কওকাবুদ্দুররী গ্রন্থকার মওলানা মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া কান্দলবী (রঃ)তার উক্ত গ্রন্থে লিখেন কুরআন মজীদের ‘উদউনি আস্তাজীব লাকুম’ (সুরা মোমেন) আয়াত দ্বারা শরীয়াতের সমস্ত বিধানকে শামিল করা হয়েছে। তাই প্রকাশ্য কোন দোয়া বা কোন এবাদতের দোয়া হলেও তাও এ ঘোষণার মধ্যে শামিল। সুতরাং দোয়ার অর্থই কাকুতি, মিনতি, দীনতা, হীনতা ও বিনয়ের সাথে রবকে ডাকা, প্রার্থনা করা। নামজের বা ছালাতের মধ্যে আল্লাহর স্মরণ করা ও তাঁকে ডাকা প্রার্থনা করা । নামাজের পরে বা বাহিরেও যে সব দোয়া হয় তাতে হাত উঠানো ও দোয়া শেষে মুখমন্ডলে হাত মুছা হচ্ছে দোয়ার আদব, বিনয় নম্রতার সাথে প্রার্থনা করা। ফরজ নামাজে যেমন বান্দা তেলাওয়াত করে, দরুদপড়ে জিকির করে, তাছবীহ্ পড়ে দোয়া করে তেমনি নামাজের পরে বা নামাজের বাইরে বা ফরজ নামাজের পরে আরো বেশীতেলাওয়াত দরুদ শরীফ, জিকির, তাছবীহ, দোয়া-প্রার্থনা মুনাজাত করবে। ইহাই নামাজের শিক্ষা, শুধু নির্দিষ্ট সময় নয় অথবা বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সীমাবন্ধ নয়।
তাই দোয়া প্রার্থনা করার নির্দেশটি পালন করা একান্ত অপরিহার্য্য। তাই দোয়া করা হতে বিরত থাকার অর্থ হচ্ছে ইসলামের ঐতিহ্যময় নিয়ম ও প্রথাকে অস্বীকার করা। সুতরাং এরূপ করা নিসন্দেহে অহংকারীদের শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তবে যে সব সমপ্রদায় গাফলাতি ও উদাসীনতার ও মুর্খতার জালে আবদ্দ এবং যাদের কলব(অন্তর)কঠিন হয়েছে তাদের কেউ-ই কুরআনের উক্ত আয়াতের নির্দেশমাফিক বিধান পালন করছেনা।
আয়াতে যে দোয়া করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা করার ক্ষমতা থাকা স্বত্বেও নিজের রিয়া অহংকারের কারণে এবং নিজেকে বহুত জাননেওয়ালা হিসাবে সমাজে প্রকাশ করার জন্য নামাজের পর সবিনয় দোয়াকে পরিত্যাগ করে। অতএব এ সময় আমাদের কর্তব্য হচ্ছে আদব রক্ষা সহ বিনয় নম্রতার সাথে কাকুতি মিনতি সহ দোয়া করা প্রয়োজন।
এজন্যই যারা নামাজের পর রিয়া অহংকারের সাথে দোয়াকে বর্জন করে চলে তাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করা উচিত। দোয়া না করাই বেয়াদবী, দোয়া বর্জনে কোন প্রকার মাজুর (শরীয়াতে দোয়া করা গোনাহ্ এমন কারণ) ভাবাউচিত নয়।(কাওকাবুদ্দুররী ২য় খন্ড, পৃ- ২৯১)[1]
তথ্যসূত্র
প্রশ্নোত্তরে দোয়ার আহ্কাম (লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম, এম, এম)
দোয়া কী ও কেন ?
