রোজা
'রোজা' শব্দটি ফার্সি । এর আরবি শব্দ হল 'সাওম' । 'সাওম' শব্দের আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা । শরীয়াতের পরিভাষায় সুব্হে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়াত সহকারে পানাহার এবং স্ত্রী সহবাস হতে বিরত থাকাকে 'সাওম' বা রোজা বলা হয় । (আলমগীরী ও কাওয়াইদুল ফিক্হ)
ইসলামের দৃষ্টিতে রোযা হল এমন এক সার্বজনীন ইবাদত যা রোজাদারকে দান করে আত্মার সজীবতা, হৃদয়ের পবিত্রতা ও চিন্তাধারার বিশুদ্ধতা । এ রোযার উপর আল্লাহ্ তা’আলা যে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন তা এক মুহুর্তে মানুষকে করে তোলে ভোগে বিতৃষ্ণ ত্যাগে উদ্বুদ্ধ এবং আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান । হাদিসে কুদসিতে উল্লেখ রয়েছে
আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেনঃ রোযা আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর পুরস্কার দান করবো
অন্য এক হাদিসে আছে
রোজাদার ব্যক্তি দু’টি আনন্দ লাভ করবে । একটি আনন্দ হল ইফতারের মুহুর্তে আর অপরটি হলো তাঁর প্রতি পালকে সাথে সাক্ষাতের মুহুর্তে
রোজাদার ব্যক্তির যেন সাধ্যাতীত কষ্ট না হয় এর জন্য রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহ্রীকে সুন্নাত এবং বিলম্বে সাহরী গ্রহণ করাকে মুস্তাহাব বলেছেন । এমনিভাবে ইফতারের সময় বিলম্ব না করে ওয়াক্ত হতেই ইফতার করার হুকুম দিয়েছেন ।
রোজার ইতিহাস
বস্তুত রোজা রাখার বিধাণ সর্বযুগে ছিল । হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আখিরী নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলগণের যুগেই রোজার বিধান ছিল । এদিকে ইঙ্গিত করে আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ
হে ইমানদারগণ ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল যাতে তোমাদের পরহেয্গারী অর্জিত হয় ;
এ আয়তের ব্যখ্যায় আল্লামা আলূসী (রঃ) স্বীয় তাফসীর গ্রন্থ ‘রুহুল মাআনী’ তে উল্লেখ করেছেন যে এখানে ‘মিন ক্বাবলিকুম’ দ্বারা হযরত আদম (আঃ) হতে শুরু করে হযরত ঈসা (আঃ) এর যুগ পর্যন্ত সকল যুগের মানুষকে বুঝানো হয়েছে । এতে এ কথা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, রোযা কেবল আমাদের উপরই ফরয করা হয়নি বরং আদম (আঃ) এর যুগ হতেই চলে এসেছে । অন্যান্য তাফসীর বিশারদগণও অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করেছেন । শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ
রোযার হুকুম হযরত আদম (আঃ) এর যুগ হতে বর্তমান কাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চলে এসেছে
— ফাওয়াইদে উসমানী
তবে হযরত আদম (আঃ) এর রোযার ধরন কেমন ছিল তা সঠিকভাবে বলা যায় না । আল্লামা ইমাদুদ্দীন ইবন কাশীর (রঃ) বলেন, ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখার বিধান ছিল । পরে রমজানের রোযা ফরয হলে তা রহিত হয়ে যায় । হযরত মু’আয, ইবন মাসউদ, ইবন আব্বাস, আতা, কাতাদা এবং যাহ্হাক (রাঃ) এর মতে তিন দিন রোযা রাখার বিধান হযরত নূহ (আঃ) এর যুগ হতে শুরু করে নবী করিম (সঃ) এর জামানা পর্যন্ত বলবৎ ছিল । পরে আল্লাহ্ তা’আলা রামাযানের রোযা ফরজ করে ঐ বিধান রহিত করে দেন ।
তাফসীরে রুহুল মা’আনীতে এ কথাও উল্লেখ রয়েছে যেঃ
‘যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেওয়া হয়েছিল’ বলে যে তুলনা করা হয়েছে তা শুধু ফরয হওয়ার ব্যাপারে প্রযোজ্য হতে পারে । অর্থাৎ তোমাদের উপর যেমন রোযা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও রোযা ফরজ করা হয়েছিল । যদিও নিয়ম এবং সময়ের দিক থেকেও এ তুলনা প্রযোজ্য হতে পারে । তাই বলা হয়যে, কিতাবিদের উপরও রামাযানের রোযা ফরজ ছিল । তারা তা বর্জন করে বছরে ঐ একদিন উপবাসব্রত পালন করে, যেদিন ফির’আউন নীলনদে নিমজ্জিত হয়েছিল । এরপর খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও উক্ত দিনে রোজা রাখে । অবশ্য তারা এর সাথে আগে-পিছে আরো দুইদিন সংযোজন করে নেয় । এভাবে বাড়াতে বাড়াতে তারা রোজার সংখ্যা পঞ্চাশের কোটায় পৌঁছে দেয় । গরমের দিন এ রোজা তাঁদের জন্য দুঃসাধ্য হলে তারা তা পরিবর্তন করে শীতের মৌসুমে নিয়ে আসে ।
মুগাফ্ফাল ইব্ন হানযালা (রাঃ) থেকে বর্নিত । রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেন খৃষ্টান সম্প্রদায়ের উপর রামাযানের একমাস রোযা ফরয করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁদের জনৈক বাদশাহ অসুস্থ হয়ে পড়লে তারা এ মর্মে মানত করে যে, আল্লাহ্ তাঁকে রোগমুক্ত করলে রোযার মেয়াদ আরো দশ দিন বাড়িয়ে দেব । এরপর পরবর্তী বাদশাহর আমলে গোস্ত খাওয়ার কারনে বাদশাহর মুখে রোগব্যধি দেখাদিলে তারা আবারো মানত করে যে, আল্লাহ্ যদি তাঁকে সুস্থ করে দেন তবে আমরা অতিরিক্ত আরো সাতদিন রোযা রাখব । তারপর আরেক বাদশাহ সিংহাসনে সমাসীন হয়ে তিনি বললেন, তিন দিন আর ছাড়বো কেন ? এবং তিনি এও বলেন যে, এ রোযাগুলো আমরা বসন্তকালে পালন করব । এভাবে রোযা ত্রিশের সংখ্যা অতিক্রম করে পঞ্চাশের কোটায় পৌঁছে যায়
— রুহুল মাআনি, ২য় খন্ড
হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে, ইয়াহুদীরা আশুরার দিন সাওম পালন করে । তিনি জিজ্ঞাসা করালেন কি ব্যাপার? (তোমরা এ দিনে সাওম পালন কর কেন?) তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন । এ দিনে আল্লাহ্ তা’আলা বনী ইসরাইলকে তাঁদের শত্রুর কবল থেকে নাজাত দান করেন, ফলে এ দিনে মুসা (আঃ) সাওম পালন করেন । রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ আমি তোমাদের অপেক্ষা মুসার অধিক হকদার । এরপর তিনি এ দিন পালন করেন এবং সাওম পালনের নির্দেশ দেন
— বুখারী, সাওম অধ্যায়
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, হযরত মুসা ও হযরত ঈসা (আঃ) এবং তাঁদের উম্মাতগণ সকলেই সাম পালন করেছেন । নবীগণের মধ্যে হযরত দাউদ (আঃ) এর রোযা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস (রাঃ) থেকে বর্নিত । তিনি বলেন, নবী (সঃ) আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি সবসময় রোযা রাখ এবং রাতভর নামায আদায় কর । আমি বললাম জী, হ্যাঁ । তিনি বললেনঃ তুমি এরূপ করলে তোমার চোখ বসে যাবে এবং শরীর দূর্বল হয়ে পড়বে । যে ব্যক্তি সারা বছর রোযা রাখল সে যেন রোযাই রাখলনা । (প্রতি মাসে) তিনি দিন রোযা রাখা সারা বছর রোযা রাখার সমতুল্য । আমি বললাম, আমি এর চেয়ে বেশী রাখার সামর্থ রাখি । তিনি বললেনঃ তাহলে তুমি ‘সাওমে দাঊদী’ পালন কর । তিনি একদিন রোযা রাখতেন আর একদিন ছেড়ে দিতেন । (ফলে তিনি দূর্বল হতেন না) এবং যখন তিনি শত্রুর সম্মুখীন হতেন তখন পলায়ন করতেন না ।
— বুখারী, সাওম অধ্যায়
এতে একথা প্রমাণিত হয় যে, হযরত দাউদ (আঃ) ও সিয়াম পালন করেছেন । মোটকথা হযরত আদম (আঃ) এর যুগ থেকেই রোযা রাখার বিধান ছিল । কিন্তু পরবর্তীকালে আদর্শচ্যুত হয়ে লোকেরা আল্লাহ্র বিভিন্ন বিধানকে যেভাবে পরিবর্তন ও বিকৃত করেছিল অনুরূপভাবে রোযার ধর্মীয় তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্য শেষ হয়ে একটি নিছক প্রথায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল ।
এহেন অবস্থা হতে রোযাকে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের দিকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং একে অত্মিক, নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যাণের ধারক বানানোর নিমিত্তে মহান রাব্বুল আলামিন দ্বিতীয় হিজরিতে রামাযানের মাসের রোযাকে এ উম্মাতের উপর ফরয করে দেন ।
আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেনঃ
হে ইমানদারগণ ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল যাতে তোমাদের পরহেয্গারী অর্জিত হয়
— সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৩
আরও ইরশাদ হয়েছেঃ
রামাযান মাস, এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ন হয়েছে । সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে
— সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৫
ইসলাম অন্যানায় ইবাদতের মত রোযার মধ্যেও বেশ কিছু মৌলিক ও বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করেছে । সমাজের সর্বস্তরে এ সুদূরপ্রসারী সংস্কারের প্রভাব সুস্পষ্ট ।
ইসলামের সর্বপ্রধান সংস্কার হল রোযার ব্যাপারে ধারনাগত পরিবর্তন । অর্থাৎ ইয়াহুদীদের দৃষ্টিতে রোযা ছিল বেদনা ও শোকের প্রতীক । ইসলাম এই হতাশাব্যঞ্জক ভ্রান্ত ধারনাকে স্বীকার করেনি ।
কোন কোন প্রাচীন ধর্ম মতে রোযা এক বিশেষ শ্রেণীর জন্য পালনীয় ছিল । কিন্তু ইসলাম রোযাকে সকল শ্রেণী বিভক্তি ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করে এক সার্বজনীন রূপ দান করেছে । ইসলামের বিধানে প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানের জন্য রোযা রাখা ফরজ । [1]
যেসব কারনে রোযা ভঙ্গ হয় বা ভঙ্গ হয় না
মাসআলাঃ
রোযা রাখিয়া যদি রোযার কথা ভুলিয়া কিছু খাইয়া ফেলে, কিংবা ভুলে স্বামী-সহবাস হইয়া যায়, রোযার কথা মাত্রই স্মরণ না আসে, তবে তাহাতে রোযা ভঙ্গ হয় না । যদি ভুলে পেট ভরিয়াও পানাহার করে, কিংবা ভুলে কয়েকবার পানাহার করে, তবুও রোযা ভঙ্গ হয় না । (কিন্তু খাওয়া শুরু করার পর স্মরণ হইলে তৎক্ষণাৎ খাওয়া বন্ধ করিতে হইবে । কিছু জিনিস গিলিয়া ফেলিলেও রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে ।)
মাসআলাঃ
