জন্ম ও পরিচয়ঃ হযরত গোলাব শাহ (র) ১৭৭৫ ইংরেজি সিলেট জেলার মৌলভীবাজার মহকুমার ইদিলপুর (ফতেপুর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বাজ খা। তিনি তার পিতা মাতার দ্বিতীয় সন্তান। বড় ভাইয়ের নামগুলজার খা। তার গুরু ছিলেন সাধক সদাই শাহ (র)। বাল্যকালে তিনি পিতা মাতাকে হারান। ভাই গুলজার খা তাকে খুব স্মেহ করতেন। গোলাবশাহ (র) বাল্যকালে খুব গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। মনে হত যেন সামাজিক লোকাচারমেনে চলা তার পক্ষে দুরুহ। তার এই অবস্থা দেখে বড় চিন্তিত হলেন। ভাইকে তিনি বুঝিয়ে শুনিয়ে পরিবর্তন করতে চাইলেন। কিন্তু সব বৃথা। তার কোন পরিবর্তন হল না।
আধ্যাত্মিক জীবনঃ হঠাৎ একদিন গোলাবশাহ (র) বাড়ী থেকে উধাও হয়ে যান। সবাই তাকে অনেক খোজাখোজি করলেন। কিন্তু পাওয়া গেলনা। তিনি পীর সদাই শাহ (র) এর সান্নিধ্য চলে গেলেন। দুনিয়ার মায়া মমতা ছেড়ে দিয়েখোদার ধ্যানে মগ্ন থাকেন। কিছুদিন পর একদল শিকারী ইদিলপুরের জঙ্গলে গোলাবশাহ (র) কে ধ্যান মগ্ন অবস্থায় দেখতে পান। খবর পেয়ে তার ভাই তাকে নিয়ে আসতে চান। কিন্তু পথিমধ্যে লোকজনের অসাবধানতার সুযোগেতিনি নদীতে লাফিয়ে পড়েন এবং নদীর অপর পাড়ে উঠে জঙ্গলে নিখোঁজ হয়ে যান। অনেক তল্লাশির পর খুজে পাওয়া যায়নি। এর ৬/৭ বছর পর তিনি নদী তীরে বাহাদুপুরের বালুচর নামক স্থানে আবির্ভূত হন। এস্থানে কেহ তাকেপাগল বলে জানত,কেউ কামিল ফকির বলে জানত, আর শ্রদ্ধাভাজন মামু ডাকত। এখানে তার আলোকিক ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন আশেপাশের কারো কোন বিপদ ঘনিয়ে আসলে সেখানে গিয়ে বাশের কাঞ্চি বা লাঠিদিয়ে ঝোপ জঙ্গলের উপর এলোপাথাড়ি পিটাতেন। এতে ঐ স্থানের লোকজন বুঝত যে তাদের কোন বিপদ ঘনিয়ে আসছে। তাই তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রার্থনা করত। ক্রমে তা চারিদিকে জানাজানি হয়ে গেল। লোকজনেরভক্তি-শ্রদ্ধা তার প্রতি বেড়ে গেল। তার অনেক শিষ্য জুটে গেল। তিনি লোকালয় ছেড়ে ঘিলাছড়া পাহাড়ে চলে যান। ঘিলাছড়া পাহাড় জন্তু-জানোয়ারে ভরপুর। কিন্তু তিনি এসবের ভয়ে ভিত নন। কারণ তিনি তখন সাধারণ মানবঅনুভুতির উর্দ্ধে। সেখানে তিনি গাছের ফল-ফলাদি খেয়ে বাচতেন। কিছুদিন পর তিনি আবার লোকালয়ে চলে আসেন। বালাগঞ্জে আস্তানা গড়েন। সেখানে তার কাছে দূর দুরান্ত থেকে লোকজন আসত।