উত্তরঃ
আল্লাহ বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়াদিব। দোয়া অর্থ ডাকা, প্রার্থনা করা, ভিক্ষা চাওয়া। ছোট বড়র নিকট শব্দ করে কাকুতি মিনতি ও বিনয়ের সাথে কিছু চাওয়া । শরীয়াতে এমন চাওয়া, রকম প্রকারহীন আল্লাহর নিকট চাওয়া । যিনি আকারের মালিক ও নিরাকারেরও মালিক সেই আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা । কোন কোন সুফিয়া কেরাম ফানাফিল্লাহর মাকামে অবস্থান করায় আল্লাহর নিকট কিছু না চাইয়া তাঁর মর্জির উপর ছেড়ে দেয়াই উত্তম বলেছেন । তবে অনেক নবীর দোয়ার বিবরণ কুরআনেই আছে । আমাদের নবী (সাঃ)ও বহু দোয়া করেছেন । তাই দোয়া করা সমস্ত নবীগণের সূন্নাত । নবী (সাঃ)হইতে যে সকল দোয়া বর্ণিত সে সকল দোয়াকে দোয়ায়ে মাসূরা বলে । দোয়া মাসূরার অর্থজেনে নিয়ে প্রার্থনা করা উচিত। নচেত দোয়ায় মনোযোগ হয়না । তবে কোন বিশেষ ব্যাপারে মন খুলে নিজের আবেগ ভরে নিজের মাতৃভাষায় দোয়া করা যায় । অজুর সাথে দোয়া করা সম্ভব হলে কেবলামুখী হয়ে দোয়া করা আরো ভাল ।
উত্তম সময়ে ও স্থানে, শেষরাতে, ফরজ-সুন্নাত নামাজের পর, তেলওয়াতের পর, মসজিদে সম্মিলিতভাবে ও একাকি দোয়া করতে চেষ্টা করা উচিত ।
দোয়ার সময় সিনা বরাবর হাত উঠানো উচিত, মনোযোগ হুজুরী কলব এবং বিনয়ের সাথে কবুলিযাতের নিয়তে, নিশ্চয়তা ও দৃঢ়তার সাথে দোয়া করা আদব অমনোযোগী অন্তর নিয়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করা বেয়াদবী । দোয়ার শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা করা চাই এবং শেষের দিকে নবীজীর উপর দরুদ পাড়া চাই, হাদীস মতে দরুদ ছাড়া দোয়া কবুল হয় না । [1]
তথ্যসূত্র
প্রশ্নোত্তরে দোয়ার আহ্কাম (লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম, এম, এম)
ফরজ নামাযের পর হাদীসে দোয়া আছে কি না ?
ফরজ নামাজের পর দোয়া করা নবী করিম (সাঃ)এর তরীকা ও সূন্নত-(زخيرةالزفر পৃঃ ৫০ )
নবী করিম (সাঃ) প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর দোয়া প্রার্থনা করতেন । নিম্নের এই হাদীস প্রমাণ-
عَنْ اَبِيْ اُمَامَةَ قَالَ قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللَّهِ صَلَّي اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَيُّ الدُعَاءِ اَسْمَعُ فَقَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّي اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَوْفُ الَّليْلِ الْاَخِرِ وَدُبُرَ الصَّلَوَةِ الْمَكْتُوْبَاتِ- مشكوة ترمذي نساءي شريف
অর্থঃ নবী (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হলো কোন সময় বেশী দোয়া কবুল হয় ? তখন নবী (সাঃ) বললেন রাতের শেষ অংশের দোয়া এবং ফরজ নামাজের পরের দোয়া ।
— তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাই শরিফ, মেশকাত শরিফ
সুতরাং উক্ত হাদীস মতে ফরজ নামাজের পর সংক্ষেপ দোয়া শুধু বৈধই নয় বরং উত্তম ।-(জখিরাতুজ্জাফর- ৪৫)
তথ্যসূত্র
প্রশ্নোত্তরে দোয়ার আহ্কাম (লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম, এম, এম)
মুনাজাত কখন দীর্ঘ করা যায় না ?
উত্তরঃ
যে সকল ফরজের পর সুন্নত নামাজ থাকে (যথা জোহর, জুম্মা, মাগরিব, এশা) এসব হলো সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এবং ফরজ নামাজের পরে ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদার আগে এ উভয়ের মাঝে মুনাজাত হলো মুস্তাহাব; এই মুস্তাহাব মুনাজাত লম্বা করার কারণে দেরীতে সুন্নত আদায় করা মাকরুহ হবে। সুন্নাতে মুয়াক্কাদার উপর মুস্তাহাব কাজকে প্রাধান্য দেওয়া বেদাত ও মাকরুহ । (মাজাহেরে হক পৃষ্ঠা- ৩০৮) [1]
তথ্যসূত্র
প্রশ্নোত্তরে দোয়ার আহ্কাম (লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম, এম, এম)
মাছবুক নামাজ চলাকালীন এলান দেয়া জায়েজ কিনা ?