কোন রোযাদারকে ভুলবশতঃ খাইতে দেখিলে যদি রোজাদার সবল হয় এবং রোযা রাখিতে কষ্ট না হয়, তবে তাহাকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া ওয়াজিব । কিন্তু যদি রোযা রাখিবার মত শক্তি তাহার না থাকে, তবে স্মরণ করাইবে না; তাহাকে খাইতে দিবে ।
মাসআলাঃ
রোযা রাখিয়া দিনে ঘুমাইলে বা স্বপ্নদোষ হইলে (বা স্বপ্নে কিছু খাইলে) রোযা ভঙ্গ হয় না ।
মাসআলাঃ
রোযা রাখিয়া সুরমা বা তেল লাগান অথবা খুশবুর গরান লওয়া দুরস্ত আছে । এমন কি, চোখে সুরমা লাগাইলে যদি থুথু কিংবা শ্লেষ্মায় সুরমার রঙ দেখা যায়, তবুও রোযা ভঙ্গ হয় না, মাকরুহ্ও হয় না ।
মাসআলাঃ
রোযা রাখিয়া দিনের বেলায় স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে শোয়া, হাত লাগান বা পেয়ার করা সমস্তই দুরস্ত, কিনত যদি কামভাব প্রবল হইয়া স্ত্রীসহবাসের আশঙ্কা হয়, তবে এরূপ করা মাকরুহ । (এই জন্যই জওয়ান স্বামী-স্ত্রীর জন্য রোযা রাখিয়া চুম্বন অথবা কোলাকুলি করা মাকরুহ। কিন্তু যে সব বৃদ্ধের মনে চাঞ্চল্য আসে না তাহাদের জন্য মাকরুহ নবে।)
মাসআলাঃ
আপনাআপনি যদি হলকুমের মধ্যে মাছি, ধোঁয়া বা ধুলা চলিয়া যায়, তবে তাহাতে রোযা ভঙ্গ হয় না; কিন্তু ইচ্ছাপূর্বক এরূপ এরূপ করিলে রোযা ভঙ্গ হইবে ।
মাসআলাঃ
লোবান বা আগরবাতি জ্বালাইয়া তাহার ধোঁয়া গ্রহণ করিলে রোযা ভঙ্গ হইয়া যাবে । এইরূপে যদি কেহ বিড়ি সিগারেট অথবা হুক্কার ধোঁয়া পান করে তবে তাহার রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে । কিন্তু গোলাপ, কেওড়া ফুল, আতর ইত্যাদি যে সব খোশবুতে ধোঁয়া নাই, তাহার ঘ্রাণ লওয়া দুরস্ত আছে ।
মাসআলাঃ
দাঁতের ফাঁকে যদি কোন খাদ্যদ্রব্য আট্কিয়া থাকে এবং খেলাল বা জিহ্বার দ্বারা তাহা বাহির করিয়া গিলিয়া ফেলে, মুখের বাহির না করে এবং ঐ খাদ্যদ্রব্য একটি বুটের পরিমাণ অথবা তদপেক্ষা অধিক হয়, তবে রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে । আর যদি একটি বুট অপেক্ষা কম হয় তবে রোযা ভঙ্গ হইবে না, কিন্তু যদি মুখ হইতে বাহিরে আনিয়া তারপর গিলে, তবে তাহা বুট হইতে কম হইলেও রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে ।
মাসআলাঃ
মুখের থুথু যত বেশীই হউক না কেন তাহা গিলিলে রোযার কোনই ক্ষতি হয় না ।
মাসআলাঃ
শেষ রাত্রে সেহ্রী খাওয়ার পর যদি কেহ পান খায়, তবে ছোব্হে সাদেকের পূর্বেই উত্তমরূপে কুল্লি করিয়া মুখ ছাফ করিয়া লওয়া উচিৎ । উত্তমরূপে কুল্লি করার পরও যদি সকালে থুথু কিছু লাল দেখায়, তবে তাহাতে রোযা ভঙ্গ হইবে না ।
মাসআলাঃ
রাত্রে যদি গোসল ফরয হয়, তবে ছোব্হে ছাদেকের পূর্বেই গোসল করিয়া লওয়া উচিত; কিন্তু কেহ যদি গোসল করিতে দেরী করে,কিংবা সারা দিন গোসল নাও করে, তবে তাহাতে রোযা ভঙ্গ হইবে না। অবশ্য ফরয গোসল অকারনে দেরীতে করিলে তজ্জন্য পৃথক গোনাহ্ হইবে।
মাসআলাঃ
নাকের শ্লেষ্মা জোরে টানার কারনে যদি হলকুমে চলিয়া যায়, তবে তাহাতে রোযা নষ্ট হয় না। এইরূপে মুখের লালা টানিয়া গিলিয়া ফেলিলেও রোযা নষ্ট হয় না।
মাসআলাঃ
যদি কেহ সেহ্রী খাইয়া পান মুখে দিয়া চিবাইতে চিবাইতে ঘুমাইয়া পরে এবং পান মুখে থাকা অবস্থাতেই রাত্রি প্রভাত হইয়া যায়, তবে তাহার রোযা শুদ্ধ হবে না। এই রোযা ভাঙ্গিতে পারিবে না বটে, কিন্তু উহার পরিবর্তে একটি রোযা ক্বাযা রাখিতে হইবে, কাফ্ফারা ওয়াজিব হইবে না।
মাসআলাঃ
কুল্লি করার সময় যদি (অসতর্কতাবশতঃ রোযার কথা সরন থাকা স্বত্বেও) হলকুমের মধ্যে পানি চলিয়া যায়,(অথবা ডুব দিয়া গোসল করিবার সময় হঠাৎ নাক বা মুখ দিয়া হলকুমের ভিতর চলিয়া যায়,) তবে রোযা ভঙ্গ হইবে। (কিন্তু পানাহার করিতে পারিবে না।) এই রোযা ক্বাযা করা ওয়াজিব, কাফ্ফারা ওয়াজিব নহে।
মাসআলাঃ
আপনা আপনি যদি বমি হইয়া যায়, তবে বেশী হউক কি কম হউক, তাহাতে রোযা নষ্ট হয় না। তবে যদি ইচ্ছা করিয়া মুখ ভরিয়া বমি করে, তবে রোযা নষ্ট হইয়া যায়, অল্প বমি করিলে রোযা নষ্ট হয় না।
মাসআলাঃ
যদি আপনাআপনি সামান্য বমি হয় এবং আপনাআপনি হলকুমের ভিতর চলিয়া যায়, তাহাতে রোযা নষ্ট হইবে না। অবশ্য যদি ইচ্ছাপূর্বক গিলে, তবে পরিমানে কম হইলেও (বমি) রোযা নষ্ট হইয়া যাইবে, (অথবা যদি বেশী পরিমান আপনাআপনি হলকুমের নিচে চলিয়া যায়, তবে রোযা নষ্ট হইয়া যাইবে। কিন্তু পানাহার করিবে না।)
মাসআলাঃ
যদি কেহ একটি কঙ্কর অথবা লোহার (বা সীসার) গুলি (অথবা একটি পয়সা গিলিয়া ফেলে অর্থাৎ) এমন কোন জিনিস গিলিয়া ফেলে যাহা লোকে সাধারণতঃ খাদ্যরুপে খায় না বা ঔষধরুপেও সেবন করে না, তবে তাহাতে রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে বটে, কিন্তু কাফ্ফারা দিতে হইবে না। শুধু একটি রোযার পরিবর্তে আর একটি রোযা ক্বাযা করিতে হইবে । আর যদি এমন কোন জিনিশ গিলিয়া ফেলে, যাহা লোকে খাদ্যরুপে খায়, অথবা পানীয়রুপে পান করে, বা ঔষধরুপে সেবন করে, তবে তাহাকে কবাযাও রাখিতে হইবে এবং কাফ্ফারাও দিতে হইবে।
মাসআলাঃ
রোযা রাখিয়া দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাস করিলে এমন কি পুরুষের খৎনা স্থান স্ত্রীর যোনি দ্বারে প্রবেশ করিলে বীর্যপাত হউক বা না হউক রোযা ভঙ্গ হইবে, ক্বাযা এবং কাফ্ফার উভয়ই ওয়াজিব হইবে।
মাসআলাঃ
স্বামী যদি স্ত্রীর গুহ্যদ্বারে পুরুষাঙ্গের খৎনা স্থান পর্যন্ত প্রবেশ করায়, তবুও উভয়ের রোযা ভঙ্গ হইবে । কাফ্ফার, ক্বাযা উভয়ই ওয়াজিব হইবে ।
মাসআলাঃ
রমযান শরীফের রোযা রাখিয়া ভাঙ্গিলে কাফ্ফারা ওয়াজিব হয় । রমযান ছাড়া অন্য কোন রোযা ভাঙ্গিলে রোযা ওয়াজিব হয় না, যেরূপেই ভাঙ্গুক, যদিও রমযানের ক্বাযা রোযা রাখিয়া ভাঙ্গে। অবশ্য যদি রাত্রে রোযার নিয়্যত না করে, কিংবা রোযা ভাঙ্গার পর ওই দিনই হায়েয আসে, তবে ওই ভাঙ্গার কারনে কাফ্ফারা ওয়াজিব হইবে না।
মাসআলাঃ
নাকে নস্যি টানিলে কিংবা কানে তেল ঢালিলে, অথবা পায়খানার জন্য ডুস লইলে রোযা ভঙ্গ হইয়া যায়, কিন্তু এইরূপ করিলে কাফ্ফারা ওয়াজিব হইবে না, শুধু ক্বাযা করিতে হইবে । কানে পানি টপ্কাইলে তাহাতে রোযা ভঙ্গ হয় না ।
মাসআলাঃ
রোযা রাখা অবস্থায় পেশাবের রাস্তায় কোন ঔষধ রাখা অথবা তেল ইত্যাদি টপকান দুরুস্ত নাই। যদি কেহ ঔষধ রাখে, তবে রোযা ভঙ্গ হইবে এবং ক্বাযা ওয়াজিব হইবে, কাফ্ফারা ওয়াজিব হইবে না।
মাসআলাঃ
ধাত্রী যদি প্রসূতির প্রস্রাব দ্বারে আঙ্গুল ঢুকায় কিংবা নিজেই নিজ যোনিতে আঙ্গুল ঢুকায়, অতঃপর সম্পূর্ণ আঙ্গুল বা কিয়দংশ বাহির করার পর আবার ঢুকায়, তবে রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে । কিন্তু কাফ্ফারা ওয়াজিব হইবে না। আর যদি বাহির করার পর আবার না ঢুকায় তবে রোযা ভঙ্গ হইবে না । অবশ্য যদি পানি ইত্যাদির দ্বারা আঙ্গুল ভিজা থাকে, তবে প্রথমবারে ঢুকাইলেই রোযা ভঙ্গ হইবে ।
মাসআলাঃ
দাঁত দিয়া রক্ত বাহির হইলে যদি থুতুর সঙ্গে সে রক্ত গিলিয়া ফেলে, তবে রোযা ভঙ্গ হইবে, কিন্তু যদি থুতুর চেয়ে কম হয় – যাহাতে রক্তের স্বাদ পাওয়া না যায়, তবে রোযা ভঙ্গ হইবে না ।
মাসআলাঃ
কোন জিনিস জিহ্বার অগ্রভাগ দিয়া একটু স্বাদ দেখিয়া থুথু ফেলিয়া দিলে, রোযা ভঙ্গ হয় না । কিন্তু বিনা দরকারে এরুপ করা মাক্রুহ । অবশ্য যদি কাহারও স্বামী এত বড় যালেম এবং পাষান হৃদয় হয় যে ছালুনে নিমক একটু কম বেশী হইলে যুলুম করা শুরু করে, তাহার জন্য ছালুনে নুন দেখিয়া থুথু ফেলিয়া দেয়া দুরুস্ত আছে, মাক্রুহ নহে ।
মাসআলাঃ
রোযাবস্থায় শিশু সন্তানের খাওয়ার জন্য কোন জিনিস চিবাইয়া দেওয়া মাক্রুহ । অবশ্য শিশুর জীবন ওষ্ঠাগত হইলে এবং কেহ চিবাইয়া দেয়ার না থাকিলে, এইরূপ অবস্থায় চিবাইয়া দিয়া মুখ পরিষ্কার করিয়া ফেলা জায়েয আছে।
মাসআলাঃ
রোযা রাখিয়া দিনের বেলা কয়লা, বা মাজন (বা বালুর) দ্বারা দাঁত মাজা মাক্রুহ এবং ইহার কিছু অংশ যদি হলকুমের নিচে চলিয়া যায়, তবে রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে । কাঁচা বা শুক্না মেস্ওয়াক দ্বারা দাঁত মাজা দুরুস্ত আছে । এমন কি, নিমের কাঁচা দালের মেস্ওয়াক দ্বারা মেস্ওয়াক করে এবং তাহার তিক্ততার স্বাদ মুখে অনুভব করে, তাহাতেও রোযার কোন ক্ষতি হইবে না, মাক্রুহও হইবে না ।
মাসআলাঃ
কোন স্ত্রীলোক অসতর্ক অবস্থায় ঘুমাইয়াছে, কিংবা অজ্ঞান অবস্থায় পড়িয়া আছে, কেহ তাহার সহিত সহবাস করিলে তাহার রোযা ভঙ্গ হইবে এবং ক্বাযা ওয়াজিব হইবে । কিন্তু পুরুষের কাফ্ফারাও ওয়াজিব হইবে ।
মাসআলাঃ
ভুলে পানাহার করিলে রোযা যায় না, কিন্তু এইরূপ করার পর তাহার রোযা ভঙ্গ হইয়া গিয়াছে মনে করিয়া যদি কিছু খায়, তবে তাহার রোযা অবশ্য ভঙ্গ হইয়া ; কিন্তু শুধু ক্বাযা করিতে হইবে, কাফ্ফারা দিতে হইবে ।
মাসআলাঃ
কাহারও যদি আপনাআপনি বমি হয়, তাহাতে রোযা ভঙ্গ হয় না ।, কিন্তু রোযা ভঙ্গ হইয়া গিয়াছে মনে করিয়া যদি পরে কিছু খায়, তবে তাহার রোযা অবশ্যই টুটিয়া যাইবে ; কিন্তু শুধু ক্বাযা করিতে হইবে, কাফ্ফারা দিতে হইবে না ।
মাসআলাঃ
যদি কেহ সুরমা অথবা তেল লাগাইয়া অজ্ঞতাবশতঃ মনে করে যে, তাহার রোযা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে এবং এই কারনে ইচ্ছা করিয়া কিছু খাওয়া – দাওয়া করে, তবে ক্বাযা কাফ্ফারা উভয়ই ওয়াজিব হইবে ।
মাসআলাঃ
রমযান মাসে যদি কোন কারনবশতঃ যদি কাহারও রোযা ভাঙ্গিয়া যায়, তবুও দিনের বেলায় তাহার কিছু খাওয়া দুরুস্ত নহে, সমস্ত দিন রোযাদারের ন্যায় না খাইয়া থাকা তাহার ওপর উপর ওয়াজিব হইবে ।
মাসআলাঃ
যদি কেহ রমযানে রোযার নিয়্যতই করে নাই বলিয়া খাওয়া – দাওয়া করিতে থাকে, তাহার উপর কাফ্ফারা ওয়াজিব হইবে না। রোযার নিয়্যত করিয়া ভাঙ্গিলে কাফ্ফারা ওয়াজিব হয়।
