মুরশিদে কামিল, রঈসুল কুররা, উস্তাযুল মুহাদ্দিসীন হযরত আল্লামা মোঃ আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ আমাদের দেশে এক সুপরিচিত ওলী-আল্লাহর নাম। তিনি আমাদের মাঝে নেই। ২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারি দিবাগত রাতে তিনি ইন্তিকাল করেন। সুদীর্ঘ প্রায় সত্তর বছরকাল যাবত আন্জাম দেয়া দীনের বহুমুখী খিদমতই তাঁর ব্যাপক পরিচিতির অন্যতম কারণ। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর জীবন আল্লাহর রাহে সর্বোতভাবে নিবেদিত ছিল। তাঁকে একটি নির্দিষ্ট পরিচয়ে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। এটা কোনো অতিশয়োক্তি নয়; বরং তাঁর জীবন ও কর্ম এবং অবদানই এর বাস্তব প্রমাণ। তিনি ছিলেন তাসাওউফের উচ্চস্তরে আসীন একজন ওলী-আল্লাহ। জৌনপুরী সিলসিলার প্রখ্যাত বুযুর্গ হিসেবে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ও সুনাম পূর্বেও ছিল এবং এখনও বিদ্যমান। অন্যদিকে ইলমে কিরাতের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনন্য ও বিশ্ববিখ্যাত। ইলমে হাদীসের খিদমতে তাঁর রয়েছে পৌনে এক শতাব্দীর প্রোজ্জ্বল ইতিহাস। সমাজের অসহায়-দুঃস্থ মানুষের সেবায় তাঁর রয়েছে বহুবিধ খিদমত। তিনি সারাটি জীবন মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করেছেন বিভিন্নভাবে। তিনি ছিলেন সুললিত কন্ঠের অধিকারী দাঈ-ইলাল্লাহ, পাশাপাশি একজন সুলেখক ও সমাজ সংস্কারক।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ১৯১৩ সালে (১৩২১ বাংলা) সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলাধীন ফুলতলী গ্রামে এক প্রখ্যাত আলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুফতী মাওলানা আবদুল মজীদ চৌধুরী (র.) ছিলেন একজন স্বনামধন্য বিখ্যাত আলিমে দীন ও ফকীহ। তিনি অবিভক্ত ভারতের বাংলা আসাম অঞ্চলের একজন মশহুর বুযুর্গ ছিলেন। তিনি আজীবন মাদরাসায় শিক্ষকতাসহ দীনের অসাধারণ খিদমত আনজাম দেন। আমলে সালিহের মাধ্যমে তাযকিয়ায়ে নাফসের মেহনতে উচ্চাসনে আসীন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন তিনি।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) হযরত শাহজালাল (র.)-এর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হযরত শাহ কামাল (র.)-এর বংশের অধঃস্তন পুরুষ বিশিষ্ট বুযুর্গ হযরত শাহ আলা বখশ (র.)-এর বংশধর। শাহ আলা বখশ (র.) পর্যন্ত তাঁর বংশ পরম্পরা নিম্নরূপ: শাহ মোহাম্মদ আলা বখশ (র.) > শাহ মোহাম্মদ এলাহী বখশ (র.) > শাহ মোহাম্মদ সাদেক (র.) > শাহ মোহাম্মদ দানেশ (র.) > শাহ মোহাম্মদ হিরণ (র.) > মুফতী মাওলানা আবদুল মজীদ চৌধুরী (র.) > আল্লামা মোঃ আব্দুল লতিফ চৌধুরী (র.)।
শিক্ষা জীবন
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ফুলতলী মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষক ছিলেন তাঁর বংশীয় চাচাতো ভাই মাওলানা ফাতির আলী (র.)। এ সময় তিনি কারী সৈয়দ আলী সাহেবের নিকট কিরাত শিক্ষা গ্রহণ করেন। সে সময় তাঁর মুহতারাম পিতা গঙ্গাজল মাদরাসার প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁরই সুযোগ্য শাগরিদ হাইলাকান্দি রাঙ্গাউটি মাদরাসার সুপার, প্রখ্যাত ওলী মাওলানা আব্দুর রশিদ ছাহেব তাঁর শ্রদ্ধেয় উস্তাদের নিকট ফুলতলী ছাহেবকে এ মাদরাসায় ভর্তি করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। ফলে ১৩৩৬ বাংলায় তিনি এ মাদরাসায় ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। অতঃপর ১৩৩৮ বাংলায় বদরপুর সিনিয়র মাদরাসায় ভর্তি হয়ে সুনামের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন।
উচ্চ শিক্ষা ও ইলমে হাদীসের সনদ অর্জন
মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপনান্তে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) তাঁর উস্তাদ ও মুরশিদ হযরত মাওলানা আবূ ইউসূফ শাহ মোহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (র.)-এর নির্দেশ মুতাবিক উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ভারতের বিখ্যাত দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদরাসায়ে আলিয়া রামপুরে ভর্তি হয়ে ফনুনাত সম্পন্ন করেন। পরে ইলমে হাদীসের শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে মাতলাউল উলূম মাদরাসায় ভর্তি হন এবং সুনামের সাথে অধ্যয়নের পর হাদীসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে ১৩৫৫ হিজরী সনে হাদীসের সনদ লাভ করেন। এ মাদরাসায় তাঁর হাদীসের উস্তাদ ছিলেন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত আল্লামা খলীলুল্লাহ রামপুরী (র.) ও আল্লামা ওয়াজীহ উদ্দীন রামপুরী (র.) প্রমুখ। ইলমে হাদীস ছাড়াও তিনি ইলমে তাফসীর ও ফিকহ শাস্ত্রে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর হাদীসের সিলসিলা নিম্নরূপ :
১. হযরত আল্লামা মো: আব্দুল লতিফ ফুলতলী (র.) > ২. হযরত মাওলানা খলীলুল্লাহ রামপুরী (র.) > ৩. হযরত মাওলানা মনোওর আলী রামপুরী (র.) > ৪. হযরত সায়্যিদ মুহাম্মদ শাহ্ (র.) > ৫. তাঁর পিতা হযরত সায়্যিদ হাসান শাহ্ (র.) > ৬. হযরত শায়খ আলম আলী আন নাকিনাওয়ী (র.) > ৭. হযরত শাহ্ মুহাম্মদ ইসহাক (র.) > ৮. হযরত শাহ্ আবদুল আযীয আদ দেহলভী (র.) > ৯. তাঁর পিতা হযরত শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ আল উমরী আদ দেহলভী (র.) > ১০. হযরত শায়খ আলহাজ মুহাম্মদ আফদ্বাল (র.) > ১১. হযরত শায়খ আবদুল আহাদ (র.) > ১২. তাঁর পিতা খাযিনুর রহমত হযরত শায়খ মুহাম্মদ সাঈদ (র.) > ১৩. হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে ছানী শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (র.) > ১৪. হযরত শায়খ মুহাম্মদ ইয়াকূব কাশ্মিরী (র.) > ১৫. হযরত শায়খ আহমদ ইবনে হাজার আল হায়তামী আল মক্কী (র.) > ১৬. হযরত শায়খ যায়নুদ্দীন যাকারিয়া আল আনসারী (র.) > ১৭. হযরত শায়খ হাফিয আবুল ফদল শিহাবুদ্দীন আহমদ ইবনে আলী ইবনে হাজার আসকালানী (র.) > ১৮. হযরত ইবরাহীম ইবনে আহমদ আত তানূখী (র.) > ১৯. হযরত আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে আবূ তালিব আল হাজ্জার (র.) > ২০. হযরত সিরাজুল হুসায়ন ইবনুল মুবারক আয যাবিদী (র.) > ২১. হযরত শায়খ আবুল ওয়াক্ত আবদুল আউয়াল ইবনে ঈসা ইবনে শুয়াইব আস সিজযী আল হারাভী (র.) > ২২. হযরত শায়খ আবুল হাসান ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে মুজাফফর আদ দাঊদী > ২৩. হযরত আবূ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ আস সারখাসী (র.) > ২৪. হযরত আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ ইবনে মাতার আল ফিরাবরী (র.) > ২৫. ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম ইবনুল মুগীরা আল জু’ফী আল বুখারী (র.)। ইমাম বুখারী (র.) থেকে রাসূলে পাক (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক হাদীসের সনদ সুপ্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য। অনুরূপভাবে হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ভারতবর্ষের স্বনামধন্য মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা ওয়াজীহ উদ্দীন রামপুরী (র.) হতে হাদীসের সনদ লাভ করেন। হযরত ওয়াজীহ উদ্দিন রামপুরী (র.)-এর সনদ অন্য সিলসিলায় হযরত শাহ্ মুহাম্মদ ইসহাক পর্যন্ত পৌঁছে পূর্বের সনদের সাথে যুক্ত হয়েছে।১
ইলমে কিরাত
ইসলামী জ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘ইলমে কিরাত’। ইলমে কিরাতে তাঁর সুযোগ্য শিক্ষক ছিলেন স্বীয় পীর ও মুরশিদ হযরত আবূ ইউসূফ শাহ মোঃ ইয়াকুব বদরপুরী (র.)। তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ফুলতলী ছাহেব কিরাত বিষয়ে আরো শিক্ষা গ্রহণ করেন উপমহাদেশের বিখ্যাত কারী হযরত মাওলানা হাফিয আবদুর রঊফ করমপুরী শাহবাজপুরী (র.)-এর কাছ থেকে। শাহবাজপুরী (র.) ছিলেন হযরত ইরকসূস মিসরী (র.)-এর ছাত্র। ১৯৪৪ ইং (১৩৫১ বাংলা) সনে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) মক্কা শরীফ গমন করে ইলমে কিরাতের আরো উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন শায়খুল কুররা হযরত আহমদ হিজাযী (র.)-এর কাছ থেকে। আহমদ হিজাযী (র.) ছিলেন হারাম শরীফের ইমামগণের পরীক্ষক ও তৎকালীন বিশ্বের খ্যাতিমান কারীগণের উস্তাদ। তিনি শায়খুল কুররা হযরত আহমদ হিজাযী (র.)-এর কাছ থেকেও ১৯৪৬ ইং (১৩৫৩ বাংলা) সনে ইলমে কিরাতের সনদ লাভ করেন।
ইলমে কিরাতের সনদ
শামসুল উলামা হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) তিন সিলসিলায় ইলমে কিরাতের সনদ লাভ করেন।
প্রথমত
তাঁর উস্তাদ ও মুরশিদ কুতবুল আউলিয়া হযরত মাওলানা আবূ ইউসূফ শাহ্ মোঃ ইয়াকুব বদরপুরী (র.) > হযরত শায়খ মাওলানা আবদুল মজীদ (র.) > হযরত শায়খ মাওলানা আবদুল ওয়াহ্্হাব সিলেটী (র.) > তিনি হতে ধারাবাহিক সনদে হযরত ইমাম আবূ আমর আদ্্ দানী পর্যন্ত কিরাতের সিলসিলা মিলিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত
তাঁর উস্তাদ হযরত হাফিয মাওলানা আব্দুর রউফ করমপুরী (র.)> হযরত ইরকসূস মিসরী (র.) > শায়খুল কুররা হযরত আবদুল্লাহ আল মক্কী (র.) > তিনি হতে ধারাবাহিক সনদে ইমাম আবূ আমর আদ্্ দানী পর্যন্ত কিরাতের সিলসিলা মিলিত হয়েছে।
তৃতীয়ত
তাঁর উস্তাদ মক্কা শরীফের রঈসুল কুররা শায়খ আহমদ হিজাযী মক্কী আল ফকীহ (র.) > হযরত শায়খ আহমদ আদ্ দারদীর, তিনি হতে ধারাবাহিক সনদে হযরত ইমাম আবূ আমর আদ্ দানী পর্যন্ত কিরাতের সিলসিলা মিলিত হয়েছে।
কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এখানে হযরত ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর উস্তায হযরত আবদুর রউফ করমপুরী (র.)-এর সিলসিলাটি কেবল পূর্ণাঙ্গরূপে প্রদত্ত হলো :
১. হযরত আল্লামা মোঃ আব্দুল লতিফ ফুলতলী (র.) > ২. হযরত হাফিয মাওলানা আবদুর রউফ করমপুরী (র.) > ৩. হযরত ইরকসূস মিসরী (র.) > ৪. শায়খুল কুররা হযরত আবদুল্লাহ আল মক্কী (র.) > ৫. হযরত কারী ইবরাহীম সা’দ মিসরী (র.) > ৬. হযরত হাসান বাদবার শাফিঈ (র.) > ৭. হযরত মুহাম্মদ আল মুতাওয়াল্লী (র.) > ৮. হযরত সায়্যিদ আহমদ তিহামী (র.) > ৯. হযরত আহমদ সালমুনা (র.) > ১০. হযরত ইবরাহীম আল ‘উবায়দী (র.) > ১১. হযরত আবদুর রহমান আল আজহুরী (র.) > ১২. হযরত শায়খ আহমদ আল বাকারী (র.) > ১৩. হযরত শায়খ মুহাম্মদ আল-বাকারী (র.) > ১৪. হযরত আবদুর রহমান আল ইয়ামনী (র.) > ১৫. হযরত শায়খ শাখ্খাজা (র.) > ১৬. হযরত শায়খ আবদুল হক ছানবাতী (র.) > ১৭. হযরত শায়খুল ইসলাম যাকারিয়া আল আনসারী (র.) > ১৮. হযরত শায়খ দেওয়ান আল-আকারী (র.) > ১৯. হযরত শায়খ মুহাম্মদ আননাওয়েরী (র.) > ২০. হযরত ইমাম মুহাম্মদ আল জাযারী (র.) > ২১. হযরত শায়খ ইবনুল লাব্বান (র.) > ২২. হযরত শায়খ আহমদ ছিহর আশ শাতাবী (র.) > ২৩. হযরত শায়খ আবুল হাসান আলী ইবনে হুদায়ল (র.) > ২৪. হযরত শায়খ আবূ দাঊদ সুলায়মান ইবনে নাজ্জাহ (র.) > ২৫. হযরত ইমাম আবূ আমর আদ্ দানী (র.)।
হযরত শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (র.) ও হযরত আহমদ হিজাযী মক্কী (র.)-এর কিরাতের সিলসিলাও ভিন্ন ভিন্ন সনদে হযরত ইমাম আবূ আমর আদ্্দানী (র.)-তে পৌঁছে মিলিত হয়েছে। এ হিসেবে ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর তিন উস্তাযের সিলসিলার ঊর্ধ্বতন ক্রমধারা ইমাম আবূ আমর আদ্ দানী (র.)-এর পর থেকে নিম্নরূপ :
২৬. হযরত আবুল হাসান তাহির ইবনে গালিউন (র.) > ২৭. হযরত সালিহ আল-হাশিমী (র.) > ২৮. হযরত আহমদ আল উশনানী (র.) > ২৯. হযরত মুহাম্মদ ‘উবায়দ আল সাব্বাহ (র.) > ৩০. হযরত ইমাম হাফস (র.) > ৩১. হযরত ইমাম আসিম ইবন আবুন নুজূদ আল কূফী (র.) > ৩২. হযরত আবূ আবদিল্লাহ ইবনে হাবীব আস সুলামী ও যির ইবনে হুবায়শ (র.) > ৩৩. আমীরুল মু’মিনীন হযরত উসমান (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.), হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.) ও হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.) > ৩৪. সায়্যিদুল মুরসালীন, শাফিউল মুযনিবীন, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হযরত জিবরীল (আ.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের লাওহে মাহফুয থেকে।২
ইলমে তরীকত
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ছাত্রজীবনেই তরীকতের বায়আত হন ও খিলাফত লাভ করেন। ইলমে তাসাওউফে তাঁর মুরশিদ হযরত মাওলানা আবূ ইউসুফ শাহ মোঃ ইয়াকুব বদরপুরী (র.)। হযরত বদরপুরী (র.) ছিলেন তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আলিমে দীন ও সর্বজনমান্য বুযুর্গ। তিনি হাদিয়ে বাঙ্গাল হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (র.)-এর সুযোগ্য ছাহেবজাদা ও খলীফা হযরত হাফিয আহমদ জৌনপুরী (র.)-এর খলীফা ছিলেন।
কৈশোরেই এক শোকাবহ দিনে হযরত বদরপুরী (র.)-এর সাথে হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর পরিচয় হয়। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর পিতা হযরত মাওলানা আবদুল মজীদ চৌধুরী (র.)-এর ইন্তিকালের আগের দিন হযরত বদরপুরী (র.) জকিগঞ্জের আটগ্রামে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তিনি হযরত মুফতী আবদুল মজীদ ছাহেব (ফুলতলী ছাহেবের আব্বা)-কে দেখতে যান। তিনি ছিলেন অত্যন্ত অসুস্থ, শয্যাশায়ী। বদরপুরী (র.) নির্ধারিত সফর বাতিল করে পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে অবস্থান করেন। এ দিন রাতেই মাওলানা আবদুল মজিদ চৌধুরী (র.) ইন্তিকাল করেন। পরদিন তাঁর জানাযায় হযরত বদরপুরী (র.) ইমামতি করেন। জানাযার পর যখন তাঁকে দাফনের কাজ চলছে, কিশোর ফুলতলী ছাহেব কবরের একপাশে বিষণœ মনে বসে নিরবে চোখের পানি ফেলছেন, এমনি মুহূর্তে তিনি তাঁর পিঠে যাঁর দয়ার্দ্র হাতের পরশ অনুভব করলেন তিনি হলেন হযরত বদরপুরী (র.)।
মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য ফুলতলী ছাহেব হাইলাকান্দি মাদরাসায় ভর্তি হলেন। কিছুকাল পর একদিন বদরপুর অতিক্রম করার সময় বদরপুরী ছাহেবের সাথে দেখা হলো তাঁর। খোঁজ-খবর নিয়ে বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক জামাতে ভর্তি হতে বললেন বদরপুরী ছাহেব। তাঁর কথামতো ফুলতলী ছাহেব বদরপুর সিনিয়র মাদরাসায় ভর্তি হলেন। পীর-ওলীগণের মাযার যিয়ারত তাঁর খুব ভালো লাগত। আধ্যাত্মিকতা এবং বদরপুরী ছাহেব কিবলাহর প্রতি তাঁর মনে ছিল তীব্র আকর্ষণ। কিসের যেন এক টান সর্বদা অনুভব করতেন মনে। কিন্তু ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিলেন না, কোথায় কার নিকট বায়আত হবেন। অনেকটা সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যেই এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন, বদরপুরী ছাহেব কিবলাহ নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় বরই (কুল) গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন তিনি। রাত তখন দু’টা। ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন তরুণ ফুলতলী ছাহেব স্বপ্নের কোনো ব্যাখ্যা বুঝতে পারলেন না। ওযূ করে দু’রাকাত নামায পড়ে আবার শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আবারো সেই একই স্বপ্ন-একই ইশারা। এবারও জেগে উঠলেন তিনি। স্বপ্নের গভীর তাৎপর্য বুঝতে বাকী রইল না। ওযূ করে লজিং থেকে বেরিয়ে পড়লেন পার্শ্ববর্তী গ্রাম বুন্দাশিলের উদ্দেশ্যে-বদরপুরী (র.)-এর বাড়ি যেখানে। গভীর রাতে ছাহেব বাড়িতে পৌঁছে দেখেন, স্বপ্নে যে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বদরপুরী ছাহেব তাঁকে ডাকতে দেখেছেন, ঠিক সেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি! আলো আঁধারের মাঝে মানুষের অস্তিত্ব অনুমান করে বদরপুরী ছাহেব কিবলাহ তাঁর নাম ধরে বললেন, আব্দুল লতিফ এসেছো ? তিনি সালাম দিলেন। ছাহেব ওযূ আছে কি না জানতে চাইলে ফুলতলী ছাহেব বললেন, আছে। আর কোনো কথা না বলে ভেতর বাড়ির নিজের কামরায় নিয়ে হাত ধরে বায়আত করালেন, তা’লীম-তাওয়াজ্জুহসহ সবক বাতলে দিলেন।৩
বায়আত হওয়ার পর থেকে আপন পীর ও মুরশিদ হযরত বদরপুরী (র.)-এর নির্দেশনা হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) যথাযথভাবে পালন করে যেতে থাকলেন। পীর ও মুরশিদের তা’লীম-তাওয়াজ্জুহের এক পর্যায়ে ছাত্রাবস্থায়ই মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৩৩৯ বাংলা সনে তিনি খিলাফত লাভ করেন। এটি ছিল হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর অনন্য গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি।
তরীকতের সিলসিলা
হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) হযরত বদরপুরী (র.)-এর কাছে পাঁচ তরীকায় বায়আত হন। তরীকাগুলো হলো চিশতিয়া, কাদিরিয়া, নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দিদিয়া এবং মুহাম্মদিয়া। রামপুর অবস্থানকালে ছাহেব কিবলাহ (র.) স্বীয় মুরশিদের অনুমতিক্রমে সেখানকার চিশতিয়া নিজামিয়া তরীকার প্রখ্যাত বুযুর্গ হযরত মাওলানা গোলাম মুহিউদ্দীন (র.)-এর নিকট থেকে চিশতিয়া নিজামিয়া তরীকার বায়আতের ইজাযত লাভ করেন। হযরত গোলাম মুহিউদ্দীন (র.) তাঁকে দালাইলুল খায়রাতেরও ইজাযত প্রদান করেন।
হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর চিশতিয়া, কাদিরিয়া, নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দিদিয়া ও মুহাম্মদিয়া তরীকার সিলসিলা নিম্নরূপ:
০১. শামসুল উলামা হযরত আল্লামা মোঃ আব্দুল লতিফ ফুলতলী (র.) > ০২. কুত্বুল আউলিয়া হযরত মাওলানা আবূ ইউসূফ শাহ মোহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (র.) > ০৩. শামসুুল আরিফীন হযরত মাওলানা শাহ্ হাফিয আহমদ সিদ্দীকী জৌনপুরী (র.) > ০৪. তাঁর পিতা ও মুরশিদ হযরত মাওলানা শাহ্ কারামাত আলী সিদ্দীকী জৌনপুরী (র.) > ০৫. ইমামুত্ তরীকাত, আমীরুল মু’মিনীন হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) > ০৬. হযরত মাওলানা শাহ্ আবদুল আযীয দেহলভী (র.) > ০৭. তাঁর পিতা ও মুরশিদ হযরত মাওলানা শাহ্ আহমদ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (র.) > ০৮. তাঁর পিতা ও মুরশিদ হযরত মাওলানা শাহ্ আবদুর রহীম দেহলভী (র.) হযরত শাহ আবদুর রহীম মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) তিনটি সিলসিলায় বিভিন্ন তরীকার বায়আত ও ইজাযত হাসিল করেন।
তরীকায়ে চিশতিয়া
হযরত শাহ আবদুর রহীম মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)-এর তরীকায়ে চিশতিয়া’র সিলসিলা নিম্নরূপ : ০৯. তাঁর নানা হযরত শায়খ রাফিউদ্দীন (র.) > ১০. হযরত শায়খ কুত্বুল আলম (র.) > ১১. হযরত শায়খ নাজমুল হক চাঁয়ে লুদ্দাহ (র.) > ১২. হযরত শায়খ আবদুল আযীয (র.) > ১৩. হযরত কাযী খান ইউসূফ নাসিহী (র.) > ১৪. হযরত শায়খ হাসান তাহির (র.) > ১৫. হযরত শায়খ সায়্যিদ রাজী হামিদ শাহ্ (র.) > ১৬. হযরত শায়খ হুস্সামুদ্দীন মানিকপুরী (র.) > ১৭. হযরত নূর কুতবুল আলম (র.) > ১৮. হযরত শায়খ আলাউল হক (র.) > ১৯. হযরত শায়খ সিরাজ উদ্দীন আখী সিরাজ (র.) > ২০. সুলতানুল আউলিয়া হযরত নিযামুদ্দীন (র.) > ২১. হযরত ইমামুয যাহিদীন শায়খ ফরীদ উদ্দীন গনজেশকর (র.) > ২২. হযরত শায়খ কুত্বুদ্দীন বখতিয়ার কাকী (র.) > ২৩. হযরত ইমামুত তরীকত শায়খ মুঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী (র.) > ২৪. হযরত শায়খ ওসমান হারূনী (র.) > ২৫. হযরত শায়খ আলহাজ্জ শরীফ যানদানী (র.) > ২৬. হযরত শায়খ মওদূদ চিশতী (র.) > ২৭. হযরত শায়খ ইউসূফ চিশতী (র.) > ২৮. হযরত শায়খ মুহাম্মাদ চিশতী (র.) > ২৯. হযরত শায়খ আহমদ চিশতী (র.) > ৩০. হযরত শায়খ আবূ ইসহাক শামী চিশতী (র.) > ৩১. হযরত খাজা মামশাদ উলূ দিনওয়ারী (র.) > ৩২. হযরত আবূ হুবায়রাহ আল বসরী (র.) > ৩৩. হযরত হুযায়ফাহ আল মার‘আশী (র.) > ৩৪. সুলতানুত তারিকীন হযরত ইবরাহীম ইবন্ আদহাম আল বলখী (র.) > ৩৫. শায়খ হযরত ফুদায়ল ইবন আয়াদ্ব (র.) > ৩৬. হযরত আবদুল ওয়াহিদ ইবন যায়দ (র.) > ৩৭. খায়রুত তাবিঈন হযরত হাসান আল-বসরী (র.) > ৩৮. কুদওয়াতুল আতকিয়া ইমামুল আউলিয়া আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা হযরত আলী (রা.) > ৩৯. সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন মাহবূবু রাব্বিল আলামীন সায়্যিদুনা ওয়া মাওলানা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলা আলিহি ওয়া সাল্লাম।
তরীকায়ে কাদিরিয়া
হযরত মাওলানা শাহ্ আবদুর রহীম মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)-এর তরীকায়ে কাদিরিয়ার সিলসিলা নিম্নরূপ:
০৯. হযরত সায়্যিদ আবদুল্লাহ আকবারাবাদী (র.) > ১০. হযরত সায়্যিদ আদম বান্নূরী (র.) > ১১. ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে ছানী হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (র.) > ১২. তাঁর পিতা হযরত শায়খ আবদুল আহাদ (র.) > ১৩. হযরত শাহ কামাল (র.) > ১৪. হযরত শাহ ফুদায়ল (র.) > ১৫. হযরত সায়্যিদ গদা রহমান (র.) > ১৬. হযরত সায়্যিদ শামসুদ্দীন আরিফ (র.) > ১৭. হযরত শাহ গদা রহমান ইবন সায়্যিদ আবুল হাসান (র.) > ১৮. হযরত শামসুদ্দীন সাহরাওয়ী (র.) > ১৯. হযরত শায়খ ‘উকায়ল (র.) > ২০. হযরত শায়খ বাহাউদ্দীন (র.) > ২১. হযরত শায়খ আবদুল ওয়াহহাব (র.) > ২২. হযরত শায়খ শরফুদ্দীন কাত্তাল (র.) > ২৩. হযরত শায়খ আবদুর রায্যাক (র.) > ২৪. হযরত ইমামুত তরীকত শায়খ আবদুল কাদির জিলানী (র.) > ২৫. হযরত শায়খ আবূ সাঈদ আল মাখযূমী (র.) > ২৬. হযরত শায়খ আবুুল হাসান আল কারশী (র.) > ২৭. হযরত শায়খ আবুল র্ফাহ আত তারতুসী (র.) > ২৮. হযরত শায়খ আবুল ফদল আবদুল ওয়াহিদ আত তামীমী (র.) > ২৯. হযরত শায়খ আবদুল আযীয আত তামীমী (র.) > ৩০. হযরত শায়খ আবূ বকর আশ-শিবলী (র.) > ৩১. হযরত সায়্যিদুত তায়িফা জুনায়দ বাগদাদী (র.) > ৩২. হযরত শায়খ আবুল হাসান সারী আস সাকাতী (র.) > ৩৩. হযরত শায়খ মা’রূফ আল কারখী (র.) > ৩৪. হযরত ইমাম আলী রেদ্বা (র.) > ৩৫. হযরত ইমাম মূসা কাযিম (র.) > ৩৬. হযরত ইমাম জা’ফর আস সাদিক (র.) > ৩৭. হযরত ইমাম মুহাম্মাদ আল বাকির (র.) > ৩৮. হযরত ইমাম যায়নুল আবিদীন (র.) > ৩৯. সায়্যিদুশ্ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) > ৪০. সায়্যিদুল আউলিয়া ওয়াল কামিলীন, হযরত আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু (রা.) > ৪১. সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন হাবীবু রাব্বিল ‘আলামীন সায়্যিদুনা ওয়া মাওলানা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলা আলিহি ওয়া সাল্লাম।
তরীকায়ে নকশবন্দিয়া ও মুজাদ্দিদিয়া
হযরত মাওলানা শাহ আবদুর রহীম মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)-এর তরীকায়ে নক্শবন্দিয়া ও মুজাদ্দিদিয়া-এর সিলসিলা নিম্নœরূপ :
০৯. হযরত সায়্যিদ আবদুল্লাহ আকবরবাদী (র.) > ১০. হযরত সায়্যিদ আদম বান্নূরী (র.) > ১১. ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে সানী হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (র.) > ১২. হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ্ (র.) > ১৩. হযরত খাজা আমাকনাকী (র.) > ১৪. হযরত শায়খ দরবেশ মুহাম্মাদ (র.) > ১৫. হযরত শায়খ যাহিদ (র.) > ১৬. হযরত শায়খ ‘উবায়দুল্লাহ আল আহ্রার (র.) > ১৭. হযরত মাওলানা ইয়াকূব চরখী (র.) > ১৮. ইমামুশ শরীআত ওয়াত তরীকত শায়খ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী (র.) > ১৯. হযরত খাজা মুহাম্মদ বাবা সাম্মাসী (র.) > ২০. হযরত শায়খ আলী রামীতিনী (র.) > ২১. হযরত শায়খ মাহমুদুল খায়ের ফাগনাওয়ী (র.) > ২২. হযরত খাজা আরিফ রিওয়ায়গড়ী (র.) > ২৩. হযরত শায়খ আবদুল খালিক গিজদিওয়ানী (র.) > ২৪. হযরত শায়খ ইউসূফ আল হামাদানী (র.) > ২৫. হযরত শায়খ আবূ আলী আল ফারমিদী (র.) > ২৬. হযরত ইমাম শায়খ আবুল কাসিম আল কুশায়রী (র.) > ২৭. হযরত শায়খ আবূ আলী আদ-দাক্কাক (র.) > ২৮. হযরত শায়খ আবুল কাসিম নাছিরাবাদী (র.) > ২৯. হযরত শায়খ আবূ বকর আশ শিবলী (র.) > ৩০. হযরত সায়্যিদুত তায়িফা জুনায়দ আল বাগদাদী (র.) > ৩১. হযরত শায়খ আবুল হাসান সিররী আস সাকাতী (র.) > ৩২. হযরত শায়খ মা’রূফ আল কারখী (র.) > ৩৩. হযরত শায়খ ইমাম আলী রেদ্বা (র.) > ৩৪. হযরত ইমাম মূসা কাযিম (র.) > ৩৫. হযরত ইমাম জা’ফর আস সাদিক (র.) > ৩৬. রাঈসুল ফুকাহা ওয়াত তাবিঈন হযরত কাসিম ইবন মুহাম্মদ (র.) > ৩৭. ছাহিবে রাসূল (সা.) সাইয়িদুনা হযরত সালমান আল-ফারসী (রা.) > ৩৮. সায়্যিদুল ওয়াসিলীন আফদালুল খুলাফা ওয়া রাশিদীন আমীরিল মু’মিনীন সাইয়্যিদুনা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) > ৩৯. সায়্যিদুল মুরসালীন ইমামুল মুত্তাকীন সাইয়্যিদুনা হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলা আলিহি ওয়া সাল্লাম।
তরীকায়ে চিশতিয়া নিযামিয়া
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত বদরপুরী (র.)-এর অনুমতিক্রমে ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) চিশতিয়া নিজামিয়া তরীকায় বায়আত হন হযরত গোলাম মুহিউদ্দীন (র.)-এর কাছে। তাঁর চিশতিয়া নিজামিয়া তরীকার সিলসিলা নিম্নরূপ:
০১. হযরত মাওলানা মোঃ আব্দুল লতিফ ফুলতলী (র.) > ০২. শায়খুল মাশায়িখ হযরত মাওলানা গোলাম মুহিউদ্দীন রামপুরী (র.) > ০৩. হযরত মাওলানা সায়্যিদ মুহাম্মদ মুশতাক শাহ (র.) > ০৪. হযরত মাওলানা সায়্যিদ মুহাম্মদ জামাল শাহ রামপুরী (র.) > ০৫. হযরত মাওলানা মুহাম্মদ নাসির উদ্দীন শাহকালী ছাহেব (র.) > ০৬. হযরত মাওলানা কুতুব উদ্দীন (র.) > ০৭. হযরত মাওলানা ফখরুদ্দীন দেহলভী (র.) > ০৮. হযরত শায়খ নিযামুদ্দীন আওরঙ্গবাদী (র.) > ০৯. হযরত শায়খ কালীমুল্লাহ জাহানাবাদী (র.) > ১০. হযরত শায়খ ইয়াহইয়া আল মাদানী (র.) > ১১. হযরত শায়খ মুহাম্মাদ (র.) > ১২. হযরত শায়খ হাসান মুহাম্মাদ (র.) > ১৩. হযরত শায়খ জামাল উদ্দীন (র.) > ১৪. হযরত শায়খ মাহমূদ রাজান (র.) > ১৫. হযরত শায়খ আলাম (র.) > ১৬. হযরত শায়খ সিরাজুদ্দীন (র.) > ১৭. হযরত শায়খ কামালুদ্দীন আল্লামা (র.) > ১৮. হযরত নাসির উদ্দীন মাহমূদ চেরাগে দিল্লী (র.) > ১৯. শায়খ নিযামুদ্দীন মুহাম্মদ ইবন হযরত সায়্যিদ আহমদ বাদায়ুনী (র.) > ২০. ফরিদ উদ্দীন মাসউদ গনজেশকর (র.) > ২১. খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী (র.) > ২২. হযরত ইমামুত তরীকত শায়খ মুঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী (র.) > ২৩. হযরত শায়খ ওসমান হারূনী (র.) > ২৪. হযরত শায়খ আলহাজ্জ শরীফ যানদানী (র.) > ২৫. হযরত শায়খ মওদূদ চিশতী (র.) > ২৬. হযরত শায়খ ইউসূফ চিশতী (র.) > ২৭. হযরত শায়খ মুহাম্মাদ চিশতী (র.) > ২৮. হযরত শায়খ আহমদ চিশতী (র.) > ২৯. হযরত শায়খ আবূ ইসহাক শামী চিশতী (র.) > ৩০. হযরত খাজা মামশাদ উলূ দিনওয়ারী (র.) > ৩১. হযরত আবু হুবায়রাহ আল বসরী (র.) > ৩২. হযরত হুযাইফাহ আল মার‘আশী (র.) ৩৩. সুলতানুত তারিকীন হযরত ইবরাহীম ইবন আদম আল বলখী (র.) > ৩৪. শায়খ হযরত ফুদায়ল ইবন আয়াদ্ব (র.) > ৩৫. হযরত আবদুল ওয়াহিদ ইবন যায়দ (র.) > ৩৬. খায়রুত তাবিঈন হযরত হাসান আল বসরী (র.) > ৩৭. কুদওয়াতুল আতকিয়া ইমামুল আউলিয়া আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা হযরত আলী (রা.) > ৩৮. সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন মাহবূবু রাব্বিল আলামীন সায়্যিদুনা ওয়া মাওলানা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলা আলিহি ওয়া সাল্লাম।৪
কর্ম জীবন
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর কর্মজীবন দীনের বহুমুখী খিদমতে নিবেদিত ছিল। তিনি সারা জীবন আল কুরআনুল কারীমের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শিক্ষা দিয়েছেন, হাদীসে নববীর দারস দিয়েছেন, তরীকতের তা’লীমের মাধ্যমে মানুষের অন্তর পরিশুদ্ধ করেছেন, আর্ত মানবতার সেবা করেছেন। তাঁর বহুমুখী খিদমত সম্পর্কে এখানে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হলো।
ইলমে হাদীসের খিদমত
কর্মজীবনে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ১৯৪৬ সালে বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় যোগদান করে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। এরপর গাছবাড়ি জামেউল উলূম আলিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করে ছয় বছর সুনামের সাথে পাঠদান করেন। তিনি এ সময় ভাইস প্রিন্সিপাল ও প্রিন্সিপাল হিসেবে গুরুদায়িত্ব আনজাম দেন। এরপর সুদীর্ঘকাল সৎপুর আলিয়া মাদরাসা ও ইছামতি আলিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে ইলমে হাদীসের খিদমত আনজাম দেন। তিনি এসব প্রতিষ্ঠানে বুখারী, নাসাঈ, ইবন মাজাহ, তিরমিযী, আবূ দাঊদ, ইতকান, নূরুল আনোয়ার, আকাইদ, হিদায়া, জালালাইন প্রভৃতি উঁচু পর্যায়ের কিতাবাদি দক্ষতার সাথে পাঠদান করেন। ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত সপ্তাহে দু’দিন ফুলতলী আলিয়া মাদরাসায় কামিল জামাতে বুখারী শরীফের দারস দিতেন। তাঁর দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে পয়গামে ইলাহী ও তা’লীমে নববীর অমিয় সুধা পানে আলোকপ্রাপ্ত হয়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী।
হাদীস শরীফের সনদ প্রদান
হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) দীর্ঘ প্রায় পৌনে একশতাব্দী ইলমে হাদীসের খিদমত করেছেন। বদরপুর আলিয়া মাদরাসা থেকে শুরু হওয়া খিদমতের ধারা ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তাঁর নিকট হাদীসের দারস গ্রহণকারী কতিপয়কে ২৭ এপ্রিল ২০০৬ তারিখে একটি সুন্দর মাহফিলের মাধ্যমে হাদীস শরীফের সনদ প্রদান করা হয়। শুধু নির্বাচিত আবেদনকারীগণই সনদ লাভ করেন। এ উপলক্ষে হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর নিকট থেকে হাদীস শরীফের সনদ গ্রহণকারী শাগরিদবৃন্দের পক্ষ থেকে ‘রাহী মদীনা’ নামে একটি স্মারকও প্রকাশিত হয়। স্মারকটিতে সনদ গ্রহণকারীদের তালিকাতে ৮১৬ জনের নাম, ঠিকানা ও কামিল পাশের সন ছাপা হয়েছে। অবশ্য এর বাইরেও আল্লামা ফুলতলী (র.)-এর বহু সংখ্যক শাগরিদ রয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই তাঁর পূর্বে ইন্তিকাল করেছেন। অনেকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদন করতে সক্ষম হননি। তাছাড়া বিদেশে অবস্থানসহ নানা কারণে অনেক শাগরিদ এখানে তালিকাভুক্তও হতে পারেননি।
ইলমে কিরাতের খিদমত
হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ ভারতের উত্তর প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী রামপুর আলিয়া মাদরাসা থেকে তাফসীর, হাদীস ও ফিক্হ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করে যখন ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ (বর্তমানে জেলা)-এর বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতায় নিয়োজিত, তখন তাঁর মুরশিদ হযরত মাওলানা আবূ ইউসূফ শাহ মোহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (র.) তাঁকে বিশুদ্ধ কিরাত শিক্ষার ব্যাপারে বিশেষ তাকীদ প্রদান করেন। বদরপুরী (র.)-এর তাকীদের ব্যাপারে হযরত ফুলতলী (র.)-এর নিজের ভাষ্য নিম্নরূপ :
“সে সময় উলামায়ে কিরামের ধারণা ছিল যে, ‘আমার কিরাত বিশুদ্ধ।’ কিন্তু বদরপুরী ছাহেব কিবলাহ আমাকে সময় সময় বলতেন, ‘তোমার কিরাত কিছুটা অশুদ্ধ।’ একদিন বললেন, ‘তোমার কিরাত বিশুদ্ধ করে নিলে ভবিষ্যতে ভালো হতো।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার নিকট থেকে কুরআন শরীফ গিয়ে শুদ্ধ করব?’ উত্তরে বললেন, ভোগা নিবাসী মাওলানা আব্দুর রউফ করমপুরী ছাহেবের নিকট গিয়ে কুরআন শরীফ শুদ্ধ করে নাও।”
মুরশিদের নির্দেশ পেয়ে তিনি প্রথমে বিশ্ববিখ্যাত কারী হযরত ইরকসূস মিসরী (র.)-এর অন্যতম শাগরিদ হযরত মাওলানা হাফিয আব্দুর রউফ করমপুরী (র.) ও পরবর্তীতে মক্কা শরীফের ইমামগণের পরীক্ষক, মিসরীয় বংশোদ্ভূত, রঈসুল কুররা হযরত আহমদ হিজাযী (র.)-এর নিকট কিরাতের শিক্ষা গ্রহণ করেন।
আল-কুরআনুল কারীম তারতীলের সাথে (শুদ্ধ পঠনপ্রণালী অনুযায়ী) তিলাওয়াতের শিক্ষা বিস্তার হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর অন্যতম প্রধান খিদমত। স্বপ্নে রাসূলে পাক (সা.)-এর ইঙ্গিতেই এ খিদমত শুরু হয়। ঘটনাটি নিম্নরূপ :
হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) মক্কা শরীফ হতে ফিরে পুনরায় যথারীতি বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষাদান শুরু করেন। একদিন হযরত ছাহেব কিবলাহ ক্লাসে ছাত্রদের দারস দেয়ার সময় সেখানে হযরত আবদুন নূর গড়কাপনী (র.) তাশরীফ নিলেন। সমকালীন খ্যাতনামা আলিম ও বুুযুর্গ ছিলেন তিনি। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তাঁকে সমাদরে পাশে বসতে অনুরোধ করে পাঠদানে ব্যস্ত হলেন। ক্লাসের সময় শেষ হলে ছাহেব কিবলাহ তাঁর কুশলাদি ও আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, সর্বসাধারণ তো দূরের কথা এতদঞ্চলের বেশ কিছু সংখ্যক আলিমেরও কিরাত শুদ্ধ নয়। তাই ছাহেব কিবলাহ দারসে কিরাতের জন্য অন্তত সপ্তাহে ঘন্টাখানেক সময় যেন দেন আমাদের। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ জবাবে বললেন, আমার হাতে সময় একেবারে কম, বিশেষ করে ক্লাসে ছাত্রদের পাঠদানের আগে নিজে ভালোভাবে তা দেখে নিতে হয়, তাই সময় দেয়া মোটেই সম্ভব নয়। একথার পর আবদুন নূর ছাহেব চলে গেলেন।
পরদিন ঠিক একইভাবে উপস্থিত হয়ে এ কথারই পুনরাবৃত্তি করলে ছাহেব কিবলাহ আবারও অপারগতা প্রকাশ করলেন। তখন হযরত আবদুন নূর (র.) বললেন, আমি নিজে থেকে আপনার নিকট আসিনি। বড় জায়গা থেকে নির্দেশ পেয়েই তবে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তখন স্বীয় মুরশিদ হযরত বদরপুরী (র.)-এর নির্দেশ কিনা জানতে চাইলে হযরত আবদুন নূর (র.) বললেন, না আরো বড় জায়গা থেকে নির্দেশ পেয়েছি। ছাহেব কিবলাহর অনুরোধে তিনি বর্ণনা করলেন, ‘স্বপ্নে হুযূর (সা.) কে দেখা গেল। আরয করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, কুরআন শরীফের তিলাওয়াত শুনতে চাই। রাসূল (সা.) তিলাওয়াত করে শুনালেন। আরয করলাম, এই কিরাত কিভাবে শিখব? তখন নবী করীম (সা.) ডান দিকে ইশারা করলেন। সেদিকে চেয়ে দেখা গেল, সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি আপনি।’ একথা শুনার সাথে সাথে হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ কেঁদে ফেললেন এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার ১২টার পরে নিকটবর্তী হযরত আদম খাকী (র.) (৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম)-এর মাযার সংলগ্ন মসজিদে কিরাতের দারস দেয়ার ওয়াদা দিলাম।’ এভাবেই ছাহেব কিবলাহর ইলমে কিরাতের খিদমতের সূত্রপাত। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে পায়ে হেটে, ঘোড়ায় চড়ে, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অবৈতনিকভাবে কিরাতের দারস দিয়েছেন।৫
১৯৫০ ইংরেজি সনে ছাহেব কিবলাহ নিজ বাড়িতে ইলমে কিরাতের দারস প্রথম চালু করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষকদের সুবিধার্থে ছুটির অবসরকালীন রামাদান মাসকে কিরাত শিক্ষার জন্য বেছে নেন তিনি। তাছাড়া রামাদান মাস হলো নুযূলে কুরআনের মাস।
প্রতি বছর রামাদানে ছাহেব কিবলাহ নিজ বাড়িতে শিক্ষার্থীদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নিজ খরচে বহন করতে থাকেন। দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি সবাইকে তা’লীম দিয়ে এবং সমগ্র কুরআন শরীফ নিজে শুনে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে তবেই সনদ প্রদান করতেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় অন্যান্য স্থানে শাখাকেন্দ্র অনুমোদন ও একটি বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই ৭ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের সদস্যদের অনুরোধক্রমে ছাহেব কিবলাহ’র ওয়ালিদ মুহতারাম হযরত মাওলানা মুফতী আবদুল মজীদ চৌধুরী (র.)-এর নামানুসারে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’। ছাহেব কিবলাহ তাঁর ভূ-সম্পত্তির বিশাল অংশ (প্রায় ৩৩ একর) এই ট্রাস্টের নামে ওয়াকফ করে দিয়েছেন। বর্তমানে এই বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় দেড় সহস্রাধিক শাখা কেন্দ্র দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে।
ইলমে কিরাতের সনদ প্রদান
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর কাছ থেকে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কত মানুষ ইলমে কিরাতের শিক্ষা লাভ করেছেন তার সঠিক হিসাব প্রদান দুঃসাধ্য। ছাহেব কিবলাহর নিকট যাঁরা কিরাত পাঠ করেছেন তাঁদের সবাইকে ‘ছাদিছ’ পাশের সার্টিফিকেট ট্রাস্টের মাধ্যমে দেয়া হয়। মাঝে মাঝে বিশেষ প্রয়োজনে কেউ কেউ কিরাতের ‘সনদ’ও লাভ করেন। তবে উত্তীর্ণ প্রত্যেক কারী ছাহেবের আকাক্সক্ষা ছিল, ছাহেব কিবলাহর হাতে সনদ গ্রহণ করবেন। দীর্ঘ কাল পরিক্রমায় এ আকাক্সক্ষা বাস্তবরূপ লাভ করে ৩১ মার্চ ২০০২ সালে (১৬ মহররম, ১৪২৩)। এদিন প্রায় ৪০০০ কারী ছাহেবকে সনদ ও পাগড়ী প্রদান করা হয়। ১৯৫০-২০০২ পর্যন্ত উত্তীর্ণ কারী ছাহেবদের মধ্যে নির্দিষ্ট শর্তের ভিত্তিতে (৩য় বিভাগ ব্যতীত) প্রায় চার হাজার কারী ছাহেব সনদ ও পাগড়ী লাভ করেন। নানা কারণে বহু সংখ্যক কারী ছাহেব তালিকাভুক্ত হতে পারেননি। এ উপলক্ষে দৈনিক ইনকিলাবে বিশেষ ক্রোড়পত্রও ছাপা হয়। সেখানে বাংলাদেশের তৎকালীন মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও কয়েকজন মন্ত্রীর বাণী স্থান পায়।৬
দালাইলুল খায়রাত-এর সনদ প্রদান
হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দুরূদ পাঠের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন। তাঁর কাছে কেউ বায়আত গ্রহণ করলে তিনি প্রথমেই যে সকল সবক দিতেন তার মধ্যে প্রতিদিন দুইশত বার দুরূদ শরীফ পাঠের কথা বলতেন। সম্ভব হলে আরো বেশি দুরূদ শরীফ পাঠের তাকীদ দিতেন। যারা তরীকতের সবকের দিকে কিছুটা অগ্রসর, বিশেষ করে আলিম মুরীদগণকে তিনি দুরূদ শরীফের মকবূল ওযীফা দালাইলুল খায়রাত পাঠের অনুমতি দিতেন।
ছাহেব কিবলাহ দালাইলুল খায়রাত পাঠের জন্য মৌখিক অনুমতি দিয়ে আসছিলেন। আশির দশকের প্রথম দিকে ইজাযতপ্রাপ্তদের মাঝে প্রথম সনদ প্রদান করা হয়। সে সময় সনদে শুধু ছাহেব কিবলাহর হাদীসের উস্তায খলীলুল্লাহ রামপুরী (র.)-এর সিলসিলার উল্লেখ ছিল। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক খানকার সময় পূর্বোক্ত সিলসিলার সাথে তাঁর মুরশিদ হযরত বদরপুরী (র.)-এর সিলসিলা যুক্ত করে সনদ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এ উপলক্ষে খানকা-ই-লতিফিয়ার পক্ষ হতে ‘মদীনার রাহগীর’ নামে একখানা স্মারকও বের হয়। উক্ত স্মারকে সনদ গ্রহণকারী ২৮৮ জনের একটি তালিকা প্রদত্ত হয়েছে। অবশ্য এই তালিকায় উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গের বাইরেও সনদপ্রাপ্ত অনেক রয়েছেন। উক্ত স্মারকের প্রকাশক বড় ছাহেবজাদা আল্লামা মোঃ ইমাদ উদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্য থেকেও তা অনুমিত হয়। তিনি তাঁর ‘গুজারিশ’-এ লিখেছেন, “যোগাযোগের অসুবিধায় দেশে বিদেশে অবস্থানকারী সকল ইজাযতপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণকে আহুত মাহফিলে সনদ দেয়া সম্ভবপর হয় নাই। অনেকেই বাদ পড়িয়া গেলেন। ইনশাআল্লাহ তাহারা পর্যায়ক্রমে ছাহেব কিবলাহ’র হাত মোবারক হইতে যাহাতে সনদ হাসিল করিতে পারেন তাহার ব্যবস্থা করা হইবে”।৭
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর দালাইলুল খায়রাত-এর সনদ নিম্নরূপ:
আল্লামা মোঃ আব্দুল লতিফ চৌধুরী> মাওলানা শাহ আবূ ইউসূফ মোহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (র.) > শাহ আবূ আলী মুহাম্মদ আব্দুল ওয়াহ্হাব হানাফী কাদিরী চিশ্তী সিলেটী (র.) > শাহ মুহাম্মদ ইরশাদ হুসায়ন রামপুরী (র.) > সায়্যিদ আহমদ সাঈদ দেহলভী (র.) > শায়খ সায়্যিদ আবূ সাঈদ (র.) > শায়খ আহমদ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) > শায়খ আবূ তাহির আল মাদানী (র.) > শায়খ আহমদ আন্ নাখলী আবদ (র.) > সায়্যিদ আবদুর রহমান আল ইদরিসী (র.) > সায়্যিদ আহমদ (র.) > সাইয়্যিদ মুহাম্মদ (র.) > আহমদ (র.) > দালাইলুল খায়রাতের গ্রন্থকার সায়্যিদ মুহাম্মদ বিন সুলায়মান আল জাযূুলী (র.)।
দ্বিতীয় সিলসিলা হচ্ছে-
শায়খ মাওলানা খলীলুল্লাহ রামপুরী (র.) > মাওলানা আবুল মনসুর মনোওর আলী নকশবন্দী রামপুরী (র.) > শায়খ মাওলানা মা’সূম আল মুজাদ্দিদী আল মাদানী (র.) > শায়খুদ্দালাইল আরিফ বিল্লাহ আলী বিন ইউসূফ মালিক আল বাশিলী আল মাদানী (র.) > সাইয়্যিদ আহমদ মুজগিরী (র.) > আবুল বারাকাত আল উযমা মোহাম্মদ ইবন আহমদ বিন আহমদ আল মূসান্না (র.) > আহমদ বিন আল হাজ্জ (র.) > শায়খ আহমদ আল মুকরী > শায়খ আব্দুল কাদির আল ফাসী > শায়খ আহমদ বিন আহমদ বিন আবুল আব্বাস সামঈ (র.) > শায়খ আস সামলালী (র.) > শায়খ আবদুল আযীয আত্তাব্বা (র.) > দালাইলুল খায়রাতের গ্রন্থকার আবূ আবদুল্লাহ সায়্যিদ মুহাম্মদ বিন সুলায়মান আল জাযূলী আশ শরীফ আল হাসানী (র.)।৮
অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
হযরত আল্লামা ফুলতলী (র.)-এর জীবন ছিল বহু গুণের আধার। তাঁর মধ্যে এমন সব গুণের সমাহার ঘটেছিল যার কোনো একটিই মানুষকে আলোকিত করতে পারে। তিনি ছিলেন সুন্নাতে রাসূলের পরিপূর্ণ অনুসারী। তাঁর কথা, কাজ, চলাফেরা, আচার-ব্যবহার সব কিছুতেই ছিল সুন্নাতে নববীর যথাযথ অনুসরণ।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ছিলেন লাখো মানুষের রূহানী অভিভাবক। কত মানুষ কত বিষয় নিয়েই না তাঁর খিদমতে হাজির হতো। তিনি সপ্তাহের ৫ দিনই বাইরে কাটাতেন দাওয়াতী কার্যক্রমে। বাড়িতে তাশরীফ রাখতেন দু’দিনÑশনি ও রবিবার। তারপরও তিনি পরিবারের মানুষকে পর্যাপ্ত সময় দিতেন। তাদের প্রয়োজনের প্রতি খেয়াল রাখতেন। মমতার সুশীতল ছায়া দিয়ে রাখতেন তিনি তাঁর পরিবারকে।
