নামাজিদের এবাদতে এবং অজিফায় বাধা প্রদান
মুসল্লীরা নামাজে, তেলায়াতে বা অজিফায় লিপ্ত থাকলে মসজিদে সরবে সুরা তেলাওয়াত করা, জিকির করা, নামাজিদের নামাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করা নিষিদ্ধ। এমতাবস্থায় সজোরে বয়ান করা এবং বয়ানের জন্য কোন এলান বা ঘোষণা দেওয়া আরও নিষিদ্ধ। মসজিদে নামাজে (জিকিরে) বাধা দেওয়ার যত পন্থা হতে পারে সে সবগুলোই হারাম । তন্মধ্যে প্রকাশ্য পন্থা এই যে, মসজিদে গমন করতে বা সেখানেনামাজ ও খফি জিকির আজকার করতে এমন এবাদত বন্দেগীতে পরিস্কার ভাষায় নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা । দ্বতীয় পন্থা এই যে, মসজিদে হট্টগোল করে অথবা আশে-পাশে গানবাজনা করে মুসল্লীদের নামাজ ও জিকরের বিঘ্ন সৃষ্টি করা আরও অবৈধ কর্ম এবং শক্ত গুনাহ্ ।
এমনিভাবে নামাজের সময় মুসল্লীরা যখন নামাজ, তসবিহ ইত্যাদিতে নিয়োজিত থাকেন তখন মসজিদে ফজরের নামাজের জামায়াতের পরে বা যে কোন ওয়াক্তের ফরজ নামাজের জামায়াতের পরে সরবে এবং সমষ্টিগতভাবে সূরা হাশরের শেষ ৩ আয়াত অথবা যে কোন তেলাওয়াত করা এবং সজোরে জিকির করা নামাজিদের বা এবাদত কারীদের নামাজে এবং এবাদতে বাধা বিঘ্ন সৃষ্টি করে, মূলত সে বাধাদান কারীদেরই অন্তুর্ভুক্ত হয় । এ কারনেই ফিকাহ-বিদ গণ এ বিষয়গুলোকে নাযায়েজ আখ্যা দিয়েছেন ।
لَايَقْراُ جَهْرًا عِنْدَالْمُشْتَغِلِيْنَ بِالْاَعْمَالِ অর্থঃ কোন আমলকারী ব্যক্তি তার আমল অজিফায় লিপ্ত থাকা কালে তার নিকট উচ্চস্বরে তেলাওয়াত এবং জিকির নিষিদ্ধ ।
— ফতোয়ায় আলমগীরি, এমদাদিয়া ৪র্থ খন্ড, ৫৮ পৃঃ
তেমনি একজন খফী জিকির কারীর নিকট কোন উচ্চসরে তেলাওয়াতকারী সরবে তেলাওয়াত বা যে কোন সরব জিকির করবে না । এটাই আদব ।
— আলমগীরি
যখন কোন এবাদতকারী বা মুসল্লী নামাজ, তসবিহ্ অথবা নামাজিগণ জুম্মার আরবী খুতবা শ্রবণ ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকে তখন মসজিদে নিজের জন্য অথবা কোন ধর্মীয় কাজের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করাও নিষিদ্ধ।
— মাআরেফুল কোরআন পৃঃ ৫৭
ফরজ নামাজের পর দোয়া করা শুধু সেই সকল ফরজ নামাজের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় যারপর কোন সুন্নাত নামাজ নাই বরং সমস্ত ফরজ নামাজের পর দোয়া করা যায় । তার মধ্যে সুন্নাত থাক বা না থাক। তবে ফরজের পর সুন্নত থাকলে সংক্ষেপে মুনাজাত করে সুন্নাত পড়বে দীর্ঘ মুনাজাত সুন্নাতের পরে করবে যত ইচ্ছা করা যাবে ।
— আলমগীরি, বাহারে শরিয়াত- ১৯৯১ পৃঃ, জখিয়াতুজ্জাফর- ৫০পৃঃ, মুসলিম শরীফ
তথ্যসূত্র
প্রশ্নোত্তরে দোয়ার আহ্কাম (লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম, এম, এম)
‘কিরাআত’ শব্দের অর্থ পাঠ করা । নামাযের মধ্যে বিশেষ স্থানে পবিত্র কোরআন হতে কিছু অংশ পাঠ করাকে শরীয়াতের পরিভাষায় ‘কিরাআত’ বলা হয় । নামাযে কিরাআত পাঠ করা ফরয । কিরাতের সর্বিনিম্ন পরিমাণ ছোট তিন আয়াত বাবড়া এক আয়াত । নামাযী স্বীয় সঙ্গতি অনুসারে কিরাআতকে দীর্ঘও করতে পারে । কিন্তু ইমামের পশ্চাতে মুক্তাদি সূরা ফাতিহা এবং অন্য কোণ কিরাআত পড়বে না । বরং নামাযের ধ্যানে ইমামের কিরাআত শুনতে থাকবে অথবা চুপ করে থাকবে । সূরা ফাতিহা ও অন্য সূরা পাঠ শুধু ইমামের দায়িত্ব । ইমাম আযম আবূ হানীফা (রহঃ) এর মতে কোন অবস্থায়ই ইমামের পিছনে মূকতাদের সূরা ফাতিহা ও অন্য আয়াত তিলাওয়াত করা জরুরী নয় । নিচে এর প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হলঃ
১) পবিত্র কোরআনের সূরা আ’রাফ এ ইরশাদ হয়েছেঃ
আর যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা নিবিষ্ট চিত্তে শুনবে এবং চুপ করে থাকবে, যাতে তোমাদের উপর রহমত হয় ।
— সূরা আল-আ’রাফ আয়াত নং ২০৪
এই আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছেযে, এই হুকুমটি কি নামাযের কোরআন পাঠ সংক্রান্ত, না কোন বয়ান-বিবৃতিতে কোরআন পাঠের ব্যাপারে, নাকি সাধারণভাবে কোরআন পাঠের বেলায়, তা নামাযেই হোক অথবা অন্য যে কোন অবস্থায় হোক । অধিকাংশ মুফাসসেরীনের মতে এই-ই যথার্থ যে, আয়াতের শব্দগুলো যেমন ব্যাপক, তেমনি এই হুকুমটিও ব্যাপক ।
কতিপয় নিষিদ্ধ স্থান বা কাল ব্যতীত যে কোন অবস্থায় কোরআন পাঠের ক্ষেত্রে এই নির্দেশ ব্যাপক । উল্লেখ্য যে, কতিপয় তাফসীরকার উক্ত আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে নিম্নোক্ত মন্তব্য পেশ করেছেনঃ
ইমাম বাগাবী তাফসীরে মুয়াল্লেমুত্তানযীন-এ লিখেছেন যে, একদল বিদ্বান বলেন- উপরোক্ত আয়াতটি নামাযের কিরাতের সম্বন্ধে অবতীর্ণ হয়েছে । অর্থাৎ ইমামের পশ্চাতে কিরাআত নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য নাযিল হয়েছে ।[1]
তাফসীরে ইবনে কাসীরে আছে, আলী ইবনে তানহা বলেন, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ননা করেছেন যে, উক্ত আয়াতের অর্থ এই যে, যে সময় ফরয নামাযে কোরআন তিলাওয়াত করা হয়, সে সময় তোমরা (মুকতাদিগন) শ্রবণ কর ও নীরব থাক ।[2]
ইমাম মুজাহিদ বলেন, নবী করিম (সাঃ) নামাযে কোরআন পাঠ করছিলেন, তখন তাঁর পশ্চাতে যুবক কোরআন পড়ছিলেন, সেই সময় উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল ।[2]
ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী তাফসীরে দুররে মানসুরে লিখেছেন-
ইমাম আবূ বিন হুমাইদ ও ইমাম বায়হাকী কিরাআতের অধ্যায়ে হযরত আবুল আলিয়া হতে বর্ননা করেছেন- নবী করীম (সঃ) যে সময় নামাযে কোরআন পাঠ করতেন সে সময় সাহাবাগণও (মুক্তাদি) কোরআন পড়তেন, সেহেতু উক্ত আয়াত নাযিল হয়েছিল । তৎপরে নবী করিম (সঃ) নামাযে কিরাআত পাঠ করতেন, কিন্তু মুক্তাদি সাহাবাগণ কিরাআত পাঠ করতেন না ।
— তাফসীরে দুররে মানসুরে
এ ছাড়া সাইদ বিন মুসাইয়েব, মুহাম্মদ বিন কা’ব জুহুরী, ইব্রাহীম, হাসান বলেন, উক্ত আয়াত নামায সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল ।
২) ‘মিশকাতুল মাসাবীহ্’ হাদীস গ্রন্থ হতে সংগৃহীত হয়েছেঃ
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্নিত আছে,
একবার রাসুলুল্লাহ (সঃ) এরূপ এক নামায হতে অবসর গ্রহণ করলেন যাতে তিনি জেহরী (আওয়াজ) কিরাআত পড়েছিলেন । অতঃপর বললেনঃ তোমাদের মধ্যে কি কেউ এখন আমার সাথে কিরাত পড়েছ ? একব্যক্তি উত্তর করলঃ জ্বি, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! তা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ আমি নামাযে মনে মনে বলতেছিলাম আমার কী হল, কোরআন পড়তে আমি এরূপ টানা হেঁচড়া অনুভব করতেছি কেন ? আবূ হুরায়রা বলেন, যখন লোকেরা রাসূল (সঃ) এর মুখে এটা শুনল, তখন হতে তারা জেহরী নামাযে (ইমামের পিছনে) করাত পড়া হতে বিরত হয়ে গেল ।
— মালেক, আহমদ, আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনু মাজাহ্
ইমাম আযম আবূ হানীফার (রহঃ) মতে এই হাদীস দ্বারা ইমামের পিছনে কিরাআত পড়ার সমস্ত হাদীস মানসূখ হয়ে গিয়েছে ।
৩) মুসলিম, আবূ দাউদ, নাসায়ী ও ইবনু মাজাহ হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত আছেঃ
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেনঃ
রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ইমাম এজন্যই নির্ধারিত হয়েছেন যাতে তার অনুসরণ করা হয় । সুতরাং যখন ইমাম আল্লাহু আকবার বলবে তোমরাও আল্লাহু আকবার বলে এবং যখন তিনি কোরআন পড়বেন তোমরা চুপ থাকবে ।
