কারামত’ শব্দটি আরবি একবচন। বহুবচনে ‘কারামাত’। এর অর্থ বিশেষ ক্ষমতা, মর্যাদা ও সম্মান ইত্যাদি। শরিয়তের দৃষ্টিতে কারামত হলো- মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর পছন্দের বান্দাদের থেকে এমন কিছু কাজ প্রকাশ করেন, যা দ্বারা তিনি তাদের সম্মানিত করেন, যা অস্বাভাবিক ও অলৌকিক। নবী-রাসূলদের পরই এই বান্দাদের মর্যাদা, যাদের ওলি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘জেনে রাখ, নিশ্চয় যারা আল্লাহর ওলি তাদের কোনো ভয় নেই এবং নেই কোনো চিন্তা।’ (সূরা ইউনুস-৬২)। আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দাদের বৈশিষ্ট্যের সর্বোচ্চ নিদর্শন ‘মোজেজা’ ও ‘কারামত’। মোজেজা প্রকাশ পায় নবী ও রাসূলদের মাধ্যমে, আর কারামত হক্কানি আউলিয়ায়ে কেরামদের জন্য নির্ধারিত।
আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বান্দাদেরকে তার অসংখ্য নিয়ামত অবলোকন করান। কখনও সেগুলো সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়, কখনও গোপন থাকে। প্রিয় বান্দাগণের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা যেসব অলৌকিক ঘটনা বা অপ্রাকৃতিক বিষয় প্রকাশ করেন, সেগুলোকে কারামত বলা হয়। কারামত কখনও বান্দার নিজস্ব ক্ষমতা বা ইচ্ছায় সংঘঠিত হয় না। একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ও তার ক্ষমতায় বান্দার হাতে কারামত প্রকাশিত হয়। এক্ষেত্রে বান্দা উপলক্ষ মাত্র। মূল ক্ষমতা ও ইচ্ছা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার। কোন ব্যক্তি যদি প্রকৃত অর্থে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয় এবং তার থেকে অস্বাভাবিক কোন কারামত প্রকাশিত হয়, তবে এটা অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে বর্ণিত কারামতের সত্যতা যাচাই করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে সংগঠিত কারামত হোক, কিংবা ঐতিহাসিক সূত্রে বর্ণিত হোক, কারামতে বিশ্বাস স্থাপন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মৌলিক আকিদার একটি অংশ। কেউ যদি বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী হয়ে কারামত অস্বীকার করে তাহলে সে শুধু আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত থেকে বের হবে না, সেই সাথে ঈমানহারা হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসসমূহে অসংখ্য কারামত বর্ণিত হয়েছে। মৌলিকভাবে কারামত অস্বীকারের অর্থ হল কুরআন ও হাদীসের এসব ঘটনা অস্বীকার করা। কারামত থেকে শিরক অনুসন্ধানের চেষ্টাও একটি ইমান বিধ্বংসী প্রয়াস।
সাধারণ কারামতকে শিরক আখ্যা দিয়ে কাউকে মুশরিক বললেই বিষয়টি শেষ হয় না, হুবহু একই পর্যায়ের ঘটনা বা এর চেয়েও অস্বাভাবিক ঘটনা কুরআন ও হাদীসে থাকতে পারে। একজন সাধারণ বুজুর্গের একটি কারামতকে শিরক আখ্যা দিয়ে তাকে যদি মুশরিক বলেন, তাহলে এর চেয়েও অস্বাভাবিক যেসব ঘটনা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোকে কেন শিরক বলেন না? একজন সাধারণ বুজুর্গের কারামত কোন কিতাবে উল্লেখ করাকে কেন্দ্র করে যদি উক্ত কিতাবের লেখককে শিরকের অপবাদ দেন, কোন সুনির্দিষ্ট কিতাবে কারামত উল্লেখের কারণে সেটাকে যদি শিরকের উৎস বলা হয়, তাহলে এর চেয়ে অস্বাভাবিক কারামত যেই কুরআন ও হাদীসে রয়েছে, সেটা কি তাদের শিরকের অপবাদ থেকে মুক্ত থাকে? নাউযুবিল্লাহ কারামত অস্বীকারকারীদের মনস্তত্ব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমাদের গা শিউরে ওঠে।