দীন ইসলামের এক মর্দে মুজাহিদ ছিলেন হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)। দীনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপসহীন। দীনের প্রতি কোনো আঘাত আসলে তিনি কখনো নীরব থাকতেন না। অমিত সাহস বুকে নিয়ে বজ্রকণ্ঠে এর প্রতিবাদ করতেন। যখনই দেশীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলাম ও মুসলমানের উপর কোনো আঘাত আসতো, তিনি এর প্রতিবাদে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে দীনের স্বকীয়তা রক্ষার আন্দোলনে তিনি সিপাহ্সালারের ভূমিকা পালন করেছেন। এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ-ভারতের আসাম অঞ্চলে ইসলামী শিক্ষার স্বকীয়তা রক্ষার আন্দোলন, পাকিস্তান আমলে ফজলুর রহমান বিরোধী আন্দোলন, বাংলাদেশ আমলে তাসলিমা নাসরিন বিরোধী আন্দোলন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ বিরোধী আন্দোলন, আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
তিনি আলিম-উলামাকে সমাজের সর্বোচ্চ সম্মানিত মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতেন। মানুষ আলিমদের সম্মান করুক, এটা তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন। সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর ছাত্র ও মুরীদগণকে এমনভাবে সমাজে উপস্থাপন করতেন, কেউ ধারণাও করতে পারতো না যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তাঁর ছাত্র বা মুরীদ। তিনি তাঁর ছাত্র-মুরীদগণকে এমন সম্মানজনক শব্দ প্রয়োগে আহ্বান জানাতেন যে তারা নিজেরাও লজ্জায় পড়ে যেতেন।
শুধু নিজের ছাত্র বা মুরীদদের নয়; বরং অন্য ধারার কোনো আলিম বা ভিন্ন সিলসিলার কোনো বুযুর্গ এলে তিনি তাঁদের আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাতেন, ইয্যত-সম্মান দান করতেন এবং তাঁদের যথাযথ খিদমতের ব্যবস্থা করতেন।
হযরত ছাহেব কিবলাহ (র.) ছিলেন প্রিয়নবী (সা.)-এর ভালোবাসায় সিক্ত কামিল মনীষী। প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রতি তাঁর হৃদয়ের টান ছিল অত্যন্ত সুগভীর। তাঁর আলাপচারিতায়, ওয়াযে, দারসে, দু‘আয়, কান্নায় ও কবিতায় এর বহিপ্রকাশ ঘটত। তিনি ওয়াযে বেশির ভাগ সময়ই সায়্যিদুল মুরসালীন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শান-মর্যাদা, তাঁর মাধ্যমে জগৎবাসীর উপকৃত হওয়া, তাঁকে ভালোবাসার ইহ-পারলৌকিক ফায়দা ইত্যাদি বর্ণনা করতেন।
প্রিয়নবী (সা.)-এর প্রতি তাঁর অনুপম মহব্বতের উজ্জ্বল নিদর্শন হচ্ছে তাঁর রচিত অমর কাব্যগ্রন্থ ‘না’লায়ে কলন্দর’। না’লায়ে কলন্দরে রাসূলে পাক (সা.)-এর প্রতি তাঁর ভালোবাসার নমুনা আমরা পাই তাঁর নিম্নোক্ত কবিতায়:
নবীজীর পদধূলি হোক সুরমা এই দু’চোখে
মনের যতো কালিমা ঘুচুক যিয়ারত আলোকে।৯
নবী করীম (সা.)-এর সাথে সম্পর্কিত কিছু পেলেও তিনি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করতেন। বিশেষত সায়্যিদগণের সাথে তাঁর আচরণ ছিল নযীরবিহীন। এমনকি তাঁর নিজ আত্মীয়দের মধ্যে যাঁরা সায়্যিদ তাঁদের শিশু সন্তানদেরও তিনি আলাদাভাবে মর্যাদা দিতেন। তাঁদের ওসীলা নিয়ে দু‘আ করতেন।
মদীনার মাটি, ধূলো-বালিকেও তিনি সম্মানের চোখে দেখতেন। তাঁর কবিতায় এসেছে :
বিশ্বভুবন থেকে প্রিয় খাক মদীনার
সে খাক তরে ফিদা যেথায় পিয়ারা খোদার।১০
প্রিয়নবী (সা.)-এর ভালোবাসার প্রতিদানও তিনি ইহজগতে পেয়েছেন বহু ভাবে। স্বপ্নে প্রিয়নবী (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়েছেন বহুবার। একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা : তিনি কারাবন্দী থাকাবস্থায় প্রিয়নবী (সা.)-এর জীবনী রচনার মনস্থ করেন। এ ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন যে কী পদ্ধতিতে লেখা শুরু করবেন, ইতিহাসের না সীরাতের পদ্ধতি অবলম্বন করবেন। এসময় তিনি স্বপ্নযোগে প্রিয়নবী (সা.)-এর দর্শন লাভে ধন্য হলেন। নবীজী তাঁকে সীরাত পদ্ধতি অবলম্বনের নির্দেশ দিয়ে টেবিলে রাখা সাদা কাগজে একটি রেখা টানলেন। জেগে স্বপ্নে দর্শনমতো টেবিলে রাখা কাগজে দাগ দেয়া ও কলম খোলা অবস্থায় পেলেন তিনি (সুবহানাল্লাহ!)। এ ঘটনা তিনি আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন। এর ইঙ্গিত তাঁর লিখিত সীরাত গ্রন্থ ‘মুনতাখাবুস সিয়র’-এর ভূমিকায় রয়েছে।
আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি বহুমাত্রিক বিশেষ দানে বিভূষিত ছিলেন। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা ও সাহস ছিল কিংবদন্তিতুল্য। মেহমান এলে তিনি নিজে তাদের মেহমানদারী করতেন। নিজের সন্তানদেরও তিনি মেহমানদারীর কাজে নিয়োজিত করতেন।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও নিরহংকারী। আবার সত্যের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অবিচল ও আপসহীন। কোথাও কোনো অন্যায় পরিলক্ষিত হলে বা শরীআতের বিধান লঙ্ঘিত হলে তিনি অত্যন্ত কঠোর হতেন। এ সকল ক্ষেত্রে আপন-পর ছিল তাঁর কাছে সমান। অতি নিকটজনও তাঁর কাছে কোনো অন্যায় আবদার করার সাহস করতেন না। কোনো অন্যায় করে পার পাবার কথাতো কল্পনাও করতে পারতেন না। মোটকথা তাঁর জীবন ছিল “আল হুব্বু ফিল্লাহ ওয়াল বুগদু ফিল্লাহ”-এর বাস্তব নমুনা।
কুরআন কারীমের শুদ্ধ পঠন বিস্তারে তাঁর ভূমিকা বিশ্ববিশ্রুত। কিরাত শিক্ষার জন্য তাঁর ত্যাগ অপরিমেয়। দারুল কিরাতের সূচনালগ্নে তিনি একাই পাঠদান করতেন তাঁর বাড়িতে জমায়েত হওয়া শিক্ষার্থীদের। তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করতেন তিনি। এমনকি অনেক সময় নিজ হাতেও রান্না করেছেন তিনি।
মানুষের হিদায়াতের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। আজীবন মানবতার হিদায়াতের জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ওয়াযের মাধ্যমে, তরীকতের বায়আতের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন। মানুষের আত্মসংশোধনের বিষয়কে তিনি খুবই গুরুত্ব দিতেন। চূড়ান্ত অসুস্থতার সময়ও কেউ বায়আত হতে চাইলে, তরীকতের সবক শুনাতে চাইলে তিনি তাদের বিমুখ করতেন না।
জীবনের শেষ বয়স পর্যন্ত তরীকতের ওযাইফ আদায়ের ব্যাপারে তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন। কুরআন তিলাওয়াত, দালাইলুল খায়রাত, হিযবুল বাহারসহ তরীকার কোনো ওযীফাই তিনি বাদ দিতেন না। সব সময়ই দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে থাকে বলে তাঁর তিলাওয়াত বেশিরভাগই হত গাড়ির মধ্যে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে গাড়িতে তিনি কখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন বা ঘুমাতেন না। এ সময়টাতেই তিনি তাঁর ওযাইফগুলো আদায় করতেন।
সামাজিক খিদমত
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) দীনী খিদমতে প্রাতিষ্ঠানিক কর্ম সম্পাদনে যেমন শীর্ষস্থানীয়, তেমনি সমাজসেবা তথা দেশ ও দশের খিদমতে তাঁর অবদান আদর্শস্থানীয়। তিনি নীরবে-নিভৃতে সারা জীবন খিদমতে খালক তথা সৃষ্টির সেবা করে গেছেন। তিনি প্রায়ই বলতেন :
তরীকত বজুয খিদমতে
খালকে নেসত
বসুজ্জাদা তাসবীহ ওয়া
দালকে নেসত।
তিনি মানব সেবাকে রাসূলে করীম (সা.)-এর সুন্নতের ধারা হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। অসহায় এতীম, মিসকীন, বিধবা, গৃহহীন, বস্ত্রহীন সবার দুঃখ-বেদনাকে আজীবন নিজের করে দেখেছেন। এতীমদের লালন পালন ও সুশিক্ষার জন্য তিনি গড়েছেন এতীমখানা। শত শত এতীমের অভিভাবকত্ব করে গেছেন ইন্তিকাল পর্যন্ত। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত এতীমখানায় হাজারেরও অধিক এতীম প্রতিপালিত হচ্ছে। গরীব-অসহায়দের চিকিৎসার সুবিধার্থে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা ও পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন বিনামূল্যে চিকিৎসা কেন্দ্র বা ডিসপেন্সারি। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় চালু হয়েছে লঙ্গরখানা, বিধবা ও পঙ্গু পুনর্বাসন কেন্দ্র, গৃহ নির্মাণ, টিউবওয়েল স্থাপন, বৃক্ষরোপণসহ নানা প্রকল্প। তাঁর বড় ছাহেবজাদা হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী শুরু থেকেই এসবের তত্ত্বাবধান করছেন।
শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবদান সুবিদিত ও সর্বমহলে প্রশংসিত। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে, মহাদেশের গ-ি পেরিয়ে তাঁর খিদমত ছড়িয়ে পড়েছে বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য মাদরাসা-মক্তব, পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন শত শত মানব কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের। গরীব ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তি প্রকল্প, নিজ খরচে শিক্ষাদান তথা বিনামূল্যে শিক্ষারও সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি।
সামাজিক শৃঙ্খলা ও মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় স্থানীয় বিচার-সালিসে ন্যায়বিচার পেতে লোকজন তাঁর দ্বারস্থ হতো। চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, অন্যায়-অত্যাচার এগুলোর বিরুদ্ধে তাঁর জোরালো ভূমিকায় সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তথা স্থানীয় হিন্দুরাও তাঁর ন্যায় বিচার, সামাজিক নিরাপত্তা ও সাহায্য-সহযোগিতায় উপকৃত হয়েছে।
তিনি গরীব ও অভাবী মানুষকে উদার হস্তে সাহায্য করতেন। বিপদের সময় তাঁদের পাশে দাঁড়াতেন। বিশেষ করে বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগে গরীবদের মাঝে চাল, ডাল, কাপড়সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বিতরণ করে কিছুটা হলেও মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করতেন। মাদরাসা, মক্তব, মসজিদ, স্কুল প্রতিষ্ঠা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ ইত্যাদিতেও জমি দান করে এলাকার উন্নয়নে তিনি সব সময় রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সময়ে সময়ে তাঁর সময়োপযোগী পদক্ষেপে বড় বড় সমস্যার সমাধান হয়েছে, সংকট বা সংঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছে মানুষের জান-মাল। তিনি সব সময়ই জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন।
কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে দীনী খিদমত আন্জাম দেয়ার লক্ষ্যে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন গড়ে তুলেছেন, পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন শত শত মসজিদ, মাদরাসা ও প্রতিষ্ঠানের। এসবের কয়েকটি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য এখানে উপস্থাপন করা হলো :
দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ১৯৫০ ইংরেজি সনে নিজ বাড়িতে ইলমে কিরাতের দারস প্রদান শুরু করেন। আল কুরআনুল কারীমের বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’ গঠন করেন। তাঁর সম্পত্তির এক বিশাল অংশ (প্রায় ৩৩ একর জমি) এ ট্রাস্টের জন্য ওয়াকফ করেছেন। এর অধীনে বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে বর্তমানে দেড় হাজারের বেশি শাখা-কেন্দ্র রয়েছে।
লতিফিয়া এতীমখানা
১৯৭২ সালে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) নিজ বাড়িতে একটি এতীমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে ছাহেব কিবলাহর নামে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘লতিফিয়া এতীমখানা’। বর্তমানে এখানে প্রায় এক হাজার এতীম অবস্থান করে এখন সুশিক্ষা গ্রহণ করছে।
বাদেদেওরাইল ফুলতলী আলিয়া মাদরাসা
এটি ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। শৈশবে আল্লামা ফুলতলী (র.) এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করেছেন। কর্মজীবনে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাথমিক স্তরের এ মাদরাসা ক্রমান্বয়ে কামিল পর্যায়ে উন্নীত হয়। বর্তমানে এ মাদরাসায় ফাযিল (বি.এ) অনার্সসহ কামিল স্তরে তাফসীর ও হাদীস বিভাগ চালু আছে।
হযরত শাহজালাল দারুচ্ছুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদরাসা
১৯৮৩ সালে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র সোবহানীঘাটে এ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এ মাদরাসায় দাখিল ও আলিম জামাতে বিজ্ঞান বিভাগ ও ফাযিল (বি.এ) অনার্সসহ কামিল জামাতে ফিকহ ও হাদীস বিভাগ চালু আছে।
লতিফিয়া কমপ্লেক্স
আল্লামা ফুলতলী (র.)-এর নির্দেশ ও সরাসরি সহযোগিতায় ফুলতলীতে ২০০২ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কমপ্লেক্সে তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে : ১. আল কুরআন মেমোরাইজিং সেন্টার ২. ফুলতলী ইসলামিক কিন্ডারগার্টেন ৩. ফুলতলী ইসলামিক প্রি ক্যাডেট একাডেমী।
বাংলাদেশ আন্জুমানে মাদারিছে আরাবিয়া
মাদরাসা শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ করে রাখার পাশাপাশি মাদরাসা শিক্ষার মান উন্নয়ন ও শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া আদায়ে সংঘবদ্ধ কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য ১৯৬৪ সালে আল্লামা ফুলতলী (র.) এ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা, বৃত্তিপ্রদান ইত্যাদি শিক্ষা উন্নয়নমূলক কাজের লক্ষ্যে এটি গঠিত হয়।
বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ
ব্যক্তি জীবনে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত ১৯৭৯ সালে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ সংগঠন ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) গৃহীত বিভিন্ন ঐতিহাসিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে এ সংগঠন।
লতিফিয়া কারী সোসাইটি
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) কেবল একজন শ্রেষ্ঠ আলিম ও বুযুর্গ ওলীআল্লাহ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বিশ্ববিখ্যাত কারীও। দরবারে রিসালাত থেকে ইশারা পেয়ে তিনি ইলমে কিরাত শিক্ষাদানে নিয়োজিত হন। অর্ধ শতাব্দিরও অধিক সময় ধরে ইলমে কিরাত শিক্ষাদানে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তিনি গড়ে তুলেছেন অনেক কিরাত শিক্ষাকেন্দ্র। বর্তমানে এর সংখ্যা দেড় সহস্রাধিক। তাঁর নিকট শিক্ষা গ্রহণ করে হাজার হাজার শিক্ষার্থী লাভ করেছে বিশুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াতের সর্বোচ্চ সনদ। এ সকল কারী ছাহেবকে সহীহ আকীদা-বিশ্বাসে একতাবদ্ধ করে রাখা এবং ইলমে কিরাতের এ খিদমত চালু রাখার জন্য তিনি গঠন করেন ‘লতিফিয়া কারী সোসাইটি বাংলাদেশ’।
বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া
ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে ছাত্রদের জীবন গঠনের লক্ষ্যে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ ১৯৮০ সালে ‘বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া’ নামে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। জন্মলগ্ন থেকে এ সংগঠন মুসলিম ছাত্র সমাজকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথে পরিচালিত করতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
ইয়াকুবিয়া হিফযুল কুরআন বোর্ড
হাফিযিয়া মাদরাসাগুলো সুন্দর ও সুচারু রূপে পরিচালনা করার লক্ষ্যে ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর নির্দেশে ‘ইয়াকুবিয়া হিফযুল কুরআন বোর্ড’ নামে একটি বোর্ড গঠন করা হয়। ইয়াকুবিয়া নাম গ্রহণ করা হয়েছে আল্লামা ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর মুরশিদ কুতবুল আউলিয়া হযরত মাওলানা আবূ ইউসুফ শাহ মোহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (র.)-এর নামানুসারে। এ বোর্ডের কার্যক্রম লতিফিয়া কারী সোসাইটির মাধ্যমে সমগ্র দেশে বিস্তৃত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ২২টি উপজেলার ৩০৪ টি মাদরাসা বোর্ডের অন্তর্র্ভুক্ত রয়েছে।
মুসলিম হ্যান্ডস বাংলাদেশ
এটি আর্ত-মানবতার সেবায় নিবেদিত প্রতিষ্ঠান। গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণ, এতীমদের বৃত্তি প্রদান, বৃক্ষরোপন, অন্ধ-আতুরদের সাহায্য প্রদান, নলকুপ স্থাপন, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে এ সংগঠন। এর অধীনে ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে একটি ডিসপেন্সারিও রয়েছে। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এ ছাড়াও আরো অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও এসবের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)।
যুক্তরাজ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর দীনী খিদমতের পরিধি বাংলাদেশ, ভারত তথা সমগ্র উপমহাদেশ ছাড়িয়ে সুদূর ইউরোপ, আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ইলমে কিরাত, ইলমে হাদীস, ইলমে তাসাওউফসহ সব ধরনের খিদমত পরিচালনার জন্য তিনি যুক্তরাজ্যে বহু সংখ্যক দীনী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) প্রতিষ্ঠিত এ সকল প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো।
দারুল হাদীস লতিফিয়া
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম ব্রিটেন সফরকালে সে দেশে অভিবাসী মুসলিম সমাজের ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিন্তা করে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হন। সেই বছরই পূর্ব লন্ডনের নিউ রোডের ভাড়া করা ঘরে ‘মাদ্রাসা-ই-দারুল কিরাত মাজিদিয়া’ নামে একটি মাদরাসা শুরু করেন। ১৯৮১ সালে ক্যানন স্ট্রীট রোড, লন্ডন ঊ-১-এর ফ্ল্যাট কিনে মাদরাসা স্থানান্তর করা হয়। তখনকার সময়ে লন্ডনে মসজিদ কেন্দ্রিক প্রাথমিক ইসলামী শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও তা ছিল অত্যন্ত অপ্রতুল। ২০০৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এখানেই এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি মক্তব ও প্রাইমারি ইসলামী শিক্ষার গ-ি পেরিয়ে সেকেন্ডারি স্কুল, কলেজ ও উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার পর্যায়ে উন্নীত হয়। ক্যানন স্ট্রীট রোডের মাদরাসা-ই-দারুল কিরাত মজিদিয়ায় কামিল (টাইটেল) ক্লাস পর্যন্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হলে ছাত্রদের স্থান সংকুলান অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই মাদ্রাসার জন্য বৃহত্তর পরিসরে ভবন ক্রয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ লক্ষ্যে বেথনাল গ্রীনে একটি ভবন কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে ছাহেব কিবলাহ নিজে লন্ডনে গিয়ে তহবিল সংগ্রহের ব্যবস্থা করে দেন। ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর শিক্ষক-ছাত্রদের সাথে নিয়ে বর্তমান ভবনটি তিনি উদ্বোধনও করেন। উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি তথা কামিল জামাত পর্যন্ত মাদ্রাসা উন্নীত হওয়ার কারণে নতুন আঙ্গিকে মাদরাসার কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় মাদ্রাসার নামকরণ করা হয় ‘দারুল হাদীস লতিফিয়া’। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ছিলেন এ মাদ্রাসার ট্রাস্টি বোর্ডের আজীবন চেয়ারম্যান। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানে পাঁচ শতাধিক ছাত্র ইসলামী শিক্ষায় অধ্যয়নরত। সেখানে রয়েছে ব্রিটেনের ন্যাশনাল কারিকুলাম ও ইসলামী শিক্ষার সুষম সমন্বয়, যা মুসলিম সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত বিনির্মাণে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। কামিল জামাত সমাপ্ত করে অনেক ছাত্র উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার জন্য মিশরের বিশ্ববিখ্যাত আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশীপ পেয়ে সেখানে অধ্যয়নের সুযোগ পাচ্ছেন। ইল্ম-আমল, তাহযীব-তামাদ্দুন এবং আদব-আখলাকের বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষণে আদর্শ মুসলিম গঠনের প্রত্যয় নিয়ে দারুল হাদীস লাতিফিয়া তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
আনজুমানে আল ইসলাহ ইউকে
ইংল্যান্ডে অবস্থানরত মুসলিম সমাজকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা-আদর্শের উপর টিকিয়ে রাখা ও দীনী খিদমত আনজাম দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) তাঁর প্রথম ব্রিটেন সফরকালে গঠন করেন আনজুমানে আল ইসলাহ ইউকে। বর্তমানে ইংল্যান্ডের প্রত্যেকটি বড় নগরে আনজুমানে আল ইসলাহ’র শাখা রয়েছে। প্রবাস জীবনে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সঠিক আকীদা-বিশ্বাস প্রচার ও প্রসারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি এ সংগঠন বাংলাদেশের আর্ত-মানবতার সেবায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে থাকে।
লতিফিয়া উলামা সোসাইটি ইউকে