ফরজ নামাযের পর সুন্নাত নামাজ থাকলে যেখানে মুনাযাত সংক্ষেপ করা শরীয়তে বিধান আছে। সেখানে কোন এলান বা ঘোষণা দেয়া মাকরুহ হবে । যেখানে মুনাযাত লম্বা করা মাকরুহ, সংক্ষেপ করা বিধেয়, সেখানে উক্ত ফরজ নামাযের পরে সুন্নাত নামাজ থাকলে কোন এলান বা ঘোষণা দেওয়া আরও মাকরুহ কাজ । ইমান আমলের বয়ান হবে বাকি নামাজ শেষে বসি, ইনশাআল্লাহ বহুত ফায়দা হবে । এই বলে এলান দেওয়া বা কোন ঘোষণা দেওয়া অথবা যে কোন ব্যাপারে চাঁদা তোলা শক্ত বেদাত ও মাকরুহ কাজ । উল্লেখ্য যে, নামাযির পার্শে বা নিকটে যেখানে সজোরে কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, নিষেধ সেখানে উক্ত রূপ এলান্ বা ঘোষণা দান কালে মাছবুক নামাজীরও কানে এলানের আওয়াজ পৌঁছায় । ফলে মনোযোগ ভঙ্গ হয়ে যায় । অথচ প্রত্যহ ফরজ নামাযের পর এলান্ দেয়া ফরজ সুন্নাত, মোস্তাহাব কিছুই নয় । বরং নামাযির নামাজ মনোনিবেশ সহকারে আদায় করা ফরয। নবী কারীম (সাঃ) বলেছেন লা ছলাতা ইল্লা বি হুজুরিল ক্বালবে অর্থাৎ মনের উপস্থিতি ছাড়া নামাজ হয় না ।
সুতরাং নামাযির নামাজরত অবস্থায় মনোযোগ ভঙ্গকারী এমন ঘোষণা বা এলান্ দাতা গুনাহগার হয়ে যাবে । অপর দিকে মুসাল্লিরও নামাযে ছুরা কেরায়াত পাঠ করায় বিঘ্ন ঘটে যাবে এরুপে অপরের নামায বা এবাদতে বাধা বিঘ্ন ঘটিয়ে এলান্ দেওয়ার বিধান বা বয়ান করার বিধান, তেলাওয়াত ও জিকিরের বিধান ইসলামী শরিয়তে কোথাও নেই বরং এটাও বেদাত ও শক্ত মাকরুহ কাজ। এ বিষয়েআল্লাহপাক সুরা বাকারার ১১৪ নং আয়াতে উল্লেখ করেন-
যে ব্যক্তি আল্লাহর মসজিদ সমূহে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে (সালাত আদায় করতে) বাধা প্রদান করে তার চাইতে বড় জালেম আর কে হতে পারে ?
— সুরা বাকারার, আয়াত ১১৪
এর দ্বারা প্রমানিত যে, মসজিদে নামাজির নামাজে ও জিকিরে বাধা দেওয়ার যত পন্থা আছে তা সবগুলোই হারাম ।-(মাআরিফুল কুরআন)
অন্য আমলকারীর নিকট উচ্চ স্বরে তেলওয়াত, সজোরে জিকির নিষিদ্ধ । বয়ান এবং এলান করা আরও নিষিদ্ধ । এ কারণে খফি (গোপন) জিকিরকারীর নিকট সজোরে তেলাওয়াত ও জিকির করা নিষেধ। বয়ান করা, এলান দেওয়া আরও শক্ত নিষেধ এবং গুনাহ ।
— ফতোয়ায়ে আলমগিরি, ফতোয়ায়ে এমদাদিয়া ৪র্থ খন্ড ৫৮ পৃঃ
তথ্যসূত্র
প্রশ্নোত্তরে দোয়ার আহ্কাম (লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম, এম, এম)
ফজরের ফরজ নামাযের পর সমষ্টিগত ভাবে সূরা হাশরের শেষের তিন আয়াত তিলাওয়াত করা জায়েজ কিনা ?