হ্যাঁ, কারামত বর্ণিত হলে সেটার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, কিন্তু কারামতে অস্বাভাবিক ক্ষমতা প্রকাশ ইত্যাদির কারণে তাকে শিরকের অপবাদ মূর্খতা ছাড়া কিছুই নয়। কেননা প্রত্যেক কারামতের মাঝেই অস্বাভিবক কুদরত সংশ্লিষ্ট বিষয় থাকে। কারামত অস্বীকারকারীদের এই মনস্তত্ব অনুযায়ী সকল কারামতই শিরক হতে বাধ্য।
ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.) ‘আল ফিকহুল আকবর’-এ ওলির সংজ্ঞায় বলেছেন, ওলি ওই ব্যক্তি, যিনি আল্লাহ তায়ালার জাত ও সিফাতগুলোর মারেফাত তথা পরিচয় লাভ করেছেন। সাধ্যানুযায়ী ইবাদত-বন্দেগিতে লিপ্ত রয়েছেন। যাবতীয় কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা ও আনন্দ-উপভোগ থেকে বিমুখতা অবলম্বন করেন এবং যাবতীয় গুনাহের কাজ থেকে দূরে থাকেন।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা হচ্ছে, ‘কারামাতুল আউলিয়ায়ে হাক্কুন’, অর্থাৎ আউলিয়ায়ে কেরামদের কারামত সত্য। এগুলো তাদের উচ্চ কামালাত তথা মর্যাদার সাক্ষ্য বহন করে বটে; কিন্তু কখনও তারা এসবের মাধ্যমে নিজেদের জনসমাজে প্রকাশ করেন না। ওলিদের যে কারামত সংঘটিত হয়, এগুলো তাদের অনিচ্ছায় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় অলৌকিকভাবে সম্পন্ন হয়। ঘটনাচক্রে বা ক্ষেত্রবিশেষে ওলিদের মাধ্যমে কারামত প্রকাশ পায়। প্রকৃতপক্ষে যিনি আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দা অর্থাৎ যারা আল্লাহর ওলি তাদের কারামত আল্লাহ পাকের জাত, সিফাত ও এলমে মারফতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যে ব্যক্তি শরিয়তের পূর্ণ অনুসারী কেবল তার দ্বারা কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটলেই এটিকে কারামত বলা হয়। যে ব্যক্তি আমলের ক্ষেত্রে শরিয়তের খেলাপ করে সে যদি চেষ্টা-সাধনা করে কোনোরূপ অলৌকিক কাজ প্রদর্শন করে তবে এটিকে কারামত বলে না। তাই জাদুকর, কাফের বা যোগী-সন্ন্যাসীদের দ্বারা যে অস্বাভাবিক কাজ প্রদর্শিত হয় সেগুলো কখনও কারামত নয়। এসবকে ‘এসতেদরাজ’ বলে। ওলি থেকে কারামত প্রকাশ পাওয়া জায়েজ ও অস্বাভাবিক। এটি সহিহ দলিলের মাধ্যমে প্রমাণিত। প্রকৃত মুসলমান একে অস্বীকার করতে পারে না। কারণ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ওলিদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। সূরা তওবার ১১৯নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও। এখানে সত্যবাদী বলতে ওলিদের বোঝানো হয়েছে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া কারামতের বাস্তবতা সম্পর্কে বলেন, “পূর্ণতা মূলত তিনটি বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। ১. ইলম বা জ্ঞান ২. কুদরত বা ক্ষমতা। ৩. গিনা বা