ব্রিটেনে বসবাসরত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উলামায়ে কিরামের একতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে দীনী খিদমত আনজাম দেয়ার মহান লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮৭ সালের নভেম্বর মাসে হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) প্রতিষ্ঠা করেন ‘আল ইসলাহ উলামা সোসাইটি ইউকে’। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ সংগঠনটি ব্রিটেনে বসবাসরত মুসলিম সমাজকে দিক-নির্দেশনা দানের নিমিত্ত বিভিন্ন মাহফিল আয়োজনসহ নানামুখী কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর ইন্তিকাল পরবর্তী সময়ে এ সংগঠনের নামকরণ করা হয় ‘লতিফিয়া উলামা সোসাইটি ইউকে’।
লতিফিয়া কারী সোসাইটি ইউকে
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর নিকট থেকে ইলমে কিরাতের সনদগ্রহণকারী ব্রিটেন প্রবাসীদের ঐক্যবদ্ধ রেখে তাদের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের মধ্যে ইলমে কিরাতের খিদমত জারি রাখার লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘লতিফিয়া কারী সোসাইটি ইউকে’। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ সংগঠনটি ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত কিরাত শিক্ষকেন্দ্রগুলোকে তত্ত্বাবধান ও সহযোগিতা করে আসছে।
আল ইসলাহ ইয়ুথ ফোরাম
ব্রিটেনের তরুণ ও যুব সমাজকে সঠিক ইসলামী চিন্তা-চেতনায় উজ্জীবিত করে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) গঠন করেন ‘আল ইসলাহ ইয়ুথ ফোরাম ইউকে’।
কিরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর নির্দেশনায় এবং তাঁর নিকট থেকে কিরাতের সনদপ্রাপ্ত কারী ছাহেবগণের পরিচালনায় ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষাদানের নিমিত্ত গড়ে উঠেছে অনেক কিরাত প্রশিক্ষণকেন্দ্র। দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্টের সিলেবাস অনুসরণে এ সকল কেন্দ্রে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দেয়া হয়। স্কুল-কলেজের ছুটির সময়ে ছোট ছেলে-মেয়ে থেকে নিয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও এ কিরাত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। লন্ডন, ম্যানচেস্টার, বার্মিংহাম, লুটন, টিপটন, ওল্ডহাম, কভেন্ট্রিসহ বিভিন্ন শহরে এ সকল কিরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু রয়েছে।
আল মাজিদিয়া ইভিনিং মাদ্রাসা
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ইসলামী শিক্ষার নানাবিধ খিদমত আনজাম দিতে গঠন করেন ‘আল মাজিদিয়া ট্রাস্ট ইউকে’। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত কোমলমতি শিশুদের বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষাদানের পাশাপাশি দীনী প্রাথমিক শিক্ষায় পারদর্শী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ ট্রাস্টের অধীনে ‘আল মাজিদিয়া ইভিনিং মাদ্রাসা’ এবং ‘আল মাজিদিয়া উইকেন্ড ইভিনিং মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। লন্ডনস্থ দারুল হাদীস লাতিফিয়া, লাতিফিয়া গার্লস্ স্কুল ছাড়াও লন্ডনের বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসায় এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম রয়েছে।
লাতিফিয়া গার্লস স্কুল
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ব্রিটেনের মুসলিম ছেলেদের ইসলামী শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি মেয়েদেরও ইসলামী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে শেষবারের মত ব্রিটেন সফরকালে ক্যানন স্ট্রীট রোডে মাদরাসা-ই-দারুল কিরাত মাজিদিয়ার পুরাতন বিল্ডিংয়ে মেয়েদের জন্য একটি ইসলামী স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ অনুমোদন করেন। এ প্রতিষ্ঠানটি ‘লাতিফিয়া গার্লস্ স্কুল’ নামে ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। ব্রিটেনের ন্যাশনাল কারিকুলাম ও ইসলামী শিক্ষার সমন্বয়ে গঠিত সিলেবাস এ স্কুলকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টম-িত করেছে।
মসজিদ-মাদ্রাসা
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর নির্দেশ, তত্ত্বাবধান, পৃষ্ঠপোষকতা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা এবং তাঁর মুরীদীন-মুহিব্বীনের উদ্যোগে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে গড়ে উঠেছে অনেক মাদ্রাসা, মক্তব, মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার। কোনো শহরে মসজিদ, মক্তব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের সংবাদ শুনলেই হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) স্বয়ং উপস্থিত থেকে তহবিল সংগ্রহ করেছেন, উদ্যোক্তাদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর উৎসাহ-অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতার মাধ্যমে গড়ে উঠেছে ওল্ডহ্যাম জালালিয়া মাদ্রাসা, লাতিফিয়া একাডেমী ওল্ডহ্যাম। সর্বশেষ ২০০৭ সালে ব্রিটেন সফরকালে তিনি ওল্ডহ্যামে একটি পূর্ণাঙ্গ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ অনুমোদন করেন। তাঁর দু‘আ, ইজাযত ও সহযোগিতায় লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, কার্ডিফ, টিপটন, ওয়ালসল, ওল্ডহ্যাম, লুটনসহ সমগ্র ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অনেক মসজিদ, মাদরাসা, মক্তব ও ইসলামিক সেন্টার।
তাঁর ইন্তিকাল পরবর্তী সময়ে তাঁর সুযোগ্য সন্তান ও শাগরিদগণ তাঁর এ সকল খিদমতের ধারাবাহিকতা রক্ষায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, প্রতিষ্ঠা করছেন নতুন নতুন মাদ্রাসা, মসজিদ, মক্তব ও ইসলামিক সেন্টার।১২
আমেরিকায় আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর খিদমত
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান শহরে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় আল-ইসলাহ ইসলামিক সেন্টার। তিনি ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের চীফ প্রেট্রন। এ প্রতিষ্ঠানের অধীনে আল ইসলাহ মসজিদ নামে একটি ঐতিহাসিক মসজিদও মাদরাসা রয়েছে। আমেরিকার এ মসজিদে মাইকে আযান দেয়া হয়ে থাকে। ভোটা-ভোটি ও আদালতের রায়ের মাধ্যমে মসজিদটি প্রকাশ্যে আযানের অনুমতি লাভ করে। ২০০১ সালে তাঁর দু‘আ ও নির্দেশনায় নিউইয়র্ক সিটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় নিউইয়র্ক হাফিযিয়া মাদরাসা। পরবর্তীতে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় নিউইয়র্ক সুন্নিয়া হাফিযিয়া মাদরাসা। ২০০৯ সালে আমেরিকার নিউজার্সি শহরে শুরু হয়েছে শাহজালাল লতিফিয়া মাদরাসা। এ ছাড়া ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর মুরিদীন, মুহিব্বীন তাঁরই দু‘আ ও ইজাযতে আমেরিকায় অনেক মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ভারতে খিদমত
ভারতেও আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর বহুবিধ দীনী খিদমতের ধারা চালু রয়েছে। তাঁর কর্মজীবনের সূচনাও ভারতেই (বদরপুরে)। জীবনের প্রথম দিকে তিনি তাঁর মুরশিদ হযরত আবূ ইউসুফ শাহ মোঃ ইয়াকুব বদরপুরী (র.)-এর প্রতিষ্ঠিত বদরপুর সিনিয়র মাদরাসায় শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ করেন। হাদীস শাস্ত্র পাঠদানের পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে একদিন বদরপুরের হযরত শাহ আদম খাকী (র.)-এর মোকাম (মাযার) সংলগ্ন মসজিদে বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষাদান করতেন।
ভারতের আসাম রাজ্যে দীনী শিক্ষাকে ধ্বংস করার জন্য যখন সরকারিভাবে মাদরাসা শিক্ষাকে সিভিল স্কুল বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, তখন ছাহেব কিবলাহ নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে দীনী শিক্ষার মান উন্নয়ন কল্পে পৃথক মাদরাসা বোর্ড স্থাপনের দাবি নিয়ে আন্দোলনের ডাক দেন। সে আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য ছাহেব কিবলাহ-এর প্রতি গুলির নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু উলামা সমাজ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সমর্থন ছাহেব কিবলাহ-এর এ আন্দোলনকে আরও জোরদার করে। ফলে তদানীন্তন আসামের প্রাদেশিক সরকার বাধ্য হয়ে তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুল মুতলিব মজুমদার সাহেবের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে। সেই কমিশনের সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ শামসুল হুদা সাহেব। এই কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৫৫ সালে আসামে পৃথক মাদরাসা বোর্ড স্থাপিত হয়। আজ পর্যন্ত এই মাদরাসা বোর্ড আসামে দীনী শিক্ষার উন্নয়ন, প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় সুদূর অতীত থেকে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে পবিত্র কুরআন শরীফের বিশুদ্ধ পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। পরবর্তীতে ছাহেব কিবলাহর অনুমতিক্রমে ‘লতিফিয়া দারুল কিরাত সমিতি’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়, যা প্রতি বছর রামাদান মাসে বিভিন্ন স্থানে দারুল কিরাতের শাখাকেন্দ্র স্থাপন করে দীনী খিদমত আনজাম দিচ্ছে।
পারিবারিক জীবন
পারিবারিক জীবনে তিনি ১৩৪৫ বাংলায় তাঁর পীর ও মুরশিদ হযরত মাওলানা আবূ ইউসুফ শাহ মোঃ ইয়াকুব বদরপুরী (র)-এর তৃতীয়া কন্যা মুহতারামা মুছাম্মত খাদিজা-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ তরফে চারজন ছাহেবজাদা ও তিন ছাহেবজাদী রয়েছেন। তাঁরা হলেন হযরত আল্লামা মোঃ ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী, হযরত আল্লামা মোঃ নজমুদ্দীন চৌধুরী, মোছাম্মত করিমুন্নেছা চৌধুরী, হযরত মাওলানা মোঃ শিহাবুদ্দীন চৌধুরী, মোছাম্মত মাহতাবুন্নেছা চৌধুরী, মোছাম্মত আফতাবুন্নেছা চৌধুরী, মুফতি মাওলানা মো: গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী। আল্লাহর রেযামন্দি তথা ইবাদত-বন্দেগীর এক পর্যায়ে বদরপুরী ছাহেব কিবলাহর এই ছাহেবজাদীর অন্তরে সংসারের প্রতি বিরাগ সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষিতে ছাহেব কিবলাহ তাঁর পীর ও মুরশিদ হযরত বদরপুরী (র)-এর নির্দেশে ফুলতলী গ্রামের মরহুম আব্দুর রশিদ খানের কন্যা মুহতারামা নেহারুন নেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ তরফে তিন জন ছাহেবজাদা রয়েছেন। তাঁরা হলেন- মাওলানা মুহাম্মদ কমরুদ্দীন চৌধুরী, হাফিয মাওলানা মুহাম্মদ ফখরুদ্দীন চৌধুরী ও মাওলানা মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী।
রচিত গ্রন্থাবলী
বহুমুখী ব্যস্ততার মধ্যেও আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) তাফসীর, কিরাত, সীরাত, তাসাওউফ ইত্যাদি বিষয়ে বেশ কয়েকখানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। নীচে তার রচিত গ্রন্থাবলীর পরিচিতি প্রদত্ত হলো।
১. আততানভীর আলাত তাফসীর
এটি পবিত্র কুরআনুল করীমের প্রথম দু’ পারার তাফসীর গ্রন্থ। উর্দু ভাষায় সংকলিত এ তাফসীর দু’খ-ে সমাপ্ত। ছোট ছাহেবজাদা মাওলানা মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী এটি অনুবাদ করেছেন।
২. মুন্তাখাবুস সিয়র
তিন খন্ডে প্রকাশিত সীরাতগ্রন্থ। এটি সীরাত বিষয়ে একখানা অনবদ্য কিতাব। এ গ্রন্থের প্রথম খন্ডের বঙ্গানুবাদক বড় ছাহেবজাদা মাওলানা মোঃ ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী। পরবর্তীতে এটি অনুবাদ করেছেন ছোট ছাহেবজাদা মাওলানা মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী।
৩. আনওয়ারুস সালিকীন
উর্দু ভাষায় লিখিত তাসাওউফ বিষয়ক গ্রন্থ। এর অনুবাদ করছেন বড় ছাহেবজাদা মাওলানা মোঃ ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী।
৪. আল খুতবাতুল ইয়াকুবিয়া
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা নির্ভর বার চাঁদের খুতবা। এর মূল আরবী ইবারতের সাথে বাংলা অনুবাদও রয়েছে। বাংলা অনুবাদ করেছেন এ.কে.এম ফজলুর রহমান মুন্সী।
৫. নালায়ে কলন্দর
হামদ, না’ত, মুনাজাত ও আধ্যাত্মিক বাণী ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ উর্দু গীতিকাব্য হলো নালায়ে কলন্দর। প্রথম অনুবাদ করেন কবি সৈয়দ শামসুল হুদা। পরবর্তীতে গীতিকবিতার আদল ঠিক রেখে এটি অনুবাদ করেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা কবি রূহুল আমীন খান।
৬. শাজারায়ে তায়্যিবাহ
ছাহেব কিবলাহর তরীকতের সিলসিলা পরিচিতি সম্বলিত বই। এটি উর্দু ভাষায় সংকলিত। এ বইটি বাংলায়ও অনূদিত হয়েছে।
৭. নেক আমল
দৈনন্দিন জীবনের আমলিয়াতের রূপরেখা সমৃদ্ধ একখানা পুস্তিকা।
৮. আল-কাউলুছ ছাদীদ
ইলমে তাজবীদ বিষয়ে উর্দু ভাষায় লিখিত অনন্য গ্রন্থ। এটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন বড় ছাহেবজাদা মাওলানা মোঃ ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী। এটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিভাগ ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া-এর আল কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে রেফারেন্সগ্রন্থ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত।
উল্লেখযোগ্য খলীফাবৃন্দ
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র) নবী করীম (সা.)-এর যথাযথ উত্তরাধিকারী হিসেবে ইলমে কিরাত, ইলমে হাদীসের খিদমতের পাশাপাশি তাযকিয়াতুন নফস বা ইলমে তাসাওউফের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। অগণিত মানুষ তাঁর হাতে বায়আত হয়ে আল্লাহপ্রাপ্তির পথে এগিয়ে গেছেন। তিনি ওয়ায, যিকিরের তা’লীম, খানকা মাহফিল ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষকে আত্মিক ও চারিত্রিক কলুষমুক্ত করার প্রয়াস নিয়েছেন। সিলেট নগরীর সোবহানীঘাটস্থ বাসায় প্রতি বৃহস্পতিবার বাদ মাগরিব, প্রতিমাসে নিজ বাড়ি ফুলতলীতে তিনদিন, বছরান্তে ফুলতলীতে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ খানকা-মাহফিল ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি তাযকিয়াতুন নফসের খিদমত চালিয়ে গেছেন। বিশেষ করে চিশতিয়া তরীকা ও হিযবুল বাহারের চিল্লার মাধ্যমে তরীকতের সালিকদের জীবনকে আল্লাহমুখী করার প্রচেষ্টাও চালিয়ে গেছেন তিনি। বর্তমান সময়ে তরীকতের এ ধারার চর্চা সাধারণত পরিলক্ষিত হয় না। তাঁর হাতে বায়আত হয়ে বহু মানুষ তরীকতের উচ্চ মাকাম লাভে সক্ষম হয়েছেন। অনেকে তাঁর কাছ থেকে বায়আতের ইজাযত লাভে ধন্য হয়েছেন। আমাদের জানামত তাঁর কয়েকজন উল্লেখযোগ্য খলীফার নাম নিচে প্রদত্ত হলোÑ
হযরত মাওলানা ইমাদ উদ্দীন চৌধুরী, ফুলতলী, জকিগঞ্জ, সিলেট।
হযরত মাওলানা সৈয়দ মুজিবুর রহমান, খান্দুরা হাবেলী, নাছিরনগর, বি.বাড়িয়া।
হযরত মাওলানা কাযী আজমান আলী (র.), ধরগাঁও, সদর, সিলেট।
হযরত মাওলানা হবিবুর রহমান, রারাই, জকিগঞ্জ, সিলেট।
হযরত মাওলানা নজমুদ্দীন চৌধুরী, ফুলতলী, জকিগঞ্জ, সিলেট।
হযরত মাওলানা সৈয়দ মস্তাক আহমদ মাদানী, উজানডিহি, করিমগঞ্জ, ভারত।
হযরত সৈয়দ জুনেদ আহমদ মাদানী, উজানডিহি, করিমগঞ্জ, ভারত।
হযরত মাওলানা আব্দুল জব্বার গোটারগামী (র.), জকিগঞ্জ, সিলেট।
হযরত মাওলানা গোলাম হুসাইন (র.), সৎপুর, বিশ্বনাথ, সিলেট।
হযরত মাওলানা আবুল ফজল ইর্শাদ হোসাইন গোয়াহরী (র.), বিশ্বনাথ, সিলেট।
হযরত মাওলানা মুফতী গিয়াসউদ্দীন চৌধুরী, ফুলতলী, জকিগঞ্জ, সিলেট।
হযরত মাওলানা আব্দুল মুকিত মঞ্জলালী (র.), মঞ্জলাল, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট।
দেওয়ান আব্দুল বছির (র.), ৩৪-ধানমন্ডি ঢাকা।
হযরত মাওলানা হাফিয নুরুল হক বিলপারী, নিজচৌকি, বিলপার, হবিগঞ্জ।
হযরত মাওলানা আব্দুর রহমান বর্ণী (র.), বিয়ানীবাজার, সিলেট।
হযরত মাওলানা ইছহাক আহমদ চৌধুরী (র.), বিশ্বনাথ, সিলেট।
হযরত মাওলানা উবায়দুল্লাহ (র.), নালুরচক, গঙ্গাজল, সিলেট।
হযরত মাওলানা মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী, দুবাগ, বিয়ানীবাজার, সিলেট।
হযরত মাওলানা মুফতি আলাউদ্দিন (র.), ঢাকা দক্ষিণ, গোলাপগঞ্জ।
হযরত মাওলানা আব্দুল লতিফ খাদিমানী (র.), জকিগঞ্জ, সিলেট।
হযরত মাওলানা কমরুদ্দীন চৌধুরী, ফুলতলী, জকিগঞ্জ, সিলেট।
হযরত মাওলানা আব্দুল কুদ্দুছ আমরুটী, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ।
হযরত মাওলানা আব্দুল মন্নান সূফীছাব (র.), বিয়াবাইল, জকিগঞ্জ,সিলেট।
হযরত মাওলানা শুয়াইবুর রহমান বালাউটি, জকিগঞ্জ, সিলেট।
হযরত মাওলানা মুফতি আব্দুল খালিক (র.), বিশ্বনাথ, সিলেট।
হযরত হাফিয আব্দুন নূর (র.), দিঘীরপার, কানাইঘাট, সিলেট।
হযরত মাওলানা আব্দুল বারী (র.), খরীলহাট, কানাইঘাট, সিলেট।
হযরত মাওলানা আব্দুন নূর, ঢাকা দক্ষিণ, গোলাপগঞ্জ।
হযরত মাওলানা রইছ উদ্দিন হামজাপুরী (র.), বিশ্বনাথ, সিলেট।
হযরত মাওলানা আব্দুল জব্বার, হাইলাকান্দি, ভারত।
হযরত মুফতি মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম (র.), সুদিয়াখলা, শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ।
হযরত মাওলানা আব্দুল কাইয়ূম সিদ্দীকী, মুড়াউল, বড়লেখা, মৌলভীবাজার।
হযরত মাওলানা আমিনুল বাহার জামালী (র.), চ-িনগর, বড়লেখা, মৌলভীবাজার।
হযরত মাওলানা কারী কুরবান আলী (র.), শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার।
হযরত মাওলানা সুলতান আহমদ (র.), নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ।
হযরত মাওলানা কাজী ওয়াহিদ উদ্দীন (র.), আকাখাজনা, বিয়ানীবাজার, সিলেট।
জনাব মোঃ বুরহান উদ্দিন শিকদার, শ্রীরামপুর, সদর, সিলেট।
হযরত মাওলানা রমিজউদ্দিন ভুট্টো (র.), বিয়ানীবাজার, সিলেট।
হযরত মাওলানা মুজিবুল হক, নোয়াখালী।
এডভোকেট আব্দুল বাছির চৌধুরী, ১২৩/১- ঝিগাতলা, ঢাকা।
হযরত কারী গিয়াস উদ্দিন, বড়দেশ, বিয়ানীবাজার, সিলেট।
হযরত মাওলানা মোঃ মোকাররম আলী, নিজ ঢাকাদক্ষিণ, গোলাপগঞ্জ, সিলেট।
মাস্টার আব্দুল মন্নান জমুনিয়া (র.), মৌলভীবাজার।
হযরত হাফিয মহসিন খান, উছলাপাড়া, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার।
হযরত মাওলানা কাযী আলাউদ্দিন আহমদ, সুন্দাদিল,মাধবপুর, হবিগঞ্জ।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর ওসিয়ত ও নসীহত
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) সারাজীবন ওয়ায নসীহত করে মানুষকে হিদায়াতের দিশা দিয়েছেন। তাঁর নসীহতের মাধ্যমে বহু মানুষ আলোর পথ পেয়েছে। এখানে কারী ছাহেবান, ওলামা-মুহাদ্দিসীন, মুরিদীন-মুহিব্বীনের উদ্দেশ্যে লিখিত আকারে তাঁর যে সকল নসীহত রয়েছে তা উল্লেখ করা হলো।
কারী ছাহেবগণের প্রতি নসীহত
ইলমে কিরাত কোনো সাধারণ বিষয় নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট হতে আল্লাহ তা‘আলার কালামে পাকের সহীহ শুদ্ধ পাঠ প্রক্রিয়া শিক্ষা করেছিলেন সাহাবায়ে কিরাম। বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের এই প্রক্রিয়া অব্যাহত ভাবে রক্ষা করেছেন আমাদের পূর্ববর্তী উস্তাদগণ। তাই ইলমে কিরাতের এই খোদায়ী আমানত আমার উস্তাদগণ যেভাবে আমার নিকট রেখে গেছেন, সেভাবে আমিও তা আপনাদের নিকট আমানত রাখলাম। সাবধান! এই আমানতের যেন বিন্দুমাত্র খেয়ানত না হয়।
সর্বাবস্থায় দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টিই যেন হয় আমাদের সকলের কাম্য। সহীহ কিরাত শিক্ষার পাশাপাশি আল কুরআনুল কারীমকে যথাযথ সম্মানপূর্বক শিক্ষার্থীদেরকে আপনাদের হাতে লাগানো বাগানের এক একটি মূল্যবান ফুল মনে করবেন।
সবক গ্রহণের সময় গভীর মনোযোগের সাথে শুনবেন এবং তালাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখবেন উচ্চারণ সঠিক হচ্ছে কি না। প্রয়োজনে নিজে বার বার পড়ে দেখাবেন। মনে রাখতে হবে, ভুল একদিনে সংশোধন হয় না।
নিজের গুণাবলীর প্রতি লক্ষ্য না রেখে সর্বাবস্থায় নিজের দোষ-ত্রুটির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। পড়ানোর সময় অনর্থক ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে সময় নষ্ট করা সবার জন্যই ক্ষতিকর। এ থেকে নিজেকে হেফাযত রাখবেন।
পাঠদানের সময় বিশেষ করে ‘তাজবীদ’ ক্লাসের আগে নিজে ভালোভাবে পড়ে নেবেন। অপেক্ষাকৃত ভালো কারীদেরকে পাঠদানে অগ্রাধিকার দেবেন। নিজের কোনো ভুল থেকে থাকলে সুযোগ পেলে নিজেও তাঁর নিকট থেকে তা সংশোধনের চেষ্টা করবেন।
কুরআন পাকের সম্মান ও খিদমতের জন্য নিরহংকারী হিসেবে নিজেকে সব সময় প্রকাশ করবেন। যে ক্লাস পর্যন্ত পড়ানোর অনুমতি রয়েছে সে ক্লাস পর্যন্তই পড়াবেন।
জামাতের সাথে নামায আদায় করবেন, ছাত্রদেরকেও জামাতে নামায আদায় করতে বাধ্য করবেন। নামায, রোযাসহ ফরয ইবাদত-বন্দেগী একাগ্রতা বা খুলুসিয়তের সাথে করবেন।
পাঠদানের সময় খেলাফে আদব কোনো কাজ করবেন না। সহকর্মীদের সাথে যথাসম্ভব সু-সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করবেন। জিহবা সংযত রাখলে আপনার পরকাল হবে সুখময়।
হাবীবে খোদার মহব্বতে নিজেকে বেঁধে রাখবেন। মনে রাখবেন, হুযূরে পাক (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা অন্তরে পোষণের মাধ্যমেই লাভ করা যায় ঈমান ও নাজাতের পথ।
