দশ তারিখের রাত্রি হল, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) তাঁর সফর সঙ্গীদের সবাইকে একত্রিত করলেন এবং বললেন, আমার প্রিয় সাথীরা! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আন্তরিকভাবে সন্তুষ্ট । আমি সানন্দে তোমাদেরকে অনুমতি দিচ্ছি যে, আজ রাতে তোমরা যে যেদিকে পার চলে যাও। এইসব ইয়াযীদী বাহিনীর লোকেরা আমার রক্ত পিপাসু। এরা একমাত্র আমার রক্তেই পরিতৃপ্ত হবে। তোমরা চলে যাও, তোমাদের জান বেঁচে যাবে। কিন্তু তাঁর সাথীদের মধ্যে একজনও যেতে রাজী হলেন না । বরং বললেন, এ নাজুক সময়ে আপনাকে শত্রুদের হাতে সোপর্দ করে কিভাবে চলে যেতে পারি! এ রকম পরিস্থিতিতে যদি আপনাকে ফেলে আমরা চলে যাই, কাল ক্বিয়ামতের মাঠে আমরা আল্লাহর রসূল (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে কিভাবে মুখ দেখাব? আল্লাহ্র রসূল (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলবেন, তোমরা নিজেদের জানকে আমার প্রিয় দৌহিত্র হুসাইন এর জান থেকে প্রিয় মনে করেছ এবং তোমরা আমার দৌহিত্রকে শত্রুদের অস্ত্রের মুখে সোপর্দ করে চলে গেছ । না!না!! কিছুতেই আমরা আপনাকে ফেলে চলে যেতে পারি না। আমরা আপনার সাথেই থাকবো এবং আমরা আমাদের জানকে পতঙ্গের মতো উৎসর্গ করবো।
যখন কেউই যেতে রাজি হলেন না, তখন হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বললেন, তাহলে শুন! যদি তোমরা হুসাইনের সাথে থাকার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হও, তাহলে তোমরা ধৈর্য এবং আত্ম-বিশ্বাসে শিশাঢালা প্রাচীরের মতো অটল হয়ে যাও। এমন দৃঢ় ও অটল হয়ে যাও, যেন জুলুম-অত্যাচারের বিভীষিকা তোমাদের পদস্খলন ঘটাতে না পারে। বাতিলের সাথে মোকাবিলা করার সময়টা হলো, আমাদের পরীক্ষার সময়। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর বান্দাদের থেকে পরীক্ষা নিয়ে থাকেন । এখন আমাদের সামনে মুছীবতের পাহাড় । সমস্ত দুঃখ-দূর্দশা আমাদেরকে ধৈর্য সহকারে অতিক্রম করতে হবে। আল্লাহর রাস্তায় অটল থাকতে হবে এবং এভাবে অটল থেকে শাহাদাতের শরবত পান করতে হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদাহরণ রেখে যেতে হবে । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর এ কথা তাঁর সাথীদের মধ্যে যথেষ্ট ধৈর্য শক্তি সৃষ্টি করলো । তাঁর (রাঃ) সকল সাথী তাঁর জন্য জান কুরবান করতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং সকলেই শাহাদাত বরণের জন্য অনুপ্রাণিত হয়ে গেলেন এবং ধৈর্য ও ত্যাগ স্বীকারের জন্য দৃঢ় পাহাড় হয়ে গেলেন । রাত একটু গভীর হলে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) তাঁর সাথীদের বললেন, তোমরা কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম করো। সকাল বেলা আল্লাহর হুকুমে যা হওয়ার তাই হবে ।
তাঁর সাথীরা সবাই নিজ নিজ তাঁবুতে চলে গেলেন এবং তিনি নিজের তাঁবুতে কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন হলেন । কুরআন তিলাওয়াত করতে করতে তাঁর তন্দ্রাভাব আসায় তিনি কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়লেন । তখন তিনি স্বপ্নে দেখলেন, তাঁর নানাজান (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাশরীফ এনেছেন এবং তাঁকে কোলে নিয়ে নিলেন এবং তাঁর বুকে হাত মুবারক রেখে বললেন-
اللهم ات الحسين صبرا واجرا অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ ! হুসাইনকে ধৈর্য ও পূণ্য দান করুন
এবং হুসাইনকে আরও বললেন,
তোমার উপর যা হচ্ছে, তা থেকে আমি বেখবর নই। আমি সবকিছু দেখছি। তোমার বিরুদ্ধে যারা তলোয়ার, তীর ইত্যাদি নিয়ে এসেছে, তারা সকলেই আমার শাফায়াত থেকে বঞ্চিত।
হুযূর (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটা বলে ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর অন্তরকে ধৈর্য এবং স্থিরতার খনি বানিয়ে চলে গেলেন । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ঘুম থেকে উঠে তাঁর বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবার পরিজনকে স্বপ্নের কথা শুনালেন। ফজরের নামাযের পর তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলেন- ‘ইয়া আল্লাহ! আপনার রাস্তায় আমাকে অটল রাখুন, মওলা ! ধৈর্য এবং সহনশীলতা দান করুন । হে মাওলা! জুলুম-অত্যাচারের ঝড় তুফান আমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে, আপনি আমাকে অটল থাকার তাওফীক দান করুন, যেন জুলুম-অত্যাচার আমাকে পদচ্যুত করতে না পারে।’ এভাবে তিনি মুনাজাত করছিলেন আর তাঁর (রাঃ) সাথীরা আমীন, আমীন বলছিলেন।
এদিকে পিপাসাকাতর আল্লাহর নেক বান্দাগণ ধৈর্য এবং সহনশীলতার জন্য আল্লাহ পাক উনার কাছে প্রার্থনা করছেন, অন্যদিকে ইয়াযীদের সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছে । দুর্যোগের কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল, ইয়াযীদের সৈন্যরা লম্ফ-ঝম্ফ দিতে লাগল, তাদের মধ্যে কতেক জাহান্নামী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর তাঁবুর আশে-পাশে চক্কর দিতে লাগল এবং গর্ব ও অহংকারভরে হুঙ্কার দিয়ে বলতে লাগল, এমন কোন বাহাদুর আছ? থাকলে আমাদের মোকাবিলায় আস । ইত্যবসরে যালিমদের মধ্যে কেউ হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম উনার তাঁবুর দিকে তীর নিক্ষেপ করল এবং মোকাবিলার জন্য হুঙ্কার দিল।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর অনুসারীদের শাহাদাত
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর সাথীরা, যারা শাহাদাত বরণ করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন, তাঁরা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর অনুমতি প্রার্থনা করলেন । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) তাঁদেরকে অনুমতি দিলেন । অনুমতি পেয়ে তারা বীর বিক্রমে যুদ্ধ ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন । তিন দিনের পিপাসাকাতর এবং ভুখা সঙ্গীরা সবর এবং ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠাদেখালেন । ভুখা ও পিপাসার্ত হলে কি হবে, তারা ঈমানী বলে বলীয়ান ছিলেন । এদের একজন ওদের দশজনের থেকেও অধিক শক্তিশালী ছিলেন । প্রচন্ড যুদ্ধ করে অনেক ইয়াযীদী বাহিনীকে জাহান্নামে পাঠিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেরা এক এক করে শাহাদাত বরণ করেন । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) নিজের চোখের সামনে তাঁর এই পঞ্চাশজন সাথীর শাহাদাত বরণ দেখলেন । এত কিছু দেখার পরও তিনি ধৈর্যচ্যুত হলেন না; তাঁর (রাঃ) সাথীদের বুকে তীর নিক্ষেপ অবলোকন করছেন আর বলছেন-
رضيت بقضائك ‘রদ্বীতু বিক্বদ্বায়িকা’ অর্থাৎ মাওলা! আমি আপনার ইচ্ছা এবং আপনার সিদ্ধান্তের উপর রাজী ।
পঞ্চাশজন সাথী শহীদ হওয়ার পর তাঁর (রাঃ) মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন আপনজন ছাড়া আর কেউ রইলো না।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর মর্মস্পর্শী ভাষণ এবং হুরের সপক্ষ ত্যাগ
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর আপন জনের মধ্যে ভাই ছিল, ভ্রাতুষ্পুত্র ছিল, ভাগিনা ছিল এবং ছেলে ছিল । তিনি কাউকে কিছু না বলে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ইয়াযীদের সৈন্যদের সামনে গেলেন এবং বললেন,
তোমাদের মধ্যে আহলে রসূল (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাহায্যকারী কেউ আছো কি? এ সঙ্কটময় মুহূর্তে আওলাদে রসূল (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাহায্যকারী কেউ আছো কি? আহলে রসূল (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহায্য করে বেহেশ্তে গমনের ইচ্ছুক কেউ আছো কি ?
