আরবিতে 'মালাইকা' । ইহার একবচন 'মালাক' 'হামযা' ব্যতীত এবং এইরূপই কুরআন মজীদে সর্বত্র লিখিত হইয়াছে । মালাক শব্দের আভিধানিক অর্থ দূত বা সংবাদবাহক । এইজন্যই কোরআনে ফেরেশতার জন্য রুসুল শব্দো ব্যবহৃত হয়েছে । কোরআন হাদীস ও তাফসীর গ্রন্থসমূহে ফেরেশতা সম্পর্কে যেইসব গুরুত্বপূর্ন বিষয় বর্নিত রহিয়াছে তাহা নিম্নরুপঃ
১) উহারা অদৃশ্য দেহধারী এমন এক মাখলুক যাহাদিগকে নূর দ্বারা সৃষ্টি করা হইয়াছে
২) তাহাদের পালক থাকে
৩) তাহারা যেকোন স্থুল আবরন ভেদ করিতে সক্ষম
৪) তাহাদের দেহ সূক্ষ্ণ ও বায়বীয় ধরনের
৫) বিভিন্ন প্রকার দেহ ধারন করিতে সমর্থ । তাহারা আসমানে অবস্থান করেন ।
৬) আল্লাহ্ তা'আলা তাঁদের মাধ্যমে অনেক কার্য সমাধা করাইয়া থাকেন ।
৭) তাহাদের গতির পরিমন্ডল আসমান হইতে জমিন পর্যন্ত এবং অতঃপর আসমান হইতে আরো উর্ধে আরেক সীমানা পর্যন্ত ব্যাপৃত
৮) ফেরেশতাগণ সরাসরি আল্লাহ্ তা'আলার নিকট হইতে নির্দেশ লাভ করেন এবং তাহারই ফয়সালা ও মর্জিমাফিক কার্্য ও উপাদানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন ।
৯) তাহারা আল্লাহ্ ও সৃষ্টির মধ্যে সংবাদ বহনের দায়িতব সম্পাদন করেন । আল্লাহ্ প্রদত্ত বিধানের মাঝে তাহারা নিজেদের পক্ষ হইতে কোন রদবদল করিতে পারে না
১০) সর্বক্ষন তাহারা আল্লাহ্ তা'আলার হাম্দ, মহিমা ও তার রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ) এর উপর দরুদ সালাম পাঠে রত থাকেন ।
ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ) এর নাম কুরআনে তিনবার অলিখিত হইয়াছে । তাহার নাম সম্পর্কে মুসলিম শরীফে উল্লেখ আছে । জীবরাঈল (আঃ) কে অনুক্ত 'রুহুল আমীন' (বিশ্বস্ত আত্মা) নামে উল্লেখ রয়েছে । তিনি মুহাম্মাদ(সঃ) এর ক্বালবে সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় প্রত্যাদেশ (ওহি) বহন করিয়া আনিতেন । কোরআনের আরও কিছু জায়গায় তিনি অনুক্ত রহিয়াছেন
তিনি সরাসরি মুহাম্মাদ (সঃ) এর নিকট ওহি বহন করিয়া আনিতেন
অতঃপর আমি তার কাছে আমার রূহ প্রেরণ করলাম
— সূরা ১৯, আয়াত ১৭
তথ্যসূত্র
· ইসলামী বিশ্বকোষ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ)
· · মুসলিম শরীফ, ঈমান অধ্যায়, হাদীস নং ২৮০
· · সূরা ২৬, আয়াত ১৯৩ - ১৯৫
· · সূরা ৫৩, আয়াত ৫-১৮
· · সূরা ৮১, আয়াত ১৯ -২৫
· সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ)
ফেরেশতা সম্পর্কিত আক্বীদা
ফেরেশতাবৃন্দ আল্লাহ্তায়ালার দাস। তাঁরা ভুলভ্রান্তি এবং গোনাহ্ থেকে সুরক্ষিত ও পবিত্র। আল্লাহ্তায়ালার আদেশ তাঁরা যথাযথভাবে পালন করেন। এসম্পর্কে আল্লাহ্তায়ালার এরশাদ এরকম
এবং যাহাই আদিষ্ট হয়, তাহাই করে’
— সূরা তাহরীম, ৬ আয়াত