যতদিন বেঁচে থাকবেন কোনো অবস্থায়ই যেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পথ ও পদ্ধতি থেকে সরে না যান। আমার উস্তাদ রঈছুল কুররা আহমাদ হিজাযী (র.) প্রায়ই বলতেন যে, যার মধ্যে সহীহ-শুদ্ধ কুরআন ও অন্তরে রাসূল (সা.)-এর মহব্বত রয়েছে, তার কখনো নিজেকে গরীব বা দুর্বল ভাবা উচিত নয়।
অদূর ভবিষ্যতে আমি যখন আপনাদের মাঝে থাকব না, তখন আপনাদের স্মরণ ও চোখের পানি যেন আমার নাজাতের পাথেয় হয়। আমি আপনাদের কত যে স্নেহ করি তা এ জীবনে প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই স্নেহ, এই ভালোবাসা যেন হাশরের সেই ভয়াল দিনে আমার সহায়ক হয়।
আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা যে শ্রম দিচ্ছেন তার প্রতিদান দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ পাকই দেবেন, যিনি তাঁর হাবীব (সা.)’র প্রতি এই কালাম নাযিল করেছেন। আপনাদের বিশ্বস্ত হাতে কালামে পাকের এই পবিত্র আমানত অর্পণ করলাম। আমি আপনাদের দু‘আ চাই। আল্লাহ তা‘আলা আপনাদের সহায় হোন। আমীন!১৩
উলামা-মুহাদ্দিসীনের প্রতি নসীহত
শরীআতের পূর্ণ অনুসরণে সর্বদা সচেষ্ট থাকিবেন।
সকল ক্ষেত্রে নবী করীম (সা.)- এর সুন্নাতের অনুসরণ একজন মুহাদ্দিসের জন্য অপরিহার্য। তাই এই বিষয়ে যতœবান হইবেন।
নিয়মিত তিলাওয়াতে কালামে পাক, দুরূদ শরীফ বিশেষত দালাইলুল খায়রাত পাঠের অভ্যাস করিবেন।
রিয়া, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, অহেতুক কথা-বার্তা, মন্দ ধারণা হইতে বাঁচিয়া থাকিবেন। কেননা এইগুলি মানুষকে ধ্বংস করিয়া দেয়।
যাহারা হাদীস শরীফের দরস দান করেন তাহাদের জন্য উচিত হাদীসের আদবের প্রতি অত্যন্ত সতর্ক থাকা। দরসের আগে নিজে ভালো ভাবে মুতালাআ করিবেন।
হাবীবে খোদার মহব্বতে নিজেকে বাঁধিয়া রাখিবেন। মনে রাখিবেন, হুযূরে পাক (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা অন্তরে পোষণের মাধ্যমেই লাভ করা যায় ঈমান ও নাজাতের পথ। সর্বাবস্থায়ই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা-বিশ্বাস ও পথ-পদ্ধতির উপর অটল থাকিবেন।
নবী করীম (সা.)-কে আল্লাহ তা‘আলা যে সকল বিষয় শিক্ষাদানের দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠাইয়াছিলেন তাহার মধ্যে অন্যতম হইল তাযকিয়ায়ে নাফস তথা আত্মার পরিশুদ্ধিতা। পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। তাই সকলকে হক সিলসিলার অন্তর্ভূক্ত হইয়া আত্মার পরিশুদ্ধিতা অর্জনের চেষ্টা করা প্রয়োজন।
হালাল রোজগারের চেষ্টা করিবেন। মানুষের মহতাজ থাকা আলিমগণের জন্য শোভনীয় নয়।
আমি যখন মাওলার দরবারে সমর্পিত হইব, আপনাদের মাঝে থাকিব না, তখন আপনাদের দু‘আ ও চোখের পানি আমার নাজাতের ওসীলা হইবে, ইহাই আমার আশা। এই অধমকে আপনাদের সকল দু‘আতে স্মরণ করিবেন।১৪
মুরীদীনের প্রতি নসীহত
তরীকতের পথিকদের উচিত শিরক ও বিদ‘আত থেকে পরিপূর্ণরূপে বেঁচে থাকা। ফরয-ওয়াজিব, হালাল-হারামের জ্ঞান থাকা সকলের উপর আবশ্যক। তাই তরীকতের পথে বিচরণকারীকে এ বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
পাঁচ ওয়াক্ত নামায হুযূরী কলবে এবং শান্তি মনে আদায় করবেন। কেননা নামায সকল ইবাদতের মূল।
জেনে রাখবেন, ইলমে তাসাওউফ ইলমে শরীয়তেরই অন্তর্ভুক্ত। তাই শরীয়তের অনুসরণ তথা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণ সর্বাধিক জরুরী।
জেনে রাখবেন, আল্লাহর স্মরণেই মন শান্তি পায়। এর মাধ্যমে মনে তাকওয়া সঞ্চারিত হয়। শয়তানের ওসওয়াসা থেকেও মন রক্ষা পায়। সুতরাং সর্বদা যিকরের হালতে থাকা খুবই জরুরী। বিশেষ করে সকল লতীফার যিকর সমূহের প্রতি খেয়াল রাখবেন।
শায়খের নিকট থেকে বায়‘আত গ্রহণের মুল উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র ইলমে তাসাওউফের জ্ঞান অর্জন নয়; বরং মূল উদ্দেশ্য হলোÑ আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন। সুতরাং নৈকট্য অর্জনের লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক মেহনত চালিয়ে যাবে। এটা যারা করবে না তারা আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হবে।
কূ-প্রবৃত্তি এবং অশোভন কাজ থেকে বিরত থাকবেন। লৌকিকতা, অহংকার, চোগলখুরী, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ, লোভ, অনর্থক কথা-বার্তা এবং খারাপ ধারণা পোষণ থেকে বিরত থাকবেন। কেননা এসবই ধ্বংসাত্মক কর্মের অন্তর্গত।
প্রতিদিন নিয়মিত তরীকতের সবক আদায় ও মুরাকাবা মুশাহাদা করবেন এবং ওযীফা পাঠ করবেন।
সালিকের উচিত তাঁর অন্য ভাইয়ের কল্যাণ সাধনে প্রচেষ্টা চালানো, অন্যের আনন্দে আনন্দিত হওয়া এবং অন্যের ব্যাথায় ব্যথিত হওয়া। কম খাওয়া, কম ঘুমানো ইবাদাতের সহায়ক। সুতরাং সালিকের এ বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত।
সালিকের উচিত সায়্যিদুল কাউনাইন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর তরীকা অনুযায়ী সর্বক্ষণ প্রতিটি মুহূর্তে আমলের প্রচেষ্টা চালানো।
তারতীলের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করা একটি দৈনন্দিন আবশ্যকীয় কাজ। এ ছাড়া নামায বিশুদ্ধ হয় এ পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা করা প্রতিটি মুসলমানের উপর ওয়াজিব।
হালাল রিযিকের নিমিত্ত প্রয়াস চালানো সালিকের উপর একান্ত কর্তব্য।
ছোটদের স্নেহ করা এবং বড়দের সম্মান করা সালিকের উপর একান্ত কর্তব্য। কেননা পার্থিব সম্মান এবং আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ।
আদব এবং মহব্বতের সাথে নবী করীম (সা.)-এর উপর দুরুদ পাঠ করবেন। কেননা, নবী করীম (সা.)-এর উপর দুরুদ ও সালাম পাঠ আত্মিক উন্নতি লাভের পূর্বশর্ত।
দালাইলুল খায়রাতের সনদগ্রহণকারীদের প্রতি নসীহত
দালাইলুল খায়রাতের তিলাওয়াতকারীগণ শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণে সতর্ক থাকা আবশ্যক।
নবী করীম (সা.)-এর সুন্নতের পূর্ণ পাবন্দ হওয়া আবশ্যক।
যারা দালাইলুল খায়রাতের ইজাযত পাইয়াছেন তাঁহারা গণীমত মনে করিয়া নিয়মিত তিলাওয়াত করিবেন।
দালাইলুল খায়রাত তিলাওয়াতকারীগণ কুরআনুল কারীম নিয়মিত তিলাওয়াত করিবেন।
শুদ্ধ উচ্চারণে তিলাওয়াত করা আবশ্যক, কেননা অশুদ্ধ উচ্চারণ অর্থের বিকৃতি ঘটাইতে পারে। ওযূর সাথে তিলাওয়াত করিবেন।
সিলসিলার নিয়মিত যিকির ও ওযীফা গুরুত্ব সহকারে সম্পন্ন করিবেন।
হালাল রোজগারের চেষ্টা করিবেন।
হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, গীবত, অহংকার ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কর্ম হইতে বিরত থাকিবেন।
প্রত্যেক জিনিসকে কোনো না কোনো কিছু বাধা প্রদান করিতে পারে। কিন্তু মহব্বতের বিদ্যুৎকে কোনো কিছুই আটকাইতে পারে না। যাহাদের অন্তরে রাসূল (সা.)-এর মহব্বত আছে তাহাদের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আচরণ কিভাবে হইতে পারে হযরত ওয়েস করনী (রা.)-এর ঘটনা ইহার উত্তম উদাহরণ। তাছাড়া হযরত বিলাল (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পরে শামে চলিয়া যাওয়ার পর রাসূল (সা.) তাঁকে ডাকিয়া আনার কথাও স্মরণযোগ্য। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হুযূরীর ধ্যান এবং মনে আদবের খেয়াল রাখিয়া দুরূদ শরীফ পড়িলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর হাবীবের সঙ্গে গাঢ় সম্পর্ক করিয়া দেন। মোট কথা; রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহব্বতের দিকে ধ্যান রাখিয়া দুরূদ পড়িলে নিজের রূহের যে পরিবর্তন আসে তাহা বর্ণনা করা যায় না।
হযরত বদরপুরী (র.) ফরমাইতেন : কোনো ব্যক্তি এ’শার নামাযের পরে রওদ্বায়ে আতহারের দিকে ধ্যান করিয়া ৭০ বার দুরূদে তুনাজ্জিনা শরীফ পড়ার আদত করিলে ক্রমান্বয়ে পর্দা উঠিয়া যাইবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দীদার নসীব হইয়া যাইবে। যার অন্তরে আল্লাহর হাবীবের সঙ্গে যে পরিমাণ মহব্বত আছে সে পরিমাণ তার মাঝে ঈমান আছে। মোট কথা, ঈমানের চরম উন্নতির পথ হলো হুব্বে রাসূল (সা.)। দালাইলুল খাইরাত ওযীফা তিলাওয়াতের সময় মনে হুজুরী ও আদব রাখিয়া পড়িলে বিশেষ উপকৃত হওয়া যাইবে বলিয়া আশা রাখি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে যেন নেক আমলের তাওফীক দান করেন।১৫
কামিল উত্তীর্ণ ছাত্রবৃন্দের প্রতি ছাহেব কিবলাহর ওসিয়ত ও নসীহত
প্রাতিষ্ঠানিক সনদ অর্জন মানে পূর্ণ জ্ঞান চর্চার দিশা লাভের স্বীকৃতি মাত্র। সনদ লাভের পর যোগ্য হয়ে উঠার জন্য প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন জ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়োগ করা।
আর ভালো ছুহবত না পেলে যথাযথ জ্ঞান চর্চা হয় না। আজকাল ছাত্ররা এ পথ থেকে দূরে সরে যাওয়ায় যোগ্যতা কমে আসছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপনের পর ছাত্রদের উচিত ভালো ছুহবতে থেকে প্রকৃত জ্ঞান চর্চায় সচেষ্ট থাকা।
ছাত্রদের বিনয়ী ও নম্র হওয়া প্রয়োজন। নম্র ও বিনয়ী হলে জীবনে উন্নতি হাসিল হবে। উন্নতি অর্জনের অন্যতম পদ্ধতি হলো বড়কে সম্মান করা এবং ছোটকে দয়া করা। রাসূল (সা.) এ বিষয়ে কঠোরভাবে নির্দেশও দিয়েছেন।
জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন রাসূলের আনুগত্যে কাটে; ছাত্রদের এ বিষয়েও যতœবান থাকতে হবে।১৬
ইন্তিকাল
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ ১৬ জানুয়ারি ২০০৮ ঈসায়ী, ৬ মুহাররম ১৪২৯ হিজরী, ৩ মাঘ ১৪১৪ বাংলা বুধবার প্রথম প্রহরে (রাত ২টায়) সিলেট শহরের সুবহানীঘাটস্থ তাঁর প্রতিষ্ঠিত শাহজালাল দারুচ্ছুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদ্রাসা সংলগ্ন বাসভবনে ইন্তিকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ইন্তিকালের কিছুক্ষণ পর ফজরের আগেই তাঁকে নিজ বাড়ি ফুলতলীতে নিয়ে যাওয়া হয়। ঐ দিন বিকাল ৪টার সময় বাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বস্থ বালাই হাওরে তাঁর নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় মুরীদান-মুহিব্বীনসহ লাখো লাখো মানুষ অংশগ্রহণ করেন। জানাযার নামাযে ইমামতী করেন বড় ছাহেবজাদা আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহকে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ছাহেব বাড়ি জামে মসজিদের উত্তর পাশে কবর দেয়া হয়েছে।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) সারা জীবন দীনের খিদমতে অতিবাহিত করেছেন। শেষ জীবনে বয়সের ভারে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গেলেও এ খিদমত থেকে তিনি বিরত হননি। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াও তিনি প্রায় নিয়মিতই ইসলামী মাহফিলে যোগ দিতেন। এসব সভা সম্মেলনে তাঁর অনুসারী মুরীদানসহ উপস্থিত জনগণকে ইসলামী শরীয়ত ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা অনুযায়ী জীবন গঠনের জন্য বিস্তারিত পরামর্শ ও নির্দেশনা দিতেন। অসাধারণ বাগ্মী হিসেবে তাঁর পরিচয় সুবিদিত ছিল। তাঁর বাগ্মিতার বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁর বক্তব্য বাস্তবোচিত, যুক্তিসিদ্ধ ও পুরোপুরি তথ্যনির্ভর থাকতো।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম ওলীয়ে কামিল ও যামানার মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক ছিলেন। আল কুরআনুল কারীমের বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের বিস্তার তাঁর সবচেয়ে বড় সংস্কারমূলক কাজ। তা ছাড়া তিনি সমাজে প্রচলিত নানা ভুল আকীদা-বিশ্বাসের মূলোৎপাটন ঘটিয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা-বিশ্বাসকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিদআত-কুসংস্কার দূর করেছেন। সর্বোপরি তিনি মুসলমানদের শরীআত মুতাবিক জীবন গঠন ও পরিচালনার কার্যকর দিকনির্দেশনা প্রদান করে গেছেন। তাঁর জীবন আমাদের জন্য আদর্শ ও অনুপ্রেরণার উৎস।
ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) সম্পর্কে
গুণীজনের মূল্যায়ন
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ছিলেন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ বুযুর্গ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ওলীআল্লাহ। তিনি আপন কর্মের মাধ্যমে তাঁর মুরীদীন-মুহিব্বীনসহ সর্বস্তরের মানুষের মনে এক বিশাল আসন গড়ে গেছেন। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর ইন্তিকালের পর শোক করে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেশের শীর্ষস্থানীয় পীর-মাশায়িখ, আলিম-উলামা, লেখক-সাহিত্যিক, ইসলামী চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। এ ছাড়া তাঁকে নিয়ে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত এ সকল বক্তব্য-বিবৃতি ও লেখালেখি থেকে এখানে উল্লেখিত অভিমতসমূহ নেয়া হয়েছে। তবে পত্রিকার বানানের পরিবর্তে নিজস্ব বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
“আল্লামা আব্দুল লতিফ ফুলতলী ছিলেন ইসলামের একজন শ্রেষ্ঠ বুযুর্গ। অসংখ্য ছাত্র, শিক্ষক, হাফিয তাঁর ইলমের তত্ত্বাবধানে বড় মাপের আলিম এবং বুযুর্গ হিসেবে গড়ে উঠেছেন। তারা ব্রিটেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ইসলামী উম্মাহর খিদমতে নিয়োজিত আছেন। আলহামদুলিল্লাহ, তারা তাঁর রেখে যাওয়া ইলম এবং আদর্শকে মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর মকবুলিয়াতের প্রধান আলামত হলো তিনি ছিলেন ইখলাসের অধিকারী একজন আলিম। ইলম ও আদর্শের যে বিরাট উত্তরাধিকার তিনি রেখে গিয়েছেন তা-ই প্রমাণ করে তিনি কত উঁচু মাপের বুযুর্গ ছিলেন। আল্লাহ পাক তাঁকে বরকতময় করেছেন। আমি আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন তাঁর সন্তান, খলীফাবৃন্দ এবং তাঁর রেখে যাওয়া উলামায়ে কিরামকে অনুগ্রহ করেন যাতে তারা তাঁর আদর্শের বাণী ধারাবাহিকভাবে জারি রাখতে পারেন।”
-শায়খ সাইয়্যিদ মুহাম্মদ ইউসুফ হাশিম আর রিফাঈ:
কুয়েত সরকারের সাবেক মন্ত্রী, ডাক-টেলিযোগাযোগ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়
শিক্ষাবিদ, বহু প্রন্থ প্রণেতা
#রঈসুল কুররা, উস্তাযুল উলামা শায়খ মো. আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (র.) আজ আর আমাদের মাঝে নেই। আজ হতে দুই বছর পূর্বে ২০০৮ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন তাঁর সর্বশক্তিমান মাওলার সান্নিধ্যে। ভারতীয় উপমহাদেশের আধ্যাত্মিকতার উর্বর ভূমি বাংলাদেশের সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণকারী এ মহান সূফী সাধক প্রায় শতবর্ষব্যাপী জীবনের অধিকারী ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে তাঁর মেধা, উন্নত চরিত্র, তাকওয়াহ, আত্মার উৎকর্ষ, ত্যাগ, বিশেষত তাঁর রূহানিয়াত তথা আধ্যাত্মিকতা তাঁকে বিখ্যাত করেছিল এবং বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বের তরিকতপন্থী মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। বাংলাদেশ, ভারতের আসাম রাজ্য, ইউরোপ ও আমেরিকার বাংলাভাষী বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য তিনি ছিলেন তাসাওউফ তথা ইসলামী আধ্যাত্মিকতা শাস্ত্রের এক মহান মুরশিদ- আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক।
আধ্যাত্মিকতার প্রাচীন সিলসিলাসমূহ যেমন চিশতিয়া, কাদিরিয়া, নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দিদিয়া এবং মুহাম্মদিয়ার অনুসরণে আল্লাহপ্রাপ্তির সাধনায় সফলতা অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে আসা লাখো লাখো মানুষকে মা’রিফাতের তালিম-তারবিয়ত প্রদানের পাশাপাশি মুসলমানদের পবিত্র কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত ও তাজবীদ শাস্ত্র শিক্ষাদানের স্মরণাতীত খিদমত করে তিনি তার জীবন অতিবাহিত করেছেন। দীনে মুস্তাফা (সা.)-এর খিদমতে এ সকল অসামান্য অবদান বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন হাজারো মসজিদ, মাদরাসা, মক্তব এবং এতীমখানা। ইসলামী শিক্ষার এ সুবিশাল নেটওয়ার্ক এখনও জীবন্ত আছে, যা আল্লামা ফুলতলী (র.)-এর অবদানের ধারাকে চিরদিন আমাদের মাঝে জারি রাখতে সহায়তা করবে। এমনকি বৃটেন এবং আমেরিকায়ও আল্লামা ফুলতলী (র.)-এর হিদায়াত ও দাওয়াতী কর্মকান্ডের ফলেই তৈরী হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানের। উদাহরণস্বরূপ এ মহান সূফী ও মনীষীর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সর্বাধিক সুখ্যাতিসম্পন্ন বৃটেনের দারুল হাদীস লতিফিয়া’র নাম উল্লেখযোগ্য, যেখানে আমিও গিয়েছি। তাঁর নিকট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামরা বৃটেনের শত শত মসজিদে ইমামতি করছেন।
আল্লামা ফুলতলী (র.) ভারতের আল্লামা শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (র.)-এর মাধ্যমে হযরত আল্লামা শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (র.)-এর সিলসিলাভুক্ত ছিলেন। গৌরবান্বিত জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও তিনি তাঁর মুরীদীন তথা শিষ্যদের নিয়ে সভা-সমাবেশ করেছেন। তাদের সত্যের পথ প্রদর্শন করেছেন। রাসূলে আকরাম (সা.)-এর মহব্বতে সিক্ত করে, রাসূলের ইশকে তাদের একীভূত করে তিনি তাদের মধ্যে প্রচার করে গেছেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা বিশ্বাস। পাশাপাশি তাদের সদা সতর্ক করেছেন ভ্রান্ত-মিথ্যা আকীদা বিশ্বাসের মারাত্মক বিপদ থেকে। তাঁর অসংখ্য অনুগামীদের সকলের মধ্যেই তিনি এ সকল শিক্ষা সফলভাবে সঞ্চারণ করে গেছেন এবং তাঁর মুরীদীনের, মুহিব্বীন, ছাত্র, শিষ্য ও অনুগামীদের কয়েকটি প্রজন্ম রেখে গেছেন যারা বিশ্ব জুড়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বীনী খিদমতে অবদান রেখে যাচ্ছেন।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব (র.)-এর ব্যাপক মকবুল খিদমতসমূহ সম্পর্কে আমরা অবগত ছিলাম। তাঁর নিকট হতে আমন্ত্রণ পেয়ে ২০০৫ সালে সিলেটে অনুষ্ঠিত ‘শানে রিসালত আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলন’-এ যোগদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশে যাওয়ার সুবাদে আমার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সুহবত তথা সাহচর্য লাভের, তাঁর সম্পর্কে অবগত হওয়ার। আমি এটা দেখে পুলক অনুভব করেছিলাম, আনন্দিত হয়েছিলাম যে, মোহাম্মদী নূরের দীপ্তি বাংলাদেশ ও এর সীমানা ছাড়িয়ে সর্বত্র ছড়াচ্ছে। তাঁর জীবন, সত্যিকার ইসলাম ও মুসলিম জীবনে তাঁর অবদান সম্পর্কিত এ স্মারক নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত গুণীজনদের লেখনীতে ভরপুর। এ মহান ওলী আল্লাহর শানে কিছু কথা লেখার সুযোগ পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
আল্লাহ যেন এ মহান ওলীর মকবুলিয়ত বৃদ্ধি করে দেন। তাঁর অনুসারী, উত্তরাধিকারী এবং খিদমতসমূহকে আল্লাহ পাক হিফাযত করুন, এদের সংখ্যা বাড়িয়ে দিন এবং এদের কবুল করুন। আমীন।১৮
–শায়খুল ইসলাম প্রফেসর ড. মুহাম্মদ তাহির আল কাদরী
বিশ্ব বিখ্যাত দাঈ ও বহু গ্রন্থপ্রণেতা
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান : মিনহাজুল কুরআন ইন্টারন্যাশনাল
#“আল্লাহ তা’আলা হযরত আল্লামা ফুলতলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র মতো ব্যক্তিত্বের দ্বারা এ দেশবাসীকে সম্মানিত করেছেন। তাঁর মতো ব্যক্তিরা সমাজের জন্য আদর্শ।”
-আল্লামা সায়্যিদ আল হাবীব আছিম আদী ইয়াহইয়া
পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারা, সাউদী আরব
#“আমরা ভারতে পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তথা মীলাদ শরীফের অনুষ্ঠান করে থাকি। এতে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলীয়ে কামিল আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর বিরাট অবদান রয়েছে। ভারত, বাংলাদেশসহ অনেক স্থানে তিনি মীলাদুন্নবী’র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নবীর দুশমনদের আক্রমনের শিকারও হয়েছেন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দরজা বুলন্দ করুন। তিনি সকলকে মীলাদুন্নবীর অকাট্য দলীল পেশ করে মীলাদুন্নবী পালন করার আহবান জানান। বিশ্ববিখ্যাত উলামায়ে কিরাম, কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস তথা ইসলামের চার দলীলের ভিত্তিতে পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বৈধতা প্রমাণ করেন।”
-সায়্যিদ জুনাইদ আহমদ মাদানী আল হুসাইনী
প্রেসিডেন্ট, দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত, ভারত
#“আল্লামা ফুলতলী (র.) ছিলেন শরী’আত ও তরীকতের অন্যতম রাহবার এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দিশারী একজন আশিকে রাসূল। আল্লাহর জমিনে দীন ইসলামের সঠিক মতাদর্শ প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে মরহুম পীর ছাহেব যে অবদান রেখে গেছেন তা অবিস্মরণীয়।”
-হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মদ মুহেব্বুল্লাহ
পীর ছাহেব কিবলাহ, ছারছিনা দরবার শরীফ, বরিশাল
#…“কুরআন মাজীদ তাজবীদের সাথে পঠনের ক্ষেত্রে তাঁর খিদমতের কোনো তুলনা হয় না। শুধু বাংলাদেশ নয় ভারতীয় উপমহাদেশ, ব্রিটেন, আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইলমে কিরাতের প্রতিষ্ঠান ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’-এর মাধ্যমে যে খিদমত চলছে তার জুড়ি মেলা ভার।
