.
[প্রথম পর্ব]
.
হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর ওফাতের পর যখন ইয়াজিদ জোরপূর্বক ইসলামী সালতানাতের খিলাফত দখল করে,তখন সে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে বায়’আত গ্রহণের প্রস্তাব দেয়। ইমাম হুসাইনরাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু তার বায়’আতকে প্রত্যাখ্যান করত মক্কা মুকাররামায় চলে যান। ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর নিকট ইয়াযিদ মুসলিম বিশ্বের খলীফা এবং ইমাম হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ অযোগ্য ছিল, বরং; সে ফাসিক, পাপিষ্ঠ, অত্যাচারী ও মদ্যপায়ী ছিল । আর খলিফা হিসেবে তার নিযুক্তিও খোলাফায়ে রাশেদা নির্বাচনে যে ইসলামী পদ্ধতি ছিল,তার পরিপন্থী । কূফার বাসিন্দারা ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর নিকট একে একে পত্র এবং প্রতিনিধি প্রেরণ করে আরজ করে যে, তিনি যেন কূফায় আগমন করেন। তারা এও বলে যে, আমাদের কোন ইমাম নেই। আমরা আপনার নিকটই বায়’আত গ্রহণ করব।
.
অতঃপর ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কূফায় আগমণের সিদ্ধান্ত নিলেন। ইতোপূর্বে তিনি হযরত মুসলিম বিন আক্বীল রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’কে সেখানে প্রেরণ করলেন। কূফাবাসী মুসলিম বিন আক্বীল রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র হাতে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র নামে বায়’আতও হল। কিন্তু যখন ইবনে যিয়াদ কূফাবাসীকে হুমকি দিল,তখন প্রায় সবাই ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র বায়’আত হতে প্রত্যাবর্তন করলো। এ খবর তখনও ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র নিকট পৌঁছায়নি। যার ফলে তিনি তাঁর যাত্রাকে কূফা অভিমুখে অব্যাহত রাখলেন। এর মধ্যে ইবনে যিয়াদ হযরত মুসলিম্ বিন আক্বীল রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’কে শহীদ করলো। অতঃপর ইয়াজিদেরনির্দেশে সে কারবালা অভিমুখে ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে আটক করতে সৈন্যবাহিনী পাঠালো।
.
হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু পাপীষ্ঠ ইয়াজিদের বায়’আতকে অস্বীকার করায় ২২ হাজার সৈন্যের বিশাল ইয়াজিদ বাহিনী সেদিন তিন দিন যাবৎ ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং তাঁর ১৮ জন আহলে বাইত ও সঙ্গীদের মধ্য হতে ৫৪ জনকে ৬১ হিজরী মোতাবেক ১০ই মুহররম কারবালা প্রান্তরে নির্দয় ভাবে শহীদ করে।উল্লেখ্য যে, সেদিন নবী বংশের কারোরই বিন্দু পরিমাণ সামরিক প্রস্তুতি ছিল না।
.
এই তো গেল কারবালার সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা। কিন্তু ইয়াজিদ বাহিনীর উপর এর পর পরই নেমে এসেছিল আল্লাহর মহা গযব।এই গযব ছিল ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর শাহাদাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সকল ব্যক্তির উপর। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দুনিয়াতে নির্মমভাবে শাস্তি দিয়ে ধবংস করে দেন।নবী বংশকে কষ্ট দেওয়া মানে নবীকে কষ্ট দেওয়া।আর নবীকে কষ্ট দেওয়া মানে স্বয়ং খোদা তা’আলাকেই কষ্ট দেওয়া।
.
সুতরাং,আমরা এখন জানব কারবালা পরবর্তী অবস্থায় কিরুপ হয়েছিল ইয়াজিদ বাহিনীর অবস্থা।এর আগে সংক্ষেপে জেনে নিই ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র ফযিলত।এতে করে আহলে বাইতের মর্যাদা সম্পর্কে আমরা অবগত হতে পারবো। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আহলে বায়তের সাথে হাশর নসীব করুন।আমিন, বিহুরমাতি সাইয়্যিদিল মুরসালিন – অনুবাদক
.
হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র ফযিলত
.
হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র অগণিত ফযিলত হাদীস সমূহের আলোকে প্রমাণিত। তন্মধ্যে কিছু ফাযায়েল বর্ণনা করছি।
.
হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র চাচী সাইয়্যেদা হযরত উম্মুল ফযল বিনতে হারিস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা অর্থাৎ হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র সহধর্মিনী একদিন নবীজীর নবুয়তী দরবারে হাজির হয়ে আরয করলেন,ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! আজ আমি একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি। সাইয়্যেদুল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা জিজ্ঞাসা করলেন, “কি দেখেছেন?” তিনি বললেন,অনেক ভয়ংকর।হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা আবার বললেন, “তা কি ?” অতঃপর তিনি আরয করলেন,
.
আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আপনার দেহ মুবারকের একটি অংশ আমার কোলে রাখা হয়েছে।
.
হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ইরশাদ করলেন,
.
আপনি অনেক উত্তম স্বপ্ন দেখেছেন। ইনশা’আল্লাহ ফাতিমা (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা) এর ঘরে একটি ছেলে সন্তান হবে। এবং তাঁকে আপনার কোলে রাখা হবে।
.
হুজুর সরওয়ারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র এই তা’বীর (স্বপ্নের বিশ্লেষণ) বাস্তবায়ন হল। সাইয়্যেদুশ শোহাদা, শাহজাদায়ে কাওনাইন হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ৪ঠা হিজরী মোতাবেক ৫ই শা’বান হযরত মাওলা আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র ঘরে এবং হযরত সাইয়্যেদা মা ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র পবিত্র গর্ভের মাধ্যমে দুনিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। অতঃপর তাঁকে সাইয়্যেদা উম্মুল ফযল রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা’র কোলে দেওয়া হয়।এরই মাধ্যমে নবীজীর ভবিষ্যত বাণী’র বাস্তবায়ন ঘটলো।
.
হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ইরশাদ করেন,
হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) দেখতে রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র মত ছিলেন। [বুখারী শরীফ]
.
হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু একবার হুজুর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র নিকট আরয করলেন,
ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! আহলে বায়তের মধ্যে আপনার নিকট কে সর্বাধিক প্রিয় ? হুজুর ইরশাদ করলেন, হাসান এবং হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা)। [মিশকাত শরীফ]
.
অধিকাংশ সময়ই হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা হযরত ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহাকে বলতেন, আমার সন্তানদেরকে ডাকো। যখন হযরত ইমাম হাসান এবং হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা হাজির হতেন, তখন তিনি উভয়ের ঘ্রাণ নিতেন এবং তাদের গর্দান মুবারকে চুমু খেতেন। [তিরমিযী,মিশকাত]
.
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন যে, নিঃসন্দেহে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ইরশাদ করেছেন,
.
নিশ্চয় হাসান এবং হুসাইন(রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) দুনিয়াতে আমার দু’টি ফুল। [তিরমিযী]
.
হযরত ইয়া’লী বিন মুররাহ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত যে,
রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ইরশাদ করেছেন, হুসাইন আমার হতে এবং আমি হুসাইন হতে। আল্লাহ তাকে মুহাব্বত করবেন, যে হুসাইনকে ভালোবাসবে। হুসাইন আমার আসবাতদের (নাতিদের) হতে অন্যতম প্রিয় সিব্তুন (নাতি)। [তিরমিযী,মিশকাত]
.
[‘সিব্তুন’ ঐ গাছকে বলা হয়, যার শেকড় একটি কিন্তু শাখা-প্রশাখা অনেক। যেমনকিনা হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর সন্তানদের আস্বাত (সিব্তুন এর বহুবচন আসবাত) বলা হয়। এমনিভাবে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হুজুর আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম এর সিব্তুন (অর্থাৎ এ দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, এই শাহজাদা’র মাধ্যমে আমার বংশ বৃদ্ধি পাবে এবং তাঁর সন্তান দ্বারা পূর্ব হতে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত পরিপূর্ণ হবে) সুতরাং দেখুন, আজ সা’আদাতে কিরামগণ (সৈয়্যদ বংশীয়গণ)পূর্ব হতে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত আছেন। এবং এটাও পরখ করে দেখুন যে,হাসানী সৈয়্যদ কম কিন্তু হুসাইনী সৈয়্যদ বেশী।]
.
ইয়াজিদ সৈন্যদের ভয়ংকর পরিণতি
.
