জন্মঃ মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার চন্দগ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন আলহাজ্ব আব্দুল বারী (র) বড় হাফিজ ছাহেব।
বাল্যজীবনঃ মানব ইতিহাসে দেখা যায়, জগতে যারা মহান আল্লাহর বিশেষ রহমত লাভ করেন তাদের ধৈর্য, সহ্য, স্থিরতা, নিষ্ঠা ইত্যাদি সকল সদগুনের অনুশীলনের মাধ্যমে ভবিষ্যত কর্মের উপযোগী গড়ে তোলা হয়। তিনি এরব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি নামাজ বন্দেগীতে যেমন নিষ্ঠাবান, তেমনটি মুরব্বীদের প্রতি আদব প্রদর্শন ও তাদের সেবাযত্ন ইত্যাদিতে অভিভূত ও মুগ্ধ করেন। বাল্যকাল যখন তিনি হামাগুড়ি দিতেন তখন বাড়ীর কিছু দক্ষিণে ছেলেমেয়েদের মক্তবে পড়ানো হতো। বড় হাফিজ ছাহেব (র) পড়ার আওয়াজ শুনে হামাগুড়ি দিয়ে সেখানে চলে যেতেন।
শিক্ষাজীবনঃ প্রাথমিক জীবনে ৬বছর থেকে ১২ বছর পর্যন্ত তিনি মাওলানা কাছিম ছাহেবের খেদমতে তার তাহাজ্জুদ নামাজের পানি দিয়াছেন এবং তার কাছে পড়াশোনা করেছেন। তিনি বরইকান্দি মাদ্রাসার হাফিজ সুলতানআহমদ সাহেবের খেদমতে গিয়ে কোরআন শরীফ ৩০ পারা মুখস্থ করেন এবং দাওরা দেন। পরে তিনি করমপুর মাদ্রাসার হাফিজ মাওলানা শাহ আব্দুর রউফ করমপুরী সাহেবের নিকট গিয়ে কোরআন শরীফ শুনাইয়াছেন।পরবর্তীতে বড় হাফিজ ছাহেব (র) হযরত শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (র) এর কাছে কোরআন শরীফ তালিম করেন। তাছাড়া বড় হাফিজ ছাহেব (র) যখন মক্কা শরীফ যান তখন মক্কা মুকাররমার ক্বারী আব্বাস সাহেবের কাছেওকোরআন শরীফ শিক্ষা করেন।
শিক্ষকতাঃ বড় হাফিজ ছাহেব (র) এর কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা দিয়ে। তিনি বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকতা করেন। কিছুদিন তিনি জকিগঞ্জ থানার ছাবঘাট মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। ভারতের ধর্মনগরের ফটিকলি নামকস্থানেও তিনি শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তিনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাকি জীবন এই মাদ্রাসাতে শিক্ষকতা করে অতিবাহিত করে গেছেন। তিনি কেবল ছাত্রদের শিক্ষক নয়। জিন্নেমুমিনরাও তার কাছে কোরআন শরীফশিক্ষা লাভ করেছিলেন।
চান্দগ্রাম হাফিজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাঃ বড় হাফিজ ছাহেব (র) প্রাথমিক অবস্থায় বাড়ীর একটি কক্ষে ছাত্রদেরকে কোরআন শরীফ শিক্ষা দেন। পরবর্তীতে তিনি একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তার জীবনের অন্তিম মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি এই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।
মুর্শিদের সান্নিধ্যেঃ আল্লাহর ওলীর সোহবতে থেকে জিকির করে ইসলাহে নফস অর্জন করা ছাড়া কেউ কোন দিন আল্লাহর ওলী হতে পারেনি, যারা আল্লাহর নিকট সমর্পণ করার যত চেষ্টা করেন বা সমর্পিত হন, তারা আল্লাহতা'য়ালার মহব্বত লাভ করেন। আর এই মহব্বতের মাধ্যমে পরম প্রাপ্তি ঘটে নেক বান্দাগণের জীবনে। বড় হাফিজ ছাহেব (র) যখন ইলমে জাহির এর পাশাপাশি ইলমে বাতিন অর্জনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন, তখন তিনিহযরত শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (র) এর খেদমতে হাজির হলেন। প্রিয় মুর্শিদের দিক নির্দেশনায় এবং স্বল্প সময়ের সান্নিধ্য বা সহবতে বড় হাফিজ ছাহেব (র) এর জীবনে এনেছিল অসাধারণ আধ্যাত্মিক বা রুহানী শক্তি।