৪) মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ ও শরহে মাআনিউল আছার গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছেঃ
হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হুযুর (সঃ) এরশাদ করেছেনঃ যে বক্তি ইমামের পশ্চাতে নামায পড়ে, ইমামের কিরাআত তার (মুক্তাদির) কিরাআত বলে গণ্য হবে ।
৫) মুসলিম শরীফে উল্লেখ হয়েছেঃ
হযরত আবূ হুরায়রা ও হযরত কাতাদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে,
যখন (ইমাম) কিরাআত পড়ছেন, তখন তোমরা (মুক্তাদি) চুপ থাকবে । এতে মুক্তাদিগণের পক্ষে কিরাআত পাঠ করা ঠিক নয় ।
৬) দারে কুত্নী গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছেঃ
হযরত শা’বী বর্ননা করেছেন,
নবী করিম (সঃ) এরশাদ করেছেন, ইমামের পশ্চাতে মক্তাদির কোন কিরাআত নাই ।
৭) উক্ত কিতাবে আরও উল্লেখ হয়েছেঃ
হযরত আলী (রাঃ) বর্ননা করেছেন,
এক ব্যক্তি নবী করীম (সঃ)কে বললেন, আমি কি ইমামের পিছনে কিরাআত পড়ব, না চুপ থাকব ? নবী করিম (সঃ) বললেন, চুপ থাকবে । কেননা ইমামের কিরাআতই তোমার জন্য যথেষ্ট ।
৮) মুয়াত্তায়ে ইমাম মুহাম্মদ নামক কিতাবে উল্লেখ আছে,
হযরত ইবনে হযরত ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে,
জনৈক ব্যক্তি তার নিকট ইমামের পিছনে কিরাআত পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ অর্থাৎ যখন তোমাদের মধ্যে কেউ ইমামের পিছনে নামায পড়ে, তখন ইমামের কিরাআত তার জন্য যথেষ্ট । হযরত ইবনে উমর (রাঃ) নিজেই ইমামের পিছনে কিরাআত পড়তেন না ।
৯) তাহাবীতে আছেঃ
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্নিত । তিনি বলেন,
নবী করিম (সঃ) এরশাদ করেছেনঃ যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে কিরাআত পড়ে থাকে, তার মুখ যদি মাটি দ্বারা বন্ধ করে দেয়া হত (তবে ভালই হত) ।
১০) মুসনাদে ইমাম আযম আবূ হানীফা হাদীস গ্রন্থে উল্লেখিত আছেঃ
এক রেওয়ায়েতে আছে,
এক ব্যক্তি নবী করিম (সঃ) এর পিছনে যোহর অথবা আসর নামাজে কিরাআত পাঠ করে, তখন এক ব্যক্তি ইঙ্গিতে এটা পড়তে নিষেধ করে । যখন তিনি নামায থেকে অবসর হলেন তখন বললেনঃ তুমি কি আমাকে নবী করিম (সঃ) এর পিছনে নামায পড়া থেকে বাধা প্রদান করছ ? অতঃপর উভয়ে এটা নিয়ে তর্ক করতে লাগল । এমনকি নবী করিম (সঃ) এটা শুনে ফেললেন, তখন তিনি বললেন- যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে নামায পড়বে এই অবস্থায় ইমামের কিরাআত তার কিরাআত হবে । অর্থাৎ মুক্তাদি হিসেবে তার কিরাআত পড়বে হবে না ।
১১) মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছেঃ
হযরত আবূ মূসা (রাঃ) এবং হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্নিত আছে-
রাসূল (সঃ) এরশাদ করেছেনঃ ইমাম যখন কোরআন পড়বে, তোমরা চুপ করে থাকবে ।
ইমাম মুসলিম, ইমাম আহ্মদ, ইমাম ইবনে জারীর, ইমাম মুনযির ও ইমাম ইবনে হাযেম উক্ত হাদীস বিশুদ্ধ বা সহীহ বলে বর্ননা করেছেন । হযরত ইবনে আব্দুল বার ও ইবনে তাইমিয়ার এই হাদীস স্বীয় কিতাবে বর্ননা করেছেন ।[10]
১২) ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছেঃ
হযরত আলী (রাঃ) বলেছেনঃ
যে ব্যক্তি ইমামের পশ্চাতে কিরাআত পড়ে, সে যেন (দ্বীনের কাজে) ভুল করলো ।
১৩) তিরমিযী শরীফে বর্নিত হয়েছেঃ
হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্নিত আছে,
তিনি বলেনঃ যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা ব্যতীত নামায পড়ল, তার নামায হয় নাই । কিন্তু ইমামের পশ্চাতে নামায পড়লে তার জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করার প্রয়োজন নাই । ইমাম তিরমিযী (রহঃ) এই হাদিসকে হাসান সহীহ্ বলে অভিহিতকরেছেন ।
১৪) সহীহ মুসলিম শরীফে উল্লেখ হয়েছেঃ
কোন ব্যক্তি হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ইমামের পশ্চাতে কোরআন পড়তে আছে আছে কিনা ? তদুত্তরে তিনি বললেন, ইমামের পশ্চাতে (মুক্তাদিদেরকে) কোন নামাযেই কোরআন পড়তে হবে না ।
১৫) মুসলিম শরীফ উদ্ধৃত হয়েছেঃ
হযরত আবূ হুরায়রা ও হযরত কাতাদা (রাঃ) বর্ননা করেন যে,
নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ ইমাম যে সময় কোরআন পাঠ করেন, তোমরা (মুক্তাদিগণ) চুপ করে থাক ।
ইমাম মুসলিম বলেন, এই দিসটি আমার নিকট সহীহ্ বা বিশুদ্ধ ।[14]
১৬) ‘ফতহুল কাদীর’ কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে যে,
ইমাম মুজাহিদ বর্ননা করেছেন যে, নবী করীম (সঃ) নামাযে কোরআন পাঠ অবস্থায় (তাঁর পশ্চাতে) জনৈক আনসারী (মদিনাবাসী) যুবককে কোরআন পড়তে শুনলেন, সে সময় উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়েছিল । যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা নিবিষ্ট চিত্তে শুনবে এবং (সর্বদা) চুপ থাকবে ।
১৭) উক্ত কিতাবে আরও উদ্ধৃত হয়েছে যে, ইমাম বায়হাকী বর্ননা করেনঃ
আলিমগণের এজমা হয়েছে যে, উক্ত আয়াতটি নামাযের সম্বন্ধেই নাযিল হয়েছে । অর্থাৎ মুক্তাদিগণকে ইমামের কোরআন পাঠের সময় নীরব থাকার জন্য নাযিল হয়েছে ।
১৮) আবূ দাউদ শরীফে উল্লেখ হয়েছেঃ
যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা এবং অন্য কিছু না পড়ে, তার নামায হবে না ।
ইমাম সুফিয়ান বলেন, এটা যিনি একাকী না পড়েন তার জন্য ।[17]
১৯) মুয়াত্তায়ে মালেক হাদীসগ্রন্থে আছেঃ
জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেনঃ
যে ব্যক্তি এক রাকআত নামায পড়ল; এতে সূরা ফাতিহা পড়লো না, সে যেন নামায পড়ল না । কিন্তু ইমামের পশ্চাতে মুক্তাদিগণকে পাঠ করতে হবে না ।
২০) হযরত আবূদ্দারদা (রাঃ) হতে নাসায়ী শরীফে বর্নিত আছেঃ
আমি বিশ্বাস করি- ইমাম কিরাআত পড়লে মুক্তাদিগণের কিরাআত পড়া হয়ে যাবে ।
২১) নাসায়ী শরীফে বর্নিত আছেঃ
ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) বলেন,
নিশচয়ই হযরত নবী করিম (সঃ) যোহর ও আসর পড়েছিলেন এবং এক ব্যক্তি তার পশ্চাতে কোরআন পড়েছিলেন । নবী করিম (সঃ) নামায শেষ করে বললেন, তোমাদের মধ্যে কোণ ব্যক্তি সূরা ‘আলা’ পাঠ করেছো ? ঐ দলের মধ্যে এক ব্যক্তি বললেন- আমিই পড়েছি । কিন্তু সদুদ্দেশ্যেই পড়েছি । এতে নবী করিম (সঃ) বললেন, আমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছি যে, তোমাদের মধ্যে কেউ আমার কিরাআতের মধ্যে বিঘ্ন ঘটিয়েছ ।
উক্ত হাদিসের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইমাম চুপে চুপে কিরাআত পড়লেও মুক্তাদিও কোন কিরাআত পাঠ করবে না । ঠিক তেমনি জাহরিয়া নামাযে যেমন মাগরিব, এশা ও ফজরে মুকতাদি কিরাআত পড়বে না । এই মর্মে হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে হাদীস বর্নিত হয়েছে ।
২২) হাফেযে হাদীস মাওঃ আব্দুর রশীদ গঙ্গুহী বলেনঃ
ইমামের পিছনে মুকতাদির কিরাআত পাঠ করা ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় ছিল । পরবর্তি সময় 'ওয়া ইযা ক্বুরিয়াল ক্বুরআনু' এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর উক্ত বিধান রহিত হয়ে গেছে ।
২৩) বুখারী শরীফের শরাহ্ ফয়যুল বারীতে আছে,
ইমাম ইবনে হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেনঃ
হুযুর (সঃ) ইনতিকালের পূর্বে তিন দিন পর্যন্ত তিনি জামাআতে যাওয়া হতে বিরত ছিলেন । উক্ত সময় হযরত আবূ বকর (রাঃ) জাহরী নামাযের ইমামতি করছিলেন । হুযুর (সঃ) যখন মসজিদে আগমন করলেন তখন হযরত আবূ বকর (রাঃ) নামাযের মধ্যেই পশ্চাতে গেলেন । নবী করিম (সঃ) ইমামতির জায়গায় দাঁড়িয়ে গেলেন । হযরত আবূ বকর (রাঃ) যে পর্যন্ত কিরাআত পড়তেছিলেন, সেখান থেকে কিরাআত পাঠ করা শুরু করলেন । উক্ত অবস্থায় নবী করীম (সঃ) সূরা ফাতিহা দোহ্রান নাই । যদি সূরা ফাতিহা পাঠ রুকন হত যা পাঠ না করলে নামায হয় না, তবে হুযুর (সঃ) সূরা ফাতিহা অবশ্যই দোহরাতেন । হুযুর (সঃ) শেষ জীবনে ‘ফাতিহা’ ছাড়া নামায কেমন করে পড়লেন ? তাঁর জীবনে শেষ আমলের দ্বারা জানা গেল যে, সূরা ফাতিহা ইমামই পাঠ করবেন । ইমামের কিরাআত পাঠ অর্থ মুক্তাদির কিরাআত পাঠ করা । সুতরাং কিরাআত পাঠ ইমামের পিছনে মুক্তাদির জন্য জরুরী নয় । কিরাআত পাঠের হুকুম মনসুখ (রহিত) হয়ে গেছে । সেহেতু যদি কেউ ইমামকে ফাতিহা পাঠের পরে পায় বা রুকুতে পায়, তখন সূরা ফাতিহা বা অন্য সূরা কিভাবে পড়বে । এতে প্রমাণিত হয় যে, ইমামের পিছনে মুকতাদির কিরাআতের প্রয়োজন নেই ।
— ফয়যুল বারী
২৪) যুক্তিতর্কেও বুঝা যায় যে, ইমাম সমস্ত মুকতাদির পক্ষ হতে উকিল । সূরা ফাতিহা খোদার শিখানো দরখাস্ত, যা ইমাম সাহেব সকলের পক্ষ হতে প্রভুর দরবারে আবেদন-নিবেদন করে থাকেন । দরখাস্তে (সূরা ফাতিহা) শেষ হয়ে গেলেসকলেই আমীন বলে থাকেন । যেমন বাদী-বিবাদীর পক্ষ হতে হাকিমের (বিচারক) নিকটে একজন উকিল বর্ননা দিয়ে থাকেন । উকিলের কথাই সকলের কথা । হাকিমের সম্মুখে প্রত্যেকে বর্ননা দেন না এবং উকিলই দিয়ে থাকেন । অনুরূপ ইমাম সাহেব মাত্র একাই সকলের পক্ষ হতে প্রভুর কাছে দরখাস্ত পেশ করেন । মুক্তাদিগণ নয় ।
২৫) পবিত্র কোরআন ও বর্নিত হাদীসসমূহের দ্বারা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, কিরাআত ও সূরা ফাতিহা পাঠ করার দায়িত্ব ইমামের । কিন্তু একাকী নামায পড়লে সূরা ফাতিহা ও কিরাআত উভয়ই পড়তে হবে । ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) এর মতে উচ্চস্বরের নামায হোক যেমন ফজর, মাগরিব, ঈশা ও জুমুয়া এবং নিম্নস্বরের নামায যেমন যোহর ও আসর কোন অবস্থাতেই ইমামের পশ্চাতে মুক্তাদির সূরা ফাতিহা ও কিরাআত পড়তে হবে না । একই মত পোষণ করেছেন হযরত আবূ তালিব, হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ, হযরত জায়েদ বিন সাবিত, হযরত আলী বিন আবূ তালিব, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ, হযরত সুফইয়ান সওরী, হযরত সুফিইয়ান ইবনে উয়ায়াইনা, ইবনে আবি লাইলা, ইবনে আব্বাস, আবূ সাইদ খুদরী, হাসানবিন সালেহ ও ইব্রাহীম নাখয়ী প্রমুখ সাহাবা ও তাবীঈগণ । আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি বলেনঃ প্রথম যুগের মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবাদের ৮০ জন ইমামের পশ্চাতে কিরাআত পাঠ না করার পক্ষ সমর্থন করেছেন ।[21]
উপরের বর্ননাসমূহের দ্বারা স্পষ্টরূপে বুঝা গেল যে, হানাফিগণ ইমামের পশ্চাতে সূরা ফাতিহা ও কিরাআত না পড়ার সিদ্ধান্ত কোন মনগড়া খেয়াল খুশীমত করেন নাই । বরং পবিত্র কোরআন, হাদীস, তাফসীর অনুযায়ী ইমামের পশ্চাতে সূরা ফাতিহা ও অন্য কোন সূরা বা আয়াত না পড়ার আমল করে থাকেন । তবে উল্লেখ্য যে, ইমামের কিরাআতের শব্দ কর্ণগোচর হলে মুক্তাদিগন আগ্রহ সহকারে শ্রবণ করবে । কিরাআতের শব্দ শুনতে পাওয়া না গেলে মুক্তাদি শুধু চুপ বা নীরব থেকে নামাযের ধ্যানে দাঁড়িয়ে থাকবে । হানাফী ইমাম ও ফকীহ্গণের এটাই সিদ্ধান্ত ।[22]
· সাইফুল মুকাল্লেদীন, কৃত মাওঃ ইবরাহীম মুহাব্বাতপুরী, পৃঃ ৩৯ । এবং তুহফাতুল মু’মিনীন, কৃত মাওঃ শামসুদ্দীন মোহনপুরী, পৃঃ ৮৪ ।
· · তুহফাতুল মু’মিনীন, পৃঃ ৮৫ ।
· · তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ৩১৫, ৩৭৪, ৩৭৫ ।
· · ইবনে মাজা, পৃঃ ৭১; তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩১৭ এবং মুয়াত্তায়ে ইমাম মুহাম্মদ (ঊর্দূ), পৃঃ ৫৯
· · সহীহ মুসলিম, পৃঃ ১৭৪
· · তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ৩১৯ ।
· · মুয়াত্তায়ে ইমাম মুহাম্মদ (ঊর্দূ), পৃঃ ৫৬
· · আনোয়ারুল মুকাল্লেদীন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পৃঃ ৪৬ এবং তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ৩২১ ।
· · মুসনাদে ইমাম আ’যম আবূ হানীফা, হাদীস নং ১০৪ ।
· · আনোয়ারুল মুকাল্লেদীন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পৃঃ ৪৪ ।
· · তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ৩১২ ।
· · তিরমিযী, পৃঃ ৪২ এবং মুয়াত্তায়ে মালেক, পৃঃ ২৮ ।
· · সহীহ্ মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃঃ ২১৫ ।
· · সহীহ্ মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৭৪ ।
· · ফতহুল কাদীর, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৭ ।
· · ফতহুল কাদীর, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৩৭ ।
· · আবূ দাউদ শরীফ, পৃঃ ১৪৬ ।
· · মুয়াত্তায়ে মালেক, পৃঃ ২৮ এবং সাইফুল মুকাল্লেদীন, কৃত মাওঃ ইবরাহীম মুহাব্বাতপুরী, পৃঃ ৬২।
· · নাসায়ী শরীফ, পৃঃ ২৪৬ ।
· · তানযীমুল আশতাত, ১ম খন্ড (ঊর্দূ), পৃঃ ৩২৯ ।
· · বঙ্গানুবাদ মুসনাদে ইমাম আ’যম আবূ হানীফা, পৃঃ ১৩৯ ।
· হানাফীদের কয়েকটি জরুরী মাসায়েল (লেখকঃ মাওলানা মোঃ আবু বকর সিদ্দীক)
ইকামতের সময় মুসল্লিগণ কখন দাঁড়াবেন তার শরঈ বিধান সুস্পষ্ট । বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে সুন্নাতী পদ্ধতি ব্যবহার না করে মুসল্লিগণ ইকামতের পূর্বে দাঁড়িয়ে যান । খতীব/ইমামগন সঠিকভাবে মাস'আলাটি বর্ননা না করার ফলে হয়ত এ ধরনের প্রথা পৃথিবী ব্যাপী শুরু হয়েছে । তাই ইসলামী শরীয়তের আলোকে হানাফি মাজহাবের নির্ভরযোগ্য ফিকাহ্ গ্রন্থাবলীর উদ্ধৃতিসহ নিম্নে বিষয়টি আলোচনা করা হলো, যাতে মুসল্লিগণ ইকামতের সময় প্রিয় নবীর সুন্নাত তরীকানুযায়ী দাড়াতে পারেন ।
খাদেমে রাসূল হযরত আনাছ বিন মালিক (রাঃ) হতে বর্নিত, তিনি বলে, নামাযের ইকামত হয়ে গেছে অতঃপর প্রিয় রাসূল (সঃ) আমাদের দিকে সামনা সামনি হয়ে ফিরে গেলেন এবং বললেন, তোমাদের কাতার বা লাইন সমূহ সোজা কর ও একে অন্যের সাথে লাগিয়ে মিলিয়ে দাঁড়াও কেননা নিশ্চয় আমি আমার পিছনের দিক থেকেও তোমাদেরকে দেখতে পাই
— (বোখারী শরীফ)
বর্নিত হাদিস থেকে বুঝা গেল, ইকামত বলার পর দাঁড়ানো, তাকবীরে তাহরীমার পূর্বে কাতার সোজা করা এবং পিছনের দিক থেকেও অদৃশ্য জ্ঞানের বদৌলতে মুসল্লিদের রুকু সিজদা এমনকি অন্তরের অবস্থা পর্যন্ত প্রিয় নবী কর্তৃক দেখা ।
সুতরাং প্রমাণিত হয়ে গেল, ইকামত শুরু করার পূর্বে কাতার সোজা করার উদ্ধেয় দাঁড়িয়ে যাওয়া খেলাফে সুন্নাত । বরং ইকামত দেওয়ার পর কাতার সোজা করার কথা বলা হয়েছে । অন্য একটি হাদিসে পাকে এসেছে-
হযরত নুমান বিন বশীর (রাঃ) হতে বর্নিত । তিনি বলেন, আমরা যখন নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে যেতাম তখন প্রিয় রাসূল (সঃ) আমাদের (নামাজের) কাতার সোজা করতেন । কাতার যখন সম্পূর্ন সোজা হয়ে যেন তখন তিনি তাকবীরে তাহ্রীমা বলতেন ।
— মিশকাত শরীফ, পৃঃ ৯৮
