নামাজ কি?
রাছুলে পাক (সঃ) বলেন
যখন তোমাদের কেউ নামাজে দণ্ডায়মান হয় সে যেন নামাজ শেষ না করা পর্যন্ত নামাজের মধ্যে গভীরভাবে মনোযোগ রাখে, আর বিশেষ করে যেন এদিক সেদিক খেয়াল করা থেকে বিরত থাকে । কেননা তোমাদের কেউ যতক্ষণ নামাজের মধ্যে থাকে ততক্ষণ সে আল্লাহ্র সাথে কথাবার্তা বলতে থাকে ।
— তিবরানী-আততারগীব , ১ম জেলদ-৩৭৩ পৃঃ
রাসুলে পাক (সঃ) বলেন
হে লোক সকল ! নামাজী যখন নামাজ পড়ে, নিশ্চয় সে তাঁর রবের সঙ্গে কথা বার্তায় লিপ্ত থাকে । সুতরাং সে তাঁর রবের সঙ্গে কি বলছে তা যেন খেয়াল রাখে এবং তোমাদের একে অপরের স্বরকে উঁচু না করে ।
— মুছনাদে আহমাদ , হাদীস নং ৬১৩২
যখন তোমাদের কেউ নামাজে দাঁড়ায় সে যেন সামনের দিকে থুথু না ফেলে। কেননা সে আল্লাহর সাথে গোপনে কথা-বার্তায় লিপ্ত আছে, যতক্ষন সে নিজ জায়নামাজে আছে।
— বুখারী ও মুছলিম-মেশকাত, ৬৫৮
হযরত জাবের রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, রাছুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম বলেন - যখন কেউ নামাজে দাঁড়ায় তখন আল্লাহ তাআ’লা নিজ চেহারাকে তার দিকে ফিরান। যখন সে এদিক সেদিক খেয়াল করে তখন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে আদম সন্তান তুমি কোন্ দিকে খেয়াল করছ ? তুমি যাকে খেয়াল করছ সে কি আমার চেয়ে ভাল ? তুমি আমার দিকে খেয়াল করো। যদি সে দ্বিতীয় বার এদিক সেদিক খেয়াল করে তখন আল্লাহ তাআ’লা অনুরূপ বলেন । যদি সে তৃতীয়বার অন্যদিকে খেয়াল করে তখন আল্লাহ তা’আলা তার দিক থেকে নিজ চেহারা ফিরিয়ে নেন । বাজ্জার এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন ।
— আততারগীব ১ম জেলদ, ৩৭০ পৃঃ
হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতেও অনুরূপ হাদীছ বর্ণিত আছে। [1]
হযরত আবু যর (রাঃ) বর্নিত আছে, রছূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআ’লা সব সময় বান্দার নামাজের মধ্যে হাজির থাকেন। যদি না সে এদিক সেদিক খেয়াল করে। যদি সে অন্যদিকে মুখ ফিরায় তখন আল্লাহ তাআ’লাও তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। আহমাদ, আবু দাউদ, নাছায়ী, ইবনু খোজায়মা তার ছহীহ কেতাবে এবং হাকেম এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
— আততারগীব ১ম জেলদ ৩৬৯ পৃঃ, মেশকাত হাদীছ নং ৯৩২
ইবনে মাছউদ ও আনাছ রাদিআল্লাহু আনহুমা হতেও অনুরূপ হাদীছ বর্ণিত আছে। [2]
হযরত আবু দারদা রাদিআল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লামকে বলতে শুনেছি – যে ব্যক্তি নামাজে দাঁড়াল এরপর এদিক সেদিক তাকাল আল্লাহ তাআ’লা তার নামাজ কবুল না করে তার দিকে ফিরিয়ে দেন।
— আততারগীব ১ম ৭২
হযরত ইবনে আব্বাছ রাদিআল্লাহু আনহুমা হ'তে বর্ণিত আছে - রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম বলেছেনঃ জিবরাইল এসে বললেনঃ হে রাছুল আল্লাহ তাআ’লা আপনাকে ছালাম দিয়েছেন এবং বলেছেনঃ কোন বান্দা যখন নামাজের জন্যে আল্লাহর দরবারে দাড়িয়ে আল্লাহু আকবার বলে তখন আমার এবং ঐ বান্দার মধ্যেকার পর্দা উঠিয়ে দেয়া হয়।
নামাজী যখন বলেঃ আলহামদু (সকল প্রশংসা )।
আল্লাহ তখন বলেনঃ লিমানিল হামদ (কার জন্যে প্রশংসা) ?