তাফসীর, সীরাত, তাসাওউফ বিষয়ে তাঁর অনেক কিতাব রয়েছে। তাঁর লেখা কিতাবসমূহ পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। বিশেষ করে তাঁর ‘আল-খুতবাতুল ইয়াকূবিয়া’ আমার হাতের কাছেই থাকে। আমি যখন খুতবা দেই তখন এটি হতে অনেক সাহায্য নিয়ে থাকি। এটি অত্যন্ত সুন্দর একটি খুতবা। বাজারে বহু খুতবা পাওয়া যায়। কিন্তু কোনোটিই এটার মতো নয়। তাঁর তাসনীফাতসমূহের মধ্যে রূহানীয়াত রয়েছে। ইখলাস রয়েছে। আমাদের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে। তাঁর লেখাসমূহ সংগ্রহ করে যদি আমরা আমাদের হাতের নিকট রাখি, মাঝে মাঝে একটু অধ্যয়ন করি, এতে আমাদের মুর্দা দিল যিন্দা হবে ইনশা আল্লাহ।”
-প্রফেসর মাওলানা মোঃ সালাহ্উদ্দিন
খতীব, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, ঢাকা
#“শায়খ আব্দুল লতিফ ফুলতলী ছিলেন সকল দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী একজন মনীষী। বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্বে তিনি যে খিদমত এবং অসংখ্য অনুসারী রেখে গেছেন তার প্রকৃত মূল্যায়ন আল্লাহ পাকই ভাল জানেন। তাঁর অনুসারী মুরীদীনের সংখ্যা হাজার হাজার নয়, মিলিয়ন হিসেবে গণনা করা যেতে পারে, যাদের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমি আল্লামা ফুলতলীকে প্রায় বিশ-ত্রিশ বছর ধরে জানি, ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রে যিনি একজন রাহবার। তিনি তাঁর সারা জীবন ধরে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য মাদরাসা, মসজিদ, এতীমখানা, খানকা এবং দীনি প্রতিষ্ঠান। প্রকৃতপক্ষে তিনি আল্লাহ-রাসুুল (সা.)-এর একজন উত্তরসূরী এবং সর্বোতভাবে একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তিনি দীর্ঘ জীবন লাভ করে ইসলামী দাওয়াতের কাজ চালিয়ে গেছেন এবং বাংলাদেশে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সঠিক আকীদা বিশ্বাসে পরিচালিত করে গেছেন। তাঁর বিশিষ্ট মুরীদীন এবং খলীফাগণ যারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন তাদের মাধ্যমে তাঁর খ্যাতি আরো বেড়েই চলেছে। তারা তাদের দায়িত্বের উপর এতটুকু সক্রিয়, যতটুকু সক্রিয় ছিলেন তাঁর জীবদ্দশায়। এভাবেই আমরা অনুধাবন করতে পারি মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে তুলনা অথবা অনুধাবন করা যায় দুনিয়ায় তাঁর কর্মের মাধ্যমে। শায়খ আব্দুল লতিফ (আল্লাহ পাক তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হোন) মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং মসজিদে আগতদের পরিচর্যা করেছেন। তিনি খানকা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং খানকায় অবস্থানকারীদের দেখাশোনা করেছেন। তিনি ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং এ প্রতিষ্ঠানসমুহের শিক্ষার্থীদের সঠিক তত্ত্বাবধান করেছেন। আমি শায়খ আব্দুল লতিফ ফুলতলী সম্পর্কে আর কী বলতে পারি, তিনি হচ্ছেন আল্লাহর মনোনীত একজন মানুষ ও একজন ওলী আল্লাহ। তিনি কেবল একজন সাধারণ ওলী আল্লাহই নন, তিনি হচ্ছেন কুতুব। তিনি তার সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন আল্লাহর জন্য এবং তিনি এখনও আমাদের মধ্যে জীবিত আছেন তাঁর কর্মের মাধ্যমে। কেননা এ রকম মানুষেরা কখনও মৃত্যু বরণ করেন না।”
-শায়খ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আবূ লায়লাহ
শিক্ষাবিদ বুযুর্গ, অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান-
ইসলামিক স্টাডিজ ইন ইংলিশ, আল আযহার ইউনিভার্সিটি, মিসর
#“আউলিয়ায়ে কিরাম এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁরা খানকা প্রতিষ্ঠা করে যিকর আযকার ও তা’লীম-তরবিয়াতের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করেন। আল্লামা ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহিও আজীবন এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বড় মাপের ওলী ও বুযুর্গ।”
-হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ
সাবেক রাষ্ট্রপতি
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
#“শুদ্ধভাবে কুরআন পাক তিলাওয়াতের ফযীলত অপরিসীম। এই তিলাওয়াত বিশুদ্ধ করা আমাদের কর্তব্য। দেশের প্রখ্যাত আলিম ও বুযুর্গ মাওলানা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ষাট বছর যাবত ট্রাস্টের (দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট) মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছেন তা প্রশংসনীয়।”
-অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী
সাবেক রাষ্ট্রপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
#“ফুলতলী পীর ছাহেব কিবলাহ সুদূর মক্কাশরীফ গিয়ে শায়খুল কুররা আহমদ হিজাযী (র.)-এর নিকট থেকে কিরাত শিক্ষা করে সূদীর্ঘ ষাট বছর যাবৎ অন্যান্য খিদমতের পাশাপাশি কুরআন পাকের যে খিদমত আনজাম দিয়ে আসছেন তা দেশ বিদেশের এক বিরল দৃষ্টান্ত।”
-মাওলানা এম এ মান্নান
সাবেক ধর্মমন্ত্রী, ইসলামী চিন্তাবিদ
প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় দৈনিক ইনকিলাব, ঢাকা।
#“আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলীর আধ্যাত্মিকতায় ধর্মের সঙ্গে জীবন ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের দিকটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব পেয়েছে। তাই তিনি আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে যেমন ছিলেন সকলের আদর্শ, তেমনি সমাজ জীবনে ছিলেন সকলের অনুকরণযোগ্য এক মহান ব্যক্তিত্ব।”
-বিচারপতি আব্দুর রউফ
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার
#“দেশে বিদেশে তাঁর (ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ) ভক্ত ও প্রতিষ্ঠানের বিস্তৃতি আছে। বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেটে পবিত্র রামাদান মাসে যে বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের সুর শুনা যায় তা ফুলতলী ছাহেবেরই প্রচেষ্টার ফসল।”
-এম সাইফুর রহমান
সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
#“মরহুম পীর ছাহেব (ফুলতলী) একজন বিখ্যাত আলিম ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।”
-ড. ইফতেখার আহমদ চৌধুরী
সাবেক উপদেষ্টা- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
#“আল্লামা আব্দুল লতিফ ফুলতলী ছিলেন দেশের লক্ষ কোটি মুসলমানের আত্মার আত্মীয়। তাঁর ইন্তিকালে দেশ দীনি খিদমত ও ইলমে তাসাওউফ অঙ্গনের একজন মনীষীকে হারালো।”
-শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক
সাবেক আমির- বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস
#“সিলেটের ফুলতলী পীর ছাহেব ছিলেন উপমহাদেশের এক শীর্ষ স্থানীয় বুযুর্গ, মুজাহিদ এবং আল্লামা ব্যক্তিত্ব। তাঁর সন্তানরাও দীনের খিদমতে এবং সেবামূলক কাজে নিয়োজিত। দেশ এবং জাতি তাঁর ইন্তিকালে একজন বুযুর্গ মুরব্বিকে হারালো।”
-আমিরুল মুছলিহীন মাওলানা মোঃ আযীযুর রহমান নেছারাবাদী
(কায়েদ ছাহেব হুজুর), ঝালকাঠি
#“ফুলতলী পীর ছাহেব বাতিল ও খোদাদ্রোহীদের বিরুদ্ধে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অসাধারণ মেহনত করেছেন।”
-মুফতি সৈয়দ রেজাউল করিম
পীর ছাহেব, চরমোনাই
#“আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নি:শর্ত ভালবাসা পরম নৈকট্য লাভের সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ। আর এই পথেই ঘটে ভক্তিবাদের চরম বিকাশ। এই বিকাশ আমরা লক্ষ্য করি ফুলতলী ছাহেবের মধ্যে।”
-দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ
দার্শনিক, ইসলামী চিন্তাবিদ, জাতীয় অধ্যাপক
#‘‘আমি তাঁর মাঝে এমন কিছু গুণ প্রত্যক্ষ করেছি যেগুলো খুবই বিরল। তিনি একাধারে সাহসী, কষ্ট সহিষ্ণু, বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর ও দীনের তরে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। দীনের জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দেয়ার জন্য প্রতি প্রস্তুত থাকতেন।
আমি হযরত ফুলতলী (র.)-এর মাঝে শহীদে বালাকোট হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ (র.)-এর প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছি। তাঁর মাঝে সায়্যিদ (র.)-এর চেতনা যথাযথ ভাবে পরিস্ফুুট ছিল। সায়্যিদ (র.)-এর চেতনাকে তিনিই আমাদের দেশে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা হুযূরকে আল-কুরআন আল-কারীমের খাদিম হিসেবে কবূল করেছিলেন। তিনি আল-কুরআন বিশুদ্ধভাবে পাঠের যে অনুপম ব্যবস্থা করে ও রেখে গেছেন তা এককথায় অসাধারণ। আমার মনে হয়েছে আল্লাহ কুরআনের খিদমতের জন্য তাঁকে বিশেষভাবে বেছে নিয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন সর্বোতভাবে মানুষের কল্যাণকামী। অন্যের উপকার করা, অন্যের দুঃখে কষ্ট পাওয়া এ গুণগুলো তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্টের অন্যতম দিক।’’
-মাওলানা মুহি উদ্দিন খান
ইসলামী চিন্তাবিদ, সম্পাদক- মাসিক মদীনা, ঢাকা
#“ফুলতলীর পীর ছাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন একজন বরেণ্য আলেমে দীন ও বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব। তাঁর মৃত্যুতে জাতি এক অভিভাবককে হারালো।”
-আল্লামা আব্দুল মুমিন
সভাপতি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ
#“বর্তমান বিশ্বে শান্তির ধর্ম ইসলামের শ্বাশত মূল্যবোধ ও কালজয়ী আদর্শকে যারা জিন্দেগীভর ত্যাগ ও মেহনতের মাধ্যমে প্রচার করে গেছেন তাদের মধ্যে আল্লামা ফুলতলী (র.) অন্যতম। আল্লামা ফুলতলী (র.) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখে গেছেন। তাঁর এই মহান খিদমতের জন্য তিনি অনাগতকাল জাতির হৃদয়ে শ্রদ্ধাশীল হয়ে থাকবেন।”
-ব্রিগেডিয়ার (অব:) ডা. আব্দুল মালিক
সাবেক জাতীয় অধ্যাপক, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
#“আব্দুল লতিফ চৌধুরী ছিলেন একজন বরেণ্য আলেমে দ্বীন ও সর্বজন মান্য বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন ইসলামী সাম্যবাদের অন্যতম বার্তাবাহক। তার উচ্চারিত প্রতিটি বাণী মানব জীবনে কল্যাণ ও সমৃদ্ধি বয়ে এনেছে।”
-প্রফেসর এমাজ উদ্দীন আহমদ
সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
#“শাহজালাল রাহমাতুল্লাহি আলাইহির উত্তরসূরী আল্লামা ফুলতলী মর্দে মুমিন, ইনসানে কামিল। তিনি আজীবন প্রকৃত ইসলাম প্রচার ও প্রসারে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তিনি ইসলামকে আমল করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। ইসলাম রক্ষার বিভিন্ন আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিলো অগ্রগন্য।”
-প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান
সাবেক ভিসি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
#“বিশিষ্ট ধর্মতাত্মিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলীর জীবন বর্ণাঢ্য বৈচিত্রময়। ঐশি গ্রন্থ আল কুরআনের বিশুদ্ধ প্রচার ও প্রসারে শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। এছাড়াও আর্তমানবতার সেবা, দুস্থ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা প্রভৃতি মানবীয় গুণাবলী তাঁকে অনুসরণীয় এক আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।”
-প্রফেসর ফয়েজ মোহাম্মদ সিরাজুল হক
ভিসি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
#“সূফীবাদের এক জ্বলন্ত উদাহরণ ছিলেন তিনি। মানুষের নফসকে জয় করতে পারলে সে যে আধ্যাত্মিক জগতে কতদূর এগুতে পারে এবং স্রষ্টার কত কাছে থাকতে পারে এ শিক্ষা তিনি অনেককেই দিয়েছেন। এখন আমরা যারা তাঁকে শ্রদ্ধা করি মনে প্রাণে, তাদের উপর একটা দায়িত্ব অবশ্যই এসে পড়েছে। সে দায়িত্ব হচ্ছে সেসব ইনসটিটিউশন তিনি গড়ে গেছেন আমাদের কাজ হবে সে গুলোকে ধরে রাখা এবং আরো প্রসারিত করা। আমাদের কাজ আরো আছে; বিভ্রান্ত মানুষকে ঘৃণার চোখে না দেখে ভালোবাসা ও মানবতার চোখে দেখে তাদেরকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা।”
-প্রফেসর ড. এম শমসের আলী
বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী, উপাচার্য সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
#“শরী’আত, তরীকত ও মা’রিফতের উজ্জ্বল নক্ষত্র আল্লামা ফুলতলী ছাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আজীবন ইসলামের একনিষ্ঠ, নির্ভীক খাদিম হিসেবে কাজ করে গেছেন। আমাদের জন্য উচিৎ হবে তাঁর রেখে যাওয়া কাজগুলো চালিয়ে দীনের খিদমতে তাঁর এবং তাঁরই মত অন্যান্য সকল হক্কানী উলামা ও মাশায়েখের মাধ্যমে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণ অনুসরণ ও অনুকরণ করা।”
-ড. আহমদ আনিসুর রহমান
সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
#“যাদের মধ্যে চুম্বক শক্তি বা মানুষকে আকর্ষণ করার মতো ক্ষমতা আছে; তাদের মধ্যে ফুলতলী পীর ছাহেব হুযূর অন্যতম। ফুলতলী পীর ছাহেবের মতো হৃদয়বান, খাঁটি মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া একটি সৌভাগ্যের বিষয়। আমার ভাগ্যে তা জুটেছিলো বলে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আল্লামা ফুলতলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর সংস্পর্শ আমার মর্মমূল কম্পিত করেছিল।”
-কবি আল-মাহমুদ
বর্তমান বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি
#“সিলেটের ফুলতলী পীর সাহেবের কথা আমি অনেক শুনেছি, এই মহান পুরুষ তার দোয়ার, বরকতে বহু মানুষকে দ্বীনের পথে এনেছেন। সেজন্য তারা পরে আলোকিত করেছেন আমাদের সমাজ ও জাতিকে। ফুলতলী পীর সাহেবকে আমি দেখিনি; কিন্তু তার পবিত্র বাণীর মাধ্যমে জাতি জাগবে, জাতি উঠে দাড়াবে। আজ এটুকুই শুধু হুজুর কিবলাহ’র জন্য প্রার্থনা তিনি বেহেশত থেকেও যেন আমাদের দোয়া বর্ষণ করেন।”
-আশরাফ সিদ্দিকী
কবি সাহিত্যিক কলামিষ্ট
#“আল্লাহ পাক কোনো কোনো মানুষকে এক একটা শক্তি দেন, ক্ষমতা দেন। সবাইকে সব জিনিষ দেন না। হ্যাঁ, তাদের দেন, যারা সেটা প্রয়োগ করতে পারে। সবাই আবার পারেও না, অনেক বদনসীব আছে। আল্লাহ আমাদের অনেক গুণ দিয়েছেন কিন্তুু আমরা আল্লাহকে চিনতে পারলাম না। আমরা কি আল্লাহকে চিনতে পেরেছি! না। তিনি যতটুকু আমাদের বুঝতে দেন, ততটুকু বুঝতে পারব, বাড়াতে পারবোনা। আর পারতাম যদি ফুলতলী ছাহেবের মতো বুযুর্গদের সান্নিধ্যে আসতাম। কেউ কেউ আছেন শুধু নিজের সময়কে বুঝেন না, ভবিষ্যতকেও বুঝার ক্ষমতা রাখেন। আমি মনে করি ফুলতলী ছাহেবও এ ধরনের মানুষ ছিলেন।”
-কবি আসাদ চৌধুরী
বিশিষ্ট কবি ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
#“হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ মা’রিফতে ইলাহীর উচ্চ মর্গে আসীন বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে একজন আলিমে দ্বীন, আশিকে রাসূল ছিলেন। তাঁর কাব্যগ্রস্থ “নালায়ে কলন্দর” এ মারিফাতে ইলাহী ও ইশকে রাসূলের বিষ্ময়কর প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর ইন্তেকালে আমরা একজন সত্যিকারের লেখক ও সাহিত্যিককে হারালাম।”
-এ জেড এম শামছুল আলম
সাবেক সচিব, ইসলামী চিন্তাবিদ বহুগ্রন্থ প্রণেতা
#“আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছিলেন অত্যন্ত উঁচুমানের ব্যক্তিত্ব। তাঁর ভেতর ছিল অত্যন্ত উঁচু মানের ব্যক্তিত্ব। তাঁর ভেতর একই সাথে ছিলো আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও সমাজ সেবার এক অনুপম নৈপূন্য। এসবের সমন্বয় সাধারণত একই ব্যক্তির মাঝে খুব একটা দেখা যায় না। শুধু তাই নয় তিনি তাঁর জীবনে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের সাথে ও বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর সৃষ্ট যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে কুরআনের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে।”
-ভাষা সৈনিক অধ্যক্ষ মসউদ খান
রাজনীতিবিদ, সাবেক সভাপতি, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ সিলেট
#“ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ শুধু মহান আধ্যাত্ম পুরুষই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আলেম সমাজেরও শীর্ষস্থানীয় এক ব্যক্তিত্ব। ইসলামী শিক্ষা প্রসারে নিরলস এক মহান শিক্ষাবিদ হিসেবে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্যসাধারণ। তদুপরি তিনি ছিলেন এ জাতির প্রতিটি সংকট সন্ধিক্ষণে সাহসসঞ্চারী এক বিবেকী কণ্ঠস্বর। সত্য প্রকাশে ছিলেন বরাবরই অকুতোভয়। ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তি কোন কিছুই তাঁকে নীতি আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। সূদীর্ঘ জীবনে তিনি তরিকতের খেদমত ছাড়াও ইসলামী শিক্ষা প্রসারে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। দেশে বিদেশে অসংখ্য মাদ্রাসা মসজিদ ও কিরাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। বিশেষ করে ব্রিটেন, আমেরিকায় ইসলামী শিক্ষা ও ইসলাম চর্চার পরিবেশ সৃষ্টিতে তাঁর রয়েছে অসাধারণ ভূমিকা। প্রতিবেশী দেশ ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলেও এ ক্ষেত্রে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য।”
-এএমএম বাহাউদ্দীন
সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব, ঢাকা
#“শরীআত, মারিফাত, আমল-আখলাকে, সাহসিকতায় সর্বক্ষেত্রে পারদর্শী ও সঠিক নেতৃত্বের যোগ্য ব্যক্তি হচ্ছেন ফুলতলী পীর ছাহেব। আল্লামা ফুলতলী একজন সত্যিকারের আশিকে রাসূল ছিলেন। তাঁর মতো মহানুভব, পরোপকারী, মিল্লাতের কল্যাণকামী, সর্বোপরী আদর্শ মহাপুরুষ যুগে যুগে খুব বেশি জন্মাননি। এ ক্ষণজন্মা মহামনীষী জীবনব্যাপী রাসূল (সা.)-এর মহত্তম আদর্শ ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের প্রকৃত আকীদা বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার মিশন পরিচালনা করে গেছেন”।
-মাওলানা কবি রূহুল আমীন খান
ইমলামী চিন্তাবিদ, গবেষক ও কবি, নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব, ঢাকা
#“আল্লামা ফুলতলী ছিলেন ইসলাম বিদ্বেষী শক্তির আতংক এবং সত্যিকারের সিপাহসালার। ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে আল্লামা ফুলতলীর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
-অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউসুফ
সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড, ঢাকা
#“শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম মহামানবদের মধ্যে অন্যতম আল্লামা ফুলতলী রহ. ছিলেন কুরআন, হাদীস, ইলমে তাসাউফসহ প্রভৃতি বিষয়ে অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারী। তাঁর চিন্তা চেতনা ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটলে মুসলমানরা হারানো গৌরব অর্জন করতে পারবে।”
কর্ণেল (অব:) আতাউর রহমান পীর
সাবেক প্রিন্সিপাল- মদনমোহন কলেজ, সিলেট
#“ইসলাম প্রচারে নির্ভিক সৈনিক আল্লামা ফুলতলী রহ. এর জীবন ছিল সততা নিষ্ঠা ও আধ্যাত্মিক চেতনা সমৃদ্ধ। মানবসেবাসহ বিভিন্ন জনহিতকর কার্য্যে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল সর্বজন স্বীকৃত। তাঁর মানবীয় গুণাবলী অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে আমাদের জীবনকে কল্যাণমুখী করা সম্ভব।”
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) জুবায়ের সিদ্দিকী
প্রিন্সিপাল- স্কলার্সহোম, সিলেট
[বি.দ্র : যে সকল গুণীজনের মূল্যায়ন এখানে উপস্থাপিত হয়েছে তাঁরা প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য। বক্তব্য উপস্থাপনের ক্রমধারা তাঁদের মর্যাদা ও অবস্থানের নির্দেশক নয়।]
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে শোক-প্রস্তাব
২৫ জানুয়ারি, ২০০৯ তারিখে অনুষ্ঠেয় নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠকে জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পীকার এডভোকেট আব্দুল হামিদ দেশ-বিদেশের গুণীজনের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এতে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর ইন্তিকালের শোকও ছিল। উপস্থাপিত শোক প্রস্তাবে তিনি বলেন :
‘মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
আমি এখন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হযরত আব্দুল লতিফ চৌধুরী পীর সাহেব ফুলতলী (র.)-এর মৃত্যুতে একটি শোক-প্রস্তাব এ মহান সংসদে উত্থাপন করছি। আশা করি, প্রস্তাবটি সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হবে।
জনাব হযরত আব্দুল লতিফ চৌধুরী পীর সাহেব ফুলতলী (র.) ১৯১৩ সালে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ থানাধীন ফুলতলী গ্রামে এক প্রখ্যাত আলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০৮ সালের ১৬ জানুয়ারি নিজ বাসভবনে ইন্তিকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৯৫ বছর।
