আমরা মিলাদুন্নবীর মূল আলোচনা লিখার আগে মিলাদুন্নবীর শাব্দিক আলোচনা করবো । মিলাদ + নবী দুটি শব্দ একত্রে মিলে মিলাদুন্নবী বলা হয় । সমাজে ‘মিলাদ’ এর তিনটি শব্দ প্রচলিত আছে মিলাদ, মাওলিদ ও মাওলূদ । ‘মিলাদ’ অর্থ জন্মের সময়, ‘মাওলিদ’ অর্থ জন্মের স্থান, ‘মাওলূদ’ অর্থ সদ্যপ্রসূত সন্তান । আর ‘নবী’ শব্দ দ্বারা বুঝায় হুজুর (সঃ) কে । শাব্দিক অর্থে ‘মিলাদুন নবী’ বলতে হুযুর (সঃ) এর বিলাদত শরীফ বা জন্মবৃত্তান্তকে বুঝানো হয়ে থাকে । মিলাদ তথা স্থান বা কালবাচক বিশেষ্য । যেমন মীছাক, মীকাত, মীয়’আদ ইত্যাদি শব্দগুলো একইভাবে ইসমে যরফ তথা স্থান বা কালবাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় । বিভিন্ন অভিধানে মীলাদ শব্দটির অর্থ কিভাবে লিখা হয়েছে তা নিম্নে উল্লেখ করছি-
আল্লামা ইবনে মানযুর আল আফরীকি (মৃতঃ ৭১১ হিঃ) লিখেছেনঃ
অর্থাৎ লোকটির মিলাদঃ যে সময় সে জন্মগ্রহন করেছে সে সময়ের নাম ।
গিয়াছুল লুগাতে লিখিত আছে
মিলাদ শব্দটির মীম অক্ষর যের বিশিষ্ট যার অর্থঃ জন্মকাল ।
মুন্তাখাব অভিধানে লিখিত আছেঃ
নবজাতক শিশু, জন্মকালীন ঘটনা, জন্মের সময়কাল ।
ইংরেজী ও আরবী ডিকসনারীতে আছে
‘মিলাদ’ অর্থঃ birth (process of being born, coming into the world) অর্থাৎ পৃথিবীতে আগমনের সময় ।
ফায়েদাঃ
আমরা দেখলাম মিলাদুন্নবী অর্থঃ হুজুর (সঃ) এর জন্মের সময় বা জন্মকালীন ঘটনা । আমরা বিভিন্ন অভিধান খুঁজে দেখলাম যে, মিলাদ শব্দটি কে কোন অভিধানবেত্তা ইসমে আ’লাহু তথা যন্ত্রবাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহার করেন নাই । যারা এমনটি বলেন, মূলতঃ তা নবীর সাথে বেয়াদবী বৈ কিছুই নয় ।
১) আল্লামা মোল্লা আলী আল ক্বারী (রহঃ) তার বিখ্যাত কিতাব “আল মাওরিদুর রাবী” তে বলেন
মিলাদ বলতে নবীর জন্মবৃত্তান্ত তার মুজিযাসমূহ ও সিরাতের আলোচনার জন্য একত্রিত হওয়া, আর যথাযথ প্রশন্সাসহ তার প্রতি দরুদ ও সালাম পড়া । জীবিত ও মৃতের জন্য দোয়া, অতঃপর তাবাররুক (খাবার) আয়োজন করে মানুষের অন্তরে নবীর জন্মে আনন্দিত হওয়া ।
২) মিলাদুন্নবী অর্থ হচ্ছেঃ
তার জীবনকালের ঘটনাবলী, সানা সিফাত, মাতৃগর্ভে অবস্থানকালীন অলৌকিক ঘটনাবলী, তার বংশ পরিচয়য়, হালিমা (রাঃ) এর ঘরে প্রতিপালিত হওয়ার ঘটনা আলোচনার নামই মিলাদ ।
৩) প্রচলিত মিলাদ বলতেঃ
কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরীফ পাঠ, তাওয়াল্লুদ বা জন্মকালীন ঘটনা মজলিস করে আলোচনা করা, দাঁড়িয়ে সালাম, কাসিদা বা প্রশংসামূলক কবিতা, দোয়া মুনাজাত ও তাবাররুক বিতরণ ইত্যাদির সামষ্টিক রূপ ।
আমরা মিলাদের পরিচয়ে যা বুঝতে পারলাম এখন দেখব তা কতটুকু শরীয়াহ সমর্থিত তা পর্যালোচনা করার প্রয়াস পাব ।
মিলাদ শব্দটির মূল অক্ষর হচ্ছে و + ل + د) ولد) । আমরা দেখব কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফে মূল অক্ষরে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে কিনা ।
وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدتُّ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا
আর শান্তি বর্ষিত হোক আমার উপরে যে দিন আমার জন্ম হয়েছিল, আর যে দিন আমি মারা যাব । আর যে দিন আমাকে পুররুত্থিত করা হবে জীবিত অবস্থায় ।
ফায়েদাঃ
আমরা দেখলাম কুরআন মাজীদে মূল অক্ষরে وَلَدَتُ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে; যার অর্থ আমি জন্ম গ্রহণ করেছি । এ শব্দটি প্রমাণ করে মিলাদের মূল অস্তিত্ব কুরআন মাজীদে বিদ্যমান ।
আমরা এখন দেখব কুরআনের পাশাপাশি হাদীস শরীফে এ শব্দটির ব্যবহার আছে কিনা । আমরা দেখি যে, জামে তিরমিযী শরীফে ميلاد ‘মিলাদ’ (জন্মের সময়) শব্দটি রাসূল (সঃ) নিজেই ব্যবহার করেছেন । যেমনঃ
১) রাসূল (সঃ) এর জন্ম সাল সম্পর্কে হযরত কায়স ইবনে মাখরামা (রাঃ) বলেনঃ
অর্থাৎ আমি ও রাসূলুল্লাহ (সঃ) দুজনেই “হাতীর বছরে” জন্মগ্রহণ করেছি । হযরত উসমান বিন আফফান (রাঃ) কুবাস বিন আশিয়ামকে প্রশ্ন করেনঃ আপনি বড় না রাসূল (সঃ) বড় ? তিনি উত্তরে বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (সঃ) আমার থেকে বড়, আর আমি তার পূর্ব জন্মগ্রহণ করেছি ।
২) হাদীস শরীফে আমরা আরও দেখতে পাই মহানবী (সঃ) বলেনঃ
ما من مولود الا يولد على الفطرة অর্থাৎ প্রত্যেক শিশু তার স্বভাবের উপর জন্মলাভ করে ।
আমরা দেখলাম হাদীস শরীফে “মাওলুদ” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ।
আমরা এখন দেখব কুরআন ও হাদীস শরীফের পাশাপাশি হাদিসের ইমামগণ স্ব স্ব কিতাবে মিলাদ শব্দটি ব্যবহার করেছেন কিনা । আমরা দেখি যে, আবূ ঈসা মুহাম্মদ ইবনু ঈসা তিরমিজী (রহঃ) (হিঃ ২৭৯) তার বিখ্যাত কিতাব জামে তিরমিযীর ২য় খণ্ডের ২০৩ পৃষ্ঠায় একটি শিরোনামে লিখেন-
باب ما جاء فى ميلاد النبى صلى الله عليه وسلم অর্থাৎ যা রাসূল (সঃ) এর জন্ম সম্পর্কে এসেছে । এখানে তিনি ‘মিলাদ’ শব্দটি রাসূল (সঃ) এর জন্মবৃত্তান্ত বুঝাতে ব্যবহার করেছেন ।
অনুরূপভাবে ইমাম বায়হাকী (রহঃ) (ওফাত ৪৫৮ হিঃ) তার বিখ্যাত সিরাত সংক্রান্ত হাদিসের কিতাব ‘দালায়েলুন নবুওয়ত” নামক কিতাবের ১ম খণ্ডের ৪৯ পৃষ্ঠায় ابواب ميلاد رسول الله শীর্ষক একটি অধ্যায় এনেছেন । যেখানে তিনি রাসূল (সঃ) এর জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করেছেন ।
কোরআনের আলোকে মিলাদ শরীফঃ ১ নং আয়াতঃ
এবং স্মরণ করুন! যখন আল্লাহ নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, ‘আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত প্রদান করবো, অতঃপর তাশরীফ আনবেন তোমাদের নিকট রসূল, যিনি তোমাদের কিতাবগুলোর সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরা নিশ্চয় নিশ্চয় তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং নিশ্চয় নিশ্চয় তাঁকে সাহায্য করবে। এরশাদ করলেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করলে এবং এ সম্পর্কে আমার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করলে?’ সবাই আরয করলো, ‘আমরা স্বীকার করলাম।’ এরশাদ করলেন, ‘তবে (তোমরা) একে অপরের উপর সাক্ষী হয়ে যাও এবং আমি নিজেই তোমাদের সাথে সাক্ষীদের মধ্যে রইলাম।’ সুতরাং যে কেউ এর পর ফিরে যাবে তবে সেসব লোক ফাসিক
— সূরা আল ইমরান আয়াত ৮১, ৮২
ফায়েদাঃ
উপরোক্ত আয়াতে বুঝা যায়, আল্লাহ্ তায়ালা রুহের জগতে মুহাম্মদ (সঃ) এর জীবনী আলোচনা ও তাঁকে মানার ব্যাপারে নবী-রাসূলগণের নিকট থেকে অঙ্গিকার গ্রহণ করেছিলেন । তাই রাসূল (সঃ) এর জীবনী দলবদ্ধভবে আলোচনা সুনাতে ইলাহীরই নামান্তর । এছাড়াও এ আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে বিভিন্ন মুফাসসিরগণের অভিমত নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ
তাফসীরে ইবনে কাসীরে বলা হয়েছে- এ আয়াতে নবীদের থেকে এ ইঙ্গিত নেয়া হয়েছে যে, রাসূল (সঃ) যখন আসবেন তখন তার প্রতি ঈমান আনবেন এবং সাহায্য করবেন ।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, আয়াতে রাসূ দ্বারা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) কে বুঝানো হয়েছে ।
তাফসীরে কাবিরে ইবনে মুনির বলেন, আল্লাহ্ পাক ঐ সমস্ত জাতির লোকদের কাছ থেকে ঐ রাসূল সম্পর্কে অঙ্গীকার নিলেন যাদের নিকট তাঁদের নবীগণ তার তা’জীম বা সম্মানের কথা বর্ননা করতেন । আর এখানে তার মর্যাদা বলতে মুহাম্মদ (সঃ) এর মর্যাদাকে বুঝানো হয়েছে ।
আল্লামা তাকী উদ্দিন সুবুকী (রঃ) لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنصُرُنَّهُ এর অর্থের উপরে একটি সুন্দর ও চমৎকার রেসালাহ লিখেছেন, তাতে তিনি বলেন এতে কোন সন্দেহ নাই যে, এই আয়াতটি রাসূল পাক (সঃ) এর উচ্চ প্রশংসা এবং উচ্চ মর্যাদা ও সম্মানের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে ।
↑ তিরমিযি, আবূ ঈসা মুহাম্মদ ইবনু ঈসা (২৭৯ হিঃ), আস সুনান, , (বৈরুত, দারু ইহ্য়ায়িত তুরাসিল আরাবী, প্রকাশকাল - ১৯৯৮ খৃঃ) হাদিস নং ৩৬১৯
↑ বুখারী, মুহাম্মদ ইবনুল ঈসমাইল (২৫৬ হিঃ), আস শুনান, (বৈরুত, দারু ইবনি কাসীর, প্রথম প্রকাশকাল ১৪০৭ হিঃ/১৯৮৭ ঈসায়ী), খন্ড-১, পৃষ্টা- ১৪, হাদিস নন্ত ১৩৫৮, মুসলিম শরীফ, মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ (২৬১ হিঃ) আস সহীহ (বৈরুত, দারুল আফাক আল জাদীদাহ) হাদীস নং ৬৯২৬
শরীয়ার কষ্টিপাথরে মীলাদ ও কিয়াম (লেখকঃ মুফতি মুহাম্মদ ওসমান গনি সালেহী)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামর শুভাগমনের দিন কেবল মুসলমান নয় সৃষ্টিজগতের সকলের জন্য আনন্দের ও রহমতের। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন-আমি আপনাকে জগতসমূহের রহমত করে প্রেরণ করেছি। তাই সৃষ্টির সূচনা কাল থেকে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপিত হয়ে আসছে। যেহেতু ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলো মুসলিম জাতির আনন্দের দিন, সেহেতু সারা বিশ্বের মুসলিমগণ অত্যন্ত ভক্তি ও মর্যাদার সাথে রবিউল আউয়াল মাসে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপন করে থাকেন। কিন্তু এক দল লোক এটিকে অবৈধ ও বিদয়াতে সাইয়্যিআহ (মন্দ বিদআত) বলে প্রচার করছে। অথচ এটি একটি শরিয়ত সম্মত পুণ্যময় আমল, যা কুরআন, সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। অত্র প্রবন্ধে আমরা এটি শরিয়ত সম্মত হবার বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের দলীল, সাহাবায়ে কিরামের স্বীকৃতি, সালফে সালেহীন, প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদগণের দৃষ্টিভঙ্গি তোলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি।
‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ শব্দটি যৌগিক শব্দ। যা তিনটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত।
এক, ঈদ
দুই, মিলাদ
তিন, নবী।
প্রথমত
ঈদ শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ উৎসব, আনন্দ, খুশি।
বিশ্ববিখ্যাত অভিধান প্রণেতা ইবনু মনযুর বলেন-
ﺍﻟﻌﻴﺪ ﻛﻞ ﻳﻮﻡ ﻓﻴﻪ ﲨﻊ
‘সমবেত হবার প্রত্যেকদিনকে ঈদ’ বলা হয়।
— ইবনু মনযুর, লিসানুল আরাব, দারু সাদির, বৈরুত, ১ম সংস্করণ, খ. ৩য়, পৃ.৩১৫
মুফতি আমীমূল ইহসান আলাইহির রাহমাহ বলেন-
ﺍﻟﻌﻴﺪ ﻛﻞ ﻳﻮﻡ ﻓﻴﻪ ﲨﻊ ﺍﻭ ﺗﺬﻛﺎﺭ ﻟﺬﻱ ﻓﻀﻞ
কোন মর্যদাবান ব্যক্তিকে স্মরণের দিন বা সমবেত হবার দিনকে ঈদের দিন বলা হয়।
— মুফতি আমীমূল ইহসান, কাওয়ায়িদুল ফিকহ, আশরাফি বুক ডিপু, ভারত, ১ম সংস্করণ, ১৩৮১ হিজরী, পৃ.৩৯৫
দ্বিতীয়ত
মিলাদ শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ: জন্মকাল, জন্মদিন। এ অর্থে মাওলিদ (ﻣﻮﻟﺪ) শব্দের ব্যবহার আরবি ভাষায় অত্যোধিক।
তৃতীয়ত
নবী, এখানে নবী বলতে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। কারণ মুসলিম জাতি ও পুরো সৃষ্টিজগত তাঁর আগমণের শোকরিয়া আদায় করে। সুতরাং ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ অর্থ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র শুভাগমনের আনন্দ উৎসব।
‘মিলাদুন্নবী’ শব্দের মধ্যে ‘মিলাদ’ শব্দটি কারো জন্ম বা জন্মকাল বুঝানোর জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। এ অর্থে শব্দটির ব্যবহার রয়েছে হাদিস শরিফে, অভিধান গ্রন্থে, ইতিহাস গ্রন্থে, এমনকি অনেক কিতাবের নামেও। এটি নতুন কোন শব্দ নয়। এর কয়েকটি ব্যবহার নিম্নে উলেখ করা হল।
১.অভিধান গ্রন্থ
আল্লামা ইবনু মনযুর তার সুপ্রসিদ্ধ আরবি অভিধান ‘লিসানুল আরব’-এ লিখেছেন-
ﻣﻴﻼﺩ ﺍﻟﺮﺟﻞ: ﺍﺳﻢ ﺍﻟﻮﻗﺖ ﺍﻟﺬﻱ ﻭﻟﺪ ﻓﻴﻪ
লোকটির মিলাদ- "যে সময়ে সে জন্ম গ্রহণ করেছে সে সময়ের নাম"।
— ইবনু মনযূর, প্রাগুক্ত, খ. ৩য়, পৃ.৪৬৮, আল্লামা ইসমাঈল বিন হাম্মদ জাওহারী, আস-সিহাহ, দারুল ইলম, বৈরুত, ১৪০৪ হিজরী, খ.১ম, পৃ.৩০৬
২.হাদিস গ্রন্থ
ইমাম তিরমিযী আলাইহির রাহমাহ তাঁর ‘আল জামেউস সহীহ’ গ্রন্থের একটি শিরোনাম হল-
ﺑﺎﺏ ﻣﺎ ﺟﺎﺀ ﰲ ﻣﻴﻼﺩ ﺍﻟﻨﱯ
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম সম্পর্কে বর্ণিত বিষয়ের অধ্যায়।
— ইমাম তিরমিযী, আল-জামেইস সহীহ, দারুল গারব আল ইসলামী, বৈরুত,লেবানন, ১৯৯৮ইং, খ. ৫ম, পৃ.৫৮৯।
হযরত উসমান বিন আফ্ফান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বনী ইয়ামর বিন লাইসের ভাই কুরাছ বিন উশাইমকে জিজ্ঞেস করলেন-
ﺃﺍﻧﺖ ﺃﻛﱪ ﺃﻡ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﷲ ﺻﻠﻰ ﺍﷲ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻓﻘﺎﻝ : ﺭﺳﻮﻝ ﺍﷲ ﺃﻛﱪ ﻣﲏ ﻭﺃﻧﺎ ﺍﻗﺪﻡ ﻣﻨﻪ ﰲ ﺍﳌﻴﻼﺩ
‘আপনি বড় নাকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার চেয়ে বড়। আর আমি জন্মের মধ্যে তার চেয়ে অগ্রজ।
নোটঃ
ইমাম তিরমিযী, প্রাগুক্ত;
ইমাম তাবারী, তারিখুল উমাম ওয়াল মূলুক, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানন, ১৪০৭ হি. খ. ১ম, পৃ.৪৫৩,
ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, দারুল ফিকর, বৈরুত, লেবানন, ১৪১৯ হিজরী, খ.২য়. পৃ.২১৬,
মিয্যী, তাহযীবুল কামাল, মুয়াস সাসাতুর রিসালা, বৈরুত, লেবানন, ১৪০০হিজরী, খ. ২৩, পৃ.৪৬৭,
আহমাদ বিন আমর শায়বানী, আল-আহাদ ওয়াল মাছানী, দারুর রাইয়া, রিয়াদ, সৌদি আরব, ১৪১১হিজরী, খ. ১ম, পৃ.৪০৭।
৩. ইতিহাস ও সীরাত গ্রন্থ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরতের সময় ‘সাওর’ গুহায় আশ্রয় নেন। এদিকে মক্কার কুরাইশরা তাকে খুঁজতে খুঁজতে ‘সাওর’ গুহা মুখে পৌছলে তাদের একজন বলল-
ﺃﻥ ﻋﻠﻴﻪ ﺍﻟﻌﻨﻜﺒﻮﺕ ﻗﺒﻞ ﻣﻴﻼﺩ ﺍﻟﻨﱯ ﺻﻠﻰ ﺍﷲ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻓﺎﻧﺼﺮﻓﻮﺍ
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের পূর্ব থেকে এ গুহামুখে মাকড়শার জাল রয়েছে। অতঃপর তারা চলে গেল।
নোটঃ
ইবনে সাদ, আত্ তাবকাতুল কুবরা, দারু বৈরুত লিত্-তাবয়া ওয়ান নশর, বৈরুত, লেবানন, ১৩৯৮ হি. খ.১ম,পৃ.২২৮,
ইমাম সুয়ূতী, আল-খাছায়িছুল ক্বুবরা, মাকতাবাতু নূরিয়্যা রিজকিয়্যা, ফয়সালাবাদ, পাকিস্তান, ১৯৯৮ ইং, খ.১ম, পৃ.৩০৫
ইবনু আউন (রহ.) বলেন-
হযরত আম্মার বিন ইয়াসির রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ৯১ বছর বয়সে শহীদ হন। তিনি জন্মের ক্ষেত্রে রাসুলুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অগ্রজ ছিলেন।
— ইবনে সাদ, প্রাগুক্ত, খ. ৩য়, পৃ. ৩৫৯
হযরত ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-
ﻭﻛﺎﻥ ﺑﲔ ﻣﻴﻼﺩ ﻋﻴﺴﻰ ﻭﺍﻟﻨﱯ ﻋﻠﻴﻪ ﺍﻟﺼﻼﺓ ﻭﺍﻟﺴﻼﻡ ﲬﺲ ﻣﺎﺋﺔ ﺳﻨﺔ ﻭﺗﺴﻊ ﻭﺳﺘﻮﻥ ﺳﻨﺔ
আর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের মাঝখানে ৫৬৯ বছর ব্যবধান ছিল।
নোটঃ
ইবনু সাদ, প্রাগুক্ত, খ. ১ম, পৃ.৫৩,
ইমাম তাবারী, প্রাগুক্ত, খ. ১ম, পৃ.৪৯৫,
ইমাম কুরতুবী, আল-জামেঈ লিআহকামিল কুরআন, দারু ইহইয়ায়িত তুরাসিল আরাবী, বৈরুত, লেবানন, খ.৬ষ্ঠ, পৃ.১২২।
আল্লামা ইবনু হাজর আসক্বালানী আলাইহির রাহমাহ বলেন-
তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র জন্মের কিছুকাল পরে জন্ম গ্রহণ করেছেন।
— আল্লামা ইবনু হাজর আসকালানী, ফতহুল বারী, দারু নশরিল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, লাহর, পাকিস্তান, ১৪০১হি. খ.৬ষ্ট, পৃ.৫৫৭।
উপরিউক্ত উদ্ধৃতি থেকে বুঝা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র জন্ম বুঝানোর জন্য ‘মিলাদুন্নবী’ শব্দটির ব্যবহার সাহাবায়ে কিরামের যুগ থেকে অদ্যাবধি রয়েছে; এ যুগের নবসৃষ্ট কোন শব্দ নয়। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করে যে ‘মিলাদুন্নবী’ একটি ইদানিং সময়ের শব্দ, যা আদৌ সঠিক নয়। আবার কেউ কেউ ‘মিলাদ’ শব্দের অর্থ ‘জন্ম’ না নিয়ে অন্যঅর্থ নেয়ার চেষ্টা করে, যা কোন অভিধান প্রণেতা উলেখ করেননি।
‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতে বুঝায়-এ ধরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমনে আনন্দিত হওয়া এবং এ অদ্বিতীয় নিয়ামত পাবার কারণে সৎকাজ ও ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা।
মাসিক তরজুমান, ১৪৩৬ হিঃ রবিউল আউয়াল সংখ্যা
ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা সম্পর্কে হাদিসে পাকে বলা হয়েছেঃ
সাহাবী আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে কারীম সা. যখন মদীনায় আসলেন তখন দেখলেন বছরের দুটি দিনে মদীনাবাসীরা আনন্দ-ফুর্তি করছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন এ দিন দুটো কি? তারা বলল যে আমরা ইসলামপূর্ব মুর্খতার যুগে এ দুদিন আনন্দ-ফুর্তি করতাম। রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ 'আল্লাহ তাআলা এ দু’দিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটো দিন তোমাদের দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর'।
— আবু দাউদ
এখানে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা কে দুটি ঈদের দিন হিসেবে বলা হয়েছে কিন্তু এই দুইটি দিন ছাড়া অন্য কোন ঈদের দিন নাই তা এখানে উল্লেখ নাই । পবিত্র কুর’আন ও আরও অসংখ্য হাদীসে আরও অনেক দিনকে ঈদ এর দিন হিসেবে উল্লেখ হয়েছে।
قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا أَنزِلْ عَلَيْنَا مَآئِدَةً مِّنَ السَّمَاء تَكُونُ لَنَا عِيداً لِّأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا وَآيَةً مِّنكَ وَارْزُقْنَا وَأَنتَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ
অর্থঃ ঈসা ইবন মারিয়ম বললেন- হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য ভর্তি খাঞ্চা নাযিল করুন। এ দিন আমাদের জন্য ঈদ হবে। আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবার জন্যও তা হবে ঈদের দিন। আপনার পক্ষ থেকে এটি হবেএকটি কুদরতি নিদর্শন।
— সূরা মায়িদাহ ১১৪
উক্ত আয়াতে প্রমাণিত হল যে, আল্লাহ পাকের কোন নিয়ামত লাভের দিনকেও ঈদের দিন হিসেবে উদযাপন করা যায়। নিঃসন্দেহে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে প্রেরিত দুনিয়াবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় নিয়ামত; কারন তিনি সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমত । আল্লাহ তায়ালা বলেন,
আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি ।
— সূরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭
সুতরাং এই দিনটি অবশ্যই আনন্দ তথা ঈদের দিন । এছাড়াও লাইলাতুল বারাত ও লাইলাতুল কদরকেও ঈদের দিন হিসেবে বলা হয়েছে। হযরত আব্দুল কাদীর জিলানী (রঃ) বলেন-
ফেরেশতাদের জন্য লাইলাতুল বারাত ও লাইলাতুল ক্বদর দুটি ঈদের দিন।
— গুনিয়াতুত তালেবীন (উর্দু) পৃঃ ৩৬৫
১. জুম্মার দিন
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বর্ণনা করেন- রাসূলুল্লাহ (দঃ) ইরশাদ করেন, নিশ্চয় এ দিন (জুমুআর দিন) আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদের জন্য ঈদের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি জুমুয়া পড়তে আসবে সে যেন গোসল করে ও সুগন্ধি থাকলে উহা লাগায় এবং তোমাদের উপর মিসওয়াক করা আবশ্যক।
— ইবন মাজাহ পৃঃ ৭৮
অনেক হাদীসে এই দিনটিকে ইদুল ফিতর ও ইদুল আযহা থেকেও শ্রেষ্ঠ দিন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
—ইবন মাজাহ পৃঃ ৭৭ ও মিশকাত শরীফ পৃঃ ১২০
২. আরাফার দিন (৯ই জিলহজ্ব)
অনেক রেওয়াতে ৯ই জিলহজ্ব অর্থাৎ আরাফার দিনটিকেও ঈদের দিন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
—মিশকাত শারীফ পৃঃ ১২১ ও তিরমিযী শারীফ পৃঃ ১৩৪
৩. প্রতি মাসে ৪/৫ দিন
হুজুর পাক (সঃ) ইরশাদ করেন, মু'মিন মুসলমানদের প্রতি মাসে চারটি অথবা পাঁচটি ঈদ রয়েছে। অর্থাৎ প্রতিমাসে চারটি অথবা পাঁচটি সোমবার হয়ে থাকে।
— কিফায়া শরহে হিদায়া ২য় খন্ড - বাবু ছালাতিল ঈদাইন; হাশিয়ায়ে লখনবী আলাল হিদায়া
৪. রোযাদারের জন্য দুটি ঈদ
হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করেন, রোযাদারের জন্য দুটি ঈদ বা খুশি। একটি হলো তার প্রতিদিন ইফতারের সময়। আর অন্যটি হলো মহান আল্লাহ পাকের সাক্ষাতের সময়!
— বুখারী শরীফ - কিতাবুস সাওম; মুসলিম শরীফ; মিশকাত শরীফ, রোজা অধ্যায়
সুতরাং কোরআন ও হাদীস থেকে দেখা যাচ্ছে, শরীয়ত সমর্থিত যেকোন আনন্দের দিনই ঈদের দিন । আর ঈদ-ই-মিলাদুন্নাবী বলতে বুঝায় নবী কারীম (দঃ) এর পৃথিবীতে আগমন উপলক্ষে ঈদ বা আনন্দের দিন।
সর্বপ্রথম মিলাদ ও কেয়াম কে করেছিলেন ?
পবিত্র মিলাদুন্নবীর ইতিহাস অতি প্রাচিন । মিলাদুন্নবীর সুচনা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন । রোজে আজলে সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামকে নিয়ে আল্লাহ এই মিলাদের আয়োজন করেছিলেন । নবী গনের মহাসম্মেলন ডেকে মিলাদুন্নবী আয়োজক স্বয়ং আল্লাহ । তিনি নিজে ছিলেন মীরে মাজলিস বা সভাপতি । সকল নবীগন ছিলেন শ্রোতা । ঐ মজলিসের উদ্দেশ্য ছিল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামের বেলাদাত, শান ও মান অন্যান্য নবীগনের সামনে তুলে ধরা এবং তাঁদের থেকে তাঁর উপর ঈমান আনয়ন ও সাহায্য সমর্থনের প্রতিশ্রুতি আদায় করা । কোরআন মজিদের ৩য় পারা সুরা আলে এমরানে ৮১-৮২ নং আয়াতে মধ্যে আল্লাহ তায়ালা ঐ মিলাদুন্নবী মাহফিলের কথা উল্লেখ করেছেন । নবীজীর সম্মানে এটাই ছিল প্রথম মিলাদ মাহফিল এবং মিলাদ মাহফিলের উদ্যোগ্ক্তা ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা । সুতরাং মিলাদে মাহফিল আনুষ্ঠান হচ্ছে আল্লাহর সুন্নত বা তরিকা । ঐ মজলিসে সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম ও উপস্থিত ছিলেন । ঐ মজলিসে স্বয়ং আল্লাহ নবীজীর শুধু আবির্ভাব বা মিলাদের উপরই গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন । সিরাতুন্নবীর উপর কোন আলোচনা সে দিন হয়নি । সমস্ত নবীগন খোদার দরবারে দন্ডায় মান থেকে মিলাদ শুনেছেন এবং কিয়াম করেছেন । কেননা খোদার দরবারে বসার কোন অবকাশ নেই । পরিবেশটি ছিল আদবের ।
মিলাদ পাঠকারী ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ এবং কিয়ম কারীগন ছিলেন আমবিয়ায়ে কেরাম ।
এই মিলাদ ও কিয়াম কোরআনের " ইকতেদো উন নস " দ্বারা প্রমানিত হলো : উল্লেখ্য যে কোরআনে মজিদের "নস" চার প্রকার যথা : ইবারত , দালালত , ইশারাও ইক্কতিজা ।উক্ত চার প্রকার দ্বারাই দলিল সাবেত হয় । ( নুরূল আনওয়ার দেখুন ) নিম্নে উল্লেখিত আয়াতের মধ্যে ইবারতের দ্বারা প্রমানিত হয়েছে অঙ্গীকার / দালালাতের দ্বারা নবীগনের মাহফিল , ইশারার দ্বারা মিলাদের ব আবির্ভাবের এবং ইকতিজার দ্বারা কিয়ামের প্রমানিত হয়েছে ।
সুতরং মিলাদুন্নবী মহফিল কেয়াম নবীগনের সম্মিলিত সুন্নাত ও ইজামায়ে আম্বিয়া দ্বারা প্রতিষ্ঠিত । কোরআন মজিদে আলে এমরানের আয়াত ৮১-৮২ উল্লেখ করা হলো : আল্লাহ বলেন ( ৮১ )
হে প্রিয় রাসুল ! আপনি স্মরণ করূন ঐ দিনের কথা , যখন আল্লাহ তায়ালা সমস্ত নবীগন থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন এ কথার উপর যে , যখন আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরন করবো ; তারপর তোমাদের কাছে আমার মহান রাসুল যাবেন এবং তোমাদের নবু্যত ও কিতাবের সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করবেন , তখন তোমরা অবশ্য অবশ্যই তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং অবশ্যইতাঁকে সাহায্য করবে
আল্লাহ বলেন
তোমরা কি এ সব কথার উপর অঙ্গীকার করছো এবং এই শর্তে আমার ওয়াদা গ্রহন করে নিয়েছো ( তখন ) তাঁরা সকলেই সমস্বরে বলেছিলেন, ----আমরা অঙ্গিকার করছি ।
আল্লাহ বলেন
তাহলে তোমরা পরস্পর সাক্ষি থাক । আর আমি ও তোমাদের সাথে মহাসাক্ষী রইলাম ।
অত:পর যে কোন লোক এই অঙ্গীকার থেকে ফিরে যাবে- সেই নফরমান (কাফের )
উক্ত দুটি আয়াতে মধ্যে নবী করিম (দ) -এর ব্যাপারে ১০ টি বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে । যথা :
১ । এই ঐতিহসিক মিলাদ সম্মেলনের ঘটনাবলীর প্রতি রাসুলে কারিম (দ) -এর দৃষ্টি আকর্ষণ । যেহেতু নবী করিম (দ) ঐ সময়ে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ।
২। আল্লাহ কর্তৃক অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরামের নিকট থেকে নবীজীর শানে অঙ্গীকার আদায় ।
৩। নবীগনের রমরমা রাজত্বকালে এই মহান নবীর আগমন হলে তাঁর উপর ঈমান আনতে হবে ।
৪। তাঁর আগমন হবে অন্যান্য নবীগনেরর সত্যতর দলীল স্বরূপ ।
৫। ঐ সময়ে নবীগনের নবুয়ত স্থগিত রেখে- নবীজীর উপর ঈমান আনয়ন করতে হবে ।
৬।নবীজীকে সর্বাবস্থায় পুর্ন সাহায্য সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকার আদায় ।জীবনের বিনিময়ে এই সাহায্য হতে হবে নি:শর্তভাবে ।
৭। নবীগনের স্বীকৃতি প্রদান ।
৮। পরস্পর সাক্ষী হওয়া ।
৯। সকলের উপরে আল্লাহ মহাসাক্ষী ।
১০ । ওয়াদা ভঙ্গের পরিনাম - নাফরমান ও কাফের ।
১০ নং দফায় নবীগনের উম্মত তথা ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের পরিনতির দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে । কেননা নবীগগনের অস্বীকারের প্রশ্নই উঠে না । অস্বীকার করেছেন ইয়াহুদী ও নাসারাগন । সুতরাং তারাই কাফের ।
হযরত আদম (আঃ) এর যুগে মিলাদ
প্রত্যেক নবী নিজ নিজ যুগে আমাদের প্রিয়নবী ও আল্লাহর প্রিয় হাবিবের আবির্ভাবের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন । হযরত আদম (আ) তাঁর প্রিয় পুত্র ও প্রতিনিধি হযরত শীস (আ) কে নুরে মুহাম্মদীর তাজিম করার জন্য নিম্ন অসিয়ত করে গেছেন ।
আনুবাদ অংশ টি নিম্নে বর্ননা করা হলো
আদম (আ) আপন পুত্র হযরত শীস (আ) কে লক্ষ্য করে বল্লেন : হে প্রিয় বৎস। আমার পরে তুমি আমার খলিফা । সুতরাং এই খেলাফত কে তাকওয়ার তাজ ও দৃঢ় একিনের দ্বারা মজবুত করে ধরে রেখো । আর যখনই আল্লাহর নাম ঝিকির (উল্লেখ) করবে তাঁর সাথেই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নামও উল্লেখ করবে । তাঁর কারন এই : আমি রূহ ও মাটির মধ্যবর্তী থাকা অবস্থায় ই তাঁর পবিত্র নাম আরশের পায়ায় (আল্লাহর নামের সাথে ) লিখিত দেখেছি । এরপর আমি সমস্ত আকাশ ভ্রমন করেছি । আকাশের এমন কোন স্থান ছিলনা যেখানে মুহাম্মাদ(দ) -এর নাম অন্কিত পাই নি । আমার রব আমাকে বেহেস্তে বসবাস করতে দিলেন । বেহেস্তের এমন কোন প্রাসাদ ও কামরা পাইনাই যেখানে মুহাম্মদ (দ) -এর নাম ছিলনা । আমি মুহাম্মদ ( দ) -এর নাম আরোও লিখিত দেখেছি সমস্ত হয়রদের স্কন্ধ দেশে , বেহেস্তের সমস্ত বৃক্ষের পাতায় , বিষেশ করে তুলা বৃক্ষের পাতায় পাতায় , পর্দার কিনারায় এবং ফেরেসতাগনের চোখের মনিতে ঐ নাম অন্কিত দেখেছি । সুতরাং হে শীস ! তুমি এই নাম বেশী বেশী করে জপতে থাক । কেননা , ফেরেস্তাগন পুর্ব হতেই এই নাম জপনে মশগুল ররয়েছেন
— জুরকানি শরীফ
উল্লেখ্য যে সর্ব প্রথম দুনিয়াতে ইহাই ছিল জিকরে মিলাদুন্নবী ( দঃ )।
তথ্যসূত্র
মিলাদ ও কিয়ামের বিধান (লেখকঃ অধ্যক্ষ এম এ জলিল (রহঃ))
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর মিলাদ পাঠ ও কেয়াম
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এবং হযরত ইসমাইল (আঃ)যখন আল্লাহর ঘর তৈরী করছিলেন , তখন ইব্রাহীম (আঃ) উক্ত ঘরের নির্মাণ কাজ কবুল করার জন্য নিজের ভবিষ্যৎ সন্তানাদিদের মুসলমান হয়ে থাকার জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করার পর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা কেয়াম করে নবী (দঃ) -এর আবির্ভাব আরবে ও হযরত ইসমাইলের বংশে হওয়ার জন্য এভাবে দোয়া করেছেন ।
অর্থাৎ হে আমার রব ! তুমি এই আরব ভুমিতে আমার ইসমাইলের বংশের মধ্যে তাদের মধ্যে হতেই সেই মহান রাসুলকে প্রেরণ করো- যিনি তোমার আয়াত সমুহ তাদের কাছে পাঠ করে শুনাবে, তাদেরকে কোরআন সুন্নাহর বিশুদ্ধ গেয়ান শিক্ষা দেবেন এবং বাহ্যিক ও আত্বিক অপবিত্রতা থেকে তাদের পবিত্র করবেন ।
— সুরা আল বাকারা ১২৯ আয়াত
এখানে দেখা যায় - হযরত ইব্রাহীম ( আঃ) রাসুলুল্লাহের ৪০০০ বৎসর পুর্বেই মুনাজাত আকারে তাঁর আবির্ভাব , তাঁর সারা জিন্দেগীর কর্ম চান্চল্য ও মাণুষের আত্বার পরিশুদ্ধির ক্ষমতা বর্ননা করে হুজুর (দ) -এর মিলাদের সারাংশ পাঠ করেছেন এবং এই মুনাজাত বা মিলাদ দন্ডায়মান অবস্থাই করেছেন ;যা পুর্বের দুটি আয়াতের মর্মে বুঝা যায় ।
ইবনে কাছির তাঁর বেদায়া ও নেহায়া গ্রন্থে ২য় খন্ডে ২৬১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন
দোয়া ইব্রাহিমু আলাইহি ওয়া সাল্লামু ওয়াহুয়া কায়েমুন
অর্থাৎ উক্ত দোয়া করার সময় ইব্রাহীম (আঃ) দন্ডায়মান ছিলেন ।
নবী করিম (দ) বলেণ
আনা দুয়াওতু ইব্রাহীমা
আমি হযরত ইব্রহীমের (আঃ) -এর দোয়ার ফসল ।
হযরত ইব্রাহীম ( আঃ) আল্লাহর নিকট থেকে চেয়ে আমাদের প্রিয় নবী(দ) কে আরবের ইসমাইল (আঃ) -এর বংশে নিয়ে এসেছেন । এটা উপলব্ধির বিষয় । আশেক ছাড়া এ মর্ম অন্য কেউ বুঝবে না । বর্তমান মিলাদ শরীফে রাসুলে পাঁকের আবির্ভাবের যে বর্ননা দেয়া হয় -তা হযরত ইব্রাহিম(আঃ)-এর দোয়ার তলনায় সামান্যতম অংশ মাত্র । সুতরাং আমাদের মিলাদ শরিফ পাঠ ও কেয়াম হযরত ইব্রাহীম আলাহিস সালামেরই সুন্নাত । [1]
তথ্যসূত্র
দেখুন বেদায়া ও নেহায়া ২য় খন্ড ২৬১ পৃষ্ঠা
মিলাদ ও কিয়ামের বিধান (লেখকঃ অধ্যক্ষ এম এ জলিল (রহঃ))
হযরত ঈসা (আঃ) এর মিলাদ পাঠ ও কেয়াম
নবী করিম (দঃ) -এর ৫৭০ বৎসর পুর্বে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আবির্ভাব ।তিনি তাঁর উম্মত- হাওয়ারী ( বনি ইসরাইল ) কে নিয়ে নবী করিম (দঃ) এর মিলাদ শরিফ পাঠ করেছেন । উম্মতের কাছে তিনি আখেরী জামানার পয়গম্বর (দঃ) -এর নাম ও সানা সিফাত এবং আগমন বার্তা এভাবে বর্নণা করেছেনঃ
