এককালে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য ভারত উপমহাদেশের দিল্লীর যশ খ্যাতি ছিল বিশ্বজুড়ে। পৃথিবীর সকল অঞ্চল থেকে জ্ঞান পিপাসুরা ছুটে আসতেন এখানে। আর তাদের আসার পেছনে মূল কারণ বিশ্ব বরেণ্য মুহাদ্দিস শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)। দিল্লীর মুহাদ্দিসীনদের মধ্যে যার অবদান সমগ্র পৃথিবীতে সমাদৃত তিনি হলেন শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)। তিনি শরী’আত ও তরীকতের মহান বুযুর্গ ছিলেন। রাসূলে পাক (সা.)-এর ইশক ও মহব্বত তাঁর অন্তরে সদা প্রবাহমান ছিল। সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী আন-নাদভী (র.) তাকে “ইমামুল ‘উলামা ওয়া রাঈসুল হুকামা” অর্থাৎ- ‘আলিমদের নেতা বিজ্ঞজনদের মাথা বলে পরিচয় দিয়েছেন।
এ মহান পুরুষ হিজরী ১১৫৯ সনে পবিত্র রমযান মাসের ২৫ তারিখ বৃহস্পতিবার জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর নাম ছিল আব্দুল আযীয তাঁর উপাধি “সিরাজুল হিন্দ” কেহ আবার হুজ্জাতুল্লাহ বলেছেন। এ মহান মনীষী ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারুক (রা.)-এর বংশধর। তাঁর বংশপরিক্রমা হল : শাহ আবদুল আযীয ইবন শাহ ওয়ালী উল্লাহ (র.) ইবন শাহ আব্দুর রহীম (র.) ইবনে শহীদ ওয়াজীহ উদ্দীন (র.) ইবন মু’আযযম (র.) ইবন মানসুর (র.) ইবনে আহমদ (র.) ইবন মাহমুদ (র.) ইবন কিওয়ামুদ্দীন (র.) ইবনে কাযী কাসেম (র.) ইবন কাযী করীম (র.) ইবন আবদুল মালিক (র.) ইবন কুতুবুদ্দীন (র.) ইবন কামালুদ্দীন (র.) ইবন শামসুদ্দীন মুফতী (র.) ইবন শের মালিক (র.) ইবন মুহাম্মাদ আতা মালিক (র.) ইবন আবুল ফাতাহ মালিক (র.) ইবন উমর হাকিম মালিক (র.) ইবন আদিল মালিক (র.) ইবন ফারুক (র.) ইবন জারজীস (র.) ইবন আহমদ (র.) ইবন মুহাম্মদ (র.) ইবন কুরাইশ (র.) ইবন সুলাইমান (র.) ইবন আফফান (রহ.) ইবন ‘আব্দুল্লাহ (র.) ইবন মুহাম্মদ (র.) ইবন ‘আব্দুল্লাহ (রা.) ইবন উমর ইবন খাত্তাব (রা.)।
শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) বাল্য বয়সেই পবিত্র কুর’আন শরীফ হিফয করেন। তারপর তাঁর মহান পিতা শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)-এর কাছে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পিতার কাছ থেকে তিনি ইলমে শরী’আতের বিভিন্ন শাস্ত্রের পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ষোল বৎসর বয়সে তিনি তাঁর পিতাকে হারান। শরী’আতের পূর্ণ জ্ঞান হাসিলের জন্য তিনি আরো অনেক উস্তাযের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন : তাঁর বড় ভাই শায়খ মুহাম্মদ (র.), সাইয়্যিদ গোলাম হুসাইন মক্কী (র.), শাহ মুহাম্মদ আশেক ইবন উবাইদুল্লাহ ফুলতী (র.), শায়খ মুহাম্মদ আমীন কাশমিরী (র.), শায়খ যহূরুল্লাহ মুরদাবাদী (র.), শায়খ মুহাম্মদ জাওয়াদ ফুলতী (র.), শায়খ নূরুল্লাহ (র.) সহপ্রমুখ।
শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) স্বীয় পিতা তরিকতের উজ্জল নক্ষত্র শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)-এর হাতে বাই’আত গ্রহণ করেন এবং খিলাফত লাভ করেন।
সিরাজুল হিন্দ শাহ আবদুল আযীয (র.) তাঁর কর্ম জীবনে পিতার অনুকরণে তখনকার যুগের অনৈসলামিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলন করেন। দ্বীনের সংস্কার করেন। পবিত্র কুর’আন শরীফ বিশুদ্ধ রীতিতে তিলাওয়াতের জন্যমুসলমানগণকে তাগিদ দেন এবং তিনি নিজেও সপ্তাহে প্রতি বুধ ও শুক্রবার পবিত্র কুর’আন শরীফের দারস দিতেন। সাথে সাথে আয়াতসমূহ তাফসীর করে মানুষদেরকে বুঝিয়ে দিতেন। তাঁর এ দারসের দ্বারা তখনকার দিল্লীতে কুর’আনের প্রতি আগ্রহ ব্যাপক হারে বেড়ে যায়।
