আবু আবদিল্লাহ মুহাম্মাদ বিন্ ইদরীস্ বিন্ আব্বাস বিন্ ওসমান বিন্ শাফিয়ী’ হাশেমী কো্রেশী মোত্তালেবী (র.) যিনি ইমাম শাফিরী নামে সমধিক খ্যাত- আহলে সুন্নাতের ইমাম চতুষ্টয়ের অন্যতম। এ মহান ব্যক্তি ১৫০ হিজরীতে ফিলিস্তিনের গাজায় জন্মগ্রহণ করেন। অবশ্যকেউ কেউ তাঁর জন্মস্থান আসকালান, মিনা বা ইয়েমেন বলেও উল্লেখ করেছেন। শাফিয়ী অনেক দিন মক্কা শরীফে থেকে ফিকাহ্শাস্ত্র শিক্ষা করেছিলেন। এরপর তিনি মদীনায় চলে যান এবং আহলে সুন্নাতের ইমাম চতুষ্টয়ের অন্যতম মালেক বিন্ আনাসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।১৭৯ হিজরীতে ইমাম মালেকের ওফাতের পরে তিনি ইয়েমেনে চলে যান এবং সেখানে কিছুদিন থাকার পর বাগদাদে চলে যান। তিনি ১৮৮ হিজরীতে বাগদাদ ত্যাগ করেন এবং হারান্ (ইরাকে অবস্থিত) ও শাম (সিরিয়া) হয়ে মিশরে যান। কিন্তু ১৯৫ হিজরীতে তিনি পুনরায়বাগদাদে ফিরে আসেন এবং ১৯৮ হিজরী পর্যন্ত সেখানে শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত থাকেন। এরপর তিনি পুনরায় মিশরে গমন করেন। ২০০ হিজরীতে তিনি বাইতুল্লাহ শরীফে হজ্বের উদ্দেশে মক্কা গমন করেন এবং হজ্ব সমাপনের পরে মিশরে ফিরে যান। ২০৪ হিজরীতেতিনি মিশরের ফুসতাতে ইন্তেকাল করেন।
ইমাম শাফেয়ী অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। গবেষকদের গবেষণা অনুযায়ী তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীর সংখ্যা ১১৩ থেকে ১৪০টি। ইবনে নাদীম তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আলফিহরিস্ত’- এ তাঁর লিখিত ১০৯টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁর লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থাবলীর অন্যতম হচ্ছে ‘কিতাবুল উম্ম’ যা তাঁর অনুসারী ইউসুফ বিন্ ইয়াহইয়া বুয়েতী (জন্ম ২৭০ হিজরী) কর্তৃক সংকলিত ও রানি’ বিন্ সোলায়মান কর্তৃক বিভিন্ন অধ্যায়ে বিন্যস্ত হয়েছে। ‘কিতাবুল উম্ম’-এর বিষয়বস্তু হচ্ছে ফিকাহ্। গ্রন্থটি ১৯৬১-১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কায়রো থেকে ৮ খন্ডে এবং১৩২১-১৩২৬ হিজরীতে বুলাক থেকে একবার চার খন্ডে ও আরেকবার ১৩২৪-১৩২৫ হিজরীতে সাত খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
শাফিয়ী রচিত অপরাপর বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: ‘আল মুসনাদ’ (হাদীস গ্রন্থ), ‘আহকামুল কুরআন’, ‘আসসুনান’, ‘র্আরিসালাতু ফি উসূলিল ফিক্হ্’, ‘ইখ্তিলাফুল্ হাদীস’, ‘আস্সাবাকু ওর্য়া রামী’, ‘ফাযায়েলু কুরাইশ’, ‘আদাবুল্ কাজী’, ‘আল্ মাওয়ারিস’ ইত্যাদি।
প্রচীনকালের গবেষক ইবনে আবি হাতিম রাযী (জন্ম ৩২৭ হিজরী), আবি বকর মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম বিন মানজার (জন্ম ৩১৮ হিজরী), আবি জা’ফার বিন মুহাম্মাদ খুলদী (জন্ম ৩৪৮ হিজরী), মুহাম্মদ বিন হোসাইন বিন ইবরাহীম ‘আছেম্ আবেরী (জন্ম ৩৬৩ হিজরী), ফখরুদ্দীন আবি আবদিল্লাহ মুহাম্মদ বিন ওমর রাযী (জন্ম ৬০৬ হিজরী) প্রমুখ ঈমাম শাফিয়ী (র.) সম্বন্ধে গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং তাতে তাঁর সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আধুনিককালের গবেষক ওয়াস্তেন ফেল্ড ইমাম শাফেয়ী এবং ৩০০ হিজরী পর্যন্ত তাঁরশিষ্যঅনুসারীদের সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা সম্বলিত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তেমনি মুস্তফা মুনীর আদহাম, আবু মুহাম্মাদ যোহ্রাহ্ প্রমুখ ইমাম শাফিয়ী সম্বন্ধে গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