হে আমার প্রিয় রাসুল ! আপনি স্বরণ করে দেখুন ঐ সময়ের কথা - যখন মরিয়মেম তনয়া ঈসা (আঃ) বলেছেন : হে বনী ইসরাইলঃ আমি তোমাদের কাছে নবী হয়ে প্রেরিত হয়েছি । আমি আমার পুর্ববর্তী তওরাত কিতাবের সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছি এবং এমন এক মহান রাসুলের সুসংবাদ দিচ্ছি-- যিনি আমার পরে আগমন করবেন এবং তাঁর নাম হবে আহমদ (দঃ)
— সুরা আছ- ছফ ৬ আয়াত
হযরত ঈসা ( আঃ) এর ভাষন সাধারনত দন্ডায়মান হতো আর এটাই ভাষনের সাধারন রীতি ও বতে । ইবনে কাছির বেদায়া ও নেহায়া গ্রন্থের ২য় খন্ডে ২৬১ পৃষ্ঠয় উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন :
আখাতোবা ঈসা আলাইহেস ষালামু উম্মাতাহুল হাওয়ারিইনা কায়েমা
অর্থৎ হযরত ঈসা (আঃ) দন্ডায়মান (কেয়াম) অবস্থায় তাঁর উম্মৎ হাওয়ারীদেরকে নবীজীর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে বক্তৃতা করেছেন ।
সুতরাং মিলাদ ও কিয়াম হযরত ঈসা (আঃ) এর সুন্নাত এবং নবীযুগের ৫৭০ বৎসর পুর্ব হতেই । [1]
তথ্যসূত্র
বেদায়া ও নেহায়া
মিলাদ ও কিয়ামের বিধান (লেখকঃ অধ্যক্ষ এম এ জলিল (রহঃ))
মহানবী (সাঃ) নিজের মিলাদ নিজেই পাঠ করেছেন
.একদিন নবী করীম (দাঃ) মিম্বারে দড়িয়ে সমবেত সাহাবীগনকে লক্ষ্য করে বললেন : তোমরা বল - আমি কে ? সাহাবায়ে কেরাম বললেন আপনি আল্লাহর রাসুল । হুজুর ( দঃ ) বললেন : আমিআব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ , আব্দুল মোত্তালিবের নাতী, হাশেমের প্রপৌত্র এবং মানাফের পুত্রের প্রপৌত্র ।
এই হাদিসের গুরুত্ব মতেই ইমামগন চার কুরছিকে ফরজ বলেছেন ।
হুজুরে আকরাম (দঃ) আরও এরশাদ করেন
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে আমার একটি বিশেষ মর্যাদা এই যে , আমি খতনা অবস্থায় ভুমিষ্ট হয়েছি এবং আমার লজ্জা স্থান কেউ দেখেনি ।
— তাবরানী, জুরকানী
অন্যান্য রেওয়ায়াতে পা পবিত্র , নাভি কর্টকৃত , সুরমা পরিহিত , বেহেস্তি লেবাস পরিহিত অবস্থা ভুমিষ্ট হওয়ার বর্ননা এসেছে [1] । এছাড়াও জঙ্গে-হোনায়নেরর যুদ্ধে যখন হাওয়াজিনের তীর নিক্ষেপে মুসলিম সৈন্যগন ছত্রভঙ্গ হয়ে পরেছিলেন , তখনও নবী করীম (দঃ) একা যুদ্ধ ময়দানে দাড়িয়ে বলেছিলেন
আনা নাবী্যয়ু লা কাযেব + আনা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব
অর্থাৎ আমি আল্লাহর নবী , আমি মিথ্যাবাদী নই । আমি আব্দুল মোত্তালিবের বংশধর ।
উপরোক্ত প্রথম ঘটনা টি দাঁড়িয়ে বলা এবং বর্ননা করার নামই মিলাদ ও কেয়াম । সুতরাং মিলাদ ও কেয়াম স্বয়ং রাসুল পাকের সুন্নত । দ্বিতিয় বর্ননায় " ওয়ালাদাত " শব্দটি এসেছে । এর অর্থ হলো আমি জন্ম গ্রহন করেছি - ভুমিষ্ট হয়েছি -আবির্ভুত হয়েছি । সব বর্ননাই নবী করীম (দঃ) কেয়াম আবস্থা ছিলেন । তিনি নিজেই কেয়াম করেছেন সুতরাং বেলাদতের বর্নানা কালে কেয়াম করা নবীজীর ই সুন্নত ।
তথ্যসূত্র
মাদারেজুন্নবুয়াত
মিলাদ ও কিয়ামের বিধান (লেখকঃ অধ্যক্ষ এম এ জলিল (রহঃ))
ফেরেস্তাগণের কিয়ামঃ দিবা-রাত্রি ২৪ ঘন্টা
আল্লাহর ৭০ হাজার ফেরেস্তা সর্বদা হুজুরের রওজা মোবারক দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে নুরের পাখা রওজা মোবারকে সামিয়ানার মত বিস্তার করে দুরূদ ও সালাম পেশ করে থাকেন । অথচ আমরা ফেরেস্তাদের অনুকরনে ৫/১০ মিনিট দাড়িয়ে দুরূদ ও সালাম পেশ করলে বেদআত হয়ে যায় - বলে এক শ্রেনীর আলেম ও নাম ধারীরা ফতোয়া দিয় বসে । ফেরেস্তারাও কি তাহলে বেদআতে লিপ্ত ? হাদিস খানানিম্নরূপ ।
হযরত নোবাইহাতা ইবনে ওহাব (রহ ) তাবেয়ী হতে বর্নিত ; একদিন হযরত কা'ব আহবার ( তাবেয়ী ) হযরত আয়েশা (রাঃ) -এর খেদমতে উপস্থিত হলেন । অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম তথা নবীয়ে করিম ( দঃ)-এর শানে-মানে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলেন । হযরত কা'ব বললেন : এমন কোন দিন উদয় হয়না- যে দিনে ৭০ হাজার ফেরেস্তা নাজিল হয়ে রাসুলুল্লাহ (দাঃ) -এর রওজা মোবারাক বেষ্টন করে তাঁদের নুরের পাখা বিস্তার করে সন্ধা পর্যন্ত নবী করিম ( দ ) -এর উপর দুরুদ ও সালাম পাঠ না করেন । অতঃপর যখন সন্ধা হয়ে আসে তখন তাঁরা আকাশে আরোহন করেন এবং তাদের অনুরূপ সংখ্যায় (৭০ হাজার ) ফেরেস্তা দ্বারা অবতরন করে তাদের মতই দুরুদ ও সালাম পাঠ করতে থাকেন । আবার কেয়ামতের দিন যখন জমিন (রওজা মোবারক) বিদীর্ন হয়ে যাবে , তখন তিনি ৭০ হাজার ফেরেস্তা দ্বারা বেস্টিত হয়ে প্রেমাস্পদের রুপ ধারন করে আসল প্রেমিকের সাথে শীঘ্র মিলিত হবেন ।
— দারমী ও মিশকাত _ বাবুল কারামত হাশিয়াহ
উল্লেখিত হাদিসে নিম্নোক্ত বিষয়ঘুলো খুবই গুরুত্বপুর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য
১। কা'ব আহবার (রা) নবী করীম (দ) -এর রওজা মোবারকে ৭০ হাজার ফেরেস্তা নাজিল হতে নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন । এটি তার কারামতের প্রমান ( লোমআত )
২ । হযরত আয়েশার উপস্থিতিতে কা'ব এ সাক্ষ্য দিয়েছেন ।
৩। রওজা মোবারাকে দিনে ৭০ হাজার এবং রাত্রে ৭০ হাজার ফেরেস্তা নাজিল হয় এবং তাদের ডিউটি হলো : রওজা মোবারক বেষ্টন করে নুরের পাখা রওজা মোবারকে সামিয়ানা স্বরূপ বিছিয়ে দাঁড়ি্যে দাঁড়িয়ে দুরুদ ও সালাম পাঠ করা । ইহাই মিলাদ ও কিয়ামের সারাংশ । মুসলমানগন ফেরেস্তাদের অনুকরনে কেয়াম সহকারে দরূদ ও সালাম পড়ে থাকেন । [1]
৪। হাদিসে উল্লেখিত " মিসলাহুম" শব্দ দ্বারা প্রমানিত হলো যে সব সময় নিত্য নতুন অন্য একদল ফেরেস্তা আসেন । জীবনে একবারই তাঁরা এ সুযোগ পেয়ে থাকেন ।
৫। উক্ত ফেরেস্তারা অন্য কোন আমল না করে কেয়াম অবস্থায় শুধু দরূদ ও সালাম পড়েন ।
৬। রওজা মোবারকে পলা ক্রমে দিন রাত ২৪ ঘন্টাই মিলাদ ও কেয়াম হয় ।
৭। মিলাদ মাহফিলে উত্তম ভাবে আলোক সজ্জা করা ও সামিয়ানা টাঙ্গানো বৈধ ।
৮। নবী করিম (দ) কে সম্মান প্রদর্শনার্থে দাঁড়ানোর জন্য চোখের সামনে উপস্থিত থাকা শর্ত নহে । কেননা , ফেরেস্তাদের চোখের সামনে শুধু রওজা মোবারাক পরিদৃষ্ট ছিল ।
৯ । কেয়ামতের দিবসে পর্যন্ত কেয়াম সহ দুরুদ ও ষালামের এই ধারা অব্যাহত থাকবে । দুশমনেরা তা বন্ধ করতে পারবে না ।
ইমামে আহলে সুন্নত মাওলানা আহমেদ রেজা (রহঃ) লিখেছেন :
আমরা মিলাদুন্নবীর মাহফিল জীবন ভর করে যাবো । হে নজদীগন ( আব্দুল ওয়াহাব নজদীর অনুসারীগন ) ! তোমরা জ্বলতে থাক । জ্বলে মরাই তোমাদের কাজ ।
— আলা হযরত
১০। কেয়ামতের দিবসে রওজা মোবারক অক্ষত থাকবে - ধ্বংস হবে না ।
১১। রোজ হাশরে ৭০ হাজার ফেরেস্তা হুজুর (সা) কে পরিবেস্টন করে ও জুলুছ করে খোদার দরবারে নিয়ে যাবে । নবীজির জুলুছ করা ফেরেস্তাগনের ই সুন্নত ।
১২। সে দিন খোদা হবেন হাবীব এবং নবী (সা) হবেন মাহবূব । হাদিসে উল্লেখিত " ইয়ারকাউনা " শব্দেটি বাবে নাছারা হতে উৎপন্ন ক্রিয়া পদ । মুল ধাতু " ঝিফাফুন " অর্থ মিলন । খোদার সাথে সে দিন প্রিয় মাহবুবের মিলন হবে । [2]
তথ্যসূত্র
মিলাদ ও কিয়ামের বিধান (লেখকঃ অধ্যক্ষ এম এ জলিল (রহঃ))
· আনওয়ারে আফতাবে সাদাকাত
· লোমআত
হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের উপস্থিতিতে সাহাবায়ে কেরাম মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠান করেছেন । নিম্নে কয়েকটি প্রমান উপস্থাপন করা হল-
প্রথমঃ
হযরত দারদা (রা) হতে বর্নিত আছে - তিনি বলেন আমি নবী করিম (দঃ) -এর সাথে মদিনার আবু আমের আনসারির গৃহে গমন করে দেখি- তিনি তাঁর সন্তানাদি এবং আত্বয়-স্বজনকে নবী করিম (দঃ) -এর জন্ম বৃত্তান্ত শিক্ষা দিচ্ছিলেন এবং বলছিলেন আজই সেই দিন । এতদ্দশর্নে নবী করিম (দঃ) -এরশাদ করলেন : নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা তোমার উপর রহমতের দরজা খুলে দিয়েছেন এবং আল্লাহর ফেরেস্তাগনও তোমাদের সকলের জন্য মাগফিরাত কামনা করছেন ।
— দোররে মুনাজ্জাম - আব্দুল হক এলাহাবাদি
দ্বিতীয়ঃ
ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্নিত আছে
একদিন তিনি ( ইবনে আব্বাস ) কিছু লোক নিয়ে নিজগৃহে রাসুলে কারিম (দঃ) -এর জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা করে আনন্দ উৎসব করছিলেন এবং তাঁর প্রশংসাবলী আলোচনা সহ দুরুদ ও ষালাম পেশ করেছিলেন । এমন ষময় নবী করিম (দঃ) তথায় উপস্থিত হয়ে এ আবস্থা দেখে বললেন : তোমাদের সকলের জণ্য আমার সাফায়াত অবধারিত হয়ে গেল
— ইবনে দাহইয়ার আত-তানভির ৬০৪ হিজরি
সুতরাং প্রমানীত হলো যে নবী পাকের মিলাদ শরিফ পাঠে রাসুলে পাকের সাফায়াত নসীব হবে ।
তৃতীয়
হযরত হাসসান বিন সাবের ( রা ) মিম্বারে দাঁড়িয়ে কবিতার মাধ্যমে মিলাদুন্নবী (দঃ) পাঠ করেছেন দির্ঘ কবিতার একাংশ নিম্ন উদ্ধৃত করা হলো ;
ইয়া রাসুল্লাহ ! আপনি সর্ব দোষত্রুটি হতে মুক্ত হয়ে জন্ম হয়েই জন্ম গ্রহন করেছেন । আপনার এই বর্তমান সুরত মনে হয় আপনার ইচ্ছা অনুযাযী সৃষ্টি হয়েছে । আল্লাহ তার প্রিয় নবীর নামে আযানে নিজের নামের সাথে সংযুক্ত করেছেন । এর প্রমান যখন মুয়াজ্জিন পান্জেগানা নামাজের জন্য " আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ " বলে আজান দেয় । আল্লাহ তায়ালা আপন নামের অংশ দিয়ে নবীজীর নাম রেখেছেন -তাঁকে অধিক মর্যাদাশীল করার লক্ষ্যে । এর প্রমান হচ্ছে আরসেরঅধিপতির নাম হচ্ছে " মাহমুদ" এবং ইনির নাম হলো"মুহাম্মদ "
— দিওয়ানে হাসসান
বিঃ দ্রঃ
আরবীতে মাহমুদ লিখতে পাঁচ হরফ যেমন মিম- হা -মিম - ওয়াও - দাল এবং মুহাম্মদ লিখতে যেমন মিম-হা-মিম - দাল ব্যবহৃত হয় । ব্যবধান মাত্র এক হরফের বিষয়টি খুবই ইঙ্গীতপুর্ন । একটিমাত্র 'ওয়াও' হরফের ব্যবধান ।
উক্ত মিলাদী কাসিদায় হযরত হাসসানের কয়েকটি আকিদা প্রমানীত হয়েছে । যেমন-
১। নবী করিম (দঃ) এর উপস্থিতিতে এই প্রশংসাসুচক কাসিদা পাঠ।
২। মিম্বারে দাঁড়িয়ে ( কিয়াম ) অবস্থায় হুজুরের জন্ম বৃত্তান্ত ও গুনাবলী বর্ননা করা ।
৩। নবী করীম (দঃ) সর্বত্রটি হতে মুক্ত।
৪। হুজুর (দঃ) -এর বর্তমান সুরত নবীজীর ইচ্ছানুযায়ী সৃষ্টি ।
৫। আজানের মত গুরুত্ব পুর্ন ইবাদতে আল্লাহর নামের পাশে নবীজীর নামে আল্লাহ কর্তৃক সংযোজন ।
৬।নবীজীর মুহাম্মদ নামের উৎস হচ্ছে আল্লাহর সিফাতি নাম - মাহমুদ ।
হযরত হাসসান বিন সাবের (রাঃ)এর এই মিলাদ পাঠ শুনে নবী করিম (দঃ) বলতেন
আল্লাহুম্মা আইদ্দাহু বে রূহিল কুদ্দুস
অর্থাৎ, হে আল্লাহ ! তুমি তাকে জিবরাইল মারফত সাহায্য করো
তাফছিরে খাজাইনুল ইরফান (আঃ) উল্লেখ আছে যারা নবী করিম (দঃ) -এর প্রশংসাগীতি করে , তাদের পিছনে জিবরাইল (আঃ) -এর গায়েবি মদদ থাকে [1]। মিলাদ ও কেয়ামের জন্য এটি একটী শক্ত ও উৎকৃষ্ট দলিল ।
মিলাদ ও কিয়ামের বিধান (লেখকঃ অধ্যক্ষ এম এ জলিল (রহঃ))
↑ সুরা মূজাদালাহ
মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে তাঁর দেয়া নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি ইরশাদ করেছেন-
ﻓﺎﺫﻛﺮﻭﱐ ﺍﺫﻛﺮﻛﻢ ﻭﺍﺷﻜﺮﻭﺍ ﱄ ﻭﻻﺗﻜﻔﺮﻭﻥ
সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, অকৃতজ্ঞ হয়ো না।
— আলকুরআন, সূরা-বাকারা, আয়াত নং ১৫২
তাই আল্লাহর নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপন করা প্রত্যেক মানুষের ওপর কর্তব্য। শোকরিয়া জ্ঞাপনের বিভিন্ন ধরণ রয়েছে, যা মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন ।
নিয়ামতের স্মরণ
নিয়ামতের স্মরণ করাও শোকরিয়া জ্ঞাপনের একটি মাধ্যম। নিয়ামতের স্মরণ করার মাধ্যমে আল্লাহর নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপন করা যায়। তাই মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন-
ﻳﺎ ﺑﲏ ﺍﺳﺮﺍﺋﻴﻞ ﺍﺫﻛﺮﻭﺍ ﻧﻌﻤﱵ ﺍﻟﱵ ﺍﻧﻌﻤﺖ ﻋﻠﻴﻜﻢ
হে বণীঈসরাঈল! আমার সেই অনুগ্রহকে স্মরণকর যদ্দারা আমি তোমাদেরকে অনুগৃহীত করেছিলাম ।
— সূরা-বাকারা, আয়াত নং ৪৭
তিনি অন্যত্র ইরশাদ করেছেন-
তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর।
— সূরা-আলে ইমরান, আয়াত নং:১০৩
নিয়ামতের বর্ণনা দেয়া
নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপনের আরেকটি মাধ্যম হল নিয়ামতের বর্ণনা দেয়া, অপরকে জানানো ইত্যাদি। (আল-মাওসূয়াতুল ফিকহিয়্রাহ আল-কুয়াইতিয়্যাহ, দারুস্ সালাসিল, কুয়েত, ১ম সংস্করণ, ১৪০৪ হিজরী, খ. ২৬, পৃ.১৭৮)
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
তুমি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহের কথা জানিয়ে দাও।
— সূরা:দুহা, আয়াত নং:১১
অত্র আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন মানুষদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা তাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করে।
নিয়ামত চেনা
নিয়ামতকে নিয়ামত হিসেবে চেনাও শোকরিয়া জ্ঞাপনের একটি মাধ্যম। প্রত্যেক নিয়ামত হল আল্লাহ প্রদত্ত। আর এ নিয়ামতের মর্যাদাও চিনতে হবে এবং তদনুযায়ী শোকরিয়া জ্ঞাপন করতে হবে।
ইবাদত বন্দেগী
আল্লাহর নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল ইবাদত-বন্দেগী। নামায, রোযা,হজ্জ, যাকাত ছাড়াও অন্যান্য নফল ইবাদত যেমন দান-খয়রাত, এতিম-গরীবদের খাওয়ানো ইত্যাদিও শোকরিয়া জ্ঞাপনের উত্তম মাধ্যম। ফরজ ইবাদত পালনের মাধ্যমে দায়মুক্তি পাওয়া যায়; কিন্তু অধিকতর কৃতজ্ঞ হবার জন্য নফল ইবাদতের বিকল্প নেই।
খুশি তথা ঈদ উদযাপন করা
আল্লাহর নিয়ামত পাবার দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমেও নিয়ামতের শোকরিয়া করা যায়। যেমন হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বলেছিলেন-
رَبَّنَا أَنزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِّنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا لِّأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا وَآيَةً مِّنكَ ۖ وَارْزُقْنَا وَأَنتَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ
অর্থ-হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য আসমান হতে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করুন; এটি আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য হবে ঈদ স্বরূপ এবং আপনার নিকটি হতে নিদর্শন।
— আল-কুরআন, সূরা:মায়িদা, আয়াত নং:১১৪
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ তায়ালার নিকট ফরিয়াদ করেছিলেন যেন তিনি তাদের জন্য আসমান হতে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা অবতীর্ণ করেন। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বলেছেন যে, খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা অবতীর্ণ হলে তারা সে দিনকে ঈদের দিনহিসেবে গ্রহণ করবেন। মহান রাব্বুল আলামীন তাদের ওপর সেই নিয়ামত রবিবারে অবতীর্ণ করেছিলেন বিধায় তারা আজও রবিবারকে ঈদের দিন হিসেবে মেনে থাকে এবং এদিনকে তারা ছুটির দিন হিসেবে পালন করে। কুরআন মাজীদের এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, নিয়ামত পাবার দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার স্বীকৃতি রয়েছে; কারণ তিনি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ঈদ উদযাপনের স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর উক্তি পবিত্র কুরআনে উলেখ করেছেন এবং কোন প্রকার নিষেধ করেননি। এটি অবৈধ হলে তিনি অবশ্যই তা পবিত্র কুরআনে উলেখ করতেন।