ইয়াওমুশ্শক (সন্দেহের দিন)
(শা’বানের ২৯শে তারিখে যদি রমযানের চাঁদ দেখা যায়, তবে পর দিন রোযা রাখিতে হইবে।) যদি আকাশে মেঘ থাকে এবং চাঁদ দেখা না যায়, তবে দিন রোযা রাখিবে না। হাদীস শরীফে ইয়াওমুশ্শক অর্থাৎ এইরূপ সন্দেহের দিনে রোযা রাখার নিষেধ আসিয়াছে। শা’বানের ৩০ দিন পুরা হইলে পর রোযা রাখিবে।
মাসআলাঃ
২৯শে শা’বান মেঘের কারনে যদি চাঁদ দেখা না যায়, তবে পর দিন নফল রোযা রাখাও নিষেধ। অবশ্য যদি কাহারও হামেশা বৃহস্পতিবার, শুক্রবার অথবা অন্য কোন নির্দিষ্ট দিনে নফল রোযা রাখার অভ্যাস থাকিয়া থাকে এবং ঘটনাক্রমে ঐ তারিখ ঐ দিন হয়, তবে নফল নিয়াতে রোযা রাখা ভাল। অবশ্য যদি পরে কোথাও হইতে খবর আসে যে, ঐ দিন রমযানের ১লা তারিখ প্রমানিত হইয়াছে, তবে ঐ নফলের দ্বারাই ফরয আদায় হইয়া যাইবে, ক্বাযা করিতে হইবে না।
মাসআলাঃ
মেঘের কারনে যদি ২৯শে তারিখে যদি রমযানের চাঁদ দেখা না যায়, তবে দুপুরের ১ ঘন্টা পূর্ব পর্যন্ত কিছুই পানাহার করিবে না। যদি কোথাও হইতে চাঁদের খবর আসে, তবে তখনই রোযার নিয়্যত করিবে, আর যদি খবর পাওয়া না যায়, তবে পানাহার করিবে।
মাসআলাঃ
২৯শে শা’বান সন্ধায় যদি চাঁদ দেখা না যায়, তবে পর দিন ক্বাযা রোযা, মান্নতের রোযা, কাফ্ফারা রোযা কোন রোযাই দুরুস্ত নহে, মকরুহ। অবশ্য দুরুস্ত না হওয়া স্বত্বেও যদি কেহ রাখে, পরে ঐ দিন রমযানের ১লা তারিখ বলে প্রমানিত হয়, তবে ঐ রোযাতেই রমযানের রোযা আদায় হইয়া যাবে। ক্বাযা, কাফ্ফারা অথবা মান্নতের রোযা পরে রাখিতে হইবে। যদি খবর না পাওয়া যায়, তবে যে রোযার নিয়্যত করিয়াছে উহাই আদায় হইবে।
চাঁদ দেখা
আকাশে যদি মেঘ বা ধূলি থাকে, তবে মাত্র একজন পুরুষ বা স্ত্রী সত্যবাদী দ্বীনদার লোকের সাক্ষ্ম্যতেই রমযানের চাঁদ প্রমানিত অ সাব্যস্থ হইবে।
মাসআলাঃ
২৯শে রমযান যদি আকাশে মেঘ থাকে, তবে ঈদের চাঁদ প্রমানিত হইবার জন্য অন্ততঃ দুইজন বিশ্বস্ত দ্বীনদার পুরুষ অথবা দ্বীনদার একজন পুরুষ এবং দ্বীনদার দুইজন স্ত্রীলোকের সাক্ষ্ম্য আবশ্যক, অন্যথায় ঈদের চাঁদ প্রমানিত হইবে না। যদি একজন অতি বিশ্বস্ত, অতি ধার্মিক পুরুষেও সাক্ষ্য দেয়, অথবা শুধু চারিজন স্ত্রীলোক সাক্ষ্ম্য দেয়, পুরুষ কেহই সাক্ষ্য না দেয়, তবে উহাতে ঈদের চাঁদ প্রমানিত হইবে না এবং রোযা ভাঙ্গা যাইবে না।
মাসআলাঃ
যে লোক শরীয়াতের হুকুম মত চলে না, অনবরত শ’রার বরখেলাপ কাজ করিতে থাকে ; যেমন হয়ত নাময পরে না, রোযা রাখে না, মিথ্যা কথা বলে, (অথবা সুদ খায়) অথবা এইরূপ অন্য কোন গোনাহ্র কাজে লিপ্ত থাকে, শরীঅতের পাবন্দী করে না। শরীঅতে এইরূপ লোকের কথার কোনই মুল্য নাই । এই রকমের লোক যদি শত শত কসম খাইয়াও বয়ান করে তবু তাহার কথা বিশ্বাস করা যাইবে না । এমন কি, যদি এই ধরনের দুই তিন জন লোকেরাও বর্ণনা দেয়, তবুও তাহা দ্বারা কিছুই প্রমানিত হইবে না।
মাসআলাঃ
মশহুর আছে, যে দিন রজব মাসের ৪ তারিখ হইবে, সেদিন রমযানের প্রথম তারিখ হইবে। শরীঅতে ইহার কোন মুল্য নাই । চাঁদ না দেখিলে রোযা রাখিবে না ।
মাসআলাঃ
হাদীস শরীফে আছে, চাঁদ দেখিয়া এইরূপ বলা যে, চাঁদ অনেক বড়। ইহা আজকার চাঁদ নয় কালকার চাঁদ, এইরূপ বলা বড়ই খারাপ। ইহা কিয়ামতের একটি আলামত। সারকথা, চাঁদ বড় ছোট হওয়ার কোন মুল্য নাই। হিন্দুদের কথা বিশ্বাস করিও না যে, আজ দ্বিতীয়া, আজ অবশ্য চাঁদ উঠিবে । শরীঅতে এসব কথার কোন মুল্য নাই।
মাসআলাঃ
আকাশ যদি সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকে এবং তা স্বত্বেও চাঁদ দেখা না যায়, তবে দুই চারি জনের বলাতে এবং সাক্ষ্ম্য দেওয়াতে চাঁদ প্রমানিত হইবে না ।রমযানের চাঁদ হউক আর ঈদের চাঁদ হউক। অবশ্য যদি এত লোকে চাঁদ দেখার প্রমান দেয়, যাহাতে মনে দৃঢ় ধারণা হয় যে, এত লোক কিছুতেই মিথ্যা বানাইয়া বলিতে পারে না, তবে চাঁদ প্রমানিত হইয়া যাইবে।
মাসআলাঃ
অনেক সময় এরকম হয় যে দেশ ব্যাপিয়া মশহুর হইয়া যায় যে, কাল চাঁদ দেখা গিয়াছে; কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে সমস্ত দেশ খুঁজিয়া একজনেও দেখিয়াছে প্রমান পাওয়া গেল না ; শরীঅতে এইরূপ ভিত্তিহীন গুজবের কোনই মুল্য নাই।
মাসআলাঃ
রমযান শরীফের চাঁদ মাত্র একজন লোকে দেখিল, অন্য কেহই দেখিল না ; কিন্ত সে লোক শরীঅতের পাবন্দ না হওয়ার কারনে অন্য লোকে রোযা রাখিবে না। কিন্তু তাহার নিজের রোযা রাখিতে হইবে। কিন্তু এই লোকের প্রমানের হিসাবে ৩০ রোযা হইয়া যাওয়া স্বত্বেও ঈদের চাঁদ দেখা না যায়, তবে তাহার ৩১ রোযা রাখা ওয়াজিব হইবে, ঈদ তাহাকে সকলের সঙ্গেই করতে হইবে।
মাসআলাঃ
ঈদের চাঁদ যদি কেহ একা একা দেখে, অন্য কেহ না দেখে, তবে অন্যরা ত তাহার কথা গ্রহন করিবেই না, তার নিজেরও একা ঈদ করা দুরুস্ত নাই। পরদিন তাহারও রোযা রাখিতে হইবে, রোযা ভাঙ্গিতে পারিবে না।
মাসআলাঃ
৩০শে রমযানে যদি দিনের বেলায় চাঁদ দেখা যায়, দুপুরের পরে দেখা যাউক বা পূর্বে দেখা যাউক, কিছুতেই রোযা ভাঙ্গা যাইবে না, সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযা রাখিতে হইবে, সূর্যাস্তের পর নিয়ম মত ইফতার করিতে হইবে, ঐ চাঁদ কে সাম্নের রাত্রের চাঁদ ধরিতে হইবে। গত রাত্রের ধরা যাইবে না। যদি কেহ দিনের বেলা চাঁদ দেখে রোযা ভাঙ্গিয়া ফেলে, তবে তাহার কাফ্ফারা দিতে হইবে। --বেঃ গাওহার
তারাবীহ
তারাবীহ শব্দটির মূলতঃ আরবী । এর বাংলা রুপ 'তারাবী' যার অর্থ হলো - বিশ্রাম গ্রহন করা । এ শব্দের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন
تراويح শব্দটি ترويحة শব্দের বহুবচন । ترويحة অর্থ একবার বিশ্রাম গ্রহন করা । যেমন تسليمة শব্দের অর্থ একবার সালাম দেওয়া । মাহে রমযান এর বরকতময় রজনীতে জামা'আতের সঙ্গে যে নামাজ পড়া হয় তাকে সালাতুত তারাবীহ বলে । এ নামকরণের কারণ হচ্ছে যখন থেকে সাহাবায়ে কেরাম এ নামায সম্মিলিতভাবে আদায় করতে আরম্ভ করেন তখন থেকেই তারা প্রতি দু'সালামের পর অর্থাৎ চার রাকাতের পর বিশ্রাম নিতেন ।
— ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ), আহমাদ ইবনু আলী (৮৫৫ হিঃ), ফাতহুল বারী, (বৈরুত, দারুল মারিফা), প্রকাশকাল ১৩৭৯ খন্ড ৪, পৃঃ ৫০
আল্লামা বদরুদ্দীন আঈনী (রহঃ) বলেন
تراويح শব্দটি ترويحة এর বহুবচন । ترويحة এর বহুবচন ترويحات ও হতে পারে । মূলে এর অর্থ হচ্ছে বিশ্রাম গ্রহণ করা । প্রতি চার রাকাতের পর লোকেরা কিছু সময় বসার মাধ্যমে বিশ্রাম গহন করত বলেই তাকে তারাবীহ নামকরণ করা হয় । পরবর্তীতে রুপকভাবে চার রাকাতকেই এক তারবীহা বলা হত ।
— উমদাতুল ক্বারী শরহে সহীহুল বুখারীঃ আল্লামা বদরুদ্দীন আঈনী (রহঃ) (মূলফাত প্রথম প্রকাশকাল ১৭ই এপ্রিল ২০০৬) খন্ড ১৭, পৃঃ ১৫০
আল্লাম ইবনে নুযাইম আল মিসরী (রহঃ) (ওফাত ৯৭০ হিঃ) বলেন-
تراويح শব্দটি ترويحة শব্দের বহুবচন । এর মাসদার হচ্ছে الاستراحة যার অর্থ বিশ্রাম গ্রহন করা । প্রতি চার রাকাতের পর লোকেরা কিছু সময় বসার মাধ্যমে বিশ্রাম গহণ করত বলেই তাকে তারাবীহ নামকরন করা হয় । পরবর্তীতে রুপকভাবে চার রাকাতকেই এক তারাবীহা বলা । মুসান্নিফ ইহাকে সুন্নাত হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন এবং হিদায়ার লেখক এটাকে বিশুদ্ধ বলেছেন । "খুলাসাহ" গ্রন্থে বর্নিত আছে- তারাবীহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ তবে কেউ কেউ মতবিরোধ করেছে । ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ) তারাবীহ সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করলে তিনি সুন্নাত হিসেবে সাব্যস্ত করেন । এবং তিনি বলেন হযরত ওমর (রাঃ) যে পদ্ধতি চালু করেছেন তাতে তিনি বিদ'আতী নন ।
— ইবনে নুযাইম আল মিসরী (রহঃ) (ওফাত ৯৭০ হিঃ) আল বাহরুর রায়েক শারহু কানযুদ দাকায়েক (বৈরুত, দারুল কুতুবুল ইলমীয়া প্রথম প্রকাশ ১৯৯৭ ৪র্থ খন্ড পৃঃ ৩১২
পরিভাষায়
মাহে রমদ্বানের রাতে ইশার নামাজের পর (জামাতবদ্ধ হয়ে) যে সুন্নাত নামায পড়া হয়, তাকে تراويح বলে । যখন থেকে সাহাবায়ে কিরাম এ নামায সম্মিলিতভাবে আদায় করতে শুরু করেন, তখন থেকেই তারা প্রতি দু'সালাতের (অর্থাৎ চার রাকায়াতের) পর বিশ্রাম গহণ করতেন, তাই এ নামাযকে সালাতুত তারাবীহ বলা হয় ।
কেউ কেউ বলেন- তারাবীহ নামাযের মাধ্যমে মুমিন বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে চির সুখের আবাসন জান্নাত লাভের সৌভাগ্য অর্জনে সমর্থ হয় তাই একে তারাবীহ নামকরন করা হয়েছে ।[1]
ফায়েদাহঃ
تراويح তারাবীহ শব্দটি বুঝাচ্ছে এই নামাযের রাকাত সংখ্যা ৮ নয়, ৮ এর অধিক । কেননা تراويح শব্দটি বহুবচন । আরবী ভাষায় একবচন দ্বিবচন এরপর বহুবচন । এজন্য তিন বা ততোধিক বুঝাতে বহুবচন ব্যবহৃত হয় । তাহলে অন্ততঃ তিন ترويحة হলে ভাষাগত দিক থেকে একে ترويحة বলা যায় । তাহলে চার রাকাত = এক তারাবীহা (...), আট রাকাত = দুই তারাবীহা, আর বারো বা ততোধিক রাকাত = ৩ তারাবীহা ।
ক্বাযা রোযা
মাসআলাঃ
কোন কারনবশত যদি রমযানের সব রোযা বা কতেক রোযা রাখিতে না পারে, রমযানের পর যত শীঘ্র সম্ভব হয় ঐ সব রোযা ক্বাযা রাখিতে হইবে, দেরী করিবে না(হায়াত মউতের বিশ্বাস নাই,) বিনা কারনে ক্বাযা রোযা রাখিতে দেরি করিলে গোনাহ্গার হইবে।
মাসআলাঃ
ক্বাযা রোযা রাখিবার সময় দিন তারিখ নির্দিষ্ট করিবে যে, অমুক দিনের অমুক রোযার ক্বাযা করিতেছি। অবশ্য এরুপ নিয়াত করা জরুরী নহে। শুধু যে কয়টি রোযা ক্বাযা হইয়াছে, সে কয়টি রাখিলেই যথেষ্ট হইবে অবশ্য যদি ঘটনাক্রমে দুই রমযানের ক্বাযা রোযা একত্রে হইয়া যায়, তবে এই ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করিয়া নিয়্যত করিতে হইবে যে।“আজ অমুক বৎসরের রমযানের রোযা আদায় করিতেছি।”