নামাজী বলেঃ লিল্লাহি (আল্লাহর জন্যে)।
আল্লাহ বলেনঃ মানিল্লাহ (আল্লাহর পরিচয় কি) ?
নামাজী বলেঃ রব্বিল আলামীন (বিশ্ব প্রতিপালক)।
আল্লাহ বলেনঃ অমার রব্বুল আলামীন (বিশ্ব প্রতিপালক কে) ?
নামাজী বলেঃ আর রহমানির রহীম (অনন্ত অসীম দয়াময়)।
আল্লাহ বলেনঃ অমানির রহমানুর রহীম (কে অনন্ত অসীম দয়াময়) ?
নামাজী বলেঃ মালিকি ইয়াও মিদ্দীন (বিচার দিনের মালিক)।
আল্লাহ বলেনঃ ইয়া আবদী আনা মালিকি ইয়াও মিদ্দীন। (হে আমার বান্দা আমিই বিচার দিনের মালিক)।
নামাজী বলেঃ ইয়্যাকা না’বুদু অইয়্যাকা নাছতায়ীন (আমরা শুধু তোমারই এবাদাত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য চাই)।
আল্লাহ বলেনঃ ইয়া আবদী উ’বুদলী অছতায়িন (তুমি আমারই এবাদাত করো এবং আমারই কাছে সাহায্য চাও)।
নামাজী বলেঃ ইহ্ দিনা (আমাদেরকে পথ দেখাও)।
আল্লাহ বলেনঃ আছ ছিরাত্বল মুছতাকীম (সরল সঠিক পথ, কোন্ পথ তুমি চাও) ?
নামাজী বলেঃ ছিরাত্বল্লাজীনা আন আমতা আলাইহিম (তাদের পথ যাদের তুমি পুরস্কার দান করেছ)।
আল্লাহ ফেরেশতাগণকে লক্ষ্য করে বলেনঃ হে ফেরেশতাগণ তোমরা সাক্ষী থাক, আমি আমার বান্দাকে পুরস্কৃত বান্দা তথা নবী, ছিদ্দিক ও শহীদগনের দলভুক্ত করে নিলাম।
নামাজী বলেঃ গায়রিল মাগদূবি আলাইহিম অলাদ্দল্লীন (তাদের পথ নয় যাদের প্রতি তুমি গজব নাজিল করেছ এবং যারা পথভ্রষ্ট)।
আল্লাহ ফেরেশতাগণকে বলেনঃ তোমরা সাক্ষী থাকো আমি তাকে পুরষ্কৃত বান্দাদের দলভুক্ত করেছি আর কোপগ্রস্থ তিরষ্কৃত লোকদের অন্তর্ভুক্ত করিনি।
নামাজী বলেঃ আমীন (হে আল্লাহ তুমি কবুল করো)।
ফেরেশতাগণ ও বলেনঃ আমীন।
আল্লামা ইবনুল জাওযী স্বীয় কেতাব “শরহুল কুলুবে” এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
— তাফছীরে নুরুল কোরআন ১ম খন্ড ১৮৮ পৃঃ
মুছলিম শরীফে হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে নামাজের মধ্যে আল্লাহ ও বান্দার কথাবার্তা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
— মেশকাত হাদীছ নং- ৭৬৬, আহমাদ হাদীছ নং- ৯৯৪৫
আল্লাহ তাআ’লা কোরআন মজীদে এরশাদ করেন-
ঐ আল্লাহ তাআ’লা তোমাদের উপর নামাজ পড়েন এবং তাঁর ফেরেশতাগণও, আর তোমাদের মধ্যের জুলমাতকে দূর করে দিয়ে নূর প্রবেশ করান। তিনি মোমেনদের প্রতি অত্যন্ত দয়াশীল।
— আহযাব-৪৩
আল্লাহ তাআ’লার তরফ থেকে বান্দার প্রতি নামাজের অর্থ রহমত বর্ষণ করা। আর আল্লাহর প্রতি বান্দার নামাজ হলো কাকুতি-মিনতি সহকারে গোনাহ মাফের আবেদন পেশ করা। ফেরেশতাদের নামাজের অর্থ বান্দার জন্য আল্লাহর দরবারে মাগফেরাতের দোয়া করা। রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম এরশাদ করেন-
নামাজ মুমিনদের জন্য আল্লাহর দীদার
উপরোক্ত কোরআন মজীদের আয়াত ও হাদীছসমুহ হতে স্পষ্টভাবে জানা গেল যে, নামাজ হলো আল্লাহ পাকের সঙ্গে বান্দার দীদার ও গোপনে কথা-বার্তা বলা । [3]
তথ্যসূত্র
· আততারগীব ১ম জেলদ-৩৭০ পৃঃ
· · আততারগীব ১ম জেলদ- ৩৭১, ৩৭২ পৃঃ
· নামাজ প্রশিক্ষণ
নামাজের প্রথম অবস্থা