তাঁর এ আহবানে ইয়াযীদী বাহিনীর হুর বিন ইয়াযীদ রিয়াহীর অন্তরে বিপ্লব শুরু হয়ে গেল । সে ঘোড়ার উপর অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো । তার এই অবস্থা দেখে তার এক সঙ্গী জিজ্ঞাসা করলো- হুর! কি হল? তোমার এই অবস্থা কেন? তোমাকে বড়ই ব্যতিব্যস্ত দেখাচ্ছে কেন ? আমি তোমাকে অনেক বড় বড় যুদ্ধ ময়দানে দেখেছি । কিন্তু কোন সময় তোমাকে আমি এ রকম অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখিনি । কিন্তু এখন তোমার এই অবস্থা কেন ? হুর বলল, কি বলবো, আমি আমার একদিকে বেহেশ্ত দেখছি আর এক দিকে দোযখ । মাঝখানে অস্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছি এবং কি করব তা চিন্তা করছি । একদিক আমাকে দোযখের দিকে টানছে আর একদিক বেহেশ্তের দিকে আহবান করছে । এটা বলার পর পরই তিনি ঘোড়াকে চাবুক মেরে এক নিমিষে ইয়াযীদী বাহিনী থেকে এ বলে বের হয়ে আসলেন, ‘যেতে হলে বেহেশ্তেই যাব।’ শত্রু বাহিনী থেকে বের হয়ে হুর জোর গলায় বললেন, দেখ, জাহান্নাম থেকে আল্লাহওয়ালা বের হচ্ছে ।
আসলে একজন বের হয়ে আসার দ্বারা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বাহিনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন হল না । আর ইয়াযীদী বাহিনীরও হাজারের মধ্যে একজন চলে যাওয়ায় তেমন কোন ক্ষতি হলো না । কিন্তু আসল কথা হলো, হুর ছিল বেহেশ্তী কিন্তু অবস্থান করছিল দোযখীদের সাথে ।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) তাঁর আধ্যাত্মিক দূরদৃষ্টি দ্বারা অবলোকন করলেন যে, জান্নাতী দোযখীদের মধ্যে অবস্থান করছে । তাই ইমাম হুসাইন (রাঃ) ডাক দিলেন, তাঁর ডাকটা ছিল হুরের ইয়াযীদী বাহিনী থেকে বের হয়ে আসার একটা উপলক্ষ মাত্র । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর দ্বারা তাঁর বেহেস্তের রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেল । হুর বের হয়ে সোজা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর সামনেআসলেন এবং বলতে লাগলেন,
ওগো রসূল (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর আওলাদ! আপনি যে ডাক দিয়েছেন, ‘এ নাজুক সময়ে আওলাদে রসূল (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাহায্য করে বেহেশ্তে যাওয়ার মত কেউ আছে কিনা’ আমি সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ইয়াযীদ বাহিনী থেকে বের হয়ে এসেছি । তাই আমি যদি আজ আপনার সাহায্যার্থে জান কুরবান করি, তাহলে সত্যিই কি আপনার নানাজান (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এর শাফায়াত নসীব হবে?
উনি বললেন, ইনশাআল্লাহ হবে । হুর বললেন, আপনি আমার জন্য দুয়া করুন, আল্লাহ তায়ালা যেন আমার বিগত দিনের পাপ মাফ করে দেন এবং আমার গড়িমসিকে ক্ষমা করে দেন । আমি আপনার পক্ষে জান কুরবান করার জন্য যাচ্ছি । এ বলে হুর কোমর থেকে তলোয়ার বের করে ইয়াযীদী বাহিনীর সামনে গেলেন । হুরকে দেখে ইয়াযীদী বাহিনীর সেনাপতি আমর বিন সা’দ সৈন্যদেরকে বললো, দেখ, হুর ছিল আমাদের বাহিনীর সেনাপ্রধান । সে এখন আমাদের শত্রুদের হাতে হাত মিলিয়েছে । সে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে । তোমরা তাকে এমন শিক্ষা দাও, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে শিক্ষণীয় হয়ে থাকে । এরপর ইয়াযীদী বাহিনী চারিদিক থেকে আক্রমণ শুরু করলো । হযরত হুরও এমন জোরে আক্রমণ শুরু করে দিলেন যে, ইয়াযীদী বাহিনীর জন্য যেন খোদার গযব নাযিল হলো। শেষ পর্যন্ত তিনি ক্ষত-বিক্ষত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন।
চাচাত ভাই ও সৎভাই এর শাহাদাত
হযরত হুরের শাহাদাতের পর হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর সামনে হযরত আকিলের বংশধর হযরত মুসলিমের ভাই আব্দুল্লাহ বিন আকিল (রাঃ) এসে দাঁড়ালেন এবং অনুমতি প্রার্থনা করলেন । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং কপালে চুমু দিয়ে অনুমতি দিলেন । তিনি যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে নিজের শৌর্য বীর্য প্রদর্শন করে অনেক ইয়াযীদী সৈন্যকে হত্যা করে পরিশেষে শাহাদাত বরণ করলেন ।
এবার হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর ভাই হযরত আবু বকর (রাঃ) অনুমতি নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হলেন। শেরে খোদার আওলাদ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রমাণ করলেন যে, তাদের বাহুতে শেরে খোদার শক্তি রয়েছে । যুদ্ধের মাঠে তাঁরা যে বীর বিক্রমের পরিচয় দিয়েছেন, তা কারবালার মাটিতে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে । তিনিও অনেক ইয়াযীদী বাহিনীকে খতম করে শেষ পর্যন্ত নিজে শাহাদাত বরণ করেন ।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন হাসান (রাঃ) এর শাহাদাত
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর সামনে তাঁর আপন ভাতিজা, হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) এর নয়নের মণি এবং হযরত ফাতিমাতুয্ যুহরা (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) এর দৌহিত্র উপস্থিত হলেন । তিনি যুদ্ধে গমনের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন । তিনি তাঁর(রাঃ) ভাতিজার প্রতি অশ্রুসজল নয়নে তাকালেন এবং বললেন, ‘তোমরা আমার সাথে এসেছিলে এ উদ্দেশ্যে যে, চাচার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় তাঁর ভক্ত ও মুরীদানদের বাড়িতে যাবে এবং কয়েকদিন আনন্দ-আহ্লাদ করবে । আমিও তোমাদেরকে তলোয়ার ও তীরের আঘাত খাওয়ার জন্য সঙ্গে আনিনি । শোন! ওরা আমার রক্তের পিপাসু, তোমাদের রক্তের জন্য লালায়িত নয় । তোমাকে আমি অনুমতি দিতে পারিনা । তুমি আশ্রয় শিবিরে ফিরে যাও এবং তোমার মা-বোনদের সাথে মদীনা মুনাওয়ারায় চলে যেও। কিন্তু ভাতিজা বার বার বলতে লাগলেন, চাচাজান! আমাকে আপনার হাতে বিদায় দিন এবং আপনার বর্তমানেই জিহাদের ময়দানে যাওয়ার অনুমতি দিন । আমি জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছার জন্য অস্থির । চাচাজান! দীর্ঘ তিনদিনের পিপাসায় খুবই কষ্ট পাচ্ছি । এখন মন চাইছে যে, যত তাড়াতাড়ি পারি জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে আপন পিতা ও দাদাজানের হাতে হাউজে কাওছারের পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করি । ভাতিজার জান-কুরবানীর জন্য এ রকম দৃঢ় সংকল্পবোধ দেখে তাঁকে নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন; অতঃপর অশ্রুসজল নয়নে অনুমতি দিলেন ।
হযরত আলী (রাঃ)এর দৌহিত্র, হযরত ইমাম হাসান (রাঃ)এর নয়নমণি হযরত আব্দুল্লাহ বিন হাসান (রাঃ) কারবালার মাঠে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত চমকাতে লাগলেন এবং ইয়াযীদী বাহিনীর সাথে মোকাবিলা করে অনেক ইয়াযীদী সৈন্যকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে নিজে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে শেষ পর্যন্ত শাহাদাত বরণ করেন ।
