'ফিক্হ' শব্দটি আরবি । তা বাবে سَمِعَ এবং বাবে كَرِمُ উভয় বাব থেকেই ব্যবহৃত হয় । বাবে سَمِعَ থেকে ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হবে জ্ঞাত হওয়া, জানা, অবহিত হওয়া ইত্যাদি । আর বাবে كَرِمُ থেকে ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হবে ফকীহ্ হওয়া ।
আল্লামা হাস্কাফী (রঃ) ‘দুররুল মুখ্তার’ কিতাবে বলেন,
ফিকাহ্ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো - কোন বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া । পরে তা শরঈ বিষয়াদি জানার আথে খাস হয়ে যায় । এ শব্দটি বাবে سَمِعَ থেকে ব্যবহৃত হলে এর মাসদার হবে فقه, অর্থ হবে ‘জানা’ । আর বাবে كَرِمُ থেকে ব্যবহৃত হলে মাসদার হবে অর্থ فقاهة, অর্থ হবে ফকীহ্ হওয়া ।
আল্লামা ফখরুদ্দীন রামালী (রঃ) স্বীয় গ্রন্থ ‘মিনহাতুল খালিক আলাল বাহ্রির রাইক’ কিতাবে উল্লেখ করেন
فَقِهَ সে জ্ঞাত হয়েছে । فَقِهَ অবগত হওয়ার ক্ষেত্রে সে অন্যের তুলনায় অগ্রগামী হয়েছে । فَقُهَ তাঁর স্বভাবজাত বিষয়ে পরিণত হয়েছে ।
আল্লামা রশীদ রিযা মিশরী (রহঃ) তাঁর প্রণীত তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, এ শব্দটি আল-কুরআনের বিশ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে । তন্মধ্যে উনিশ জায়গায় তা গভীর জ্ঞান ও সূক্ষ্ম ইল্মের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ।
পরিভাষার এর একাধিক অর্থ বর্ননা করা হয়েছে । ‘মিফ্তাহুস সা’আদা’ গ্রন্থের লেখক ফিক্হ এর সংজ্ঞা বর্ননা প্রসঙ্গে বলেন,
যে ইল্মে শরীয়াতের বিধি-বিধান সম্বন্ধে আলোচনা করা হয় এ হিসাবে যে, তা উদ্ভাবন করা হয় বিস্তারিত প্রমাণাদি থেকে । এ ধরনের ইল্মকে ‘ইলমে ফিক্হ’ বলা হয় ।
এ সংজ্ঞা اصول فقه এর জন্য ঠিক । কিন্তু عام ف এর জন্য ঠিক নয় । সর্বোপরি এ সংজ্ঞা মুজতাহিদ ফকীহ্ এর বেলায় প্রযোজ্য । কিন্তু حافظ للفروع (শাখা-প্রশাখা সম্পর্কিত হুকুমের সংরক্ষক ব্যক্তি) এর ক্ষেত্রে এ সংজ্ঞা প্রযোজ্য নয় । কারো কারো মতে,
শরীয়াতের বিস্তারিত প্রমাণাদি থেকে আমলী শরীয়াতের বিধি-বিধান সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়াকে ফিক্হ বলে ।
উপরোক্ত সংজ্ঞায় বিস্তারিত প্রমাণাদি বলে কুরআন, হাদীস, ইজমা ও ক্বীয়াস তথা দলিল চতুষ্টয়কে বোঝানো হয়েছে । শায়খ্ ইবন হুমাম (রঃ) বলেন,
শরীয়াতের অকাট্য বিধি-বিধান যথাযথ অনুধাবন করাকে শরীয়াতের পরিভাষায় ফিক্হ বলা হয় ।
আল্লামা ইব্ন নুজায়ম (রঃ) এ মতটিকে সমর্থন করেছেন । ‘ইরশাদুল কাসিদীন’ গ্রন্থে ফিক্হ এর সংজ্ঞা এভাবে বর্ননা করা হয়েছেঃ
আমলী শরীয়াতের বিধি-বিধান সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়াকে ‘ইল্মে ফিক্হ’ বলে ।
‘ইত্মামুদ দিরায়া’ এবং ‘নিকায়া’ গ্রন্থে আল্লামা সুয়ুতী (রঃ) বর্ননা করেছেন যে,
শরীয়াতের যেসব বিধি-বিধান ইজতিহাদের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে সে সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়াকে ‘ইল্মে ফিক্হ’ বলা হয় ।
ইমাম আযম আবূ হানীফা (রহঃ) এর মতে,
নফস্ ও আত্মার জন্য যেসব কাজ কল্যাণকর এবং যেসব কাজ কল্যাণকর নয় তা সহ নাফ্স সম্বন্ধে যথাযথ অবহিত হওয়াকে ফিক্হ বলে ।
এ সংজ্ঞায় اعتقادات তথা আক্বীদা-বিশ্বাস وجدانيات তথা বাতিনী আখ্লাক এবং عمليات তথা সালাত, সাওম, বেচা-কেনা ইত্যাদি সব কিছুই অন্তর্ভূক্ত রয়েছে । কিন্তু পরবর্তীকালে যখন জ্ঞানের প্রতিটি শাখা স্বতন্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে তখন আক্বাইদ সম্পর্কিত জ্ঞানের নাম হয় ‘ইল্মে কালাম’ । আধ্যাত্মিক জ্ঞানের নাম হয় ‘ইল্মে তাসাউফ’ এবং আমলী জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিধি-বিধানের নাম হয় ‘ইল্মে ফিক্হ’ ।