জনাব হযরত আব্দুল লতিফ চৌধুরী পীর সাহেব ফুলতলী (র.) অর্ধশতাব্দীর অধিককাল দ্বীনের বহুমুখী খিদমত ও আল্লাহর রাহে সর্বতোভাবে নিবেদিত ছিলেন। জৌনপুরী সিলসিলার একজন প্রখ্যাত বুযুর্গ হিসেবে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ও সুনাম রয়েছে।
আল্লামা ফুলতলী সাহেব হযরত শাহজালাল (র.)-এর অন্যতম সহচর হযরত কামাল (র.)-এর বংশের অধঃস্তন পুরুষ ও বিশিষ্ট বুযুর্গ হযরত শাহ আলা বখশ (র.)-এর বংশধর ছিলেন।
আল্লামা ফুলতলী সাহেব (র.) ফুলতলী মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। তারপর পর্যায়ক্রমে হাইলাকান্দি রাঙ্গাউটি মাদরাসা ও বদরপুর সিনিয়র মাদরাসায় শিক্ষা অর্জন করেন। উচ্চ শিক্ষা অর্জনার্থে ভারতের বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদরাসায়ে আলিয়া রামপুরে ভর্তি হন এবং হাদীসের শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে মাতলাউল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। চূড়ান্ত পরীক্ষায় ১ম বিভাগে ১ম স্থান অধিকার করে সনদ লাভ করেন। ইলমে হাদীস ছাড়াও তিনি ইলমে তাফসীর, ইলমে ফিকহ ও ইলমে কিরাত শাস্ত্রে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে আল্লামা ফুলতলী (র.)-এর কর্মজীবন শুরু হয়। কর্মজীবনে তিনি ১৯৪৬ সালে বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৫৪ সালে গাছবাড়ি জামেউল উলুম আলিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করে ছয় বছর সুনামের সাথে পাঠদান করেন। তিনি পর্যায়ক্রমে উক্ত মাদরাসায় ভাইস-প্রিন্সিপাল ও প্রিন্সিপাল হিসেবে গুরুদায়িত্ব পালন করেন। এরপর সুদীর্ঘকাল সৎপুর আলিয়া মাদরাসা ও ইছামতি আলিয়া মাদরাসায় হাদীসের শিক্ষাদান করেন। আল্লামা ফুলতলী (র.)-এর কর্মজীবনের অন্যতম একটি দিক হল আল-কুরআনুল কারীমের বিশুদ্ধ পঠন শিক্ষাদান।
আল্লামা ফুলতলী (র.)-এর গৌরবময় রাজনৈতিক জীবনও রয়েছে। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তথা উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সময়ে সময়ে তিনি অন্যায়-অবিচার, নির্যাতন এবং অনৈসলামিক কর্ম-তৎপরতার বিরুদ্ধে সফল আন্দোলন ও সংগঠন পরিচালনায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি লন্ডনস্থ দারুল হাদীস লতিফিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি বোর্ডের আজীবন চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর সরাসরি নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে অনেক মসজিদ ও মাদরাসা স্থাপিত হয়েছে। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলতলীতে স্থাপন করা হয়েছে একটি ফ্রি ডিসপেন্সারি।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
এ সংসদ প্রস্তাব করছে যে, “জনাব হযরত আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (র.)-এর মৃত্যুতে দেশ একজন বিশিষ্ট পীর মাশায়েখ, আলেম, বুযুর্গ, ইসলামী চিন্তাবিদ এবং সমাজসেবককে হারিয়েছে। এ সংসদ তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ, তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা এবং শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সহমর্মিতা প্রকাশ করছে।”
এ শোক-প্রস্তাবের একটি অনুলিপি মরহুম জনাব হযরত আল্লামা আব্দুল লতীফ চৌধুরী ফুলতলী (রহঃ)-এর শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের নিকট প্রেরণ করা হবে।
[সূত্র : আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) স্মারক থেকে নেয়া। (দ্রষ্টব্য : পৃষ্ঠা ৬৭৩-৬৭৫]
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর
কয়েকটি কারামত
আল্লাহর প্রিয় বান্দাহগণের জীবনে যে সকল অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয় তাই কারামত। হক্কানী আউলিয়ায়ে কিরাম থেকে প্রকাশিত ‘কারামত’-এ বিশ্বাস করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদার অংশ। আকীদার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আকাইদে নাসাফী’-তে বলা হয়েছে “ওলীগণের কারামত সত্য”। সে হিসেবে মুমিন মাত্রই কারামতে বিশ্বাসী। আমাদের পীর ও মুরশিদের জীবনেও বহু অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু তিনি কখনো কারামতের পিছনে ছুটতেন না। তাঁর কারামত প্রকাশিত হোক, এটা তিনি চাইতেন না। তাঁর সামনে কারামতের কথা বলার সাহসও কেউ করতেন না। তিনি সবসময় কারামতের চেয়ে শরী‘আতের উপর ইসতিকামাতকে বেশি গুরুত্ব দিতেন।
জীবনের ব্যাপারে হতাশ রোগীর রোগমুক্তি, দু‘আ ও তাবিযের বদৌলতে হারানো মানুষ ফিরে পাওয়া, ডুবন্ত লাশ ভেসে উঠা, নিঃসন্তান দম্পত্তির সন্তান লাভসহ হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) থেকে প্রকাশিত নানা কারামত দেশ-বিদেশে মানুষের মুখে মুখে আজো আলোচিত। নিচে তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু কারামত পত্রস্থ হলো।২১
ভেসে উঠল লাশ
হযরত নিজামুদ্দীন চৌধুরী বিশকুটি ছাহেব (র.) বর্ণনা করেছেন : হযরত ফুলতলী (র.)-এর সাথে আমার গভীর সম্পর্ক ছিল। আমরা বেশ কয়েক বার এক সাথে লন্ডন ও আমেরিকায় কাটিয়েছি। ফুলতলী ছাহেব যখন খুতবায়ে ইয়াকুবিয়া লেখেন তখন আমি ও মাওলানা মাহমুদুর রহমান বদরপুরী ছাহেব লন্ডনে তাঁর সাথে অনেক দিন ছিলাম। তিনি ঐ খুতবা লন্ডনেই লিখেছেন। ২০০১ সালে আমেরিকার সাগর সৈকতে ভাদেশ্বরের আমেরিকা প্রবাসী আনছার আহমদের দুই মেয়েসহ তিন মেয়ে ডুবে মারা যায়। তাদের দু’জনের লাশ পাওয়া যায়নি। এ সময় ফুলতলী ছাহেব লন্ডনে ছিলেন। আমি আর বদরপুরী ছাহেবও এক সাথে ছিলাম। এমন সময় মেয়েদের পিতা আনছার আহমদের পক্ষ হতে তাদের এক আত্মীয় পেরেশান হয়ে ফুলতলী ছাহেবের নিকট গেলেন। তিনি এ বিষয়ে আমাকে অনুরোধ করলে আমি ফুলতলী ছাহেবের নিকট আনছার আহমদকে আমার আত্মীয় বলে পরিচয় দিলাম। এদিকে আলহাজ্জ আনছার আহমদের ছোট ভাই মনছুরও একই উদ্দেশ্যে আমেরিকা থেকে লন্ডন আসছেন। আমি ফুলতলী ছাহেবকে বিষয়টি বললাম। তখন ফুলতলী ছাহেব কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে আবার খুললেন। তিনি খিজির (আ.)’র উদ্দেশে একটি চিঠি লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন, তাদেরকে বলে দেন, যে স্থানে মেয়েরা ডুবেছে ঐ স্থানে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। অনুভব করলাম, সাগর সৈকতে এরা কিভাবে আছে এবং কিভাবে উদ্ধার করা যায় তিনি সব কিছু চোখ বন্ধ করেই সিদ্ধান্ত নিলেন। আমার মাধ্যমে আনছার আহমদের আত্মীয় চিঠি নিয়ে তাঁর ছোট ভাই মনছুরের নিকট লন্ডন এয়ারপোর্টে দিলেন। তাবিযটি ছাড়ার একদিন পর লাশগুলো ভেসে উঠতে আরম্ভ করে। অথচ ৭ দিন ধরে আমেরিকার মতো উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশের উদ্ধারকর্মীরা অনেক চেষ্টা করেও লাশ উদ্ধার করতে পারেনি। একটি লাশ ভেসে উঠার সময় একটি বড় আকারের মাছও ভেসে উঠল। লাশের শরীরে মাছের দাঁতের চিহ্নও দেখতে পাওয়া গেল।
হযরত নিজামুদ্দীন চৌধুরী বিশকুটি ছাহেব কিবলাহ (র.) তিনি বিভিন্ন মাহফিলে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
উপরোক্ত কারামত সম্পর্কে আমেরিকা প্রবাসী জনাব মাওলানা শরীফ উদ্দিন লিখেছেন, এ ঘটনাটি ঘটে ২০০১ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে। ঐ সময় আমেরিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছিলো। নিউজার্সীর প্যাটারসন শহরের দু’বোন জুবেদা (১৬) ও সাজেদা (১৪) এবং তাদের খালাত বোন রাহেলাকে (১২) তাদের মামা নিউইয়র্কের ফার রকওয়ে সমুদ্র সৈকতে বড়শী দিয়ে মাছ ধরতে নিয়ে যান। সেখানে আকস্মিকভাবে পানিতে ডুবে তিন বোনই মৃত্যুবরণ করে। ঘটনার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রাহেলার লাশ কোস্ট গার্ডরা উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। কিন্তু ডুবুরী ও উদ্ধারকারী দল ৫/৬ দিন পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টার পরও জুবেদা ও সাজেদার কোনো সন্ধান লাভ করতে পারেনি। এই সময়ে খবর আসে যে ছাহেব কিবলাহ ও বিশকুটি ছাহেব লন্ডনে অবস্থান করছেন। ওই মেয়েদের ছোট চাচা টেলিফোনে ছাহেবদের সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ করেন। ছাহেবগণ মেয়েদের পিতাকে সবর করতে উপদেশ দেন। কিন্তু মেয়েদের ছোট চাচা এক ঘণ্টার ভেতর লন্ডনে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে লন্ডনের পথে রওয়ানা হন। ইতোমধ্যে তাদের সেখানকার এক আত্মীয় ছাহেবগণের নিকট গিয়ে কোনো কিছু দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তখন বিশকুটি ছাহেব ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-কে অনুরোধ করলে তিনি একখানা ভাজ করা তাবিয তার হাতে দিয়ে বলেন যে ওই তাবিযখানা বিসমিল্লাহ বলে যেন ঘটনার স্থানে ভাসিয়ে দেয়া হয়। মেয়েদের ছোট চাচা হিথ্রো বিমান বন্দরে গিয়ে তাবিযখানা গ্রহণ করে ফিরতি ফ্লাইটে কেনেডি এয়ারপোর্টে পৌঁছেন এরপর ছাহেব কিবলার নির্দেশ মতো যথাস্থানে গিয়ে তা পানিতে ভাসিয়ে দেন। পরদিন দুপুরের দিকে ঘটনার স্থান থেকে ৫/৬ মাইল দূরে জুবেদার লাশ অক্ষত অবস্থায় ভেসে উঠে এবং এর পরদিন সাজেদার লাশ একই ভাবে অক্ষত অবস্থায় ভেসে উঠে। পানিতে ডুবে মরা এই তিনটি মেয়েকে প্যাটারসনের নিকটবর্তী টটোয়া শহরের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
দ্রষ্টব্য : মাওলানা শরীফ উদ্দীন লিখিত
‘একজন ছাহিবে কারামত ওলী আল্লাহ’ শীর্ষক প্রবন্ধ, যা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) স্মারকে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
দু‘আর বদৌলতে দৃষ্টিশক্তি লাভ
১৪১২ হিজরী সনে হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দীন চৌধুরী বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলীর হস্তলিখিত ‘কাসীদাতুন নু’মান’-এর একটি নুসখা প্রকাশিত হয়েছিল। এতে তিনি ‘পূর্বাভাষ’ শিরোনামীয় ভূমিকায় আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর বাচনিক শুনে বর্ণনা করেন, প্রায় ৫০ বছর পূর্বে সিলেটের জকিগন্্জ থানার বিলবাড়ি নিবাসী হেকিম মাওলানা আব্দুস সুবহান চৌধুরী ছাহেব দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তিনি ফুলতলী ছাহেবকে নিজ বাড়িতে দাওয়াত করে নিয়ে যান এবং বলেন, “আমার ইরাদা হজ্জ ও যিয়ারত করার। আপনি দু‘আ করুন যেন আল্লাহ তা‘আলা আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন।” ফুলতলী ছাহেব বিনয় সহকারে বললেন, “এত বড় দু‘আর জন্য আল্লাহর কোনো মকবূল বান্দাহকে তলব করা উচিত ছিল।” তখন হেকিম ছাহেব বলেন, “আপনার দু‘আ নেয়ার জন্য আমাকে ইশারা করা হয়েছে।” ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ হেকিম ছাহেবের কথায় অভিভূত হয়ে দু‘আ করলেন। হেকিম ছাহেব তাঁকে একখানা মুতারজাম (অনুবাদ) ‘কাসীদাতুন নু’মান’ দান করলেন। আলহামদুলিল্লাহ, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাচ্চা আশিক হেকিম ছাহেব পবিত্র হেজায ভূমিতে পদার্পণ করলে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। তিনি নয়ন ভরে মক্কা মুকাররামা, মদীনা মুনাওয়ারা ও অন্যান্য স্থান অবলোকন করেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় চট্টগ্রাম অথবা সিলেট পৌঁছলে তিনি আবার অন্ধ হয়ে যান।
সূত্র : আল্লামা ইমাদ উদ্দীন চৌধুরী বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলীর
হস্তলিখিত ‘কাসীদাতুন নু’মান‘-এর পূর্বাভাষ
স্বপ্নে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাস
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) একবার স্বপ্নে দেখেন যে, অসংখ্য শকুন মানুষকে খাবলে খাচ্ছে। চিল যেভাবে মাছ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায় ঠিক তেমনি। পরে তিনি হযরত শাহ ইয়াকূব বদরপুরী (র.)-এর কাছে এ ভয়ঙ্কর স্বপ্নের কথা বললেন। স্বপ্নের বিবরণ শুনে কিছু সময় অঝোরে কাঁদলেন হযরত বদরপুরী (র.)। উল্লেখ থাকে যে, হযরত বদরপুরী (র.)-এর অন্তরদৃষ্টি ছিল বড়ই প্রখর। তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন, অতি শীঘ্রই বিশ্বব্যাপী এক বড় ধরনের সংঘর্ষ বাঁধবে। অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। প্রচুর রক্তপাত হবে। বিভিন্ন দেশের রাজা মন্ত্রীরা এ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর এ স্বপ্ন বৃথা যায়নি। সত্যিই কিছু দিনের ভেতর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা দেয়।
-মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী
ছোটদের শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (র.), পরওয়ানা পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২৪
লজিং মাস্টারের সন্তান লাভ
শামসুল উলামা হযরত আল্লামা ফুলতলী (র.) রামপুর আলিয়া মাদরাসায় পড়ার সময় রামপুর হাইস্কুলের সহ-প্রধান শিক্ষক নব্বী শাহ সাহেবের বাসায় লজিং থাকতেন। জনাব নব্বী শাহ ছিলেন নিঃসন্তান। তার কোন সন্তান হতো না। আল্লাহ তা‘আলার নিকট তিনি সব সময় কায়মনোবাক্যে দু‘আ করতেন। কোন বুযুর্গ ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ লাভ হলেই তার নিকট দু‘আ চাইতেন।
এদিকে নম্রতা, ভদ্রতা, আদব-কায়দা, মাদরাসায় পড়াশুনা, সহপাঠীদের সাথে বিনয় আচরণসহ ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে নিজেকে আলাদা রেখে অসাধারণ ইবাদত বন্দেগীর ফলে ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর পরিচয় গোপন থাকল না। তিনি যে শুধু একজন তালিবে ইলিমই নন; বরং একজন পীর ছাহেবও বটে সেটি জানাজানি হয়ে গেল। তিনি শামসুল আরিফীন হযরত মাওলানা শাহ হাফিয আহমদ জৌনপুরী (র.)-এর খলীফা কুতবুল ইরশাদ হযরত মাওলানা আবূ ইউসুফ শাহ্ মোহাম্মদ ইয়াকূব (হাতেম আলী) বুন্দাশিলী বদরপুরী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর নিকট হতে খিলাফত লাভ করেছেন।
তালাবাদের মধ্যে কে বা কারা সৈয়দ নব্বী শাহকে কথাটি বলে দিলেন। তখন তিনি ভাবলেন ফুলতলী (র.)-এর নিকট হতে তাবিয নিলে এবং তিনি দু‘আ করলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে কোন সন্তান দান করতে পারেন। একদিন মাস্টার ছাহেব তাঁকে তাঁর মনের কথা খুলে বললেন। ছাহেব কিবলাহ আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা করে একটি তাবিয লিখে দিলেন। তাবিয ব্যবহারের পর আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহে মাস্টার সাহেব একটি ছেলে সন্তান লাভ করেন। মাস্টার সাহেব ছেলে সন্তান পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন।
সূত্র : মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান প্রণীত
জীবনীগ্রন্থ ‘হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’
বিষাক্ত বোলতার আক্রমণ হতে রক্ষা
ভারতের রামপুর আলিয়া মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল জনাব মাওলানা মাজুল্লাহ খাঁ সাহেবের থাকার ঘরে একটি বিষাক্ত বোলতা বাসা বেঁধেছে, যার ভয়ে ঘরে বসবাস করা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। ভাবতে লাগলেন কিভাবে রক্ষা পাওয়া যায়। এদিকে হযরত ফুলতলী ছাহেব (র.)-এর মকবূলিয়াতের সংবাদ চতুর্দিকে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে প্রতিদিন অনেক মানুষ তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা নিয়ে তাঁর নিকট আসতে লাগলেন। মাওলানা মাজুল্লাহ খাঁ ভাবলেন ফুলতলী ছাহেবের নিকট বিষয়টির কথা জানালে হয়তো একটি সমাধান হতে পারে। ভাবনাকে কার্যে রূপান্তর করার পূর্বে একদিন ঘরে প্রবেশ করতেই এক ঝাঁক বোলতা এসে তাঁর মাথাসহ সমস্ত শরীর এমনভাবে কামড়ালো যে তিনি যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে গেলেন। ঘরে মানুষ থাকা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি আশ-পাশের মানুষেরও অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে। কেউই ঘরের কাছাকাছি যেতে সাহস পান না। উপায়ন্তর না দেখে ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর নিকট গিয়ে তার মাথা দেখিয়ে বললেন, এই দেখুন কি ধরণের বোলতা কামড় দিয়েছে। অস্থিরভাবে হাত জোড় করে তিনি ছাহেব কিবলাহকে বলতে লাগলেন, আপনি যদি মেহেরবানী করে আমার ঘরে তশরীফ নিয়ে এর একটা বিহিত ব্যবস্থা করেন। আপনাকে নেবার জন্য আমি ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে এসেছি। বাসা বেশি দূরে নয়। আমি আবার গাড়ি দিয়েই আপনাকে পাঠিয়ে দিব। নিরুপায় হয়ে ছাহেব কিবলাহ জনাব মাজুল্লাহ খাঁ সাহেবের সাথে তাঁর বাসায় উপস্থিত হলেন। ঘরের বাঁশের বেড়ার ছাদের উপর হাত ঢুকিয়ে বোলতার বাসাটি বের করে আনলেন। একটি বোলতাও বাসা থেকে উড়ল না। পরে বোলতাসহ বাসাটি শহরের বাইরে ফেলে দিলেন। [প্রাগুক্ত]
বরাক নদীর ভাঙ্গন রোধ
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর ছোট ছাহেবজাদা মাওলানা মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী বলেন, ফুলতলী ছাহেব একবার সপরিবারে ভারত সফরে গেলে আমিও ছাহেবের সাথে ছিলাম। দীর্ঘদিন যাবত ভারতের বরাক নদীতে প্রখর স্রোতের ফলে আশে-পাশের রাস্তা, বাড়িঘর বিশেষ করে একমাত্র হাইওয়েটি নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়। ভাঙ্গনরোধে স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও কোন লাভ হয়নি। ছাহেব কিবলাহর ভারত গমনের সংবাদ পেয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এলাকার গণ্যমান্য লোকজন ছাহেব কিবলাহর নিকট এসে উপরোক্ত ঘটনা বর্ণনা করেন এবং তাঁর কাছে দু‘আ চাইলেন। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তখন ঘটনাস্থলে গিয়ে দু‘আ করে আসলেন। এর পর থেকে তিনি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে দু‘আ করেছিলেন তা আর ভাঙেনি। এখন পর্যন্ত তা অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।
সূত্র : মুহাম্মদ আজিজুল হক সম্পাদিত
“দ্বীনী খিদমতে শতাব্দীর সেরা ব্যক্তিত্ব আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রহমতুল্লাহ আলাইহি”
ভেসে উঠল লাশ
জগন্নাথপুর বাজারের পার্শ্ববর্তী নলজুর নদীর অভ্যন্তরে ঘোষগাঁওয়ের খালের ডহর নামক স্থানে ঐ এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি আব্দুল মজিদ (প্রাক্তন মেম্বার), প্রতাব আলী ও নৌকার মাঝিসহ মোট চার ব্যক্তি সালিশ শেষে বাড়ি ফেরার পথে ঐ ডহরে এসে নৌকা ডুবে পানিতে নিমজ্জিত হন। দু’দিন অতিবাহিত হওয়ার পরেও লাশের কোনো সন্ধান না পেয়ে ফুলতলী ছাহেব (র.)-এর নিকট থেকে তাবিয এনে ঐ স্থানে ছাড়ার পর সাথে সাথে লাশ ভেসে উঠল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লাশ দেখে মনে হচ্ছিল যেন এই মাত্র মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তির লাশ ভেসেছে।
* জগন্নাথপুর গ্রামের একজন হিন্দু জেলে মাছ ধরতে গেলে প্রচ- ঝড়ে নৌকা ডুবে মারা যায়। তার লাশ খুঁজে না পেয়ে জগন্নাথপুরের মাস্টার রইছ আলী ছাহেবের বাসায় অবস্থানরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর নিকট থেকে পাট পড়া এনে নদীতে ছাড়ার সাথে সাথে রায়কান্তি পুলের নীচে লাশ ভেসে উঠল এবং স্বজনরা তাকে খুঁজে পেল।
* ইকড়ছই মাদরাসার সহকারী মৌলভী মাওলানা মফিজ উদ্দিন ছাহেব জানান, হাজী আছাব আলী সাহেবের ব্রিক ফিল্ডের নিকটস্থ ডহরে গোসলরত অবস্থায় আট বছরের একটি মেয়ে পানিতে ডুবে মারা যায়। তখন তারা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর নিকট থেকে তাবিয এনে ডহরে ছাড়ার পর মেয়েটির লাশ ভেসে উঠে। তিনি আরও জানান, সুনামগঞ্জ রোডের বর্তমান বাসস্ট্যান্ড এর পার্শ্ববর্তী জনাব কলিম উল্লার বাড়ি গাঙে ভেঙে নিয়ে গেলে ছাহেব কিবলাহ্র নিকট থেকে ইট পড়া এনে নদীতে ছাড়েন, এরপর নদীসহ পার্শ্ববর্তী সøুইস গেইটের জায়গাগুলো পলি মাটিতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
বর্ণনাকারী : মাওলানা মোঃ ছমির উদ্দিন
অধ্যক্ষ, ইকড়ই সিনিয়র আলিম মাদ্্রাসা জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ
‘ম্যালেটারি নদী’র ভাঙ্গন রোধ
বৃটেন প্রবাসী, আলমরক মসজিদের সেক্রেটারি মোঃ মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমার বাড়ি মীর্জাশহীদপুর, ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ। আমাদের বাড়ি ইসহাক মিয়া চৌধুরীর বাড়ি নামে পরিচিত। মোঃ ইসহাক মিয়া চৌধুরী আমার দাদা। আমাদের বাড়ির পেছনে একটি নদী আছে যার নাম ‘ম্যালেটারি নদী’। নদীতে একসময় ভাঙ্গন শুরু হলো। আমার দাদা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর শরণাপন্ন হলেন। অনুযোগ করে বললেন, ‘আমাদের বাড়ি-ঘর আর টিকবে না।’ ছাহেব কিবলাহ (র.) তখন একখানা কাগজে কিছু লিখে দিয়ে তা নদীতে ছেড়ে দিতে বললেন। কথামতো তাই করা হলো। এরপর থেকে নদী ভাঙ্গন বন্ধ হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত আমাদের বাড়ি-ঘর অক্ষত রয়েছে। সে সময় আমার বাবা মোঃ আতাউর রহমান চৌধুরীও জীবিত ছিলেন।
সংগ্রহকারী : হাফিয সাব্বির আহমদ, কভেন্ট্রি, ইউ.কে.
