ঈসায়ী ১৫৬১ খৃষ্টাব্দ, মুতাবিক ৯৭১ হিজরীর ১৪ই শাওয়াল, শুক্রবার দিনগত রাতে ইমামে-রাব্বানী, মুজাদ্দিদে আলফে সানি শায়খ আহমদ ফারুকী সিরহিন্দী (রহ:) জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর কুনিয়াত ছিল-আবুল বারাকাত, লকব ছিল-বদরুদ্দিন এবং তিনি প্রথম কাইউমরূপে পরিচিত।
একজন প্রসিদ্ধ ওলী, হযরত শায়খ আহমদ জাম (রহ:) প্রায় চার শত বছর আগে এ পূণ্যময় সন্তানের নামকরণ করেন ‘আহমদ’। তাঁর জন্মের সময় তাঁর জননী যে গায়েবী আওয়ায শুনেছিলেন, তা ছিল এরূপ। ফলে নবজাত শিশুর নাম রাখা হয়। ‘শায়খ আহমদ’। হযরত ইমামে রাব্বানী, মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ:)-এর পিতার নাম হযরত শায়খ আব্দুল আহাদ (রহ:)। তিনি ছিলেন মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা.)-এর সাতাশ তম (২৭) অধস্তন পুরুষ, এ পর্যায়ে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের দু‘আ উল্লেখযোগ্য। যিনি দু‘আ করেন :
হে আল্লাহ্! উমর ইবন খাত্তাব অথবা আবু জেহেলের দ্বারা দ্বীন ইসলামকে শক্তিশালী করুন।
মহানবী (স.)-এর এ দু‘আ হযরত উমর ফারুক (রা) কর্তৃক বাস্তবে রূপায়িত হয় এবং তাঁর খিলাফতকালে দ্বীন ইসলাম উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের হাজার বছর পর যখন সমস্ত পৃথিবী পুনরায় শিরক, বিদ্‘আত ও কুফরীতে ভরপুর হয়ে যায়, তখন হযরত উমর (রা)-এর বংশধর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ:) দ্বারা দ্বীন-ইসলাম পুনরায় শিরক-বিদ্‘আত থেকে মুক্ত হয়।
হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী (রহ:)-এর পিতা হযরত শায়খ আব্দুল আহাদ (রহ:) হিজরী ১০০৭ সালে, ১৭ই রজব ৮০ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। সিরহিন্দ শরীফের উত্তর দিকে তাঁর মাযার রয়েছে।
শৈশবের কয়েকটি ঘটনা
যে বৃক্ষ ভবিষ্যতে প্রকাশ্য মহীরুহে পরিণত হবে, তা যেমন ছোট থাকতেই বোঝা যায়, তেমনি যারা পরিণত বয়সে মহাপুরুষের মর্যাদা লাভ করবেন, তাঁদের মধ্যে ক্সশশব থেকেই বহু অলে․কিক ও বিস্ময়কর ব্যাপার পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী (রহ:)-এর শৈশবে ও কিছু আশ্চর্যজনক ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। যেমন, তিনি মাতৃগর্ভ থেকেই ‘মাখতুন’ হালতে অর্থাৎ খাতনাকৃত অবস্থায় ভূমিষ্ট হন। উল্লেখ্য যে, হযরত রাসূলে পাক (স.) ও ‘মাখতুন’ অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করেন।
হযরত মুজাদ্দিদ (রহ:)-এর শৈশবকালীন আরো একটি আশ্চর্যজনক ব্যাপার এই যে, তিনি কখনো নগ্নদেহে থাকতেন না। কখনো তাঁর সতর অনাবৃ ত হলে, সাথে সাথে তা ঢেকে নিতেন। তিনি সব সময় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও হাসি মুখে থাকতেন। তাঁর প্রত্যেকটি আচার-আচরণ ও চাল-চলনের মধ্যে এক বিশেষ নিদর্শন পরিলক্ষিত হতো।
হযরত মুজাদ্দিদ (রহ:) দুদ্ধপোষ্য শিশু থাকাবস্থায় একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তার পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্যান্য সকলে তাঁর জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েন। এ সময় হযরত শাহ কামাল কায়থিলী (রহ:) সিরহিন্দ শরীফে আসেন। এখবর পেয়ে শায়খ আব্দুল আহাদ (রহ:) তাঁর অসুস্থ শিশুকে দু’আ করার জন্য তাঁর কাছে নিয়ে যান। শিশুকে দেখা মাত্রই হযরত শাহ সাহেব বলেন