খৃষ্টানদের ওপর খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা রবিবারে অবতীর্ণ হবার কারণে সেদিনকে যদি ঈদের দিন হিসেবে উদযাপন করা যায়, তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র আগমণের দিনকে কেন ঈদের দিন হিসেবে মানা যাবে না ? অথচ তিনিই হলেন সবচেয়ে বড় নিয়ামত সুতরাং ছোট নিয়ামতের শোকরিয়া স্বরূপ সেই নিয়ামত পাবার দিনকে ঈদের দিন হিসেবে উদযাপন করা বৈধ হলে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় নিয়ামত পাবার দিনকে ঈদের দিন হিসেবে মানা ও উদযাপন করা বৈধ।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের অন্যত্র ইরশাদ করেছেন-
ﻗﻞ ﺑﻔﻀﻞ ﺍﷲ ﻭﺑﺮﲪﺘﻪ ﻓﺒﺬﻟﻚ ﻓﻠﻴﻔﺮﺣﻮﺍ ﻫﻮ ﺧﲑ ﳑﺎ ﳚﻤﻌﻮﻥ
অর্থ-‘(হে রাসুল) আপনি বলুন, (সবকিছু) আল্লাহর দয়া ও মেহেরবাণীতে। সুতরাং এরই প্রতি তারা (মুসলমান) যেন খুশি উদযাপন করে। তারা যা সঞ্চয় করছে তা থেকে এটিই শ্রেষ্ঠতর।
— আল কুরআন, সূরা:ইউনূস, আয়াত নং:৫৮
এ আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন খুশি উদযাপনের দুটি উপকরণ সাব্যস্ত করেছেন। একটি হল (ﻓﻀﻞ) আর অপরটি হল (ﺭﲪﺔ)। এতদুভয়ের মর্ম কী-এর ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত তাফসির বিশারদ আল্লামা মাহমূদ আলুসী[1], ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতী [2] ,ইমাম আবু হাইয়ান আনদালূসী [3] আলাইহিমুর রাহমান স্ব-স্ব তাফসীর গ্রন্থে, তাফসিরকারকদের শিরোমণি হযরত ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, এখানে (ﻓﻀﻞ) দ্বারা জ্ঞান এবং (ﺭﲪﺔ) দ্বারা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝানো উদ্দেশ্য। আল্লামা ইবনু জাওযী (রহ.)বলেন-
ﺍﻥ ﻓﻀﻞ ﺍﷲ ﺍﻟﻌﻠﻢ ﻭﺭﲪﺘﻪ ﳏﻤﺪ ﺻﻠﻰ ﺍﷲ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﻀﺤﺎﻙ
অর্থাৎ-‘নিশ্চয় আল্লাহর ‘ফদ্বল’ হল জ্ঞান আর ‘রহমত’ হল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যা ইমাম দাহ্হাক রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন।
— ইবনু জাওযী, যাদুল মাসীর, আল-মাকতাবুল ইসলামী, বৈরুত, ১৪০৪ হিজরী, খ.৪র্থ, পৃ.৪০।
আল্লামা তাবরিযী উলিখিত আয়াতের অর্থ করতে গিয়ে বলেন
ﻓﺎﻓﺮﺣﻮﺍ ﺑﻔﻀﻞ ﺍﷲ ﻋﻠﻴﻜﻢ ﻭﺭﲪﺘﻪ ﻟﻜﻢ ﺑﺈﻧﺰﺍﻝ ﻫﺬﺍ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ ﻭﺇﺭﺳﺎﻝ ﳏﻤﺪ ﺇﻟﻴﻜﻢ ﻓﺎﻧﻜﻢ ﲢﺼﻠﻭﻥ ﻩﻤﺎ ﻧﻌﻴﻤﺎ ﺩﺍﺋﻤﺎ
অর্থাৎ-‘তোমাদের প্রতি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করে এবং কুরআন অবতীর্ণ করে আল্লাহ তায়ালা তোমদের ওপর যে দয়া ও করুণা করেছেন, তাতে তোমরা খুশি উদযাপন কর। কেননা উভয়ের (ফদল ও রহমত) মাধ্যমে নিশ্চয় তোমরা চিরস্থায়ী নিয়ামত অর্জন করবে, যা এ নশ্বর পৃথিবী থেকে তোমাদের জন্য অধিকতর শ্রেয়।
— আল্লামা তিবরিসী, মাজমাউল বয়ান, ইনশরাতে নাসির খসরু, তেহরান, ইরান, তারিখ বিহীন, খ. ৫ম, পৃ. ১৭৭
ইমাম বাক্বির রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রখ্যাত মুফাসসির হযরত ক্বাতাদাহ্, হযরত মুজাহিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা প্রমুখ থেকে বর্ণনা করেন যে (ﷲﺍ ﻞﻀﻓ)দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। [4]
উলিখিত আয়াতে ‘রহমত’ দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা বুঝানো হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেছেন
ﻭﻣﺎ ﺃﺭﺳﻠﻨﺎﻙ ﺇﻻ ﺭﲪﺔ ﻟﻠﻌﺎﳌﲔ
‘আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।
— আল-কুরআন, সূরা: আম্বীয়া, আয়াত নং ১০৭
প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা মাহমূদ আলূসী আলাইহির রাহমাহ প্রমুখের মতে ‘রহমত’ হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি নাম। এ ছাড়াও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন বিশ্ববাসীর জন্য সবচেয়ে বড় নিয়ামত। এতে কারো দ্বিমত নেই। তাই আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন-
ﻭﻟﻘﺪ ﻣﻦ ﺍﷲ ﻋﻠﻰ ﺍﳌﺆﻣﻨﲔ ﺇﺫ ﺑﻌﺚ ﻓﻴﻬﻢ ﺭﺳﻮﻻ ﻣﻦ ﺃﻧﻔﺴﻬﻢ
অর্থাৎ-‘আল্লাহ মুমিনদের ওপর অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের নিকটি রাসূল প্রেরণ করেছেন।
— সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ১৬৪
সুতরাং বুঝা গেল যে, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্ববাসীর জন্য বড় অনুগ্রহ ও নিয়ামত। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা এ বড় অনুগ্রহ তথা রাসূলুল্লাহকে পাবার ওপর খুশি উদযাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। আর রাসূলুল্লাহকে পাবার দিন হল ‘মিলাদুন্নবী’ এবং ‘মিলাদুন্নবী’ কে কেন্দ্র করে খুশি উদযাপন করাই হল ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ যা পালন করার নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহ দিয়েছেন।
দেওবন্দীদের গুরু মাওলভী আশরাফ আলী থানভী সাহেব বলেন যে,
উলিখিত আয়াতে ‘রহমত’ ও ‘ফদ্বল’ দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামাকে বুঝানো হয়েছে, যার জন্মের ওপর আল্লাহ তায়ালা খুশি উদযাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ তিনি সকল নিয়ামতের মূল। তাই তাঁর আগমনে যতই খুশি উদযাপনকরা হোক না কেন তা কমই হবে।
— মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, মিলাদুন্নবী, জীলি কুতুবখানা, লাহুর, তারিখবিহীন, পৃ. ১৫৪, ১২০, ১২১
এ ছাড়াও উপরিউক্ত আয়াতের ‘রহমত’ শব্দ দ্বারা রাসূলুল্লাহকে খাস বা নির্দিষ্ট অর্থে বুঝানো না হলেও ‘আম’ বা ব্যাপক অর্থেও তাঁকে বুঝাতে কারো দ্বিমত থাকতে পারে না; কারণ তিনি সৃষ্টি জগতের প্রতি আল্লাহর বড় রহমত। আল্লাহর অন্যান্য নিয়ামতের মত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামা যেহেতু একটি নিয়মত, সেহেতু তার আগমনের ওপর খুশি উদযাপন করা আল্লাহর নির্দেশ পালন মাত্র। আর রাসূলুল্লাহর জন্ম উপলক্ষে খুশি উদযাপন করার নামই হল ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’।
অতএব কুরআনের আয়াত থেকে প্রমাণিত হল যে রাসূলের জন্ম উপলক্ষে খুশি উদযাপন করা আল্লাহর নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। খুশি উদযাপনের ক্ষেত্রে সকল বৈধ পন্থা গ্রহণ করা শরিয়ত সম্মত। তাই মুসলিমগণ একত্রিত হয়ে মানুষের প্রতি আল্লাহর বড় কৃপার কথা তথা রাসূলের আগমনের কথা স্মরণ করে, রাসুলের জীবন-বৃত্তান্ত বর্ণনা করে, ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে খানা-পিনা খাওয়ায় এবং দান-সদকা ইত্যাদি করার ব্যবস্থা করে। মোট কথা খুশি উদযাপনের বহিঃপ্রকাশ শরিয়ত সম্মত পন্থায় হলে কোন অসুবিধা নেই।
প্রখ্যাত আলেমগণের মতে ঈদে মিলাদুন্নবী (সঃ)
প্রসিদ্ধ তাবেঈ হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন
قال حسن البصري رضي الله تعالی عنه وددت لو کان لی مثل جبل احد ذھبا فانفقته علی قراءة مولد النبي صلی الله علیه وسلم
অর্থাৎ- যদি আমার উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকত তাহলে আমি তা রাসূলে পাক (দঃ) এর ঈদ-ই-মিলাদুন্নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাহফিলে খরচ করতাম।
— আন নেয়মাতুল কুবরা আলাল আলাম, পৃষ্ঠা নং-১১
হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রঃ) বলেন
যে ব্যক্তি ঈদ-ই-মিলাদুন্নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ উপস্থিত হয়ে তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করেছে, সে ঈমানের সফলতা লাভ করেছে।
— আন নেয়মাতুল কুবরা আলাল আলাম, পৃষ্ঠা নং-১১
হযরত মারুফ কারখী (রঃ) বলেন
যে ব্যক্তি ঈদ-ই-মিলাদুন্নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপলক্ষে পানাহারের আয়োজন করে মুসলিমদের ভাইদের একত্রিত করে, আলোকসজ্জা করে, নতুন পোষাক পরিধান করে এবং খুশবো, আতোর, গোলাপ ও লোবান প্রয়োগে নিজেকে সুগন্ধিযুক্ত করে; রোজ কিয়ামতে প্রতম শ্রেণীর নবীদের সাথে তার হাশর হবে এবং ইল্লীঈনের সর্বোচ্চ স্থানে সে অবস্থান করবে।
— আন নেয়মাতুল কুবরা আলাল আলাম, পৃষ্ঠা নং-১১
শাফেঈ মাযহাবের প্রবর্তক ইমাম শাফেঈ (রঃ) বলেন
যদি কোন ব্যক্তি ঈদ-ই-মিলাদুন্নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপলক্ষে মুসলিম ভাইদেরকে খাবার তৈরী করে মজলিসে আপ্যায়ন করে ও ইবাদাত সম্পন্ন করে, রোজ কিয়ামতে সিদ্দীকিন, শাহাদা ও সালেহীনদের সাথে তার হাশর হবে এবং জান্নাতুন নাঈমে সে অবস্থান করবে।
— আন নেয়মাতুল কুবরা আলাল আলাম, পৃষ্ঠা নং-১৩
৯ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রঃ) বলেন
ইমাম সৈয়ুতী কৃত ‘আল-হাওয়ী লিল্ ফাতাওয়ী’ কিতাবের প্রচ্ছদ
আল-হাওয়ী লিল্ ফাতাওয়ী কিতাবে মিলাদুন্নবী (সঃ) এর স্বপক্ষে ইমাম জালালুদ্দিন আস সৈয়ুতী (রহঃ) এর বক্তব্য
أن أصل عمل المولد الذي هو اجتماع الناس وقراءة ما تيسر من القرآن ورواية الأخبار الواردة في مبدأ أمر النبي صلى الله عليه وسلم وما وقع في مولده من الآيات ثم يمد لهم سماط يأكلونه وينصرفون من غير زيادة على ذلك هو من البدع الحسنة التي يثاب عليها صاحبها لما فيه من تعظيم قدر النبي صلى الله عليه وسلم وإظهار الفرح والاستبشار بمولده الشريف
মীলাদুন্নবী (ﷺ)উদযাপন যা মূলতঃ মানুষদের সমবেত করা, কুরআনের অংশ-বিশেষ তেলাওয়াত, মহানবী (ﷺ)-এর ধরাধামে শুভাগমন (বেলাদত) সংক্রান্ত ঘটনা ও লক্ষ্মণগুলোর বর্ণনা পেশ, অতঃপর তবাররুক (খাবার) বিতরণ এবং সবশেষে সমাবেশ ত্যাগ, তা উত্তম বেদআত (উদ্ভাবন); আর যে ব্যক্তি এর অনুশীলন করেন তিনি সওয়াব অর্জন করেন, কেননা এতে জড়িত রয়েছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মহান মর্যাদার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং তাঁর সম্মানিত বেলাদতের প্রতি খুশি প্রকাশ।
— ইমাম সৈয়ুতী কৃত ‘আল-হাওয়ী লিল্ ফাতাওয়ী’, ১ম খণ্ড, ২৯২ পৃষ্ঠা, মাকতাবা আল-আসরিয়া, বৈরুত, লেবানন হতে প্রকাশিত
তিনি তার স্ব-রচিত “আল উয়াছায়েল ফী শরহিশ শামাইল” গ্রন্থে উল্লেখ আরও করেন,
যে গৃহে বা মসজিদে কিংবা মহল্লায় মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপলক্ষ্যে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। তখন অবশ্যই সে গৃহ বা মসজিদ বা মহল্লা অসংখ্য ফেরেশতা দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে এবং উক্ত স্থান সমূহে যারা অবস্থান করে তাদের জন্য তারা সালাত পাঠ করে। (অর্থাৎ তাদের গুণাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে) এবং আল্লাহ তায়ালা তাদের সবাইকে সাধারণভাবে রহমত ও সন্তুষ্টি দ্বারা ভূষিত করেন। অতঃপর নূরের মালা পরিহিত ফেরেশতাকুল বিশেষতঃ হযরত জিব্রাঈল, মীকাঈল, ঈস্রাফীল ও আজরাঈল আলাইহিস সালাম মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপলক্ষ্যে মাহফিল আয়োজনকারীর গুণাহ মাফের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন।
তিনি আরো বলেন,
যে মুসলমানের গৃহে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মীলাদ পাঠ করা হয়, সে গৃহ ও গৃহে বসবাসকারী ব্যক্তি দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অগ্নি, পানি, পরনিন্দা, কুদৃষ্টি ও চুরি ইত্যাদির আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকবে। সে ঘরে যার মৃত্যু হবে সে মৃত ব্যক্তি কবরে মুনকার নকীরের প্রশ্নের উত্তর অতি সহজে দিতে পারবে। যে ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মীলাদ কে সম্মান করতে চায়, তার জন্য ইহাই যথেষ্ট। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তির নিকট নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মীলাদের কোন মর্যাদা নেই, তার অন্তর এত নিকৃষ্ট হয়ে পড়বে যে, তার সামনে হুযুরপুর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিশ্বজোড়া প্রশংসাগীতি উচ্চারিত হলেও তার অন্তরে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য বিন্দুমাত্র মুহাব্বতের উদ্রেক হবে না।
— আন নেয়মাতুল কুবরা আলাল আলাম, পৃষ্ঠা নং- ১৩ ও ১৪
ইমাম ইবন কাসীর (রঃ) বলেন
আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া উর্দু কিতাবের প্রচ্ছদ
আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া উর্দু কিতাবের যে অংশে ইবনে কাসির (রহঃ) মিলাদ শরীফের পক্ষে লিখেছেন
ইবনে কাসীর, যাকে সালাফী/ওহাবীরা তাফসীর ও ইতিহাস শাস্ত্রে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করে থাকে, তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইসলামের মুজাহিদ সুলতান গাযী সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ভগ্নিপতি শাহ মালিক আল-মুযাফফর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। অথচ সালাফীরাই ইবনে কাসীরের কথাকে বিকৃত করে এই মর্মে মিথ্যে ছড়িয়েছে যে মুযাফফর শাহ একজন ফাসেক, নিষ্ঠুর ও বেদআতী শাসক ছিলেন (নাউযুবিল্লাহ)। প্রকৃতপক্ষে ইবনে কাসীর লিখেন:
أحد الاجواد والسادات الكبراء والملوك الامجاد له آثار حسنة وقد عمر الجامع المظفري بسفح قاسيون وكان قدهم بسياقه الماء إليه من ماء بذيرة فمنعه المعظم من ذلك واعتل بأنه قد يمر على مقابر المسلمين بالسفوح وكان يعمل المولد الشريف في ربيع الاول ويحتفل به احتفالا هائلا وكان مع ذلك شهما شجاعا فاتكا بطلا عاقلا عالما عادلا رحمه الله وأكرم مثواه وقد صنف الشيخ أبو الخطاب ابن دحية له مجلدا في المولد النبوي سماه التنوير في مولد البشير النذير فأجازه على ذلك بألف دينار وقد طالت مدته في الملك في زمان الدولة الصلاحية وقد كان محاصر عكا وإلى هذه السنة محمودالسيرة والسريرة قال السبط حكى بعض من حضر سماط المظفر في بعض الموالد كان يمد في ذلك السماط خمسة آلاف راس مشوى وعشرة آلاف دجاجة ومائة ألف زبدية وثلاثين ألف صحن حلوى
(মুযাফফর শাহ) ছিলেন একজন উদার/সহৃদয় ও প্রতাপশালী এবং মহিমান্বিত শাসক, যাঁর সকল কাজ ছিল অতি উত্তম। তিনি কাসিইউন-এর কাছে জামেয়া আল-মুযাফফরী নির্মাণ করেন.....(প্রতি) রবিউল আউয়াল মাসে তিনি জাঁকজমকের সাথে মীলাদ শরীফ (মীলাদুন্নবী) উদযাপন করতেন। উপরন্তু, তিনি ছিলেন দয়ালু, সাহসী, জ্ঞানী, বিদ্বান ও ন্যায়পরায়ণ শাসক - রাহিমুহুল্লাহ ওয়া একরাম -শায়খ আবুল খাত্তাব (রহ:) সুলতানের জন্যে মওলিদুন্ নববী সম্পর্কে একখানি বই লিখেন এবং নাম দেন ‘আত্ তানভির ফী মওলিদ আল-বাশির আন্ নাযীর’। এ কাজের পুরস্কারস্বরূপ সুলতান তাঁকে ১০০০ দিনার দান করেন। সালাহিয়া আমল পর্যন্ত তাঁর শাসন স্থায়ী হয় এবং তিনি ’আকা’ জয় করেন। তিনি সবার শ্রদ্ধার পাত্র থেকে যান। আস্ সাবত্ এক ব্যক্তির কথা উদ্ধৃত করেন যিনি সুলতানের আয়োজিত মওলিদ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন; ওই ব্যক্তি বলেন: ‘অনুষ্ঠানে সুলতান ভালভাবে রান্নাকৃত ৫০০০ ছাগল, ১০,০০০ মোরগ, ১ লক্ষ বৌল-ভর্তি দুধ এবং ৩০,০০০ ট্রে মিষ্টির আয়োজন করতেন’।