হযরত ইমাম কাসেম (রাঃ) এর শাহাদাত
আল্লাহ ! আল্লাহ ! এবার হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর সামনে যিনি এসে উপস্থিত, তিনি হলেন তার প্রিয় ভাতিজা হযরত ক্বাসিম (রাঃ), যাঁর সাথে তাঁর মেয়ে হযরত সখিনা আলাইহাস সালাম উনার বিবাহের আগাম ওয়াদা ছিল। হযরত ক্বাসিম রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন ঊনিশ বছরের নওজোয়ান। যখন তিনি তাঁর নওজোয়ান ভাতিজা তথা সখিনার হবু জামাতাকে সামনে দেখলেন, তখন তিনি কেঁদেদিলেন এবং বললেন, বাবা! আমি তোমাকে কিভাবে বিদায় দিতে পারি? তোমাকে কিভাবে আমি তীর খাওয়ার অনুমতি দিতে পারে ? তোমাকে কি আমি তলোয়ারের আঘাত খাওয়ার অনুমতি দিতে পারি? প্রিয় ভাতিজা! দেখ, আমার ভাইয়ের এটা একান্ত আশা ছিল যে, সখিনার বিবাহ যেন তোমার সাথে হয়। ওগো আমার প্রিয় ভাতিজা! তুমি মদীনা মুনাওওয়ারায় ফিরে গিয়ে আমার মেয়ে সখিনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আমার ভাইয়ের আশা পূর্ণ করো। কিন্তু হযরত ক্বাসিম (রাঃ) বললেন, চাচাজান! আমার আব্বাজানের আরও একটি আশা ছিল, সেটা হলো, আমার আব্বাজান আমার গলায় একটা তাবিজ দিয়েছিলেন এবং ওসীয়ত করে গিয়েছেন যে,
বাবা! এ তাবিজটা তখনই খুলে দেখিও, যখন কোন বড় মুছীবতের সম্মুখীন হও এবং সেই মতে আমল করিও।
তাই আমি এ মুহূর্তে তাবিজটা খুলে দেখলাম। কারণ এর থেকে বড় মুছীবত আর কী হতে পারে! তাবিজ খুলে যা লিখা দেখলাম তাহলো-
ওহে আমার প্রিয় বৎস ক্বাসিম! এমন এক সময় আসবে, যখন আমার ভাই কারবালার মাঠে শত্রু পরিবেষ্টিত হবে। শত্রুরা উনার জানের পিপাসু হবে, বৎস! তুমি যদি সত্যিকার আমার ছেলে হও, তখন নিজ জানের কোন পরওয়া করো না। বরং নিজের জান চাচার জন্য উৎসর্গ করে দিও। কারণ, সেই সময় হুসাইনের জন্য যে জান কুরবানী দেবে, আল্লাহ তায়ালার দরবারে সে খুবই উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে।
তাই চাচাজান! আমাকেও আপনার হাতে বিদায় দিন। আমি আপনার পরে জীবিত থাকতে চাই না। আমাকে বিদায় দিন, আমি যাতে সহসা জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারি এবং আব্বাজানকে গিয়ে বলতে পারি, আব্বাজান! আমি আপনার আশা পূর্ণ করে এসেছি।’
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) শেষ পর্যন্ত তাঁকেও বুকে জড়িয়ে ধরে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে বিদায় দিলেন। হযরত ইমাম ক্বাসিম (রাঃ) ইয়াযীদী বাহিনীর বড় বড় যোদ্ধাকে টুকরো-টুকরো করে ফেললেন। ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যে বাহাদুরী দেখিয়েছিলেন, তা দেখে ইয়াযীদী বাহিনীর জাদরেল সৈন্যরাও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এ বাহাদুরও আঘাতের পর আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে গেলেন । এভাবে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর চারজন ভাতিজা শহীদ হন।
ভাগিনাদ্বয়ের শাহাদাত
চার ভাতিজার শাহাদাতের পর তাঁর আপন বোন হযরত যয়নাব (রাঃ) তাঁর দুই অবুঝ সন্তান হযরত মুহম্মদ এবং হযরত আউনকে নিয়ে তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন, ভাইজান! আপনার এ ভাগিনাদ্বয়ও আপনার জন্য জান কুরবান করতে প্রস্তুত। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বললেন, বোন! এদেরকে তীরের আঘাত খাওয়ার জন্য সাথে আনা হয়নি। আমার সামনে তাঁদেরকে বর্শার অগ্রভাগে ঝুলানো হবে, তা আমার সহ্য হবে না। তুমি তাঁদেরকে নিয়ে যাও এবং আশ্রয় শিবিরে গিয়ে অবস্থান করো।’ বোন বললেন, ভাইজান! কক্ষনো তা হতে পারে না, আমি চাই আমার সন্তানদ্বয় আপনার জন্য কুরবান হোক। আমি যেন জান্নাতুল ফিরদাউসে গিয়ে আমার আব্বাজানকে বলতে পারি, আমার দু’টি ছেলেকেও আপনার সন্তানের জন্য কুরবানী দিয়েছি। তাই আপনি এদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরুন এবং বিদায় দিন।
বোনের বার বার আকুতি-মিনতির কারণে তিনি তাঁদেরকেও যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠালেন। হযরত যয়নাব (রাঃ) তাঁর নয়নমণি ও জানের জান সন্তানদের প্রতি নিজের অগাধ মায়া-মমতাকে ধামাচাপা দিয়ে সন্তানদ্বয়কে বিদায় দিলেন। এ কঁচি ছেলেদ্বয় বেশি দূর অগ্রসর হতে পারল না। ইয়াযীদী বাহিনীর যালিমেরা এসে তাঁদেরকে বর্শার অগ্রভাগে উঠিয়ে নিল।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এ দৃশ্য দেখে দৌঁড়ে গেলেন এবং ভাগিনাদ্বয়ের লাশ কাঁধে নিয়ে আশ্রয় শিবিরের কাছে এনে রাখলেন এবং বোনকে ডাক দিয়ে বললেন, ওহে জয়নাব! তোমার আরজু পূরণ হলো। তোমার সন্তানদ্বয় জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে তৃষ্ণা নিবারণ করছে। মা শহীদ ছেলেদ্বয়ের পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ফেললেন এবং ছেলেদের মাথার চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে বুলিয়ে বললেন, বাবারা! তোমাদের প্রতি তোমাদের মা খুবই সন্তুষ্ট। তোমরা তোমাদের মামার জন্য জান-কুরবান করেছ এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে গেছ।
হযরত আব্বাস (রাঃ) এর শাহাদাত
হযরত ইমাম (রাঃ) বোনের হাত ধরে জোর করে বোনকে নিয়ে তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। সেখানে গিয়ে আর এক দৃশ্য দেখলেন, তাঁর ছয় মাসের দুগ্ধ পোষ্য সন্তান হযরত আলী আছগর তৃষ্ণায় ছটফট করছিল এবং তাঁর জিহ্বা বের হয়ে গিয়েছিল। ছেলের মা বললেন, বাচ্চার এই অবস্থা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মুখ দিয়ে তাঁর কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। যে কোন প্রকারে ওর জন্য একটু পানি সংগ্রহ করুন। হযরত আব্বাস (রাঃ) পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এ কথা শুনে একেবারে ব্যাকুল হয়ে পড়লেন এবং বললেন, ভাইজান! আমাকে অনুমতি দিন, আমি এই মুহূর্তে গিয়ে ফোরাত নদী থেকে পানি নিয়ে আসি এবং সেই পানি পান করিয়ে এ বাচ্চার তৃষ্ণা নিবারণ করি। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বললেন, ভাই! একটু সবর করো, সে জান্নাতুল ফিরদাউসে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করবে। কিন্তু হযরত আব্বাস (রাঃ) বললেন, ভাই! বড় পরিতাপের বিষয়। আমাদের বর্তমানে একটি মাছূম শিশু এভাবে তৃষ্ণায় মারা যাবে, তা কখনো হতে পারে না। আমরা কী সেই শেরে খোদার আওলাদ নই, যিনি খায়বারের বৃহৎ দরজা হাতের উপর তুলে নিয়েছিলেন? আমি কোন বাধা মানতে রাজী নই, এ মুহূর্তে পানি নিয়ে এসে এ মাছূম বাচ্চার তৃষ্ণা মিটাবো।