বর্নিত হাদিসেও প্রিয় নবী (সঃ) কাতার সোজা করতেন ইকামতের পরে । কাতার সোজা হলেই তিনি তাকবীরে তাহ্রীমা বলে নিয়ত করতেন । আর অসংখ্য হাদিসের আলোকে হানাফি মাজহাবের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে ইকামতের সময় কখন দাঁড়াতে হবে তা একভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে ।
ইমাম আযম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মদ (রহঃ) বলেছেন,
মুয়াজ্জিন যখন “হাইয়া আলাছ ছালাহ্” বলবে তখন মুসল্লিগণ দাঁড়াবেন ।
— আইনী শরে বোখারী, ফতোয়ায়ে ছালাছা , পৃঃ ২০
মুয়াজ্জিন ইকামত বলার সময় হাইয়া আলাছ ছালাত বললে ইমাম ও মুসল্লীগন দাঁড়াবে ।
— শরহে বেকায়া, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৫৮
যখন মুয়াজ্জিন ইকামত আরম্ভ করবে, এমন সময় যদি কোন মুসল্লি মসজিদে প্রবেশ করে তাহলে তাঁকে বসে যেতে হবে । হাইয়া আলাছ ছালাত বা ফালাহ্ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে পারবে না । কেননা ইহা মাকরুহ । আল্লামা কাহাস্তানীর মুদমিরাত গ্রন্থে এরূপই বর্ণিত রয়েছে । তাহাতাভী প্রণেতা বলেন- কাহাস্তানীর কথা দ্বারা বুঝা গেল, ইকামতের প্রারম্ভে দাঁড়িয়ে যাওয়া মাকরুহ কিন্তু লোকেরা এ ব্যাপারে খুবই অমনোযোগী ।
— তাহতাভী আলা মারাকুল ফালাহ, পৃঃ ১৮৫
ইকামতের সময় যদি কোন মুসল্লি মসজিদে প্রবেশ করে তাহলে তার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা মাকরুহ বরং সে (কাতারে) বসে যাবে । মুয়াজ্জিন যখন “হাইয়া আলাল ফালাহ” বলবেন তখনই সে দাঁড়িয়ে যাবেন ।
— ফতোয়ায়ে আলমগীরী
এভাবে আর অসংখ্য কিতাবে ইকামতের সময় হাইয়া আলাছ ছালাত অথবা হাইয়া আলাল ফালাহ্ বলার সময় দাঁড়ানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে ।
অতএব, পবিত্র হাদীস ও ফকীহগনের অভিমত থেকে এটাই প্রমাণিত হল ইকামত বলার পূর্বে দাঁড়ানো মাকরুহ বরং ইকামত আরম্ভ করার পর হাইয়া আলাছ ছালাত বলার সময় মুসল্লীগন দাঁড়াবেন আর এরপর কাতার সোজা করবেন । কাতার সোজা করতে যতটুকু বিলম্ব হয়, তাতে কোন অসুবিধা নাই । পবিত্র হাদীস মতে ।
আর বর্তমানে কোথাও কাতার সোজা করতে হয় না বরং প্রতিটি মসজিদে কাতার করাই আছে । তাই কাতার সোজা করার অজুহাতে ইকামতের পূর্বে দাঁড়িয়ে না থেকে বরং মুসল্লীগন বসে থাকবেন এবং হাইয়া আলাছ ছালাত বললে দাঁড়িয়ে যাবেন এটাই সঠিক সুন্নাত পদ্ধতি । আল্লাহ্ পাক সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুণ । আমীন
এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে হলে সোভানিয়া আলীয়া মাদ্রাসার সম্মানিত মুহাদ্দিস আল্লামা মুফতি আবুল হুফফাজ মুহাম্মদ ফুরকান চৌধুরী (মজিআ) লিখিত ইকামতের পূর্বে দাঁড়ানো মাকরুহ নামক অত্যন্ত প্রামাণ্য গ্রন্থটি পাঠ করতে পারেন ।
তাকবীরে তাহ্রীমার পর পুরুষ নাভীর নিচে আর মহিলা বুকের বা সিনার উপর ডান হাতের 'কর' বাম হাতের করের উপর স্থাপন করবে । পুরুষ কোন অবস্থায়ই সিনার উপর হাত বাঁধবে না । কথিত আহলে-হাদীস সম্প্রদায় মহিলাদের ন্যায়সিনার উপর হাত বেঁধে নামায পড়ে । ইমাম আযম আবু হানিফা, ইমাম সুফিয়ান সওরী ও ইমাম ইসহাক প্রমুখ বলেন যে, পুরুষের জন্য নাভীর নিচে ও মহিলার জন্য বুকের উপর হাত বাঁধা সুন্নাত । এর খেলাফ করলে নামায মাকরুহ হবে । নিচে প্রমানাদি পেশ করা হবেঃ
১) আবূ দাউদ শরীফে হাদীস বর্নিত হয়েছেঃ
হযরত আবূ ওয়াইল হতে বর্নিত আছে, হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেছেন, নামাযের মধ্যে এক হাত অন্য হাতের উপর রেখে নাভীর নিচে স্থাপন করবে ।
২) দারে কুতনী, বায়হাকী ও আবূ দাউদ গ্রন্থে উল্লেখ আছেঃ
আল্লামা ইমাম নববী (রহঃ) মুসলিম শরীফে ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলেছেন যে, হযরত আলী (রাঃ) বলেছেনঃ নামাযের মধ্যে নাভীর নিচে হাত স্থাপন করা সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত ।
৩) হিদায়া গ্রন্থের ১ম খন্ডের ৮৬ পৃষ্ঠায় আছেঃ
রাসূল (সঃ) এরশাদ করেছেনঃ ডান হাত-বাম হাতের উপর রেখে নাভীর নিচে স্থাপন করা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত ।
৪) তিরমিযি শরীফে আছেঃ
হযরত কাবীসা ইবনে হলব তার পিতা হলব (রাঃ) থেকে বর্ননা করেন যে, তিনি বলেছেনঃ রাসুলুল্লাহ (সঃ) যখন আমাদের ইমামতি করতেন, তখন তিনি ডান হাত দিয়ে বাম হাত ধরতেন ।
ইমাম তিরমিযী (রঃ) বলেন, সাহাবী, তাবেয়ী ও পরবর্তী যুগের আলিমগন এই হাদীস অনুসারে আমল করেছেন । তবে হাত রাখার ব্যাপারে আলিমগন মতভেদ করেছেন। যেমন কেউ কেউ উভয় হাত নাভীর উপর স্থাপন করার অভিমত প্রকাশ করেছেন । আবার কেউ কেউ নাভীর নিচে স্থাপন করার অভিমত দিয়েছেন । আলিমগনের নিকট এই উভয় নিয়মের অবকাশ রয়েছেন ।[3]
৫) ইমাম মুহাম্মদ (রঃ) এর কিতাবুল আ-ছারে আছে নবী করিম (সঃ) নাভীর নিচে বাম হাতের কব্জির উপর ডান হাতের তালু রাখতেন ।[4]
৬) সহীহ আবু দাউদে আছে, হযরত আলী (রাঃ) বলেছেনঃ নাভীর নিচে এক হাত অন্য হাতের উপর রাখা নামাজের সুন্নাত ।[5]
৭) আওজাযুল মাসালিক নামক কিতাবে উল্লেখ হয়েছঃ
হযরত আনাস(রাঃ) হতে বর্নিত, তিনি বলেনঃ তিনটি নবীদের আখলাকী কাজ বা আদর্শ । যথাঃ সূর্য অস্ত যাওয়ার পরই ইফতার করা, সাহরী দেরী করে খাওয়া, তৃতীয় নামাযের মধ্যে নাভীর নিচে ডান হাতকে বাম হাতের উপর রেখে নামায আদায় করা ।[6]
৮) উক্ত কিতাবে আরো বর্নিত আছেঃ
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেনঃ নাভির নিচে ডান হাতের পাঞ্জাকে বাম হাতের উপর রেখে নামায আদায় করা সঠিক নিয়ম ।[6]
৯) মসনদে ইবনে আবি শায়বা হাদীস গ্রন্থে লিখিত আছে যে,
হযরত ওয়াসেল (রাঃ) বলেনঃ আমি নবী করিম (সঃ) কে নাভীর নিচে বাম হাতের উপর ডান হাত বাঁধতে দেখেছি ।
আল্লামা আবূ তাইয়েব মাদানী বলেছেন, মসনদে ইবনে আবি শায়বার হাদিসটি সহিহ; সনদ অতি সহীহ্ । এটাই হানাফী মাযহাবের দলিল ।[7]
১০) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্নিত আছে-
হযরত আলী (রাঃ) বলেছেনঃ নামাযের মধ্যে হাত বাঁধা সুন্নাত এবং দুই হাত নাভীর নিচে স্থাপন করবে ।
১১) সহীহ মুসলিমের টিকায় উল্লেখ হয়েছে যে,
ইমাম শাফেয়ীর প্রসিদ্ধ মতে ও অধিকাংশ আলিমের মতে দুই হাত বুকের নিচে নাভীর উপর রাখবে । ইমাম আবু হানিফা , সুফিয়ান সাওরী; ইসহাক ও আবূ ইসহাকের মতে নাভীর নিচে দুই হাত রাখবে এবং হযরত আলী (রাঃ)-এর নিকট হতে দুই প্রকার হাদীস বর্নিত হয়েছে । ইমাম আহমদ এক মতে বলেন, বুকের নিচে নাভীর উপরে হাত বাঁধবে । আর এক মতে বলেন- নাভীর নিচে হাত বাঁধবে ।
উল্লেখ্য যে, পুরুষ লোকের হাত বাঁধবার ব্যবস্থা হাদীস ও সাহাবাগনের পথ মত হতে প্রমানিত হয়েছে; কিন্তু স্ত্রীলোকের পক্ষে এতদ্সম্বন্ধে কোনই ব্যবস্থা হাদীসের দ্বারা সাব্যস্ত হয় নাই । কাজেই ইমাম আযম কিয়াস করে বলেছেন যে, স্ত্রীলোকেরা নামাযে দুই হাত বুকের উপর বাঁধবে । এটাতে তাঁদের পর্দা রক্ষা হবে- কাপড় খুলতে পারবে না ।[9]
১২) উলুমুল হাদীস গ্রন্থে ইবনে ছালা লিখেছেনঃ
খোযায়মা 'বুকের উপর হাত রাখা' এই কথাটি অতিরিক্ত বর্ননা করেছেন; কিন্তু সেটা প্রমানিত নয় ।[10]
আকুদোল জওয়াহের গ্রন্থে বর্নিত আছে- নবী করীম (সঃ) নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রেখেছিলেন, এটাই সহিহ্; কিন্তু 'বুকের উপর হাত রাখা' কথাটি সহিহ্ নয় ।[10]