আল্লাহ তায়ালা অন্যায়ভাবে হত্যাকারীদের সম্পর্কে বলেন,
وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا
অনুবাদঃ এবং যে কোন মুসলমানকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করলো,তার শাস্তি জাহান্নাম। যেখানে সে চিরস্থায়ী হবে। তার উপর আল্লাহর গযব এবং অভিশম্পাত এবং আল্লাহ তায়ালা তার জন্য মহা শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। [সূরা নিসা,আয়াত-৯৩]
.
টীকাঃ কে না জানে যে, ইয়াজিদ এবং তার সৈন্যরা যত নিরপরাধকে হত্যা করেছে,সেগুলো তো অন্যায়ভাবেই ছিল।
.
ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র বদ দোয়া
.
হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু পিপাসার্ত অবস্থায় পানি পান করার জন্য ফোরাত নদীর তীরে পৌঁছলেন। এমতাবস্থায় অভিশপ্ত হাসীন বিন নুমাইর তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছুড়লো,যা ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর মুখ মুবারকেলাগলো। সে সময়ে তাঁর জবান হতে অনিচ্ছাকৃতভাবে বদ দোয়া বের হয়ে গেল, “ইয়া আল্লাহ তায়ালা ! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এর মেয়ের সন্তানদের সাথে যে আচরণ করা হচ্ছে, আমি তার অভিযোগ(নালিশ) আপনার কাছেইকরছি। হে রাব্বুল আলামীন ! তাদেরকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করুন, টুকরা টুকরা করে দিন। তাদের মধ্যে থেকে কাউকে ছেড়ে দেবেন না।”
.
দোয়ার প্রভাব
.
এমন মজলুমের দোয়া, তারপর আবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র নাতি; তাঁর দোয়া কবুলের মধ্যে কি সন্দেহ থাকতে পারে ! সুতরাং দোয়া কবুল হল। এবং আখিরাতের পূর্বেই দুনিয়াতে এক এক জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হল।
.
ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি’র শিক্ষকের বর্ণনা
.
ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি’র শিক্ষক ইমাম যুহরী রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি বর্ণনা করেন, হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শাহাদতে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্য থেকে এক জনও রক্ষা পায়নি, যাদের কিনাআখিরাতের পূর্বে দুনিয়াতে শাস্তি হয়নি। তাদের মধ্যে কাউকে হত্যা করা হয়েছে, কারো চেহারা কুৎসিত ও বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই দেশ ও সম্রাজ্য তাদের থেকে ছিনিয়ে গিয়েছিল (অর্থাৎ তারা ক্ষমতায় থাকতে পারেনি)। প্রকাশথাকে যে, এটাই তাদের কর্মকান্ডের আসল শাস্তি নয় বরং তার এক দৃষ্টান্ত মাত্র। যা মানবজাতির শিক্ষার জন্য দুনিয়াতে দেখানো হয়েছিল।
.
ইয়াজিদের সৈন্য অন্ধ হয়ে গিয়েছিল
.
ইমাম জাওযীর দৌহিত্র বর্ণনা করেন যে, এক বৃদ্ধ হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শাহাদাতের সাথে জড়িত ছিল। সে একদিন হঠাৎ অন্ধ হয়ে গেল। লোকজন এর কারণ জানতে চাইলে সে বলল, “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’কে স্বপ্নে দেখলাম; তাঁর জামার আস্তিন গুটানো অবস্থায়,হাতের মধ্যে তলোয়ার এবং তাঁর সামনে চামড়ার একটি কার্পেট ছিল, যার উপর অপরাধীদের মৃত্যূদন্ড কার্যকর করা হয়। এর উপর ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’রহত্যাকারীদের মধ্য থেকে দশ জনের লাশ যবেহকৃত অবস্থায় পড়া ছিল। তারপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা আমাকে ধমক দিলেন এবং ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র রক্তের ফোটা আমার চোঁখে লাগিয়ে দিলেন।আমি সকাল বেলা উঠে দেখি আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছি।”
ইয়াজিদী সৈন্যদের ভয়ংকর পরিণতি
.
[দ্বিতীয় পর্ব]
.
* ইয়াজিদ সৈন্যের মুখ কুৎসিত হয়ে গেলো
.