মাসআলাঃ
ক্বাযা রোযা র জন্য রাত্রেই নিয়্যত করা যরুরী(শর্ত)। ছোব্হে ছাদেকের পরে ক্বাযা রোযার নিয়্যত করিলে ক্বাযা ছহীহ্ হইবে না, রোযা রাখিলে সে রোযা নফল হইবে। ক্বাযা রোযা পুনরায় রাখিতে হইবে।
মাসআলাঃ
কাফ্ফারার রোযারও একই হুকুম; যদি ছোব্হে ছাদেকের পূর্বে রাত্রেই কাফ্ফারা বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়া নিয়্যত না করে, তবে কাফ্ফারার রোযা ছহীহ্ হইবে না;(সেই রোযা নফল হইয়া যাইবে, কাফ্ফারার রোযা পুনরায় রাখিতে হইবে।)
মাসআলাঃ
যে কয়টি রোযা ছুটিয়া গিয়াছে, তাহা সব একাধারে বা বিভিন্ন সময়ে রাখাও দুরুস্ত আছে।(একাধারে রাখা মোস্তাহাব।)
মাসআলাঃ
গত রমযানে কিছু রোযা ক্বাযা ছিল, তাহা ক্বাযা না করিতেই পুনরায় রমযান আসিয়া গেল, এখন রমযানের রোযাই রাখিতে হইবে, ক্বাযা রোযা পরে রাখিব । এরুপ দেরী করা ভাল নয় ।
মাসআলাঃ
রমযান শরীফের সময় দিনের বেলায় কেহ যদি বেহুশ হইয়া পড়ে এবং কয়েক দিন যাবত বেহুঁশই থাকে, তবে যদি কোন ঔষধ হল্কুমের নীচে না যাইয়া থাকে, তবে বেহুশীর প্রথম দিনের রোযার নিয়্যত পাওয়া গিয়াছে, কাজেই প্রথম দিনের রোযা ছহীহ্ হইয়া যাইবে, পরে যে কয়দিন বেহুঁশ রহিয়াছে, সে কয়দিনের নিয়্যত পাওয়া যায় নাই বলিয়ায় কিছু পানাহার না হওয়া স্বত্বেও সে কয়দিনের রোযা হইবে না, সে কয়দিনের রোযা ক্বাযা করিতে হইবে।
মাসআলাঃ
এইরুপে যদি রাত্রে বেহুঁশ হয়, তবুও প্রথম দিনের রোযা ক্বাযা করা লাগিবে না। বেহুশীর অন্যান্য দিনের ক্বাযা ওয়াজিব হইবে। অবশ্য পরদিন রোযা রাখার নিয়্যত না করিয়া থাকে অথবা কোন ঔষধাদি সকাল বেলায় হল্কুমের নীচে যাইয়া থাকে, তবে ঐ দিনেরও ক্বাযা করিতে হইবে।
মাসআলাঃ
যদি কেহ সমগ্র রমযান মাস ব্যাপিয়া বেহুঁশ অবস্থায় থাকে, তবে সুস্থ হওয়ার পর সমস্ত রমযান মাসের রোযা ক্বাযা করিতে হইবে । ইহা মনে করিবে না যে, বেহুঁশ থাকার কারনে রোযা একেবারে মাফ হইয়া গিয়াছে। অবশ্য যদি কেহ সমগ্র রমযান মাস ব্যাপিয়া পাগল থাকে, মাত্রই ভাল না হয়, তবে তাহার রমযানের রোযার ক্বাযা করা লাগিবে না; কিন্তু যদি রমযানের মধ্যে ভাল হয়, তবে যে দিন হইতে ভাল হইয়াছে সে দিন হইতে রীতিমত রোযা রাখিবে।
মান্নতের রোযা
মাসআলাঃ
যদি কেহ কোন ইবাদতের (অর্থাৎ নামায, রোযা, ছদ্কা ইত্যাদির) মান্নত করে, তবে তাহা পুরন করা ওয়াজিব হইয়া যাইবে। যদি না করে, তবে গোনাহ্গার হইবে।
মাসআলাঃ
মান্নত দুই প্রকার।
প্রথম- দিন তারিখ ঠিক করিয়া মান্নত করা ।
দ্বিতীয়- অনির্দিষ্টরুপে মান্নত করা ।
ইহার প্রত্যকটি আবার দুই প্রকার
(১) শর্ত করিয়া মান্নত করা । যেমন বলিল, যদি আমার অমুক কাজ সিদ্ধ হয়, তবে আমি ৫০ টাকা আল্লাহ্র রাস্তায়দান করিব।
(২)- বিনা শর্তে শুধু আল্লাহ্র নামে মান্নত করা । যেমন বলিল, আমি আল্লাহ্র নামে পাঁচটি রপযা রাখিব। মোটকথা, যেরুপই মান্নত করুক না কেন, নির্দিষ্ট হউক বা অনির্দিষ্ট হউক, শর্তসহ হউক বা বিনাশর্তে হউক আল্লাহ্র নাম উল্লেখ করিয়া যবানে মান্নত করিলেই তাহা ওয়াজিব হইয়া যাইবে।(অবশ্য শর্ত করিয়া মান্নত করিলে যদি সেই শর্ত পাওয়া যায়, তবে ওয়াজিব হইবে ; অন্যথায় ওয়াজিব হইবে না।)
(মাসআলাঃ যদি কেহ বলে, আয় আল্লাহ্! আজ যদি আমার অমুক কাজ হইয়া যায়, তবে কালই আমি আপনার নামে একটা রোযা রাখিব, অথবা বলে, হে খোদা! আমার অমুক মকছুদ পূর্ণ হইলে আমি পরশু শুক্রবার আমি আপনার নামে একটা রোযা রাখিব। এরুপ মান্নত এ যদি রাত্রে রোযার নিয়্যত করে, তবুও দুরুস্ত আছে । আর যদি রাত্রে না করিয়া দ্বিপ্রহরের এক ঘন্টা পূর্বে নিয়্যত করে, তাহাও দুরুস্তআছে এবং মান্নত আদায় হইয়া যাইবে।)
মাসআলাঃ
মান্নত করিয়া যে জুমু’আর দিন নির্দিষ্ট করিয়াছে, সেই জুমু’আর দিনে রোযা রাখিলে যদি মান্নতের রোযা বলিয়া নিয়্যত না করে, শুধু রোযার নিয়্যত করে, অথবা নফল রোযা রাখার নিয়্যত করে, তবুও নির্দিষ্ট মান্নতের রোযা আদায় হইয়া যাইবে । অবশ্য যদি ঐ তারিখে ক্বাযা রোযার নিয়্যত করে এবং মান্নতের রোযার কথা মনে না থাকে, অথবা মনে ছিল কিন্তু ইচ্চছা করিয়া ক্বাযা রোযা রাখিয়াছে, তবে ক্বাযা রোযাই আদায় হইবে, মান্নত আদায় হইবে না; মান্নতের রোযা অন্য আর একদিন ক্বাযা করিতে হইবে।
মাসআলাঃ
দ্বিতীয় মান্নত এই যে, যদি দিন তারিখ নির্দিষ্ট করিয়া মান্নত না করে, শুধু বলে যে, যদি আমার অমুক কাজ হইয়া যায়, আমি আল্লাহ্র নামে পাঁচটি রোযা রাখিব, অথবা শর্ত না করিয়া শুধু বলে, আমি আল্লাহ্র নামে পাঁচটি রোযা রাখিব, তবুও পাঁচটি রোযা রাখা ওয়াজিব হইবে; কিন্তু যেহেতু কোন দিন তারিখ নির্দিষ্ট করে নাই, কাজেই যে কোন দিন রাখিতে পারিবে কিন্তু নিয়্যত রাত্রে করাই শর্ত। ছোব্হে ছাদেকের পর মান্নতের রোযার নিয়্যত করিলে এইরূপ অনির্দিষ্ট মান্নতের রোযা আদায় হইবে না এবং এই রোযা নফল হইয়া যাইবে।
মাসআলাঃ
নফল রোযার জন্য যদি এই নিয়্যত করে যে, ”আল্লাহ্র নামে একটা নফল রোযা রাখিব”, তাহাও দুরুস্ত আছে এবং যদি এইরূপ নিয়্যত করে যে, ’আমি আল্লাহ্র নামে একটি রোযা রাখিব’ তাহাও দুরুস্ত আছে।
মাসআলাঃ
বেলা দ্বিপ্রহরের এক ঘন্টা পূর্ব পর্যন্ত নফল রোযার নিয়্যত করা দুরুস্ত আছে। অতএব কাহারও যদি বেলা ১০টা পর্যন্ত রোযা রাখার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু এখনও কিছু পানাহার করে নাই, তারপর রোযা রাখার ইচ্ছা হইল, তবে ঐ সময় রোযারনিয়্যত করিলেও নফল রোযা দুরুস্ত হইয়া যাইবে।
মাসআলাঃ
সারা বৎসরে মাত্র পাঁচ দিন রোযা রাখা দুরুস্ত নহে। দুই ঈদের দিন এবং কুরবানীর ঈদের পরে ১১, ১২এবং ১৩ই যিলহজ্জ, মোট এই পাঁচ দিন রোযা রাখা হারাম, তাহা ছাড়া নফল রোযা যে কোন দিন রাখা যায় এবং নফল রোযা যত বেশীরাখা যাইবে তত বেশী সওয়াব পাওয়া যাইবে।
মাসআলাঃ
যদি কেহ ঈদের দিনে রোযা রাখার মান্নত করে, তবুও ঈদের দিন রোযা দুরুস্ত নহে। তৎপরিবর্তে অন্য একদিন রোযা রাখিয়া মান্নত পুরা করিতে হইবে।
মাসআলাঃ
যদি কেহ এইরূপ মান্নত করে যে, ‘আমি সারা বৎসর রোযা রাখিব, একদিনের রোযাও ছাড়িব না’ তবু এই পাঁচ দিন রোযা রাখিবে না ।এই পাঁচ দিন রোযা না রাখিয়া তাহার পরিবর্তে অন্য পাঁচ দিন রোযা রাখিতে হইবে।
মাসআলাঃ
নফল রোযার নিয়্যত করিয়া লইলে সে রোযা পুরা করা ওয়াজিব হইয়া যায়।অতএব, যদি কেহ স্কালে নফল রোযার নিয়্যত করিয়া পরে ঐ রোযা ভাঙ্গিয়া ফেলে। তবে তাহার ঐ রোযার ক্বাযা করা ওয়াহিব হইবে।
মাসআলাঃ
কেহ রাত্রে রোযা রাখার করিয়াছিল, ‘আমি আগামিকাল রোযা রাখিব’, কিন্তু ছোব্হে ছাদেক হওয়ার পূর্বেই নিয়্যত বদলিয়া গেল এবং রোযা রাখিল না, তবে তাহার ক্বাযা ওয়াজিব হইবে না।(তবে ছোব্হে ছাদেক হওয়ার পর যদি বদলায়, তবে ক্বাযা ওয়াজিব হইবে।)
মাসআলাঃ
স্ত্রীর জন্য স্বামী বাড়ীতে থাকিলে স্বামীর বিনা অনুমতিতে নফল রোযা রাখা দুরুস্ত নহে। এমন কি, যদি স্বামীর বিনা অনুমতিতে নফল রোযার নিয়্যত করে এবং পরে স্বামী রোযা ভাঙ্গিয়া ফেলার আদেশ করে, তবে রোযা ভাঙ্গিয়া ফেলা দুরুস্ত আছে, কিন্তু পরে স্বামীর অনুমতি লইয়া তাহার ক্বাযা করিতে হইবে।
মাসআলাঃ
মেহ্মান বা মেযবান(মেহ্মান অতিথি, মেযবান বাড়ীওয়ালা) যদি একে অন্যের সঙ্গে না খাওয়াতে মনে কষ্ট পায়, তবে নফল রোযা ছাড়িয়া দেয়া দুরুস্ত আছে, কিন্তু ঐ রোযা র পরিবর্তে আর একটা রোযা রাখিতে হইবে।
মাসআলাঃ
কেহ ঈদের দিন নফল রোযা রাখিল এবং নিয়্যতও করিল, তবুও সেই রোযা ছাড়িয়া দিবে, উহার ক্বাযা করাও ওয়াজিব হইবে না।
মাসআলাঃ
মহর্রম মাসের ১০ই তারিখ রোযা রাখ মুস্তাহাব। হাদীস শরীফে আছে, যে কেহ মহর্রম মাসের ১০ই তারিখে একটি রোযা রাখিবে তাহার বিগত এক বৎসরের (ছগীরা) গোনাহ্ মা’ফ হইয়া যাইবে।(কিন্তু শুধু ১০ই তারিখে একটি রো্যা মাকরুহ্। কাজেই তাহার সঙ্গে ৯ই তারিখ অথবা ১১ই তারিখ রোযা রাখিবে।)
মাসআলাঃ
এইরূপ হজ্জের চাঁদের ৯ই তারিখে রোযা রাখাও বড় সওয়াব।(হাদীস শরীফে আছে) যে ব্যক্তি হজ্জের চাঁদের ৯ই তারিখে এই রোযা রাখিবে তাহার বিগত এবং আগামী বৎসরের (ছগীরা) গোনাহ্ মা’ফ হইয়া যাইবে।(মহর্রমের আশুরার তারিখে একটি রো্যা মাকরুহ্, কিন্তু এখানে একটি রো্যা রাখা মাকরুহ্ নহে।) তবে শুরু চাঁদ হইতে ৯ই যিলহজ্জ পর্যন্ত রোযা রাখা উত্তম।(এইরুপে মহর্রমের চাঁদের শুরু হইতে ১০টি রোযা রাখা অতি উত্তম।)
মাসআলাঃ
শা’বানের চাঁদের ১৫ই তারিখে রোযা রাখা এবং শাওয়ালের চাঁদের ঈদের দিন বাদ দিয়া ছয়টি রোযা রাখা অন্যান্য নফল রোযা অপেক্ষ্ম অধিক সওয়াব(রজবের চাঁদের ২৭শে তারিখ রোযা রাখাও মুস্তাহাব।)
মাসআলাঃ
যে ব্যক্তি প্রত্যক চাঁদের ১৩ই, ১৪ই এবং ১৫ই তারিখে আইয়ামে বীযের তিনটি রোযা রাখিল, সে যেন সারা বৎসর রোযা রাখিল। হযরত নবী আলাইহিস্সালাম এই তিনটি রোযা রাখিতেন এবং প্রত্যেক সোমবার এবং বৃহস্পতিবার রোযা রাখিতেন। যদি কেহ এইসব রোযা রাখে, তবে তাহাতে অনেক সওয়াব আছে। (না রাখিলে কোন গোনাহ্ নাই।)
বেহেস্তী জেওর (লেখকঃ মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ))
রোযার কাফ্ফারা
মাসআলাঃ
রমযান শরীফের রোযা ভাঙ্গিয়া ফেলিলে একাধারে দুই মাস অর্থাৎ ৬০টি রোযা রাখিতে হইবে । কিছু কিছু করিয়া রাখা দুরুস্ত নাই । একলাগা ৬০টি রোযা রাখিতে হইবে । যদি মাঝখানে ঘটনাক্রমে দুই একদিনও বাদ পড়ে, তবে তাহার পর হইতে আবার ৬০টি গণনা করিয়া পূর্ণ করিতে হইবে, পূর্বেরগুলি হিসাবে ধরা যাইবে না । এমন কি, এই ৬০ দিনের মধ্য ঈদের বা কোরবানীর দিনও আসে, তবুওকাফ্ফারা আদায় হইবে না, পূর্বের গুলি বাদ দিয়া উহার পর হইতে ৬০টি পূর্ণ করিতে হইবে । অবশ্য এই ৬০ দিনের মাঝে যদি মেয়েলোকের হায়েয আসে তবে, তবে তাহা মা’ফ ; কিন্তু হায়েয হইতে পাক হইবার পরদিন হইতে আবার রোযা রাখিতে হইবে এবং ৬০টি রোযা পূর্ণ করিতে হইবে।