উপরোক্ত দলীলসমূহের দ্বারা প্রতিভাত হল যে, ইমাম আয'ম আবূ হানিফা ও তার অনুসারীগনের নামাযে নাভীর নিচে হাত রাখার সিদ্ধান্ত খেয়াল-খুশী মত নয় বরং সহীহ হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে । সুতরাং পুরুষগন বুকের উপর হাত না রেখে নাভীর নিচে হাত রেখে নামাজ পড়তে পারেন, তজ্জন্য আল্লাহপাক আমাদের সকলকে তওফীক দান করুন । আমীন ![11]
· আনোয়ারুল মুকাল্লেদিন, কৃত ই,ফা,বা পৃঃ ৫২
· · হিদায়া, ১ম খন্ড, পৃঃ ৮৬
· · জামে তিরমিযী শরীফ, মুতারজম উর্দূ, পৃঃ ১৭০
· · তুহ্ফাতুল মু'মিনীন, কৃতঃ মাওঃ শামসুদ্দীন মোহনপুরী, পৃঃ ৭৮
· · আবূ দাউদ শরীফ, পৃঃ ১১১
· · আওযাজুল মাসালিক, ১ম খন্ড, পৃঃ ১১৯
· · সাইফুল মুকছেদীন, মাওঃ মুহাব্বাতপুরী
· · রাযীন (হাদীস গ্রন্থ), পৃঃ ২১৬
· · তুহ্ফাতুল মু'মিনীন, কৃতঃ মাওঃ শামসুদ্দীন মোহনপুরী, পৃঃ ৭৯-৮০
· · সাইফুল মুকাল্লেদীন, কৃতঃ মাওঃ ইব্রাহীম মুহাব্বাতপুরী, পৃঃ ১২৩
· হানাফীদের কয়েকটি জরুরী মাসায়েল (লেখকঃ মাওলানা মোঃ আবু বকর সিদ্দীক)
পুরুষের ও স্ত্রীলোকের নামাজ প্রায় এক রকম, মাত্র কয়েকটি বিষয়ে পার্থক্য আছে । যথাঃ
১) তাকবীরে তাহ্রীমার সময় পুরুষ চাদর ইত্যাদি হইতে হাত বাহির করিয়া কান পর্যন্ত উঠাইবে, যদি শীত ইত্যাদির কারণে হাত ভিতরে রাখার প্রয়োজন না হয় । স্ত্রীলোক হাত বাহির করিবে না, কাপড়ের ভিতরে রাখিয়াই কাঁধ পর্যন্ত উঠাইবে । - তাহ্তাবী - বিস্তারিত এখানে
২) তাকবীরে তাহ্রীমা বলিয়া পুরুষ নাভির নিচে হাত বাধিবে । স্ত্রীলোক বুকের উপর (স্তনের উপর ) হাত বাঁধিবে । - তাহ্তাবী - বিস্তারিত এখানে
৩) পুরুষ হাত বাঁধিবার সময় ডান হাতের বৃদ্ধা ও কনিষ্ঠা অঙ্গুলী দ্বারা হালকা বানাইয়া বাম হাতের কব্জি ধরিবে এবং ডান হাতের অনামিকা, মধ্যমা ও শাহাদত অঙ্গুলী বাম হাতের কলাইর উপর বিছাইয়া রাখিবে । আর স্ত্রীলোক শুধু ডান হাতের পাতা বাম হাতের পাতার পিঠের উপর রাখিয়া দিবে, কব্জি বা কলাই ধরিবে না । -দুররুল মুখতার
৪) রুকু করিবার সময় পুরুষ এমনভাবে ঝুঁকিবে যেনো মাথা, পিঠ ও চুতড় এক বরাবর হয় । স্ত্রীলোক এই পরিমাণ ঝুঁকিবে যাহাতে হাত হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছে ।
৫) রুকুর সময় পুরুষ হাতের আঙ্গুলগুলি ফাঁক ফাঁক করিয়া হাঁটু ধরিবে । আর স্ত্রীলোক আঙ্গুল বিস্তার করিবে না বরং মিলাইয়া হাত হাঁটুর উপর রাখিবে ।
৬) রুকুর অবস্থায় পুরুষ কনুই পাঁজর হইতে ফাঁক রাখিবে । আর স্ত্রীলোক কনুই পাঁজরের সঙ্গে মিলাইয়া রাখিবে । -মারাকী
৭) সিজদায় পুরুষ পেট উরু হইতে এবং বাজু বগল হইতে পৃথক রাখিবে । পক্ষান্তরে স্ত্রীলোক পেট রানের সঙ্গে এবং বাজু বগলের সঙ্গে মিলাইয়া রাখিবে ।- বিস্তারিত এখানে
৮) সিজদায় পুরুষ কনুই মাটি হইতে উপরে রাখিবে । পক্ষান্তরে স্ত্রীলোক মাটির সঙ্গে মিলাইয়া রাখিবে ।-মারাকী- বিস্তারিত এখানে
৯) সিজদার মধ্যে পুরুষ পায়ের আঙ্গুলগুলি কেবলার দিকে মোড়াইয়া রাখিয়া তাহার উপর ভর দিয়া পায়ের পাতা দুইখানা খাড়া রাখিবে; পক্ষান্তরে স্ত্রীলোক উভয় পায়ের পাতা ডান দিকে বাহির করিয়া মাটিতে বিছাইয়া রাখিবে ।-মারাকী
১০) বসার সময় পুরুষ ডান পায়ের আঙ্গুলগুলি কেবলার দিকে মোড়াইয়া রাখিয়া তাহার উপর ভর দিয়া পায়ের পাতাটি খাড়া রাখিবে এবং বাম পায়ের পাতা বিছাইয়া তাহার উপর বসিবে । আর স্ত্রীলোক পায়ের উপর বসিবে না বরং চুতড় নিতম্ব) মাটিতে লাগাইয়া বসিবে এবং উভয় পায়ের পাতা ডান দিকে বাহির করিয়া দিবে; এবং ডান রান বাম রানের উপর এবং ডান নলা বাম নলার উপর রাখিবে ।-মারাকী
১১) স্ত্রীলোকের জন্য উচ্চ শব্দে কেরাআত পড়িবার বা তকবীর বলিবারও এজাযত নাই । তাহারা সব সময় সব নামাজের কেরাআত (তকবীর, তাস্মী ও তাহ্মীদ)চুপে চুপে পড়িবে -শামী
বেহেস্তী জেওর
হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল সঃ জীবনে একবার হাবশার বাদশা নাজাশীর মৃত্যুতে সাহাবীদের নিয়ে তার গায়েবানা জানাযা আদায় করেছেন।
— সহীহ বুখারী ১/১৯৭,৪৪৩,৪৪৬, হাঃ১১৮৮,১২৫৪,১২৬৩ সহীহ মুসলিম ১/৬৫৬ হাঃ৯৫২
ঘটনার সারসংক্ষেপঃ
বাদশা নাজাশীরর হাব্শার (বর্তমান আবিসিনিয়ার) মুসলিম শাসক ছিলেন । সেসময় তাঁর রাজ্যে মুসলমান বলতে একমাত্র তিনিই ছিলেন । তিনি আবিসিনিয়ায় আগত সকল মুসলমানদের সর্বাত্তক সাহায্য-সহযোগিতা করতেন । আল্লাহর রাসুল (সঃ)কে তিনি বড়ই মহব্বত করতেন এবং মুহাম্মাদ (সঃ)ও তাঁকে মুহাব্বাত করতেন। তাঁর ইন্তেকালের পর সেখানে তাঁর জানাজা পড়ানোর মত এক জনও ছিল না। আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট এটা কষ্টকর ছিল যে, এইরূপ একজন রাসূল প্রেমিক মুসলমানের জানাজা হল না! তাই তিনি গায়েবানা জানাযার নামায পড়িয়েছিলেন। কিন্তু উনি (সাঃ) যখন পড়াচ্ছিলেন তখন তাঁর চোখের পর্দা সড়ে গিয়েছিল এবং নাজাশী বাদশাহের লাশ সামনে দেখতে পাচ্ছিলেন। আর তাই গায়েবে জানাযা শুধুমাত্র উনার (সাঃ) জন্যই খাস ছিল। আর কারও জন্য কখনই নয়।
ঐ একমাত্র ঘটনার পর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বা কোন সাহাবী (রাঃ) বা তাবেয়ী বা তাবে তাবেয়ীন (রঃ) কোনদিন কোন মুসলিমের গায়েবানা জানাযা পড়েছেন বলে জানা যায় না।
— লামেউদ দুরারী ৪/৪৩২, ফত হুল ক্বদীর ১/৪৩২
বহু সাহাবী (রাঃ) দূর দুরান্তে শহীদ হয়েছে কেউ মারা গেছে কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আর কারও গায়েবানা জানাযা পড়েন নাই। ঈমাম শাফেয়ী (রঃ) ছাড়া বাকি ৩ ইমাম (রঃ) এর বিরোধি ছিল। তবে শাফেয়ীদের এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে- দূর দুরান্ত মাইয়েত যার জানাযা পড়ানো হয় নাই তার জন্য ই এ জানাযা সবাই একবার ই আদায় করা যাবে।
— যাদুল মা'আদ ইবনুল কাইয়ুম
হানাফী, মালেকী ও হাম্বলীদের ঊলামায়েকেরামদের মতে জানাযার নামাযে মৃত ব্যাক্তির সামনে থাকা জরুরী নতুবা গায়েবানা জানাযা পড়া যাবেনা আর গায়েবানা জানাযা সুন্নাহ সম্মত নয়।।
— বাহরুর রায়েক; ফতোয়ায়ে শামী; আহকামুল মাইয়েত; বেহেশতী জেওয়ার; যাদুল মা'আদ- বাবে সলাতুল জানায়েয; আল মাজমূ'-৫/২৫৩; আল মুগনী ২/৩৮৬; যারকানী ২/১০; ইলাউস সুনান ২/২৩৪; ফয়দুল বারী ২/৪৬৯; মুগনী মুহতাজ ১/১৬৫; কাশফুল কান্না ২/১২৬; শরহুছ ছগীর ১/৫৬৯
ইমাম আযম আবু হানিফা (রঃ) ও ইমাম মালেক (রঃ) এর মতে জানাজার নামাজ শুদ্ধ হওয়ার জন্য মাইয়্যেত ইমামের সম্মুখে উপস্থিত থাকা আবশ্যক। কাজেই কোন অনুপস্থিত মাইয়্যেতের জন্য সাধারণভাবে দু’আ করা যায় কিন্তু গায়েবানাজানাজা পড়া শুদ্ধ নয়। কারন প্রিয় নবী (সাঃ) এর জীবদ্দশায় মদিনা শরীফের দূরে অদূরে অনেক সময় অনেক সাহাবীর ইন্তিকাল কিম্বা শহীদ হওয়ার সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছত। এ সময় তিনি তাদের জন্য কেবল দু’আই করেছেন। তাদের জন্য গায়েবানা জানাজার কোন আয়োজন করেন নি। যদি গায়েবানা জানাজা শুদ্ধ হত তাহলে প্রিয় নবী (সাঃ) তাঁর ঐ সকল সাহাবীকে জানাজার নামাজ থেকে বঞ্চিত রাখতেন না। সাহাবীদের যুগেও কখনও কেউ গায়েবানা জানাজা পড়েন নি।