সূফী সাধকদের মতে ইল্ম ও আমলের সমষ্টির নামে ফিক্হ । এ কারনেই হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেন-
পরকালমুখী ইহকাল বিমুখ, স্বীয় দ্বীণের প্রতি সতর্ক দ্রষ্টা, স্বীয় প্রতিপালকের ইবাদতে সদা নিয়োজিত এবং মুসলমানদের ইজ্জত ভূলুণ্ঠিতকরণ থেকে বিরত ও সতর্কতা অবলম্বনকারী ব্যক্তিকে ‘ফকিহ্’ বলা হয়ে ।
— قواعد الفقه
ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর মতে
শরীয়াতের শাখা-প্রশাখাজনিত জ্ঞান লাভ করা এবং সূক্ষ্ম علت সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়াকে ফিক্হ বলা হয় ।
— مباديات فقه
ফাতাওয়া ওয়া মাসাইল (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ)
ফকিহ্
اصول فقه এর পরিভাষায় মুজতাহিদ ব্যক্তিকে ফকীহ্ বলা হয় । যে ব্যক্তি মাসাইলের হাফিয কিন্তু মুজতাহিদ নন তাকেও রূপক অর্থে ফকীহ্ বলা হয় । আর ফিক্হ এর পরিভাষায় মাসাইলের হাফিয ব্যক্তিকেও প্রকৃত অর্থে ফকীহ্ বলা হয় । এমনকি তিনটি বিষয়ের হাফিজকেও ফকীহ্ বলা হয় । আল্লামা যামাখশারী তাঁর 'হাকিকাতুল ফিক্হ' গ্রন্থের ১ম খন্ডে উল্লেখ করেছেন
ফকিহ্ ঐ আলিমকে বলা হয় যিনি শরীয়াতের আহ্কাম তাঁর উৎসমূল থেকে বের করেন এবং ঐগুলির মূল তত্ত্বের অনুসন্ধান করেন ও তাঁর দূর্বোধ্য বিষয়সমূহ সমাধান করেন
হযরত ইমাম হাসান বসরী (রঃ) 'ফকীহ্' এর জন্য কয়েকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকার থাকার শর্ত উল্লেখ করেছেন । ইমাম গাজ্জালী (রঃ) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ইহ্ইয়াউল উলুমুদ্দিন' এর ১ম খন্ডে লিখেছেন যে, 'ফকীহ্' এর জন্য নিম্নোক্ত ৭টি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জরুরীঃ
১) দুনিয়ার প্রতি আসক্ত না হওয়া
২) আখিরাতের কাজসমূহের প্রতি আগ্রহশীল হওয়া
৩) দ্বীন ইসলামের উপর গভীর জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া
৪) ইবাদাতগুজার ও মুত্তাকী হওয়া
৫) মুসলমানের ইজ্জত সম্মান ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা
৬) ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধে কাওম ও মিল্লাতের কল্যাণ সাধনে ব্রতী হওয়া
৭) ধন-সম্পদের প্রতি লালসা না থাকা
অপর আরেকস্থানে ইমাম গাজ্জালী (রঃ) আরও বলেন
১) নিজের দোষ-ত্রুটি, অযোগ্যতা ও মূর্খতা সম্বন্ধে সচেতনতা
২) ঐসব বিষয়ে অবগত থাকা, যা আমলসমূহকে বরবাদ করে দেয়
৩) আখিরাতের পথের জ্ঞান
৪) আখিরাতের নিয়ামতের প্রতি সীমাহীন আগ্রহ
৫) দুনিয়াকে তুচ্ছজ্ঞান করে তাঁর থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার শক্তি অর্জন
৬) মনের মধ্যে আল্লাহ্ তা'আলার ভয় সব সময়ের জন্য স্থায়ী হওয়া । এ গুনগুলো ফিকাহের গবেষকের জন্য জরুরী ।
আল্লামা যামাখশারী 'ফকীহ্' সম্পর্কে এও উল্লেখ করেছেন
যে ফকীহ্ তাঁর যুগের মানুষের 'মাওযুদাহ্-হালাত' অর্থাৎ তাঁদের চিন্তা-চেতনা, পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা সম্বন্ধে ওয়াকিফ নয়, সে জাহেল।
বিখ্যাত 'হাদীসবেত্তা' আ'মাস (রঃ) ফকীহ্গণকে লক্ষ্য করে বলেছেন,
আপনারা চিকিৎসক আর আমরা হলাম ঔষধ বিক্রেতা।
ফকীহের মর্যাদা সম্পর্কে বুখারী ও মুসলিম শরীফের বরাতে মিশকাতুল মাসাবীহের কিতাবুল ইলমে বর্নিত হয়েছেঃ
আল্লাহ্ তা'আলা যার প্রতি মঙ্গলের ইরাদা করেন তাঁকে দ্বীনের অন্তর্নিহিত 'ফিকাহের এলেম' দান করেন