অতঃপর মশক নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে তিনি ফোরাত নদীর দিকে ধাবিত হলেন এবং ফোরাত নদীর কাছে গিয়ে অতিদ্রুত ঘোড়া থেকে অবতরণ করে মশক ভরে পানি নিলেন এবং মুখ বন্ধ করে কাঁধের উপর উঠালেন এবং নিজ হাতে এক অঞ্জলি পানি মুখের কাছে নিলেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে তৃষ্ণার্ত ভাতিজার কথা মনে উদিত হলো। ভাতিজা যেন বললো, ‘চাচাজান! আপনার উচিত নয় যে, আমার আগে পানি পান করা। আপনি আলী আছগরের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পানি নিতে এসেছেন, নিজের জন্য নয়। প্রথমে আপনার মাছূম ভাতিজার তৃষ্ণা নিবারণ করান। এর পরেই আপনি পান করুন।’ শেষ পর্যন্ত হাতে নেয়া পানি ফেলে দিলেন এবং ঘোড়াকে নদীর কিনারা থেকে যখন উপরে উঠালেন, তখন ইয়াযীদের যালিম বাহিনীরা তাঁকে ঘিরে ফেলল। তিনি এ অবরোধ ভেদ করে অগ্রসর হলেন। ওরা পুনরায় অবরোধ করলো। তিনি এটাও প্রতিহত করলেন। এভাবে অবরোধ প্রতিহত করে ইয়াযীদী বাহিনীর অনেককেই জাহান্নামে পাঠিয়ে তিনি অগ্রসর হচ্ছিলেন । কিন্তু তিনি ছিলেন একা আর ওরা ছিল চার হাজারেরও অধিক। ওরা পুনরায় চারিদিক থেকে ঘিরে বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ করতে লাগল এবং তাঁর শরীর তীরের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল। এভাবে তীরের আঘাতে যখন তাঁর শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হয়ে গেল, কাপুরুষ ইয়াযীদ বাহিনী বুঝতে পারলো যে, তিনি অনেক কাবু হয়ে গিয়েছেন। তাই নিকটবর্তী হয়ে পিছন দিক থেকে একজন তরবারীর আঘাতে তাঁর বাম হাত কেটে ফেলল। বাম হাত কেটে ফেলার ফলে মশক পড়ে যাচ্ছিল। শেরে খোদার আওলাদ তখনও সাহস হারাননি। তিনি মশক ডান কাঁধে নিয়ে নিলেন। সেই যালিমরা ডান হাতটাও কেটে ফেলল। মশক তখন পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শেরে খোদার আওলাদ-এর হিম্মত দেখুন, তিনি দুই বাজু দিয়ে মশক আঁকড়িয়ে ধরলেন। এবার বাজুদ্বয়ও কেটে ফেলল কাফিররা। এখন এমন কিছু নেই যে ঘোড়ার লাগাম ধরবেন, এমন কোন হাত নেই যে তলোয়ার চালনা করবেন, এমন কিছু নেই যে মশক আঁকড়িয়ে ধরবেন।
শেষ পর্যন্ত তিনি দাঁত দিয়ে মশকের মুখ কামড়িয়ে ধরলেন। যালিমরা তীর নিক্ষেপ করে মশক ফুটা করে দিল এবং পানি সব পড়ে গেল। এই অবস্থা দেখে তিনি দাঁতের কামড় থেকে মশক ছেড়ে দিলেনএবং বলতে লাগলেন, হে আলী আছগর! এ অবস্থায় আমি কিভাবে তোমার তৃষ্ণা নিবারণ করি? আমিতো তোমার তৃষ্ণা নিবারণে কামিয়াব হতে পারলাম না। তিনি ঘোড়ার উপর বসা অবস্থায় ছিলেন। ইয়াযীদী বাহিনীর সৈন্যরা তীরের আঘাতে উনাকে ঘোড়া থেকে মাটিতে ফেলে দিল এবং চারিদিক থেকে তলোয়ার দ্বারা আঘাত করতে লাগলো। হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম দূর থেকে দেখলেন হযরত আব্বাস (রাঃ) ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে গেছেন। তখন উনি গুমরিয়ে কেঁদে উঠলেন এবং বললেন, ‘আমার কোমর ভেঙ্গে গেল।’ তিনি একেবারে বেকারার হয়ে পড়লেন। তাঁর সকল সঙ্গীরা চলে গেলেন এবং তাঁর ডান হাত হযরত আব্বাসও চলে গেলেন। এখন হযরত হুসাইন (রাঃ) একেবারে একা হয়ে গেলেন। তিনি আত্মহারা হয়ে তাঁর ভাইয়ের লাশের কাছে ছুটে গেলেন। হযরত আব্বাস (রাঃ)-এর দুই বাহু কাটা ছিল, শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল এবং সেই যালিমরা তাঁর মাথা কেটে নিয়ে গিয়েছিল। লাশের কাছে পৌঁছে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, ভাই! তুমিতো আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, তোমার সাথে অনেক কথা বলার ছিল। কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না।’ অতঃপর ভাইয়ের রক্ত রঞ্জিত লাশ সেখানে ফেলে কেঁদে কেঁদে ফিরে আসলেন। [1]
হযরত আলী আকবর (রাঃ) এর শাহাদাত
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) হযরত আব্বাস (রাঃ)-এর শহীদী দেহ মুবারকের কাছ থেকে ফিরে এসে দেখেন, তাঁর আঠারো বছরের ছেলে হযরত আলী আকবর (রাঃ) যিনি আপাদমস্তক প্রিয় নবী (সঃ) এর প্রতিচ্ছবি ছিলেন, তিনি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে বললেন, আব্বাজান! আমাকেও বিদায় দিন। আমি চাই না, আপনার পর জীবিত থাকতে। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বললেন, বেটা শোন! তুমিতো মুস্তাফা (সঃ) এরই প্রতিচ্ছবি । তোমাকে যখন কেউ দেখে, দিলের তৃষ্ণা মিটে যায়। তুমিতো আমার নানাজান (সঃ)এরই প্রতিচ্ছবি । তোমাকে দেখলেই আমার নানাজান (সঃ)এর আকৃতি সামনে ভেসে ওঠে। তোমাকে যদি আজ বিদায় দিই, আমাদের ঘর থেকে আমার নানাজান (সঃ)এর প্রতিচ্ছবি চলে যাবে। বাবা! তুমি যেয়ো না। ওরা আমারই রক্তের পিপাসু। আমার রক্তের দ্বারাই ওদের পিপাসা নিবারণ হবে। কিন্তু হযরত আলী আকবর (রাঃ) বললেন, আব্বাজান! আমিও ওখানে যেতে চাই যেখানে আমার ভাই ক্বাসিম গেছেন, যেখানে আমার চাচাজান গেছেন। আমি কাপুরুষের মত পিছনে পড়ে থাকতে চাই না। আমিও জান্নাতুল ফিরদাউসে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ব্যাকুল। আমাকেও আপনার হাতে বিদায় দিয়ে জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে দিন। আমাকে যালিমদের হাতে সোপর্দ করে যাবেন না। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বাধ্য হয়ে তাঁর আঠারো বছরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বিদায় দিলেন।
হযরত আলী আকবর (রাঃ) রওয়ানা হলেন। আল্লাহু ! আল্লাহ ! ইনি কে যাচ্ছেন? মুস্তাফা (সঃ) এর প্রতিচ্ছবি যাচ্ছেন । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর জানের জান যাচ্ছেন। হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর বাগানের ফুল যাচ্ছেন। ইনি হুযূর (সঃ)এর বাগানের ফুলের কলি যাচ্ছেন। হযরত আলী আকবর যেতে যেতে এটা পড়তে ছিলেন-
انا على بن الحسين بن على + نحن اهل البيت اولى بالنبى.
‘আনা আলিই-ইব্নুল হুসাইনিব্নু আলিইয়ি-নাহ্নু আহ্্লুল বাইতি আওলা বিন্নাবিইয়ি’
অর্থাৎ- ‘আমি আলী আকবর, হযরত হুসাইন (রাঃ)এর বেটা, যে হুসাইন (রাঃ) হযরত আলী মর্তুজা (রাঃ)এর বংশধর। আমরাই হলাম আহলে বাইত, রসূলে খোদা (সঃ)এর সবচেয়ে প্রিয় বংশধর।’
এ ‘শে’র’ পড়তে পড়তে ইমাম আলী আকবর সামনে অগ্রসর হলেন এবং ইয়াযীদী বাহিনীর সামনে গিয়ে বললেন, আমার দিকে লক্ষ্য করো! আমি ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর সন্তান। আলী আকবর আমার নাম। হে নবী পাক (সঃ)এর ঘরকে উজাড়কারী! হযরত ফাতিমাতুয্ যাহ্রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা-এর বাগানের ফুল ও কলিসমূহকে কারবালার উত্তপ্ত বালিতে ছিন্ন-ভিন্নকারীরা! আমার রক্ত দ্বারাও তোমাদের হাতকে রঞ্জিত করো, আমার প্রতিও তীর নিক্ষেপ করো।’ হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) বলছেন, যালিমদের সাহস নেই, এ নওজোয়ানের প্রতি তীর নিক্ষেপ করার বা তরবারী চালানোর। আমর বিন সাআদ নিজ সৈন্যদেরকে বলল, হে কাপুরুষের দল! তোমাদের কি হলো? সত্ত্বর একেও বর্শায় উঠিয়ে নাও। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যে সকলের আগে এ নওজোয়ানকে কতল করতে পারবে, আমি তাকে ‘মোছিল’-এর রাজত্ব প্রদান করবো। এমন কোন ব্যক্তি আছে কি? যে মোছিলের শাসক হতে চায়? মোছিলের রাজত্ব পেতে চায়?