উত্তরঃ
সুরা হাশর ফজর নামাজের পর সমষ্টিগতভাবে সজোরে পড়া বেদাত ও মাকরুহ্ কাজ । উল্লেখ্য যে, সুরা হাশরের সর্বশেষ আয়াত সমূহের উপকারিতা ও কল্যাণ প্রসঙ্গে তিরমিজি শরিফে বর্ণিত আছে যে, নবী কারিম (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি সকালে সুরা হাশরের শেষ ৩ আয়াত পাঠ করবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেস্তা নিযুক্ত করে দিবেন । তারা সন্ধা পর্যন্ত তার জন্য রহমতের দোয়া করবে । সেদিন মারা গেলে শহীদের মৃত্যু হাসীল হবে । যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় এ দোয়া পাঠ করবে সেও এই মর্তবা লাভ করবে ।
উক্ত হাদীসে সূরা হাশরের শেষ ৩ আয়াত সকালে অর্থাৎ ভোরে ঘুম হতে উঠার পর পবিত্র অবস্থায় এবং সন্ধায় একাকি পাঠ করার কথা উল্লেখ রয়েছে । কিন্তু ফজরের নামাজের জামায়াতের পর সরবে সমষ্টিগতভাবে পড়ার বা পাঠ করার কথা আদৌ উল্লেখ নেই । বিধায় ফজরের নামাযের পর সমষ্টিগতভাবে সরবে পড়তেই হবে এটাও বেদাতী আকিদা-বিশ্বাস । কারণ হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী (রহঃ) বলেছেন,
প্রত্যেক আমলের স্থান ও সময় আছে । সময় এবং স্থান মত না করলে তা ত্রুটি হয়। যদিও তা নেক ও ফজিলত পূর্ণ আমল হয় । যেমন নামাজে তাশাহুদ পাঠের সময় যদি কেউ সুরা ফাতেহা পাঠ করে তবে তা ভুল ও গুনাহ্ হবে । যদিও সেই সুরাটি কুরআনের জননী তূল্য হয় ।
— মকতুবাত শরীফ ৫ম খন্ড, ৮১ পৃঃ
উল্লেখ্য যে, ‘আদ্দীন’ কিতাবে ৮০ পৃঃ উল্লেখ আছে যে, নবী কারীম (সাঃ)সুরা হাশরের শেষ ৩ আয়াত ভোরে ঘুম হতে উঠার পর ‘পবিত্রতার সহিত’ পড়ার কথা বলেছেন । ফজরের নামাজ বাদ সাহাবিগণকে সাথে নিয়ে পড়েছেন এ কথা কোন হাদীসে প্রমাণ পাওয়া যায় না । সে কারণে ফজর নামাজ বাদ সকলে একসঙ্গে মিলে সজোরে পড়া বেদাত এবং মাকরুহ । মূল কথা নবী কারীম (সাঃ) যে কোন ব্যাপারে যে ভাবে যা আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন সে ভাবে না পড়লে বা আমল না করলে তার ফায়দা পাওয়া যায় না বরং তার জন্য গুনাহ্ হয়। আর কোন কোন অবস্থায় আল্লাহর লানত পড়তে থাকে । এজন্য প্রত্যেক আমল ইসলামী শরীয়তের অর্থাৎ ফেকাহ্ বিধান অনুযায়ী করা দরকার, নচেৎ ফজিলত, ছওয়াব এবং বরকত কিছুই পাওয়া যাবে না ।
যখন মুসল্লিরা নামাজ, তসবিহ ইত্যাদিতে নিয়োজিত থাকেন তখন মসজিদে ফজরের নামাজের জামায়াতের পরে বা যে কোন ফরজ নামাজের জামায়াতের পরে সরবে সমষ্টিগতভাবে সুরা হাশরের শেষ ৩ আয়াত পাঠ করা মাকরুহ্ এবং বেদাত হবে । কারণ এর দ্বারা অন্যের এবাদতে বিঘগ্ন সৃষ্টি করা হয় । মুলতঃ সেও অন্যের এবাদতের বাধা প্রদানকারী হিসেবে গণ্য হবে এবং গুনাহ্গার হবে । যদিও বাহ্যতঃ ভালো কাজ কিন্তু শরীয়াতে ফেকার বিধান মতে না হলে মাকরুহ্ কাজ হবে । এজন্যে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানি (রহঃ) বলেন,
তাই ধর্ম পথে চলার জন্য এবং আমল করার জন্য একজন মোর্শেদ বা পথ প্রদর্শক দরকার । নচেৎ আমল ও মেহনত বেকার ।
— মকতুবাত শরীফ ৫ম খন্ড ৮১ পৃঃ
তথ্যসূত্র
প্রশ্নোত্তরে দোয়ার আহ্কাম (লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম, এম, এম)
ফরজ নামাজের পর সুন্নাত নামাজ থাকলে মুনাজাতের জন্য শরীয়াতের বিধান কি ?