নামাজ ফরজ হওয়ার পর রাছুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম ছাহাবাগণকে প্রথমে নামাজের আহকাম অর্থাৎ শরীর পাক, কাপড় পাক ও নামাজ পড়ার জায়গা পাকের ব্যাপারে পেশাব পায়খানা, পাক নাপাক, অজু -গোছল প্রভৃতি শিক্ষা দান করেন। এরপরে নামাজের মধ্যের কিয়াম, কেরাত, রুকু, ছেজদা অর্থাৎ ফরজগুলি শিক্ষা দেন। সে সময় নামাজের মধ্যে ছাহাবাগণ একে অপরের সঙ্গে আলাপ করে নামাজ পড়তেন। নামাজের মধ্যে কথাবার্তা বলতেন।
হযরত রিফায়াহ বিন রাফে রাদিআল্লাহু আনহু বলেন- এক লোক মদীনার মছজিদে এসে নামাজ পড়ল। এরপর রাছুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম এর কাছে যেয়ে ছালাম করল। রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম তাকে বললেন- তুমি পুনরায় নামাজ পড়। কেননা তোমার নামাজ পড়া হয়নি। তখন সে বলল, হে আল্লাহর রাছুল ! আমি কিভাবে নামাজ পড়ব তা আমাকে শিখায়ে দিন। রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম বললেন, তুমি কেবলার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকবীর বলবে, এরপর ছুরা ফাতিহা পড়বে, এরপর যদি আল্লাহর ইচ্ছায় তোমার পক্ষে কিছু পড়া সম্ভব হয় তা পড়বে। এরপর যখন রুকু করবে দু’হাতের আঙ্গুল দু’হাটুর উপর রাখবে। রুকুতে স্থির থাকবে, পিঠ সমান রাখবে, এরপর যখন উঠবে পিঠ সোজা রাখবে, মাথাকে এমনভাবে উঠাবে যেন হাড়ের জোড়গুলি নিজ নিজ জায়গায় লেগে যায়। এরপর ছেজদা করবে ও ছেজদাতে স্থির থাকবে। ছেজদা থেকে উঠে বাম উরুর উপরে বসবে। এরপর প্রত্যেক রুকু ছেজদাতে ধীর স্থিরভাবে এরূপ করতে থাকবে।
— মাছবীহ, আবু দাউদ, তিরমিজি ও নাছায়ী
তিরমিজির অপর বর্ণনায় আছে,
রাছুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম বললেন, যখন তুমি নামাজ পড়তে ইচ্ছা করবে তখন আল্লাহ যেভাবে আদেশ করেছেন, সেভাবে অজু করবে এরপরে কলেমা শাহাদাত পড়বে তারপর ইকামাত বলে নামাজ শুরু করবে। এখন যদি তোমার কোরআন জানা থাকে তাহলে কোরআন পড়বে। আর যদি কোরআন জানা না থাকে তাহলে আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়বে তারপর রুকু করবে।
— মেশকাত হাদীছ নং - ৭৮৪
হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাছউদ রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, হাবশায় হিজরতের পূর্বে রাছুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছল্লামকে তাঁর নামাজে থাকা অবস্থায় আমরা তাঁকে ছালাম করতাম, আর তিনি আমাদের ছালামের উত্তর দিতেন।
— আবু দাউদ-মেশকাত হাদীছ নংঃ ৯৭৯
হযরত রেফায়া বিন রাফে রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, আমি একদিন রাছুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম এর পিছনে নামাজ পড়ছিলাম। হঠাৎ আমার হাঁচি এলো। তখন আমি বললাম “আল হামদুলিল্লাহি হামদান কাছিরান তয়্যিবান মুবারাকান ফিহি, মুবারাকান আলাইহি কামা ইহিব্বু রব্বুনা অ-ইয়ারদা”। রাছুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম নামাজ শেষ করে জিজ্ঞেস করলেন নামাজের মধ্যে এ কথাগুলি কে বলেছে ? কেউ কোন উত্তর দিলনা। তিনি দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু কেউ কোন উত্তর দিলনা। তিনি তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করলেন, তখন আমি (রেফায়া) উত্তর করলাম, হে আল্লাহর রাছুল, আমি। আল্লাহর রাছুল বললেন, আল্লাহর কছম - আমি দেখলাম তিরিশের উপর ফেরেশতা তাড়াহুড়া করছেন, কে কার আগে এ আমল নিয়ে উপরে উঠবেন।