হযরত আল্লামা ইবনে জাওযী রহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি অনুরুপ বর্ণনা করেন যে, যে ব্যক্তি হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র মাথা মোবারককে নিজের ঘোড়ার ঘাড়ের সাথে লটকিয়েছিল; তারপর তাকে এমন অবস্থায় দেখা গিয়েছিলো যে, তার মুখ আলকাতরার ন্যায় কুৎসিত হয়ে গেলো। লোকজন জিজ্ঞাসা করলো, তুমি সমগ্র আরবের মধ্যে অন্যতম সুদর্শন ব্যক্তি ছিলে তোমার এঅবস্থা কিভাবে হল ? সে বলল, “যেদিন হতে আমি ইমাম হুসাইনের মাথা মুবারক ঘোড়ার ঘাড়ের সাথে লটকিয়েছিলাম; সেদিনের পর কিছুক্ষণের জন্য ঘুমালাম। তখন(স্বপ্নে দেখলাম) দুইজন লোকআমার বাহু ধরে জ্বলন্ত এক অগ্নি কুন্ডের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অতঃপর তাতে নিক্ষেপ করে, যা কিনা আমাকে ঝলসে দেয়। অতঃপর কিছুদিন পর সে এই অবস্থা নিয়েই মারা যায়।
.
* ইয়াজিদ সৈন্য ছটফট করে মারা গেলো
.
ঐতিহাসিকগণ লিখেন যে, যে লোক হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে তীর নিক্ষেপ করেছিল এবং পানি পান করতে দেয় নাই। সে ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহ তা’আলা এমন পিপাসার সঞ্চারকরে দিলেন যে, কোনভাবেই তার পিপাসা নিবারণ হত না। পানি কতই না পান করুক সে, পিপাসায় ছটফট করতে থাকতো। এমতাবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত পানি পানে তার পেট ফেটে গেল এবং সে অবশেষেমারা গেল।
.
* ইয়াজিদ বাহিনীর নেতা ইয়াজিদের ভয়াবহ পরিণতি
.
সকল ইতিহাসবিদগণ ঐক্যমত যে,হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শাহাহাদাতের পর ইয়াজিদের একটা দিনও শান্তি মিলেনি। সমগ্র ইসলামী জাহানে তখন শহীদদের রক্তের ডাক এবংক্ষোভের সঞ্চার শুরু হয়ে যায়। (কারবালার পর) তার জীবন দুই বছর আট মাস,অপর বর্ণনায় তিন বছর আট মাস থেকে অধিক হয়নি। দুনিয়ার মধ্যেও তাকে আল্লাহ তা’আলা অপদস্থ করেছেন এবংসেই অপদস্থতার সাথেই সে ধবংস হয়ে গিয়েছিল। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন আমার কিতাব “লা’নত বর্ ইয়াজিদ”)
.
কুফা নগরীতে মুখতার এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি
.
হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র হত্যাকারীদের উপর আসমানী ও যমীনী বিভিন্ন বালা-মুসিবত নেমেছিল। শাহাদাতের পাঁচ বছর পর ৬৬ হিজরীতে মুখতার সাকাফী ইমামেরহত্যাকারীদের থেকে প্রতিশোধ(কিসাস) নেওয়ার অঙ্গীকার নিল। সাধারণ মুসলমানরাও তার সাথী হল এবং কিছু দিনের মধ্যেই তার এমন শক্তি অর্জিত হল যে, কুফা এবং ইরাকের উপর তাঁর কর্তৃত্বপ্রতিষ্ঠা হল। অতঃপর সে সর্বসাধারণের মাঝে ঘোষণা করল যে, “ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র হত্যাকারীরা ছাড়া সবাইকে নিরাপদ ঘোষণা করা হল।” অতঃপর ইমাম পাকেরহত্যাকারীদের ধরপাকড় এবং তালাশের ব্যাপারে সে সর্বশক্তি ব্যয় করলো। তারপর এক এক জনকে সে পাকড়াও করে হত্যা করল। একদিনে দুইশো আটচল্লিশ(২৪৮) ব্যক্তিকে ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহুতা’আলা আনহু’র শাহাদাতে শরীক থাকার অপরাধে হত্যা করা হল।
.
* আমর বিন হাজ্জাজ যুবাইদীঃ
.
এই ব্যক্তি গরমের মধ্যে পিপাসার্ত অবস্থায় পালিয়েছিল। পিপাসার দরুণ সে বেহুশ হয়ে পড়ে রইলো। অতঃপর সেই অবস্থায়ই তার শিরোচ্ছেদ করা হল।
.
* সীমার যিল জুশান
..
সে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অভিশপ্ত এবং দূর্ভাগা ছিল। তাকে হত্যা করে তার লাশ কুকুরের সামনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
.