মাসআলাঃ
নেফাসের কারনে যদি মাঝে রোযা ভাঙ্গা পড়ে, তবে কাফ্ফারা আদায় হইবে না । নেফাস হইতে পাক হওয়ার পর ৬০টি পূর্ণ করিবে । নেফাসের পূর্বে যদি কিছু রোযা রাখিয়া থাকে, তাহা গণনায় ধরা যাইবে না ।
মাসআলাঃ
রোগের কারনে যদি মাঝ রোযা ভাঙ্গা পড়ে, তবে আরোগ্য হওয়ার পর নুতনভাবে ৬০টি রোযা পূর্ণ করিতে হইবে ।
মাসআলাঃ
যদি মাঝে রমযানের মাস আসে, তবুও কাফ্ফারা আদায় হইবে না ।
মাসআলাঃ
যদি কাহারও কাফ্ফারা রোযা রাখার শক্তি না থাকে, তবে রমযানের শরীফের একটি রোযা ভাঙ্গিলে তাহার পরিবর্তে ৬০ জন মিস্কীনকে দুই বেলা খুব পেট ভরিয়া খাওয়াইতে হইবে ।
মাসআলাঃ
যদি এই ৬০ জনের মধ্যে কয়েকজন এমন অল্প বয়স্ক থাকে যে, তাহারা পূর্ণ খোরাক খাইতে পারে না, তবে তাহাদিগকে হিসাবে ধরা যাইবে না। তাহাদের পরিবর্তে অন্য পূর্ণ খোরাক খানেওয়ালা মিসকীনকে আবার খাওয়াইতে হইবে।
মাসআলাঃ
যদি গমের রুটি হয়, তবে শুধু রুটি খাওয়ানও দুরুস্ত আছে, আর যদি যব, বজরা, ভুট্টা ইত্যদির রুটি বা ভাত হয়, তবে উহার সহিত কিছু ভাল তরকারী দেওয়া উচিত । যাহাতে রুটি ভাত খাইতে পারে ।
মাসআলাঃ
পাকান খাদ্য না খাওয়াইয়া যদি ৬০ জন মিসকীঙ্কে গম বা তার আটা দেয়, তাহাও জায়েয আছে । কিন্তু প্রত্যেক মিসকীনকে ছদ্কায়ে ফেৎর পরিমান দিতে হইবে । ছদ্কায়ে ফেৎরের বর্ণনা যাকাত অধ্যায়ে দ্রষ্টব্য ।
মাসআলাঃ
যদি এই পরিমান গম দেয় তাহাও জায়েয আছে ।
মাসআলাঃ
কিন্তু যদি সে তাহার কাফ্ফারা আদায় করিবার জন্য কাহাকেও অনুমতি দেয় বা আদেশ করে এবং তারপর সেই ব্যক্তি আদায় করিয়া দেয়, তবে তাহার কাফ্ফারা আদায় হইয়া যাইবে । যাহার উপর কাফ্ফারা ওয়াজিব হইয়াছে তাহার বিনা অনুমতিতে যদি অন্য কেহ তাহার কাফ্ফারা আদায় করিয়া দেয়, তবে তাহাতে কাফ্ফারা আদায় হইবে না ।
মাসআলাঃ
যদি একজন মিস্কীনকে ৬- দিন সকাল বিকাল পেট ভরিয়া খাওয়াইয়া দেয় বা একই জনকে ৬০ দিন ৬০ বার (ছ্দকায়ে ফেৎর পরিমান) গম বা তাহার মুল্য দেয় তাহাতে কাফ্ফারা আদায় হইয়া যাইবে ।
মাসআলাঃ
যদি ৬০ দিন পর্যন্ত খাওয়াইবার বা মুল্য দিবার সময় মাঝখানে ২/১ দিন বাকী পড়ে, তবে তাহাতে কোন ক্ষতি নাই । (একাধারে ৬০ দিন না হইলেও সর্বশুদ্ধ ৬০ দিন খাওয়ান হইলে বা মুল্য দেওয়া হইলে তাহাতেই চলিবে) ।
মাসআলাঃ
৬০ দিনের আটা বা গম অথবা তাহার মুল্য হিসাব করিয়া একই দিন একজন মিস্কীনকে দেওয়া দুরুস্ত নাই । (দিলে মাত্র একদিনের কাফ্ফারা আদায় হইবে, বাকী ৫৯ দিনের পুনরায় আদায় করিতে হইবে ।) এইরূপে যদি এক দিন একজন মিস্কী্নকে ৬০ বার দেয়, তবুও মাত্র একদিনেরই কাফ্ফারা আদায় হইবে, বাকী ৫৯ দিনের পুনরায় আদায় করিতে হইবে। সারকথা এই যে, একদিন একজন গরীবকে একটি রোযার বিনিময় অধিক দিলে তাহার হিসাব ধরা যাইবে না, মাত্র এক দিনেরই ধরা যাইবে ।
মাসআলাঃ
কোন মিসকীনকে ছ্দকায়ে ফেৎর পরিমাণের কম দিলে কাফ্ফারা আদায় হইবে না ।
মাসআলাঃ
যদি একই রমযানের ২ বা ৩টি রোযা ভাঙ্গিয়া থাকে, তবে একটি কাফ্ফারাই ওয়াজিব হইবে । (কিন্তু যে কয়টি রোযা ভাঙ্গিয়াছে সেই কয়টির ক্বাযা করিতে হইবে। যদি দুই রমযানের দুইটি রোযা ভাঙ্গিয়া থাকে, তবে একটি কাফ্ফারা যথেষ্ট হইবে না, দুইটি কাফ্ফারা আদায় করিতে হইবে ।)
সেহ্রী ও ইফতার
মাসআলাঃ
রোযা রাখিবার উদ্দেশ্যে শেষ রাত যাহাকিছু খাওয়া হয়, তাহাকে সেহ্রী বলে। সেহ্রী খাওয়া সুন্নত । ক্ষুধা না থাকিলে অন্ততঃ ২/১ টি খোরমা বা অন্য কোন জিনিস খাইবে । কিছু না হইলেও একটু পানি পান করিবে । (ইহাতেও সুন্নত আদায় হইবে ।)
মাসআলাঃ
সেহ্রীর সময় যদি কেহ সেহ্রী না খাইয়া মাত্র (এক মুষ্টি চাল পানি দিয়া খায় বা) একটি পান খায়, তাহাতেও সেহ্রী খাওয়ার সওয়াব হাছেল হইয়া যাইবে ।
মাসআলাঃ
সেহ্রী যথাসম্ভব দেরী করিয়া খাওয়া ভাল, এত দেরী করা উচিত নহে যাহাতে ছোবহে্ ছাদেক হইবার আশংকা হয় এবং রোযার সন্দেহ আসিতে পারে ।
মাসআলাঃ
যদি সেহ্রী খুব জল্দী খায় ; কিন্তু তাহার পর পান, তামাক, চা, পানি ইত্যাদি অনেকক্ষন পর্যন্ত খাইতে থাকে, ছোব্হে ছাদেক হওয়ার অল্প পূর্বে কুল্লি করিয়া ফেলে, তবুও দেরী করিয়া খাওয়ার সওয়াব পাইবে । ইহার হুকুমও দেরী করিয়া খাওয়ার হুকুম । (সেহ্রী খাওয়ার আসল সময় সূর্যাস্ত হইতে ছোবহে্ ছাদেক পর্যন্ত যে কয় ঘন্টা হয় তাহার ছয় ভাগের শেষ ষষ্ঠ ভাগ । যদি কেহ ইহার পূর্বে ভাত ইত্যাদি খায়, কিন্তু চা, পান ইত্যাদি এই শেষ ষষ্ঠাংশে করে । তবে তাহাতেও মুস্থাহাবের সওয়াব হাছেল হইবে।)
মাসআলাঃ
যদি রাত্রে ঘুম না ভাঙ্গে এবং সেই জন্য সেহ্রী খাইতে না প্রে, তবে সেহ্রী না খাইয়া রোযা রাখিবে । সেহ্রী না খাওয়ার কারনে রোযা ছাড়িয়া দেওয়া বড়ই কাপুরুষতার লক্ষন এবং বড়ই গোনাহ্র কাজ ।
মাসআলাঃ
যে পর্যন্ত ছোবহে্ ছাদেক না হয় অর্থাৎ, পূর্বদিকে সাদা বর্ণ না দেখা যায়, সে পর্যন্ত সেহ্রী খাওয়া দুরুস্ত আছে । ছোবহে্ ছাদেক হইয়া গেলে আর কিছুই খাওয়া দাওয়া দুরুস্ত নহে ।
মাসআলাঃ
যদি কেহ দেরীতে ঘুম হইতে উঠিয়া ‘ এখনও রাত আছে, ছোবহে্ ছাদেক হয় নাই,’ এই মনে করিয়া সেহ্রী খায়, পরে জানিতে পারে যে, ঐ সময় রাত ছিল না, তবে ঐ রোযা ছহীহ্ হইবে না, ঐ রোযার পরিবর্তে আর একটি রোযা ক্বাযা করিতে হইবে ; কাফ্ফারা দিতে হইবে না । কিন্তু ঐ দিনেও পানাহার করিতে পারিবে না । এইরূপ যদি সূর্য ডুবিয়া গিয়াছে, এই মনে করিয়া ইফ্তার করিয়া ফেলে এবংপরে জানতে পারে যে, সূর্য ডুবে নাই, তবে ঐ রোযা ছহীহ্ হইবে না । ঐ রোযার ক্বাযা করিতে হইবে ; কাফ্ফারা দিতে হইবে না । অবশ্য সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবশিষ্ট সময়টুকুতে কিছুই পানাহার করিতে পারিবে না ।
মাসআলাঃ
দেরী করিয়া উঠিয়া যদি সন্দেহ হয় যে, ছোবহে্ ছাদেক হইয়া গিয়াছে, তবে ঐ সময় কিছু খাওয়া দাওয়া মাক্রুহ । ওইরুপ সন্দেহ র সময় কিছু খাইলে গোনাহ্গার হইবে এবং রোযা ক্বাযা করিতে হইবে । কিন্তু এক্কিনীভাবে জানিতে পারে যে, ছোবহে্ ছাদেক হয় নাই, তবে রোযার ক্বাযা করিতে হইবে না । আর যদি কিছু ঠিক করিতে না পারে সন্দেহই থাকিয়া যায়, তবে ক্বাযা ওয়াজিব নহে, কিন্তু ক্বাযা রাখা ভাল ।
মাসআলাঃ
যখন নিশ্চিতরুপে জান যায় যে, সূর্য অস্ত গিয়াছে তখন আর দেরী না করিয়া সীঘ্রই ইফ্তার করা মুস্তহাব । দেরী করিয়া ইফ্তার করা মাকরুহ্।
মাসআলাঃ
আবরের (মেঘের) দিনে কছু দেরী করিয়া ইফ্তার করা ভাল । শুধু ঘড়ি ঘন্টার উপর নির্ভর করা ভাল নয় । কারণ, ঘড়ি ঘন্টাও প্রায় সময় ভুল হয় । অতএব, আবরের দিনে যতক্ষণ ঈমানদার ব্যক্তির দিলে সূর্য অস্ত গিয়াছে বলিয়া সাক্ষ্য না দেয়, ততক্ষণ ইফ্তার করিবে না । কাহারও আযানের উপরও পূর্ণ নির্ভর করা উচিত নহে । কারণ, মোয়ায্যেনেরও ভুল হইতে পারে । কাজেই ঈমানদারের দিলে গাওয়াহী না দেওয়া পর্যন্ত ছবর করাই ভাল । ওয়াক্ত হইল কি না সন্দেহ হইলে ইফ্তার করা দুরুস্ত নাই ।
মাসআলাঃ
খোরমার দ্বারা ইফ্তার করা সবচেয়ে উত্তম । খোরমার অভাবে অন্য কোন মিষ্টি জিনিস দ্বারা এবং তদভাবে পানি দ্বারা ইফ্তার করা ভাল । কেহ কেহ লবণ দিয়া ইফ্তার করাকে সওয়াব মনে করে । এই আকীদা ভুল ।
মাসআলাঃ
যে পর্যন্ত সূর্যাস্ত সম্বন্ধে কিছু মাত্র সন্দেহ থাকে, সে পর্যন্ত ইফ্তার করা জায়েয নহে ।
যে সব কারনে রোযা রাখিয়াও ভাঙ্গা যায়
মাসআলাঃ
রোযা রাখিয়া হঠাৎ যদি এমন কোন রোগে আক্রান্ত হইয়া পড়ে যে, কিছু দাওয়া পানি না খাইলে জীবনের আশংকা হইতে পারে বা রোগ অত্যন্ত বাড়িয়া যাইতে পারে, তবে এইরূপ অবস্থায় রোযা ছাড়িয়া দিয়া ঔষধ সেবন করা জায়েয আছে । যেমন, হঠাৎ পেটে এমন বেদনা উঠিল যে, একেবারে অস্থির হইয়া পড়িল, অথবা সাপে দংশন করিল যে, ঔষধ না খাইলে জীবনের আশা ত্যাগ করিতে হয়, এইরূপেযদি এমন পিপাসা হয় যে, প্রান নাশের আশংকা হয়, তবে রোযা ভাঙ্গা জায়েয আছে ।
মাসআলাঃ
গর্ভবতী মেয়েলোকের যদি এমন অবস্থা হয় যে। নিজের বা সন্তানের প্রান নাশের আশংকা হয়, তবে রোযা ভাঙ্গা দুরুস্ত আছে ।
মাসআলাঃ
খানা পাকাইবার কারনে যদি এমন পিপাসা হয়, প্রান নাশের আশংকা হয়, তবে রোযা ছাড়িয়া দেওয়া দুরুস্ত আছে । কিন্তু যদি নিজে স্বেচ্ছায় এমন কাজ করে, যাহাতে এরুপ অবস্থা হয়, তবে গোনাহ্গার হইবে ।
মাসআলাঃ
কেহ যদি এমন রোগাক্রান্ত হয় যে, যদি রোযা রাখে, তবে (ক) রোগ বাড়িয়া যাইবে, (খ) রোগ দুরারোগ্য হইয়া যাইবে, (গ) জীবন হারাইবার আশঙ্কা হয়, তবে তাহার জন্য তখন রোযা না রাখিয়া আরোগ্য লাভ করার পর ক্বাযা রাখা দুরুস্তআছে । কিন্তু শুধু নিজের কাল্পনিক খেয়ালে রোযা ছাড়া জায়েয নহে, যখন কোন মুসলমান দ্বীনদার চিকিৎসক সার্টিফিকেট (সাক্ষ্য) দিবেন যে, রোযা তোমার ক্ষতি করিবে, তখন রোযা ছাড়া জায়য হইবে ।
মাসআলাঃ
চিকিৎসক, ডাক্তার বা কবিরাজ যদি কাফের (অমুসলমান) হয়, অথবা এমন মুসলমান হয় যে, দ্বীন ঈমানের পরওয়া রাখে না, তবে তাহার কথায় রোযা ছাড়া যাইবে না ।
মাসআলাঃ
রোগী যদি নিজেই বহুদর্শী জ্ঞানী হয় এবং বারবার পরীক্ষা দ্বারা প্রমানিত হইয়া থাকে যে, এই রোগে রোযা রাখিলে নিশ্চিত ক্ষতি হইবে এবং মনেও এইরূপ সাক্ষ্য দেয়, তবে নিজের মনের সাক্ষ্যের উপর রোযা ছাড়িতে পারে । কিন্তু যদি নিজে ভুক্তভোগী জ্ঞানী না হয়, তবে শুধু কাল্পনিক খেয়ালের কোনই মুল্য নাই । কাল্পনিক খেয়ালে বশীভুত হইয়া কিছুতেই রোযা ছাড়িবে না । এইরূপ অবস্থায় দ্বীনদার চিকিৎসকের সাক্ষ্য (সনদ) ব্যতিরেকে রোযা ছাড়িলে কাফ্ফারা দিতে হইবে । রোযা না রাখিলে গোনাহ্ হইবে ।
মাসআলাঃ
