শিক্ষাজীবনঃ ওলীয়ে কামেল বর্ষিয়ান বুযুর্গ আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী রাহ. জন্মের ছয় মাসের মাথায় মুহতারামা মাতাকে হারানোর পর পিতৃস্নেহ ও আপন মামা জনাব মন্তাজ আলী সাহেবের তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠেন। এভাবে তার জীবনের সাত-আটটি বছর কেটে যায়। মা ছাড়া সন্তানের বেড়ে উঠা ও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কতটুকু কষ্টসাধ্য তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। তারপরও আল্লাহর এই ওলী প্রচুর ধৈর্য, একাগ্রতা ও সুনামের সাথে লেখাপড়া চালিয়ে যান। তিনি যখন সিলেট সরকারি মাদরাসায় কামিল পড়ছিলেন তখন তার পিতৃছায়া মাথার উপর থেকে উঠে যায়।লেখাপড়ায় মনযোগ থাকার কারনে মা-বাবা হারানোর বেদনা তাকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। কেননা আল্লাহপাকের ইচ্ছা ছিলো তাকে অসাধারণ মানব, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইসলামি ব্যক্তিত্ব, প্রাজ্ঞ আলেমে দ্বীন বানাবেন। আর বাস্তবে এ মহান ক্ষণজন্মা সাধক পুরুষ বয়সের ভারে ন্যূব্জ হলেও মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর মিশন চালিয়ে যান।
সব মহলে ইমাম সাহেব হুজুর খ্যাত আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী রাহ. বাল্যকাল থেকেই সুন্নাতে রাসূলের পুরোপুরি পাবন্দ ছিলেন। আযান শুনলেই জামাতের জন্য মসজিদে ছুটে যেতেন। প্রখর মেধার অধিকারী ইমাম সাহেব হুযুর আকবর আলী রাহ. শৈশবকালে আসামভিত্তিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১ম স্থান লাভ করে তার অসাধারণ মেধার জানান দিয়েছিলেন। তৎকালীন তার উস্তায ও সহপাঠীরা ধারণা করেছিলেন একসময় এ আকবর আলী দ্যুতির বিচ্ছুরণ ঘটাবে। সময়ের ব্যবধানে তিনি তা প্রমাণ করতে সক্ষম হন। অতঃপর মাওলানা আকবর আলী রাহ. ১৯৩২ ঈসায়িতে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে টানা সাত বছর কৃতিত্বের সাথে লেখাপড়া চালিয়ে যান। নিজ চারিত্রিক গুণে অল্প দিনেই সবার নজর কাড়েন। আলিয়া মাদরাসায় পড়াকালীন প্রথম ছয় মাস দক্ষিণ সুরমার তুতি মিয়ার বাড়িতে লজিংয়ে ছিলেন। এরপর নগরীর কুয়ারপারে সাচনার হাফিয আব্দুন নূর সাহেবের সাথে মেসে থেকে আড়াই বছর কাটিয়েছেন। মেসের খরচ বাবত প্রতি মাসে দেড় টাকা করে আদায় করতেন। ইমাম সাহেব হুযুর সরকারি আলিয়া মাদরাসায় ফাযিল পাশ করার পর তার খাস উস্তায আল্লামা সহুল উসমানী রাহ.’র সার্বিক সহযোগিতা ও পরামর্শে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে ভারতের মুরাদাবাদ শহরে একমাস অবস্থান করেন। সেখান থেকে রায়পুর শহরে গিয়ে এক মাদরাসায় ছয় মাস লেখাপড়া করেন। সেখানে কোনোঅবস্থাতেই তার মন বসছিলো না। কেননা আল্লাহর ইচ্ছা ছিলো তাকে বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি বিদ্যানিকেতন দারুল উলূম দেওবন্দে নিয়ে ইলমে যাহেরী ও বাতেনী দ্বারা ধন্য করা। রায়পুরে মন না বসায় ১৯৩৯ ঈসায়িতে মাদরে ইলমী দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হন। হযরত ইমাম সাহেব হুযুর রাহ. দারুল উলূম দেওবন্দে একবছর তাফসির বিভাগে ও একবছর হাদিস বিভাগে অত্যন্ত পরিশ্রম ও সুনামের সাথে অধ্যয়নের পর দেশে ফিরে আসেন।
হিফযুল কুরআন ও কেরাত অধ্যয়ন ঃ ইলমে ওহীর শিক্ষার্থীকে আল্লাহপাক সর্বদা সাহায্য করেন। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবুদ্দারদা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারিম সা. ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ইলম অর্জনের জন্য বের হয়, আল্লাহ তাআলা তাকে বেহেশতের পথ সুগম করে দেন এবং ফেরেশতারা তার জন্য নিজ ডানা বিছিয়ে দেন।’ (মিশকাত) আল্লাহ প্রদত্ত সাহায্য যেন সর্বদা ইমাম সাহেব হুযুর রাহ.’র সাথে থাকত। এ জন্য কুরআন মাজিদের হাফিয হওয়ার জন্য তাকে আলাদা কোনো সময় ব্যয় করতে হয় নি; বরং ছাত্রাবস্থায় লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিদিন কুরআনের কিছু কিছু অংশ মুখস্ত করে হাফিযমু’তাসিম বিল্লাহকে শুনাতেন। এভাবে এক পর্যায়ে তিনি কুরআনের হাফিয হয়ে যান। ইমাম সাহেব হুযুর রাহ. নামায ও তিলাওয়াতে কুরআনের পাবন্দী করতেন। ফরয নামাযের জামাত সহ সকল নফল নামায মিলিয়ে কুরআন শরীফ প্রতিদিন প্রায় এক মনজিল তিলাওয়াত করতেন। যে কারনে প্রতি সপ্তাহে কুরআনের এক খতম হয়ে যেত। তিনি সারা বছরই কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আর রমযানে তো প্রায় ৪৫ বছর দরগাহ মসজিদে একাই খতমে তারাবিহে কুরআন শুনিয়েছেন। বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পর শেষ প্রায় দশ বছর মুসল্লিদের সুবিধার্থে মসজিদে এশার ফরয নামাযের জামাত পড়ানোর পর বাসায় চলে যেতেন এবং সেখানে দুই-তিনশ লোককে নিয়ে সালাতুত তারাবিহে কুরআন শরীফ শুনাতেন।
কর্মজীবনঃ মাওলানা আকবর আলী রাহ.’র কর্মজীবন শুরু এবং শেষ হয় ইমামতির মাধ্যমে। তিনি ঐতিহাসিক দেওবন্দ মাদরাসার ছাত্তা মসজিদে তারাবিহের নামায পড়ানো সহ সিলেট দরগাহে হযরত শাহজালাল রাহ. মসজিদে সুদীর্ঘ ৫৮ বছর ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন।
কর্মজীবনের শুরুর দিকে তিনি বিয়ানীবাজার উপজেলার আছিরখাল মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৪৭ ঈসায়িতে পাকিস্তান বিভক্তির ৬ মাস পূর্বে সিলেট শহরের নয়াসড়কে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে দরগাহ মসজিদের ইমাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই সময় আল্লামা সহুল উসমানী রাহ.’র প্রস্তাবে আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী রাহ.’র উপর দরগাহ মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব অর্পন করা হয়। ১৯৪৭ ঈসায়ি হতে ইন্তেকাল পূর্ব পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৫৮ বছর অত্যন্ত সুনাম, দক্ষতা ও সম্মানের সাথে দরগাহ মসজিদের খতিব ও ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। দরগাহ শরীফের দক্ষিণে মুফতি বাড়িতে লজিংয়ে থেকে ছাত্রদের কুরআন ও মাসআলা-মাসায়িলের পাঠদান শুরু করেন। এখান থেকেই বর্তমান জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহে হযরত শাহজালাল রাহ.’ সিলেটমাদরাসার সূচনা। শুরুতে মাদরাসার নাম ছিলো তালিমুল কুরআন।
আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী রাহ. ইমামতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নামাজের পর মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে কুরআনের দরস দিতেন। এ দরসে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মুসল্লিদের অন্তরে দ্বীন শেখার ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়। মহল্লার ছোট-বড় অনেকে ইলমে দ্বীন শিক্ষার জন্য মসজিদে এসে ভিড় জমান। স্বীয় চিন্তাধারা ও প্রাণপ্রিয় উস্তাদের পরামর্শ ও দোয়ায় সমৃদ্ধ হয়ে ইমাম সাহেব হুজুর ২৭ জুমাদাল উলা ১৩৮১ হিজরি মোতাবেক ৭ই নভেম্বর ১৯৬১ ঈসায়ি সনে হযরত শাহজালাল রাহ.’র মসজিদ ও মাজারের দক্ষিণ পার্শ্বে একটি মাদরাসা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এ মাদরাসার নাম ছিল মাদরাসায়ে তালিমুল কুরআন দরগাহে হযরত শাহজালাল রাহ.সিলেট। ইমাম সাহেব হুজুর রাহ.’র রাতজাগা রোনাজারি, প্রচেষ্টা, সহযোগীদের একনিষ্ট পরিশ্রম ও এখলাসের বরকতে নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তা’লিমুল কুরআন উত্তরোত্তর উন্নতির শীর্ষপানে পৌঁছতে শুরু করে। বছর কয়েকের মধ্যেই এ প্রতিষ্ঠান প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর অতিক্রম করে ১৯৭৪ ইংরেজী সনে দরসে নেজামীর সর্বোচ্চ জামাত তাকমীল ফিল হাদিস স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। তিনি একদিকে ইমামতির দায়িত্ব যেমন সুচারুরূপে পালন করতেন। অন্যদিকে মাদরাসা পরিচালনার ক্ষেত্রেও ছিলেন খুবই দক্ষ ও অভিজ্ঞ। তিনি তাঁর রুমে অবস্থান করলেও ছাত্র-উস্তাদ, কর্মচারি সবাই সচেতন থাকতেন। এক দিকে যেমন সবাইকে স্নেহ-মমতা করতেন। অন্যদিকে নিচের বা উপরের শিক্ষক কর্মচারী যা-ই হোন না কেন, কোনো ধরণের ছাড় দিতেন না। তাঁর ইলমী ও আমলী মাকাম ছিল খুবই উঁচু। এ জন্য বড় বড় আলেম উলামাদের কাছেও তাঁর অত্যন্ত কদর ছিল। আরিফ বিল্লাহ আকবর আলী রাহ.মাদরাসার হাল প্রথম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত খুবই শক্তহাতে ধরেছিলেন। কোন দিকেই তাঁর কোন গাফলতি বা সামান্যতম অবহেলা ছিলনা।
ইন্তেকালঃ আল্লাহর এ নেক বান্দা অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র হাজার হাজার আলেমের প্রিয় উস্তাদ ৮ নভেম্বর ২০০৫ ঈসায়ি মঙ্গলবার রাত ১১ মিনিটের সময় ঢাকাস্থ পিজি হাসপাতালে বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মহান আল্লাহপাকের অহ্বানে সাড়া দেন।