এর উপনাম ছিল ‘নাসিরুস্ সুন্নাহ’ (ধর্মের সাহায্যকারী)। মাত্র চার বছরের অল্প সময়ে তিনি একটি মযহাবের গোড়াপত্তন করার ঘটনাটি সত্যি বিস্ময়কর। ইমাম সাহেবের জীবনী ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে ৪০টিরও বেশি বই অদ্যাবধি লেখা হয়েছে।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ)
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল আশ্ শায়বানী আল-মারুযী (রহ:)-এর জন্ম ১৬৪ হিজরী মোতাবেক ৭৮০ সালে বাগদাদ নগরীতে এবং বেসালও সেখানেই ২৪১ হিজরী/৮৫৫ সালে। তিনি হাদীস ও ফেকাহ উভয় শাস্ত্রেই ইমাম ছিলেন। সুন্নাহ’র সূক্ষ্ম ও অন্তর্নিহিত বিষয়গুলোতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। যুহদ ও ওয়ারায় তাঁর প্রসিদ্ধি ছিল। হাদীস সংগ্রহের উপলক্ষে তিনি কুফা, বসরা, মক্কা মোয়াযযমা, মদীনা মোনাওয়ারা, ইয়েমেন, দামেশক ও মেসোপটেমিয়ায় ভ্রমণ করেন। ইমাম সাহেব ফেকাহ-শাস্ত্র ইমাম শাফেঈ (রহ:)-এর কাছে শিক্ষা করেন, যিনি পাল্টা তাঁর কাছ থেকে হাদীস-শাস্ত্র শিক্ষা করেন। ইবরাহীম আল-হারবী বলেন,
আমি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-কে দেখেছি। আল্লাহতা’লা তাঁকে ইসলামী জ্ঞানের সকল শাখায় সমৃদ্ধ করেছিলেন।
কুতায়বা ইবনে সাঈদ বলেন,
যদি ইমাম আহমদ (রহ:) সর্ব-হযরত (সুফিয়ান) সাওরী (রহ:), আল-আওযাঈ (রহ:), ইমাম মালেক (রহ:) ও লায়েস্ ইবনে সাআদ (রহ:) প্রমুখের যুগে জীবিত হতেন, তবে তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে যেতেন।
তিনি দশ লক্ষ হাদীস মুখস্থ করেছিলেন। ইমাম শাফেঈ (রহ:) একবার তাঁকে মিসর থেকে একখানি পত্র পেরণ করেন। এই চিঠি পড়ার সময় তিনি কাঁদতে থাকেন। তাঁকে কাঁদবার কারণ জিজ্ঞেস করার পরে তিনি জবাব দেন,
ইমাম শাফেঈ (রহ:) স্বপ্নে দেখেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-কে, যিনি তাঁকে আদেশ করেছেন এই বলে, ‘আবূ আব্দিল্লাহ আহমদ ইবনে হাম্বলকে আমার সালাম-সহ একটি পত্র লেখো। কুরআন মজীদ সৃষ্টি কি-না সে সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে। তাকে বলবে ওই প্রশ্নের উত্তর না দিতে’।
আট লক্ষ পুরুষ ও ৬০,০০০ মহিলা ইমাম সাহেব (রহ:)-এর জানাযায় শরীক হন। যেদিন তিনি বেসালপ্রাপ্ত হন, সেই দিন ২০,০০০ ইহুদী, খৃষ্টান ও প্রাচীন পারসিক পুরোহিত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।