ফেরেশতাদের পানাহারের প্রয়োজন হয় না। তারা না নারী; না পুরষ । কোনো কোনো ফেরেশতাকে আল্লাহ্পাক রেসালত বা সংবাদ বহনের জন্য নির্বাচনকরেছেন, যেমন মানুষের মধ্যেও রসুল বা বাণীবাহক আছেন। আল্লাহ্পাকের এরশাদ
আল্লাহ ফেরেশতা এবং মানুষের মধ্য থেকে রসুল নির্বাচন করে থাকেন।
— সূরা হজ, ৭৫ আয়াত
সত্যবাদী আলেমগণের অধিকাংশের মত এই যে, বিশিষ্ট মানুষ বিশিষ্ট ফেরেশতা থেকে শ্রেষ্ঠ। তবে ইমাম গাজ্জালী র. ইমামুল হারামাইন আব্দুল মালেক র. এবং ‘ফুতুহাতে মক্কিয়া’র রচয়িতা শায়েখ মুহিউদ্দিন আরাবী র. বিশিষ্ট ফেরেশতাকে বিশিষ্ট মানুষ থেকে শ্রেষ্ঠ’বলে মত প্রকাশ করেছেন।
হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি র. বলেন, এই ফকিরের প্রতি যা উদ্ভাসিত হয়েছে তা এই- ফেরেশতাগণের বেলায়েত বা নৈকট্য নবী আ.গণের বেলায়েত থেকে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু নবুয়ত এবং রেসালতের মধ্যে নবী-রসুলগণের এমন এক মর্যাদা আছে, যা ফেরেশতাগণের কোনোদিনই লাভ হবার নয়। এই মর্যাদামাটির কারণে হয়েছে, যে মাটি ফেরেশতাদের মধ্যে নেই। এ প্রসঙ্গে এই ফকিরেরনিকট আরো প্রকাশ পেয়েছে যে, কামালতে নবুয়তের (সংবাদ প্রেরণ সম্পর্কিত পূর্ণতার) তুলনায় কামালতে বেলায়েতের (নৈকট্যসম্ভূত পূর্ণতার) কোনোই মূল্য নেই। আক্ষেপ! যদি মহাসাগরের তুলনায় একবিন্দু পানির অস্তিত্বতুল্যও হতো! অতএব বুঝতে হবে, বেলায়েতজাত উৎকর্ষ অপেক্ষা নবুয়তজাত উৎকর্ষ বহুগুণবেশী। তাই, একথা নিশ্চিত যে, নবী-রসুলগণই সাধারণ শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।
ফেরেশতাগণের শ্রেষ্ঠত্ব আংশিক। কাজেই সত্যবাদী অধিকাংশ আলেমগণ যা বলেছেন, তা-ই ঠিক। আল্লাহ্পাক তাঁদের প্রচেষ্টা সফল করুন। আমিন।
এই আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার যে, কোনো ওলি কখনো নবীর স্তরে উপনীত হতে পারেন না। সর্বাবস্থায় ওলির মস্তক নবীর পদতলে। জানা আবশ্যক যে, কোনো মাসআলার ব্যাপারে আলেম ও সুফী সমাজের মধ্যে দ্বিমত দেখা দিলে আমি দেখি, আলেমগণের পক্ষই অধিক সত্য। এর রহস্যএই যে, পয়গম্বর আ. এর অনুসরণের কারণে তাঁদের লক্ষ্য কামালতে নবুয়তের এলেমের (ওহীজাত এলেমের) প্রতি স্থিরনিবদ্ধ থাকে। আর সুফীগণের দৃষ্টি নিবদ্ধথাকে কামালতে বেলায়েতজাত মারেফাতের দিকে। তাই বেলায়েত থেকে গৃহীতএলেম অপেক্ষা নবুয়তের তাক থেকে গৃহীত এলেম অধিকতর স্পষ্ট ও সঠিক হয় । ফেরেশতাগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফেরেশতা চার জন ।
১. হজরত জিবরাইল আ. ইনি রসুলগণের নিকট ওহী বা প্রত্যাদেশ বহন করে নিয়ে আসেন ।
২. হজরত মীকাইল আ. এর উপর সমস্ত সৃষ্টজীবের জীবিকা পৌঁছানোর দায়িত্ব দেওয়াহয়েছে। জীবিকার বণ্টন-বিভক্তি ও পরিমাণ নির্ধারণের দায়িত্ব তাঁর উপরেই ন্যস্ত।
