জন্ম ও পরিচয়ঃ জন্ম ও পারিবারিক জীবনে নাম শাহ মোহাম্মদ ইবরাহীম আলী, ‘তশ্না’ উপাধিতে ব্যাপক পরিচিত, তাঁর বংশ-পরিচয় ‘ফারুকী’ নামে । ১২৮৯ হিজরি মোতাবেক ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের কানাইঘাটউপজেলার বাটইআইল গ্রামের ঐতিহ্যবাহী এক মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম । > পিতা কাদরিয়া তরিকার প্রখ্যাত পীর মাওলানা শাহ্ আবদুর রহমান কাদরী এবং বড় ভাই ‘বাংলার তোতা’-খ্যাত মাওলানা ইসমাঈল আলম ছিলেনবাংলাভাষী উর্দু কবিদের মধ্যে অন্যতম । > ইবরাহীম তশ্না-র পূর্বপুরুষ শাহ তকিউদ্দীন (রাহঃ) ছিলেন সিলেট-বিজয়ী কিংবদন্তি হযরত শাহজালাল (রাহঃ)-এর অন্যতম সফর-সঙ্গী এবং পবিত্র মক্কানগরী হতে আগত কোরাইশবংশোদ্ভূত, তকিউদ্দীনের মাজার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জালালপুরের শেখপাড়ায় অবস্থিত ।
শিক্ষাজীবনঃ প্রাথমিক শিক্ষা পিতার একান্ত তত্ত্বাবধানে, তারপর তদানীন্তন আসাম প্রদেশের খ্যাতনামা ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফুলবাড়ি আজিরিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন ইবরাহীম তশ্না । > সেখানে আলেম এবং সুফিপণ্ডিত মাওলানাআব্দুল ওহাব চৌধুরী-র সাহচর্যে ইসলামি শিক্ষার পাঠ শুরু করেন । প্রখর মেধাবী তশ্না এখানে আরবি, ফারসি শিক্ষা লাভে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে বেশ সুনাম অর্জন করেন । ফুলবাড়ি মাদ্রাসায় শিক্ষা সমাপ্তির পর ১৮৮৯খ্রিস্টাব্দে চলে যান ভারতীয় মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ দ্বীনি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বিশ্বখ্যাত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় দারুল উলুম দেওবন্দ-এ । সেখানে তিনি হাদিস-শাস্ত্রে ১ম স্থান অধিকার করেন । দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় শিক্ষা সমাপ্তিরপরও তশ্না-র জ্ঞানপিপাসা মেটেনি, তিনি চলে যান দিল্লি । দেওবন্দ ও দিল্লির একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটানা নয় বছর অধ্যয়ন করে ইলমে-হাদিস, উর্দু এবং ফারসি ভাষায় গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন ।
শিক্ষা আন্দোলন ঃ নয় বছর জ্ঞান-সাধনার পর ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে তশ্না দেশে ফিরেন । মুসলমানদের পশ্চাৎপদতা তাঁর মনে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া তৈরি করে । > নয় বছরের অর্জিত জ্ঞান তিনি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগীহন । এ উদ্দেশ্যে একদিন পার্শ্ববর্তী সাত গ্রামের জনসাধারণকে নিয়ে স্থানীয় উমরগঞ্জ বাজারে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেন । সভায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর বক্তব্য দিয়ে শেষ পর্যায়ে হঠাৎ বলেন, ‘আমি দীর্ঘ নয়বছর বিদেশে থেকে আপনাদের জন্য সামান্য খেজুর নিয়ে এসেছি । আমার ইচ্ছা আজকের সভায় খেজুরগুলো বণ্টন করে দিই ।’ জনতার অনেকেই খেজুরের আশায় এদিক ওদিক তাকালো ! তিনি তখন বললেন, ‘এ খেজুর ইলমেদ্বীনের খেজুর । আজ আমি এ মাটিতে ইলমে দ্বীনের একটি বীজ রোপণ করতে চাই, ইলমে দ্বীনের এ বীজের বদৌলতে ইসলামের আলো চিরদিন জ্বলতে থাকবে ।’ এ কথা বলে উপস্থিত জনতার মতামত জানতে চান । উপস্থিতি তাঁরকথায় সম্মতি প্রদান করলে ১৩১৭হিজরি; ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় বৃহত্তর জৈন্তা অঞ্চলের দ্বিতীয় প্রাচীন ইসলামীক প্রতিষ্ঠান ‘মাদ্রাসায়ে ইমদাদুল উলুম- উমরগঞ্জ’। তখনকার সময়ে জৈন্তা-অঞ্চলে সঠিকভাবে কোরআনেরসঠিক শিক্ষাপদ্ধতি তথা তাজবিদের কোন উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান ছিল না । তাঁর প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে জৈন্তা অঞ্চলে তাজবিদের মাধ্যমে কোরআন শিক্ষার প্রচলন হয় ।
তশ্না উপাধিঃ ইবরাহীম তশ্না মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর কিছুদিন নিজেই শিক্ষকতা করেন । কিন্তু তাঁর জ্ঞান অর্জনের তৃষ্ণা তখনো মেটেনি । কয়েকজন ছাত্রসহ ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন । দিল্লী ছাতারিস্টেট-এ ওস্তাদ শায়খুল হাদিস মাওলানা নাজির হুছাইন মদনী (রাহঃ)-র খেদমতে আরও দু’বছর থেকে হাদিস-শাস্ত্রে উচ্চতর সনদপ্রাপ্ত হন । ওস্তাদ জ্ঞানের তীব্র পিপাসা দেখেই তাঁকে ‘তশ্না’ অর্থাৎ ‘পিপাসু’ উপাধি প্রদান করেন ।
আধ্যাত্মিক জীবনঃ প্রাতিষ্ঠানিক-শিক্ষা সমাপ্তি পর তশ্না কিছুদিন হাকিমুল উম্মত হজরত মাওলানা আশরফ আলী থানবী (রাহঃ)-এর খেদমতে থেকে তাঁর মুরিদ হন এবং ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে মারিফাতের কঠোর সাধনায়আত্মনিয়োগ করেন ।
ইসলামি জলসার প্রচলনঃ তশ্না ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন আসাম অঞ্চলের প্রথম ইসলামি জলসার আয়োজন করেন ‘ইমদাদুল উলুম, উমরগঞ্জ’ মাদ্রাসা ময়দান-এ । জলসার মাহফিল আয়োজন ছিল তশ্না-র এক বিরল ওঐতিহাসিক সংস্কার আন্দোলন । জনসাধারণের সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে মুনশি মেহেরউল্লাহ ১৮৯৭-৯৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে ব্যাপক ভিত্তিক ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করেন । সমসময়ে ইবরাহীম তশ্না সিলেটঅঞ্চলে কোরআন-হাদিস আমজনতার মধ্যে প্রচারের উদ্দেশে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৩২৪ হিজরি সনে ইসলামি জলসার প্রবর্তনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন । এ আন্দোলনের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যেইসলামি জ্ঞানের প্রচার-প্রসার হয় এবং এ আন্দোলন পরবর্তীকালে জৈন্তা অঞ্চলের সাধারণ জনতাকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হতে অনন্য ভূমিকা পালন করে ।
খেলাফত আন্দোলনঃ ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায় ‘খেলাফত আন্দোলন’ । এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা মুহাম্মদ আলী, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানাআকরাম খাঁ প্রমুখ সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ । এ সময় খেলাফত আন্দোলনের নেতা মাওলানা মুহাম্মদ আলী এবং শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রাহঃ)-এর নির্দেশে ইবরাহীম তশ্না সিলেট ও আসামের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন ।তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতায় গ্রামেগঞ্জে অভূতপূর্ব জাগরণের সৃষ্টি হয় । এসময় তাঁর রচিত অনেক গান গ্রামেগঞ্জে মানুষের মুখে মুখে ছিল । ইবরাহীম তশ্না-র সাহস ও রাজনৈতিক দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে অল-ইন্ডিয়া খেলাফতআন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্তর্ভুক্ত করা হলে তাঁর দিল্লি-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত হয় । তশ্না যখন গ্রামেগঞ্জে অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছেন, তখন ব্রিটিশ সরকার তাঁর ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে এবংগ্রেফতার করে । সিলেট কেন্দীয় কারাগারে বন্দিবস্থায় তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হলে তিনি সুস্পষ্ট জানিয়ে দেন- ‘বন্দী অবস্থায়ও আমরা স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি । এটা কখনও মনে করবেন না যে আমরাএখানে বৃথা সময় নষ্ট করছি । আমরা কখনও খ্রিস্টান সরকারের ভয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম ত্যাগ করতে পারি না । রূহ জগৎে আমরা করুণাময় আল্লাহর কাছে ওয়াদা করেছি যে, আমরা দ্বীনের জন্য ও ন্যায় বিচারের জন্য সংগ্রামকরবই করব ।
‘ইবরাহীম তশ্না (রাহঃ) যখন সিলেট কারাগারে বন্দি তখন নামাজের সময় নামায ও আজানের কোন ব্যবস্থা ছিল না । ইবরাহীম তশ্না ও ড. মর্তুজা চৌধুরী-র আন্দোলনের ফলেই তখনকার জেল কর্তৃপক্ষ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়আজান ও নামাজের জন্য মসজিদের বন্দোবস্ত করতে বাধ্য হয় ।’ কারাগারে তাঁর সাথে ছিলেন মাওলানা আবদুল মুছব্বির, বিপ্লবী ও অনলবর্ষী বক্তা ফজলুল হক সেলবর্ষী, ড. মর্তুজা চৌধুরী, মাওলানা সাখাওয়াতুল আম্বিয়া প্রমুখনেতৃবৃন্দ । ভারত উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু দিল্লি জামে মসজিদে উর্দু ভাষায় তাঁর এক বক্তব্যে উপস্থিতিরা চমকে যান । তারা জানতে চায়, মাওলানা কোন এলাকার লোক । যখন জানলো তিনি বাংলারঅধিবাসী, তখন ‘বাংলাদেশে এমন উর্দু বক্তা আছে?’- বলে বিস্ময় প্রকাশ করে । ‘কল্লোল’ পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে মাওলানা আবদুল আওয়াল লিখেন, খিলাফত আন্দোলনের লক্ষ্ণৌ সম্মেলনে সব নেতাই ব্রিটিশ পণ্য এবং ইংরেজি শিক্ষাবর্জনের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখলেও দুরদর্শী তশ্না তখন বুঝতে পেরেছিলেন যে-হারে ইংরেজি শিক্ষা বর্জন শুরু হয়েছে তাতে ইংরেজী শিক্ষিতরাই লাভবান হবে । তাই তিনি লক্ষ্ণৌ সম্মেলনে ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েবলেছিলেন, ‘আমরা আরবি, ফারসি, উর্দু এবং অন্যান্য ভাষায় শিক্ষা অর্জন করে থাকি । তদ্রূপ ইংরেজি একটি ভাষা মাত্র । ইংরেজদের সাথে আদর্শিক ভিন্নতা থাকতে পারে, তাই বলে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা অপরাধ নয় । ইংরেজদেরআচরণ অণুকরণ করাই অপরাধ ।’ এ বক্তব্যে তিনি দৃঢ় থাকায় সমকালীন অনেক আলেমের কাছে যদিও সমালোচিত হয়েছিলেন, তবু এতে তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায় । বক্তব্যের বাস্তব প্রয়োগ করেন তাঁরভাতিজা পীর মাওলানা শফিকুল হক (রাহঃ)-কে ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে । যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দু’শ বছরের গোলামির জিঞ্জির ভেঙে স্বাধীনতার সূর্য ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে উদিতহয়েছিল ইবরাহীম তশ্না (রাহঃ) ছিলেন তাঁদের অগ্রসৈনিক ।
কানাইঘাটের লড়াইঃ উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তেজনাকর মুহূর্তে জৈন্তিয়া-খাসিয়া পাদদেশের অঞ্চলেও তার প্রভাব পড়ে । পাহাড়ি হিমেল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা এ অঞ্চলের গণমানুষের রক্ত জেহাদি জোশে টগবগ করতেথাকে । ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ । ব্রিটিশ-ভারতজুড়ে দুর্বার গতিতে চলছে খেলাফত আন্দোলন । ইবরাহীম তশ্না প্রবর্তিত ইসলামি জলসাসমূহ তখন সিলেট অঞ্চলের খেলাফত আন্দোলনের চেতনা-কেন্দ্র হয়ে উঠেছে । আন্দোলনের অংশহিসেবে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে মার্চ কানাইঘাট মানসুরিয়া মাদ্রাসা-র জলসা উপলক্ষে জনসভা আহবান করা হয় । ইবরাহীম তশ্না-র সভাপতিত্বে জলসার কার্যক্রম শুরু হলে ব্রিটিশ প্রশাসন জলসা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। সুরমা ভেলির কমিশনার জে. ই. ওয়েবস্টার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন । ঘটনার প্রেক্ষাপটে জনতার মাঝে প্রচণ্ড উত্তেজনার সৃষ্টি করে । কমিশনার গুর্খা ও পুলিশবাহিনীকে গুলি বর্ষণের আদেশ প্রদান করলে ঘটনাস্থলেই শহিদ হনস্থানীয়: মৌলভী আব্দুস সালাম (গ্রাম: বায়মপুর), মো. মুসা মিয়া (গ্রাম: দুর্লভপুর), আব্দুল মজিদ (গ্রাম: নিজ বাউরবাগ), হাজী আজিজুর রহমান (গ্রাম: সরদারিপাড়া), ইয়াসিন মিয়া (গ্রাম: চটিগ্রাম)। এ ঘটনার জের ধরেকানাইঘাটের জনগণের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয় । কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় নেতৃত্বে থাকা ইবরাহীম তশ্না (রহ.) সহ অনেককে ।
রচনাবলীঃ অগ্নিকুণ্ড মাওলানা ইবরাহীম তশ্না-র অমর রচনা । প্রখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক আব্দুল জলীল বিসমিল ইবরাহীম তশ্নার উর্দু ও ফারসিতে দু’শোর অধিক এবং বাংলায় ৩৬০টি সঙ্গীতের উল্লেখ করেছেন । গ্রন্তর্ভুক্ত রচনাসমূহে উচ্চাঙ্গের আধ্যাত্মিক ভাবধারার প্রকাশ হয়েছে । বিভিন্ন সময়ে সংক্ষিপ্তাকারে তাঁর জীবনাংশের সাথে অগ্নিকুণ্ডের গুটিকয় গান প্রকাশ হয়েছে । তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ইন্সপেক্টর সেন্ট্রাল এক্সাইজ পদে চাকুরিরত উর্দুভাষীসাহিত্যিক আব্দুল জলীল বিসমিল ইবরাহীম তশ্না-র জীবনীসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপি প্রকাশের উদ্দেশ্যে গ্রহণ করেন । তবে দুঃখজনক হলো তিনি ছুটিতে পশ্চিম পাকিস্তানে গেলে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙলাদেশ স্বাধীন হয় এবংতিনি আর ফেরেন নি, ফলে তশ্না-র জীবনের উল্লেখযোগ্য দিক ও রচনাবলি হারিয়ে যায় । বিসমিল ‘তশ্না কি জজবা’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন বলে জানা যায় । বিসমিল তাঁর অপর গ্রন্থ ‘সিলহেট মে উর্দু’ গ্রন্থে তশ্নার ওপরআংশিক আলোচনা করেছেন । একুশে বইমেলা, ঢাকা- ২০০৯-এ কবি সরওয়ার ফারুকী সম্পাদিত ‘মরমি কবি ইবরাহীম আলী তশ্না ও অগ্নিকুণ্ড গানের সংকলন’ গ্রন্থে ২৯৭টি গান সংকলিত করে মদিনা পাবলিকেশন্স, ঢাকা কর্তৃকপ্রকাশ করলে নতুনভাবে তশ্না-র ওপর দৃষ্টি পড়ে সুধীজনের । ‘নুরের ঝংকার’ নামে তশ্না-র সঙ্গীত প্রথম প্রকাশ হয় ১৩৪৪ বাংলা ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে । ইবরাহীম তশ্না-র জীবনী ও অগ্নিকুণ্ড গ্রন্থের কয়েকটি গান তাঁর বড়ছেলে মাওলানাসিদ্দিকুর রহমান ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ‘ইবরাহীম তশ্নার সংক্ষিপ্ত জীবনী ও অগ্নিকুণ্ড’ শিরোনামে নামে ৩৪টি গানসহ একটি ছোট্ট সংকলন প্রকাশ করেন । তশ্না-র ২য় ছেলে মাওলানা ওলিউর রহমান (রহ.) ‘অগ্নিকুন্ড ও শাহ শীতালংরচিত কতিপয় রাগ’ শিরোনামে ১৩৯৮ বাংলা, ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে একটি বইয়ে তশ্না ও মরমি কবি শীতালং শাহ’র ওপর তথ্যপূর্ণ আলোচনা করেন । এছাড়া পত্র-পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেছেন গবেষক অধ্যাপকমুহম্মদ আসাদ্দর আলী, সামছুল করিম কয়েস, গবেষক আবদুল মতিন চৌধুরী সহ অনেকেই । ইসলামি বিশ্বকোষ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ ৭০০, ২য় সংস্করণ, জুন-২০০৬খ্রিঃ-এ তশ্না’র ওপর আলোচনা হয়েছে । মাওলানা ইবরাহীম তশ্না উর্দুও ফার্সি ভাষায় গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন । অধ্যয়ন ছিল তাঁর স্বভাবজাত । স্বাভাবিকভাবে তাঁর রচনাতে উর্দু ফারসি শব্দের বিরল সমাহার ঘটে । বাংলা সাহিত্যের আধ্যাত্মিক রচয়িতাদের মধ্যে মাওলানা ইবরাহীম তশ্না ছিলেনসর্বোচ্চ একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত । তাঁর রচনাবলি বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ এবং এতে রূপকের ব্যবহার অত্যধিক । বিশিষ্ট গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল বলেছেন, ‘এ কথা সত্য যে, তাঁর সঙ্গীতের মর্ম বুঝতে হলে জ্ঞান মার্গের বাসিন্দাহতে হবে ।’ বিশেষ করে তাঁর উর্দু ও ফার্সি রচনাসমূহ অত্যন্ত উঁচু মানের ছিল । স্বাধীনতার জন্যে ব্যাকুল তশ্না দেশ ও জাতির জন্যে হৃদয়ের হাহাকার অত্যন্ত জোরালোভাবে কয়েকটি উর্দু কবিতায় বর্ণনা করেন । কাব্যপ্রতিভাইবরাহীম তশ্না রচনা করেছেন কয়েকখানা মৌলিক কিতাব । যে-সবের মধ্যে তাজবীদ একটি । এছাড়াও লিখেছেন শরাহে কাফিয়্যা, শরাহে উসুলুসসাশী ও শরাহে তাহজীব । যদিও এ কিতাবগুলো দোষ্প্রাপ্যই বটে । সঙ্গীত বৈচিত্রসম্পাদনা ইবরাহীম তশ্না ইসলামী শিক্ষায় সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত, সুপরিচিত এক আলেম । জীবন ধারণে তিনি ছিলেন শরিয়ত নিয়ন্ত্রিত পূর্ণাঙ্গ মুসলিম । তাঁর সঙ্গীতও চমৎকারভাবে ইসলামী ভাব নিয়ন্ত্রিত । লোক গবেষক প্রফেসরনন্দলাল শর্মা তাঁর গীতিগুচ্ছকে বিষয় বস্তু অণুযায়ী ১১টি ভাগে ভাগ করেছেনঃ আল্লাহ স্মরণ নবী স্মরণ ওলি স্মরণ মুর্শিদ স্মরণ ভক্তিমূলক ফকিরি তত্ত্ব নিগূঢ় তত্ত্ব মন:শিক্ষা দেহতত্ত্ব কামতত্ত্ব বিচ্ছেদ আল্লাহ স্মরণ বিষয়ক গীতিসংখ্যা ২৫ টি । তশ্না বিশ্বের সর্বত্র দয়াল রব্বানি আল্লাহর জয়ধ্বনি শুনতে পেয়েছেন । আকাশে ও পাতালে তাঁর মহান নামের জয়ধ্বনি । আমরা ইহজগতে যাদের বন্ধু বলে জানি তারা প্রকৃত বন্ধু নয় বলে তাঁর অভিমত । মহানবী (সা.) ও স্মরণে তশ্না পঁচিশটি গান রচনা করেছেন । ‘উম্মতের কান্ডারী নবী রহমতের সাগর’; তাঁর রওজা মোবারক জিয়ারত করতে সক্ষম না হওয়ায় কবি আফছোছ করেছেন । তাঁর মনে হয়েছে এজন্য তাঁর ‘জমানা বিফলে গেছে’ । সুফি সাধনার বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে ইবরাহীম তশ্না গান রচনা করেছেন । যেমন- ফকিরিতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, কামতত্ত্ব প্রভৃতি । ফকিরিতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর রচিত গীতি সংখ্যা বেশি নয় । ফকির বলতে বর্তমানে ভিক্ষুক বা উদাসীবে’শরা ফকির বা মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়ানো মাদকাসক্তদের বোঝানো হয় । এরা প্রকৃত ফকির নয় । প্রকৃত ফকির হলেন দীনের ফকির । একমাত্র আল্লাহকে লাভ করার আশায় যারা পার্থিব সুখশান্তি ভোগবিলাস বর্জন করেসৃষ্টিরহস্য অণুসন্ধানের পথে নেমেছেন ।
পরিবারঃ পারিবারিক জীবনে ছিলেন ছয় সন্তানের জনক । করেছেন চার বিয়ে । প্রথম ছেলে হলেন মাওলানা সিদ্দিকুর রহমান, ২য় ছেলে মাওলানা ওলিউর রহমান, ৩য়া- মেয়ে আতিকা বেগম, ৪র্থ ছেলে ক্বারী আতিকুর রহমান, ৫ম ছেলে ক্বারী জমিলুর রহমান, ৬ষ্ঠ মেয়ের নাম জানা যায়নি ।
ইন্তেকালঃ এ মহান মনীষী ২সেপ্টেম্বর ১৯৩১খ্রিস্টাব্দ, ১৩৩৮ বাংলা, ভাদ্র মাসের শেষ শুক্রবার ৬৩ বছর বয়সে কলেরা রোগে ইন্তেকাল করেন ।
তথ্যসূত্র ঃ সম্পাদনা উদ্ধৃতি সম্পাদনা জালালাবাদের শত মনীষা, রাগিব হোসেন চৌধুরী, দৈনিক সিলেটের ডাক, ১৮ই ফাল্গুন, ১৪০০ বাংলা সিলহেট মে উর্দু, আবদুল জলীল বিসমিল, করাচি, পাকিস্তান গ্রন্থপঞ্জী সম্পাদনা উদাসীতশ্না- মাওলানা ওলিউর রহমান স্মৃতির পাতায় জালালাবাদ- শহীদ চৌধুরী ইসলামি বিশ্বকোষ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ ৭০০, ২য় সংস্করণ, জুন-২০০৬খ্রিঃ সিলহেট মে উর্দু- আব্দুল জলীল বিসমিল আযাদী আন্দোলনে আলেম সমাজের সংগ্রামীভূমিকা- যুলফিকার আহমদ কিশমতী মরমি কবি ইবরাহীম আলী তশ্না ও অগ্নিকুণ্ড গানের সংকলন, সরওয়ার ফারুকী, মদিনা পাবলিকেশান্স । আশরাফ সিদ্দিকী: লোক সাহিত্য হয় খণ্ড, ঢাকা ১৯৯৫ গুরুসদয় দত্ত ও নির্মলেন্দুভৌমিক সম্পাদিত : শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত, নন্দলাল শর্মা সম্পাদিত: বাঁশির সুরে অঙ্গ জ্বলে, সিলেট ২০০৭, : মরমী কবি শিতালং শাহ, ঢাকা ২০০৫ মুহম্মদ এনামুল হক : সূফী প্রভাব, ঢাকা ২০০৬ সৈয়দ মোস্তফা কামাল : সিলেটেরমরমী সাহিত্য, লন্ডন ১৯৯৮ হরেন্দ্র চন্দ্র পাল : পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস, কলিকাতা ১৩৬০