রোগ আরোগ্য হওয়ার পর যে দুরবলতা থাকে, সেই দুরবল অবস্থায় যদি রোযা রাখিলে পুনরায় রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবল আশংকা থাকে, তবে সে অবস্থায় রোযা না রাকাহ জায়েয আছে ।
মাসআলাঃ
যে ব্যক্তি বাড়ী হইতে ৪৮ মাইল বা তার দূরবর্তী স্থানে যাইবার এরাদা করিয়া নিজ বাসস্থানের লোকদের সীমা অতিক্রম করিয়াছে, তাহাকে শরীঅতের পরিভাষায় ‘মুসাফির’ বলে । অবশ্য যাহারা শরীঅত অনুসারে মুসাফির তাহারা সফরেথাকাকালীন রোযা ছাড়িয়া দিয়া অন্য সময় রাখিতে পারে ।
মাসআলাঃ
শরয়ী সফরে যদি কোন কষ্ট না হয়, যেমন গাড়ীতে ভ্রমন করিতেছে, ধারণা এই যে, সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ী পৌঁছাইয়া যাইব, কিংবা সঙ্গে আরামের দ্রব্য আছে । তবে রোযা রাখাই উত্তম, কিন্তু না রাখিলে গোনাহ্ হইবে না ; অবশ্য রমযানের ফযীলত পাইবে না । যদি রোযা রাখিতে কষ্ট হয়, তবে রোযা না রাখায় ভাল ।
মাসআলাঃ
যদি কেহ পীড়িতাবস্থায় মারা যায়, অথবা শরয়ী সফরেই মৃত্যু হয়, তবে যে কয়টি রোযা এই রোগের অথবা এই সফরের জন্য ছুটিয়াছে, আখেরাতে তাহার জন্য দায়ী হইবে না । কেননা, সে ক্বাযা রাখিবার সময় পায় নাই ।
মাসআলাঃ
কেহ পীড়িতাবস্থায় ১০টি রোযা ছাড়িয়াছে এবং ৫ দিন ভাল থাকিয়া মৃত্যু হইল, এখন ৫ টি রোযা মাফ পাইবে, কিন্তু পাঁচ দিন ভাল ছিল অথচ ক্বাযা রোযা রাখে নাই, সেই পাঁচটি রোযার জন্য দায়ী হইবে এবং কিয়ামতের হিসাবের সময় তাহার জন্য ধর পাকড় হইবে । আর যদি আরোগ্য হওয়ার পর পূর্ণ দশ দিন ভাল থাকিয়া থাকে, তবে পূর্ণ দশটি রোযার জন্যই হইবে এবং কিয়ামতের দিন ধর পাকড় হইবে । কাজেই কাহারও যদি এইরূপ অবস্থা হয় তবে তাহার মৃত্যুর আলামত দেখিলে তাহার মাল থাকিলে বাকী রোযার ফিদ্ইয়া আদায় করার জন্য অছিয়ত করিয়া যাওয়া উচিত (মাল থাকা স্বত্বেও যদি অছিয়ত না করে, তবে শক্ত গোনাহ্গার হইবে ।) ফিদ্য়ার বয়ান সামনে আসিতেছে ।
মাসআলাঃ
এইরূপ যদি কেহ শরীয় সফরের মাঝে রোজা না রাখে এবং বাড়ীতে ফিরিয়া কয়েকদিনের মাঝে মারা যায়, তবে যে কয় দিন বাড়ীতে আসিয়া ভাল রহিয়াছে, সেই কয় দিনের জন্য ধর পাকড় হইবে, সে কয়টি রোযার ফিদ্ইয়ার জন্য অছিয়তকরিয়া যাওয়া তাহার উপর ওয়াজিব । যে কয়দিন বাড়ী রহিয়াছে, রোযা যদি তাহা অপেক্ষা বেশী ছুটিয়া থাকে, তবে বেশী রোযার ফিদ্ইয়া তাহার উপর ওয়াজিব নহে ।
মাসআলাঃ
শরীয় সফরে বাহির হওয়ার পর যদি বিদেশে কোন স্থানে ১৫ দিন বা তাহার বেশী অবস্থান করিবার নিয়্যত করে, তবে সেখানে থাকাকালে রোযা ছাড়া দুরুস্ত নহে । কেননা, কমপক্ষে ১৫ দিন কোন স্থানে অবস্থান করার নিয়্যত করিলে শরা’ অনুসারে সে মুক্কীম হইয়া যায়, মুসাফির থাকে না । অবশ্য যদি ১৫ দিনের কম থাকার নিয়্যত করে, তবে রোযা না রাখা জায়েয আছে ।
মাসআলাঃ
গর্ভবতী মেয়েলোকের অথবা সদ্যপ্রসুত শিশুর স্তন্যদায়িনী মেয়েলোকের রোযা রাখিলে রোযা যদি নিজের বা শিশুর জীবনের আশঙ্কার কারণ হয়, তবে তাহাদের জন্য রোযা না রাখা দুরুস্ত আছে। তাহারা পরে অন্য সময় ক্বাযা রাখিয়া লইবে । অবশ্য যদি স্বামী মালদার হয় এবং অন্য কোন ধাত্রী রাখিয়া শিশুকে দুধ পান করাইতে পারে, তবে মায়ের জন্য রোযা ছাড়া জায়েয নহে । কিন্তু যদি শিশু এমন হয় তাহার মায়ের দুধ ছাড়া অন্যর দুধ মুখেই লয় না, তবে (শিশুর দুধের জন্য) মায়ের রোযা না রাখা দুরুস্ত আছে ।
মাসআলাঃ
কোন মেয়েলোক ধাত্রীর চাকুরী লইয়াছে । তাহাকে কোন বড় লোকের ছেলেকে দুধ পান করাইতে হয়, অন্যথায় শিশু বাচে না । এই অবস্থায় যদি রমযান মাস আসিয়া পড়ে, তবে তাহার জন্য তখন রোযা না রাখিয়া পড়ে ক্বাযা রাখা দুরুস্ত আছে ।
মাসআলাঃ
মেয়েলোকের যদি রোযার মধ্যে হায়েয বা নেফাস উপস্থিত হয়, তবে তদবস্থায় রোযা রাখা দুরুস্ত নহে, পরে রাখিবে ।
মাসআলাঃ
রাত্রে যদি মেয়েলোকের হায়েয বন্ধ হয়, তবে সকালে রোযা ছাড়িবে না, রোযার পর(?) যদি রাত্রে গোসল নাও করে, তবুও রোযা ছাড়িতে পাড়িবে না । আর যদি ছোব্হে ছাদেক হওয়ার পর রক্ত বন্ধ হয়, তবে রোযার নিয়্যত করা জায়েয হইবে না । অবশ্য দিন ভরিয়া কিছু পানাহার করা দুরুস্ত নাই । সারাদিন রোযাদারের মত থাকিবে ।
মাসআলাঃ
যদি কেহ রমযান শরীফে দিনের বেলায় নূতন মুসলমান হয় বা বালেগ হয়, তবে তাহাদের জন্য অবশিষ্ট দিন কিছু খাওয়া দাওয়া করা দুরুস্ত নহে, কিন্তু যদি কিছু খায়, তবে যে দিনের বেলায় বালেগ হইয়াছে বা নূতন মুসলমান হইয়াছে, তাহার ঐ দিনের ক্বাযা ওয়াজিব নহে ।
মাসআলাঃ
কেহ যদি সফরের কারণে রোযার নিয়্যত না করে, কিন্তু কিছু খাওয়া দাওয়ার পূর্বে দুপুরের এক ঘন্টা পর বাড়ী পৌছিয়া যায়, অথবা কোন স্থানে ১৫ দিন অবস্থানের নিয়্যত করে, তবে তাহার ঐ সময় রোযার নিয়্যত করিতে হইবে ।
[ মাসআলাঃ কেহ রোযার নিয়্যত করার পর যদি সফর শুরু করে, তবে তাহার জন্য ঐ রোযাটি ছাড়িয়া দেওয়া জায়েয নহে । এইরুপে যে ব্যক্তি সকাল বেলায় সফরে যাইবে তাহার জন্য রোযার নিয়্যত না করা জায়েয নহে । এইরূপে মুছাফেরযদি রোযার নিয়্যত করিয়া থাকে, তবে তাহার জন্য ঐ রোযাটি ছাড়া জায়েয নহে । ]
বেহেস্তী জেওর (লেখকঃ মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ))
ফিদিয়া
[(নামায বা) রোযার পরিবর্তে যে ছদ্কা দেওয়া হয়, তাহাকে “ফিদ্য়া” বলে এবং রমযান শরীফের বরকত, রহ্মত ও হুকুম পালনে সক্ষম হওয়ার খুশিতে বান্দা ঈদের দিন নিজের তরফ হইতে এবং নিজের পরিবারবর্গের তরফ হইতে যাহা কিছু ছদ্কা করে, তাহাকে “ফেৎরা” বলে । ফেৎরার কথা পরে বর্ণিত হইবে । এখানে ফিদ্য়া সম্বন্ধে বর্ণিত হইতেছে ।]
মাসাআলাঃ
যে ব্যক্তি এত বৃদ্ধ হইয়া গিয়াছে যে, তাহার আর রোযা রাখার শক্তি নাই, বা এত রোগা ও দুর্বল হইয়াছে যে, তাহার আর ভাল হইবার আশা নাই । এইরূপ লোকের জন্য শরীঅতে এই ব্যবস্থা করা হইয়াছে, যে, সে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে একজন মিসকিনকে দুই ওয়াক্ত পেট ভরিয়া খাওয়াইয়া দিবে, না হয় একটি রোযার পরিবর্তে একজন মিসকিনকে ছদ্কায়ে ফেৎরা পরিমান () গম বা থার মূল্যের চাউল বা পয়সা দান করিবে । ইহাকেই শরীঅতের ভাষায় ফিদ্য়া বলে ।
মাসাআলাঃ
একটি ফিদ্য়া একজন মিস্কীনকে দেওয়াই উত্তম । কিন্তু যদি একটি ফিদ্য়া কয়েকজন মিস্কীনকে কিছু কিছু করিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলেও দুরুস্থ আছে ।
মাসাআলাঃ
বৃদ্ধ যদি পুনরায় রোযা রাখার শক্তি পায়, অথবা চিররোগী নিরাশ ব্যক্তি পুনরায় আরোগ্য লাভ করে এবং রোযা রাখার শক্তি পায় , তবে যে সব রোযার তাহার ফিদ্য়া দিয়াছে সে সব রোযার ক্বাযা করিতে হইবে এবং যাহা ফিদ্য়া দান করিয়াছে তাহার সওয়াব পৃথক পাইবে ।
মাসাআলাঃ
যাহার যিম্মায় ক্বাযা থাকে , তাহার মৃত্যুর পূর্বে অছিয়ত করিয়া যাইতে হইবে যে, আমার এতগুলি রোযা ক্বাযা আছে, তোমারা ইহার ফিদ্য়া আদায় করিয়া দিও । এইরূপ অছিয়ত করিয়া গেলে তাহার স্থাবর–অস্থাবর ষোল আনা সম্পত্তি হইতে –
(১) আগে তাহার কাফনের বন্দোবস্ত করিতে হইবে ।
(২) তারপর তাহার ঋণ পরিশোধ করিতে হইবে ( যদি স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় করিয়াও ঋণ পরিশোধ করার দরকার পড়ে। তাহাও করিতে হইবে । ঋণ পরিশোধের পূর্বে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে ওয়ারিশগনের কোন অধিকার থাকে না ।
(৩) তারপর যাহা কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহার তাহার তিন ভাগের এক ভাগ দ্বারা অছিয়ত পূর্ণ করিতে ওয়ারিশগণ শরীঅতের আইন মতে বাধ্য । যতি অবশিষ্ট সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগ দ্বারা সম্পূর্ণ অছিয়ত পূর্ণ না হয়, তবে যে পরিমান আদায়, সেই পরিমান আদায় করা ওয়াজিব এবং যাহা অবশিষ্ট থাকে , তাহা যদি ওয়ারিশগন নিজ খুশিতে আদায় করিয়া দেয়, তবে তাহাদের পক্ষে ইহা অতি উত্তম হইবে এবং মৃত ব্যক্তির পক্ষে নাজাতের উপায় হইবে ।
মাসাআলাঃ
মৃত ব্যক্তি যদি অছিয়ত না করে এবং যাহারা ওলী – ওয়ারিশ থাকে তাহারা নিজের তরফ হইতে তাহার রযা – নামাযের ফিদ্য়া দেয়। তবুও আশা করা যায় যে, আল্লাহ্ ত’আলা নিজ দয়াগুনে তাহা কবুল করিয়া নিবেন এবং মৃত ব্যক্তির অপরাধ ক্ষমা করিয়া দিবেন । যদি অছিয়ত না করিয়া থাকে , তবে মৃত ব্যক্তির মাল হইতে ফিদ্য়া দেয়া জায়েয নাই । এইরূপে যদি ফিদ্য়া এক তৃতীয়াংশ হইতে বেশী হয়, তবে অছিয়ত করা স্বত্বেও সকল ওয়ারিশের অনুমতি ছাড়া বেশী দেওয়া জায়েয নাই । অবশ্য যদি সকলে খুশী হইয়া অনুমতি দেয় , তবে উভয় অবস্থায় ফিদ্য়া দেওয়া দুরুস্ত আছে । কিন্তু শরীঅতে না-বালেগ ওয়ারিশের অনুমতির কোন মুল্য নাই । বালেগ ওয়ারিশগণ নিজ নিজ অংশ পৃথক করিয়া যদি উহাতে দেয় , তবে দুরুস্ত আছে।
মাসাআলাঃ
যদি কাহারও নাময ক্বাযা হইয়া থাকে এবং অছিয়ত করিয়া মারা যায় যে, আমার নামাযের বদলে ফিদ্য়া দিয়া দিও, তাহারও এই হুকুম।
মাসাআলাঃ
প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাযের ফিদ্য়া একটি রোযার ফিদ্য়ার পরিমান । এই হিসাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরয এবং বেৎর এই ছয় নামাযের ফিদ্য়া ৮০ তোলা সেরের এক ছটাক কম পৌনে এগার সের (দশ সের বার ছটাক) গম দিবে । কিন্তু সতর্কতার জন্য পুরা বার সের দিবে।
মাসাআলাঃ