৩. হজরত ইস্রাফিল আ. ইনি শিঙ্গা ধারণ করে আছেন। তাঁর শিঙ্গার প্রথম ফুৎকারে কিয়ামত এবং দ্বিতীয় ফুৎকারে হাশর অনুষ্ঠিত হবে।
৪. হজরত আজরাইল আ. ইনি সমস্ত সৃষ্টজীবের রূহ কবজ করার দায়িত্ব পালন করেন।
এই চারজন ছাড়া আরো অনেক উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং আল্লাহ্তায়ালার নৈকট্যভাজন ফেরেশতা আছেন। তাঁদের মধ্যে আটজন মহাসম্মানিত ফেরেশতা আল্লাহ্তায়ালার আরশ ধরে আছেন। এঁরা আকারে অতি বৃহৎ। তাঁদের কানেরলতি থেকে কাঁধ পর্যন্ত দূরত্ব দুশ’বছরের পথের দূরত্বের সমান। আরেক বর্ণনায়বলা হয়েছে, সাতশ বছরের রাস্তার দূরত্বের সমান।
শায়েখ আব্দুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী র. বলেন এ কথার উপর বিশ্বাসরাখা কর্তব্য যে, আল্লাহ্তায়ালাই ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা নূরের তৈরী । তাঁরা যে কোনো আকার ধারণ করতে পারেন। তাঁদের রূহ এবং শরীরই তাঁদের পোশাক । ফেরেশতাদের মধ্যে নারী পুরুষ বলে কিছু নেই। তাঁদের বংশবিস্তারও নেই। আকাশ ও পৃথিবীর সকল জায়গায় তাঁরা কর্মরত। তাঁরা এই বিশ্বজগতের তত্ত্বাবধায়ক এবং রক্ষণাবেক্ষণকারী । একজন মানুষের সঙ্গে কয়েকজন ফেরেশতাথাকেন। কেউ আমল লেখেন, কেউ হেফাজত করেন শয়তান এবং ক্ষতিকর অনেক কিছু থেকে। ঊর্ধ্ব ও অধঃ জগতের সকল পরিসর তাঁদের কার্যতৎপরতায় মুখর। হাদিস শরীফে এসেছে, সমগ্র সৃষ্টিজগতকে দশভাগে ভাগ করলে নয় ভাগহবে শুধু ফেরেশতা। ফেরেশতারা পাখা অথবা বাহুবিশিষ্টও হন । তাঁদের মধ্যেকারো কারো দুই, তিন কিংবা চার জোড়া পর্যন্ত পাখা হয়। কোরআন মজীদে ফেরেশতাদের বাহু সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে । সুতরাং এর উপরে ইমান রাখা জরুরী । তবে ফেরেশতাদের পাখার সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা একমাত্র আল্লাহ্তায়ালারই আছে। এরকম ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, পাখা তাদের শক্তিরপ্রতীক । ফেরেশতাদের নেতা হজরত জিবরাইল আ. এর ছয়শত পাখাদেখেছিলেন রসুলে আকরম স. । মেরাজ বিষয়ক হাদিসে এরকম বিবরণ আছে । এক হাদিসে এসেছে, রসুলে করিম স. বলেন, প্রত্যেক ইমানদার ব্যক্তির উপর আল্লাহ্তায়ালার পক্ষ থেকে তার নিরাপত্তার জন্য তিনশ ষাট জন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকেন । তাঁরা তাঁর প্রত্যেক অঙ্গের হেফাজত করেন । তার মধ্যে সাতজন ফেরেশতা রয়েছেন কেবল চোখের নিরাপত্তা বিধানের কাজে নিয়োজিত। নিশ্চিত ও নির্ধারিত নয়, এরকম বিপদাপদ থেকে তাঁরা মানুষকে এমনভাবে নিরাপদ রাখেন, যেমন মধুর পাত্রের দিকে ছুটে আসা মাছির দলকে পাখা ইত্যাদির সাহায্যে তাড়িয়ে দেয়া হয় । মানুষের জন্য এরকম নিরাপত্তা-ব্যবস্থা না থাকলে শয়তান তাকে ছিনিয়ে নিত ।