সৌদি আরব হলো কোনো ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠিত পৃথিবীর একমাত্র মুসলিম দেশ। অন্য কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ কোনো ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
আবদুল্লাহ বিন সৌদ
রিয়াদের নিকটস্থ দিরিয়া নামের একটি কৃষিবসতির প্রধান ছিলেন মুহাম্মদ বিন সৌদ। এই উচ্চাভিলাষী মরুযোদ্ধা ১৭৪৪ সালে আরবের বিখ্যাত ধর্মীয় নেতা মুহাম্মদ বিন ওয়াহাব [ওয়াহাবী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা]-এর সাথে মৈত্রী চুক্তি করে “দিরিয়া আমিরাত” গঠন করেন। তুরস্কের উসমানিয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে শিরক-বিদাত পালনের অভিযোগে এই দুজন ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। ওই “দিরিয়া আমিরাত”-ই বিশ্বের প্রথম সৌদি রাজ্য/আমিরাত। মুহাম্মদ বিন সৌদ তার পুত্র আবদুল আজিজের সাথে মুহাম্মদ বিন ওয়াহাবের মেয়ের বিয়ে দেন। এভাবেই সৌদ পরিবার ও ওয়াহাবী মতবাদের মিলনযাত্রা শুরু হয়। ১৭৬৫ সালে মুহাম্মদ বিন সৌদ-এর মৃত্যু হলে তার ছেলে আবদুল আজিজ দিরিয়ায় ক্ষমতাসীন হয়।
এই আবদুল আজিজ তত্কালীন বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী মোড়ল ব্রিটেনের সাথে হাত মিলিয়ে তুরস্কের খলিফাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে থাকে। শ্বশুর ইবনে ওয়াহাবের ধর্মীয় মতবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তথাকথিত শিরক-বিদাত উচ্ছেদের নামে ব্রিটিশদের সাথে তুর্কি খিলাফত ধ্বংসের কাজে লিপ্ত হয় আবদুল আজিজ। ১৭৯২ সালে মুহাম্মদ বিন ওয়াহাবের মৃত্যু হয়। ১৮০১/২ সালে আবদুল আজিজ তুর্কি খিলাফতের কাছ থেকে ইরাক দখল করে হজরত আলী (রা.) ও হজরত হুসেন (রা.)-এর মাজার শরিফ ভেঙে ফেলে। এর প্রেক্ষিতে ১৮০৩ সালে একজন শিয়া মুসলিম আজিজকে দিরিয়ায় আসরের নামাজরত অবস্থায় হত্যা করে।
এর পর আবদুল আজিজের ছেলে সৌদ বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতায় এসে তুর্কিদের পরাজিত করে ১৮০৩ সালে মক্কা ও ১৮০৪ সালে মদিনা দখল করে নেয়। দুই পবিত্র নগরী দখল করে তারা ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালায়। তারা মক্কা-মদিনার বহু মুসলিমকে হত্যা করে। সবই করা হয় সেই শিরক-বিদাত উচ্ছেদের নামে! ওয়াহাবী মতবাদের ধর্মীয় শুদ্ধি অভিযানের অজুহাতে তারা বহু সাহাবীর কবরস্থান ধ্বংস করে। এমনকি খোদ মহানবী (সা.)-এর পবিত্র কবরে ছায়াদানকারী মিম্বরগুলোও এরা ভেঙে ফেলে! এসবই চলে ব্রিটিশদের অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা নিয়ে।
খলিফা ২য় মাহমুদ
ইরাক-মক্কা-মদিনায় সৌদিদের এই ধ্বংসযজ্ঞে তত্কালীন তুর্কি খলিফাগণ ভীষণ রুষ্ট হন। ১৮০৮ সালে খলিফা ২য় মাহমুদ ক্ষমতাসীন হয়ে সৌদিদের দমনে শক্তিশালী সেনাদল পাঠান। ষড়যন্ত্রকারী ব্রিটিশরা এবার আর সৌদিদের বাঁচাতে পারেনি। ১৮১৮ সালে সৌদের ছেলে, তত্কালীন সৌদি শাসক আবদুল্লাহ বিন সৌদ তুর্কিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
আবদুল্লাহ বিন সৌদকে বন্দী করে ইস্তাম্বুলে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই পবিত্র নগরী ও বহু মসজিদ ধ্বংসের শাস্তি হিসেবে খলিফা ২য় মাহমুদ-এর নির্দেশে আবদুল্লাহ বিন সৌদ ও তার দুই ছেলেকে ইস্তাম্বুলে প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদ করা হয়।
এভাবেই প্রথম সৌদি আমিরাত (১৭৪৪-১৮১৮)-এর পতন হয় ও পবিত্র মক্কা-মদিনাসহ আরবে উসমানিয়া খিলাফতের শাসনকর্তৃত্ব ফিরে আসে।
সৌদ পরিবারের দিরিয়ার আখড়া ১৮১৮ সালে ধ্বংস হয়ে গেলে প্রথম সৌদি আমিরাতের শেষ আমীর আবদুল্লাহর তুর্কি নামের এক পুত্র মরুভূমিতে পালিয়ে যায়। এই তুর্কি বিন আবদুল্লাহ পালিয়ে বনু তামিম গোত্রে আশ্রয় নেয়। পরে ১৮২১ সালে সে আত্মগোপন থেকে প্রকাশ্যে এসে উসমানিয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
১৮২৪ সালে তুর্কি বিন আবদুল্লাহ উসমানিয়াদের নিয়োজিত মিশরীয়দের হটিয়ে দিরিয়া ও রিয়াদ দখল করে নেয়। রিয়াদকে রাজধানী করে গঠিত এই “নজদ আমিরাত” ইতিহাসে দ্বিতীয় সৌদি রাজ্য নামে পরিচিত। দ্বিতীয় সৌদি রাজ্যটি অবশ্য খুব কম এলাকাই দখলে নিতে পেরেছিল। এটি বেশিদিন টিকেওনি। এই নজদ আমিরাতের প্রধানকে “ইমাম” বলা হত এবং ওয়াহাবী মতাবলম্বীরাই ধর্মীয় বিষয়ে কর্তৃত্বশীল ছিল।
তবে এবার সৌদ পরিবারে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কথিত ইমাম তুর্কি বিন আবদুল্লাহকে তাঁর এক জ্ঞাতি ভাই মুশারি বিন আবদুর রহমান বিদ্রোহ করে ১৮৩৪ সালে হত্যা করে। তবে ক্ষমতা পায়নি মুশারি। তুর্কির ছেলে ফয়সাল এরপর নজদ আমিরাতের ইমাম হয়।
আবদুর রহমান বিন ফয়সাল
সৌদ পরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। অবশেষে ১৮৯১ সালে মুলায়দার যুদ্ধে উসমানিয়াদের অনুগত রাশিদী বাহিনীর হাতে দ্বিতীয় সৌদি আমিরাতের পতন ঘটে। সৌদিদের শেষ ইমাম আবদুর রহমান বিন ফয়সাল তার সাঙ্গোপাঙ্গসহ পালিয়েযায়।
বিশাল বালুকাময় রুব আল খালি মরুভূমি পাড়ি দিয়ে আবদুর রহমান তার পুত্র আবদুল আজিজকে নিয়ে দক্ষিণপূর্বে মুররা বেদুইন গোত্রে গিয়ে পালায়। সেখান থেকে তারা বাহরাইনের রাজপরিবারের কাছে গিয়ে কিছুদিন আশ্রয় নেয়। তার পর ১৮৯৩ সালে আবদুর রহমান ও তার পুত্র শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ দালাল কুয়েতি আল-সাবাহ রাজপরিবারের আশ্রয় পায়।