বিয়ানীবাজারের কসবায় আগমনঃ তখন কসবা গ্রামের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ব্যবসার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বালাগঞ্জ। হযরত গোলাবশাহ (র) এর কথা জেনে তাকে কসবায় আনার অনুরোধ করারজন্য তার আস্তানায় গমন করেন। তারা গোলাবশাহ (র) এর আস্তানায় গমন করার সাথে সাথে তিনি তাদের উদ্দেশ্যের কথা বলে ফেলেন। এতে ব্যবসায়ীরা বিস্ময়ে অবিভৃত হয়ে যান। গোলাবশাহ (র) বলেন কসবায় তিনি যাবেনকিন্তু বালাগঞ্জের মানুষ তাকে যেতে দিবেনা। ব্যবসায়ীরা গোলাবশাহ (র) জানান যে, কসবাতে গেলে সেখানকার লোকেরা খুশি হবে। কসবা খাদিম বাড়ীতে পীর জলিল উদ্দিন (র) নামে একজন মহাপুণ্যবান লোক রয়েছেন।হযরত গোলাবশাহ (র) সেই পীর ছাহেবের সান্নিধ্যে সময় কাঠাতে পারবেন। আবার আসলে তারা গোলাবশাহ (র) কে কসবা নিয়ে যাবেন। এই বলে তারা চলে যান। কয়েকদিন পর কসবার ব্যবসায়ীরা আরো অনেক লোকজন সহবালাগঞ্জ পৌছেন এবং হযরত গোলাবশাহ (র) কে নিয়ে আসার জন্য নৌকার চড়ার অনুরোধ করেন। এতে বালাগঞ্জের লোকজন বাধা দেয় এবং গোলাবশাহ (র) কসবা আসার বিষয়ে কিছু অমত পোষণ করেন। কিন্তু কসবারলোকজন এক রকম জোর করে তাকেই নৌকায় তুলে নেন। নৌকাতে চড়েও তিনি বালাগঞ্জে রয়ে যাওয়ার জন্য নেমে যেতে চান। এমনকি প্রতিমধ্যে মাঝে মাঝে নদীতে ঝাপ দিতে চান। কিন্তু লোকজন খুব সাবধান থাকাতে তাসম্ভব হয়নি। তাই তিনি তখন চিৎকার করে বলছিলেনঃ-
মোরে লইয়া যায়রে
ও তোমরা দেখ আইয়ারে
ও তোমরা আইলানারে
পঞ্চখন্ডি নাইয়া মোরে
লইয়া যায়রে।
এখানে এসে হযরত গোলাবশাহ (র) পীর জলিল উদ্দিন ছাহেবের কাছে উঠেন। এটা সম্ভবত ঃ উনবিংশ শতকে গোলাবশাহ কসবায় আসেন। তখন খাসা গ্রামস্থ হিন্দু জমিদার কৃষ্ণ চন্দ্র পাল ও কৃষ্ণ কিশোর পাল তার প্রতি খুবইশ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেন। তার আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতি মুগ্ধ উক্ত জমিদারদ্বয় তাদের কিছু ভুমিতে গৃহ নির্মাণ করে তাকে দানক্রমে তার আস্তানার ব্যবস্তা করে দেন। যা পরবর্তীকালে গোলাবশাহের মোকাম বা ইমামবাড়ী নামে খ্যাতহয়েছে।
ইমামবাড়ীতে মসজিদ নির্মাণঃ হযরত গোলাবশাহ (র) ইমামবাড়ীতে একটি মসজিদ নির্মাণের মনস্থ করেন। কারিগরদের মসজিদ নির্মাণ করতে হুকুম দেন। তিনি রীতিমত কারিগরদের মজুরী দিয়ে দিতেন কিন্তু কারো কাছেকোনদিন পয়সা চাইতেন না। লোকে বলাবলি করতে লাগলো গোলাবশাহ (র) টাকা তৈরী করতে জানেন। এদিকে মসজিদ নির্মাণ শেষ হলো। শেষে দেখা গেল কারিগরদের কিছু মজুরী বাকী আছে তখন হযরত গোলাবশাহ (র) চিৎকার করতে শুরু করলেন যে, কে তার টাকা চুরি করেছে। তিনি এ জন্য কারিগরদের মজুরী শোধ করতে পারছেন না। তিনি চোরের উদ্দেশ্যে দা হাতে নিয়ে খুব আস্ফালন আর চিৎকার শুরু করে দিলেন। কারিগরেরাতোঅবাক এমন সময় অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তি এসে হযরত গোলাবশাহ (র) কে কিছু যেন দিল আবার চলে গেল। এ অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিকে কারিগরেরা আর কোনদিন দেখেনি। হযরত গোলাবশাহ (র) তাদের সম্পুর্ণ মজুরী শোধকরে দিলেন। মসজিদ তৈরী হল।