আল্লাহ তায়ালা এই শিশুর হায়াত দারাজ করুন। এর ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জল। পরিণত বয়সে সে আলেমে হাক্কানী ও আরিফে কামিল হবে এবং আমার মত হাজার হাজার লোক তাঁর আত্মিক তালিমে উপকৃত হবে। তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ প্রাপ্তির যে আলো সারা দুনিয়াতে ছড়াবে, তা কিয়ামত পর্যন্ত কখনো নিস্প্রভ হবে না।
এরপর শাহ সাহেব তাঁকে কোলে নিয়ে নিজের পবিত্র জিহবা তাঁর মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেন। শিশু মুজাদ্দিদে (রহ:) অনেকক্ষণ পর্যন্ত উক্ত জিহবা লেহন করতে থাকেন। অত:পর শাহ সাহেব তাঁর পিতাকে সান্তনা দিয়ে বলেন :
চিন্তা করবেন না, ইনশা আল্লাহ্ শিশু আরোগ্য লাভ করবে। আল্-হামদু লিল্লাহ, শিশু কাদেরিয়া তরীকার সব নিয়ামত লাভ করলো। আল্লাহ তায়ালা এর দ্বারা তাঁর দ্বীনের খিদমত নিবেন।
· হযরত মোজাদ্দেদে আলফে সানী (রহঃ) - শিক্ষা জীবন
· হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ:) শৈশব অতিক্রম করে কৈশোরে পদার্পন করলে তাঁর শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি পিতা-মাতা বিশেষ যত্ন নিতে আরম্ভ করেন। অল্প বয়সে, অতি অল্প সময়ে তিনি কুরআন মযীদ হিফয করেন। এরপর ‘ইল্মে দ্বীনের অনেক কিতাব তিনি তাঁর পিতা শায়খ আব্দল আহাদ (র)-এর নিকট অধ্যয়ন করেন। সিরহিন্দের অন্যান্য বিখ্যাত আলিমের নিকট থেকে ও তিনি দ্বীনি ইল্ম হাসিল করেন। হযরত শায়খ ইয়াকুব কাশ্মিরী (র.), হযরত মাওলানা কাযী বাহ্লুল (র.), স্বনামধন্য তর্কশাস্ত্রবিদ হযরত মাওলানা কামাল (র.) প্রমুখ আলিম ও বুযুর্গানে-দ্বীন তাঁর উস্তাদ ছিলেন।
· ইল্মে তাসাউফ বা মারিফাত সম্বন্ধীয় কিতাব ‘তাসাউফ’, আওয়ারিফুল মাআরিফ, ফুসুসুল হিকাম-প্রভৃতি তিনি সে যুগের শ্রেষ্ঠ উস্তাদদের নিকট পাঠ করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি জাহেরী ও বাতেনী ইলমের এক বিরাট ভান্ডারে পরিনত হন।
· এরপর তিনি ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বিভিন্ন দেশে থেকে দলে দলে শিক্ষার্থী তাঁর নিকট আসতে থাকে এবং দিন-রাত শিক্ষা দেওয়ার কাজ চলতে থাকে। তাঁর দারসে হাদীস ও তাফসীরের হাল্কা সব সময় শরগরম থাকতো। বহু লোক তাঁর নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ শেষ করে সনদ হাসিল করেন। অবশেষে তিনি ‘ইলমে-জাহেরীতে’ বা জাহেরী-ইলমে’ এরূপ কামালাত অর্জনকরেন যে, তিনি মুজতাহিদের দরজায় উন্নীত হন।
· উল্লেখ্য যে ইমামে রাব্বানী, মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী (র.)-এর পূর্ব পুরুষগণ সবাই ছিলেন মারিফাত পন্থী। তাই ‘ইল্মে মারিফত অর্জনের বিষয়টি তিনি ওয়ারিছ সূত্রেই লাভ করেন। প্রথমে তিনি তাঁর পিতার নিকট থেকে ‘ইল্মে মারিফাত অর্জন করেন এবং তাঁরই নিকট থেকে চিশ্তীয়া তরীকার খিলাফত প্রাপ্ত হন। এরপর তিনি কাদেরীয় তরীকার শ্রেষ্ঠ বুজর্গ হযরত শাহ সিকান্দার (র.)-এর নিকট থেকে এই তরীকার খিলাফত লাভ করেন। সে সময় ‘কুব্রাবিয়া’ তরীকার খুবই প্রসিদ্ধি ও প্রসার ছিল। হযরত মাওলানা ইয়াকুব (র.) ছিলেন এই তরীকার বিখ্যাত বুজর্গ। হযরত মুজাদ্দিদ (র.) তাঁর থেকে এই তরীকার খিলাফত লাভ করেন। এসময় তাঁর পিতা শায়খ আব্দল আহাদ (র.)-এর অন্তিম মূহুর্ত এসে পড়ে। ইন্তিকালের আগে তিনি তাঁর পুত্র মুজাদ্দিদে আলফে সানী (র) কে তাঁর সমস্ত বাতেনী শক্তি দান করে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। এভাবে তিনি সে সময় প্রচলিত সমস্ত তরীকার কামালিয়াত হাসিল করেন এবং পিতার নির্দেশ মতো নক্শাবন্দীয়া তরীকায় পরবর্তী কালে কামালিয়াত হাসিল করে ‘ইল্মে মারিফাতের মহাসাগরে পরিণত হন।
· জাহেরী ও বাতেনী ইল্ম হাসিলের পর মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী (র.) বাদশাহ আকবরের রাজধানী আগ্রায় যান। বাদশার সেনা-বাহিনীর অনেকেই তাঁর জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ হন। এ সময় অনেক ‘আলিম তাঁর নিকট থেকে ইল্মে হাদীস ও তাফসীরের সনদ গ্রহণ করনে।’ এর ফলে তাঁর ‘ইল্মে ও ইজ্তিহাদের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আগ্রায় অবস্থান কালে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (র.)-এর খ্যাতি এমন ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, শাহী দরবারের দর্শন ও তর্কশাস্ত্রে বিখ্যাত ‘আলিম আবুল ফযল ও ফৈযী তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং মাঝে মাঝে তারা তাঁর মজলিসে আগমন করতেন।
· ইমামে রাব্বানী হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রাঃ) বলেছিলেন, ~“ ইন শা আল্লাহ্ জাহাঙ্গীরকে আমার সাথে জান্নাতে নিয়ে যাবো।”
ইমামে রাব্বানী হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রাঃ) বলেছিলেন,
~“ ইন শা আল্লাহ্ জাহাঙ্গীরকে আমার সাথে জান্নাতে নিয়ে যাবো।”~
· বাদশাহ জাহাঙ্গীরকে একবার কেউ জাগ্রত অবস্থায় তার সিংহাসন থেকে তুলে ফেলে দিয়েছে। এতে সে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে অসুস্থ থাকলো । চিকিৎসা করা হল কিন্তু কোন ফল হল না।
অবশেষে একদিন স্বপ্নে সে সাক্ষাৎ লাভ করলো রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’এর,তিনি তাকে সম্বোধন করে এরশাদ করেছিলেন,
“হে জালেম! তুমি মুজাদ্দেদে ইসলাম এবং এ যুগের ইমামকে কষ্ট দিয়েছ। এই রোগ সে কারনেই হয়েছে। যদি কল্যাণ চাও তবে তার নিকট দোয়া লও।”
· জাহাঙ্গীর জাগ্রত হয়েই হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রাঃ)’কে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দিল এবং তাঁর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে সাক্ষাতের আরজী পেশ করে চিঠি লিখল।
· হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রাঃ) মোলাকাতের জন্যে কয়েকটি শর্ত আরোপ করলেন যা জাহাঙ্গীর মেনে নিল। অতঃপর তিনি গোয়ালিয়রের কারাগার থেকে বিদায় নিলেন।
· রাজপুত্র শাহজাহান এবং প্রধানমন্ত্রী তাঁর সম্বর্ধনার জন্যে উপস্থিত হয়। তিনি শাহী মহলে তাশরীফ নেন এবং দোয়া শুরু করেন, আর বাধশাহকে আদেশ দেন, “তুমি তোমার পাপাচারের জন্য তওবা করে আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে ক্রন্দন করতে থাকো।” ফলে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বাদশাহ সুস্থ হয়ে উঠলো।
· সে হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রাঃ)’এর কদমে পড়ে রইলো এবং তাঁর মুরিদদের অন্তর্ভুক্ত হল,তাঁর দরবারে সেজদা প্রথা সহ যাবতীয় মন্দ কাজ বন্ধ করে দিল।
· একবার হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী (রাঃ) তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে বলেছিলেন,
“ ইন শা আল্লাহ্ জাহাঙ্গীরকে আমার সাথে জান্নাতে নিয়ে যাবো।”
· [সীরাতে ইমামে রাব্বানী,পৃষ্ঠাঃ১৩১-১৩২]