উত্তরঃ
يْ اُمَامَةَ قَالَ قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ اَيُّ الدُّعَاءِ اَسْمَعٌ قَالَ جَوْفُ الَّيْلِ الْاَخِرِ وَدُبُرَ الصَّلَوَاتِ الْمَكْتُوْبَاتِ - ترمذي
অর্থঃ একদিন নবিজীকে জিজ্ঞাসা করা হল ইয়া রাসুল্লাহ! কোন দোয়া দ্রুত কবুল হয়? নবীজি বললেন, রাতের শেষ অংশের এবং ফরজ নামাজের পরের দোয়া। (অর্থাৎ ফরজ নামাজের পর-সুন্নাতের পরে দোয়া এবং সুন্নাত না থাকা ফরজের পরের দোয়া)
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা নিম্নহাদীস দ্বারা প্রদান করা হয়ঃ
عَنْ عَاءِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّي اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِذَا سَلّمَ لَمْ يَقْعُدْ اِلَّا مِقْدَار مَايَقُوْلُ اَللّٰهُمَّ اَنْتَ السَّلَامُ وَمِنْكَ السَّلَام تَبَارَكْتَ يَاذَالْجَلَالِ وَالْاِكْرَامِ - مسلم
অর্থঃ মা আয়েশা (রাঃ)বলেন নবিজী সালাম ফিরাইবার পর এই দোয়া পড়া পরিমান সময়ের অধিক বসতেন না। “আল্লাহ্হুমা আনতাম সালামু ওয়া মিনকাছ সালাম তাবারাকতা ইয়া জালজালালী ওয়াল ইকরাম (হে আল্লাহ তুমি শান্তিময় এবং তোমার নিকট হইতেই যাবতীয় শান্তি আসে তুমি বরকতময় হে প্রতাপ সম্মানের অধিকারী)”। (মুসলিম)
যে সকল ফরজ নামাজের পর সুন্নাত নামাজ আছে সেই সকল ফরজের পর নবিজী সংক্ষেপে এই দোয়াই করতেন এবং যে সকল ফরজ নামাজের পর সুন্নাত নাই, সেই সকল ফরজের পর অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ দোয়া করতেন । তবে যদি মাসবুক নামাজী না থাকত। মুসলিম জাহানের শ্রেষ্ঠ ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এই হাদিসেরই অনুসরন করতেন ।
হযরত মুজাদ্দিদ আলফে সানী (রাঃ)বলেছেন, একটি মাকরুহ তানজিহ হতে (ছোট মাকরুহ কাজ হতে) আত্মরক্ষা করাও বছরের পর বছর ধরে নফল নামাজ, যিকির এবাদত, দোয়া, মোনাজাত হতে শত শত গুণে শ্রেষ্ঠ ফজিলতপূর্ণ । তাই ফরজ নামাজের পর সুন্নত নামাজ থাকলে দেরীতে সুন্নাত আদায় করা এমন মাকরুহ্ কাজ হতে বিরত থাকা উল্লেখিত ফজিলতের অধিকারী এবং বড়ই সৌভাগ্যের শামীল ।
যে সকল ফরজ নামাজের পর সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্ নামাজ রয়েছে যথাঃ জোহর, মাগরিব, এশা এবং জুমা এই সকল ফরজ নামাজের পর সংক্ষিপ্ত মুনাজাত করা সুন্নাত। কারণ মুনাজাত মুস্তাহাব; তাই মুস্তাহাব আদায় করতে গিয়ে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ নামাজ বিলম্বে আদায় করা মাকরুহ
— মাজাহেরে হক ১ম খন্ড, পৃষ্টা- ৩০৮
সমস্ত ফরজ নামাজের পরই দোয়া করা নবী (সাঃ) এর তরীকা ও সুন্নত। কিন্তু ফরজ নামাজের পর সুন্নাত নামাজ থাকলে সেই স্থলে যথা- জোহর, মাগরিব, এশা ও জুমা নামাজের পর মুনাজাত সংক্ষিপ্ত করা উচিত
— জখিরাতুজ জাফর ৫০ পৃষ্ঠা