— তারিখে ইবনে কাসীর, ‘আল-বেদায়াহ ওয়ান্ নেহায়া’ ১৩তম খণ্ড, ১৭৪ পৃষ্ঠা
বুখারী শরীফের ব্যাখাকার বিশ্ববিখ্যাত মোহাদ্দিস আল্লামা কুস্তোলানী রহমাতুল্লাহে আলাইহি (মৃত্যুঃ ৯২৩ হিজরী) বলেন-
যে ব্যক্তি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শুভাগমনের মোবারক মাসের রাতসমূহকে ঈদ হিসেবে গ্রহণ করে, আল্লাহ তার উপরে রহমত বর্ষণ করেন। আর উক্ত রাত্রকে ঈদ হিসেবে উদযাপন করবে এ জন্য যে, যাদের অন্তরে (নবী বিদ্বেষী) রোগ রয়েছে। তাদের ঐ রোগ যেন আরো শক্ত আকার ধারণ করে এবং যন্ত্রণায় অন্তর জ্বলে পুড়ে যায়।
— শরহে জুরকানী আলাল মাওয়াহেব, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ২৬২
বুখারী শারীফের আরেক অন্যতম নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’ এর লেখক ইমাম ইবন হাজর আসকলানী (রঃ) বলেন-
ইমাম জালালুদ্দিন আস সুয়ুতী (রহঃ) কৃত হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মওলিদ কিতাবের প্রচ্ছদ
হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মওলিদ কিতাবের পৃষ্ঠা নং ৬৩
হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মওলিদ কিতাবের পৃষ্ঠা নং ৬৪
হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মওলিদ কিতাবের পৃষ্ঠা নং ৬৫
মহানবী (দ:)-এর মীলাদ দিবস উদযাপন সম্পর্কে হযরত ইমামকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি লিখিতভাবে যে উত্তর দেন তা নিম্নরূপ: মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপনের উৎস বলতে এটি এমন এক বেদআত (উদ্ভাবন) যা প্রথম তিন শতকের সালাফ আস্ সালেহীন (পুণ্যাত্মাবৃন্দ) কর্তৃক আমাদেরকে জ্ঞাত করানো হয় নি, যদিও এতে প্রশংসনীয় ও প্রশংসনীয় নয় উভয় দিকই বিদ্যমান। কেউ প্রশংসনীয় দিকগুলোগ্রহণ করে প্রশংসনীয় নয় এমন দিকগুলো বর্জন করায় যত্নবান হলে তা বেদআতে হাসানা তথা কল্যাণময় নতুন প্রথা হবে। আর তা না হলে এর উল্টো হবে। এ বিষয়ের বৈধতা প্রতীয়মানকারী একটি নির্ভরযোগ্য শরীয়তের দলিল আমার সামনে এসেছে, আর তা হলো বুখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত সহীহ হাদীস যা’তে বর্ণিত হয়েছে যে মহানবী (দ:) মদীনা মোনাওয়ারায় হিজরত করে দেখতে পান সেখানকার ইহুদীরা ১০ই মহররম (আশুরা) তারিখে রোযা রাখেন।
— হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মওলিদ, ৬৩ পৃষ্ঠা
এমতাবস্থায় তিনি তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা উত্তর দেন, ‘এই দিনে আল্লাহতা’লা ফেরাউনকে পানিতে ডুবিয়ে মূসা (আ:)-কে রক্ষা করেন। তাই আমরা মহান প্রভুর দরবারে এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে রোযা রেখে থাকি।’ এই ঘটনা পরিস্ফুট করে যে আল্লাহতা’লার রহমত অবতরণের কিংবা বালা-মসীবত দূর হওয়ার কোনো বিশেষ দিনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, সেই উদ্দেশ্যে বার্ষিকী হিসেবে তা উদযাপনের সময় নামায, রোযা, দান-সদকাহ বা কুরআন তেলাওয়াতের মতো বিভিন্ন এবাদত-বন্দেগী পালন করা শরীয়তে জায়েয। আর রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর মীলাদের (ধরণীতে শুভাগমন দিবসের) চেয়ে আল্লাহর বড় রহমত কী-ই বা হতে পারে? এরই আলোকে প্রত্যেকের উচিত হযরত মূসা (আ:) ও ১০ই মহররমের ঘটনার (দালিলিক ভিত্তির) সাথে সঙ্গতি রেখে মীলাদুন্নবী (দ:) দিবস উদযাপন করা; তবে যাঁরা এটি বিবেচনায় নেন না, তাঁরা (রবিউল আউয়াল) মাসের যে কোনো দিন তা উদযাপনে আপত্তি করেন না; অপর দিকে কেউ কেউ সারা বছরের যে কোনো সময় (দিন/ক্ষণ) তা উদযাপনকে কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই বৈধ জেনেছেন।
— হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মওলিদ, ৬৪ পৃষ্ঠা
আমি মওলিদের বৈধতার দলিল সুন্নাহ’র আরেকটি উৎস থেকে পেয়েছি (আশুরার হাদীস থেকে বের করা সিদ্ধান্তের বাইরে)। এই হাদীস ইমাম বায়হাকী (রহ:) হযরত আনাস (রা:) থেকে বর্ণনা করেন: ‘হুযূর পাক (দ:) নবুয়্যত প্রাপ্তির পর নিজের নামে আকিকাহ করেন; অথচ তাঁর দাদা আবদুল মোত্তালিব তাঁরই বেলাদতের সপ্তম দিবসে তাঁর নামে আকিকাহ করেছিলেন, আর আকিকাহ দু’বার করা যায় না। অতএব, রাসূলে খোদা (দ:) বিশ্বজগতে আল্লাহর রহমত হিসেবে প্রেরিত হওয়ায় মহান প্রভুর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যে এটি করেছিলেন, তাঁর উম্মতকে সম্মানিত করার জন্যেও, যেমনিভাবে তিনি নিজের ওসীলা দিয়ে দোয়া করতেন। তাই আমাদের জন্যেও এটি করা উত্তম হবে যে আমরা মীলাদুন্নবী (দ:) দিবসে কৃতজ্ঞতাসূচক খুশি প্রকাশার্থে আমাদের দ্বীনী ভাইদের সাথে সমবেত হই, মানুষদেরকে খাবার পরিবেশন করি এবং অন্যান্য সওয়াবদায়ক আমল পালন করি।’ এই হাদীস পূর্বোক্ত মহানবী (দ:)-এর দ্বারা মীলাদ ও নবুয়্যত-প্রাপ্তির দিবস পালনার্থে সোমবার রোযা রাখার হাদীসকে সমর্থন দেয়।
— হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মওলিদ, ৬৪-৬৫ পৃষ্ঠা
হযরত সাররী সাক্বত্বী (রঃ) বলেন
যে ব্যক্তি মিলাদ শারীফ পাঠ বা মিলাদুন্নাবী (সাঃ) উদযাপন করার জন্য স্থান নির্দিষ্ট করল, সে যেন তার জন্য জান্নাতে রওজা বা বাগান নির্দিষ্ট করল। কেননা সে তা হুজুর পাক (দঃ) এর মহব্বতের জন্যই করেছে।
— আন নেয়মাতুল কুবরা আলাল আলাম, পৃষ্ঠা নং- ১৩
১১’শ শতাব্দীর বা সহস্রাব্দের মুজাদ্দিদ আলফে সানী (রঃ) বলেনঃ
دیگر درباب مولود خوانی اندراج یا فتہ بود در نفس قران خواندن بصوت حسن وقصائد نعت ومنقبت خواندن چہ مضائقہ است؟ ممنوع تحریف وتغیر حروف قران است والتزام رعایت مقامات نغمہ وتبرید صوت باں طریق الحان باتصفیق منا سب انکہ در شعر نیز غیر مبارح است. اگر ہر نہجے خوانند کہ تحریفے در کلمات قران واقع نشود و در قصائد خواندن شروط مذکورہ متحقق نگردد رواں ہم بغرض صحیح تجویز نما یند چہ مانع است؟
অর্থাৎ সুমিষ্ট আওয়াজে পবিত্র কুরআন শরীফ পাঠ এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শানে সুন্দর ক্বাছীদাবলী আবৃত্তি করতে কি বাধা আছে? নিষিদ্ধ হচ্ছে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার হরফ বা অক্ষর সমূহের মধ্যে পরিবর্তন বা গানের তাল বা ছন্দ অবলম্বন স্বরের উত্থান-পতন যা সাধারণ কবিতার মধ্যেও জায়িয নেই। যদি পবিত্র মীলাদ শরীফ এমনভাবে পড়া হয় যে, পবিত্র কুরআন শরীফের মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তন আপতিত না হয় এবং পবিত্র ক্বাছীদা শরীফ আবৃত্তির মধ্যে উপরোক্ত গানের ছন্দ বা তালের অনুসরণ করা না হয়, তাহলে এরূপ পবিত্র মীলাদ শরীফ পাঠে কি বাধা আছে ?
— মাকতুবাতে ইমাম রব্বানী, ৩য় খন্ড, মাকতুব নং ৭২
ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বপ্রথম মোহাদ্দিস হযরত শায়খ আবদুল হক মোহাদ্দেসে দেহলভী রহমাতুল্লাহে আলাইহি বলেন-
যে ব্যক্তি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রাত্রকে ঈদ হিসেবে পালন করে, তার উপর আল্লাহ তায়ালা রহমত নাযিল করেন। আর যার মনে হিংসা এবং [নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দুশমনির] রোগ রয়েছে, তার ঐ (নবী বিদ্বেষী) রোগ আরও শক্ত আকার ধারণ করে।
— মা সাবাতা বিসসুন্নাহ (উর্দু) পৃষ্ঠা নং-৮৬
উল্লেখ্য যে উপরিল্লিখিত মুহাদ্দিসগণের উছিলায় আজ আমরা হাদীস শাস্ত্র এই উপমহাদেশে পেয়েছি । অন্যথায় বর্তমানের কোন আলেমদের অস্তিত্বই পাওয়া যেত না । এজন্য তাঁদের এলেমের কাছেই বর্তমান আমরা সকল মুসলমানগণ চিরঋনী ।
আল্লামা ইমাম শিহাব উদ্দিন আহমদ কুস্তোলানী রহমাতুল্লাহে আলাইহি “মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া” নামক কিতাবে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দুগ্ধপান শীর্ষক অধ্যায়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-
আবু লাহাবের আযাদকৃত দাসী সুয়াইবাহ তাকে (হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দুধ পান করিয়েছেন। যাকে আবু লাহাব তখনই আযাদ করেছিলো তখন তিনি তাকে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেলাদত শরীফের শুভ সংবাদ শুনিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, একদা আবু লাহাবকে তার মৃত্যুর পর স্বপ্নে দেখা গিয়েছিলো। (হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এক বছর পর স্বপ্ন দেখেছিলেন) তখন তাকে বলা হলো “তোমার কি অবস্থা?” সে বলল, দোজখেই আছি। তবে প্রতি সোমবার রাতে আমার শাস্তি কিছুটা শিথিল করা হয়; আর আমি আমার এ আঙ্গুল দুটির মধ্যখানে চুষে পানি পানের সুযোগ পাই। আর তখন সে তার আঙ্গুলের মাথা দিয়ে ইশারা করলো। আর বলল, আমার শাস্তির শিথিলতা এ জন্য যে, সুয়াইবা যখন আমাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেলাদতের সুসংবাদদিয়েছিলো, তখন তাকে আমি আযাদ করে দিয়েছিলাম এবং সে হুযুরকে দুগ্ধপান করিয়েছে।
তিনি আরো বলেন-
এতদভিত্তিতে, আল্লামা মোহাদ্দিস ইবনে জাযরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন ঐ আবু লাহাব কাফির, যার তিরস্কারে কোরআনের সূরা নাযিল হয়েছে। মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এ আনন্দ প্রকাশের কারণে জাহান্নামে পুরস্কৃত হয়েছে। এখন উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ঐ একত্ববাদী মুসলমানের কি অবস্থা? যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেলাদতে খুশি হয় এবং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভালবাসায় তার সাধ্যনুযায়ী খরচ করে। তিনি জবাবে বলেন- আমার জীবনের শপথ! নিশ্চয়ই পরম করুণাময় আল্লাহ তাকে আপন ব্যাপক করুণায় নিয়ামতপূর্ণ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
— শরহে জুরকানী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ২৫৮-২৬২
আবু লাহাবের উক্ত ঘটনা সর্বশ্রেষ্ঠ হাদীস গ্রন্থ পবিত্র বোখারী শরীফেও বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটি নিম্নরুপ
হযরত ওরওয়া ইবনে যোবাইয়ের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সুয়াইবাহ আবু লাহাবের দাসী ছিলেন। আবু লাহাব হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেলাদতের সুসংবাদে দেওয়ার কারণে (আনন্দিত হয়ে) সুয়াইবাহকে আযাদ করে দিয়েছিলো। অতঃপর সুয়াইবাহ হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দুধ পান করিয়েছিলেন। এরপর যখন আবু লাহাব মৃত্যুবরণ করল, তকন (এক বছর পর) তারঘনিষ্টদের কেউ [হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু] তাকে স্বপ্নে শোচনীয় অবস্থায় দেখে তার উদ্দেশ্যে বলেন, “তোমার অবস্থা কেমন?” আবু লাহাব তদুত্তরে বললো, “তোমাদের নিকট থেকে আসার পর আমি কোন প্রকার শান্তি পাইনি, কেবল আমি যে (আল্লাহর হাবীবের জন্ম সংবাদ বা মীলাদ শরীফের খুশিতে) সুয়াইবাহকে (তর্জনী ও মধ্যমা দুটি আঙ্গুলের ইশারায়) আযাদ করেছিলাম, ঐ কারণে (প্রতি সোমবার আঙ্গুল দু’টির মধ্যে কিছু পানি জমে থাকে) আমি ওই পানি চুষে থাকি ও প্রতি সোমবার আযাবকে হাল্কা বোধ করে থাকি।
— বুখারী শরীফ, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা নং-৭৬৪
বোখারী শরীফে উক্ত পৃষ্ঠায়ই শেষের দিকে এ হাদীসের পাদটিকায় বর্ণিত আছে :
সুয়াইবাহ আবু লাহাবকে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মের সুসংবাদ দেওয়ার কারণে আবু লাহাব তাকে আযাদ করে দিয়েছিলো। অতঃপর এ আযাদ করাটা (পরকালে) আবু লাহাবের উপকারে এসেছে। এ কাজ তার উপকারে আসার অর্থ হলো- তার এ কর্ম হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বরকতে অবশিষ্ট ছিল। অন্যান্য কাজের ন্যায় বিনষ্ট হয়ে যায়নি।
আল্লামা কুস্তোলানী রহমাতুল্লাহে আলাইহি স্বীয় মাওয়াহিব গ্রন্থে আরো বলেন-
প্রতিটি যুগে মুসলমানগণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেলাদত শরীফের মাসে মাহফিলের আয়োজন করে আসছেন। উন্নত মানের খাবারের আয়োজন করেন, এর রাতগুলোতে বিভিন্ন ধরণের সাদক্বাহ- খায়রাত করেন, আনন্দ প্রকাশ করতে থাকেন, পুন্যময় কাজ বেশি পরিমাণে করেন এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেলাদত শরীফের আলোচনার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আসেন। ফলে আল্লাহর অসংখ্য বরকত ও ব্যাপক অনুগ্রহ প্রকাশ পায়। এর বিশেষত্বের এটাও পরীক্ষিত যে, নিঃসন্দেহে গোটা বছরই তারা নিরাপদে থাকে এবং তাদের উদ্দেশ্য দ্রুত সফল হয়ে থাকে।
(ইমাম কুস্তোলানী রহমাতুল্লাহে আলাইহি দো’আ করে বলেন) অতএব, ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহ দয়া করুন, যে মীলাদুন্নবী মোবারক মাসের রাতগুলোকে ঈদ হিসেবে উদযাপন করে- এ লক্ষ্যে যেন মুনাফিকদের অন্তরে অসহনীয় জ্বালা সৃষ্টি হয়।
— শরহে জুলকানী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ২৬১-২৬৩
ইমাম শামসুদ্দিন দিমিস্কি (রঃ) বলেনঃ
হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মওলিদ কিতাবের পৃষ্ঠা নং ৬৬
قد صح أن أبا لهب يخفف عنه عذاب النار في مثل يوم الاثنين لإعتاقه ثويبة سرورا بميلاد النبي صلى الله عليه وسلم ثم أنشد:
إذا كان هذا كافرا جاء ذمه - وتبت يداه في الجحيم مخلدا أتى أنه في يوم الاثنين دائما - يخفف عنه للسرور بأحمدا فما الظن بالعبد الذي طول عمره - بأحمد مسرورا ومات موحدا
এটি প্রমাণিত যে আবু লাহাবের (পারলৌকিক) অনলে জ্বলবার শাস্তি প্রতি সোমবার লাঘব করা হয়, কেননা সে মহানবী (দ:)-এর বেলাদতে খুশি হয়েছিল এবং তার দাসী সোয়াইবিয়াকে মুক্ত করে দিয়েছিল (সুসংবাদ দেয়ার জন্যে)। আবু লাহাবের মতো অবিশ্বাসী, যার চিরস্থায়ী আবাস দোযখ এবং যার জন্যে সূরা লাহাব অবতীর্ণ হয়েছে, সে যদি আযাব থেকে তাখফিফ (নিষ্কৃতি) পায় প্রতি সোমবার, তাহলে ভাবুন সেই মো’মেন ব্যক্তির কী শান যিনি সারা জীবন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর বেলাদতে খুশি প্রকাশ করেছিলেন এবং আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস নিয়ে ইন্তেকাল করেছেন।
— ইমাম দামেশকী কৃত ‘মওরিদ আস্ সাফা ফী মওলিদ আল-হাদী’ এবং ইমাম সৈয়ুতী প্রণীত ‘হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মওলিদ’, ৬৬ পৃষ্ঠা
বিরোধীবাদীরা বলে থাকে এটি মহানবী (সাঃ) এর ওফাত দিবস। তাই এটি পালন করা উচিত নয়। এর জবাবও ৯ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ দিয়ে গেছেন খুব সুন্দরভাবে।