ইমাম নিয়োগঃ কিন্তু নামাজ পড়াবে কে? মসজিদের ইমাম হবে কে? হযরত গোলাবশাহ (র) কে সকলে ধ্যানী মৌন সাধক বলে জানত কিন্তু কেউ কোনদিন তাকে প্রকাশ্যে নামাজ পড়তে দেখেনি। তিনি স্থানীয় মৌলানা জনাব তাজমোহাম্মদকে তার মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার অনুরোধ জানান। মৌলানা প্রথমে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন পরে রাজি হন। মসজিদে নিয়মিত লোকজন নামাজ পড়তে শুরু করে। হযরত গোলাবশাহ (র) প্রতি শুক্রবারমসজিদে শিন্নি দিতেন।
কাবাশরীফে নামায আদায়ঃ মসজিদের ইমাম সাহেব গোলাবশাহ (র) কে প্রায়ই বলতেন আপনার মসজিদ নির্মাণের কোন স্বার্থকতা নেই কারণ আপনি নিজেই নামাজ পড়েন না। মসজিদ নির্মাণের ব্যয় ব্যয়ভার নিজ পয়সাকরেননি। গোলাবশাহ (র) নিরুত্তর থাকতেন। তিনি একদিন ইমাম সাহেব ডেকে বললেন অনেকদিন তোমরা আমাকে নামাজের কথা বলছ এখন নামাজের সময় হয়েছে চল পুকুর ঘাটে আমাকে গোসল করিয়ে দাও তোমাদেরনামাজ পড়ব। ইমাম সাহেব তাকে পুকুরে নিয়ে গেলেন। পুকুরে নেমে গোলাবশাহ (র) ইমাম একটু ধরতে ইমাম সাহেব অসাড় হয়ে গেলেন। এবং পুকুরে নেমে পড়লেন। পুকুর পাড়ে অপেক্ষামান লোকজন এসব দেখে ভয় পেয়ে গেল।কিছু পরে দুজনেই গোসল করে উঠলেন। কিন্তু কারো মুখে কথা নেই নিশ্চুপ,নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণ পর ইমাম সাহেব বললেন তোমরা নামাজ পড়ে নাও আমরা দুজনে কাবাশরীফে নামাজ আদায় করে এসেছি। এতে হযরত গোলাবশাহ (র) এর নামাজ পড়া সংক্রান্ত এত দিনের ভ্রান্তি সকলের মন থেকে দূর হয়ে যায়।
কারামতঃ শ্রীধরার সোনা মিজ্ঞা নামে এক নিসন্তান ব্যক্তি হযরত গোলাবশাহ (র) এর সেবা করতেন। এ সোনা মিজ্ঞাকে দোয়া করে গিয়েছিলেন। পরে সোনা মিজ্ঞার সাতজন পুত্র সন্তান জন্মেছিল। এর মধ্যে একজন খুব উচুস্তরেরকামেল ব্যক্তি হয়েছিলেন। তার নাম মুন্সী হাসান আলী।
ইন্তেকাল ও পুর্ব পশ্চিমে কবরঃ একদিন হযরত গোলাবশাহ (র) লোকজনকে ডেকে বললেন, আমার সময় শেষ হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন আমার মৃত্যুর পর আমাকে আমার আস্তানাতেই কবরস্থ করিও। আমার মাথা পশ্চিমেরেখে কবরে শোয়াইও। না হয় মসজিদের দিকে আমার পা পড়বে। হযরত গোলাবশাহ (র) নিজ অন্তিম সময় ঘোষণার পর মাত্র এক সপ্তাহ জীবিত ছিলেন। তিনি নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অনন্ত শান্তির জগতে পাড়ি জমালেন।তার অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী মসজিদের পার্শ্বে পুর্ব পশ্চিম করে তাকে শান্তির শয্যায় শায়িত করা হয়।
তথ্যসুত্রঃ গোলাবশাহ দর্পন নামক বইয়ের ২৬-২৭-২৮ নম্বর পৃষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ইমরান হোসেন হীরার লেখা থেকে নেওয়া।
তথ্য সংগ্রহ করতে সহযোগিতা করেছেন, জায়েদ আহমদ নয়ন, কসবা, বিয়ানীবাজার, সিলেট।