তবে প্রিয় নবী (সাঃ) সাধারণ নিয়ম বহির্ভূতভাবে একজনের জন্য গায়েবানা জানাজা পড়েছেন বলে হাদিসে পাওয়া যায়। তিনি হলেন হাব্শার বাদশাহ নাজাশী। হাদিসের আলোকে আরো বুঝা যায় যে, গায়াবানা নামাজটি তাদর জন্য একান্ত ও বিশেষ অনুমতি ছিল। কাজেই এ ঘটনার উপর অন্যদের আমল করার অবকাশ নেই। এ কারনেই সাহাবীগণ প্রিয় নবীর ওফাতের পর কখনও কারোর জন্য গায়েবানা জানাজা পড়েন নি। তা ছাড়া দু’জনের জন্য প্রিয় নবী (সাঃ) যে জানাজ আদায় করেছেন সেটিকে গায়েবানা জানাজা বলাও সর্বাংশে শুদ্ধ নয়। কেননা সে ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা’আলা মাইয়্যেতকে প্রিয় নবীর সম্মুখস্ত করে দিয়েছিলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, নাজাশী বাদশাহ্র শবদেহ ও প্রিয় নবীর মধ্যবর্তী সকল অন্তরায় তুলে দেওয়া হয়। ফলে প্রিয় নবী তাঁর লাশ স্বচক্ষে অবলোকন করেন এবং জানাজার নামাজ আদায় করেন। (ওয়াহিদী ও আস্বাবুন) সুতরাং মাইয়্যেত দৃশ্যত না হলে জানাজার নামাজ পড়া শরীয়ত সম্মত নয় ।[1]
মারেফুল কুরানে মুফতী শফী রাহ, ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ তার মাজমূয়ায়ে ফতোয়া আর ইমাম ইবনুর কাইয়ুম রাহ, তার যাদু মা'আদ এ লিখেছেনঃ ‘যেই রাসুলুল্লাহর আমল থেকে ১ বার আর যেভাবে প্রমানিত হয়েছে সেই আমল জীবনে ১ বার ঠিক সেভাবেই আদায় করা হচ্ছে সুন্নাহ। এদিকে খেয়াল করলে প্রচলিত গায়েবানা জানাযার নামাজের কোন ভিত্তি ই থাকে না।
আহলে হাদীসদের প্রিয় নেতা মুফতী কাজী ইবরাহীম এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেবও একই মত পোষন করেছে।
এছাড়া আহলে হাদীস নেতা ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাংগীর গায়েবানা জানাযার ব্যপারে লিখেন
জীবনে সর্বদা(রাসুল) যা বর্জন করেছেন এই ১টি ঘটনায় তিনি তা করলেন..... বিষয়টি তার জন্য খাছ ছিল। আল্লাহ তা'লা নাজাসীকে মর্যাদা প্রদান করে তার মৃতদেহ রাসুলুল্লাহর চাক্ষুস করে দেন (যার ফলে তিনি গায়েবানা নয় মাইয়েত কে সামনে রেখেই) তিনি জানাযা আদায় করেন...... কিন্তু কোন অবস্থায় আমরা রাসুলুল্লাহর একদিনের কাজ কে আমাদের রীতি বানিয়ে নিতে পারিনা। তাহলে তার(রাসুলের) সব সময়ের রীতি বর্জন করব। এভাবেই আমরা বিদ'আতে নিপতিত হব।
— এহ ইয়াউস সুনানের ৫ম অধ্যায়ঃ সুন্নত বনা খেলাফে সুন্নত পৃঃ৩৭৫
ইবনে তাইমিয়া বলেন
নাজাশী যেহেতু কাফেরদের এলাকায় মারা গেছে আর তার জানাযা পড়ানো হয় নাই তাই রাসুল্লাহ তার জানাযা পড়িয়েছেন...... মনে রাখবেন রাসূলুল্লাহ থেকে গায়েবানা জানাযা নামাজ পড়া ও পরিত্যাগ করা ২ টাই প্রমানিত তবে প্রত্যেকটির ক্ষেত্র ভিন্ন
— যাদুল মা'আদ ১/৫০১
ইবনুল কাইয়ুম ও তার যাদুল মা'আদের ১/৫০০ এর নামাজ অধ্যায় অনুবাদ করেছেন ডঃ আব্দুশ শহীদ নাসীন ও কুস্টিয়া ইসলামী ইউনিভার্সিটির ডঃ যাকারিয়া । অনুদিত কিতাবের বাংলা নাম "আল্লাহর রসুল কিভাবে নামাজ পড়তেন" ।অনূদিত কিতাবের পৃঃ ১৯৮ তে ইবনুল কাইয়ুমের গায়েবানা জানাযার হুকুম উল্লেখ্য আছে যার সার সংক্ষেপ হচ্ছে- গায়েবানা জানাযা পড়া হাদীস ও সুন্নাহ সম্মত নয়।
মাহমূদুল হাসান দেওবন্দী রচিত ‘কাফন- দাফনের মাসয়ালা-মাসায়েল’ কিতাবে জানাযা ও গায়েবানা জানাযার হুকুম বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
মূল সারাংশ হল, গায়েবানা জানাযার নামাজের প্রধান শর্তই হলো লাশের উপস্থিত থাকা লাগবে, নতুবা তা হবে না। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় প্রত্যেকটা লাশই তাদের আত্বীয় স্বজনরা খুঁজে পায় এবং তারাই ব্যক্তিগতভাবে জানাযার নামাযের ব্যবস্থা করে। আর যে সব ক্ষেত্রে লাশই পাওয়া যায় না সে সব ক্ষেত্রে তো গায়েবে জানাযার প্রশ্নই আসে না। তাই গায়েবে জানাযার কোনো বিন্দুমাত্র দরকার হয় না। আর সবার শেষ কথা হল, গায়েবে জানাযা শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্য খাস ছিল, আর কারও জন্য কখনই নয়।
সংগৃহীত ফতোয়া ও মাসাইল -ইসলামিক ফাউন্ডেশন (জানাজার নামাজ অধ্যায়)
আল্লাহ তাআ’লা তার দীদার, নৈকট্য ও দর্শন দানের উদ্দেশ্যে নবুয়তের ১১ সনের ২৬ শে রজব দিবাগত রাতে রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লামকে স্বশরীরে নিজের কাছে নিয়ে যান। উক্ত রাতে আল্লাহ তাআ’লা বোরাকসহ হযরত জিবরিল আলাইহিছ ছালামকে রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম এর কাছে পাঠান। হযরত জিবরিল সর্ব প্রথম রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লামকে খানায়ে কাবা হতে বোরাকে চড়িয়ে বায়তুল মোকাদ্দাছ মছজিদে নিয়ে যান। হযরত আদম আলাইহিছ ছালাম হতে রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম পর্যন্ত প্রেরিত নবী-রাছুলগণকে সাথে নিয়ে রাছুলে পাক উক্ত মছজিদে দুরাকাত নামাজের ইমামতি করেন। নামাজ বাদ নবী-রাছুলগণের পক্ষ হতে হযরত আদম, হযরত নুহ, হযরত ইবরাহীম, হযরত মুছা, হযরত ঈছা আলাইহিমুছ ছালাম বক্তব্য রাখেন ও আল্লাহ তাআ’লার দীদারে গমনের জন্য রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লামকে মোবারকবাদ জানান। সকল নবী-রাছুলগণও তাদের উম্মতের নাজাতের জন্যে সুপারিশ করার আবেদন পেশ করেন। এরপর হযরত জিবরিল রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লামকে বোরাকে চড়িয়ে উর্ধ্বে গমন করেন। প্রথম আসমান হতে সপ্তম আসমান, বেহেশত, ছিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পরিভ্রমন করান ও সেখানকার অধিবাসীগণের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দেন।
আল্লাহ তাআ’লা ছিদরাতুল মুনতাহা হতে একমাত্র রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লামকে রফরফে উঠিয়ে আরশ-কুরছী লওহো-ক্বলম, আলমে আরওয়াহ, ৭০ হাজার নূরের পর্দা, ছেফাতে এযাফি,ছেফাতে হাক্বিকী অতিক্রম করে তাকবীন ছেফাতের মূলের মূল অর্থাৎ রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম-এর মূল সৃষ্টি “নুরে মুহাম্মাদী”তে নিয়ে যান। হাদীছ অনুযায়ী এ স্থান আল্লাহ তাআ’লার আঙ্গুলগুলির দু’আঙ্গুলের ফাঁকে অর্থাৎ আল্লাহর সামনে অবস্থিত। এখানে উপনীত হয়ে রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম আল্লাহকে লক্ষ্য করে বললেনঃ
আত্তাহিয়্যাতু ওয়াস্ সালাওয়াতু ওয়াত্তাইয়্যেবাতু
উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ
আসসালামু আলাইকা আইয়্যুহান নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু
রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম পুনরায় বললেন-
আসসালামু আ’লাইনা ওয়া আ’লা ইবাদিহিল্লাহিস সলিহিন
মুকাররবীন ফেরেশতাগণ এ দৃশ্য দেখে বলে উঠলেন-
আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রসুলুহু
এরপর আল্লাহ তাআ’লা রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম এর সাথে তাঁর ও তাঁর উম্মতগণের ব্যাপারে অনেক আলাপ আলোচনা করেন। এ আলাপ আলোচনা রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম এর মে’রাজ বা আল্লাহর সাথে দীদার নামে প্রসিদ্ধ। আল্লাহ তাআ’লা তাঁর উম্মতের গোনাহ মাফ, নৈকট্য ও দীদারের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ হাদিয়া বা উপহার হিসেবে দান করেন। রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম এর মে‘রাজ লাভ হয়েছিল স্বরীরে। আর তাঁর উম্মতের দীদার হবে রুহানীভাবে ক্বলবের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআ’লা এরশাদ করেন-
তুমি ছেজদা করো ও তাঁর নৈকট্য লাভ করো।
— ছুরা আলাক্ব-১৯
...আর আল্লাহ তাআ’লা বলেছেন নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সাথে আছি যখন তোমরা নামাজ কায়েম কর।...