আব্দুল্লাহ বিন উসাইদ জাহনামী,মালিক বিন বশীর বদী,হামল বিন মালিক
.
এদের সবাইকে আটক করা হল। তারা ক্ষমার আবেদন জানালো। মুখতার বলল, হে জালিমরা ! তোমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র নাতি’র প্রতি সদয় হওনি, তোমাদের উপর কিভাবে সদয়হওয়া যায় ? অতঃপর একে একে সবাইকে হত্যা করা হল। এদের মধ্যে মালিক বিন বশীর হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র টুপি মুবারক ছিনিয়ে নিয়েছিল। তার দুই হাত-পা কর্তন করেখোলা ময়দানে নিক্ষেপ করা হয়। সে ছটফট করতে করতে পরে মারা যায়।
.
* উসমান বিন খালিদ এবং বশীর বিন সমীত
.
সে ইমাম মুসলিম বিন আক্বীল রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর হত্যায় সহযোগীতা করেছিল। এই পাপিষ্ঠকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়।
.
* আমর বিন সা’দ
.
সে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র বিরুদ্ধে সৈন্যদেরকে কমান্ড তথা আদেশ দিত। তাকে হত্যা করে তার মাথা মুখতারের সামনে আনা হল। অন্যদিকে মুখতার আমরের ছেলেহাফসকে পূর্বেই নিজ দরবারে বসিয়ে রেখেছিল।যখন এই কর্তিত মাথা মজলিশের মধ্যে আনা হল তখন মুখতার হাফসকে বলল, “তুমি কি জানো এই মাথা কার?” সে বলল , ‘হ্যা’ এটা দেখার পর আমিওআমার জীবন চাই না।” অতঃপর তাকেও হত্যা করা হল। শেষে মুখতার বলল যে, “আমর বিন সা’দ এর হত্যা তো ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র বদলায় এবং হাফস এর হত্যা আলী আসগরবিন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র বদলায়।”
.
* হাকীম বিন তুফাইল
.
সে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে লক্ষ্য করে তীর মেরেছিল। প্রতিশোধ স্বরুপ তার দেহকে তীর দ্বারা ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। এবং এতেই সে ধবংস হয়।
.
* যায়েদ বিন রিফাদঃ
.
সে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র ভাতিজা এবং মুসলিম বিন আক্বীল এর শাহজাদা(সন্তান) হযরত আব্দুল্লাহকে তীর মেরেছিল। হযরত আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হাতদ্বারা তাঁর কপাল রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। তীর হাত ভেদ করে কপালে লাগলো; এতে তাঁর হাতটিও কপালের সাথে আহত হল। সেই রিফাদকে আটক করে প্রথমে তাকে তীর নিক্ষেপ,পরে পাথর নিক্ষেপকরা হল।অতঃপর জীবন্ত পুড়ে ফেলা হল।
.
* সিনান বিন আনাস
.
সে হযরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র মাথা মুবারক কর্তনে অগ্রসর হয়েছিল। কুফা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। এরপরে তার ঘর ধবংস করে দেওয়া হয়।
.
* ফয়সালা
হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র হত্যাকারীদের এই দৃষ্টান্তমূলক পরিণতি জানতে পেরে মনের অজান্তে এই আয়াতে কারীমা জবানে চলে আসল,
.
كذلك العذاب ولعذاب الآخرة أكبر
অর্থাৎ শাস্তি এমনই হয়ে থাকে এবং আখিরাতের শাস্তি এর চেয়েও ভয়াবহ। [সূরা ক্বলম,আয়াত-৩৩]
.
টীকাঃ
আখিরাতে তো সবাই এটা প্রত্যক্ষ করবে যে, এ সকল জালিমদের হাশর কেমন হবে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াতেই কিছু দৃষ্টান্ত দেখিয়ে দিলেন।
.
* ইয়াজিদ সৈন্যদের উপর দুনিয়াবী শাস্তির তালিকা
.
জালিমদের সৈন্যবাহিনীতে (হলুদ রঙের) যে ঘাস প্রথম থেকে রাখা হয়েছিল, তা পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়। [আগের যুগেহলুদ রঙের ঘাস যুদ্ধাহতদের ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হত- অনুবাদক ]
.
এই জালিমরা তাদের মধ্যে একটি উষ্ট্রী যবেহ করলো,তখন তারা সেই গোশতের মধ্যে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হতে দেখলো।
.