তারিক বিন শিশ্ নামক এক বদবখত্ পালোয়ান ছিল। ওর মনে আমরের কথায় প্রভাব সৃষ্টি করল এবং সে আগে বাড়ল, দেখি ভাগ্যে মোছিলের গভর্নরগিরি আছে কিনা। সে তীর হাতে নিয়ে হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ)কে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। হযরত আলী আকবর (রাঃ) দৃঢ় স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। যখনই সে কাছে আসলো, হযরত আলী আকবর ঘোড়াকে ফিরায়ে ওর পিছনে এসে গেলেন এবং এমন জোরে আঘাত হানলেন যে একপলকে ওর মাথাকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।
এই দৃশ্য দেখে ওর ছেলে উমর বিন তারিক রাগে প্রজ্জ্বলিত হয়ে তলোয়ার উচু করে এগিয়ে আসলো। যখন উভয়ের তলোয়ার একটার সাথে আর একটা আঘাতে ঝনঝনিয়ে উঠল, তখন যারা অবলোকন করেছে তারা দেখছিল, ওর লাশ মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। দ্বিতীয় পুত্র তল্হা বিন তারেক সেও বাপ-ভাইয়ের খুনের বদলা নেয়ার জন্য অগ্নিশর্মা হয়ে হযরত আলী আকবর (রাঃ)এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হযরত আলী আকবর (রাঃ) একেও জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেন। এ তিনজনকে হত্যা করার পর হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) ঘোড়া ফিরিয়ে তাঁর আব্বাজানের খিদমতে হাজির হলেন।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) দেখলেন, তাঁর কলিজার টুকরা জিহাদের ময়দান থেকে আসছেন। তিনি এগিয়ে এলেন, এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা কি খবর! হযরত ইমাম আলী আকবর ঘোড়া থেকে অবতরণ করে আব্বাজানের কাছে আরজি পেশ করলেন। আব্বাজান! তৃষ্ণা খুব কষ্ট দিচ্ছে। খুবই তৃষ্ণা অনুভব করছি। যদি এক গ্লাস পানি পাওয়া যায়, তাহলে এদের সবাইকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিতে পারবো ইনশাআল্লাহ। আব্বাজান! আমি ওদের তিন বদবখত্ যোদ্ধাকে হত্যা করে এসেছি, কিন্তু আমার মুখ শুকিয়ে গেছে, আমার গলাও শুকিয়ে গেছে, আমার নিশ্বাসটাও সহজভাবে আসছে না। আমি খুবই কাহিল হয়ে গেছি।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বললেন, প্রিয় বৎস! ধৈর্য ধারণ কর। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে যাবে এবং হাউজে কাওছারের পানি দ্বারা তোমার তৃষ্ণা মিটাবে। কিন্তু বাবা! তুমি যখন আমার কাছে এসেছ, এসো, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, মুখ খোল! হযরত আলী আকবর (রাঃ) মুখ খুললেন এবং হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শুষ্ক জিহ্বা মুবারক ছেলের মুখের ভিতর প্রবেশ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার জিহ্বাটা চুষে নাও, হয়তো কিছুটা আরামবোধ করবে। হযরত আলী আকবর (রাঃ) এর আব্বাজানের জিহ্বা চুষতে লাগলেন। জিহ্বা চুষে কিছুটা আরামবোধ করলেন।
এরপর হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) পুনরায় জিহাদের ময়দানের দিকে এগিয়ে গেলেন। হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) জিহাদের ময়দানে প্রমাণ করে দিয়েছেন, তিনি শেরে খোদার দৌহিত্র। তাঁর শিরা-উপশিরায় হযরত আলী মর্তূজা (রাঃ)এর রক্ত রয়েছে এবং তাঁর চোখে হযরত আলী মর্তূজা (রাঃ) এর শক্তি কাজ করছে। তিনি আশি জন ইয়াযীদী বাহিনীকে হত্যা করে নিজে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে শাহাদাত বরণ করার আগ মুহূর্তে ডাক দিয়ে বললেন-
يا ابتاه ادركنى
‘ইয়া আবাতাহ! আদ্রিক্নী’
অর্থাৎ ‘ওহে আব্বাজান! আমাকে ধরুন, আমাকে নিয়ে যান, আপনার আলী আকবর পড়ে যাচ্ছে।'
এ আহবান শুনে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) দৌঁড়ে যান। তিনি ছেলের কাছে পৌঁছার আগে যালিমরা হযরত আলী আকবর (রাঃ)এর শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। জওয়ান ছেলের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি চোখের পানি ফেলছিলেন এবং অশ্রু সজল নয়নে তাঁর (রাঃ) এর জওয়ান ছেলের লাশ কাঁধে উঠিয়ে তাঁবুর পার্শ্বে নিয়ে আসলেন। হযরত আলী আকবর (রাঃ) এর এ শাহাদাতে প্রত্যেকেই দারুণভাবে আঘাত পেলেন। হযরত যয়নাব (রাঃ) তাঁবু থেকে বের হয়ে এসে হযরত ইমাম আলী আকবর (রাঃ) এর লাশ দেখে চিৎকার করে বলে উঠলেন, আহ! যালিমরা প্রিয় নবী (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর প্রতিচ্ছবিকেও শেষ করে দিল। এ জালিমরা প্রিয় নবী করিম (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর চিহ্নকেও নিচিহ্ন করে দিল । নবী করিম (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এরপ্রতিচ্ছবিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিল ।
হযরত আলী আসগর (রাঃ) এর শাহাদাত
হযরত যয়নাব (রাঃ) ভাতিজা হযরত আলী আকবর (রাঃ) এর লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আহাজারি করতেছিলেন। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বোনের হাত ধরে তাঁবুর অভ্যন্তরে নিয়ে গিয়ে বললেন,
বোন! ছবর করো, আল্লাহ তায়ালা ছবরকারীদের সাথে আছেন। ছবর এবং ধৈর্যের আঁচল হাতছাড়া করো না। যা কিছু হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা’র পক্ষ থেকে হচ্ছে। আমাদের ছবর ও ধৈর্যের মাধ্যমে কামিয়াবী হাছিল করতে হবে। এটা আল্লাহ তায়ালা’র পক্ষ থেকে মহাপরীক্ষা।
বোনকে নিয়ে যখন তাঁবুর অভ্যন্তরে গেলেন, তখন হযরত শহরবানু (রাঃ) হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) উনার সামনে এসে বললেন,
আপনার ছেলে আলী আছগর পানির তৃষ্ণায় কেমন যেন করছে, গিয়ে দেখুন। পানির তৃষ্ণায় তাঁর অবস্থা খুবই সঙ্গীন হয়ে গেছে। কোন রকম নড়াচড়া করতে পারছে না। কাঁদছে কিন্তু চোখে পানি আসছে না। মুখ হা করে আছে, কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গেছে। শুনুন, যালিমেরা হয়তো জানে না যে, আমাদের সাথে ছোট ছোট শিশুরাও রয়েছেন। আমার মনে হয়, এ ছোট শিশুকে কোলে করে আপনি ওদের সামনে নিয়ে গেলে নিশ্চয় ওদের দিলে রহম হতে পারে। কারণ এ রকম শিশু ওদের ঘরেও রয়েছে। তাই আপনি এ শিশুকে কোলে করে ওদের সামনে নিয়ে যান এবং বলুন, আমাকে পানি দিও না, তোমাদের হাতে কয়েক ফোঁটা পানি এ শিশুর মুখে দাও। তাহলে তারা নিশ্চয় দিবে।
হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম বললেন,
শহরবানু! তোমার যদি এটা আরজু এবং ইচ্ছা হয়ে থাকে, তাহলে তোমার এ ইচ্ছা পূর্ণ করতে আমি রাজি আছি। কিন্তু ঐ বদবখ্তদের প্রতি আমার আদৌ আস্থা নেই।
যা হোক, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ছয় মাসের দুগ্ধপোষ্য শিশুকে কোলে নিয়ে ইয়াযীদ বাহিনীর সামনে গিয়ে বললেন,
দেখ! এ ছয় মাসের দুগ্ধপোষ্য শিশু। এ আমার ছেলে আলী আছগর। এ তোমাদের সেই নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বংশধর, তোমরা যার কলিমা পাঠ করো। শোন! আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করে থাকলে, আমার থেকে তোমরা এর বদলা নেবে। কিন্তু এ মাছূম শিশুতো তোমাদের কোন ক্ষতি করেনি। এ শিশু পানির তৃষ্ণায় ছটফট করছে, কিন্তু সেটা দেখা যাচ্ছে না। শোন! আমার হাতে কোন পানির পেয়ালা দিও না, তোমাদের হাতে এ শিশুর মুখে কয়েক ফোঁটা পানি দাও। আর এ শিশু পানি পান করার পর তলোয়ার হাতে নিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়বে না। তাই এর তৃষ্ণাটা নিবারণ করো। তাঁবুর পর্দানশীন মহিলাদের কাকুতি-মিনতিতে টিকতে না পেরে আমি একে নিয়ে এসেছি।