যদি কাহারও যিম্মায় যাকাত থাকিয়া যায়, ( অর্থাৎ, যাকাত ফরয হইয়াছিল, না দিতেই মৃত্যু হইয়া গিয়াছে ) কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে যদি অছিয়ত করিয়া যায় যে, আমার যিম্মায় এত টাকা যাকাত ফরয হইয়া রহিয়াছে , তোমরা আদায় করিয়া দিও, তবে ওই পরিমান যাকাত আদায় করা ওয়ারিশগণের উপর ওয়াজিব হইবে । যদি অছিয়ত না করিয়া থাকে এবং ওয়ারিশগণ নিজ খুশিতে দেয়, তবে যাকাত আদায় হইবে না , ( তবে দেওয়া ভাল ।) আল্লামা শামী ছেরাজুল ওয়াহ্হাজ হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেন যে, যদি ওয়ারিশগণ অছিয়ত ব্যতীত আদায় করে, তবে আদায় হইয়া যাইবে । ( খোদা তা’লার দরবারে আশা করা যায় যে, মৃত ব্যক্তি তদ্দ্বারাও নাজাত পাইয়া যাইতে পারে ।)
মাসাআলাঃ
যদি ওলী মৃত ব্যক্তির পক্ষে ক্বাযা রযা রাখে বা ক্বাযা নামায পড়ে, তবে দুরুস্ত নহে । অর্থাৎ তাহার যিম্মায় ক্বাযা আদায় হইবে না ।
মাসাআলাঃ
অকারনে রমযানের রোযা না রাখা দুরুস্ত নাই । ইহা অতি বড় গোনাহ্ । এরুপ মনে করিবে না যে, ইহার বদলে রোযা ক্বাযা করিয়া লইবে । কেননা, হাদীসে আছে – রমযানের এক রোযার বদলে যদি পূর্ণ বৎসর একাধারে রোযা রাখে, তবু এতটুকু সওয়াব পাইবে না, যতটুকু রমযানের একটি রোযার সওয়াব পাওয়া যায় ।
মাসাআলাঃ
দুর্ভাগ্যবশতঃ যদি কেহ রোযা না রাখে, তবে অন্যান্য লোকের সম্মুখে পানাহার করিবে না । ইহাও প্রকাশ করিবে না যে, আমি রোযা রাখি নাই । কেননা, গোনাহ্ করিয়া উহাও প্রকাশ করাও গোনাহ্। যদি প্রকাশ্যে বলিয়া বেড়ায়, তবে গোনাহ্ দ্বিগুণ হইবে । একটি রোযা না রাখার এবং অপরটি প্রকাশ করার । বলিয়া থাকে – যখন খোদার কাছে গোপন নাই , তবে মানুষের কাছে গোপন করিয়া কিলাভ ? ইহা ভুল । বরং কোন কারনে রোযা রাখিতে না পারিলে লোকের সামনে খাওয়া উচিত নহে ।
মাসাআলাঃ
ছেলে মেয়েরা যখন ৮/৯ বৎসর বয়সের হইয়া রোযা রাখার মত শক্তিসম্পন্ন হয় , তখনই তাহাদিহকে রোযা রাখার অভ্যাস করান উচিত । যদি নাও রাখিতে পারে , তবুও কিছু অভ্যাস করান উচিত । ছেলে মেয়ে যখন দশ বৎসর হইয়া যায়, তখন শাস্তি দিয়া হইলেও তাহাদের দ্বারা রোযা রাখান, নামায পড়ান উচিত ।
মাসাআলাঃ
না-বালেগ ছেলেমেয়েরা যদি রোযা শুরু করিয়া শক্তিতে না কুলানোর কারনে রোযা ভাঙ্গিয়া ফেলিতে চায়, তবে ভাঙ্গিতে দেওয়া ভাল নয় বটে ; কিন্তু যদি ভাঙ্গিয়া ফেলে তবে রোযা আর দোহ্রাইয়া রাখার দরকার নাই ; কিন্তু যদি নামায শুরু করিয়া নিয়ত ছাড়িয়া দেয়, তবে নামায দোহ্রাইয়া পড়ান উচিত ।
২০শে রমযানের সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্ব হইতে ২৯/৩০ তারিখ অর্থাৎ যে দিন ঈদের চাঁদ দেখা যাইবে সে তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুরুষদের মসজিদে এবং মেয়েদের নিজ গৃহের যেখানে নামায পড়ার স্থান নির্ধারিত আছে তথায় পাবন্দীর সহিত অবস্থান করাকে এ’তেকাফ বলে। ইহার সওয়াব অনেক বেশী। এ’তেকাফ শুরু করিলে পেশাব পায়খানা কিংবা পানাহারের মজবুরী হইলে তথা অন্যত্র যাওয়া দুরুস্ত আছে । আর যদি খানা পানি পৌঁছাইবার লোক থাকে, তবে ইহার জন্য বাহিরেযাইবে না, সেখানেই থাকিবে । বেকার বসিয়া থাকা ভাল না । কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত করিবে , নফল নামায , দসবীহ্ সাধ্যমত পড়িতে থাকিবে এবং ঘুমাইবে । হায়েয বা নেফাস আসিলে এ’তেকাফ ছাড়িয়া দিবে । এই অবস্থায় এ’তেকাফদুরুস্ত নাই । এ’তেকাফে স্বামী স্ত্রী মিলন ( সহবাস) আলিঙ্গনও দুরুস্ত নাই ।
মাসআলাঃ
এ’তেকাফের জন্য তিনটি বিষয় জরুরী ।
(১) যেই মসজিদে নামাযের জমা’আত হয়, (পুরুষের) উহাতে অবস্থান করা।
(২) এ’তেকাফের নিয়তে অবস্থান করা। এরাদা ব্যতীত অবস্থান কে এ’তেকাফ বলে না । যেহেতু নিয়ত ছহীহ্ হওয়ার জন্য নিয়তকারীর মুসল্মান এবং আক্কেল হওয়া শর্ত কাজেই এই উভয়টি নিয়তের শামিল ।
(৩) হায়েয নেফাস ও গোসলের প্রয়োজন হইতে পাক হওয়া।
মাসআলাঃ
এ’তেকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান হইল ( ক’বা শরীফের ) মসজিদে হারাম । তারপর মসজিদে নববী , তারপর মসজিদে বায়তুল মুকাদ্দস । তারপর যে জামে মসজিদে জমা’তের এন্তেযাম আছে । অন্যথায় মহল্লার মসজিদ । তারপর যে মসজিদে বড় জাম’আত হয় ।
মাসআলাঃ
এ’তেকাফ তিন প্রকার । (১) ওয়াজিব, (২) সুন্নতে মুআক্কাদা, (৩) মোস্তাহাব। মান্নতের এ’তেকাফ ওয়াজিব , বিনাশর্তে হউক যেমন কেহ কোন শরত ব্যতীত এ’তেকাফের মান্নত করিলে , কিংবা শর্তের সহিত হউক; যেমন, কেহ শরত করিল যে, যদি আমার অমুক কাজ হইয়া যায়, তবে আমি এ’তেকাগ করিব । রমযানের শেষ দশ দিন এ’তেকাফ করা সুন্নতে মুআক্কাদা । নবী (দঃ) নিয়মিতভাবে প্রত্যেক রমযানের শেষ দশ দিন এ’তেকাফ করিয়াছেন বলিয়া ছহীহ্ হাদীসে উল্লেখ আছে ।কিন্তু এই সুন্নতে মুআক্কাদা কেহ কেহ করিলে সকলেই দায়িত্বমুক্ত হইবে। রমযানের এই শেষ দশ দিন ব্যতীত, প্রথম দশ দিন হউক বা মাঝের দশ দিন হউক বা অন্য কোন মাসে হউক এ’তেকাফ করা মোস্তাহাব।
মাসআলাঃ
ওয়াজিব এ’তেকাফের জন্য রোযা শর্ত । যখনই এ’তেকাফ করিবে , রোযাও রাখিতে হইবে । বরং যদি ইহাও নিয়ত করে যে, রোযা রাখিব না, তবুও রোযা রাখিতে হইবে। এ জন্য যদি কেহ রাত্রের এ’তেকাফ নিয়ত করে, তবে উহা বেহুদা মনে করিতে হইবে । কেননা, রাত্রে রোযা হয় না, অবশ্য যদি রাত দিন উভয়ের নিয়ত করে কিংবা কয়েক দিনের নিয়ত করে , তবে ততসঙ্গে রাত শামিল হইবে এবং রাত্রে এ’তেকাফ করা যরুরী হইবে। আর যদি শুধু একদিনের এ’তেকাফের মান্নত করে, তবে তার সঙ্গে রাত শামিল হইবে না । খাছ করিয়া এ’তেকাফের জন্য রোযা রাখা যরুরী নহে । যে কোন উদ্দেশ্যে রোযা রাখুক এ’তেকাফের জন্য যথেষ্ট । যেমন কোন ব্যক্তি রমযান শরীফের এ’তেকাফের মান্নত করিলে, রমযানের রোযা এ’তেকাফের জন্য যথেষ্ট । অবশ্য এই রোযা ওয়াজিব রোযা হওয়া যরুরী । নফল রোযা উহার জন্য যথেষ্ট নহে । যেমন নফল রোযা রাখার পর এ’তেকাফের মান্নত করিলে ছহীহ্ হইবে না । যদি কেহ পুরা রমযান মাসের এ’তেকাগের মান্নত করে এবং ঘটনাক্রমে রমযানের এ’তেকাফ করিতে না পারে , তবে অন্য যে কোন মাসে এ’তেকাফ করিলে মান্নত পুরা হইবে । কিন্তু একাধারে রোযাসহ এতেকাফ করা যরুরী হইবে।
মাসআলাঃ
সুন্নত এ’তেকাফে তো রোযা হইয়ায় থাকে । কাজেই উহার জন্য রোযার শর্ত করার প্রয়োজন নাই।
মাসআলাঃ
কাহারও মতে মোস্তাহাব এ’তেকাফে রোযা শর্ত । নির্ভরযোগ্য মতে শর্ত নহে ।
মাসআলাঃ
ওয়াজিব এ’তেকাফ কমপক্ষে এক দিন হইতে হইবে । আর বেশী যত দিনের নিয়ত করিবে ( তাহাই হইবে) । আর সুন্নত এ’তেকাফ দশ দিন । কেননা সুন্নত এ’তেকাফ রমযান শরীফের শেষ দশ দিন । মোস্তাহাব এ’তেকাফের জন্য কোন পরিমান নির্ধারিত নাই , এক মিনিট বা উহা হইতেও কম হইতে পারে ।
মাসআলাঃ
এ’তেকাফ অবস্থায় দুই প্রকার কাজ হারাম । অর্থাৎ উহা করিলে ওয়াজিব ও সুন্নত এ’তেকাফ ফাসেদ হইবে এবং ক্বাযা করিতে হইবে । মোস্থাহাব এ’তেকাফ হইলে উহাও শেষ হইয়া যায় । ইহার জন্য কোন সময় নির্ধারিত নাই । কাজেই উহারক্বাযাও নাই ।
প্রথম প্রকারঃ (হারাম কাজ) এ’তেকাফের স্থান হইতে তব্য়ী (স্বাভাবিক) বা শরয়ী প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাওয়া । স্বাভাবিক প্রয়োজন যেমন , পেশাব পায়খানা, জানাবাতের গোসল, খানা আনিবার কোন লোক না থাকিলে খানা খাইতে যাওয়া। শর্য়ী প্রয়োজন যেমন, জুমু’আর নামায ।
মাসআলাঃ
যে যরুরতের জন্য এ’তেকাফের মসজিদ হইতে বাইরে যাইবে ঐ কাজ শেষ হইলে আর তথায় অবস্থান করিবে না । এমন অবস্থানে যরুরত পুরা করিবে যাহা যথাসম্ভব মসজিদের নিকটবর্তী হয়। যেমন, পায়খানার জন্য গেলে যদি নিজের বাড়ী দূরে হয়, তবে নিকটবর্তী কোন বন্ধুর বাড়ী যাইবে । অবশ্য যদি নিজ বাড়ী ব্যতীত অন্যত্র গেলে যরুরত পুরা না হয়, তবে দূরে হইলেও নিজ বাড়ীতে যাওয়া জায়েয আছে। যদি জুমু’আর নামাযের জন্য অন্য কোন মসজিদে যায় এবং নামাযের পর সেইখানে থাকিয়া যায় এবং সেখানেই থাকিয়া যায় এবং সেখানেই এ’তেকাফ পুরা করে, তবুও জায়েয আছে । অবশ্য মকরুহ্ (তান্যিহী) ।
মাসআলাঃ
নিজ এ’তেকাফের মসজিদ হইতে ভুলেও এক মিনিট বা তদপেক্ষা কম সময়ের জন্য (অযথা) বাহিরে থাকিতে পারিবে না ।
মাসআলাঃ
সাধারণতঃ যে সব ওযরের সম্মুখীন হইতে হয় না তজ্জন্য এ’তেকাফের স্থান ছাড়িয়া দেয়া এ’তেকাফের পরিপন্থী । যেমন, কোন (কঠিন) রোগী দেখা, বা কোন ডুবন্ত লোককে বাঁচাইবার চেষ্টা করা, কিংবা আগুন নিবাইতে যাওয়া, কিংবা মসজিদ ভাঙিয়া পড়ার ভয়ে মসজিদ হইতে বাহির হইয়া যাওয়া। যদিও এসব অবস্থায় এ’তেকাফের স্থান হইতে বাহির হইলে গোনাহ্ হইবে না; বরং জান বাঁচানের জন্য যরুরী, কিন্তু এ’তেকাফ থাকিবে না । যদি কোন শর্য়ী কিংবা তব্য়ী যরুরতে বাহির হয় এবং ঐ সময় যরুরত পুরা হইবার আগে বা পরে কোন রোগী দেখে, বা কোন জানাযা নামাযে শরীক হয় , তবে কোন দোষ নাই ।
মাসআলাঃ
জুমু’আর নামাযের জন্য যদি জামে মসজিদে যাইতে হয়, তবে এমন সময় যাইবে, যেন মসজিদে গিয়া তাহিয়্যাতুল মসজিদ ও সুন্নত পরিতে পারে। সময়ের অনুমান নিজেই করিয়া লইবে । এবং ফরযের পর সুন্নত পড়ার জন্য দেরী করা জায়েয আছে । অনুমানের ভুলে সামান্য কিছু আগে গেলে দোষ নাই ।
মাসআলাঃ
মু’তাকেফকে বলপূর্বক কেউ বাহিরে লইয়া গেলে এ’তেকাফ থাকিবে না । যেমন, কোন অপরাধে কাহারও নামে ওয়ারেন্ট বাহির হইল এবং সিপাহী তাহাকে গেপ্তার করিয়া লইয়া গেল, কিংবা কোন মহাজন দেনার দায়ে তাহাকে বাহিরে লইয়া গেল ।
মাসআলাঃ
এইরূপে যদি কোন শর্য়ী বা তব্য়ী যরুরতে বাহিরে যায় এবং পথে কোন মহাজন আটকায়, বা রোগাক্রান্ত হইয়া পড়ে, ফলে এ’তেকাফের স্থানে বিলম্ব হয়, তবুও এ’তেকাফ থাকিবে না।