উক্ত নামাজ সমূহের পরে লম্বা মুনাজাত করা মাকরুহ তানজিহী।
— মুনিয়া এবং গায়াতুল আওতার
এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عَنْ عَاءِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّي صَلَّي اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يَقْعُدْ اِلَّا مِقْدَار مَايَقُوْلُ اَللَّهُمَّ اَنْتَ السَّلَامُ وَمِنْكَ السَّلَام تَبَارَكْتَ يَاذَالْجَلَالِ وَالْاِكْرَامِ - مسلم شريف مسكوة شريف
মা আয়েশা (রাঃ)হতে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী কারীম (সাঃ)নামাজের সালাম ফেরানোর পর “আল্লাহম্মা আনতাস সালামু ও মিনকাস্ সালাম তাবারকতা ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম” এ দোয়া পড়া সময়ের অধিক বসতেন না বা দেরী করতেন না
— মুসলিম শরীফ, ইবনে মাজাহ্, আবু দাউদ এবং মেশকাত শরীফ
উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় আল্লামা মানাবী (রঃ) বলেন-
لَمْ يَقْعُدْ اِلَّا مِقْدَار مَايَقُوْلُ – الخ اَيْ بَيْنَ الْفَرضِ وَالسُّنَّةِ
অর্থঃ এই পরিমাণ দোয়া পড়া পর্যন্ত বসতেন অর্থাৎ এই দোয়া পড়তেন ফরজের পর এবং সুন্নতে মুয়াক্কাদার পূর্বে -এলাউস্ সুন্নান, আজীজী
উক্ত নামাজ সমূহের পর দোয়া পড়ার পরিমাণ ব্যক্ত হয়েছে; যে সকল ফরজ নামাজের পরে সুন্নাত নামাজ রয়েছে এরূপ স্থলে নবীজী (সঃ)সাধরণতঃ এরূপ কোন সংক্ষিপ্ত দোয়াই করতেন। ইমাম আজম আবু হানীফা (রঃ)এ মতেরই অনুসরণ করতেন
— মেশকাত, মাজাহেরে হক
আর যে সকল ফরজ নামাজের পরে সুন্নাত নামাজ নাই যথাঃ ফজর, এবং আছরের নামাজ- এ স্থলে যতটুকু ইচ্ছা মুনাজাত লম্বা করা যাবে।
وَفِي الْحُجّةِ الْاِمَامُ اِذَا فَرِغَ مِنَ الظُهْرِ وَالْمَغْرِبِ وَالْعِشَاءِ يَشْرَعُ فِيْ الْسُنَّةِ وَلَايَشْغِلُ بِاَدْعِيَةٍ طَوِيْلَةٍ – (كذافي التاتارخانيه – عالمغيري جلداول)
অর্থঃ কিতাবুল হুজ্জাতে উল্লেখ আছে, ইমাম সাহেব যখন জোহর, মাগরিব এবং এশার নামাজ শেষ করবেন, তখন সংক্ষিপ্ত মুনাজাত করে সুন্নাত নামাজ শুরু করবেন। মুনাজাত দীর্ঘ/লম্বা করবেন না
— অনুরূপ তাতার খানিয়া, ফতওয়ারে আলগিরী ১ম জিঃ পৃঃ ৭৭
আশরাফ আলী থানবী (রঃ)এর বেহেস্তী জেওর উর্দ্দু কেতাব পৃষ্টা- ২৩ দেখুন ।
جن فراءض كى بعد سنتين هين انكي بعد دعاء مختصر كرنا هين زياده تاخير كرنا مكروه هين (كذافي الدرالمختار- شامي- تاتارخانيه –منيةالمصلي )
অর্থঃ যে সকল ফরজ নামাজের পর সুন্নাত নামাজ রয়েছে (যেমন- জোহর, মাগরিব, এশা)- যেগুলোর পর সংক্ষিপ্ত দোয়া করতে হয়। দীর্ঘ সময় কাটানো মাকরুহ্।
— যেরূপ আছে দুররুল মুখতার, শামী, তাতার খানিয়া, মুনিয়াতুল মুসল্লীতে
ইমাম সাহেব নামাজ শেষ করে ডানে বামে অথবা মুক্তাদীগনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসবে এবং মুনাজাত করবে, তবে শর্ত হল কোন মাছবুক নামাজী যেন সামনে প্রথম কাতরে না থাকে ।