তিনি (রাঃ) এ করুণ বর্ণনা দিচ্ছিলেন, আর এদিকে আলী আছগর (রাঃ)কে লক্ষ্য করে ‘হরমিলা বিন্ কাহিল’ নামক এক বদবখত্ যালিম তীর নিক্ষেপ করলো এবং সেই তীর এসে আলী আছগর (রাঃ)-এর গলায় বিধল। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) দেখলেন, শিশুটি একটু গা-নাড়া দিয়ে চিরদিনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেল। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন, বলতে লাগলেন,
ওহে যালিমেরা! তোমরাতো তোমাদের নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতিও কোন সমীহ করলে না। তোমাদের মনতো কাফিরদের থেকেও কঠোর। শিশুদের প্রতি কাফিরেরাও সহানুভূতি দেখায়। তোমরাতো নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবি করো।
তিনি (রাঃ) ছেলের গলা থেকে তীর বের করলেন এবং নিথর দেহ মুবারক মাটিতে রেখে বললেন,
মাওলা! এ লোকেরা যা কিছু করছে, এর জন্য আমি আপনাকে সাক্ষ্য করছি।
দেহ মুবারক কাঁধে করে তাঁবুর কাছে নিয়ে এসে হযরত আলী আকবর (রাঃ) এর পাশে রেখে ডাক দিয়ে বললেন,
ওহে শহরবানু! ওহে যয়নাব! আলী আছগর আর ছটফট করবেন না এবং তৃষ্ণার কারণে হাত পা নড়াচড়া করবেন না। উনার তৃষ্ণার্ত অবস্থা থেকে তোমাদের অস্থিরতা আর বৃদ্ধি পাবে না। সে জান্নাতুল ফিরদাউসে গিয়ে দাদীজান (রাঃ)এর কোলে বসে হাউজে কাওছারের পানি পান করছে।
আহ ! কারবালার মাঠে হযরত ফাতেমাতুয যুহরা (রাঃ) এর বাগানের ফুল ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ে রয়েছ । কোন জায়গায় আব্বাস (রাঃ) পড়ে রয়েছে, কোন জায়গায় কাসেম (রাঃ) পড়ে রয়েছে, কোন জায়গায় আলী আকবর (রাঃ) পড়ে রয়েছে, কোন জায়গায় আলী আসগর পড়ে রয়েছে ।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শেষ উপদেশ ও যুদ্ধের ময়দানে গমন
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) তাঁবুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। তখন তাঁর চৌদ্দ বছর বয়স্ক ছেলে হযরত ইমাম যাইনুল আবিদীন (রাঃ), যিনি মারাত্মক রোগ ও জ্বরে ভুগছিলেন, হেলিয়ে দুলিয়ে কোন মতে আব্বাজানের সামনে এসে আরজ করলেন, আব্বাজান! আমাকেও বিদায় দিন, আমিও শাহাদাত বরণ করতে চাই। তিনি নিজের অসুস্থ ছেলেকে সান্ত্বনা দিলেন এবং বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
যাইনুল আবিদীন! তোমাকেও যদি বিদায় দিই, তাহলে ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর ‘সিলসিলা’ কার থেকে জারি হবে? বাবা শোন! তোমার থেকেই আমার বংশের ‘সিলসিলা’ জারি হবে। আমি দুআ করছি, আল্লাহ পাক তোমাকে জীবিত রাখুন এবং তোমার থেকে আমার বংশধরের ‘সিলসিলা’ জারি রাখুন।
তিনি উনাকে বাতিনী খিলাফত ও ইমামত প্রদান করলেন। উনাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে বাতিনী নিয়ামত প্রদান করলেন এবং কিছু ওছীয়ত করার পর ফরমালেন,
প্রিয় বৎস! আমি চলে যাওয়ার পর মদীনা শরীফ-এ পৌঁছার যদি সৌভাগ্য হয়, তাহলে সবার আগে তোমার নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রওযা শরীফ-এ গিয়ে সর্বপ্রথম আমার সালাম বলিও এবং কারবালায় তোমার দেখা সমস্ত ঘটনা উনাকে শুনিও।
ছেলেকে ওসীয়ত করার পর ইমাম হুসাইন (রাঃ) তাঁর প্রস্তুতি শুরু করলেন, নবী করিম (সঃ) এর পাগড়ী মুবারক মাথার উপর রাখলেন, সৈয়দুশ শুহাদা হযরত হামযা (রাঃ) এর ঢাল পিঠের উপর রাখলেন । বড় ভাই হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) এর কোমর বন্ধনী নিজ কোমরে বাঁধলেন এবং আব্বাজান শেরে খোদা হযরত আলী মুর্তূজা (রাঃ) এর তলোয়ার ‘জুলফিকার’ হাতে নিলেন । অতঃপর কারবালার দুলহা, কারবালার সুলতান শাহীন শাহে কারবালা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ময়দানের দিকে যাত্রা দিলেন । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) তলোয়ার হাতে নিয়ে বের হওয়ার মুহুর্তে সেই পর্দানশীন মজলুম মহিলাদের দিকে এক নজর তাকালেন, তখন সবাই তাঁকে (রাঃ) সবর ও ধৈর্যে অটল দেখালেন, কারো চোখে পানি নেই, সবাই অধিক শোকে পাথর হয়ে রইলেন । কিন্তু উনাদের অন্তর হু হু করে কাঁদছিল । যাদের ভরা ঘর আজ খালি হয়ে গিয়েছে । সর্বশেষ যে আশ্রয়টা ছিল, তিনি (রাঃ)ও এখন তাদেরকে বিদায়ী সালাম দিয়ে রওয়ানা হচ্ছেন । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এক এক জনকে সম্বোধন করে বললেন,
‘শহরবানু’ আমার আখেরী সালাম গ্রহণ করো, ‘রোবাব ! হুসাইন (রাঃ) এর চেহারা দেখে নাও, সম্ভবতঃ এ চেহারা দেখার নসীব আর নাও হতে পারে । জয়নাব! তোমার ভাই যাচ্ছে, জয়নাব! তুমি খয়বার যুদ্ধ বিজয়ীর কন্যা, তুমি ধৈর্যশীলা ফাতিমাতুয যুহরা (রাঃ) এর কন্যা, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ সবরকারী (সঃ) এর আওলাদ । দেখ, এমন কোন কাজ করিও না, যদ্বারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) নারাজ হন ।যে কোন অবস্থায় ধৈর্যহারা হইওনা । জয়নাব! আর একটি কথা শোন, আমার প্রিয় কন্যা সখিনাকে কাঁদতে দিওনা । সে আমার সব চেয়ে আদরের মেয়ে । ওকে আদর করিও এবং সদা বুকে জড়িয়ে রাখিও । আমি যাচ্ছি, তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে সোপার্দ করলাম ।
তিনি (রাঃ) এ কথাগুলো বলছিলেন, আর এদিকে তাঁর মাসুম কন্যা এসে জড়িয়ে ধরলো । হযরত রোবাব (রাঃ) এসে হযরত হুসাইন (রাঃ) এর কাঁধে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন,
আমাদেরকে ফেলে আপনি কোথায় যাচ্ছেন, এ দুর্দিনে আমাদেরকে এ অবস্থায় ফেলে কোথায় যাচ্ছেন ? জালিমদের হাতে আমাদের সোপর্দ করে কোথায় যাচ্ছেন ? আমাদের পরিণাম কি হবে! এ পশুরা আমাদের সাথে কি যে আচরণ করবে! তিনি (রাঃ) বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের সাথে আছেন । তোমরা আল্লাহর নবী (সঃ) এর আওলাদ, আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত । আল্লাহ তাআলা তোমাদের ইজ্জত সম্মানের হেফাজতকারী ।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) সবাইকে ধৈর্য ধারণের জন্য তাগিদ দিলেন । কিন্তু নিজে অধৈর্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিলেন । তবুও একান্ত কষ্টে আত্ম সংবরণ করে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘোড়ার কাছে আসলেন এবং যে মাত্র ঘোড়ায় আরোহন করতে যাচ্ছিলেন, সে মূহুর্তে হযরত সৈয়দা জয়নাব (রাঃ) মাথায় পর্দা দিয়ে বের হয়ে আসলেন এবং বললেন,
ভাইজান! যে মায়ের তুমি দুধ পান করেছ, আমিও সে মায়ের দুধ পান করেছি, আমিও হযরত আলী মর্তুজা (রাঃ) এর কন্যা । ভাইজান! তুমি সবাইকে ঘোড়ায় আরোহন করিয়ে ময়দানে পাঠিয়েছ, কিন্তু তোমাকে আরোহণ করার মত এখন আর কেউ নেই । তাই এ মজলুম বোন তোমাকে ঘোড়ায় আরোহন করাবে । আমি তোমার ঘোড়ার লাগাম ধরলাম, তুমি আরোহণ কর ।
হযরত হুসাইন (রাঃ) ঘোড়ায় আরোহণ করে ময়দানের দিকে যাত্রা শুরু করলেন । হযরত ফাতেমাতুয যুহরা (রাঃ) এর নয়নমণি ইয়াজিদী বাহিনীর সামরা সামনি হতে চলেছি । নবী করিম (সঃ) এর দৌহিত্র পরিবারের সবার শাহাদাত বরণ করার পর নিজে শাহাদাত বরণ করতে চলছেন ।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর বীর বিক্রম আক্রমণ
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ইয়াযীদী বাহিনীর সামনে গিয়ে বললেন,