স্বাধীন চিন্তাধারা পোষণকারী এ মহান মনীষী সব রকমের অন্ধত্ব থেকে মুক্ত থেকে নিষ্পাপ ও পবিত্র আহলে বাইত সম্বন্ধে স্বীয় মনোভাবকে বারবার সুস্পষ্টভাবে বয়ান করেছেন। তিনি মীনায় অবস্থানরত হাজীদের সম্বোধন করে যে সুন্দর কবিতা রচনা করেছেন তাবিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন:
‘আলে মুহাম্মাদের প্রতি ভালোবাসা যদি রাফয হয় তাহলে জিন্ ও ইনসান সাক্ষী থাকুক যে, নিশ্চয়ই আমি রাফেযী।
অন্য কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘যখন কোনো মজলিসে লোকেরা আলী (রা.)-কে স্মরণ করলো, আর তাঁর দুই সিংহ শাবক (তাঁর দু’পুত্র) ও পবিত্র ফাতিমাকে, বলা হলো: হে লোকেরা! (সাবধান!) ওরা সীমালঙ্ঘন করেছে এ (ইসলামের সীমারেখা) থেকে, আর এ মত দেয়া হয়হাদীসে রাফেযিয়াহর ভিত্তিতে, (কিন্তু) আমি ঐসব লোক থেকে মুহাইমেনের (আল্লাহ তাআলার) দিকে পালিয়ে গেলাম, ফলে (আমার মধ্যে) মুহাব্বাতে ফাতেমিয়াহ রূপ রাফয সুদৃড় হলো, আমার রবের সালাওয়াত আলে রাসূলের ওপর, আর লা’নত ঐ জাহেলীয়াতের ওপর।
ইবনে হাজর মাক্কীও ইমাম শাফেয়ী থেকে নিম্নোক্ত পঙক্তি উদ্বৃত করেছেন: ‘হে রাসূলুল্লাহ’র আহলে বাইত! তোমাদের (প্রতি) মুহাব্বাত, আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরয করা হয়েছে তাঁর নাযিলকৃত কুরআনে, এটাই যথেষ্ট যে, (তোমাদের মধ্যে) মহান মর্যাদা পুঞ্জিভূত হয়েছে, অতএব, নি:সন্দেহে তোমরা হচ্ছো সেই ব্যক্তিগণ, যে ব্যক্তি তোমাদের ওপর সালাত (দরূদ) প্রেরণ করেনি তার জন্য কোনো সালাত (নামায) নেই।
ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর শোকে ইমাম শাফিয়ীর কাসিদাহ্ (কবিতা)
মুওয়াফ্ফাক বিন্ আহমদ খাওয়ারিয্মী তাঁর গ্রন্থ ‘মাকতালুল্ হুসাইন’ -এ স্বীয় ধারাবাহিক সনদসূত্রে মুহাম্মদ বিন্ ইদরীস শাফিয়ী (র.) থেকে একটি কাসিদাহ উদ্বৃত করেছেন। কাসিদাহটি হচ্ছে: ‘আমার বেদনার প্রতিক্রিয়ায় হৃদয় বেদনায় ভরাক্রান্ত হয়ে গেলো এবং আমারনিদ্রা হরণ করে নিলো, এরপর নিদ্রা যে কত দূরে। আর যা আমার নিদ্রা কেড়ে নিয়েছে এবং আমাকে বৃদ্ধ করে দিয়েছে তা হচ্ছে কালের সেই বিবর্তন যা তাঁদের জন্যই খুবই কষ্টদায়ক ছিলো। অত:পর কে আমার বাণীকে হোসাইনের কাছে পৌঁছে দেবে? যদিও এ বাণী সকলব্যক্তি ও হৃদয় অপছন্দ করবে, তা হচ্ছে যেন এই নিরপরাধ শহীদ যে, তাঁর জামাকে রক্তিম রং মেশানো পানিতে ডুবিয়ে রাঙ্গানো হয়েছে। অতএব, তলোয়ারের জন্যই বিলাপ ও আর্তনাদ এবং বর্শার জন্যই বেদনার দীর্ঘশ্বাস, আর হ্রেষা ও দাবড়ানোর পরে অশ্বের জন্য রয়েছেউচ্চৈ:স্বরে ক্রন্দন। আলে মুহাম্মাদের জন্য দুনিয়া প্রকম্পিত হবে, যেহেতু অচিরেই তাঁদের (বেদনার) কারণে পাহাড়গুলো বিগলিত হয়ে যাবে। তারকারাজি ছিটকে পড়েছে ও ধ্বংস হয়ে গেছে, পোশাকসমূহ ছিন্ন হয়েছে, আমার গলাবন্ধ ফেটে গেছে। হাশেম বংশের লোকেরা যারাস্বীয় সন্তানদেরকে মুহাব্বাতের শিক্ষা দান করেন তাঁদের পক্ষ থেকে মাহদীর প্রতি দরূদ; আলে মুহাম্মাদের প্রতি মুহাব্বাত যদি গুনাহ হয়ে থাকে তাহলে এ হচ্ছে সেই গুনাহ যা থেকে আমি কখনোই তওবাহ করবো না। কিয়ামতের দিন তাঁরাই আমার শাফায়াতকারী যেদিনআমার গুনাহর পরিমাণ হবে