— তিরমিজি, আবু দাউদ, নাছায়ী, মেশকাত- ৯৯২
হযরত আবু কাতাদা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাছুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছল্লামকে লোকের ইমামতি করতে দেখেছি। তখন আবুল আছের মেয়ে উমামা তাঁর কাঁধের উপর ছিল। তিনি যখন রুকু করতেন তখন উমামাকে নামিয়ে দিতেন। আর যখন ছেজদা হতে মাথা উঠাতেন, পূনরায় তাঁকে ঘাড়ে উঠাইয়া লইতেন।
— বুখারী, মুছলিম, মেশকাত - ৯৮৪
রাছুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম এর নিকট নামাজের মধ্যে ছেজদার সময় এক ব্যক্তির মাটি সরানো সম্মন্ধে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, যদি তা করতেই হয় তবে শুধু একবার করবে।
— বুখারী, মুছলিম, মেশকাত- ৯১৭
হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা বলেন, একদিন রাছুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম ঘরে নামাজ পড়তেছিলেন। ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। আমি এসে দরজা খুলতে বললাম। তিনি কিছুদূর হেঁটে এসে আমার জন্যে দরজা খুলে দিলেন। এরপর রাছুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম নিজের নামাজের জায়গায় ফিরে গেলেন। হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা বলেন, দরজাটি কিবলার দিকে ছিল।
— আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিজি, নাছায়ী, মেশকাত ৯৪০
হযরত যাবের রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাছুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম এর সঙ্গে জোহরের নামাজ পড়তাম। বেশী গরমের জন্যে আমি মুটোভর্তি ছোট ছোট পাথর নিতাম, যা আমার হাতে ঠান্ডা হয়ে গেলে কপালের নিচে রেখে ছিজদা দিতে পারি।
— আবু দাউদ, নাছায়ী, মেশকাত ৯৪৫
প্রথম অবস্থায় নামাজের ছুরা কেরাত দেখে পড়া বা শুনে পড়া নামাজের মধ্যে থেকে কাউকে ছালাম দেয়া বা ছালামের উত্তর নে’য়া এসব জায়েজ ছিল।
নামাজের আহ্কাম সমূহ
নামাজের আহকাম
১। শরীর পাক বা পবিত্র করা।
২। কাপড় পাক করা।
৩। নামাজ পড়ার জায়গা পাক পবিত্র করা।
৪। ছতর ঢাকা। অর্থাৎ পুরুষের নাভি থেকে হাটুর নিচ পর্য্যন্ত এবং মেয়েদের দু’হাতের কব্জি, দু’পায়ের গিরা ও মুখমন্ডল ব্যতীত বাকী সমপূর্ণ শরীর নামাজের সময় ঢেকে রাখা।
৫। কেবলা অর্থাৎ কাবা শরীফের দিকে মুখ রাখা।
৬। নিয়েত করা
নামাজের আহ্কাম ও আরকান
নামাজের আহকাম
১। শরীর পাক বা পবিত্র করা।
২। কাপড় পাক করা।
৩। নামাজ পড়ার জায়গা পাক পবিত্র করা।
৪। ছতর ঢাকা। অর্থাৎ পুরুষের নাভি থেকে হাটুর নিচ পর্য্যন্ত এবং মেয়েদের দু’হাতের কব্জি, দু’পায়ের গিরা ও মুখমন্ডল ব্যতীত বাকী সমপূর্ণ শরীর নামাজের সময় ঢেকে রাখা।
৫। কেবলা অর্থাৎ কাবা শরীফের দিকে মুখ রাখা।
৬। নিয়েত করা
নামাজের আরকান
১। তাকবীরে তাহরীমা
২। কেয়াম করা।
৩। কেরাত পড়া।
৪। রুকু করা।
৫। ছেজদা করা।
৬। কায়দায়ে আখিরাহ বা শেষ বৈঠক।
৭। খুরুজ বি ছুনয়িহী