কুয়েতি রাজপরিবারের সহায়তায় সৌদিরা উসমানিয়া খিলাফতের কর্তৃত্বাধীন নজদে একের পর এক চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে থাকে। ওয়াহাবী মতবাদের আলোকে পরিশুদ্ধ ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে উসমানিয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে এসব হামলা চলতে থাকে। কিন্তু এসব হামলায় সৌদিরা তেমন কোনো বড় সাফল্য পায়নি। ১৯০১ সালে সারিফের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে আবদুর রহমান তার হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারের সব উদ্যম হারায়।
১৮৯৯ সালের জানুয়ারিতে কুয়েতের আমির মুবারক আল সাবাহ ব্রিটেনের সাথে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করে কুয়েতকে ব্রিটেনের করদরাজ্য (Protectorate)-এ পরিণত করেন। তুরস্কের উসমানিয়া খিলাফতের প্রভাবের বিরুদ্ধেই কুয়েত এই চুক্তি করে ব্রিটেনের সাথে।
আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ – বর্তমান সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা
সৌদ পরিবারের লড়াইটিও ছিল উসমানিয়া খিলাফতের বিরুদ্ধেই। তাই ১৯০১ সালে সারিফের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে পিতা আবদুর রহমান হতোদ্যম হলেও পুত্র আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ আবারও আশার আলো দেখে। আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ১৯০১ সালের শেষের দিকে কুয়েতের আমির মুবারকের কাছে উসমানিয়াদের নিয়ন্ত্রিত রিয়াদ আক্রমণের জন্য সাহায্য চায়। ব্রিটিশ মদদপুষ্ট কুয়েত সানন্দে ইবনে সৌদকে ঘোড়া ও অস্ত্র সরবরাহ করে।
১৯০২ সালের ১৩ জানুয়ারি ইবনে সৌদ সৈন্যসহ রিয়াদের মাসমাক দুর্গ আক্রমণ করে। মাসমাকের উসমানিয়া অনুগত রাশিদী প্রশাসক ইবনে আজলানকে হত্যা করে সৌদিরা। ইবনে সৌদ যুদ্ধজয় শেষে ইবনে আজলানের ছিন্নমস্তকটি নিয়ে দুর্গশীর্ষে আসে এবং নিচে সমবেত উদ্বিগ্ন রিয়াদবাসীর দিকে ছুঁড়ে মারে ।[1]
আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের রিয়াদ আমিরাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইতিহাসে তৃতীয় সৌদি রাজ্যের সূচনা হয়।
এর পর সৌদিরা একে একে রাশিদীদের নজদের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হটিয়ে দিতে থাকে। ১৯০৭ সালের মধ্যে সৌদিরা নজদের বিরাট এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।
William Henry Irvine Shakespear
১৯০৯ সালে ব্রিটিশরা সামরিক অফিসার William Henry Irvine Shakespear-কে কুয়েতে নিয়োগ দিলে সৌদ পরিবার আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। শেক্সপিয়ারকে ইবনে সৌদ সামরিক উপদেষ্টা বানিয়ে নেয়।[2]
১৯১৩ সালে সৌদিরা উসমানিয়া সৈন্যদের কাছ থেকে পূর্ব আরবের গুরুত্বপূর্ণ মরুদ্যান হাসা শহর দখল করে নেয়। এর পর পার্শ্ববর্তী কাতিফ শহরও সৌদিরা দখলে নেয়।
পরের বছর ১৯১৪ সালে বিশ্বজুড়ে ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ব্রিটেন-ফ্রান্স-রাশিয়ার মিত্রশক্তি জার্মানি-উসমানিয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। রিয়াদে ব্রিটিশরা শেক্সপিয়ারের মাধ্যমে সৌদিদের সাথে উসমানিয়া অনুগত রাশিদীদের যুদ্ধ লাগায়।[3]
১৯১৫ সালের জানুয়ারিতে সংঘটিত এই যুদ্ধে রাশিদীরা জয়ী হয় ও শেক্সপিয়ারকে হত্যা করে। রাশিদীরা শেক্সপিয়ারের শিরশ্ছেদ করে ও তার হেলমেট উসমানিয়াদের কাছে হস্তান্তর করে। উসমানিয়ারা সৌদিদের সাথে ব্রিটিশদের সম্পর্কের প্রমাণস্বরূপ শেক্সপিয়ারের হেলমেট মদিনার প্রধান ফটকে ঝুলিয়ে দেখায়।
শেক্সপিয়ারকে হারিয়ে বিপর্যস্ত ইবনে সৌদ ১৯১৫ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশদের সাথে দারিন চুক্তি স্বাক্ষর করে। ব্রিটিশদের পক্ষে ব্রিটেনের মধ্যপ্রাচ্য প্রধান মেজর জেনারেল স্যার পার্সি কক্স ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তি মোতাবেক সৌদি রাজত্ব ব্রিটিশদের করদরাজ্য (Protectorate)-এ পরিণত হয়।[4]
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন-ফ্রান্স-রাশিয়ার মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে জার্মান-উসমানিয়া খিলাফতের দুর্বল অবস্থা ও আল-সৌদ পরিবারের সাথে ব্রিটিশদের সখ্য দেখে চিন্তিত হয়ে ওঠেন মক্কার উসমানিয়া সমর্থিত শাসক হুসাইন বিন আলী।
১৯১৫ সালের ১৪ জুলাই থেকে হুসাইন মিশরের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার হেনরি ম্যাকম্যাহনের গোপনে পত্র যোগাযোগ শুরু করেন। ৩০ জানুয়ারি ১৯১৬ পর্যন্ত এই পত্র আদান-প্রদান চলতে থাকে। উসমানিয়া খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত বিশাল আরব ভূ-খণ্ডের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা মতবিনিময় করে।[5]
ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মদদে মক্কার শাসক সেই হুসাইন বিন আলী উসমানিয়াদের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহ তৈরি করে। ব্রিটিশ সামরিক অফিসার টি.ই. লরেন্সের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় বিশ্বাসঘাতক হুসাইন মিডল-ইস্টার্ন ফ্রন্টে উসমানিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শুরু করলে বহু উসমানিয়া সৈন্য বন্দী হয় ও অবশেষে উসমানিয়ারা ১ম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়।
ব্রিটিশ সামরিক অফিসার টি.ই. লরেন্স – আরববিশ্বে আরব জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা – হলিউডের বিখ্যাত “Lawrence of Arabia” (১৯৬২) মুভিটি একে নিয়েই নির্মিত
১৩০০ বছর পর মধ্যপ্রাচ্য মুসলিম খিলাফতের হাতছাড়া হয়ে যায়।
পুরস্কার হিসেবে ব্রিটিশরা ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর হুসাইন বিন আলীর দ্বিতীয় ছেলে আব্দুল্লাহকে জর্ডানের রাজত্ব ও তৃতীয় ছেলে ফয়সালকে ইরাকের রাজত্ব দেয়। হুসাইনকে রাখা হয় হেজাজ (পবিত্র মক্কা-মদিনা ও তাবুক অঞ্চল)-এর শাসক হিসেবে।
হুসাইন বিন আলী
এভাবে ১ম বিশ্বযুদ্ধ আল-সৌদ পরিবারকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলে। কেননা ব্রিটিশদের লেজুরবৃত্তির ক্ষেত্রে তাদের প্রতিপক্ষ হুসাইন পরিবার এগিয়ে যায় এবং যুদ্ধ শেষে হুসাইন ও তার দুই ছেলে মিলে তিন দেশের রাজত্ব পায়। তবে নজদ (রিয়াদ ও তদসংলগ্ন অঞ্চল)-এর শাসক সৌদিরাই থেকে যায়।
দারিন চুক্তির আওতায় আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ব্রিটিশদের কাছ থেকে বহু অস্ত্র ও মাসে ৫,০০০ পাউন্ড ভাতা (দালালির পুরস্কার) পেতে থাকে।
যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ইবনে সৌদকে ১ম বিশ্বযুদ্ধের উদ্বৃত্ত বিপুল গোলাবারুদ দিয়ে দেয়। ওই ব্রিটিশ অস্ত্র ও গোলাবারুদের সম্ভার নিয়ে সৌদিরা ক্রমধ্বংসমান উসমানিয়া খিলাফতের অনুগত রাশিদীদের ওপর দক্ষিণ-পশ্চিম আরব অঞ্চলে আক্রমণ শুরু করে। ১৯২০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত লড়ে রাশিদীরা শেষ পর্যন্ত সৌদিদের হাতে পুরোপুরি পরাজিত হয়। ফলে আরবে আল-সৌদ পরিবার নিয়ন্ত্রিত ভূ-খণ্ডের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। ইরাকে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত Percy Cox-এর মধ্যস্থতায় ১৯২২ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত Uqair Protocol-এর আওতায় ওই বিশাল অঞ্চলে সৌদি রাজত্ব স্বীকৃতি লাভ করে।[7]
এ-সময় পর্যন্ত আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ কখনোই ব্রিটিশ অনুগত হেজাজের শাসক হুসাইনের সাথে সংঘাতে জড়ায়নি।
১৯২৪ সালের ৩ মার্চ আরেক ব্রিটিশ দালাল মুস্তাফা কামাল পাশা তুরস্কে অফিসিয়ালি খিলাফত বিলুপ্ত করে। সারা বিশ্বের মুসলিমদের সাথে মক্কার হুসাইন বিন আলীও মহানবী (সা.) আমল থেকে ১৩০০ বছর পর্যন্ত চলমান মুসলিমদের রাষ্ট্র খিলাফতের পতনে ব্যথিত হন। পৃথিবী থেকে খিলাফত মুছে গেছে, এটা হুসাইনের চেতনায় আঘাত করে। ব্রিটিশদের ক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা সত্ত্বেও ৫ মার্চ হুসাইন নিজেকে মুসলিমদের খলিফা ঘোষণা করেন।
ব্যস, এ-সুযোগটিই কাজে লাগায় খিলাফতের দীর্ঘদিনের শত্রু আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ। ব্রিটিশরা স্বাভাবিকভাবেই হুসাইনের নিজেকে খলিফা ঘোষণা করা মেনে নেয়নি এবং হেজাজের শাসক হিসেবে হুসাইনের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেনেয়।
আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ কালবিলম্ব না করে হেজাজ আক্রমণ করে এবং ১৯২৫ সালের শেষ নাগাদ পুরো হেজাজ দখলে নিয়ে নেয়। ১৯২৬ সালের ৮ জানুয়ারি আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ মক্কা-মদিনা-জেদ্দার গোত্রীয় নেতাদের সমর্থনে নিজেকে হেজাজের “সুলতান” ঘোষণা করে। ১৯২৭ সালের ২৭ জানুয়ারি ইবনে সৌদ আগের নজদ ও বর্তমান হেজাজ মিলিয়ে Kingdom of Nejd and Hejaz ঘোষণা করে। ৪ মাস পর সেই বছরের ২৭ মে জেদ্দা চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশরা Kingdom of Nejd and Hejaz-কে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।[8]
নতুন জেদ্দা চুক্তি, ১৯২৭-এর মাধ্যমে ব্রিটিশ-সৌদের “Protectorate” স্ট্যাটাসের দারিন চুক্তি, ১৯১৫-এর সমাপ্তি ঘটে।
পরবর্তী ৫ বছর আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ তার দুই রাজত্বকে আলাদা রেখেই শাসন করে। অবশেষে ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ইবনে সৌদ তার দুই রাজত্বকে একত্রিত করে তার নিজের ও বংশের পদবি অনুসারে দেশের নাম “Kingdom of Saudi Arabia” (আরবি: المملكة العربية السعودية al-Mamlakah al-‘Arabiyyah as-Su‘ūdiyyah) ঘোষণা করে।
এভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উসমানিয়া খিলাফতবিরোধী নীতির প্রকাশ্য সমর্থক হিসেবে, পদে পদে ব্রিটিশদের মদদ নিয়ে, দালাল আল-সৌদ পরিবার ১৯৩২ সাল থেকে Kingdom of Saudi Arabia নামে মুসলিমদের পবিত্র ভূমি দখলে রেখে শাসন করে যাচ্ছে।
১. মিশরের মুরসি সরকারের পতনের পর সৌদি সরকারের ভূমিকায় মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এই দালাল রাজপরিবারের ইতিহাস তাই মুসলিম উম্মাহর জেনে রাখা প্রয়োজন।
২. সৌদ পরিবার মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক উসমানিয়া খিলাফত ভাঙতে ওয়াহাবী মতবাদকে ব্যবহার করেছিল। আর সৌদ পরিবার জেনে-বুঝে দালালি করেছে তত্কালীন বিশ্বমোড়ল ও খিলাফতের শত্রু ব্রিটেনের।
৩. মাজারকেন্দ্রিক শিরকের চর্চা আর কবর জিয়ারত এক কথা নয়। মাজারকেন্দ্রিক শিরক পরিত্যাজ্য, কিন্তু কবর জিয়ারত একটি প্রতিষ্ঠিত সুন্নাহ।
৪. এই নোটে বহু বই থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে – তবে তথ্যগুলো এতই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে, কম-বেশি সব তথ্যই Wikipedia-য় আছে। এমন কি, সৌদি দূতাবাসের ওয়েব সাইটেও আছে [অবশ্যই ব্রিটিশদের দালালির বিষয়টি বাদ দিয়ে][9]
৫. যারা সৌদি আরবের ইতিহাস সামগ্রিকভাবে একটি বই থেকেই জানতে চান, তারা Cambridge University Press থেকে ২০০২ সালে প্রকাশিত Madawi al-Rasheed-এর লেখা A History of Saudi Arabia বইটি পড়তে পারেন।
৬. প্রফেসর ড. আবদুল্লাহ মুহাম্মদ সিন্দি রচিত ২২ পৃষ্ঠার নিবন্ধ/বুকলেট “The Direct Instruments of Western Control over the Arabs: The Shining Example of the House of Saud” এ-বিষয়ে একটি অনবদ্য রচনা।
জাজিরাতুল আরবের প্রদেশ সমূহ
বর্তমান এই যুগে আরব বলতে আমরা উপলব্ধি করতে পারি মুসলিম জাহানের ঐতিহাসিক স্থান ও ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মক্কাতুল মুয়াজ্জামা,এটি পূর্বে বাক্কা নামে প্রসিদ্ধ ছিল। মহান আল্লাহ তা'লা তার ঐশীগ্রন্থ কুরআনে পাকে ঐ স্থানকে "উম্মুল কুরা" তথা "আদি নগর" হিসেবে অবহিত করেছেন, এই মক্কা নগরীকে কেন্দ্র করেই ইসলামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় এবং এর অন্তর্নিহিত ইতিহাস ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বের এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয়।
১৮৮০ সালের পূর্বে আরব ইতিহাসের যে পরিচয় পাওয়া যায়,সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গেলে ইতিহাস বলে,সে সময়ের আরবীয়দের মধ্যে ছিল সত্যের উজ্জীবিত আদর্শ, নিয়মনীতি, সাম্য,মৈত্রীর এক আভিনব কানুন শৃংখলার বিশ্ময়কর পরিবেশ।আরবীয়দের আদর্শের জাগরণের সৌরভে সুশোভিত হয় সারা বিশ্ব। ততকালীন সময়ে তাদের জীবনাচার ও শিষ্টাচার এমনিভাবে প্রভাবিত করে ছিল যে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলো আরবীয়দের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে তাদের রীতি-নীতি অনুস্বরন করত। তারাই ছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বের পরিচালক ও সংস্কারক।কেননা,তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার সংবিধান রচনা হয়েছিল বিশ্ব জাহানের মুক্তির দিশারী মানবতার পথ প্রদর্শক বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) এর আলোকিত সত্যের আদর্শ থেকে এবং তিনি কুরআন-সুন্নাহের আলোকে তাহার উম্মতগণকে ইসলামী গণতন্ত্র-এর যে শিক্ষা দিয়েছেন,তার বিস্তার লাভ করেছিল আরব ভূ-খন্ড থেকেই।
সেক্ষেত্রে তখনকার আরবীয়দের আদর্শ ছিল শিক্ষনীয় এবং তাদের শাসন ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া ছিল দৃষ্টান্তমূলক। সে আমলে আরবে বসবাসরত অন্যান্য ধর্মের অনুসারিগণ তাদের একতা, ভ্রাতৃত্ব ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকে এবং মুসলমানদের দিনে দিনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রভাব দেখে আরবে অবস্থানরত অন্যান্য কাফির, ইয়াহুদি,নাসারারা ভীষণভাবে ব্যাথিত ও আতংকিত হতে থাকে। তারা তাদের ঐতিহ্য,সংস্কৃতি,রীতি-নীতি হারানোর ভয়ে মুসলমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করতে থাকে।তারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলিম ছদ্মবেশে মুসলমানদের আদর্শ দুর্বল ও ধ্বংস করার নিমিত্তে সর্বদা চেষ্টা চালাতে থাকে। শত চেষ্টার পরেও তারা খুব কমই সফল হয়। কারণ,মুসলমানদের অন্তরে ছিল আল্লাহ ও তার হাবিবের একনিষ্ঠ ভালবাসা এবং কুরআন-সুন্নাহের আদর্শে গড়া প্রবিত্র ঈমান। তারা তখন আরবের মুখোশদারী কিছু মুসলমান তথা মুনাফিকদের সহযোগীতায় তাদের প্রক্রিয়াকে বেগবান করে। যেমন মুসলমানগণ যখন ইবাদতে মাশগুল থাকতেন,তখন তারা মুসলমানদের ন্যায় রূপধারণ করে মুসলমানদের ইবাদাত ও ধর্ম-কর্ম নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করত। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা'লা তাঁহার প্রবিত্র কুরআনুল কারীমে "সূরা মায়েদা"এর ৫৭ নং আয়াত থেকে ৬০ আয়াত পর্যন্ত মুনাফিকদের কার্যক্রম সম্পর্কে ঈমানদারগণকে সাবধান করেছেন।
ওসমানীয় সম্রাজ্য (১৯১৪ সাল)
কিন্তু আল্লাহ ও রাসুলের দুশমনের দল তথা ইয়াহুদি, নাসারা, কাফের,মুনাফিকরা অন্যান্য সকল ইবাদত বন্দেগিতে ক্ষতিসাধন করলেও কিন্তু তাদের দ্বারা নবী কারীম (দ.)-এর গুণগাণ,দরুদ ও সালাম পড়া তাদের নিকট আসম্ভব হয়ে পড়ত। ফলে তাদের কার্যক্রম ব্যহত হতো। পরে তারা সম্মিলিতভাবে চিন্তা করতে লাগল যে,মুসলমাদের অন্তর থেকে কিভাবে নবীর প্রেম তথা দরুদ সালাম বের করা যায়। তারা উপলব্ধি করতে পারল যে,নবীর প্রতি ভালবাসাই হচ্ছে মুসলমানের ঈমান ও আদর্শ মজবুত থাকার প্রধান ভিত্তি। আর তা ধ্বংস করতে পারলেই তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। ফলে মুসলমানদের একতা ও ভ্রাতৃত্ব বিনষ্ট হলে তাদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ দেখা দিলে অন্য ধরমের অনুসারীরা মুসলমানদেরকে ঘৃনা অবজ্ঞা করতে থাকবে। আর তা যদি বাস্তবায়ন করতে হয়,তাহলে মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তখনই তাদের দৃষ্টি পড়ল মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তর শক্তিশালী দেশ তুরস্কের দিকে। ১৮৮০ সালের দিকে তুরস্কবাসী ছিল অন্যান্য মুসলিম দেশের চেয়ে অধিক নবী প্রেমে উজ্জীবিত। তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে মিলাদুন্নাবী (দ.) এবং কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইসলামের মাহাত্ম্য ও মূলমন্ত্রকে প্রচার প্রসার করতেন। তুরস্কবাসীর এই ধরণের অনুষ্ঠান তাদের সহ্য হত না। ফলে তারা তুরস্ক প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে থাকে। তখন তৎকালীন তুরস্কের শাসক গোষ্ঠীর নাম ছিল সুলতানাতুল ওসমানিয়া এবং বাদশা ছিলেন মুস্তফা কামাল পাশা এবং রাজধানী ছিল ইস্তাম্বুল। তখন প্রশাসনেরনেত্রীত্বে অধিকাংশ আরব ভূমিকে শাসন করা হত। তার মধ্যে তুরস্কের বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে অন্যতম প্রদেশ হলো 'নজদ',যা এখন সৌদ আরবের রাজধানী রিয়াদ নামে খ্যাত।
মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব নজদী
তৎকালীন আমলে নজদের গভর্নর ছিলেন রশিদ। আর গভর্নর রশিদ কর্তৃক গঠিত গোত্র শাখার নাম ছিল রশিদীয়া গোত্র এবং রশিদীয়া গোত্রের মাধ্যমে নজদের সকল প্রকার কার্যক্রম সম্পাদন করা হতো। তখন রশিদীয়া গোত্রের আদর্শ ছিল সুন্নি মতাদর্শ ভিত্তিক। কিন্তু নজদের কিছু সংখ্যক লোক এবং তাদের শীর্ষ নেতা সৌদ ও তার পুত্র আব্দুল আজিজ ছিল খারেজী মতাদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের ইতিহাসে কথিত আছে যে,৬৬১ খ্রি: বিদ্রোহী খারেজীগণ হযরত আলী (রা:)কেইসলামের শান্তি-শৃংখলা কারণ বলে দায়ী করে। পরে খারেজী গোত্রের একজন সদস্য যার নাম ছিল আব্দুর রহমান ইবনে মূলজিম হযরত আলী (রা:)কে নামায থেকে ফেরার পথে বিষাক্ত ছুরির অব্যর্থ আঘাতে ৬৬১ খ্রি: ২৭ জানুয়ারি ২১ রমজান হযরত আলী (রা:) কে শহীদ করে দেয়। সেই খারেজী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা ও প্রচার প্রসারের লক্ষে সৌদ এবং তার পুত্র আব্দুল আজিজ একনিষ্ঠভাবে কাজ করতে থাকে এবং তাদের গঠিত গোত্র পতিদের নিয়ে ধীরে ধীরে সুন্নি মতাদর্শের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও মতানৈক্য করতে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, ওহাবীদের গোঁমর ফাঁস নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, প্রখ্যাত ভন্ড নবী মুসাইলামাতুল কাজ্জাবের একজন বংশধর, সে নজদ প্রদেশের আল উয়ানীয়া নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যার নাম ছিল "মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব নজদী, সে ছিল সৌদের শ্বশুর। সে বাল্যকাল থাকে ধর্ম বিরোধী ছিল এবং খারেজী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষে সর্বদা জামাতা সৌদকে সহযোগীতা করত। শেষ পর্যন্ত সৌদের গোত্র খারেজী আদর্শে উদ্ভুদ্ধ হয়েদূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে। একথা অবশ্যই নবী কারীম (দ:) এর হাদীসে বর্ণিত আছে যে, মসজিদে নববীতে নবী কারীম (দ:) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে ফরিয়াদ কালে তিনি বিভিন্ন প্রদেশের নাম ধরে এবং সমস্ত উম্মতে মুহাম্মদীরজন্য দোয়া করা অবস্থায় একজন নজদের অধিবাসী সাহাবী,তাঁর নাম ছিল আবুল মুকাররাম, তিনি নবী কারীম (দ:) এর প্রতি আরজ করলেন,ইয়া রাসূলুল্লাহ (দ:)! আমি নজদ থেকে এসেছি, আমার মাতা-পিতা ও আমার নজদ প্রদেশের জন্য একটু দোয়া করুন। এভাবে ক্রমান্বয়ে তিন তিনবার বলা সত্বেও নবী কারীম (দ:) তার নজদ প্রদেশের জন্য দোয়া করেননি। নবী কারীম (দ:) আবুল মুকাররাম (রা:)কে ডেকে বল্লেন- হে আবুল মুকাররাম! আমি এই কারণে নজদের জন্য দোয়া করিনি যে,কেননা ঐ নজদ থেকে শয়তানের শিং বের হবে(আমার কুরআন সুন্নাহ ও সালাতুস সালামের বিপক্ষে প্রচার আরম্ভ হবে এবং ঐ নজদী শাসকগোষ্ঠী আমার আহলে বাইতকে ভালবাসে না)। সমগ্র বিশ্বের মুসলিম উম্মাহকে তারা নির্যাতিত করবে। আবুল মুকাররাম নবী কারীম (দ.) এর এইরূপ বর্ননা শ্রবণ করার পর কান্নাকাটি করতে লাগলেন এবং পরে নবী কারীম (দ.) তাহার পিতা-মাতার জন্য দোয়া করলেন । রাসূলুল্লাহ (দ:) এক বাক্যে বুঝিয়েছেন যে,ঐ নজদ থেকে ইসলামের ক্ষতি সাধনকারী শত্রু নির্গত হবে। নবী কারীম (দ:) এর দেড় হাজার বছর আগের বাণী,যা আজ প্রমাণিত। নবী কারীম (দ:) এবং তাঁর খলিফাগণ যেভাবে ইসলামি গণতন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম সম্রাজ্যকে বৃদ্ধি করেছিলেন, তা বর্তমান আরবে বিলুপ্ত। কেননা, বর্তমান আরব দেশগুলোতে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। যা নবী কারীম(দ:) এর আদর্শের বিপরীত। ফলে আজ সমস্ত মুসলিম বিশ্ব অস্থিতিশীলতায় নিমজ্জিত ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ।
আরামকু কোম্পানি লোগো
অতঃপর আল্লাহর রাসূলের দেওয়া সুন্নি মতাদর্শ বিরোধীদের নেতা সৌদ ও তার পুত্র আব্দুল আজিজ এবং তার গোত্রের সকল কর্মীদেরকে নজদের গভর্নর রশিদ নজদ প্রদেশ থেকে বিতাড়িত করেন। তখন তারা কুয়েত চলে যায় এবং সেখানে বসবাস শুরু করে। কুয়েতে অবস্থানরত অবস্থায় সেখানে এক মার্কিন কোম্পানি তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে। কোম্পানিটির নাম ছিল "আরামকু কোম্পানি "। তারা তাদের সাথে সহযোগীতার আলোচনা করে।ঐ আলোচনায় আরামকু কোম্পানি সৌদ গোত্রকে বলেছিল যে,'তোমরা একটি কমিটি গঠন কর। আমরা তোমাদের প্রতি মাসে পাঁচ হাজার পাউন্ড স্বর্ণ দিয়ে সাহায্য করব। এবং তোমাদেরকে আমরা উন্নত প্রশিক্ষনের মাধ্যমে এমনভাবে গড়ে তুলব,যাতে তোমরা তোমাদের দেশে ফিরে যেতে পার। তোমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করে দেব।' তারা মার্কিন আরামকু কোম্পানির সহযোগীতার প্রস্তাবিত কথাবার্তা শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হল।অতএব সৌদ গোত্র আরামকু কোম্পানির সিদ্ধান্তানুযায়ী ১৮৮০ সালে কমিটি গঠন করল। কমিটির নাম ছিল "ইখওয়ানুল মুসলিমিন" অর্থাৎ মুসলমানগন ভাই ভাই। অত:পর আরামকু কোম্পানি তাদের পাঁচ হাজার পাউন্ড সাহায্য দেয়া আরম্ভ করল এবং উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের কৌশলের মধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণও দেয়। অথচ ইতিপূর্বে সৌদ গোত্র পেশায় ছিল জেলে। আর এমনিভাবে মার্কিন আরামকু কোম্পানি সৌদ গোত্রের দূরবলতার সুযোগে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র তুরুস্কে মুসলমানে-মুসলমানে ফেতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে। অপরদিকে ঠিক এভাবেই ভারতবর্ষের ইতিহাসে ইহুদী নাছারার একটি ব্রিটিশ চক্র ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামের বেশ নিয়ে ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করে। তারা ভারতে প্রবেশ করার পর ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সম্রাজ্যের মহান সম্রাট নবাব সিরাজুদ্দৌলার সাথে বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্কের কথা বলে এবং তারা তাঁহার সাথে একটি সন্ধি চুক্তি করে। সে সন্ধির নাম ছিল "আলিগড়ের সন্ধি"। এই সন্ধির নাম দিয়ে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের মুসলিম নওয়াব শাসকদের থেকে মীর জাফরের সহায়তায় ১৭৫৭ সালে ভারতবর্ষে মুসলিম নওয়াবদের ক্ষমতা কেড়ে নেয়। ফলে ভারত উপমহাদেশে চিরতরে মুসলিম সম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। তদ্রূপ মার্কিন আরামকু কোম্পানি সৌদ গোত্রের সৈন্যদেরকে সংগে নিয়ে নবী করীম(দ.) এর জীবনাদর্শ ও শানে-রেসালাত ক্ষুন্ন করতে থাকে।
এমনিভাবে সৌদ গোত্রের সৈন্যরা বিশ বছর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হওয়ার পর ১৯০১ সালে তারা নজদে হামলা করে। তখন তারা সর্বপ্রথম নজদের গভর্নর রশিদকে সুবহে সাদিকের সময় নামায পড়া অবস্থায় ধরে ফেলে এবং তারা রশিদের বুকের উপর বসে তার ঘাড় কেটে শরীর থেকে মাথাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পরে তারা সেখানে আশিকে রাসূলদের অবস্থানস্থল চিহ্নিত করে এবং তার মধ্য হতে জ্ঞানীগুণী ও গন্যমান্য ব্যক্তিদের উপর হঠাৎ অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। এমনকি তারা সুন্নী মতাদর্শের অনুসারী আশেকে রাসূল ও আওলাদে রাসূলগণের ৩/৪ দিনের নিষ্পাপ ছোট ছোট শিশুদেরকে পর্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে। ঘরে যা পেত সব লুটপাট করে নিত । ঘরে কারপেট থাকলে তা বের করে টুকরো টুকরো করে ফেলত ওতাদের মাঝে তা ভাগাভাগি করে নিত।এবং যেখানে মাটির স্থান দেখা যেত, সেখানে পানি দ্বারা ভিজিয়ে ফেলত। পানি দিয়ে ভিজিয়ে ফেলার কারণ ছিল মাটির নীচে নজদবাসীগণ তাদের মুল্যবান দ্রব্যসামগ্রী, যেমন:স্বরণ,রৌপ্য চুরি-ডাকাতির ভয়ে নিরাপদ হিসেবে মাটির নীচে পুতে রাখত। আর যেখানে মূল্যবান সামগ্রী থাকত, সেখানে পানি তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যেত ।
এভাবেই সৌদ সৈন্যরা মার্কিন "আরামকু কোম্পানির" পরিকল্পনা অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে নজদের নিরীহ সুন্নি মুসলমানদের উপর নির্মমভাবে অত্যাচার নিপীড়ন করে। নবী করীম (দ:) এর বাণী:- তিনি ইরশাদ করেন-'সকল মুসলমান পরস্পরঈমানী ভাই। সে হিসেবে প্রত্যেক ঈমানদার মুসলমানদের রক্ত,ধন-সম্পদ ভক্ষণ করা অপর মুসলমানের জন্য হারাম। 'তিনি আরো ইরশাদ করেন:-
একজন মুসলমান যদি অন্য মুসলমানের হাত ও মুখ দ্বারা সংগঠিত অত্যাচার ও অনিষ্টতা থেকে নিরাপদ না থাকে, তবে সে প্রকৃত ঈমানদার মুসলমান নয়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
মানবজাতির মহান সংবিধান মহাগ্রন্থ প্রবিত্র কুরআনে পাকের ২৫তম পারার সূরা আশশূ'রা এর ২২-২৩নং আয়াতে কারীমাগুলোতে আল্লাহ তা'লা ইরশাদ করেন
হে রাসূল(দ:)! আপনি বলে দিন, তোমাদের কাছে আমার আহলে বাইত তথা নবী পরিবারের ভালবাসা ছাড়া কোনো প্রতিদান চাই না।
হে আমার মুসলমান ভাইগণ! আপনাদের কাছে কুরআন-হাদীসের আলোকে প্রশ্ন রাখলাম, তারা কোন ধরণের মুসলমান ?
অতঃপর সৌদ গোত্রের সৈন্যরা পরিকল্পনা করতে থাকে কিভাবে মক্কা শরীফের জান্নাতুল মুয়াল্লা এবং মদীনা শরীফের জান্নাতুল বাকীতে হামলা করা যায়। তৎকালীন আমলে মক্কা শরীফের গভর্নর ছিলেন হুসাইন শরীফ। তাঁর শাসনামলে তারা মক্কা শরীফে আক্রমণ করে ও সাথে সাথে মক্কা শরীফের গভর্নর হুসাইন শরীফকে আটক করে। অবশেষে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম উম্মাহের ঐতিহাসিক স্থান মক্কা ও মদীনা শরীফের জান্নাতুল মুয়াল্লা এবং জান্নাতুল বাকী শরীফের পবিত্র মাটিতে দাফনকৃত প্রত্যেক সাহাবায়ে কেরাম ও আনসার, মুহাজির এবং আশেকে রাসূলগণের কবর ও রাওযা শরীফকে বিভিন্ন ধারালো ট্রাক্টর তথা মাটি কাটার গাড়ি বিশেষ দ্বারা উল্টিয়ে দেয় এবং তাতে কোনো প্রকার চিহ্ন পর্যন্ত রাখেনি । এমনকি তারা ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা.) এর রাওযা শরীফ ভেঙে ফেলে । পরে রাসূল (দ.) এর রাওযা শরীফের দিকে অগ্রসর হয়। ওহাবীদের গোঁমর ফাঁক নামক গ্রন্থে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা আআব্দুল ওহাব নজদী এবং অন্যদিকে সে আবার সৌদের শ্বশুরও হয় । অতএব সৌদের শ্বশুর আব্দুল ওহাব নজদীর নেতৃত্বে এই হামলা পরিচালনা করা হয় এবং সে এমন ব্যক্তি,যে সর্বপ্রথম রাসুলে কারীম (দ.)এর রাওযা শরীফের দিকে গেল । তখন আল্লাহ তা'লার হুকুমে আকস্মিকভাবে দুটি সাপ এসে তাদেরকে নবীজীর রাওযার দিকে পৌছার পথে তৎক্ষণাৎ বাধাগ্রস্ত করল । ফলে তারা ব্যর্থ হয়ে সেখান থেকে বিতাড়িত হলো এবং পরে তা আর সম্ভবপর হয়নি । তাই আজ পর্যন্ত নবী কারীম (দ.)এর রাওযা ব্যতীত অন্য কোন সাহাবীর রাওযা শরীফের চিহ্ন বা নিশান দেখা যায় না। এই কারণে বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ ও হাজীগণ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না যে, এখানে পূর্বে পৃথক পৃথক মাজার শরীফ অবস্থিত ছিল। মক্কা শরীফেরজান্নাতুল মুয়াল্লা ও মদীনা শরীফের জান্নাতুল বাকীর পূর্বের অবস্থার চিত্র এবং সেখানে সাহাবায়ে কেরামের রাওযা শরীফের পূর্বের দৃশ্য ও নবী করীম (দ.)এর বিভিন্ন মু'জিযার দর্শনীয় স্থানসমূহের বর্তমান ধ্বংসাবশেষ চিত্র নিয়ে লিখিত "আল মুকাদ্দেস" নামক গ্রন্থে চিত্রসহ স্ববিস্তারে মক্কা ও মদীনা শরীফের পূর্বের অবস্থা এবং বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেছেন। এই গ্রন্থখানা আপনাকে দলিল স্বরূপ সহায়তা করবে । অতঃপর এভাবেই সৌদের গোত্র মার্কিন "আরামকু কোম্পানি"-র সহযোগীতায় আরবের বুকে সুন্নি মতাদর্শকে ধ্বংস করতে সমর্থ হলো এবং খারেজী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিল।