— ছুরা মায়েদা-১২
রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম বলেন-
বান্দাহ সবচেয়ে আল্লাহর নিকটবর্তী হয় নামাজের মধ্যে ছেজদার সময়।
— মুছলিম-তাফছীরে মাজহারী , ১০ম ৩০১ পৃঃ
হযরত ইবনে আব্বাছ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে-রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম বলেন-জিবরিল এসে বললেন- হে রাছুল! আল্লাহ আপনাকে ছালাম দিয়েছেন এবং বলেছেন- কোন বান্দাহ যখন নামাজের জন্যে আল্লাহু আকবার বলে আল্লাহরদরবারে দাঁড়িয়ে যায়, তখন আমার ও ঐ বান্দার মধ্যেকার পর্দা উঠিয়ে দেয়া হয়। ঐ বান্দা নামাজে ক্বলবের মাধ্যমে আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে ছুরা ফাতেহা দিয়ে আল্লাহর সঙ্গে কথা বার্তা বলতে থাকে। (নামাজ কি? অধ্যায়ে এ হাদীছ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে)। নামাজের মাধ্যমে রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম এর উম্মতগনের এ মে’রাজ প্রাপ্তির কারণে অন্যান্য নবী-রাছুলগণ ও আকাংখা করে বলেছেন- নবী রাছুল না হয়ে রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম এর উম্মত হতে পারলে ছলাতের মাধ্যমে আল্লাহর দীদার লাভ করে ধন্য হতাম।
রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম মে’রাজ থেকে ফিরে এসে ছাহাবীগণের সামনে মেরাজের ঘটনাবলী বর্ণনা করে তাঁর উম্মতের জন্যে হাদিয়া বা উপহার স্বরূপ পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ দানের সুসংবাদ প্রদান করেন।[1]
নামাজ প্রশিক্ষণ (লেখকঃ মাহবুবুর রহমান)
আল্লাহ তাআ’লা কোরআন মাজীদে এরশাদ করেছেন-
নিশ্চয়ই আমি আমার আমানাতকে আছমান জমীন এবং পাহাড় সমুহের সামনে পেশ করেছিলাম। তারা একে গ্রহন করতে অস্বীকার করল এবং এ প্রস্তাবে ভীত হল কিন্তু মানুষ তা গ্রহন করল। নিশ্চয় সে (আমানাত গ্রহনের ব্যাপারে) নিজের উপর জুলুমকারী ও (আমানাত প্রতিপালনের ব্যাপারে) অজ্ঞ মুর্খ।
— ছুরা আহযাব-৭২
রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম বলেন -
আল্লাহ তাআ’লা বলেন-আমি গুপ্ত ভান্ডার ছিলাম। আমি নিজের পরিচয় দেয়াকে ভালবাসলাম। এরপর আমি আমার পরিচয় দানের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট (নুরে মুহাম্মাদী)-কে সৃষ্টি করলাম
— হাদীছে কুদছী
আল্লাহ তাআ’লা এরশাদ করেন-
আমি জ্বীন ও মানবজাতিকে আমার পরিচয় গ্রহনের জন্যে সৃষ্টি করেছি।
— ছুরা যারিয়াত-৫৬
তাফসীরবিদগণ ইবাদাতের অর্থ পরিচয় গ্রহন লিখেছেন (তাফছীরে মাজহারী)। আল্লাহ তাআ’লা বলেছেন-
আল্লাহ তাআ’লা ইনছানদের ভালবাসেন আর ইনছানও আল্লাহকে ভালবাসে।
দুনিয়ায় স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বিয়ের আগে তারা নিজ নিজ বাপ-মায়ের পরিবেশে মানুষ হয়। বাপ-মায়ের চাল-চলন, কথা-বার্তা, আদব-আখলাক, রুচি-অরুচি এক কথায় বাপ-মায়ের গুন গ্রহন করে সেই গুনে গুণান্বিত হয়। প্রত্যেক পরিবারের পরিবেশ হয় ভিন্ন। পৃথিবীতে এই দুই ভিন্ন পরিবেশের ছেলে-মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর দেখা যায় একজন মাছ, দুধ, টক বেশী পছন্দ করে, অন্যজন গোশ্ত, ঝাল, মিষ্টি। একজন সকাল ৮টায় খায়, অন্যজন ১০টায়। একজন রাত ৮টায় শোয়, অন্যজন ১১টায়। স্বামী, স্ত্রীর জন্যে সালোয়ার কামিছ পরা পছন্দ করে, স্ত্রী চায় শাড়ী। এ অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকে যদি তার বাপ-মায়ের পরিবেশ ঠিক রাখতে জেদ ধরে তবে তাদের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয়ে সংসার ভেঙ্গে যায়। এ জন্যে সংসারে শান্তির জন্যে দুজনেই একে অপরের পরিচয় গ্রহন করতে থাকে। স্ত্রী লক্ষ্য করে স্বামী তার চলা-ফেরা, খাওয়া-পরা, শোয়া, কথা-বার্তা কোনগুলি বেশী পছন্দ করে। স্ত্রীর সেগুলো অপছন্দ হলেও স্বামীকে ভালবাসার কারণে স্ত্রী আস্তে আস্তে স্বামীর পছন্দনীয় জিনিষগুলি গ্রহন করতে থাকে এবং নিজের পছন্দের জিনিষ থেকে দুরে সরে আসে। অন্যদিকে স্বামী ও স্ত্রীর চালচলন, খাওয়া-পেওয়া, শোয়া, কথা-বার্তা,পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে কোনগুলি বেশীপছন্দ করে তা’ লক্ষ্য করে। স্বামীর এগুলি পছন্দ না হলেও স্ত্রীকে ভালবাসার কারণে নিজের পছন্দ থেকে সরে এসে স্ত্রীর পছন্দ গ্রহন করতে থাকে। ফলে দেখা যায় স্বামী বাজার করার সময় স্ত্রীর পছন্দনীয় জিনিষ কিনে আনে। আর স্ত্রীও বাজার করতে গেলে স্বামীর রুচি ও পছন্দের জিনিষগুলি কিনে নিয়ে আসে।
স্ত্রীর মধ্যে যদি নোংরা বা অপরিস্কার থাকে তবে স্বামী তাকে সাবান ব্যবহার করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে শিক্ষা দেয়। এরপর স্বামীর পছন্দ অনুযায়ী আতর-সুগন্ধি কিনে দিয়ে তা মেখে স্বামীর সামনে আসতে বলে যেন নোংরা ও অপরিচ্ছন্নতা দূর করে সুগন্ধিতে মোহনীয় হয়ে আসে এবং স্বামীর চোখে মোহনীয় হয়ে ওঠে।
এর বিপরীতে স্বামী নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন থাকলে স্ত্রীও স্বামীকে সাবান দিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে আতর গোলাপ মাখিয়ে নিজের কাছে মোহনীয় করে তোলে। অশালীন আলাপ বা আচরণ থাকলে তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তা দূর করে ভাল আচারআচরণে অভ্যস্ত করে তোলে। স্ত্রীর সামনে স্বামীর যত ভাল গুন প্রকাশ পায় স্ত্রীও তত বেশী স্বামীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে স্বামীকে ভালবাসে। আর স্বামীর সামনে স্ত্রীর যত ভালগুন প্রকাশ পায় স্বামীও তত বেশী স্ত্রীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে স্ত্রীকে ভালবাসে। স্বামী-স্ত্রী যত বেশী পরস্পরের পরিচয় গ্রহন করতে থাকে তত বেশী তাদের মধ্যে প্রেম-মহব্বত সৃষ্টি হয় এবং সে প্রেম গাঢ় ও গভীর হতে থাকে। আপনি আপনার ছোট মেয়েকে বেশী ভালবাসেন। সে প্রায় সময়ই আপনার কোলে থাকে। আপনি আত্মীয় বাড়ী যাওয়ার জন্যে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে রওনা দিচ্ছেন। ছোট মেয়ে নিজে পেশাব-পায়খানা করে গায়ে মাখল। এরপর আপনার কোলে উঠার জন্যে কান্না শুরু করে দিল। আপনি কি ঐ অবস্থায় তাকে কোলে উঠাবেন? যার সামান্য কান্নাকাটি আপনি সহ্য করতে পারেন না, কান্নার সাথে সাথে কোলে উঠান। আর এখন তাকে কোলে উঠালে শুধু কাপড়-চোপড় নোংরা হবে, দূগন্ধ ছুটবে এজন্যে যতক্ষন তাকে সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার করে না দিবে ততক্ষন আপনি তাকে কোলে নেবেন না। আপনি যে পেশাব-পায়খানাকে ঘৃনা করছেন বর্তমানে ঐরূপ পেশাব-পায়খানা আপনার পেটের মধ্যেও আছে। যা আপনার মধ্যে আছে সেই একই ধরনের দূর্গন্ধ আর একজনের মধ্যে থাকায় আপনি তাকে এমন ঘৃনা করছেন।
আপনি চিন্তা করুন, যার মধ্যে কোন দূর্গন্ধ নেই, কোন দূর্গন্ধও যিনি সহ্য করতে পারেন না, তার কাছে নোংরা দূর্গন্ধ নিয়ে হাজির হলে তিনি কি তাকে সহ্য করে কাছে উঠিয়ে নেবেন ?