নামাজের শুরুতে তাকবীরে তাহরীমার সময় কান পর্যন্ত হাত উঠানো সুন্নাত । নামাযের মধ্যে অন্য সময় রফে’ ইয়াদাইন বা হাত উঠানো জায়েজ নয় (সুন্নাত নয়) । নিম্নে এর দলীল পেশ করা হলোঃ
১) তিরমিযী, আবু দাউদ ও নাসায়ী শরীফে উল্লেখ হয়েছেঃ
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্নিত হয়েছে যে, তিনি (একদিন উপস্থিত লোকদের) বললেন, আমি কি তোমাদের নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর নামাযের মত নামায পড়বো ? অতঃপর তিনি নামায পড়লেন এবং প্রথমবার অর্থাৎ তাকবীর তাহ্রীমা ব্যতীত অন্য কোন সময় হস্ত উত্তোলন করলেন না ।
ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী (রহঃ) বলেন, ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বর্নিত এই হাদিসটি হাসান, একাধিক সাহাবী ও তাবীঈগণ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন । ইযরত ইবনে মাসঊদ (রাঃ) এর হাদীস সম্পর্কে কেউ কেউ আপত্তি করেছেন । কিন্তু ইমাম ও আলিমগণের অভিমত যে, প্রকৃতপক্ষে তিনি (ইবনে মাসঊদ) নবী করীম (সঃ) এর সফরে ও মুকীমে হালতে সকাল-সন্ধ্যায় হার হামেশা দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে নামায আদায় করেছেন । তিনি ভুল করেছেন, এটা গ্রহণযোগ্য নয় ।[1]
২) বুখারী শরীফের ১ম খণ্ডের টীকায় উল্লেখ হয়েছেঃ
হযরত ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্নিত হয়েছে যে, নবী করীম (সঃ) শুধু নামায শুরু করার সময় তাকবীরে তাহরীমার জন্য হাত উঠাতেন । অতঃপর আর কোথাও (নামাজে) উঠাতেন না ।[2]
৩) উপরোক্ত হাদীস গ্রন্থের টীকায় আরও উল্লেখ হয়েছেঃ
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে রুকুতে যাওয়ার সময় ও রুকু হতে মাথা উঠাবার সময় ‘রফে ইয়াদাইন’ করতে দেখলেন । তখন তিনি তাঁকে বললেন, তুমি এরূপ করিও না । কারন, এটা এমন বিষয় যা রাসুলুল্লাহ (সঃ)করিয়াছিলেন, কিন্তু অতঃপর এটা পরিত্যাগ করেছেন ।[2]
৪) মুসলিম শরীফে বর্নিত হয়েছেঃ
হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্নিত আছে- একদা রসুলুল্লাহ (সঃ) আমাদের নিকট আগমন করে বললেন, কি হলো ? আমি তোমাদেরকে ‘রফে ইয়াদাইন’ করতে দেখছি । মনে হয় যেন তোমাদের হাতগুলো অবাধ্য ঘোড়ার লেজের মত (উঠাচ্ছো), তোমরা নামাজে এরূপ করিও না- ধীরস্থির থাকো ।
৫) আবু দাউদ ও তাহাবী শরীফে উদ্ধৃত হয়েছেঃ
হযরত বারা ইবনে আয়েব (রাঃ) হতে বর্নিত হয়েছে যে, নবী করীম (সঃ) নামাযের শুরুতে তাকবীরে তাহরীমার সময় কানের লতি পর্যন্ত হাত উঠাতেন । পুনরায় আর উঠাতেন না ।
৬) বায়হাকীতে আছেঃ
হযরত ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্নিত আছে যে, নবী করিম (সঃ) নামাজের শুরুতে রফে ইয়াদাইন করতেন । পুনরায় আর উঠাতেন না ।
৭) তাহাবী শরীফে উল্লেখ হয়েছেঃ
হযরত আসওয়াদ (রাঃ) হতে বর্নিত আছে, তিনি বলেছেন, আমি হযরত উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) কে প্রথম রাফে’ ইয়াদাইন করতে দেখেছি । অতঃপর পুনরাবৃত্তি করেন নাই ।
৮) তাহাবী এবং মুয়াত্তায়ে মুহাম্মাদ নামক হাদীস গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছে যে,