যখন উষ্ট্রীর গোশত রান্না করা হল, তখন তা তিক্ত বিষে পরিণত হয়ে গেল।
.
এক লোক হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শানে বেয়াদবীপূর্ণ কথা বলেছিল। তখন খোদায়ে জাব্বার ওয়া কাহহার তার উপর আসমানী তারকারাজির দুইটা স্ফুলিঙ্গ ছুঁড়লেন,যারদ্বারা তার দৃষ্টিশক্তি চলে যায়।
.
টীকাঃ
.
সাইয়্যেদুনা হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ইয়াজিদের হীন কর্মকান্ডের কারণে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। নিজ, নিজের বংশধর এবং সৈনিকগণ আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছেন কিন্তুঅপরদিকে ইয়াজিদের শেষ পরিণতি হল বরবাদী তথা ধবংস।
.
হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর শাহাদাত পরবর্তী সময়
.
সাইয়্যেদুনা হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র শাহাদাতের পর খবীস ইয়াজিদের জন্য আরাম আয়েশের দরজা খুলে গেল। জিনা,হারামখোরী ও মদপান উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং সে নিজনাফরমানীতে এতটাই মত্ত হয়ে গেল যে, সে মুসলিম বিন উকবাকে বার হাজার(১২,০০০) সংখ্যক সৈন্যসহ মদিনায়ে তৈয়্যেবা’র ধবংসের জন্য প্রেরণ করলো। ৬৩ হিজরীর ঐ সময়ে ইয়াজিদ বাহিনীমদীনা শরীফে এসে চরম মাত্রায় অসভ্যতা করা শুরু করলো।
.
ঐ পথভ্রষ্ট সৈন্যরা সাতশো’র মত সম্মানিত সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুম’কে শহীদ করলো এবং তাঁদের সাথে আরও দশ হাজার সাধারণ মানুষদেরকেও শহীদ করলো। অসংখ্য মেয়ে এবং মহিলাদেরকেবন্দি করলো এবং অন্যান্য ঘরের সাথে উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা’র ঘরেও লুটতরাজ চালালো। মসজিদে নববী’র খুঁটি’র সাথে ঘোড়া বেঁধে রাখলো এবং এই পবিত্রমসজিদকে ঘোড়ার পেশাব-পায়খানা দ্বারা অপবিত্র করে দিল। যার কারণে মুসলমানরা এই মসজিদে তিন দিন পর্যন্ত নামায আদায় করতে পারেননি। মোদ্দাকথা হল যে, ঐ ইয়াজিদী সৈন্যরা সেখানেএমন অবস্থা করলো, যা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না।
.
হযরত আব্দুল্লাহ বিন হানযালা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন যে, “মদিনা শরীফে ইয়াজিদী সৈন্যরা তখন এমন খারাপ এবং ক্ষমার অযোগ্য কর্মকান্ড করেছিল, যার ফলে আমরা আশংকাকরেছিলাম যে, তাদের হীন কর্মের জন্য না আবার আকাশ হতে পাথর বর্ষণ হওয়া শুরু করে।”
.
অতঃপর সেই সৈন্যরা মক্কা মুকাররমার দিকে রওয়ানা হয়। সেখানে গিয়েও ইয়াজিদীর সৈন্যরা অনেক সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম’কে শহীদ করে। খানায়ে কা’বার প্রতি পাথর নিক্ষেপকরলো,যার ফলে তাওয়াফের স্থানটি পাথর দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এতে করে মসজিদুল হারামের কয়েকটি খুঁটিও ভেঙ্গে পড়লো। এই জালিমরা কা’বা শরীফের গিলাফকেও তাঁর ছাদ পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিল।যার ফলশ্রুতিতে মক্কায়ে মুয়াজ্জামা কয়েকদিন পর্যন্ত গিলাফহীন থাকে। ইয়াজিদ এই জুলুম এবং সীমালংঘন করতঃ তিন বছর সাত মাস পর্যন্ত সম্রাজ্য পরিচালনা করে এবং পরিশেষে ১৫ ই রবিউলআউয়াল ৬৪ হিজরীতে শাম দেশের এক শহর হামাসে উনচল্লিশ (৩৯) বছর বয়সে মারা যায়। [আল্লাহ তা’আলা এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র অভিশম্পাত ইয়াজিদের উপর -অনুবাদক]