পরবর্তীতে সে সময়ের মদীনাবাসীরা তাদের কঠোর নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে মদিনা ছেড়ে পাহাড়ে-পর্বতে চলে যায় এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন । তার প্রমাণ হলো মদীনার অদূরে পাহাড়-পর্বতে অবস্থানরত বর্তমান অধিবাসী । এমনকি আওলাদে রাসূল ও আশেকে রাসূল (দ.) বণিকগণ আপন জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। ফলে নিজ বাসস্থান ছেড়ে জানমাল রক্ষার্থে বিভিন্ন দেশে চলে গিয়েছিলেন । যারা যেখানে গিয়েছিলেন, সেখানে সুন্নি মতাদর্শ ও সালাতুস সালাম এবং তৌহিদ এবং রিসালাত প্রতিষ্ঠা করেন। তাই আজ পর্যন্ত সেই সালাতুস সালামের ঝান্ডা সারা বিশ্বে উড়ছে । খারেজীরা এখনও কাফের মুনাফিকদের সহযোগীতায় বিভিন্ন দেশে ও জেলায় এবং গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। যাতে নবী প্রেমিকগণ জেগে উঠতে না পারে। কেননা তাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে নবীর প্রেম যাতে মুসলমানদের অন্তর থেকে চিরতরে মুছে যায়। আর নবীর প্রেম ও আদর্শ ধ্বংস করতে পারলেই মুসলমানদের ঈমান, আমলও নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে মুসলমান মুসলমানে লড়াই চলতে থাকবে। এটাই হলো খারেজী -ওয়াহাবীদের মূল প্রচেষ্টা। অতএব পরবর্তী পর্যায়ে যখন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে নির্যাতিত আওলাদে রাসূল ও আশেকে রাসূলগণ হেজাজুল আরব থেকে চলে যান। তখন সৌদের গোত্র ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তুরস্ক থেকে নজদ ও মক্কা -মদীনা শরীফ দখল করে শাসনভার তাদের অধীনে নিয়ে আসে এবং সাথে সাথে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে সেপ্টেম্বর হেজাজুল আরবের নাম পাল্টিয়ে দেয় এবং নিজ নামানুসারে "সৌদ আরব " রাখে,নজদ প্রদেশের নাম পরিবর্তন করে "রিয়াদ" নামকরণ করে। উল্লেখ্য যে,এখানে তুরস্কের বাদশাহ মুস্তফা কামাল পাশার কিছুই করার ছিল না। কারণ, মার্কিন আরামকু কোম্পানি সৌদ গোত্রকে সবদিক থেকে এমনিভাবে গড়ে তুলে ছিল যে,তাদের দমন করা তুরস্কের বাদশার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে ।
পরিশেষে এইভাবেই তারা আরবের মূল ভূ-খন্ডে খারেজী এবং ওয়াহাবী মতবাদ ও তাদের ধ্বংসাত্মক শাসন ক্ষমতা যুগে যুগে প্রতিষ্ঠিত রাখে।
ঊর্দূ এলবাম "তাশকিলে জাদীদ" (ভাষ্যকার রাশেদ আশরাফ, তার পিতার নাম আবদুল্লাহ।)
দেওবন্দি মাযহাব:-সৈয়দ পীর গোলাম মুহাম্মদ মেহের আলী (র.)
তারিখ ও নাজদে হেজাজ:- হযরত মুফতি মুহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম কাদেরী
খুনকা আঁসুও:-আল্লামা হযরত মুহাম্মদ মুশতাক নেজামী (র.)
ওহাবী মাযহাব কা হাকীকাত:-হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হামিদ জিয়াউল্লাহ আল কাদেরী
আল মুকাদ্দেস (মক্কা ও মদীনা শরীফের বিভিন্ন স্থানের অতীত ও বর্তমান চিত্র সংবলিত):-শাহ মুহাম্মদ আব্দুল হালিম আল মাদানী
ওহাবীদের গোঁমর ফাক:-হযরত মুহাম্মদ রতন মিয়া চিশতী (র.)
হক্ব বাতিলের পরিচয় :-মাওলানা মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন আল কাদেরী
ওহাবী মাযহাবের নেপত্য কাহিনী :-(মূল) এইম.এম.গুমুজ।(অনুবাদ)হাফেয মাওলানা রুহুল আমিন
ইসলামের মূলধারা ও বাতিল ফিরকা:-লেখক মাওলানা কাযী মুহাম্মদ মুঈনউদ্দিন আশরাফী
বাদশাহ্ আব্দুল আযীয ইবন সৌদ
১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের অনুচর ও সেবাদাস আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ব্রিটেনের অনুমতি নিয়ে হিজাজের নাম পরিবর্তন করে নিজ বংশের নাম অনুযায়ী এই বিশাল আরব ভূখণ্ডের নাম রাখে সৌদি আরব।
রক্তপাত, গণহত্যা ও প্রতারণার মাধ্যমে ইবনে সৌদ দখল করেছিল হিজাজ। এই দেশই (বর্তমান সৌদি আরব) বিশ্বের একমাত্র দেশ যার নামকরণ করা হয়েছে দেশটির সংখ্যালঘু একটি গোত্রের নাম অনুসারে।
আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ছিল ‘নজদ’ নামক মরু অঞ্চলের অধিবাসী। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য সে ওয়াহাবি সম্প্রদায়ের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই উগ্র মতবাদটির জন্ম দেয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়। ব্রিটিশরা ওসমানি খেলাফত তথা অটোম্যান তুর্কি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য ইবনে সৌদকে অনুচর হিসেবে বেছে নেয় এবং এ জন্য তাকে প্রতি মাসে ৫ হাজার পাউন্ড স্টার্লিং ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করে।
তুরস্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হলে ইবনে সৌদের সাহস বেড়ে যায়। ফলে সে আরব অঞ্চলের নানা অংশে সেনা অভিযান চালাতে থাকে। ক্ষমতাসীন আলে-রশিদ গোত্রকে পরাজিত করার পর সৌদের বাহিনী ১৯২৫ সালে হিজাজে অভিযান চালায়।হিজাজের পবিত্র মক্কা ও মদীনা শহরসহ বন্দর শহর জেদ্দাহ, তায়েফ ও ইয়ানবু শহরে সৌদের বাহিনী অন্ততঃ বিশ-ত্রিশ হাজার মুসলমানকে হত্যা করেছিল।
মক্কা ও মদীনার পবিত্র মাজারগুলোর অবমাননা ও ধ্বংস সাধন ছিল সৌদের জঘন্য হঠকারিতার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য।
এরপর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের আরেক অনুচর হিজাজের শরিফ হুসাইনকে পুরস্কার দেয়ার জন্য তার দুই পুত্র ফয়সল ও আবদুল্লাহকে যথাক্রমে ইরাক এবং নব-গঠিত জর্দান নামক দেশের শাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়। এ অবস্থায় ব্রিটিশরা ইবনে সৌদকে রাজার উপাধি ব্যবহারের অনুমতি দেয় এবং তার দখল-করা অঞ্চলকে ‘সৌদি আরব’ হিসেবে ঘোষণা করারও অনুমতি দেয়। অবশ্য এইসব অনুমতি ব্রিটিশরা তখনই দেয় যখন ইবনে সৌদ এই প্রতিশ্রুতি দেয় যে সে ফিলিস্তিনেঅবৈধ ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার কোনো বিরোধিতা করবে না।
বাদশাহ আব্দুল আজিজ কর্তৃক ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার অনুমোদন পত্র
১৯১৭ সালের দোসরা নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যালফোর ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই ঘোষণা ব্যালফোর ঘোষণা নামে ইতিহাসে খ্যাত। এ ঘোষণা দেয়ার আগে ব্রিটিশরা সৌদি রাজা আবদুল আজিজের কাছ থেকে লিখিত সম্মতিপত্র আদায় করেছিল। ওই চিঠিতে লেখা ছিল:
আমি বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে আবদুর রহমান--ফয়সলের বংশধর ও সৌদের বংশধর-- হাজার বার স্বীকার করছি ও জেনেশুনে বলছি যে, মহান ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি স্যার কুকাস-এর সামনে স্বীকারোক্তি করছি এই মর্মে যে, গরিবইহুদিদেরকে বা অন্য কাউকে ব্রিটিশ সরকার যদি ‘ফিলিস্তিন’ দান করে দেন তাহলে এতে আমার কোনো ধরনের আপত্তি নেই। বস্তুত: আমি কিয়ামত পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের অভিমতের বাইরে যাব না।
— নাসিরুস সাইদ প্রণীত ‘আলে সৌদের ইতিহাস
একবার (১৯৪৫ সালে) বাদশাহ আবদুল আজিজ সৌদ ইহুদিবাদী ইসরাইল গঠনের বিরুদ্ধে পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বসে। সঙ্গে সঙ্গে বা ততক্ষণাত ব্রিটিশ সরকার ও ইহুদিবাদীদের পক্ষে দু’জন প্রতিনিধি এসে বাদশাহ আবদুল আজিজের সঙ্গে দেখা করে এবং বাদশাহকে তার সম্পাদিত সম্মতি-পত্রটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তখন বাদশাহ তাদের বলেছিল:
আমি ইহুদিদের স্বার্থে কার্যত যা করে যাব তার ওপর বিশ্বাস রাখবেন। কি বলছি তার দিকে লক্ষ্য করবেন না। কারণ, এ ধরনের কথা না বললে আমি (ক্ষমতায়) টিকে থাকতে পারব না।
— নাসিরুস সাইদ লিখিত ‘আলে সৌদের ইতিহাস’, পৃ-৯৫৩
বাদশাহর এই কথা শুনে ব্রিটিশ সরকারের ও ইহুদিবাদীদের প্রতিনিধি খুশি হয়ে ফিরে যায়।
১৯১৪ সালে স্বাক্ষরিত আল-আকির চুক্তি অনুযায়ী ইবনে সৌদ তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য দেয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হন। আর বাহরাইন ব্রিটিশ সরকারের কর্তৃত্বে থাকবে বলেও সৌদ কথা দেয় এবং উপসাগরীয় এলাকায় ব্রিটিশ নাগরিক ও ইংরেজদের ব্যবসা বাণিজ্যের রক্ষণাবেক্ষণ করবে বলেও ওই চুক্তিতে অঙ্গীকার করে। বিনিময়ে ব্রিটিশ সরকার ইবনে সৌদকে সমর্থন দেয়ার ও যে কোনো পক্ষ থেকে তার ওপর আক্রমণ করা হলে তা প্রতিহত করবে বলে ওয়াদা দেয়। [1]
এভাবে সে যুগে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক ও শেষ ভরসাস্থল হিসেবে বিবেচিত তুর্কি খেলাফতের ধ্বংস সাধনে সৌদি রাজা আবদুল আজিজ ও ব্রিটেনের যৌথ ষড়যন্ত্রটি বাস্তবায়িত হয়েছিল। সৌদের অনুগত ওয়াহাবি সেনারা তুর্কি মুসলমানদের গুলি করে হত্যা করেছিল এবং রক্ষা করেছিল ব্রিটিশ নাগরিকদের ও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে। তাই এটা স্পষ্ট যে সৌদি আরব নামক রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সৃষ্টিতে ব্রিটেনের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ। অথচ ইসলাম রাজতন্ত্র সমর্থন করে না বলে ইসলাম বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন।
উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুর্কি খেলাফতের বিরুদ্ধে ব্রিটেন সৌদিদেরকে তথা সৌদি বংশের লোকদের ব্যবহার করে। ফলে তুর্কি সরকার ওয়াহাবিদের রাজধানী ‘দারইয়া’ শহরটি দখল করে নেয়। আর সৌদি সর্দার আমির আবদুল্লাহকে গ্রেফতার করে প্রথমে কায়রোতে ও পরে তুরস্কে পাঠিয়ে দেন মিশরের শাসক মুহাম্মাদ আলী পাশা। তুর্কি খেলাফতের সরকার আমির আবদুল্লাহকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের অবস্থা দুর্বল হয়ে গেলে ব্রিটিশরা আবারও সৌদ গোত্রের লোকদের নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ব্রিটেন ইবনে সৌদের সঙ্গে কুখ্যাত ‘দারান’ চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯১৫ সালে। কুয়েতের শেখ জাবির আল সাবাহ ছিল সে সময় ব্রিটিশদের আরেক দালাল। ব্রিটিশরা এই দালালের মাধ্যমে ইবনে সৌদের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার সৌদ-পরিবারকে প্রতি বছর ষাট হাজার পাউন্ড ভাতা দিতে থাকে। পরে এ ভাতা বাড়িয়ে এক লাখ পাউন্ড করা হয়। এ ছাড়া তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য সৌদ গোষ্ঠীকে তিন হাজার রাইফেল ও তিনটি মেশিনগান উপহার দেয় ব্রিটেন।[2]
ব্রিটিশ সরকার আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের ক্ষমতা গ্রহণের উতসবে পাঠিয়েছিল স্যার কুকাসকে প্রতিনিধি হিসেবে। রাজা উপাধিতে বিভূষিত করে কুকাস তাকে বলেছিল,
হে আবদুল আজিজ, আপনি শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
উত্তরে রাজা বলেছিল, আপনারাই আমার এ ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করেছেন ও এ সম্মান দান করেছেন। যদি মহান ব্রিটিশ সাম্রাজ্য না থাকত তাহলে এখানে আবদুল আজিজ আল-সৌদ নামে কেউ আছে বলেই জানত না। আমি তো আপনাদের (ব্রিটিশদের) মাধ্যমেই ‘আমির আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ’ শীর্ষক খেতাবটি অর্জন করতে পেরেছি। আমি আপনাদের এই মহানুভবতা আজীবন ভুলব না। আর আমার বিগত আচরণ ছিল আপনাদের সেবক ও ফরমানবরদার (গোলাম) হিসেবে আপনাদের ইচ্ছাগুলো বাস্তবায়ন করা।
ওই উৎসবে কুকাস ব্রিটিশ সরকারের দেয়া শাহী তামগা বা মেডেল রাজা আজিজের গলায় পরিয়ে দেয়। কুকাস বলে যায়: অচিরেই আমরা আপনাকে হিজাজ ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলোর বাদশাহ বলেও ঘোষণা করব এবং তখন হিজাজকে ‘সৌদি সাম্রাজ্য’ বলে ঘোষণা করা হবে।
এ কথা শুনে রাজা আজিজ স্যার কুকাসের কপালে চুমু খায় ও বলে: "আল্লাহ যেন আমাদেরকে (সৌদিদেরকে) আপনাদের খেদমত (দাসত্ব) করার ও ব্রিটিশ সরকারের সেবা (গোলামি) করার তৌফিক দেন।
— মুহাম্মাদ আলী সাইদ লিখিত ‘ব্রিটিশ ও ইবনে সৌদ’, পৃ-২৬
· ‘সরওয়াতুস সৌদিয়া’, পৃ-৩৯ এবং ‘ব্রিটিশ ও ইবনে সৌদ’, পৃ-২০
· নজদ ও হিজাজের ইতিহাস, পৃ-২১০