হযরত আসেম ইবনে কুলাইব (রাঃ) থেকে বর্নিত আছে, তিনি বলেছেন যে, আমি হযরত আলী ইবনে আবূ তালিব (রাঃ) কে ফরয নামাযের প্রথম তাকবীর ব্যতীত আর কোন সময় হাত উঠাতে দেখি নাই ।
৯) বুখারী শরীফের শরাহ ‘আইনী’ গ্রন্থের তৃতীয় খন্ডে লেখা হয়েছে যে,
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্নিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, আশারায়ে মুবাশশারাহ- যাদেরকে নবী করিম (সঃ) বেহেস্তের সুসংবাদ দিয়েছেন তারা নামায আরম্ভ করার সময় ব্যতীত দুই হাত উঠাতেন না । অর্থাৎ রফে’ ইয়াদাইন করতেন না ।
১০) ‘মুতারজম মুয়াত্তায়ে মুহাম্মাদ’ গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছে যে, হযরত হাম্মাদ ইব্রাহীম নাখয়ী (তাবীঈ) বলেছেন যে,
তোমরা নামাযে তাকবীরে উ’লা ছাড়া অন্য কোন সময় হাত উঠাবে না ।
১১) ‘তানযীমুল আশ্তাত’ নামক গ্রন্থে বিশ্ববিখ্যাত দারুল উলূম দেওবন্দ মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস ফখরুল মুহাদ্দেসীন হযরত মাওলানা ফখরুদ্দীন মূরাদাবাদী উল্লেখ করেছেন যে,
১ম যুগে মুসলমানদের রাজধানী ছিল মদিনায় । তখন সেখানে অনেক অনেক সাহাবায়ে কিরাম ও তাব্যীনে এযাম অবস্থান করতেন । মদীনাবাসীদের আমল দেখে ইমাম মালেক (রহঃ) শেষ জীবনে রফে ইয়াদাইন ত্যাগ করেছিলেন । পরে যখন মদিনা হতে কুফায় রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে গেল, তখন লোকেরা সাহাবা ও তাবেঈগনের আমল দেখে রফে’ ইয়াদাইন করা ত্যাগ করেছিলেন । সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, তৎকালীন মদিনা ও কুফাবাসীগন রফে’ ইয়াদাইন করতেন না ।
১২) তাহাবী শরীফে উল্লেখ হয়েছেঃ
হযরত মুজাহিদ হতে বর্নিত আছে- তিনি বলেছেন যে, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) এর পশ্চাতে নামায পড়েছি । তিন শুধু প্রথম তাকবীরে তাহরীমার সময় নামাযের মধ্যে হাত উঠিয়েছেন । ইমাম তাহাবী বলেন যে, এই আব্দুল্লাহইবনে উমর (রাঃ) ই রাসূল (সঃ) কে প্রথম রফে’ ইয়াদাইন করতে দেখেছিলেন । কিন্তু রাসূল (সঃ) এর ইন্তিকালের পর হজরত ইবনে উমর রফে’ ইয়াদাইন পরিত্যাগ করেছিলেন । এর দ্বারা বুঝা যায় যে, রাসূল (সঃ) এর এই আমলটি মনসূখ বা রহিত হয়ে গেছে । এই জন্যেই হযরত ইবনে উমর পরবর্তী সময়ে এই আমল পরিত্যাগ করেছিলেন ।
১৩) নিহায়া ও কিফায়া কিতাবে বর্নিত আছেঃ
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছিলেন- যে দশজন সাহাবীর বেহেশতী হওয়ার সংবাদ দেয়া হয়েছে, তারা নামায আরম্ভকালে একবার মাত্র রফে’ ইয়াদাইন ব্যতীত তাঁদের হাত উঠাতেন না ।
ইমাম তাহাবী ও আইনী প্রমাণ করেছেন যে, আবূ হুমায়দের রফে’ ইয়াদাইনের হাদীস কয়েকটি কারনে যয়ীফ সাব্যস্ত হয়েছে । সেই দশজন সাহাবা আবূ হুমায়দের সাক্ষাতে ছিলেন, কিন্তু তাঁদের রফে’ ইয়াদাইনের কথা প্রমাণিত হয় না । ইমাম বুখারী যে ১৭জন সাহাবার রফে’ ইয়াদাইনের হাদীস বর্ননা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে হযরত উমর, হযরত আলী, ইবনে উমার, আবূ সাইদ ইবনে যুবাইর রফে’ ইয়াদাইন ত্যাগ করেছিলেন। ইমাম তাহাবী হযরত আনাস ও হযরত আবূ হুরায়রায় হাদীস যয়ীফ সাব্যস্ত করেছেন । আল্লামা জায়লাঈ হজর আবূ সাইদ, হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত ইবনে যোবায়ের ও হযরত আবূ হুরায়রার হাদিসকে যয়ীফ বলেছেন । সুতরাং ইমাম বুখারীর রফে’ ইয়ায়াদাইনের হাদীস গ্রহণযোগ্য নয় ।[13]
১৪) হযরত মাওলানা রুহুল আমীন বসিরহাটি রচিত কামিউল মুবতাদেয়ীন ফী রদ্দে ছিয়ানাতুল মু’মিনীন গ্রন্থে লিখেছেন যে,
ইমাম আযম আবূ হানীফা (রহঃ) এর মতে রফে’ ইয়াদাইনের হাদীস মনসুখ (রহিত) হয়েছে । এটা হযরত আবুদল্লাহ ইবনে মাসঊদ, হজরত বারা ইবনে আযেব, হযরত জাবের ইবনে সামরা (রাঃ) প্রমুখ সাহাবায়ে কিরামের মত । হজরত উমর, হযরত আলী ও হযরত ইবনে উমর (রাঃ) উক্ত রফে’ ইয়াদাইন ত্যাগ করেছিলেন । কূফাবাসী মুহাদ্দিস, শ্রেষ্ঠ ইমাম সুফিয়ান সওরী, ইবরাহীম নাখয়ী, ইবনে আবী লাইলা, আলকামা, আসওয়াদ, শা’বী, আবূ ইসহাক, খায়ছমা, মুগীরা প্রমুখ মহাবিদ্বান গণের এই অভিমত ।
উপরোক্ত আলোচনায় প্রমাণিত হল যে, নামাযে তাকবীরে তাহ্রীমা ব্যতীত কোন রফে’ ইয়াদাইন বা হস্ত উত্তোলন না করার প্রমাণ হাদিসে বিদ্যমান । সাহাবা ও তাবীঈগণের এক জামায়তও হাত না উঠাবার মত প্রকাশ করেছেন । অতএব, ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) এবং তাঁর অনুসারীগণ নবী করিম (সঃ) এর আমল এবং হাদীস বর্ননাকারীদের মতভেদের উপর পূর্ন দৃষ্টি রেখে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) এবং তাবীঈগণের বর্ননার উপর গুরুত্ব আরোপ করে রফে’ ইয়াদাইন না করার মত প্রকাশ করেছেন । আমরা হানাফিগণ এই মতের উপর আমল করে থাকি । সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য যে, ভারত উপমহাদেশ তোহা মুসলিমজাহানের স্বনামখ্যাত আলিম হযরত শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভী এবং তাঁর সুযোগ্য পুত্র ও পৌত্রগণ যারা এই উপমহাদেশে হাদিস শাস্ত্রের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন তারা নামাযে রফে’ ইয়াদাইন করেন নাই ।[15]
· তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ২৯২
· · বুখারী শরীফের ১ম খণ্ডের টীকা, পৃঃ ১০২
· · তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ২৯৪
· · তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ২৯৩
· · তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ২৯২
· · তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ২৯৫
· · মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ (ঊর্দূ), পৃঃ ৫৫
· · তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ২৯৫
· · আইনী গ্রন্থ, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৭
· · মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ (ঊর্দূ), পৃঃ ৫৫
· · তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ২৯৬
· · আনোয়ারুল মুকাল্লেদীণ, ইফাবা, পৃঃ ৫৫
· · সাইফুল মুকাল্লেদীন, প্রণেতা মাওঃ ইব্রাহীম মহব্বতপুরী, পৃঃ ৩৫
· · কামিউল মুবতাদেয়ীন, ৩য় খন্ড, প্রণেতা মাওঃ রুহুল আমীন বসিরহাটী
· হানাফীদের কয়েকটি জরুরী মাসায়েল (লেখকঃ মাওলানা মোঃ আবু বকর সিদ্দীক)