দেখ, আমি কে? আমি হলাম জান্নাতের যুবকদের সাইয়্যিদ। আমি ঐ হুসাইন, যাঁকে রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুমু দিতেন এবং বলতেন, এটা আমার ফুল। আমি ঐ হুসাইন যাঁর মা ফাতিমাতুয্ যাহরা (রাঃ)। আমি ঐ হুসাইন যাঁর পিতা হযরত আলী মর্তূজা (রাঃ), যিনি খাইবর বিজয়ী। আমি ঐ হুসাইন, যার নানা আল্লাহর নবী খাতেমুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সঃ) । আমি ঐহুসাইন, যখন আল্লাহর নবী (সঃ) সিজদারত অবস্থায় থাকতেন, আমি পিঠ মুবারকের উপর সওয়ার হয়ে যেতাম আর তখন উনি সিজদাকে দীর্ঘায়িত করতেন। ওহে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ঘর উচ্ছেদকারীরা! ওহে হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা (রাঃ) বাগানের ফুলকে ছিঁড়ে ছিন্ন-ভিন্ন করে কারবালার উত্তপ্ত বালিতে নিক্ষেপকারীরা! এসো, আমার রক্তের দ্বারাও তোমাদের হাতকে রঞ্জিত করো। কি দেখছ ? আমার পিছনে আর কেউ নেই। একমাত্র আমিই রয়েছি। এগিয়ে এসো।
তখন ওরা তলোয়ার খাপ থেকে বের করে তীর উত্তোলন করে এগিয়ে আসলো। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) যখন খাপ থেকে তলোয়ার বের করে ওদের উপর আক্রমণ করলেন, তখন ওরা মেষের পালের মত পালাতে লাগলো। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এমন বিদ্যুৎ বেগে ওদের উপর তলোয়ার চালাতে লাগলেন যে ওদের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে এমনভাবে পতিত হতে লাগলো যেমন শীতকালে বৃক্ষের পাতা ঝরে পড়ে। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) অল্প সময়ের মধ্যে লাশের স্তূপ করে ফেললেন। তিনি (রাঃ) নিজে তীরের আঘাতে জর্জরিত এবং তিনদিনের তৃষ্ণায় কাতর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর তলোয়ার ‘যুলফিকার’ তখনও সেই নৈপুণ্য দেখিয়ে যাচ্ছিল, যেভাবে বদরের যুদ্ধে দেখিয়েছিল। বদরের যুদ্ধে এ তলোয়ার যখন শেরে খোদা হযরত আলী (রাঃ) এর হাতে ছিল এবং চালানো হচ্ছিল, তখন অদৃশ্য থেকে আওয়াজ আসছিল-
লা ফাতা ইল্লা আলী, লা সাইফা ইল্লা যুল্ফিকার
অর্থাৎ ‘ হযরত আলী (রাঃ) এর মত যেমন কোন জওয়ান নেই, তেমনি ‘যুলফিকার’-এর মত কোন তলোয়ার নেই।
এখনও সেই তলোয়ার সেই নৈপুণ্য দেখাচ্ছিল। মোট কথা, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) লাশের স্তুপ করে ফেলেছেন। ইয়াযীদী বাহিনীকে কেটে কেটে মাটি রঞ্জিত করে ফেললেন। একদিকে তিনি যেমন অনেকইয়াযীদী সৈন্যকে কচুকাটা করলেন, অন্যদিকে ওরাও তাঁকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে ফেললো।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাত
নিজেদের মারাত্মক পরিণতির কথা উপলব্ধি করে আমর বিন সা’আদ নির্দেশ দিল, সবাই মিলে চারিদিক থেকে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করো। নির্দেশমত ইয়াযীদী বাহিনী নবী (সঃ) এর দৌহিত্রকে চারিদিক থেকে ঘিরে বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ করতে লাগলো। ফলে চারিদিক থেকে তীর এসে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)কে আঘাত হানতে লাগলো। কোনটা ঘোড়ার গায়েও লাগছিল, কোনটা তাঁর নিজের গায়ে পড়ছিল। এভাবে যখন তীরের আঘাতে তার পবিত্র শরীর ঝাঁঝরা হয়ে ফিনকি দিয়ে সারা শরীর থেকে রক্ত বের হতে লাগলো, তখন তিনি (রাঃ) বার বার মুখে হাত দিয়ে বললেন, বদবখতের দল! তোমরাতো তোমাদের নবী পাক (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর লেহাজও করলে না। তোমরা নিজের নবী (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বংশধরকে হত্যা করেছ । এভাবে যখন তিনি আর একবার মুখের উপর হাত দিলেন, তাঁর চোখের সামনে আর এক দৃশ্য ভেসে উঠল। তিনি দেখতে পেলেন, স্বয়ং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতে একটি বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হযরত আলী মর্তুজা (রাঃ) ও হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা (রাঃ)ও পার্শ্বে আছেন আর বলছেন,
হুসাইন! আমাদের দিকে তাকাও, আমরা তোমাকে নিতে এসেছি।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কাপড় রক্তে ভিজে যাচ্ছিল আর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই রক্ত বোতলে ভরে নিচ্ছিলেন এবং বলছিলেন,
হে আল্লাহ পাক! হুসাইনকে পরম ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দান করুন।
আল্লাহ্ ! আল্লাহ্ ! নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৌহিত্র নিজের রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেলেন। শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে গিয়ে একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গেলেন এবং আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন। যে মুহূর্তে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন, আল্লাহ পাকের আরশ দুলিয়ে উঠলো, ফাতিমাতুয্ যাহরা (রাঃ) এর আত্মা ছটফট করতে লাগলো, হযরত আলী (রাঃ)এর রূহ মুবারক থেকে ‘আহ’ শব্দ বের হলো। সেই হুসাইন (রাঃ) পতিত হলেন, যাকে প্রিয় নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের কাঁধে নিতেন। ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার পর কমবখত্ সীমার, হাওলা বিন ইয়াযীদ, সেনান বিন আনাস প্রমুখ বড় বড় জালিম এগিয়ে আসলো এবং হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর শরীরের উপর চেপে বসলো। সীমার বুকের উপর বসলো। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) বুকের উপর সীমারকে দেখে বললেন, আমার নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিকই বলেছেন,
এক হিংস্র কুকুর আমার আহলে বাইতের রক্তের উপর মুখ দিচ্ছে’, আমার নানাজান (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর কথা মুবারক ষোল আনা সত্য, তুমিই আমার হত্যাকারী। আজ জুমার দিন। এ সময় লোকেরা আল্লাহ পাকের দরবারে সিজদারত। আমার মস্তকটা তখনই আমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করো, যখন আমিও সিজদারত থাকি।
আহ ! দেখুন, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) জীবন সায়াহ্নের সেই মুহূর্তেও পানি পান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি, নিজের ছেলেমেয়েকে দেখার জন্য আরজু করেননি, সেই সময়ও কোন আকাঙ্খা বা আরজু থাকলে এটাই ছিল যে, আমার মাথা নত হলে যেন আল্লাহ পাকের সমীপেই নত হয়। সে সময়ও তিনি (রাঃ) বাতিলের সামনে মাথা নত করেন নি । সে সময়ও তিনি (রাঃ) সিজদা করে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন, নামায পড়ে দেখিয়েছেন, দুনিয়াবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, হুসাইন (রাঃ) আঘাতে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েও নামায ত্যাগ করেন নি । তিনি (রাঃ) দুনিয়াবাসীকে এটাই যেন বলতে চেয়েছিলেন, আমাকে যদি ভালবাসেন, আমার জিন্দেগী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন । হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) সিজদায় মাথা রাখলেন এবং سبحان ربى الاعلى ‘সুবহানা রব্বিইয়াল আ’লা’ তাসবীহ পাঠ করে বললেন,
মাওলা! যদি হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর কুরবানী আপনার দরবারে গৃহীত হয়, তা’হলে এর ছওয়াব (নানাজান ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উম্মতের উপর বখশিশ করে দাও ।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)এর মস্তক মুবারক যখন শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল, তখন তাঁর ঘোড়া স্বীয় কপালকে তাঁর (রাঃ) রক্তে রঞ্জিত করল এবং দৌড়ে চলে যেতে লাগল, তখন সীমার লোকদেরকে বলল, ঘোড়াটিকে ধরো, কিন্তু যতজন লোক ঘোড়াটি ধরতে এগিয়ে গেল, সে সবাইকে আক্রমণ করল এবং দাঁত আর পা দিয়ে জখম করে ওদেরকে শেষ করে দিল। সতের জন লোককে এভাবে খতম করল। শেষ পর্যন্ত সীমার বলল, ছেড়ে দাও, দেখি কি করে? ঘোড়া ছুটে গিয়ে তাঁবুর কাছে গেল এবং কান্না ও চিৎকার করতে লাগলো।