রাসূলে পাক (সা.)-এর ইশক ও মুহাব্বাতের অনলে নিজেকে দগ্ধ করে শাহ আবদুল আযীয (র.) ইলমে হাদীসের যে অনন্য খিদমত করেছেন তা ভারত উপমহাদেশে খুবই বিরল। তিনি দীর্ঘ চৌষট্টি বছর ইলমে হাদীসের খেদমত করে যেসব শাগরেদ তৈরি করেছেন তারা শুধু ভারতেই নয়, সুদূর হিজায পর্যন্ত হাদীসের ফাল্গুন ধারা প্রসারিত করতে পেরেছেন।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)-এর সময় ভারতে মারাঠীদের আক্রমণ এবং তাদের সামরিক বাহিনীর যুলম-নির্যাতন লুঠতরাজ স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।
শাহ ছাহেবের ইন্তিকালের পর ইংরেজদের শোষণ বেড়ে যায়। মুসলমানদের উপর নির্যাতন নিপিড়ন বেড়ে গিয়েছিল। শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা উপলব্ধি করেন বর্তমান সময় মুসলমানদের জন্য খুবই করুণ অবস্থা। তাই তিনি ভারতকে “দারুল হরব” শত্রু কবলিত রাষ্ট্র বলে ঘোষণা দেন। তিনি তাঁর মহান খলীফা সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.)-কে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমীর খানের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার ইঙ্গিত দেন।শাহ আবদুল আযীয (র.) ইংরেজদের বিরুদ্ধে কিরূপ মনোভাব ছিল তা স্পষ্ট হয় তাঁর চেতনায় দীপ্ত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) এর জিহাদের মাধ্যমে।
মুসলমানদের ঈমান-আকীদা হিফাযতে খুব দায়িত্ববান ছিলেন শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.)। সে জন্যে তাঁর সময়ে বেড়ে যাওয়া রাফেযী ও শিয়া মতবাদকে তাঁর ক্ষুর ধার কলম দ্বারা প্রতিহত করেন। তিনি এসব ভ্রান্ত মতবাদেরজবাব দেন তাঁর “ইছনা ‘আশারিয়াহ” এর মাধ্যমে। তাঁর এ গ্রন্থ রচনা শিয়া মতবাদের ক্রমবর্ধমান প্লাবন প্রতিরোধে একটি মজবুত বাঁধের কাজ করেছে।
শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)-এর অতুলনীয় জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল। যার জন্য সাধারণ মানুষ তাঁকে উপকার লাভের মাধ্যম মনে করে তাঁর কাছে হাজির হত এবং দু’আ চাইত। কবি সাহিত্যিকগণ তাদের লেখনীদেখানোর জন্য আসতেন, সূফী সাধকগণ আধ্যাত্মিক উপকারিতা ও আত্মশুদ্ধির জন্য হাজির হতেন।
মতানৈক্য পূর্ণ বিষয়ে সুন্দর ঐক্য স্থাপনে তিনি তাঁর যুগে দৃষ্টান্তহীন ব্যক্তি ছিলেন। যে কোন সমস্যার সুন্দর ও সাবলীল সমাধান দিতে পারতেন। তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদানে খুবই পারদর্শী ছিলেন।
শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) জীবনের শেষ দিকে খুবই রুগ্ন হয়ে যান। একাধিক রোগ তাঁকে ঘিরে ধরে। যার ফলে তিনি গ্রন্থ রচনা করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। তারপরও যে সমস্ত কিতাবাদি লিপিবদ্ধ করেছেন পৃথিবীর জ্ঞান পিপাসুরা কিয়ামত পর্যন্ত তাঁকে স্মরণ করবে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কিতাবাদি হল : ১. ফাতহুল আযীয (তাফসীর) ২. বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন ৩. আল আজিলাতুন নাফিয়া ৪. মীযানুল বালাগাহ ৫. মীযানুল কালাম ৬. আল মুররুল জালিল ফি মাস’আলাতিত তাফদ্বীল ৭. ইছনা ‘আশারিয়া ৮. হাশিয়ায়ে আযীয়্যাহ। এছাড়াও আরো অনেক কিতাবাদি রয়েছে।
ইসলামের এ মহান ব্যক্তিত্ব ১২৩৯ হিজরীর ৭ই শাওয়াল রোজ রবিবার পবিত্র ফজরের নামাযের পর ইন্তিকাল করেন। দিল্লী শহরের অদূরে তাঁর শ্রদ্ধাভাজন পিতার কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।