আল্লাহ তাআ’লা পবিত্র। পবিত্র ছাড়া কোন অপবিত্র ও দূর্গন্ধ যুক্ত জিনিষ তিনি সহ্য করতে পারেন না। তিনি সকল মাখলুককে সৃষ্টি করেছেন। সকলকে রিজিক দেন, সকলকে প্রতিপালন করেন। তিনি নিজের পরিচয় দানের জন্য মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানব জাতিকে ভালবাসেন আর মানবজাতিও তাকে ভালবাসে।
দুনিয়ার মানুষ একে অপরকে হিংসা, ঘৃনা, বিদ্বেষ, মিথ্যা, জুলুম, অন্যায়-অত্যাচার করে নিজেকে নোংরা কলুষিত ও দূগন্ধযুক্ত করে ফেলে। আল্লাহ তাআ’লা মানবের উক্ত দূগন্ধ পাপরাশি পরিস্কারের জন্য সাবান হিসেবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ দান করেছেন।
বান্দাহ যখন পাপরাশি নিয়ে নামাজে দাড়িয়ে নামাজের অনুশীলনের মাধ্যমে কাকুতি-মিনতি সহকারে পাপের জন্য অনুতাপ অনুশোচনা করে তখন আল্লাহ তাআ’লাও বান্দার প্রতি মোতাওয়াজ্জাহ হন এবং আপন রহমতের নুরের তাজাল্লী দিয়ে উক্ত পাপরাশি মুছে দেন আর তার মধ্যের লজ্জাহীন খারাপ ভাব ও মন্দ কাজ-কর্মের স্বভাব দূর করে দিয়ে নিজের গুনাবলীর সুগন্ধি মাখিয়ে নিজের (আল্লাহর) গুনাবলীর রংএ রঞ্জিত করে নেন। বান্দাহ এবং নিজের মধ্যকার পর্দা উঠিয়ে দিয়ে ক্কলবের দ্বারা ছুরা ফাতেহার মাধ্যমে কথা-বলতে থাকেন। রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম স্বশরীরে আল্লাহ তাআ’লার যে দীদার লাভ করেছিলেন, বান্দাহ নামাজের মাধ্যমে রুহানীভাবে সেই দীদার লাভ করে থাকে।
আল্লাহ তাআ’লা তাঁর হাবীবের উম্মতের মিরাজের জন্যে নামাজ দান করেছেন। সুতরাং বান্দাহ প্রথম দিকে নামাজের মাধ্যমে নিজের গোনাহ মাফ করিয়ে নিয়ে, লজ্জাহীন খারাপ স্বভাব থেকে বিরত থাকার গুন অর্জন করে। এরপর আল্লাহ তাআ’লার নৈকট্য,প্রেম, ও দীদার লাভের জন্যে মিরাজের যোগ্যতা অর্জনের নামাজ পড়ে থাকে। এ ব্যতীত নামাজের আরও বহু উপকারিতা আছে। এর বিভিন্ন উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হল। [1]
নামাজ প্রশিক্ষণ (লেখকঃ মাহবুবুর রহমান)
হযরত আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
আমি রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ তোমাদের কি ধারণা ? যদি তোমাদের কারো বাড়ীর পাশে একটি প্রবাহিত নদী থাকে আর তাতে প্রতিদিন কোন লোক পাঁচ বার গোছল করে তবে তার শরীরে কি কোন প্রকার ময়লাথাকতে পারে ? সকলে জবাব দিলঃ না কোন ময়লা থাকতে পারেনা। রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম বললেনঃ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের দৃষ্টান্তও তেমনি। আল্লাহ তাআ’লা নামাজের কারণে নামাজীদের গোনাহসমুহ মুছে দেন।
— বুখারী, মুছলিম, তিরমিজি ও নাছায়ী এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
ইবনো মাজাহ হযরত ওছমান রাদিআল্লাহু আনহু থেকেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
আবু ওছমান (রাঃ) বলেন
আমি হযরত ছালমান রাদিআল্লাহু আনহুর সঙ্গে এক গাছের নীচে ছিলাম। তিনি গাছের শুকনো ডাল ধরে নাড়া দিলেন আর তার পাতাগুলি সব ঝরে পড়ল। এরপর তিনি বললেনঃ হে আবু ওছমান! তুমিতো আমার কাছে জিজ্ঞেস করলে না কেন আমি এমন করলাম। আমি বললাম কেন এমন করলেন ? তিনি জবাব দিলেনঃ রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম আমার সঙ্গে এরূপ করেছিলেন, যখন আমি তাঁর সঙ্গে এক গাছ তলায় ছিলাম। রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম গাছের একটি শুকনো ডাল ধরে নাড়া দিলেন। অমনি তার সবগুলো পাতা ঝরে পড়লো। রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম আমাকে বললেনঃ হে ছালমান ! তুমি তো জিজ্ঞেস করলে না কেন আমি এমন করলাম। আমি বললামঃ কেন এমন করলেন ? রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম বললেনঃ কোন মুছলিম যখন ভালভাবে অজু করে তারপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে তখন তার গোনাহগুলি ঝরে যায় যেমন এ গাছের পাতা ঝরে পড়লো। এরপর তিনি এ আয়াত পড়লেন- ‘হে মুহাম্মাদ দিনের দু’প্রান্তে (সকাল-সন্ধ্যায়) এবং রাতের কিছু অংশে তুমি নামাজ কায়েম করো। কেননা ভাল কাজ (আমলনামা থেকে) পাপকে দূর করে দেয়। এটা উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য অতি উত্তম উপদেশ।‘
— আহমাদ, নাছায়ী ও তিবরানী এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন
হযরত ওছমান রাদিআল্লাহু আনহু বলেন
আমি রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লামকে বলতে শুনেছি - তিনি বলেছেনঃ যখন কোন ব্যক্তি ভালভাবে অজু করে নামাজ আদায় করে আল্লাহ তাআ’লা তার ঐ নামাজ ও পূর্ববর্তী নামাজের মাঝখানের সকল গোনাহ মাফ করে দেন।
— বুখারী ও মুছলিম
হযরত ওছমান রাদিআল্লাহু আনহু রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেনঃ
রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম বলেন - আল্লাহ যেমনভাবে অজু করার হুকুম করেছেন যখন কোন ব্যক্তি ঠিক তেমনভাবে অজু করে তখন তার ফরজ নামাজসমুহ তার মধ্যেকার সকল গোনাহকে মুছে দেয়।
— নাছায়ী ও ইবনু মাজাহ ছহিহ ছনদে এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন
ইবনে মাছউদ রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন -
রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম বলেন – প্রত্যেক নামাজের সময় একজন ঘোষনাকারী (ফেরেশতা) পাঠানো হয়। তিনি বলতে থাকেন, হে আদম সন্তান ! তোমরা ওঠো, তোমরা তোমাদের নিজদের জন্যে যে আগুন জ্বেলেছ তা নিভাও। এরপর আদম সন্তান উঠে পাক পবিত্র হয় এবং জোহরের নামাজ পড়ে। তখন তাহার জোহর ও তার পূর্বের নামাজের মধ্যেকার গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। এরপর আছর ওয়াক্ত হাজির হয়। তখন ঘোষক ফেরেশতা অনুরূপ বলেন ও অনুরূপভাবে আছরের ও তার আগের নামাজের মধ্যেকার গোনাহ মাফ করা হয়। এরপর মাগরিবের ওয়াক্ত হাজির হয়। ঘোষক ফেরেশতা অনুরূপ বলেন ও নামাজীর মাগরিব ও তার আগের নামাজের মধ্যের গোনাহ মাফ করা হয়। এরপর এশার ওয়াক্ত হাজির হয়। ঘোষক ফেরেশতা অনুরূপ বলেন এবং এশা ও মাগরিবের মধ্যেকার গোনাহ মাফ করা হয়। এরপর আদম সন্তান ঘুমিয়ে যায় এবং শান্তিতে অথবা অশান্তিতে ঘুমের মধ্যে সফর করতে থাকে। তিবরানী তার আল কাবীর কিতাবে এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
— আততারগীব ১ম - ২৩৫ পৃঃ
উপরোক্ত হাদীছসমুহ এবং আরো বহু হাদীছে রছূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লাম নামাজের মাধ্যমে গোনাহ মাফ হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন। [1]
নামাজ প্রশিক্ষণ (লেখকঃ মাহবুবুর রহমান)
· নামাজ প্রশিক্ষণ