أن ولادته صلى الله عليه وسلم أعظم النعم علينا ووفاته أعظم المصائب لنا والشريعة حثت على إظهار شكر النعم والصبر والسلوان والكتم عند المصائب وقد أمر الشرع بالعقيقة عند الولادة وهي إظهار شكر وفرح بالمولود و لم يأمر عند الموت بذبح ولا غيره بل نهى عن النياحة وإظهار الجزع فدلت قواعد الشريعة على أنه يحسن في هذا الشهر إظهار الفرح بولادته صلى الله عليه وسلم دون إظهار الحزن فيه بوفاته
বিশ্বনবী (দ:)-এর বেলাদত হলো (আল্লাহর) সর্ববৃহৎ নেয়ামত (আশীর্বাদ); আর তাঁর বেসাল মহা দুর্যোগ। ধর্মীয় বিধান আমাদের প্রতি তাকিদ দেয় যেন আমরা আল্লাহর নেয়ামতের শোকরগুজারি (কৃতজ্ঞতা প্রকাশ) করি এবং দুর্যোগের মুহূর্তে ধৈর্য ধরি ও শান্ত থাকি। শরীয়তের আইনে আমাদের আদেশ দেয়া হয়েছে কোনো শিশুর জন্মে পশু কোরবানি দিতে (এবং ওর গোস্ত গরিবদের মাঝে বিতরণ করতে)। এটা ওই শিশুর জন্মোপলক্ষে কৃতজ্ঞতা ও খুশি প্রকাশের নিদর্শন। পক্ষান্তরে, মৃত্যুর সময় পশু কোরবানি দিতে শরীয়ত আমাদের আদেশ দেয় নি। উপরন্তু, শোক প্রকাশ বা মাতম করতে শরীয়তে মানা করা হয়েছে। অতএব, মীলাদুন্নবী (দ:)-এর পুরো মাসব্যাপী খুশি প্রকাশ করার পক্ষে ইসলামী বিধানের রায় পরিদৃষ্ট হয়; আর তাঁর বেসাল উপলক্ষে শোক প্রকাশ না করার পক্ষে মত দেয়া হয়।
— হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মওলিদ, ৫৪-৫৫ পৃষ্ঠা; ইমাম সৈয়ুতী প্রণীত ’আল-হাওয়ী লিল্ ফাতাওয়ী’, ১ম খণ্ড, ২৯৮ পৃষ্ঠা, মাকতাবা আল-আসরিয়া, বৈরুত, লেবানন হতে প্রকাশিত
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী রহমাতুল্লাহে আলাইহি তার রচিত “আদ দুররুস সামীন ফী মুবাশশারাতিন নবীয়্যিল আমীন” কিতাবের ৯ম পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ
আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান আমাকে অবহিত করে বলেন, আমি প্রতি বছরই নবীকুল সর্দার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মীলাদ উপলক্ষ্যে বিরাট খাবার আয়োজন করে আসছিলাম। অতঃপর এক বছর খাবারের আয়োজন করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সুতরাং অল্প ভাজ্যকৃত চনা ব্যতীত আর কিছুই আমি জোগাড় করতে পারিনি। কাজেই সেগুলো উপস্থিত লোকদের মাঝে বন্টন করে দিলাম। অতঃপর আমি স্বপ্নে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাক্ষাত লাভ করে ধন্য হলাম। দেখলাম, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামনে ঐ চনাগুলো মওজুদ আছে। তখন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন অত্যন্ত আনন্দিত ও হাস্যোজ্জল।
— তথ্যসূত্রঃ ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপন, পৃষ্ঠা নং-৮১, ফতুয়ায়ে রশীদিয়া, পৃষ্ঠা নং- ১৩৭, হাকিকতে মীলাদ, পৃষ্ঠা নং-২৮
“ফয়ূযুল হারামাইন” কিতাবে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী রহমাতুল্লাহে আলাইহি আরো বলেনঃ
আমি এর পূর্বে মক্কা মু’আযযামায় বেলাদত শরীফের বরকতময় ঘরে উপস্থিত ছিলাম। আর সেখানে লোকজন সমবেত হয়ে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর একত্রে দরুদ শরীফ পাঠা করছিলেন। তার (হুযুরের) শুভাগমনের সময় সংঘটিত অলৌকিক ঘটনাবলী ও তার নবুয়ত প্রকাশের পূর্বে সংঘটিত ঘটনাবলী আলোচনা করছিলেন। তারপর আমি সেখানে এক মিশ্র নূরের ঝলক প্রত্যক্ষ করলাম। আমি বলতে পারিনি যে, এ নূরগুলো চর্মচক্ষে দেখেছিলাম এবং এটাও বলতে পারি না যে, এগুলো কেবল মাত্র অন্তর চক্ষুতে দেখেছিলাম। এ দুটোর মধ্যে প্রকৃত ব্যাপার কি ছিল, তা আল্লাহ পাকই ভাল জানেন। অতঃপর আমি গভীরভাবে চিন্তা করলাম এবং উপলব্ধি করতে পারলাম যে, এই নূর বা জ্যোতি ঐ সব ফিরিশতার, যারা এ ধরণের মজলিস ও উল্লেখযোগ্য (ধর্মীয়) স্থানসমূহে (জ্যোতি বিকিরণের জন্য) নিয়োজিত থাকেন। আমার অভিমত হল সেখানে ফিরিশতাদের নূর ও রহমতের নূরের সংমিশ্রণ ঘটেছে।
— ফয়ূযুল হারামাইন (আরবী-উর্দু), পৃষ্ঠা নং- ৮০-৮১
শায়খ আলাউইয়ী মালেকী (রহঃ)
মক্কা মেয়াযযমায় অবস্থিত পবিত্র মসজিদের প্রাক্তণ শায়খ আলাউইয়ী মালেকী (বেসাল: ১৩৯১ হিজরী) তাঁর ”ফাতাওয়া” গ্রন্থে বলেন, মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন তিন ভাগে বিভক্ত।
প্রথমতঃ মহানবী (দ:)-এর মোবারক নামগুলো, তাঁর মহান বংশ পরিচয়, তাঁর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমনের বৃত্তান্ত ও এর সাথে জড়িত নানা অত্যাশ্চর্য ঘটনা, তাঁর রেসালাত, ইসলাম ধর্ম প্রচারের সময় বিভিন্ন দুঃখ-কষ্টে ও অন্যায়-নিপীড়নে তাঁর ধৈর্য-সহ্য, তাঁর মদীনায় হিজরত, এবং তাঁর বেসাল তথা খোদার সাথে পরলোকে মিলনপ্রাপ্তির কথা উল্লেখ করা; এগুলোর সবই তাঁর প্রতি মহব্বত ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধিতে সহায়ক।
দ্বিতীয়তঃ মহানবী (দ:)-এর কোনো নাম মোবারক উচ্চারণের সাথে সাথে তাঁর প্রতি সালাওয়াত (দরুদ-সালাম) পাঠও এসে পড়ে, যা সূরা আহযাব, ৫৬ নং আয়াতেরসাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এরশাদ হয়েছে,
হে ঈমানদার সকল! তোমরাও মহানবী (দ:)-এর প্রতি দরুদ ও (ভক্তিসহ) সালাম প্রেরণ করো।
তৃতীয়তঃ মহানবী (দ:)-এর নিখুঁত বৈশিষ্ট্য, অনুকরণীয় আচার-ব্যবহার, মর্যাদাপূর্ণ ঐতিহ্য ও উন্নত নৈতিকতার উল্লেখ করা। এগুলো তাঁর পথ, রীতি-নীতি ও আচার-আচরণের অনুসরণে কোনো ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। ইয়েমেন দেশের মানুষ মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপনে সমবেত হলে সেখানকার উলামাবৃন্দ এ উপলক্ষে তাঁদেরকে সঠিক পথ সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন এবং ওই পথের দিকে হেদায়াত দিতেন।
শায়খ মোহাম্মদ আল-খাদর হুসাইন (রহঃ)
মিসরের জামে’ আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শায়খ মোহাম্মদ আল-খাদর হুসাইন (ওফাত:১৩৭৮ হিজরী) ‘আল-হেদায়া’ ম্যাগাজিনে বলেন, মহানবী (দ:)-এর মীলাদ উদযাপন তাঁর সাহাবা তথা সাথীবৃন্দের রীতি-নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।সর্ব-হযরত হাসসান বিন সাবেত (রা:), আলী ইবনে আবি তালেব (ক:), আল-বারাআ’ ইবনে ‘আজিব (রা:) ও আনাস বিন মালিক (রা:) সে সকল বুযূর্গের অন্তর্ভুক্ত যাঁদের পদ্য বা অন্য কোনো পন্থায় কৃত মহানবী (দ:)-এর প্রশংসা-স্তুতি এবং তাঁরই মহান (সত্তাগত) বৈশিষ্ট্য, আচার-ব্যবহার ও গুণাবলী সম্পর্কে প্রদত্ত বর্ণনা মানুষেরা শুনতেন।
শায়খ আবদুল মজীদ মাগরেবী (রহঃ)
শায়খ আবদুল মজীদ মাগরেবী (ওফাত:১৩৫২ হিজরী) তাঁর প্রণীত ‘আল-মিনহাজ ফীল্ মে’রাজ’ গ্রন্থে বলেন, মুসলমান সমাজ যে সব ভাল আচার-অনুষ্ঠান পালন করতেন, তার মধ্যে ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:)-এর বাৎসরিক মাহফিল অন্যতম। তাঁরাসমবেত হয়ে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর মীলাদের বৃত্তান্ত শুনতেন, যে মহানবী (দ:)-কে আল্লাহতা’লা (ধরণীতে) পাঠিয়েছিলেন অজ্ঞতার অমানিশা থেকে মানবকুলকে রক্ষা করে আলোকোজ্জ্বল সঠিক পথের দিশা দিতে।
হাফেয আবদুর রহমান ইবনে ইসমাইল (রহঃ)
হাফেয আবদুর রহমান ইবনে ইসমাইল (ওফাত: ৯৬৫ হিজরী) যিনি আবু শামাহ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ, তিনি তাঁর ‘আল-বা’য়েস আ’লা এনকার আল-বেদআ’ ওয়াল হাওয়াদিস’ পুস্তকে বলেন, বেদআতে হাসানা বা নতুন প্রবর্তিত উত্তম/কল্যাণকরপ্রথাগুলোর অন্যতম হলো মীলাদুন্নবী (দ:)-এর দিন উদযাপনের জন্যে যা যা করা হয়; যেমন – দান-সদকাহ করা, অন্যান্য সওয়াবদায়ক আমল পালন এবং খুশি প্রকাশ করা। গরিবদের প্রতি দয়াশীল হওয়ার পাশাপাশি এ রকম একটি আমল মহানবী (দ:)-এর প্রতি কারো মহব্বত, প্রশংসা ও গভীর শ্রদ্ধার ইঙ্গিত বহন করে এবং তাঁকে নেয়ামতস্বরূপ (আমাদের মাঝে) প্রেরণের জন্যে তা আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে।
হাফেয সাখাভী (রহঃ)
হাফেয সাখাভী (ওফাত: ৯০২ হিজরী) তাঁর ’ফাতাওয়া’ গ্রন্থে বলেন, মওলিদ উদযাপন হিজরী তৃতীয় শতকের পরে আরম্ভ হয়। অতঃপর ইসলামী জনসমাজ সকল শহর ও নগরে দান-সদকা, মহানবী (দ:)-এর মীলাদ-বর্ণনার মতো নানা সওয়াবদায়ক আমল পালন করে এর উদযাপন করে আসছেন।
ইমাম হাফেয জালালউদ্দীন সৈয়ুতী (রহঃ)
ইমাম হাফেয জালালউদ্দীন সৈয়ুতী (বেসাল: ৯১১ হিজরী) তাঁর ‘হুসনুল মাকসিদ ফী ‘আমালিল মাওলিদ’ পুস্তকে বলেন, মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপনের উদ্দেশ্যে মানুষজনকে সমবেত করা, কুরআন মজীদের আয়াতে করীমা তেলাওয়াত করা, মহানবী (দ:)-এর জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা, তাঁর বেলাদতের (ধরণীতে শুভাগমনের) সাথে সম্পর্কিত বিস্ময়কর অলৌকিক ঘটনাবলীর উল্লেখ করা, এবং এই উপলক্ষে মানুষকে খাবার পরিবেশন করা সেই সকল বেদআতে হাসানা (কল্যাণকর ও সওয়াবদায়ক নতুন প্রবর্তিত আমল)-এর শ্রেণীভুক্ত যা মহানবী (দ:)-এর প্রতি আনুগত্য ও যথাযথ সম্মান প্রতিফলন করে।
শায়খ মোহাম্মদ ইলিয়াশ (রহঃ)
মালেকী মযহাবের আলেম শায়খ মোহাম্মদ ‘ইলিয়াশ (ওফাত: ১২৯৯ হিজরী) তাঁর ’আল-কওল আল-মুনজিয়ী’ কেতাবে বলেন, ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বপ্রথম পালন করা হয় হিজরী ৬ষ্ঠ শতকে। এটি প্রবর্তন করেন ইরবিলেরন্যায়পরায়ণ সুলতান মোযাফফর শাহ। ওই সব অনুষ্ঠানে তিনি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আলেম-উলেমা ও মহান সূফীবৃন্দসহ সকলকে আমন্ত্রণ জানাতেন। যে মেজবান খাওয়ানো হতো তাতে অন্তর্ভুক্ত থাকতো ৫০০০ দুম্বার রোস্ট, ১০০০০ মোরগ ও ৩০০০০ প্লেট মিষ্টি। সেই সময় থেকে অদ্যাবধি মুসলমান সমাজ রবিউল আউয়াল মাসে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপন করে আসছেন। এর আয়োজনে তাঁরা মানুষকে খাওয়ানো, গরিব-দুঃস্থদের মাঝে দান-সদকাহ এবং অন্যান্য প্রশংসনীয় (মোস্তাহাব) আমল পালন করেন। এই আমল (ইসলামী আচার) তাঁদেরকে বিগত বছরগুলোতে মহা রহমত-বরকত অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
ইমাম হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী (রহঃ)
ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) সম্পর্কে ইমাম হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:) বলেন, ঈদে মীলাদুন্নবী (দ:) উদযাপনে যে সব নেক বা পুণ্যময় কাজ করা যায় তাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে – মহানবী (দ:)-এর প্রতি (শোকরিয়াসূচক) খুশি উদযাপন ও আনুগত্য প্রদর্শন; পুণ্যবান ও গরিব মানুষকে সমবেত করে তাঁদেরকে খাওয়ানো; নেক আমল পালন ও মন্দ বেদআত বর্জনে উদ্বুদ্ধ করে এমন ইসলামী নাশিদ/না’ত/সেমা/কাওয়ালী/পদ্য আবৃত্তি বা পরিবেশন; রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর প্রশংসাসূচক (এ ধরনের) শে’র-পদ্য-সেমা আবৃত্তিকে সে সকল শ্রেষ্ঠ মাধ্যমের অন্তর্গত বলে বিবেচনা করা হয় যা দ্বারা কারো অন্তর তাঁর প্রতি মহব্বত-আকৃষ্ট হয়।
পবিত্র মক্কাতুল মুয়াজ্জামা এবং পবিত্র মদীনাতুল মুনাওয়ারা শরীফাঈন এর ইমাম ও সম্মানিত মুফতী সাহেবদের মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম শরীফ সম্পর্কে ফতোয়া নিম্নে দেয়া হলঃ
পবিত্র মক্কা শরীফ এর হানাফী মাযহাব এর মুফতী , মাওলানা শায়খ জামাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতোয়া —
মীলাদ শরীফ মাহফিল অনুষ্ঠান করা হচ্ছে সারা বছর ব্যাপী শান্তি নিরাপত্তায় থাকা এবং মকসুদ হাসীল হওয়ার মাধ্যম !
পবিত্র মক্কা শরীফের হানাফী মাযহাবের মুফতী শায়খ আব্দুর রহমান সিরাজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতোয়া —
পূবসুরী শীর্ষ স্থানীয় ওলামায়ে কিরাম মীলাদ শরীফ এক অনুষ্ঠান পালনকে মুস্তহসান বা ভাল কাজ মনে করেন !
মক্কা শরীফ এর মালেকী মাযহাবের মুফতী শায়খ রহমাতুল্লাহ সাহেব উনার ফতোয়া —
এ অধম উপরোক্ত ফতোয়ার বিষয় সম্পর্কে অবহিত হয়েছি , এ প্রশ্নের উওরে হানাফী মাযহাবের মুফতী সাহেব যে উত্তর দিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ বাস্তব সত্য বিষয় !
পবিত্র মক্কা শরীফ এর শাফেঈ মাযহাবের মুফতী সাঈদ ইবনে মুহম্মদ আবসীল রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতোয়া —
রহমতের নবী মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্ম ও প্রকাশ অপেক্ষা বড় শ্রেষ্ঠ নিয়ামত আর কি হতে পারে !
পবিত্র মক্কা শরীফ এর হাম্বলী মাযহাবের মুফতী শায়খ খলফ ইবনে ইব্রাহিম রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন —
ওলামায়ে কিরাম গনের ঐক্যমতে মীলাদ শরীফ অনুষ্ঠান করা জায়িয !
মক্কা শরীফ এর হানাফী মাযহাবের মুফতী শাইখ আবদুল্লাহ ইবনে সিরাজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতোয়া —
নবীজীর বিলাদত শরীফ উপলক্ষে মীলাদ শরীফ অনুষ্ঠান করা হয় , তখন ক্বিয়াম শরীফ করে উনার প্রতি সম্মান প্রদরশন করা বিশিষ্ট ও নামযাদা ইমামদের থেকে উত্তরাধিকার. সূত্রে প্রপ্ত !
পবিত্র মক্কা শরীফ এর মালেকী মাযহাবের এর মুফতী আবু বকর হাজী বসাউনি রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর ফতোয়া —
মীলাদ শরীফ ও ক্বিয়াম শরীফ এর ফতোয়ার ব্যপারে হানাফী মাযহাবের বর্তমান মুফতী সাহেবের সাথে এক মত , উনার ফতোয়া সঠিক ও নিরভুল !
পবিত্র মক্কা শরীফের হাম্বলী মাযহাবের মুফতী শাইখ মুহম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে হামীদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতোয়া—
মীলাদ শরীফ এর অনুষ্ঠানে নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আলোচনা কালে ক্বিয়াম শরীফ করা হচ্ছে শিষ্টাচার ও অাদবের. দাবি ! ক্বিয়াম শরীফ করা কখনোই শরীয়তের নীতিমালার পরিপন্থি নয় !
মক্কা শরীফ এর হাম্বলী মাযহাবের মুফতী শায়খ মুহম্মদ ইবনে ইয়াহিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতোয়া —
হ্যাঁ , মীলাদ শরীফ এর অনুষ্ঠানে যখন নবীজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম. উনার বিলাদত শরীফ এর আলোচনা কালে ক্বিয়াম শরীফ করা ওয়াজিব !
পবিত্র মক্কা শরীফ এর মালেকী মাযহাবের মুফতী হুসাইন ইবনে ইব্রাহীম রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতোয়া —
মীলাদ শরীফ অনুষ্ঠানে নবীজী উনার জন্ম মুবারক আলোচনার সময় ক্বিয়াম শরীফ করা অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম গন মুস্তহাসান. মনে করেন !
পবিত্র মক্কা শরীফ এর শাফেয়ী মাযহাবের ফতোয়া বোর্ডের সভাপতি মুফতী শায়খ মুহম্মদ উমর ইবনে আবু বকর রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতোয়া —
নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিলাদত শরীফ এর.আলোচনা কালে ক্বিয়াম শরীফ করা মুস্তহাসান , ঐ সময় কাজটি করা উত্তম !'
দুররুল মুনাজ্জাম – সপ্তম অধ্যায় – দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ২৩২ পৃষ্ঠা থেকে ২৮৬ পৃষ্ঠা !
ইশবাউল কালাম !
হাক্বীকতে মুহম্মদী মীলাদে আহমদী !
প্রশ্নঃ আল্লাহ তায়ালা অসীম রহমত আপনার উপর বর্ষিত হোক । নিম্নে বর্নিত বিষয়ে আপনার অভিমত ও ফতোয়া কি ?
" মিলাদ শরীফ পাঠ করা - বিশেষ করে নবী করিম সাল্লাল্লাহয় আলাইহে ওয়াসাল্লামের পবিত্র জন্ম বৃত্তান্ত পাঠকালে কিয়াম করে সম্মান প্রদর্শন করা , মিলাদের জন্য দিন তারিখ নিদিষ্ট করা , মিলাদ মজলিস কে সাজানো , আতর গোলাপ ও খুশবু ব্যাভার করা। কুরআন শরীফ হতে সুরা ক্বেরাত পাঠ করা এবং মুসলমানদের জন্য খানাপিনা (তাবারুক) তৈরি করা - এই ভাবে অনুষ্ঠান করা জায়েয কিনা এবং অনুষ্ঠানকারীগন এতো সাওয়াবের অধিকারী হবেন কিনা ? বর্ণনা করে আল্লাহর পক্ষ হতে পুরস্কৃত হোন " । - আব্দুর রহীম তুর্কমানী - হিন্দুস্তান ,১২৮৮ হিজরি ।
মক্কা শরীফের ফতোয়াদাতাগনের জবাব ও ফতোয়াঃ
জেনে নিন - উপরে বর্নিত নিয়মে (কিয়াম) মিলাদ শরীফের অনুষ্ঠান করা মোস্তাহসান ও মুস্তাহাব । আল্লাহ ও সমস্ত মুসলমানের নিকট ইহা উত্তম । ইহার অস্বীকারকারীগন বিদআতপন্থী ও গোমরাহ্ । হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)হতে বর্নিত হুজুর (দঃ) -এর হাদিস আছে -
মুসলমান যে কাজকে পছন্দনীয় বলে বিবেচনা করেন-তা আল্লাহর নিকটও পছন্দনীয় । (মুসলিম)
এখানে মুসলমান বলতে ঐ সমস্ত মুসলমানকে বুঝায়-যারা কামেল মুসলমান । যেমন পরিপুর্ন আমলকারী উলামা , বিশেষ করে আরবেরদেশ , মিশর , সিরিয়া ,তুরস্ক ও স্পেন-ইত্যাদি দেশের উলামাগন সলফে সালেহীনদের যুগ থেকে অদ্যবধি (১২৮৮ হিঃ) সকলেই মিলাদ কেয়াম কে মুস্তাহসান, উত্তম ও পছন্দনীয় বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন । সর্বযুগের উলামাগনের স্বীকৃতির কারনে মিলাদও কিয়ামের বিষয় বরহক । উহা গোমরাহী হতে পারে না । নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
আমার উম্মত গোমরাহ বিষয়ে একমত হতে পারে না (আল হাদিস)
সুতরাং যারা মিলাদ ও কিয়াম কে অস্বিকার করবে-শরিয়তের বিচারকের উপর তাদের যথাযথ শাস্তি প্রদান করা ওয়াজিব ।
মক্কা শরিফের ফতোয়াদাতা মুফতীগনের স্বাক্ষর ও সিলমোহর
১। আল্লামা আব্দুর রহমান সিরাজ ।
২।আল্লামা আহনদ দাহলান ।
৩।আল্লামা হাসান ।
৪। আল্লামা আব্দুর রহমান জামাল ।
৫। আল্লামা হাসান তৈয়ব।
৬।আল্লামা সোলায়মান ঈছা ।
৭। আল্লামা আহমদ দাগেস্তানী ।
৮। আল্লামা আব্ডুল কাদের সামস ।
৯। আল্লামা আব্দুর রহমান আফেন্দী ।
১০। আল্লামা আব্দুল কাদের সানখিনী।
১১। আল্লামা মুহাম্মদ শারকী ।
১২ । আল্লামা আব্দুল কাদের খোকীর ।
১৩। আল্লামা ইবরাহিম আলফিতান।
১৪। আল্লামা মুহাম্মদ জারুল্লাহ ।
১৫। আল্লামা আব্দুল মুত্তালিব ।
১৬। আললামা কামাল আহমেদ ।
১৭। আল্লামা মুহাম্মাদ ছায়ীদ আল-আদাবি ।
১৮। আল্লামা আলি জাওহাদ ।
১৯। আল্লামা সৈয়দ আব্দুল্লাহ কোশাক।
২০। আল্লামা হোসাইন আরব।
২১ । আল্লামা ইব্রাহিম নওমুছি।
২২। আল্লামা আহমদ আমিন।
২৩। আল্লামা শেখ ফারূক ।
২৪। আল্লামা আব্দুর রহমান আযমী ।
২৫। আল্লামা আব্দুল্লাহ মাশশাত ।
২৬। আল্লামা আব্দুল্লাহ কুম্মাশী।
২৮। আল্লামা মুহাম্মদ বা-বাসীল।
২৯। আল্লামা মুহাম্মদ সিয়ুনী।
৩০। আল্লামা মুহাম্মদ সালেহ জাওয়ারী।
৩১। আল্লামা আব্দুল্লাহ জাওয়ারী।
৩২। আল্লামা মুহাম্মাদ হাবীবুল্লাহ ।
৩৩। আল্লামা আহমদ আল মিনহিরাভী ।
৩৪ । আল্লামা সোলাইমান উকবা ।
৩৫। আল্লামা সৈয়দ শাত্বী ওমর ।
৩৬। আল্লামা আব্দুল হামিদ দাগেস্তানী ।
৩৭। আল্লামা মুস্তফা আফীফী ।
৩৮। আল্লামা মানসুর।
৩৯ । আল্লামা মিনশাবী ।
৪০। আল্লামা মুহাম্মদ রাযী ।
(১২৮৮ হিজরী) ।
আল্লামা আব্দুর রহীম তুর্কমানী (রহঃ) ১২৮৮ হিজরী সনে মক্কা ও মদিনা এবং জেদ্দাহ ও হাদিদার উলামায়ে কেরামের দ্বারা মিলাদ ও কিয়াম সম্পর্কে একটি ফতোয়া লিখিয়ে হিন্দুস্তানে নিয়ে আসেন এবং নিজ গ্রন্থ " রাওয়াতুন নাঈম " -এর শেষাংশে ছেপে প্রকাশ করেন । ( আনওয়ারে ছাতেয়া দেখুন )
মিলাদ ও কিয়ামের বিধান (লেখকঃ অধ্যক্ষ এম এ জলিল (রহঃ))
ফতোয়া
মুসলমানদের উপস্থিতিতে হুযূর-ই আকরামের জন্ম-বৃত্তান্ত পাঠ করা, উত্তম জিনিস দান করা, রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বেলাদত শরীফ বর্ণনাকালে ক্বিয়াম করা, গোলাব ছিঁটানো, সুগন্ধি জ্বালানো মজলিস সাজানো, ক্বোরআন মজীদ থেকে পাঠ করা, নবী করীমের উপর দুরূদ ও সালাম পেশ করা, আনন্দ ও খুশীর বহিঃপ্রকাশ ঘটানো ইত্যাদি নিঃসন্দেহে সুন্নাতে হাসানার অন্তর্ভুক্ত এবং মুস্তাহাব। এর উত্তম ফযীলত রয়েছে। একমাত্র বিদ্‘আতপন্থী গোমরাহ্ লোক ছাড়া অন্য কেউ এটা অস্বীকার করতে পারে না । তাদের কথায় কেউ কর্ণপাত করবে না। তাদেরকে শাস্তি প্রদান করা ইসলামী রাষ্ট্রের পরিচালকের উপর ওয়াজিব। আল্লাহ্ই সর্বাধিক জ্ঞাতা। আল্লাহ্ পাক আমাদের মুনিব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর এবং তাঁর বংশধর ও সাহাবীগণের উপর অজস্র রহমত বর্ষণ করুন।
ফাত্ওয়া এ পর্যন্ত। মদীনা মোনাওয়ারার মুফতীগণের মধ্যে যাঁরা এ’তে সীলমোহরসহ স্বাক্ষর করেছেন-
১. আল্লামা মুহাম্মদ আমীন,
২. আল্লামা জাফর হোসাইনী বিরযাঞ্জী,
৩. আল্লামা আবদুল জাব্বার,
৪. আল্লামা সৈয়দ জামালুদ্দীন,
৫. আল্লামা ইবরাহীম ইবনে খিয়ার,
৬. আল্লামা সাইয়্যেদ ইয়ূসুফ,
৭. আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ আলী,
৮. আল্লামা সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ্ ইবনে সাইয়্যেদ আহমদ,
৯. আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে আহমদ রিফা‘ঈ,
১০. আল্লামা ওমর ইবনে আলী,
১১. আল্লামা আলী হারীরী,
১২. আল্লামা সাইয়্যেদ মোস্তফা,
১৩. আল্লামা আহমদ সিরাজ,
১৪. আল্লামা হাসান আদীব,
১৫. আল্লামা আবুল বারাকাত,
১৬. আল্লামা আবদুল কাদের মাশ্শাত,
১৭. আল্লামা সাইয়্যেদ আলম,
১৮. আল্লামা আহমদ হাবাশী,
১৯. আল্লামা মুহাম্মদ নূর সুলায়মানী,
২০. আল্লামা আবদুর রহিম বার‘ঈ,
২১. আল্লামা মোহাম্মদ ওসমান কুর্দী,
২২. আল্লামা ক্বাসেম,
২৩. আল্লামা আবদুল আযীয হাশেম,
২৪. আল্লামা ইয়ূসুফ রাভী,
২৫. আল্লামা মুহসেন,
২৬. আল্লামা মুবারক ইবনে সা‘ঈদ,
২৭. আল্লামা হামেদ,
২৮. আল্লামা হাশেম ইবনে হাসান,
২৯. আল্লামা আবদুল্লাহ্ ইবনে আলী,
৩০. আল্লামা আবদুর রহমান সফদী।
[১২৮৮হিজরী]
আল্লামা আব্দুর রহীম তুর্কমানী (রহঃ) ১২৮৮ হিজরী সনে মক্কা ও মদিনা এবং জেদ্দাহ ও হাদিদার উলামায়ে কেরামের দ্বারা মিলাদ ও কিয়াম সম্পর্কে একটি ফতোয়া লিখিয়ে হিন্দুস্তানে নিয়ে আসেন এবং নিজ গ্রন্থ " রাওয়াতুন নাঈম " -এর শেষাংশে ছেপে প্রকাশ করেন । ( আনওয়ারে ছাতেয়া দেখুন )
মিলাদ ও কিয়ামের বিধান (লেখকঃ অধ্যক্ষ এম এ জলিল (রহঃ))
মাওঃ আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) বলেন
এভাবে কিয়াম করাকে আমরা অবৈধ বলিনা,বরং কোথাও রাসুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লামের জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনাকালে দাড়িয়ে যান, আবার কখনো তাঁর দুগ্ধ পানের ঘটনা বলার সময়,আবার কখনো মিরাজুন্নবির আলোকপাত কালে,এমনিভাবেকোনো কোনো খাস মাহফিলে ৩-৪ বারও কিয়াম করে থাকেন।তবে এরুপ মিলাদ কিয়াম করাকে কে নিষেধ করবে??(অর্থাৎ নিষেধ করা নয়)
— তাবলিগ,পৃঃ ৩৫ (লেখকঃ আশরাফ আলী থানবী (রহঃ))
মাওঃ আশরাফ আলী থানভী কোনো এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন-
প্রচলিত মিলাদ মাহফিলের ব্যাপারে সাধকদের আমলকে আমি ভিত্তিহিন মনে করিনা। শাফেয়ী মাযহাবের মুযতাহিদ বা গভেষক ফিকাহ শাস্ত্রবিদদের অভিমত উহাই। আল্লামা ইমাম শামী (রহঃ) তাঁর প্রণিত কিতাবের মুসাফাহা বা'দাস সালাত অধ্যায়ে শায়েখ আবু জাকারিয়া মহিউদ্দিন নববি (রহঃ) এর অনুরুপ অভিমত বলে বর্ণনা করেছেন।কাজেই যেসব সুফিয়ায়ে কেরাম বিশুদ্ব পন্থায় মিলাদ মাহফিল করেন , তাদের ব্যাপারে আপত্তিমুলক খারাপ ধারণা না করাই উচিত।
— মাযালিসে হাকিমুল উম্মত(রচনায় মুফতি মুহাম্মদ শফি)
মাওঃ আশরাফ আলী থানবি,মাওঃ রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহঃ),মাওঃ কাসেম নানুতুবি প্রমুখ দেওবন্দি বড় বড় আলেমদের পীর ছিলেন হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মাক্কী (রহঃ) যিনি মিলাদ কিয়ামের পক্ষে ছিলেন।যখন অনেকেই তাঁকে বেদাতি বলে ফতোয়া দিতে লাগলেন তখন মাওঃ আশরাফ আলী থানবি নিজের পীর এর পক্ষে কলম ধরলেন।তিনি বলেন-
হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মাক্কী (রহঃ) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অবিকল আকিদায় বিশ্বাসী ছিলেন।তাঁর এসব আমল তথা প্রচলিত মিলাদ ও কিয়াম অনুষ্ঠানে যোগদান,বক্তব্য ও লেখনির মাধ্যমে তা সমর্থন করা কোনো ভ্রান্ত আকীদা বা শীয়া ধর্মের অনুকরন ছিলনা। বরং এহেন মহৎ আমলগুলা যেহেতু মূলত বৈধ ,তাই তিনি বৈধ কাজকে পুন্যময় মনে করে নিজে করতেন এবং অপরকে করতে উৎসাহ যোগাতেন।
— এমদাদে ফতোয়া
মাওঃ আশরাফ আলী থানভী উক্ত বইয়ের ৩৮ পৃষ্টায় আরো বলেন-
আমাদের আলেমগন প্রচলিত মিলাদ-কিয়াম নিয়ে অনেক ঝগড়া বিভেদে লিপ্ত রয়েছেন।এতদসত্তেও আমরা মিলাদ ও কিয়ামকে বৈধ বা ' পুন্যময় আমল ' মনে করি।যেহেতু ইহা বৈধ পন্থায় আদায় করার সুযোগ আছে সেহেতু এমতাবস্থায় বিরুধী দলের এত বাড়াবাড়ি ঠিক নয়।প্রকৃত পক্ষে মক্কা ও মদিনা শরিফের হক্কানি, রব্বানি উলামা মাশায়েখদের অনুকরনই আমাদের জন্য যতেষ্ট।অর্থাৎ হারামাইন শরিফাইনে মিলাদ,কিয়াম হতো,তাদের অনুকরন ই আমরা করবো।অবশ্য কিয়াম করার সময় নুরনবীর জন্মের খেয়াল না করা উচিত।এ কথাও চির সত্য যে, যদি মিলাদ মজলিসে হুযুরে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম উপস্থিত হতে পারেন, এমন বিশ্বাস স্থাপনে কোনো দোষ নেই।কারন জড় জগত স্থান,কাল হতে সম্পুর্ন মুক্ত বিধায় নবী কারিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম মিলাদ মাহফিলে উপস্থিত হওয়া মোটেও অসম্ভব নয় ।
— এমদাদে ফতোয়া
মাওঃ আব্দুল হাই লখনভীর দৃষ্ট মিলাদঃ মাওঃ আব্দুল হাই লখনভী ভারতিয় উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত দেওবন্দি আলেম। তিনি তাঁর মযমুয়ায়ে ফতোয়া কিতাবের ২য় খণ্ড ৩৪৭ পৃষ্টায় লিখেনঃ
মিলাদ বা জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনার সময় যদি কোনো ব্যক্তি সত্যিকারের ইশকে মুহাব্বাতে লৌকিকতা বিহীন কিয়াম বা দাড়িয়ে যায় তাহলে কিছু বলার নেই।মজলিশের আদব হচ্ছে অন্যান্য ব্যাক্তিগন তার অনুকরনে কিয়াম করবে।ইশক মুহাব্বাত ব্যাতিত ইচ্ছাকৃত দাড়ানো এটা ফরয,ওয়াজিব,সুন্নাত মুয়াক্কাদা ও মুস্তাহাবে শরিয়ত নয়। কেননা এটা হুযুর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম উনার যামানা বা কুরুনে ছালাছায় (উত্তম যুগ) ছিলনা। ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) ' ইয়াহয়া উলুমুদ্দিন' কিতাবে নকল করেছেন যে, হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন - ক্ষেত্র বিশেষে সাহাবায়ে কেরাম রাসুলে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম তিনির জন্য দাড়াতেন্না, কিন্তু হারামাইন শারিফাইনের উলামায়ে কেরাম অর্থাৎ মক্কা ও মদিনা শরিফের আলেমগন মিলাদের সময় কিয়াম করতেন।ইমাম বরজনযী (রহঃ) স্বীয় ' মিলাদুন্নাবী' কিতাবে লিখেছেন - রাসুলে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম উনার জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনাকালে কিয়াম করা বিচক্ষণ ইমামগন মুস্তাহাব বলেছেন।কতই যে খুশীর সুসংবাদ ঐ ব্যাক্তির জন্য যার একমাত্র উদ্দেশ্য হুযুরে আকরাম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম উনার সন্মানার্থে দাড়ানো।
— মযমুয়ায়ে ফতোয়া, ২য় খণ্ড, ৩৪৭ পৃষ্ঠা
মাওঃ হুসাইন আহমদ ছিলেন দেওবন্দ মাদ্রাসার একজন প্রখ্যাত শায়খুল হাদীস।তিনি তাঁর ' মাক্তুবাতে শায়খুল ইসলাম' কিতাবে লিখেন- হযর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস র(আদিঃ) হতে বর্ণিত - তিনি বলেন, রাসুলে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম ইরশাদ করেন,নিশ্চই আল্লাহ তা'য়ালা এই জমিনে কিছু ভ্রমনকারী ফেরেশতা নিয়োগ করেছেন। তাঁরা আমার উম্মতের প্রেরিত ছালামগুলো আমার নিকট পৌঁছান।
হযরত আবু হুরাইরা (রাদিঃ) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন রাসুলে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম ইরশাদ করেন- যে কোনো উম্মত আমার উপর ছালাম প্রদান করে আল্লাহ তা'য়ালা তা আমার রুহে পৌঁছান আর আমি তার ছালামের জবাব দেই।
স্মরণ রাখা উচিৎ, হযরত রাসুলে আকরাম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম উনার রওদ্বা শরিফের সামনে ছালাম পড়া হোক, তা কাছের স্থান থেকে হোক কিংবা দূরবর্তী স্থান থেকে, তা রাসুলে মাকবুল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম উনার নিকট পৌঁছে।উপরল্লেখিত হাদীসদ্বয়ে দূর ও নিকট থেকে ছালাম দেওয়ার কোনো বৈশিষ্ট নেই।অর্থাৎ প্রত্যেক স্থান হতে ছালাম তিনির নিকট পৌঁছে।ছালামদাতা যখন ইচ্ছা ছালাম প্রেরন করতে পারবে।দাড়িয়ে বা বসে ছালাম দেওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়নি।হ্যাঁ,রাসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম উনার জিকরে বেলাদাত বা জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা কালে কেহ দাড়িয়ে ছালাতু ছালাম পড়লে ,তাতে দোষের কি আছে?? (মাক্তুবাতে শাইখুল ইসলাম,১ম খণ্ড,৩৩৯ পৃষ্টা)
আক্বায়েদে উলামায়ে দেওবন্দ কিতাবের ১৯ পৃষ্টায় মিলাদের ব্যাপারে নিম্নের ফতোয়া আসেঃ আমরা (দেওবন্দি উলামাগন) মিলাদ মাহফিলে রাসুলে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম তিনির জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করাকে অস্বীকার করিনা, বরংনাজায়েয বস্তু যা উহার সহিত যুক্ত হয়েছে, তাহা অস্বীকার করি।হ্যাঁ, যদি কোনো মিলাদ মাহফিলে মন্দ উপসর্গ বর্জিত হয়, তবে আমরা কি এ কথা কখনো বলতে পারি যে, মিলাদ শরিফের বর্ণনা নাজায়েয ও বেদাত! এহেন মন্দ কথা কোনোমুসলমানের প্রতি কিভাবে ধারণা করা যেতে পারে???
উক্ত কিতাবের ৪১ পৃষ্টায় আরো উল্লেখ আছে - মিশর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত আলেম শাইখুল উলামা সেলিম সাহেব বলেন যে, হুযুরে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম উনার জন্ম কাহিনি বর্ণনার সময় কিয়াম অস্বীকার করা এবং হুযুরের ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম উনার জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করাকে পৌত্তলিক এবং রাফেজীগনের সহিত তুলনা করা আর ইহার সমালোচনা করা একজন ইমানদারের কাজ হতে পারেনা।কেননা পূরবর্তী ইমামগন এই মিলাদের কিয়াম হুযুর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম তিনির শান,মান ও মর্যাদার উদ্দেশ্যে মুস্তাহসান মনে করেছেন এবং উহা এমন একটি কাজ,যার দধ্যে খারাপ বা নিন্দনীয় বলতে কিছুই নেই।
— আকায়েদে উলামায়ে দেওবন্দ, রচনায়- মাওঃ খলিল আহমদ সাহারানপুরী দেওবন্দী
মাওঃ রশিদ আহমদ উস্তাদ প্রখ্যাত আলেম মাওঃ শাহ আহমদ সাইদ হানাফী তাঁর 'মালফুযাত' এ বলেছেন- মিলাদ শরীফ পাঠ করা এবং রাসুলে আকরাম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম তিনির জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা কালে কিয়াম বা দাড়িয়ে যাওয়া মুস্তাহাব।
— মাকামাতে সাইদিয়া ওয়া আহমাদিয়া
বিশিষ্ট দেওবন্দি উলামাদের (মাওঃ কাসেম নানুতুবী, রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী, মাওঃমাহমুদুল হাসান, মাওঃ আশরাফ আলী থানভী…প্রমুখ) পীর হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মাক্কি (রহঃ) যিনি এই উপমহাদেশে একজন যোগ্য দীনের মুবাল্লেগ হিসেব্দ পরিচিত এবং পীরে কামেল ও আধ্যাত্নিক সাধক ছিলেন,তিনি তাঁর লিখিত কিতাব ফয়সালায়ে হাফত মাস'আলা কিতাবের মধ্যে মিলাদ নিয়ে একটি অধ্যায় লিখেছেন,সেখানে এক যায়গায় তিনি বলেছেন-
আমার নীতি হচ্ছে আমি মিলাদ মাহফিলে যোগদান করি এবং এটাকে বরকতের উছিলা মনে করে আমি নিজেই প্রতি বছর এর আয়োজন করে থাকি এবং কিয়ামে আনন্দ ও তৃপ্তি পেয়ে থাকি।
— ফয়সালায়ে হাফত মাস'আলা
আর একটি বিষয় প্রশ্ন সাপেক্ষ! তা হচ্ছে- নবী করিম (দঃ)-এর শুধু জন্ম তারিখ পালন করা হয় কেন? ইনতিকাল তো একই তারিখে এবং একই দিনে হয়েছিল। সুতরাং একসাথে জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন করাইতো যুক্তিযুক্ত। যেমন অন্যান্যমহামানব অলী-গাউসদের বেলায় মৃত্যু দিবসে ওরস পালন করা হয়ে থাকে।
প্রথম উত্তর হলোঃ
আল্লাহ পাক কোরআন মজিদে নির্দেশ করেছেন নিয়ামত পেয়ে খুশি ও আনন্দ করার জন্য। নিয়ামত পাওয়া জন্ম উপলক্ষেই হয়। যেমন কোরআনে আছেঃ
হে নবী! আপনি একথা ঘোষণা করে দিন-মুসলমানগণ খোদার ফযল ও রহমত পাওয়ার কারণে যেনো নির্মল খুশি ও আনন্দ উৎসব করে। ইহা তাদের যাবতীয় সঞ্চিত সম্পদ থেকে উত্তম।
তাফসীরে রুহুল মাআনী উক্ত আয়াতে ‘ফযল ও রহমত’ অর্থে মোহাম্মদ (দঃ)-এর নাম উল্লেখ করেছেন- ইহা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর ব্যাখ্যা। রাসুল (দঃ)-এর এক হাজার চারশত নামের মধ্যে ফযল, রহমত, বরকত, নেয়ামত, নূর-প্রভৃতি অন্যতম গুণবাচক নাম- যা গ্রন্থের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং নেয়ামত প্রাপ্তি উপলক্ষে শুকরিয়া আদায়ের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান করাই কোরআনের নির্দেশ। সূরা ইউনুসের উক্ত ৫৮নং আয়াতে নবীজীর জন্মোৎসব পালন করার স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। সুতরাং ঈদে মিলাদুন্নবী ও জশনে জুলুছ কোরআনের আলোকে প্রমাণিত। (তাফসীরে রূহুল মাআনী সূরা ইউনুছ ৫৮ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা)
মোদ্দাকথাঃ
আল্লাহপাক হুযুর (দঃ)-এর আবির্ভাব উপলক্ষে আনন্দোৎসব করার নির্দেশ করেছেন। কিন্তু ইনতিকাল উপলক্ষে শোক পালন করতে বলেন নি। তাই আমরা আল্লাহর নির্দেশ মানি। ওরা কার নির্দেশ মানে?
দ্বিতীয় উত্তরঃ
নবী করিম (দঃ) নিজে সোমবারের রোযা রাখার কারণ হিসেবে তাঁর পবিত্র বেলাদাত ও প্রথম অহী নাযেলের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ বা ইনতিকাল উপলক্ষে শোক পালন করার কথা উল্লেখ করেন নি। যদিকরতেন, তাহলে আমরা তা পালন করতাম। সুতরাং একই দিনে ও একই তারিখে নবী করিম (দঃ)-এর জন্ম এবং ইনতিকাল হলেও মৃত্যুদিবস পালন করা যাবে না। এটাই কোরআন-হাদীসের শিক্ষা।
তৃতীয় উত্তরঃ
নবীজী তো সশরীরে হায়াতুন্নবী। হায়াতুন্নবীর আবার মৃত্যুদিবস হয় কি করে? কেউ কি জীবিত পিতার মৃত্যু দিবস পালন করে? আসলে ওরা কোনটাই পালন করার পক্ষে নয়। শুধু ঈদে মিলাদুন্নবী (দঃ) পালনকারীদেরকে ঘায়েল করার লক্ষ্যেইএইসব শয়তানী কুটতর্কের অবতারণা করে থাকে। ওরা শয়তানের প্রতিনিধি। আমরা কোরআন নাযিলের আনন্দ উৎসব করি শবে ক্বদরে এবং নবীজীর আগমনের আনন্দ উৎসব পালন করি ১২ই রবিউল আউয়ালে। ওরা কোনটাই পালন করার পক্ষপাতি নয়। আমরা সূরা ইউনুছের ৮৫নং আয়াতের নির্দেশ পালন করি।
নূরনবী (লেখকঃ অধ্যক্ষ মাওলানা এম এ জলিল (রহঃ), এম এম, প্রাক্তন ডাইরেক্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ)
নবী করিম (দঃ) যখন ভূমিষ্ঠ হন- তখন এমন কতিপয় আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছিল- যা সচরাচর দেখা যায় না। প্রথম ঘটনাটি স্বয়ং বিবি আমেনা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন এভাবে-
যখন আমার প্রসব ব্যথা শুরু হয়, তখন ঘরে আমি প্রায় একা ছিলাম এবং আমার শ্বশুর আবদুল মোত্তালিব ছিলেন কা’বা ঘরে তাওয়াফরত। আমি দেখতে পেলাম, একটি সাদা পাখির ডানা আমার কলিজায় কি যেনো মালিশ করে দিচ্ছে। এতে আমার ভয়ভীতি ও ব্যথা বেদনা দূরিভূত হয়ে গেল। এরপর দেখতে পেলাম এক গ্লাস শ্বেতশুভ্র শরবত আমার সামনে। আমি ঐ শরবতটুকু পান করে ফেললাম। অতঃপর একটি ঊর্ধ্বগামী নূর আমাকে আচ্ছাদিত করে ফেললো। এ অবস্থায় দেখতে পেলাম- আবদে মোনাফ (কোরাইশ) বংশের মহিলাদের চেহারা বিশিষ্ট এবং খেজুর বৃক্ষের ন্যায় দীর্ঘাঙ্গিনী অনেক মহিলা আমাকে বেষ্টন করে বসে আছেন। আমি সাহায্যের জন্য ‘ওয়া গাওয়াছা’ বলে তাদের উদ্দেশ্যে বললাম- আপনারা কোথা হতে আমার বিষয় অবগত হলেন? উত্তরে তাঁদের একজন বললেন- আমি ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আছিয়া। আরেকজন বললেন- আমি ইমরান তনয়া বিবি মরিয়ম এবং আমাদের সঙ্গিনীগণ হচ্ছেন বেহেস্তী হুর। আমি আরও দেখতে পেলাম- অনেক পুরুষবেশী লোক শূন্যে দণ্ডায়মান রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের হাতে রয়েছে রূপার পাত্র। আরও দেখতে পেলাম- একদল পাখি আমার ঘরের কোঠা ঢেকে ফেলেছে। আল্লাহ তায়ালা আমার চোখের সামনের সকল পর্দা অপসারণ করে দিলেন এবং আমি পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম সব দেখতে পেলাম। আরও দেখতে পেলাম- তিনটি পতাকা। একটি পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তে স্থাপিত, অন্যটি পশ্চিম প্রান্তে এবং তৃতীয়টি স্থাপিত কাবাঘরের ছাদে। এমতাবস্থায় প্রসব বেদনার চূড়ান্ত পর্যায়ে আমার প্রিয় সন্তান হযরত মোহাম্মদ (দঃ) ভূমিষ্ঠ হলেন
— হযরত ইবনে আব্বাস সূত্রে মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া
খাছায়েছে কোবরা ও তারিখুল খামীছ গ্রন্থে যথাক্রমে আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতি (রহঃ) এবং আল্লামা আবু বকর দিয়ারবিকরী (রহঃ) বিবি আমেনা (রাঃ)-এর একটি বর্ণনা এভাবে লিপিবদ্ধ করেছেনঃ
বিবি আমেনা বলেন-
যখন আমার প্রিয় পুত্র ভূমিষ্ঠ হলেন, তখন আমি দেখতে পেলাম- তিনি সিজদায় পড়ে আছেন। তারপর মাথা ঊর্ধ্বগামী করে শাহাদাৎ অঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করে বিশুদ্ধ আরবি ভাষায় পাঠ করেছেন “আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্নি রাসুলুল্লাহ
— যিকরে জামীল সূত্রে
উপরোক্ত বর্ণনায় কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হলোঃ
(১) নবী করিম (দঃ)-এর পবিত্র বেলাদত উপলক্ষে বেহেস্তে ও আকাশ হতে পবিত্র নারী ও হুর ফিরিস্তাগণ জুলুছ করে বিবি আমেনার (রাঃ) কুটিরে আগমনকরেছিলেন এবং নবীজীর সম্মানার্থে দণ্ডায়মান হয়ে কিয়াম করেছিলেন। আর ফিরিস্তাদের হয়ে এই জুলুছ ছিল আকাশ ছোঁয়া জুলুছ। তাই আমরাও নবীজীর সম্মানে কিয়াম করি ও জুলুছ করি।
(২) নবী করিম (দঃ)-এর নূরের আলোতে বিবি আমেনা (রাঃ) পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত অবলোকন করেছিলেন। যাদের অন্তরে নবীজীর নূর বিদ্যমান, সেসব অলীগণেরও দিব্যদৃষ্টি খুলে যায়। তাঁরা লাওহে মাহফুযও দেখতে পান (মসনবী শরীফ)।
(৩) নবী করিম (দঃ)-এর জন্ম উপলক্ষে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান আলো ও পতাকা দ্বারা সজ্জিত করা উত্তম। ইহা আল্লাহ ও ফিরিস্তাদের সুন্নাত।
(৪) কোরআন নাযিলের ৪০ বছর পূর্বেই নবী করিম (দঃ) কুরআনের গুরুত্বপূর্ণ দুটি আদর্শ- ‘কালেমা ও নামাজ’ বাস্তবায়ন করেছিলেন। মূলতঃ থিউরিটিক্যাল কোরআন নাযিলের পূর্বেই প্র্যাকটিক্যাল কোরআন (নবী) নাযিল হয়েছিলেন। কোরআন হলো হাদিয়া- আর নবী হলেন সেই হাদিয়ার মালিক। হাদিয়া ও তার মালিকের মধ্যে যে সম্পর্ক তা সর্বজন বিদিত।
(৫) পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দঃ) উপলক্ষে জুলুছ এবং শুকরিয়ার আনন্দ মিছিল বের করা ফিরিস্তাদেরই অনুকরণ (আনওয়ারে আফতাবে সাদাকাত)। মাওয়াহেব গ্রন্থের বর্ণনায় আকাশ হতে জমীন পর্যন্ত ফেরেস্তাদের জুলুছ বা মিছিল পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন- “তোমরা আল্লাহর ফযল ও রহমত স্বরূপ নবীকে পেয়ে আনন্দ-উল্লাস করো”। (সূরা ইউনুছ ৫৮ আয়াতের তাফসীর, রুহুল মাআনীত)। জালালুদ্দীন সুয়ুতি তাঁর আল হাভী লিল ফাতাওয়া গ্রন্থে ঈদে মিলাদুন্নবীর দিনে সব রকমের আনন্দ-উল্লাসকে বৈধ বলে উল্লেখ করেছেন।
পূর্ব যুগের জুলুছ
প্রাচীনকালে ১০৯৫-১১২১ খ্রিস্টাব্দে মিশরে ঈদে মিলাদুন্নবী (দঃ) উপলক্ষে ধর্মীয় জুলুছ বের করা হতো। গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এতে অংশ নিতেন। উযির আফযলের যুগে এ আনন্দ মিছিল বের করা হতো। এ সময় রাজপথসমূহ লোকে লোকারণ্যহয়ে যেতো। পরবর্তীতে এ উৎসবের প্রসার ঘটে আফ্রিকার অন্যান্য শহরে, ইউরোপের স্পেনে এবং ভারতবর্ষে। (মাকরিজী, ইবনে খাল্লেকান)
সুতরাং যারা জশনে জুলুছকে নূতন প্রথা, শিরক ও বিদ্আত বলে- তারা অতীত ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং ইসলামী জ্ঞানের ক্ষেত্রে মূর্খ। নবীবিদ্বেষ তাদেরকে অন্ধ করে রেখেছে। জশনে জুলুছ বের করা কোরআনী আয়াত দ্বারাই প্রমাণিত।
নূরনবী (লেখকঃ অধ্যক্ষ মাওলানা এম এ জলিল (রহঃ), এম এম, প্রাক্তন ডাইরেক্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ)
নবী করিম (দঃ) নবুয়ত পরবর্তীকালে নিজেই সাহাবীদেরকে নিয়ে নিজের মিলাদ পড়েছেন এবং নিজ জীবনী আলোচনা করেছেন। যেমন- হযরত ইরবায ইবনে ছারিয়া (রাঃ) একদিন নবী করিম (দঃ) কে তাঁর আদি বৃত্তান্ত বর্ণনা করার জন্য আরয করলে নবী করিম (দঃ) এরশাদ করেন-
আমি তখনই নবী ছিলাম- যখন আদম (আঃ)-এর দেহের উপাদান-মাটি ও পানি পৃথক পৃথক অবস্থায় ছিল। অর্থাৎ আদম সৃষ্টির পূর্বেই আমি নবী হিসেবে মনোনীত ছিলাম। আমাকে হযরত ইবরাহীম (আঃ) দোয়া করে তাঁর বংশে এনেছেন- সুতরাং আমি তাঁর দোয়ার ফসল। হযরত ঈছা (আঃ) তাঁর উম্মতের নিকট আমার আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তাঁরা উভয়েই আমার সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত ছিলেন। আমার আম্মা বিবি আমেনা আমার প্রসবকালীন সময়ে যে নূর তাঁর গর্ভ হতে প্রকাশ পেয়ে সুদূর সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত করতে দেখেছিলেন- আমিই সেই নূর
— মিশকাত
এভাবে হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ), হযরত ওসমান (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ) খলিফা চতুষ্টয় নিজ নিজ খেলাফত যুগেও নবীজীর পবিত্র বেলাদত শরীফ উপলক্ষে মিলাদ মাহফিল করতেন এবং মিলাদের ফযিলত বর্ণনা করতেন বলে মক্কা শরীফের তৎকালীন (৯৭৪হিঃ) বিজ্ঞ মুজতাহিদ আলেম আল্লামা ইবনে হাজার হায়তামী (রহঃ) স্বীয় রচিত “আন-নি’মাতুল কোবরা আলাল আলম” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
এছাড়াও অন্যান্য সাহাবী নবীজীর জীবদ্দশায় মিলাদুন্নবী মাহফিল করতেনঃ
১) হযরত আবু আমের আনসারীর (রাঃ) মিলাদ মাহফিলঃ
হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে- তিনি বলেন, আমি একদিন নবী করিম (দঃ)-এর সাথে মদিনাবাসী আবু আমেরের (রাঃ) গৃহে গমন করে দেখতে পেলাম- তিনি তাঁর সন্তানাদি ও আত্মীয় স্বজনকে একত্রিত করে নবী করিম (দঃ)-এর পবিত্র বেলাদত সম্পর্কিত জন্ম বিবরণী শিক্ষা দিচ্ছেন এবং বলছেন যে, “আজই সেই পবিত্র জন্ম তারিখ”।
এই মাহফিল দেখে নবী করিম (দঃ) খুশি হয়ে তাঁকে সুসংবাদ দিলেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য (মিলাদের কারণে) রহমতের অসংখ্য দরজা খুলে দিয়েছেন এবং ফিরিস্তাগণ তোমাদের সকলের জন্য মাগফিরাত কামনা করছেন”
— আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতির সাবিলুল হুদা ও আল্লামা ইবনে দাহইয়ার আত-তানভীর-৬০৪ হিঃ
২) হযরত ইবনে আব্বাছ (রাঃ) কর্তৃক মিলাদ মাহফিলঃ
একদিন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) নিজগৃহে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছিলেন। তিনি উপস্থিত সাহাবীগণের নিকট নবী করিম (দঃ)-এর পবিত্র বেলাদত সম্পর্কিত ঘটনাবলি বয়ান করছিলেন। শ্রোতামণ্ডলী শুনতে শুনতেমিলাদুন্নবীর আনন্দ উপভোগ করছিলেন এবং আল্লাহর প্রশংসা ও নবীজীর দরূদ পড়ছিলেন। এমন সময় নবী করিম (দঃ) সেখানে উপস্থিত হয়ে এরশাদ করলেন- “তোমাদের সকলের প্রতি আমার সুপারিশ ও শাফাআত অবধারিত হয়ে গেল।
— আদ দুররুল মুনাযযাম
৩) হযরত হাসসান (রাঃ)-এর কিয়ামসহ মিলাদঃ
সাহাবী কবি হযরত হাসসান বিন সাবিত (রাঃ) দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নবী করিম (দঃ)-এর উপস্থিতিতে তাঁর গৌরবগাঁথা পেশ করতেন এবং অন্যান্য সাহাবী সমবেত হয়ে তা শ্রবণ করতেন।
কিয়াম করে মিলাদ মাহফিলে নবী করিম (দঃ)-এর প্রশংসামূলক কবিতা ও না’ত পাঠ করা এবং সালাম পেশ করার এটাই বড় দলীল। এরূপ করা সুন্নাত এবং উত্তম বলে মক্কা-মদিনার ৯০ জন ওলামা ১২৮৬ হিজরীতে নিম্নোক্ত ফতোয়া দিয়েবিভিন্ন রাষ্ট্রে প্রেরণ করেছেন।
হে মুসলমান ! আপনারা জেনে রাখুন যে, মিলাদুন্নবী (দঃ)-এর আলোচনা ও তাঁর শান মান বর্ণনা করা এবং ঐ মাহফিলে উপস্থিত হওয়া সবই সুন্নাত। বর্ণিত আছে যে, হযরত হাসসান বিন সাবিত (রাঃ) কিয়াম অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (দঃ)-এরপক্ষে হুযুরের উপস্থিতিতে হুযুর (দঃ)-এর গৌরবগাঁথা পেশ করতেন, আর সাহাবীগণ তা শোনার জন্য একত্রিত হতেন।
— ফতোয়ায়ে হারামাঈন
একজনের কিয়ামই সকলের জন্য দলীল স্বরূপ।
হযরত হাসসান বিন সাবিত (রাঃ)-এর কিয়ামের কাছিদার অংশ বিশেষ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ কাছিদায় তিনি রাসূল করীম (দঃ)-এর আজন্ম নির্দোষ ও নিষ্পাপ হওয়া এবং হুযুরের ইচ্ছানুযায়ী তাঁর আকৃতি বা সুরতে মোহাম্মাদী সৃষ্টির তত্ত্ব পেশ করেছেন। নবী করিম (দঃ) তাঁর এই কাছিদা শুনে দোয়া করতেন-
হে আল্লাহ! তুমি জিব্রাইলের মাধ্যমে হাসসানকে সাহায্য কর।
অর্থাৎ আমার পক্ষে আমার প্রশংসা বাক্য সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার তৌফিক দাও। এতে আমার দুশমনগণ ভালোভাবে জব্দ হবে।
৪) সুদূর অতীতে মিলাদুন্নবীর চিত্রঃ মাওয়াহিবের বর্ণনা
সুদূর অতীতকালে কীভাবে মুসলমানগণ ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করতেন- তাঁর একটি বিস্তারিত বর্ণনা আল্লামা শাহাবুদ্দীন কাসতুলানী (রহঃ) মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবে বিধৃত করেছেন। মিলাদুন্নবী (দঃ) সমর্থক বিজ্ঞ মোহাক্বেক ওলামায়ে কেরাম এবং ফকিহগণ নিজ নিজ গ্রন্থে দলীল স্বরূপ আল্লামা কাসতুলানীর (রহঃ) এই দুর্লভ প্রমাণাদি লিপিবদ্ধ করেছেন। ঈদে মিলাদুন্নবী (দঃ) পালনকারী এবং সমর্থক ওলামা ও নবীপ্রেমিক মুসলমানদের অবগতির জন্য উক্ত মন্তব্য কোটেশন আকারে অনুবাদসহ নিম্নে পেশ করা হলো।
সমগ্র মুসলিম উম্মাহ সুদূর অতীতকাল থেকে নবী করিম (দঃ)-এর পবিত্র বেলাদত উপলক্ষে মাসব্যাপী সর্বদা মিলাদ-মাহফিল উদযাপনব করতেন। যিয়াফত প্রস্তুত করে তারা লোকদের খাওয়াতেন। মাসব্যাপী দিনগুলোতে বিভিন্ন রকমের সদকা খয়রাত করতেন এবং শরীয়তসম্মত আনন্দ উৎসব করতেন। উত্তম কাজ প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি করতেন। তাঁরা পূর্ণমাস শান-শওকতের সাথে বিশেষ আয়োজনের মাধ্যমে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠান করতেন- যার বরকতে বরাবরই তাদের উপর আল্লাহর অপার অনুগ্রহ প্রকাশ পেতো। মিলাদ মাহফিলের বৈশিষ্ট্য সমূহের মধ্যে এটা একটি পরীক্ষিত বিষয় যে, মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের বরকতে ঐ বছর আল্লাহর পক্ষ হতে নিরাপত্তা কায়েম থাকে এবং তড়িৎগতিতে উহা মনোবাঞ্ছা পূরণের শুভ সংবাদ বাহন করে নিয়ে আসে। অতএব- যিনি বা যারা মিলাদুন্নবী মাসের প্রতিটি রাত্রকে ঈদের রাত্রে পরিণত করে রাখবে- তাঁদের উপর আল্লাহর খাস রহমত বর্ষিত হবে
— মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া, মা ছাবাতা বিচ্ছুন্নাহ্
উত্তরঃ
হ্যাঁ, রোযা রাখতে পারে, বহু লোক ওই দিন রোযা রেখে সুন্নাতে মুস্তাফা পালন করে । ঐ দিনের রোযা রাখা সুন্নাত ।
হযরত আবু কাতাদাহ বর্ননা করেন যে,হুযুর কে জিজ্ঞাসা করা হল ইয়া রাসুলাল্লাহ আপনি সোমবারের দিন কেন রোযা রাখেন, হুযুর ইরশাদ করলেন ওই দিন আমার জন্ম হয় এবং ওই দিনই আমার উপর ওহী নাযীল হয়।
— মুসলিম ২য় খন্ড ৮১৯ পৃঃ, হাদিস নং১১৬২, ইমাম বায়হাকী আস সুনানুল কুবরা ৪র্থ খন্ড ২৮৬ পৃঃ, হাদিস নং ৮১৮২
মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে উত্থাপিত প্রশ্ন সমূহ ও তাদের উত্তর (লেখকঃ মুফতী নুরুল আরেফিন রেযবী আযহারী এম.এ(ডবল),রিসার্চ(আযহার ইউনিভারসিটি,মিসর), ডিপ্লোমা ইন ইংলিশ(আমেরিকা ইউনিভারসিটি ,কায়রো))
ঈদে মিলাদুন্নবীর দিন বহু লোক ভাল ভাল খাবার প্রস্তুত করে নিয়াজ ফাতেহা দেয়; এটা কি জায়েজ ?
উত্তরঃ
হ্যাঁ,অবশ্যই জায়েয। যে যত বেশি করে এই দিনে ফাতেহা, নিয়াজ, দান-খয়রাত প্রভৃতি করবে সে তত বেশি সাওয়াবের অধিকারি হবে ।
মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে উত্থাপিত প্রশ্ন সমূহ ও তাদের উত্তর (লেখকঃ মুফতী নুরুল আরেফিন রেযবী আযহারী এম.এ(ডবল),রিসার্চ(আযহার ইউনিভারসিটি,মিসর), ডিপ্লোমা ইন ইংলিশ(আমেরিকা ইউনিভারসিটি ,কায়রো))