তাবিযের বরকতে রোগমুক্তি
১৯৯৭-এ বদরপুরস্থ দেওরাইল সিনিয়র মাদরাসায় অধ্যয়নকালে গড়কাপন গ্রামের মুজিবুর রহমান সাহেবের বাড়িতে এক বৈঠকী আলোচনায় বাঁশকান্দি মাদরাসার প্রধান মাওলানা আহমদ আলী সাহেবকে বলতে শুনেছি, ১৯৪৬-৪৭ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় অধ্যয়নকালে আহমদ আলি সাহেবের এক মারাত্মক রোগ দেখা দেয়। অনেক চেষ্টা ও তদবিরের পরও রোগের কোনো উপশম না হওয়ায় তিনি পড়া ছেড়ে দেওবন্দ থেকে বদরপুরে নিজ বাড়িতে চলে আসেন। এখানে আসার পর তৎকালীন আসাম-বাংলার শ্রেষ্ঠ ওলী আল্লামা ফুলতলী ছাহেবের মুরশিদ হযরত শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (ওরফে হাতিম আলী) ছাহেব (র.)-এর সমীপে উপস্থিত হওয়া মাত্রই তিনি বলেন, ‘আহমদ আলী, তোমার বদনজর লেগেছে। আব্দুল লতিফ (ফুলতলী ছাহেব)-এর কাছ থেকে একটি তাবিয গ্রহণ কর। নিরাময় হয়ে যাবে।’ ফুলতলী ছাহেবের কাছে উপস্থিত হলে তিনি আহমদ আলী সাহেবকে একটি তাবিয প্রদান করেন। এই তাবিযের বরকতে আহমদ আলী সাহেব রোগমুক্ত হন এবং তিনি পুনরায় দেওবন্দ গিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন।
ঘটনাটি মাওলানা আহমদ আলী সাহেবের মুখে শোনার কিছুদিন পর হোজাইয়ের মরকজুল মারিফ প্রকাশনী থেকে বদরুদ্দীন আজমলের বদান্যতায় প্রকাশিত আব্দুল জলিল রাগিবীর লিখিত মাওলানা আহমদ আলী সাহেবের জীবনীগ্রন্থ ‘উত্তর-পূর্ব ভারতের ওলীয়ে কামিল’ পুস্তকেও উল্লেখ পাই।
বর্ণনাকারী : এম. হাবিবুর রহমান লস্কর
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বহুগ্রন্থ প্রণেতা, ভাগাবাজার, কাছাড় (আসাম)।
সূত্র : মুহাম্মদ আজিজুল হক সম্পাদিত
‘দ্বীনি খেদমতে শতাব্দীর সেরা ব্যক্তিত্ব আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’
আল-মনসুর পাবলিকেশন্স, করিমগঞ্জ, আসাম (ভারত), জুলাই ২০০৮
দপ করে নিভে গেল আগুন
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তখন বয়সে তরুণ। তখন আছিমিয়া সিনিয়র মাদরাসার পূর্ব মাঠে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। বর্তমানে যেখানে একটি মসজিদ গড়ে উঠেছে, ঠিক সেই স্থানে আয়োজিত এক মাহফিলে তিনি বয়ান ফরমাচ্ছেন। বয়ান চলাকালীন পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে আগুন ধরেছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে একটি বাড়ি। আগুনের তীব্রতা দেখে মানুষ মাহফিল ছেড়ে ওই বাড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করেন। তখন ছাহেব কিবলাহ বয়ান থামিয়ে বললেন, আপনারা মাহফিল ভাঙ্গবেন না, বসে পড়–ন। ইনশাল্লাহ, আগুন এখনই থেমে যাবে। এই বলে টেবিলের উপর সজোরে থাপ্পড় মারলেন। সত্যিই, আল্লাহর কী দয়া। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল, আগুন থেমে যাচ্ছে। সবাই মাহফিলে চুপচাপ বসে রইলেন। ছাহেব কিবলাহ যথারীতি বয়ান করে গেলেন।
যুবক ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর সেদিনের কারামত যারা প্রত্যক্ষ করেছেন, তন্মধ্যে একজন হলেন ৬৭ বছর বয়সী রাতাবাড়ির হাফিয জহির উদ্দিন ছাহেব। তিনি এই ঘটনা বর্ণনা করেন। [সূত্র : প্রাগুক্ত]
বিষক্রিয়া উপশম হলো
মাওলানা আলিমুদ্দীন (ভাগাবাজার, কাছাড়, আসাম, ভারত) বলেন, ভাগাবাজারের (করিমগঞ্জ, আসাম) খলিলুদ্দীন লস্কর নামক এক ছাত্রের এইচ এস সি পরীক্ষার্থীর গণিত বিষয়ের পরীক্ষা খুবই খারাপ হয়। পরীক্ষা শেষে বাড়িতে আসার পর মনের দুঃখে সে বিষ পান করে ফেলে। বিষের প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তাকে সাথে সাথে নিয়ে যাওয়া হলো ভাগাবাজারস্থ হাজী তাবারক লস্করের বাড়িতে অবস্থানরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেবের কাছে। ফুলতলী ছাহেব পানিতে ফুঁক দিয়ে তাকে তা পান করান এবং দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করে তার জীবন ভিক্ষা চান। সাথে সাথে তার বিষক্রিয়া উপশম হয়। বিনা চিকিৎসায় বেচারা সুস্থ হয়ে ওঠে। তিনি আজও সুস্থ আছেন। [সূত্র : প্রাগুক্ত]
তাবিযের ভেতর পুত্রসন্তানের নাম
কাছাড় ভাগাবাজারের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন হাফিয আব্দুল জলিল। হাফিয শফিকুর রহমান নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর এক মেয়ের বিয়ে হয়। বিয়ের প্রায় দশ-বার বছর পর্যন্ত এ দম্পতির কোনো জীবিত সন্তানাদি ছিল না। হাফিয আব্দুল জলিল তাঁর মেয়ের বিবাহিত জীবনের এ সমস্যার কথা জানিয়ে ছাহেবের কাছে একটি তাবিযের জন্য আবদার করেন। ফুলতলী ছাহেব তাঁকে একটি তাবিয দিলেন এবং সেই সঙ্গে বললেন, এ তাবিযের ভিতরে একটি নাম আছে, সন্তান জন্ম হওয়ার পরে শিশুটির যেন এ নাম রাখা হয়। যথাসময়ে উক্ত মহিলার গর্ভে এক ফুটফুটে পুত্রসন্তানের জন্ম হলো। সঙ্গে সঙ্গে শিশুটির বাবা ফুলতলী ছাহেব প্রদত্ত সেই তাবিযটি স্বীয় শ্বশুর হাফিয আব্দুল জলিলের হাতে তুলে দিলেন। কী আশ্চর্য! হাফিয সাহেব কবয থেকে তাবিযটি খুলে দেখলেন যে, তাতে লেখা রয়েছে ‘মুহাম্মদ‘। পূর্ব নির্দেশমত এই শিশুটির নাম রাখা হলো মুহাম্মদ আহমদ হোসেন। ঘটনাটির সত্যাসত্য যাচাই করার জন্য হাফিয শফিকুর রহমানকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাঁর আনুপূর্বিক বর্ণনা দেন। [সূত্র : প্রাগুক্ত]
সুস্থ হলো কুকুরে কামড়ানো ছেলে
তখন সবে মাত্র দেশ স্বধীন হয়েছে। আমি আমার দোকানে কাজ করছিলাম। আমার বড় ছেলে নজরুল ইসলাম-এর বয়স তখন ৫-৬ বছর হবে। সে কুকুর নিয়ে খেলছিল। হঠাৎ কুকুরটি এসে তার মাথায় কামড় মারলো। সেদিন ছিল মঙ্গলবার, মাস ছিল ভাদ্র; কুকুরটি ছিল পাগল। এমতাবস্থায় বিষয়টি কুলক্ষণে মনে হলো। ছেলেকে নিয়ে কি করি চিন্তায় পড়ে গেলাম। ছাহেব কিবলাহ (র.) তখন সিলেট জেলা কারাগারে। তাঁকে ঘটনাটি বলা সমীচীন মনে করলাম না। যে যা বললো আমি তাই করতে লাগলাম। কিন্তু কোনো ফল পেলাম না। প্রতিষেধক ইনজেকশন মৌলভীবাজার, সিলেট খুঁজতে খুঁজতে কোথাও পেলাম না। একটা ইনজেকশন পেলাম, একজন রোগীর, তাও অনেক কষ্টের বিনিময়ে। ইনজেকশন দেবার পর কিছুটা সান্ত¡না পেলাম। ডাক্তার বললেন, আগামী দুই বৎসর এ রোগী কোন গোশত খেতে পারবে না। আমরা ছেলেকে গোশত না খাইয়ে রাখছিলাম। এ ঘটনার পরের মাস ছিল রামাদান শরীফের মাস। প্রতিদিন সেহরী খাবার পর আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম। ইতোমধ্যে আমার এ ছেলে অন্যান্য ছেলে মেয়েদের সাথে মক্তবে যেত। একদিন ঘুম থেকে উঠে আমার বিবি (স্ত্রী) দেখেন গোশতের পাতিলের ডাকনা উঠানো। তিনি আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন এবং দেখালেন যে ছেলে গোশত খেয়ে ফেলেছে। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। ডাক্তার বলেছিল দুই বছর গোশত না খাওয়াতে, এখন কি করি? ঘটনার ৩-৪ দিন পর আমি ফেঞ্চুগঞ্জে গিয়েছিলাম ব্যবসার কাজে। রাতে বাড়ি এসে শুনি কান্নার আওয়াজ, বললাম কি হয়েছে? আমার বিবি বললেন ছেলে পাগলামী শুরু করেছে। পানি দেখলে ভয় পায়, আগুন দেখলে ভয় পায়। এ অবস্থা শুনে ও দেখে আমারও কান্না আসল। এখন কি করব কিছু বুঝতে পারলাম না। পাশের বাড়ির লোকজনের সাথে পরামর্শ করলাম। তখনকার সময়ে এই এলাকায় ডাক্তার ছিলো না। হঠাৎ মনে হলো বাগানে একজন ডাক্তার আছেন তার কাছে নিয়ে যাই। তিনি ছেলেকে দেখে জিহ্বায় কামড় মারলেন। ডাক্তারের এ অবস্থা দেখে আমার আর বুঝতে বাকী রইল না। ভাবলাম ছেলেকে বুঝি হারাতে হবে। ডাক্তার কিছু ঘুমের ঔষধ দিয়ে দিলেন। বাসায় ফিরে এসে কি করা যায় তা নিয়ে সবার সাথে আলোচনা করলাম। মনে হলো ছাহেব কিবলাহর কাছে গিয়ে বললে তিনি হয়তো কিছু দিবেন। তাই আর দেরি না করে সকালে উঠেই সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ছাহেব কিবলাহ তখন জেলে। গিয়ে দেখি জেলের সামনে লাইনে দাঁড়ানো অনেক মানুষ। কেউ ছাহেব কিবলাহকে দেখতে এসেছেন, কেউ কিছু নিয়ে এসেছেন, আবার কেউ বিপদে পড়ে এসেছেন। সবার সাথে আমিও লাইনে দাঁড়াই। আমার সামনে যখন ৪-৫ জন মানুষ তখন ছাহেব কিবলাহ আমাকে ইশারা করলেন লাইন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্যে। আরও ২-৩ জনকেও এভাবে বললেন। সবার সাক্ষাৎ শেষ হওয়ার পর পুলিশ এসে আমাকে বলল ছাহেব কিবলাহ আপনাকে ডাকছেন। আমি গিয়ে ছাহেব কিবলাহর সামনে দাঁড়ানো মাত্রই তিনি বললেনÑকি হয়েছে দরছ মিয়া? আমি ছাহেব কিবলাহকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলি। ঘটনা শুনে ছাহেব কিবলাহ বললেন, আগে আসলে না কেন? আমি বললাম, আপনার এ অবস্থার মধ্যে আপনার কাছে আসা সমীচীন মনে করিনি। ছাহেব কিবলাহ তখন সৈয়দ সাহেবকে ডাক দিয়ে, কুরআন শরীফের একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, মনে আছে কি? সৈয়দ সাহেব বললেন জি, ছাহেব আমার মনে আছে। ছাহেব কিবলাহ বললেন, আপনি দরছ মিয়ার সাথে তার বাড়িতে যাবেন, বাড়িতে গিয়ে একটি মোরগ জবাই করে রান্না করার পর তরকারীতে ফুঁক দিয়ে আপনি, দরছ মিয়া এবং তার ছেলেকে নিয়ে একসাথে বসে খাবেন। এ কথা বলার পর ছাহেব কিবলাহ বললেন, গাড়ির সময় হয়ে গেছে আপনারা এখন রওয়ানা দিন। আমরা মেইল ট্রেনে সিলেট থেকে কুলাউড়ায় এসে ফুলতলায় আসি। বাড়ি এসে পৌঁছালে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমাকে দেখে আমার বিবি কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ছাহেব কিবলাহ কি দিয়েছেন? কি নিয়ে এসেছেন তাড়াতাড়ি দিন। সান্ত¡না দিয়ে বললাম আমাদের একটু সময় দাও এবং আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা কর। আর একটা মোরগ নিয়ে আস যবাই করার জন্য। মোরগের কথা শুনতেই বললেন, মোরগ দিয়ে কি হবে? আমি বললাম, খাব। নিজ হাতে যবাই করলাম। রান্না শেষে আমার ছেলে ও সৈয়দ সাহেবকে নিয়ে এক সাথে খেতে বসলাম। সৈয়দ সাহেব ঐ আয়াত পড়ে তরকারীতে ফুঁক দিলেন। তারপর আমরা তিনজন বসে ভাত খেলাম। এ অবস্থা দেখে আমার বিবি বললেন, গোশত খেয়ে আমার ছেলে পাগল হয়েছে আবার তাকে গোশত দিচ্ছেন। সৈয়দ সাহেব বললেন, বাবা তুমি বেশি বেশি করে গোশত খাও তোমার কোনো রোগ নেই। ভাত খাওয়া শেষ হলে আমার ছেলে লম্বা ঘুম দিয়ে পরদিন দুপুর ১২টায় উঠে। তখন থেকে তার আর কোনো সমস্যা হয়নি।
বর্ণনাকারী : হাজী দরস মিয়া
ফুলতলা, জুড়ি, মৌলভীবাজার
সংগ্রহকারী : ফজলুল হক খান সাহেদ ও বদরুল ইসলাম
কুলাউড়া, মৌলভীবাজার
তথ্যসূত্র :
১. আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) প্রদত্ত হাদীসের সনদ।
২. আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.), আল কাউলুছ ছাদীদ।
৩. শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (র.), মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৭১।
৪. আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) প্রদত্ত তরীকদের সনদ।
৫. নির্দেশিকা, দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট, প্রধানকেন্দ্র ফুলতলী ছাহেব বাড়ি।
৬. বিশেষ ক্রোড়পত্র, দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট : দৈনিক ইনকিলাব ৩১ মার্চ, ২০০২, ১৬ মুহররম ১৪২৩।
৭. মদীনার রাহগীর, পৃষ্ঠা ৬
৮. আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) প্রদত্ত দালাইলুল খায়রাতের সনদ।
৯. নালায়ে কলন্দর, আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ, কাব্যানুবাদ: সৈয়দ শামসুল হুদা, পৃষ্ঠা ২৩
১০. নালায়ে কলন্দর, আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ, কাব্যানুবাদ: মাওলানা কবি রূহুল আমীন খান, পৃষ্ঠা ২৭
১১. ইয়াকুবিয়া হিফযুল কুরআন বোর্ড সম্পর্কে কিছু কথা, হাফিয মাওলানা ফখরুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী, গুলশানে লতিফী, পৃষ্ঠা ৫
১২. যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোর তথ্য নেয়া হয়েছে দারুল হাদীস লতিফিয়ার প্রিন্সিপাল জনাব মাওলানা মোহাম্মদ হাসান চৌধুরী ও শাহজালাল মসজিদ এন্ড ইসলামিক সেন্টারের ইমাম ও খতীব মাওলানা খায়রুল হুদা খান থেকে।
১৩. নির্দেশিকা, দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট, প্রধানকেন্দ্র ফুলতলী ছাহেব বাড়ি।
১৪. হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র নিকট থেকে হাদিস শরীফের সনদ গ্রহণকারী শাগরিদবৃন্দ কর্তৃক প্রকাশিত ‘রাহী মদীনা’।
১৫. দালাইলুল খায়রাত এর সনদ বিতরণ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত মদীনার রাহ্গীর, পৃষ্ঠা ৫।
১৬. ইবতেহাল; বাদেদেওরাইল ফুলতলী আলিয়া মাদরাসা, কামিল ২০০২ ঈসায়ী সনের বিদায়ী ছাত্রগণ।
১৭. ‘গুণীজনের মূল্যায়ন’-এর অধিকাংশই আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) স্মারক থেকে নেয়া। (দ্রষ্টব্য : পৃষ্ঠা ৬৭৩-৬৮৬)
১৮. বক্তব্যটি আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) স্মারক-এ গ্রন্থিত অ ঝঢ়রৎরঃঁধষ গধংঃবৎ এর অনুবাদ। (দ্রষ্টব্য : পৃষ্ঠা ৫০-৫১)
১৯. বক্তব্যটি আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) স্মারক থেকে নেয়া। (দ্রষ্টব্য : পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭)
২০. বক্তব্যটি আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) স্মারক থেকে নেয়া। (দ্রষ্টব্য : পৃষ্ঠা ৭২-৭৩)
২১. কারামতগুলো আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) স্মারক থেকে নেয়া। (দ্রষ্টব্য : পৃষ্ঠা ৬৪১-৬৭০)