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর লাশের পার্শ্বে হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) ও হযরত সখিনা (রাঃ)
হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) যখন ঘোড়ার কান্না ও চিৎকার শুনলেন, তখন তিনি হযরত সখিনা (রাঃ)কে ডেকে বললেন, বেটি! একটু দাঁড়াও, আমি বের হয়ে দেখে আসি, সম্ভবতঃ তোমার আব্বা এসেছেন। মজলুম বোন বের হয়ে দেখলেন, ঘোড়ার জীন খালি এবং ঘোড়ার কপাল রক্তে রঞ্জিত। তা দেখে হযরত যয়নাব (রাঃ) বুঝতে পারলেন, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) শাহাদাত বরণ করেছেন এবং তিনি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন-
واه حسينا ‘ওয়াহ্ হুসাইনা’ واه غريبا ‘ওয়াহ্ গরীবা।’
তাঁর এ আওয়াজ শুনার সাথে সাথে তাঁবুর অভ্যন্তরে ক্রন্দনের রোল পড়ে গেলো। হযরত যয়নাব (রাঃ) ডাক দিয়ে বললেন, শহরবানু! সখিনাকে থামিয়ে রেখ, আমি ভাইয়ের খবর নিতে যাচ্ছি। হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা (রাঃ)এর কন্যা হযরত যয়নাব (রাঃ), যার মাথার ওড়নাও কোন অপরিচিত ব্যক্তি কখনো দেখেনি, যিনি ঘরের চৌহদ্দি থেকে কখনো বের হননি, আজ পরদেশে অসহায় অবস্থায় মুখের উপর পর্দা ফেলে ভাইয়ের লাশকে দেখার জন্য কারবালার ময়দানের দিকে ছুটে চললেন। যেতে যেতে তিনি বলতে লাগলেন,
'ওহে যালিমেরা! পথ ছেড়ে দাও, আমার ভাইকে দেখতে দাও।’
ওরা বলল, তুমি ওকে কি দেখবে ? ওর মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে।
হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) গিয়ে ভাইয়ের লাশকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন, আর বলতে লাগলেন, ভাইজান! তুমিতো আমাদেরকে যালিমদের হাওলা করে চলে গেলে।
আল্লাহ্ ! আল্লাহ্ !হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর নিস্প্রাণ দেহ মুবারক কারবালার যমীনে পড়ে রইল। যেসব লোকেরা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর লাশ দাফন করেছিলেন, তারা বলেছেন যে, হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শরীরে চৌঁত্রিশটি বর্শার ছিদ্র , চল্লিশটা তলোয়ারের আঘাত এবং একশত একুশটি তীরের জখম ছিল। হযরত সৈয়দ যয়নাব (রাঃ) নিজের ভাইয়ের লাশ মুবারকের পাশে বিভোর হয়ে পড়ে রইলেন; এদিকে হযরত সৈয়দা সখিনা (রাঃ), হযরত সৈয়দা শহরবানু (রাঃ) থেকে নিজেকে মুক্ত করে কারবালার ময়দানের দিকে অঝোর নয়নে ক্রন্দনরত অবস্থায় ছুটে গেল এবং চিৎকার করে বলতে লাগলো, ফুফু! তুমি কোথায়? আব্বু আমার কোথায়? আওয়াজ শুনে ফুফু ডাক দিলেন, বেটি! এদিকে এসো, তোমার মজলুম ফুফু তোমার আব্বুর পাশে বসে আছে। হযরত সৈয়দা সখিনা (রাঃ) যখন নিজের আব্বাজানকে দেখলো, চিনতে পারলো না। কারণ তাঁর (রাঃ) সমস্ত শরীর মুবারক রক্তে রঞ্জিত ছিল এবং মস্তক মুবারক শরীর থেকে বিছিন্ন ছিল। মা’ছুমা সখিনা আব্বাজানের লাশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেহুঁশ হয়ে গেল। হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) হযরত সখিনার হাত টেনে ধরে বলল, মা সখিনা! ওঠ, আমি তোমাকে তাঁবুতে দিয়ে আসি। আমার ভাই, আমাকে বলেগেছেন যে, তোমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। উনি জোর করে হযরত সখিনাকে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর বুক থেকে ছাড়িয়ে তাঁবুতে নিয়ে গেলেন। আল্লাহ! আল্লাহ! হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ও তাঁর অন্যান্য সঙ্গী সাথীদের লাশ কারবালার ময়দানে পড়ে রইলো। ইয়াজিদী বাহিনী তাদের লোকদের লাশগুলো খুঁজে খুঁজে দাফন করলো । কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ও আহলে বায়তের লাশ যেভাবে ছিল, সে ভাবেই পড়ে রইল । আল্লাহ! আল্লাহ! এরা এক রাত সেখানে অবস্থান করলো । পরের দিন তাদের চলে যাওয়ার কথা । ইয়াযীদী বাহিনীরা, যারা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে মনে করেছিল তারা বিজয়ী হয়েছে, বাস্তবে তাদের এমন পরাজয়ই হয়েছে যা আর কারো হয়নি। যাক, যখন তারা শুয়ে পড়ল, হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) মুখে পর্দা ফেলে তাঁবু থেকে পুনরায় বের হলেন। দেখলেন, হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (রাঃ) এর বাগানের জান্নাতী ফুল কারবালার প্রান্তরে পড়ে রয়েছেন। নবী পাক (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নয়নের মণি চকমক করছে। হযরত যয়নাব (রাঃ) এক পলক সকল প্রিয়জনকে দেখলেন। ছবর ও ধৈর্যে অটল থাকা সত্ত্বেও অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে এক এক জনকে দেখে দেখে শেষে ভাইয়ের দেহ মুবারকের পাশে আসলেন এবং বসে পড়ে বললেন,
‘ওগো আমার ভাইয়া ! আমি অসহায়, অপারগ, ভিন-দেশের মুসাফির। মদীনা মুনাওওয়ারা অনেক দূর। আমি কিভাবে ওখানে তোমার খবর পৌঁছাবো? আমি কিভাবে তোমার দাফন করবো?’ আহ! হযরত ফাতেমাতুয যুহরা (রাঃ) এর কলিজার টুকরা, নবী করিম (সঃ) এর আদরের দৌহিত্র কারবালার প্রান্তরে বেওয়ারীশের মত পড়ে রইল ।
হযরত সৈয়দা যয়নাব (রাঃ) মদীনার দিকে মুখ করে ক্রন্দনরত অবস্থায় হাত তুলে বলতে লাগলেন,
ইয়া রসূলাল্লাহ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) কাফন ও দাফন বিহীন রক্তে রঞ্জিত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন।
আর এদিকে রুগ্ন হযরত যাইনুল আবিদীন (রাঃ) হাত তুলে বলছেন-
للعالـمين- ادركنى زين العابدين يارحمة
ইয়া রহমতাল্লিল আলামীন! আদরিকী যাইনাল আবিদীন’
অর্থাৎ ‘হে রহমাতুল্লিল আলামীন (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ! আমার উপর রহম করুন।’
আল্লাহ্ ! আল্লাহ ! এভাবে রাত্রি অতিবাহিত করলেন। উলামায়ে কিরাম লিখেছেন যে, ‘হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতের সময় সূর্যগ্রহণ হয়েছিল, আসমান ঘোর অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, ফলে দিনে তারকারাজি দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর আকাশ কালো থেকে লাল বর্ণে পরিণত হয়েছিল এবং আসমান থেকে রক্ত বর্ষিত হয়েছিল। সাতদিন পর্যন্ত এ রক্ত বর্ষণ অব্যাহত ছিল। সমস্ত ঘর বাড়ির দেয়াল রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল এবং যেসব কাপড়ের উপর রক্ত পতিত হয়েছিল, সেসব কাপড় ছিড়ে টুকরো টুকরো হওয়ার পরও সেই রক্তের লালিমা যায়নি। যমীনও কান্নাকাটি করেছিল। বায়তুল মুকাদ্দাসে যে পাথরটা উঠানো হতো, সেই পাথরের নিচ থেকে তাজা রক্ত বের হতো। পানি ভর্তি কলস রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। ইয়াযীদী বাহিনীরা যখন উট যবেহ করেছিল তখন সে উটের ভিতর থেকে রক্তের পরিবর্তে আগুনের লেলিহান শিখা বের হয়েছিল। জিনদের মধ্যেও শোক-বেদনা ছড়িয়ে পড়েছিল। এক অদ্ভুত ও বিস্ময়কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক দূর্লভ, লোমহর্ষক ঘটনার কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতের ঘটনা অতুলনীয় । এর নকশা চোখের সামনে ভেসে উঠলে মন-প্রাণ শিউরে ওঠে।