— আশ্রাফী বেহেস্তী জেওর- ১১ জিঃ পৃঃ ৩৩
جن فراءض كي بعد سنتين هين ان كي بعد دعاء مختصر هونا منا سب اور افضل هين زياده تاخير كرنا مكروه هين (كذافي الدر المختار – شامي – تاتارخانيه – منية المصلي –احسن الفتاوي)
অর্থঃ যে সকল ফরজ নামাজের পর সুন্নাত নামাজ আছে (জোহর, মাগরিব, এশা) তাদের পর সংক্ষিপ্ত মুনাজাত করা উচিত এবং উত্তম। (সুন্নাতে মুয়াক্কাদা নামাজ আদায় করতে) বেশী বিলম্ব করা মাকরুহ ।
— অনুরূপ দুররুল মুখতার, শামী তাতার খানিয়াহ, মুনিয়া, আলমগিরী কিতাবে আছে; আহসানুল ফতওয়া ১ম জিঃ পৃঃ ৩৪৬
কোন কিতাবে দেখা যায় প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তিনবার আসতাগফিরুল্লাহাল্লাজি লাইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়ুল কাইয়ুম ওয়া আতুবু ইলাইহে, আয়াতুলকুর্ছি, এখলাছ, ফালাক, নাছ এক একবার এবং ৩৩ বারসুব্হানাল্লাহ ৩৪ বার আলহামদুল্লিলাহ, ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়া মোস্তাহাব। তবে যে ফরজ নামাজের পর সুন্নাত নামাজ আছে এগুলো সুন্নাতের পরে পড়াই মোস্তাহাব এবং উত্তম ।
— মারাকি, বেহেস্তিজিওর-পৃঃ ১৫৩
যে সকল ফরজ নামাজের পর সুন্নাত নামাজ আছে, সেক্ষেত্রে আমল, অজীফা, তাছবীহ, তাহ্লীল সমূহ সুন্নাত নামাজ আদায় করার পর পড়তে হবে। এটাই উত্তম
— মারাকী, বেহেস্তি জেওয়র ২য় খন্ড পৃঃ ১৫৩
جن فراءض كي بعد سنتين هين انكي بعد امام اور مقتد يان مختصر دعاء كر سنتين ادا كري (فتاوي دار العلوم ديو بند جلد سوم )
অর্থঃ যে সকল ফরজ নামাজের পর সুন্নত নামাজ আছে সে সকল নামাজের পরে ইমাম এবং মুক্তাদীগণ সংক্ষিপ্ত মুনাজাত করে সুন্নাত আদায় করবে
— ফতওয়ায়ে দারুল উলুমদেওবন্দ ২য় জিঃ পৃঃ ১৯৭
عَنْ اَبِيْ اُمَامَةَ قَالَ قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ اَيُّ الدُّعَاءِ اَسْمَعٌ قَالَ جَوْفُ الَّيْلِ الْاٰخِرِ وَدُبُرَ الصَّلَوَاتِ الْمَكْتُوْبَاتِ ترمذي شريف-مشكوة شريف-
আবু উমাম (রঃ) বলেন একদিন নবীজিকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ্ কোন্ দোয়া দ্রুত কবুল হয়? নবীজি বলেন শেষ রাতের এবং ফরজ নামাজের পরের দোয়া এ হাদীসের ব্যাখ্যা মা আয়শার হাদীসে উল্লেখ হয়েছে যে, ফরজের পর সংক্ষেপ মুনাজাত করে সুন্নাতের পর মুনাজাত লম্বা করার কথা। তবে যে ফরজ নামাজের পর সূন্নাত নেই সেক্ষেত্রে দীর্ঘ মুনাজাত করতে দোষ নেই। আবি উমামারহাদীস মতে। ফরজ নামাজের পর দোয়া কবুল হওয়ার অর্থ ফরজ - সূন্নাত নামাজের পর। অর্থাৎ ফরজের পর সুন্নতে মোয়াকদাহ নামাজ থাকলে সেক্ষেত্রে সংক্ষেপ মুনাজত করে সুন্নাত নামাজ আদায়ের পর যত ইচ্ছা মুনাজাত করা যাবে।
— বেহেস্তি জিওর