অমুখাপেক্ষীতা। এই তিনটি বিষয়ের পরিপূর্ণতা একমাত্র আল্লাহর রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তার ইচ্ছায় কোন বান্দাকে এই তিনটি বিষয়ের কিছু অংশ কারামত হিসেবে দান করে থাকেন। ইলম বা জ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট কারামতের উদাহরণ হল, কেউ এমন কিছু শ্রবণ করা যা অন্য কেউ শোনে না। জাগ্রত বা ঘুমন্ত অবস্থায় এমন কিছু দেখা অন্য অন্যরা দেখে না। ওহী (নবীদের ক্ষেত্রে) বা ইলহাম (ওলীদের ক্ষেত্র) এর মাধ্যমে এমন কিছু জানা, যা অন্যরা জানতে পারে না। অথবা কারও উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ ইলম অবতীর্ণ হওয়া। অথবা এমন বিচক্ষণতা যা আল্লাহ তায়ালা দান করে থাকেন। এগুলোকে কাশফ ও মুশাহাদা (অদৃশ্য বা গায়েবী বিষয় অবলোকন), মুকাশাফা (অদৃশ্য বিষয় উন্মোচন), মুখাতাবা (অদৃশ্য কথোপকথন) ও বলা হয়ে থাকে। কুদরতের সাথে সংশ্লিষ্ট কারামতের উদাহরণ হল, কোন কিছুর উপর তা’সীর বা ক্ষমতা প্রয়োগ। কখনও এটি মনোবল, সত্যবাদীতা বা দুয়া কবুলের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কখনও আল্লাহর পক্ষ থেকে কাজটি সম্পন্ন হয়। এক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির নিজস্ব প্রভাব থাকে না। যেমন, কোন ব্যবস্থা নেয়া ছাড়াই শত্রু মৃত্যুবরণ করা। যেমন হাদীসে কুদসীতে রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে আমার ওলীর সাথে শত্রুতা রাখে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। একইভাবে কোন বুজুর্গের প্রতি কারও মনকে আকৃষ্ট করে দেয়া বা তার মহব্বত কারও অন্তরে সৃষ্টি করা। এসকল ক্ষেত্রে বুজুর্গের কোন নিজস্ব প্রভাব থাকে না। একইভাবে কাশফের কিছু বিষয়ও কুদরতের সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন বুজুর্গের বিভিন্ন হালত অন্যের সামনে প্রকাশিত হওয়া।" (আল-মু’জিযা ওয়াল কারামত, পৃ. ৯-১০-১১)
ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এর উপর্যুক্ত বক্তব্য অনুযায়ী প্রত্যেকটি কারামতে অস্বাভাবিক ক্ষমতা বা গায়েবী বিষয়ের ইলম সংশ্লিষ্ট। সুতরাং কারামতকে যারা শিরক আখ্যা দেয়, তাদের মনস্তত্ব অনুযায়ী সকল কারামতই শিরক। নাউযুবিল্লাহ। কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত কারামত ও অন্যান্য কিতাবে বর্ণিত কারামতের মাঝে তাদের নিকট পার্থক্য এটুকু যে কুরআন ও হাদীসের কারামতকে মুখ ফুটে সরাসরি শিরক আখ্যা দেয় না, কিন্তু অন্যান্য কিতাবের কারামতকে অবলীলায় শিরক আখ্যা দেয়। এছাড়া শিরকের কারণ বর্ণনার ক্ষেত্রে এদুয়ের মাঝে তাদের নিকট কোন পার্থক্য নেই। মোটকথা, তথাকথিত সালাফী ও আহলে হাদীসদের যারা কারামতকে শিরক আখ্যা দেয়, তাদের মনস্তত্ব অনুযায়ী সকল কারামতই শিরক। সেটি কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হোক, কিংবা অন্য কোন ঐতিহাসিক গ্রন্থে বর্ণিত হোক। তবে পার্থক্য এতটুকু যে, ঐতিহাসিক গ্রন্থে বর্ণিত কারামতকে সরাসরি শিরক বলে কিন্তু সাধারণ মানুষের ভয়ে কুরআন-হাদীসের কারামতকে শিরক বলা থেকে বিরত থাকে। আল্লাহ এসকল কারামত অস্বীকারকারীদেরকে হেদায়াত দান করুন। আমিন ॥