আধ্যাত্মিকতাঃ বড় হাফিজ ছাহেব (র) মুর্শিদ বদরপুরী (র) এর দরবার থেকে আল্লাহপাকের নৈকট্য লাভ করে চান্দ্রগ্রামে ফিরে আসেন। জীবনে এই অসাধারণ প্রাপ্তীকে আল্লাহর দয়া ও করুনা মনে করে নিজের মধ্যে গোপনে রেখেযথারীতি অধ্যাপনার কাজে আত্ননিয়োগ করলেন। শ্বাশ্বত রাতের আধার কেটে সুর্য তো দিগন্তে উঠবেই। শত আগাছার মাঝে ফুল তো বাগানে ফুটবেই। বাগানে সদ্য ফোঁটা ফুল থেকে যেমন- সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে, তেমনিআধ্যাত্মিক প্রতিভায় উদ্ভাসিত বড় হাফিজ ছাহেব (র) এর স্বনাম ছড়িয়ে পড়লো গোটা অঞ্চলে। যেন আধারের মাঝে আলোর কিরণ। দিক বিদিক থেকে লোকজন আসতে থাকলো তার কাছে।
বড় হাফিজ (র) নসিহতঃ ভালো কাজের আদেশ, মন্দ কাজের নিষেধ, দুনিয়ার জীবনে সামগ্রিক দিক নির্দেশ ও আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ তথ্য আল্লাহ ও রাসুলের সন্তুষ্টির পথে বক্তব্য দ্বারা মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করার নাম নসিহত। বড়হাফিজ (র) জীবনের প্রায় অধিকাংশ সময় দ্বীনি খেদমত ও নসীহতের মাধ্যমে হেদায়াতের কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন।
বিশুদ্ধ কোরআন তিলাওয়াতঃ হযরত আব্দুল বারী (র) মশহুর ওলী হওয়ার পাশাপাশি কোরআনুল করীমের বিশুদ্ধ তিলাওয়াতে পারদর্শী বা খ্যাতনামা হাফিজে কোরআন ছিলেন। কিরাত বিশুদ্ধ করার জন্য সকলকে কঠোরভাবেতাগিদ দিতেন।
হজ্ব পালনঃ বড় হাফিজ ছাহেব (র) ১৯৬১ সালে হজ্ব সমাপন করেন। মক্কা শরীফের তৎকালীন বিশিষ্ট ক্বারী আব্বাস সাহেবের নিকট ও কোরআন শরীফ শিক্ষা করেন।
তাওয়াক্কুল ও পরহেজগারীঃ তাওয়াক্কুল ও পরহেজগারীতা কামিল মুমিনের বৈশিষ্ট্য। তিনি এ সকল গুনাবলীতে এত বেশী অগ্রসর ছিলেন যে, তার ন্যায় পরহেজগার আর মোতাওয়াক্কিল বা আল্লাহতে নির্ভরশীল খুব কমই দেখাযেতো। নিজের সমস্ত কিছুর ফায়সালা বা সমাধান একাগ্রচিত্তে আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিত থাকতে পারতেন। মানুষকে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হতে তিনি নসীহত করতেন।
কারামতঃ ১. বড় হাফিজ ছাহেবের ভাতিজা আকবর আলী সাহেব বলেন একদিন বড় হাফিজ ছাহেব (র) তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্য বড় মসজিদে যাওয়ার পথে মানুষরুপী কলেরা রোগের সাথে দেখা হলো । বড় হাফিজ ছাহেব (র) প্রশ্ন করলেন, তোমরা কারা তারা বলল আমরা কলেরা রোগ। আল্লাহর ওলী বললেন এ গ্রাম থেকে চলে যাও। এদিকে তোমরা আসতে পারবেন না। পরবর্তীতে জানা গেছে যে, পাশের গ্রামে বহু লোক ঐরোগে মৃত্যুবরণকরেছেন। আল্লাহর হুকুমে ওলীরা পারেন রোগের প্রাদুর্ভাব তাড়িয়ে দিতে।
২. বিয়ানীবাজার উপজেলাধীন পাতনগ্রামের মাওলানা আরজদ আলী সাহেবের মেয়ে বলেন। এক সময় আমার মা খুব বেশী অসুস্থ ছিলেন এমতাবস্থায় আমার আব্বা বড় হাফিজ ছাহেব (র) এর কাছে গেলেন। বড় হাফিজ ছাহেবআমার আব্বাকে দেখা মাত্র বললেন আইল ভেঙ্গে পানি প্রবেশ করার পর কেন আসছেন। তখন আমার আব্বা কেদে কেদে বললেন, হুজুর আপনি দোয়া করুন আল্লাহপাক আমার হায়াত কমিয়ে আমার স্ত্রীর হায়াত বাড়িয়ে দেন।যাতে আমার বাচ্চাদের বুক টান্ডা থাকে। বড় হাফিজ ছাহেব (র) বললেন তুমি কি ঠিক কথা বলছ? তিনি বললেন হা। বড় হাফিজ ছাহেব (র) বললেন ঠিক আছে তোমার স্ত্রী ভালো হয়ে যাবে দোয়া করব। তারপর থেকে আমার মাআস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ২১ বছর বেছে ছিলেন। কিন্তু আমার আব্বা মাওলানা আরজদ আলী সাহেব মাত্র ৭ মাস বেচে ছিলেন।
ইন্তেকালঃ ১৯৮৭ সালের ০৮ ই ডিসেম্বর রোজ মঙ্গলবার বড় হাফিজ ছাহেব (র) ইন্তেকাল করেন।
তথ্যসুত্রঃ হযরত হাফিজ আব্দুল বারী (র) এর জীবন ও কারামত বই থেকে নেওয়া।
তথ্য পেতে সহযোগিতা করেছেন মিছবাহ উদ্দিন মাছুম, মাইজগ্রাম, বড়লেখা, মৌলভীবাজার।