দ্বিতীয় প্রকারঃ (হারাম কাজ) ঐ সব কাজ যাহা এ’তেকাফে নাজায়েয । যেমন – সহবাস ইত্যাদি করা, ইচ্ছাকৃত হউক বা ভুলে হউক । এ’তেকাফের কথা ভুলিয়া মসজিদে করুক বা বাহিরে করুক, সর্বাবস্থায় এ’তেকাফ বাতিল হইবে । সহবাসের আনুষঙ্গিক সব কাজ যেমন চুম্বন করা, আলিঙ্গন করা, এ’তেকাফ অবস্থায় না জায়েয। কিন্তু ইহাতে বীর্যপাত না হইলে এ’তেকাফ বাতিল হয় না । বীর্যপাত হইলে এ’তেকাফ ফাসেদ হইবে । অবশ্য যদি শুধু কল্পনা বা চিন্তার কারনে বীর্যপাত হয় তবে এ’তেকাফ ফাসেদ হইবে না ।
মাসআলাঃ
এ’তেকাফ অবস্থায় বিনা যরুরতে দুনিয়াদারীর কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরুহ্ তাহ্রীমী । যেমন, বিনা যরুরতে কেনাবেচা, বা ব্যবসা সংক্রান্ত কোন কাজ করা । অবশ্য যে কাজ নেহায়েত যরূরী ( যেমন ঘরে খোরাকী নাই, সে ব্যাতীত বিশ্বাসী কোন লোকও নাই, এওমতাবস্থায় কেনাবেচা জায়েয আছে, কিন্তু মালপত্র মসজিদে আনা কোন অবস্থায়ই জায়েয নাই-যদি উহা মসজিদে আনিলে মসজিদ খারাপ হওয়ার কিংবা জায়গা আবদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা হয় । অন্যথায় কেহ কেহ জায়েয বলিয়াছেন।)
মাসআলাঃ
এ’তেকাফ অবস্থায় (সওয়াব মনে করিয়া) একেবারে চুপ করিয়া বসিয়া থাকা মকরুহ্ তাহ্রীমী । অবশ্য খারাপ কথা, মিথ্যা কথা বলিবে না বা গীবত করিবে না; বরং কোরআন মাজীদ তেলাওয়াত। দ্বীনই এল্ম শিক্ষা করা বা শিক্ষা দেওয়া, কিংবা অন্য কোন এবাদতে কাটাইবে। সার কথা, চুপ করিয়া বসিয়া থাকা কোন এবাদত নহে ।
বেহেস্তী জেওর (লেখকঃ মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ))
মাসআলাঃ
ঈদের দিন ছোব্হে ছাদেকের সময় যে ব্যক্তি হাওয়ায়েজে আছলিয়া অর্থাৎ, জীবিকা নিরবাহের অত্যাবশ্যকীয় উপকরন (যথা পরিধানের বস্ত্র, শয়নের গৃহ এবং আহারের খাদ্য-দ্রব্য ) ব্যাতীত ৭।। তোলা সোনা, অথবা ৫২।। ( সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা, অথবা এই মূল্যের অন্য কোন মালের মালিক থাকিবে , তাহার উপর ফেৎরা দেওয়া ওয়াজিব হইবে । সে মাল তেজারত বা ব্যবসায়ের জন্য হউক, বা সে মালের বৎসর অতিবাহিত হউক বা না হউক।ফেৎরাকে “ছদক্কায়ে ফেৎর” বলে । জীবিকা নির্বাহের আবস্যকিয় উপকরণসমূহকে “হাওয়াযেজে আছলিয়া” বলে। ২০০ দেরহাম পরিমান সম্পত্তির অধিক্কারীকে মালেকে নেছাব বলে। আমাদের দেশি হিসাবে ২০০ দেরহামে ৫২।। তোলা রুপা হয়।)
মাসআলাঃ
কাহারও বসবাসের অনেক বড় ঘর আছে , বিক্রয় করিলে হাজার পাঁচশ টাকা দাম হইবে । পরিধানে দামী দামী কাপড় আছে , কিন্তু ইহা জরিদার নহে, ২/৪ জন খেদমতগারও আছে, হাজার পাঁচ শত টাকার প্রয়োজনীয় মাল আসবাব আছে; কিন্তুঅলঙ্কার নহে । এই সমস্তই কাজে ব্যবহৃত হয়, কিংবা কিছু মালপত্র প্রয়োজন অপেক্ষা বেশী আছে এবং জরী, অলঙ্কারও আছে, কিন্তু যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পরিমাণ নহে, এমন লোকের উপর ছদ্কায়ে ফেৎর ওয়াজিব নহে ।
মাসআলাঃ
যদি কেহ মাত্র দুইখানা বাড়ীর মালিক হয়, এক বাড়ীতে নিজে বিবি বাচ্চা নিয়ে থাকে, অন্য বাড়ী খানা খালি পড়িয়া থাকে, অথবা ভাড়া দেওয়া হয়, তবে দ্বিতীয় বাড়ীখানাকে বাড়ীখানাকে হাওয়াযেজে আছলিয়ার মধ্য গন্য করা যাইবে না, অতিরিক্ত বলা হইবে । কাজেই দেখিতে হইবে, যদি বাড়ীখানার মুল্য ৫২।।০ তোলা রুপার মূল্যের সমান বা তার চেয়ে বেশী হয়, তবে তাহার উপর ছত্কায়ে ফেৎর ওয়াজিব হইবে, এমন লোককে যাকাত দেয়া জায়েয নাই । কিন্তু যদি এই বাড়ীখানার উপরই তাহার জীবিকা নির্বাহ নির্ভর করে, তবে বাড়ীখানাকে হাওয়ায়েজে আছলিয়ার মধ্যে গন্য করিতে হইবে এবং তাহার উপর ছদ্কায়ে ফেৎর ছদ্কায়ে ফেৎর ওয়াজিব হইবে না । এমন ব্যক্তি ছদ্কায়ে ফেৎর লইতে পারে এবং তাহাকে দেওয়াও জায়েয আছে। সারকথা- যে ব্যক্তি যাকাত, ছদ্ক্কার পয়সা লইতে পারে, তাহার উপর ছদ্কায়ে ফেৎর ওয়াজিব নহে; যাহার ছদ্কায়ে যাকাত লওয়া দুরুস্ত নাই ইয়াহার উপর ওয়াজিব । (এইরূপ কেহ যদি ৭ বিঘা জমির মালিকহয় এবং ৬ বিঘা জমির ফসলে তাহার জীবিকা নির্বাহ হইয়া যায়, আর এক বিঘা জমি অতরিক্ত, ইহার মুল্য ৫২।।০ তোলা রুপার মূল্যের সমান বা তার বেশী হয়, তাহার উপর ছদকায়ে ফেৎর ওয়াজিব হইবে ।)
( মাসআলাঃ মেয়েলোকের জেওর হাওয়ায়েজে আছলিয়ার মধ্য গন্য নহে । কাজেই যে মেয়েলোকের নিকট ৫২।। তলা রুপা বা সমমুল্যের জেওর থাকিবে তাহার উপর ফেৎরা ওয়াজিব হইবে ।(‘সুক্ষ হিসাবে যাহাদের ওপর ফেৎরা ওয়াজিব [বাধ্যতামুলক] হয় না অথচ দেওয়ার সঙ্গতি আছে, তাহারা যদি নিজ খুশিতে ছদ্কা দান করে , তবে তাহাও মুস্তাহাব হইবে এবং তাহারা অনেক বেশী সয়াওব পাইবে। কারন, হাদিস শরীফে আছে, গরিব হওয়া স্বত্বেও কষ্ট করিয়া যে আল্লাহর রাস্তায় ছদ্ক্কা দেয় তাহার দানকে আল্লাহ্ তা’আলা অনেক বেশী পছন্দ করেন’।))
মাসআলাঃ
যদি কেহ করযদার (ঋণগ্রস্ত) থাকে , তবে ঋণ বাদে যদি মালেকে নেছাব হয়, তবে ফেৎরা ওয়াজিব হইবে, নতুবা নয় ।
মাসআলাঃ
ঈদের দিন যে সময় ছোব্হে ছাদেক হয়, সেই সময় ছদ্ক্কায়ে ফেৎর ওয়াজিব হয়। কাজেই কেউ যদি ছোব্হে ছাদেকের আগে মারা যায়, তবে তাহার উপর ফেৎর ওয়াজিব হইবে না, তাহার সম্পত্তি হইতে দিতে হইবে না এবং মালেকে নেছাবের যেসন্তান ছোব্হে ছাদেকের পূর্বে জন্মিবে তাহার ফেৎরা দিতে হইবে। যে ছোব্হে ছাদেকের পরে জন্মিবে তাহার দিতে হইবে না। (এইরূপে কেহ যদি ছোব্হে ছাদেকের পর নও মুসলমান হয়, তবে তাহার উপরও ফেৎরা ওয়াজিব হইবে না।)
মাসআলাঃ
ঈদের নামাযের পূর্বেই ছদ্ক্কায়ে ফেৎর দিয়া পরিষ্কার হওয়া মুস্তাহাব। যদি একান্ত আগে দিতে না পারে , তবে পরেই দিবে । পরে দিলেও আদায় হইবে ।
মাসআলাঃ
কেহ যদি ঈদের দিনের পূর্বেই রমযানের মধ্যে ফেৎরা দিয়া দেয় তাহাও দুরুস্ত আছে, ঈদের দিন পুনরায় দিতে হইবে না। যদি কেহ ঈদের দিন ফেৎরা না দেয়, তবে তাহার ফেৎরা মাফ হইয়া যাইবে না, অন্য সময় দিতে হইবে ।
( মাসআলাঃ মালেকে নেছাব পুরুষের একটি সাবালগ সন্তান যদি পাগল হয়, তবে তাহার পক্ষ হইতে ফেৎরা দেওয়া পিতার উপর ওয়াজিব।)
( মাসআলাঃ এতিম সন্তান যদি মালেকে নেছাব হয়, তবে তাদেরও ফেৎরা দিতে হইবে ।)
মাসআলাঃ
মেয়েলোকের শুধু নিজের ফেৎরা দেওয়া ওয়াজিব । স্বামী, সন্তান, মা, বাপ বা অন্য কাহারও পক্ষ হইতে ওয়াজিব নহে।( কিন্তু পুরুষের নিজেরও দিতে হইবে এবং নিজের ছেলেমেয়েদের পক্ষ হইতেও দিতে হইবে। সন্তান না-বালেগ হইলে তাহাদের ফেৎরা দেওয়া পিতার উপর ওয়াজিব। আর বালেগ হইলে এবং এক পরিবারভুক্ত থাকিলে তাহাদের ফেৎরা, স্ত্রীর ফেৎরা এবং মা বাপ থাকিলে তাহাঁদের ফেৎরা দেওয়া মুস্তাহাব। )
মাসআলাঃ
না-বালেগ সন্তানের নিজের মাল থাকিলে যে প্রকারেই মালিক হউক না কেন , ওয়ারিশ সুত্রে বা অন্য প্রকারে হউক, তাহাদের মাল হইতে দিতে হইবে। ( এবং মাল না থাকিলে পিতাকে নিজের মাল হইতে দিতে হইবে।) যদি ঐ শিশু ঈদের দিনছোব্হে ছাদেক হওয়ার পর পয়দা হয়, তবে তাহার পক্ষ হইতে ফেৎরা দ্দেওয়া ওয়াজিব হইবে না।
মাসআলাঃ
(ফেৎরার সঙ্গে রোযার কোন সংশ্রব নাই । এই দুইটি পৃথক পৃথক ইবাদত। অবশ্য এই ইবাদতের তাকীদ হয় । অতএব, ) যাহারা কোন কারনে রোযা না রাখে, ফেৎরা তাহাদের উপরও ওয়াজিব। আর যাহারা রাখে তাহাদের ওপরও ওয়াজিব। উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই ।
মাসআলাঃ
ফেৎরা যদি গম বা গমের আটা বা গমের ছাতু দ্বারা আদায় করিতে চায়, তবে আধা ছা’ অর্থাৎ ৮০ তোলার সেরে এক সের সাড়ে বার ছটাক দিতে হইবে । কিন্তু পূর্ণ দুই সের দিয়া দেওয়াই উত্তম । কেননা, বেশী দিলে কোন ক্ষতি নাই; বরংবেশী সওয়াব পাওয়া যাইবে । পক্ষান্তরে কম হইলে ফেৎরা আদায় হইবে না । আর যব বা যবের ছাতু দ্বারা ফেৎরা আদায় করিতে চাহিলে পূর্ণ এক ছা’ অর্থাৎ, তিন সের নয় ছটাক দিতে হইবে । পূর্ণ চারি সের দেওয়াই উত্তম।
মাসআলাঃ
যদি গম এবং যব ব্যতীত অন্য কোন শস্য যেমন- ধান, চাউল, বুট, কলাই ইত্যাদি দ্বারা ফেৎরা আদায় করিতে চায়, তবে বাজার দরে উপরোক্ত পরিমাণ গম বা যবের যে মুল্য হয়, সেই মূল্যের চাউল, ধান, বুট ইত্যাদি দিলে আদায় হইয়া যাইবে । ( মুল্য হিসাব না করিয়া আন্দাজি দুই সের চাউল বা ধান দিলে যদি চাউলের মুল্য কম হয়, তবে ওয়াজিব আদায় হইবে না । ইহাই আমাদের হানাফী মযহাবের ফতওয়া। শাফেয়ী মযহাবে মুল্য না দিয়া চাউল দিলেও ওয়াজিব আদায় হইবে বটে; কিন্তু পূর্ণ চারি সের চাউল দিতে হইবে ।)
মাসআলাঃ
যদি গম বা যব না দিয়া , উপরোক্ত পরিমাণ গম বা যবের মুল্য নগদ পয়সা দিয়া দেয় , তবে তাহা সবচেয়ে উত্তম।
মাসআলাঃ
একজনের ফেৎরা একজনকে দেওয়া বা একজনের ফেৎরা কয়েকজনকে ভাগ করিয়া দেওয়া উভয়ই জায়েয আছে ।
মাসআলাঃ
যদি কয়েকজনের ফেৎরা একজনকে দেওয়া হয়, তাহাও দুরুস্ত আছে, ( কিন্তু তদ্দারা মিসকীন যেন মালেকে নেছাব না হইয়া যায়।)
মাসআলাঃ
যাহার জন্য যাকাত খাওয়া হালাল, তাহার জন্য ফেৎরা খাওয়াও হালাল।
মাসআলাঃ
ফেৎরা কাহাকে দিতে হইবে ? উত্তরঃ আত্মীয়, স্বজন, প্রতিবেশী এবং পার্শ্ববর্তী লোকদের মধ্যে যাহারা গরীব দুঃখি আছে তাহাদিগকে দিতে হইবে । সাইয়্যেদকে, মালদারকে , মালদারের না-বালেগ সন্তানকে এবং নিজের মা, বাপ, দাদা, নানা, নানী বা নিজের ছেলে, মেয়ে, নাতি,নাতনী ইত্যাদিকে ফেৎরা, যাকাত দেওয়া জায়েয নহে। অবশ্য সাইয়্যেদ বা মা, বাপ, দাদা, নানা, নানী বা ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনী যদি গরীব হয়, তবে তাহাদিগকে হাদিয়া-তোহ্ফা স্বরূপ পৃথকভাবে দান করিয়া সাহায্য করিতে হইবে।
মাসআলাঃ
মসজিদের ইমাম, মোয়ায্যিন বা তারাবীহ্র ইমাম গরীব হইলে তাহাদিগকেও ফেৎরা দেওয়া দুরুস্ত আছে, কিন্তু নেছাব পরিমাণ দেওয়া যাইবে না এবং বেতন স্বরূপও দেওয়া যাইবে না। বেতন স্বরূপ দিলে ফেৎরা আদায় হইবে না ।
বেহেস্তী জেওর (লেখকঃ মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ))